দ্য অ্যামিটিভিল হরর – পরিশিষ্ট / শেষ কথা

পরিশিষ্ট

২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬

নিউইয়র্কের চ্যানেল ফাইভের মারভিন স্কট, লং আইল্যান্ডের ‘তথাকথিত’ ভূতুড়ে বাড়িটা সম্পর্কে বিস্তারিত তদন্তের দায়িত্ব নিলেন। বেশ কিছু পরামনোবিদ, মিডিয়াম, প্রেততত্ত্ববিদকে তিনি আহবান জানালেন; এক রাত ওনার সাথে ওই বাড়িটাতে থাকার জন্য। 

অবশ্য কয়েকদিন আগেই লুৎজ দম্পতির সাথে যোগাযোগ তাদের পরিত্যক্ত বাড়িতে থাকা, ছবি তোলা এবং প্রয়োজনে ভিডিয়ো করার অনুমতি নিয়েছিলেন তিনি। অ্যামিটিভিলেরই একটা ছোট্ট পিৎজার দোকানে জর্জের সাথে দেখা করেছিলেন স্কট, জর্জ অনুমতি তো দিয়েছিল কিন্তু এটাও বলে দিয়েছিল যে সে বা তার পরিবারের কেউ কখনও আর ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে যাবে না। 

তবে হ্যাঁ, স্কট আর তার দল কী কী খুঁজে পেয়েছে তা জানতে আগ্রহ ছিল ওর। জর্জ বলেছিল, “আপনার তদন্ত শেষে এই রেস্তোরাঁতেই ডাকবেন আমাদের, আমি আর ক্যাথি আসব। এখনও কিছু ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে আমাদের… হয়তো লং আইল্যান্ড ছেড়েই চলে যেতে হবে।” 

নির্দিষ্ট দিনে অ্যামিটিভিলে রাত কাটাতে গেলেন স্কট আর তার দল। বাড়ির ভয়ংকর অতিপ্রাকৃত শক্তিটাকে রাগিয়ে তোলার জন্য ডাইনিং টেবিলের ওপর বেশ বড়ো একটা ক্রুসিফিক্স আর কতগুলো মন্ত্রপূত মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হলো। মারভিনের দলে ছিলেন—লোরেন ওয়ারেন (প্রেতাত্মা দেখতে পেতেন তিনি), তার স্বামী এড (একজন স্বনামধন্য প্রেততত্ত্ববিদ), মেরি প্যাসকারেলা (মনোবিদ), মিসেস আলবার্ট রাইলি (পরামনোবিদ) এবং নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে আসা জর্জ কেকোরিস আর তার সহকারী জেরি… এছাড়া চ্যানেলের কিছু কর্মী আর রেডিয়ো স্টেশন থেকে আসা কিছু লোক। 

রাত সাড়ে দশটা দিকে প্রথম ‘প্রেত আহবান চক্র’র আয়োজন করা হলো। বাকি সবার সাথে মারভিন স্কটও বসলেন চক্রে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই হুট করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন মেরি প্যাসকারেলা। উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন তিনি, যাওয়ার আগে ফিসফিসে কণ্ঠে বলেছিলেন, “এই বাড়ির ওপর একটা ভয়ংকর কালো ছায়ার প্রভাব রয়েছে… ওটার আকৃতি অনেকটা মানুষের মাথার মতো! ওটা পুরো বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়… আমার খুব ভয় লাগছে!” আটকে যাচ্ছিল ওনার কথাগুলো। 

একটু পর কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেলেন মিসেস রাইলি, কেমন যেন অদ্ভুত কণ্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, “দোতালার বসার ঘরে কিছু একটা আছে… ভয়ংকর কিছু! ওটাকে দেখলে যে-কোনো সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে যাবে… আমার বুকে ব্যথা করছে! ধকধক করছে… সবচেয়ে ভয়ংকর এই বাড়ির দোতালা!” 

“এই চক্র তাড়াতাড়ি শেষ করে দেওয়া উচিত,” উঠে দাঁড়ালেন এড ওয়ারেন। আরও ত্রিশ সেকেন্ডের মতো অদ্ভুত সব কথা বললেন মিসেস রাইলি, তারপরেই ঘোর কেটে গেল তার! 

জর্জ কেকোরিসের একটু পর বমি পেল, সে-ও পাশের ঘরে চলে গেল। রেডিয়ো কর্মী মাইক লিন্ডার হুট করেই আর্তনাদ করে উঠল, “আমার শরীরের বাম পাশটা অবশ হয়ে যাচ্ছে… খুব ঠান্ডা লাগছে!” 

অবশেষে মুখ খুললেন লোরেন ওয়ারেন, “এই বাড়িতে কোনো ভয়াবহ শক্তির প্রভাব রয়েছে, এটা ভয়ংকর শক্তিশালী। কোনো মৃত মানুষের আত্মা এত শক্তিশালী হয় না। পাতাল লোক থেকে উঠে আসা কোনো পিশাচ হতে পারে…” 

শেষ হয়ে গেল চক্র, এবার ছবি তোলার পালা। 

চ্যানেল ফাইভের ক্যামেরাম্যান স্টিভ পেট্রোপলিস বেশ সাহসী লোক। বীভৎস এমন অনেক লাশের ছবি সে তুলেছে যা অন্য কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না… এমন লোকেরও সেলাইঘরের ছবি তুলতে গিয়ে অজানা কারণে বুকটা কেঁপে উঠল, খুব ভয় লাগছিল! কিছুক্ষণ পর লোরেন ওয়ারেন আর মারভিন স্কটও ঢুকলেন ওই ঘরে… দু’জনেরই মনে হয়েছিল কেউ তাদের দেখছে! তাছাড়া ঘরটা একটু বেশিই ঠান্ডা। লোরেন তো এটাও বলে ফেললেন, “বাড়ির সব খারাপ শক্তির কেন্দ্র এই ঘরটা!” 

পরবর্তীতে লোরেন ওয়ারেন আমাদের জানিয়েছেন, “এক তলার বসার ঘরটাতেও সমস্যা আছে। ওখানকার প্রতিটি আসবাবপত্রের মধ্যে অশুভ ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম! সম্ভবত অশুভ শক্তিটা দিনের বেলা এখানেই থাকে। বিশ্রাম নেয় মনে হয়? ফায়ারপ্লেসটাতে বেশ ভালো সমস্যা আছে। এছাড়া সিঁড়িতেও বাজে প্রভাব রয়েছে…” 

দলের কয়েকজন দোতালার ঘরগুলোতে শুয়ে পড়ল। চ্যানেলের একজন ফটোগ্রাফার (নাম জানা যায়নি) ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু ছবি তুলল। যদি কোনোভাবে ভূতের ছবি ওঠে? জেরি সলফভিন ব্যাটারিচালিত লণ্ঠন নিয়ে পুরো বাড়িটা একবার বেশ ভালো করে চক্কর দিলো, কিন্তু তেমন কিছুই দেখতে পেল না। 

সাড়ে তিনটার দিকে আরেকবার প্রেতচক্রের আয়োজন করলেন ওয়ারেনরা। কিন্তু এবার তেমন কিছুই হলো না। সকলেই স্বাভাবিকই রইল। 

সবাই একমত হলো যে হুট করেই অশুভ শক্তিটার প্রভাব কমে গেছে।

অবশেষে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস ওয়ারেন, তারপর থমথমে কণ্ঠে বললেন, “কোনো সন্দেহ নেই যে এই বাড়িতে একটি নয়, একাধিক অপশক্তি রয়েছে। হয়তো এখন কোনো কারণে ওরা আমাদের জ্বালাচ্ছে না… কিন্তু এই বাড়িটা ওদের আস্তানা। একজন অভিজ্ঞ যাজক ডেকে খুব ভালো করে বাড়িটাকে শুদ্ধ করানো দরকার।” 

পরেরদিন লুজদের ফোন করে আবার সেই পিৎজার দোকানে ডাকলেন মারভিন স্কট। তবে সেখানে যেতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল তার। গিয়ে তিনি শুনলেন যে লুৎজরা একটু আগেই চলে গেছে। মার্চের শুরুতেই ক্যালিফোর্নিয়াতে পাড়ি জমাল লুৎজ পরিবার। ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতেই পড়ে রইল ওদের সব জিনিসপত্র… এত টাকা খরচ করে কেনা বাড়িটা এভাবেই খালি হয়ে গেল! শুধু কী তাই? বাড়িটার সমস্ত দলিলপত্র ব্যাংকে জমা করে দিলো ওরা। অথচ এই বাড়িটা নিয়েই কত স্বপ্ন দেখেছিল জর্জ আর ক্যাথি। 

ব্যাংক থেকে বাড়িটার জানালাগুলো বাইরে থেকে পেরেক মেরে বন্ধ করে দেওয়া হলো, ‘প্রবেশ নিষেধ’ সাইনবোর্ডও লাগিয়ে দেওয়া হলো। ততদিনে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বাড়িটার কথা। অতি উৎসাহী কেউ যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা। 

ওদিকে ক্যালিফোর্নিয়াতে গিয়ে আবার নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ফাদার ম্যানকুসো। অবশেষে ১৯৭৬ সালের গুড ফ্রাইডের (১৬ এপ্রিল) দিন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। লং আইল্যান্ডে ফেরার পর বিশপ তাকে অন্য এক রেক্টরিতে পাঠিয়ে দিলেন, জায়গাটা ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটা থেকে অনেক দূরে! 

আজকাল জোড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলেই মন খারাপ হয়ে যায় মিসির। ড্যানি আর ক্রিসের কিন্তু বেশ ভালো করেই ওই ‘দানব’-টার কথা মনে আছে, একদম নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারে ওরা। ক্যাথি ব্যাপারটা নিয়ে কোনো কথাই বলতে চায় না, সম্ভবত বাড়িটাকে ভুলে যেতে চায় সে। 

এখন ওরা ক্যালিফোর্নিয়াতেই আছে। ওখানে যাওয়ার পর আর কোনো ভৌতিক ঝামেলা হয়নি। লং আইল্যান্ড ছাড়ার আগে জর্জ, উইলিয়াম এইচ. প্যারি কোম্পানিটা বিক্রি করে দেয়। এখনও সে বিশ্বাস যে করে প্রতিটি মানুষের উচিত অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকার। আমাদের সে জানিয়েছে, “অবিশ্বাস খুব খারাপ জিনিস! এর ফলে যে কতটা ভয়ংকর বিপদে মানুষ পড়তে পারে তার উদাহরণ আমার পরিবার। ওই বাড়িতে ভয়ংকর কিছু আছে… সত্যিই আছে! এই অপশক্তিগুলো সবসময় সুযোগে থাকে মানুষের ক্ষতি করার। মরে গেলেও আমরা আর কখনও ওখানে ফিরব না।” 

সমাপ্ত

শেষ কথা  

লেখকের নিজস্ব বক্তব্য 

বইটা লেখার আগে আমি বেশ খোঁজ-খবর নিয়েছি এবং এটুকু বলতে পারি যে এখানে যা লিখেছি সবই সত্য। শুধুমাত্র আমার অনুরোধে জর্জ আর ক্যাথি নিজেদের আটাশ দিনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিল, সেগুলো টেপে রেকর্ড করা হয়। অনেক সময়ে দু’জনকে আলাদা করেও ঘটনা শুনেছি আমি, যাতে করে কোনো পার্থক্য থাকলে তা তুলে ধরতে পারি। তবে তেমন কিছু পাইনি। শুধু জর্জ আর ক্যাথির ভরসাতেই বসে থাকিনি। ফাদার ম্যানকুসো আর স্থানীয় পুলিশ কর্মচারীদের সাথেও দেখা করেছি। তারাও জানিয়েছেন যে জর্জ আর ক্যাথি ঠিকই বলেছে। 

তবে এতটা যাচাই না করলেও পারতাম। পাঁচ জন মানুষের একটা ছিমছাম পরিবার, এত বড়ো আর লোভনীয় একটা বাড়ি ছেড়ে পালাল! এটাই কি সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ নয় যে বাড়িটা ভূতুড়ে? চিন্তা করে দেখুন… তিন তলার বাড়ি, সুইমিং পুল, নৌকা রাখার ছাউনি… কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কি শুধু শুধু এই বাড়ি ছেড়ে পালাবে? ওরা কিন্তু নিজেদের আসবাবপত্রগুলোও নেয়নি। 

ও হ্যাঁ, ভালো কথা। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিক পর্যন্ত কিন্তু নিজেদের এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা বই আকারে প্রকাশের কোনো ইচ্ছাই ছিল না লুৎজদের। কিন্তু টিভি চ্যানেল আর খবরের কাগজগুলো যখন ব্যাপারটা নিয়ে মাতামাতি শুরু করল, তখন ওরা বই প্রকাশে মত দেয়। এখানে বলে রাখি, টিভি আর খবরের কাগজের বেশিরভাগ রিপোর্টেই তথ্যগুলো বিকৃত করা হয়েছে। 

ওদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বইটার প্রথম খসড়া বানিয়ে আমি লুৎজ দম্পতিকে পাঠিয়েছিলাম। ওটা পড়েই ওরা প্রথম জানতে পারে যে ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ফাদার ম্যানকুসোকে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। 

ওশান অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটাতে ওঠার আগে প্রেততত্ত্বের ব্যাপারে তেমন কিছু জানত না জর্জ আর ক্যাথি। ওরা তো শুরুর দিকে এটাও ভেবেছিল যে হয়তো ধ্যান করার কারণে অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলোর সাথে যোগাযোগ ঘটেছে। 

পরবর্তীতে ওদের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার পরিচিত কিছু প্রেত বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করেছিলাম। ওনারা বেশ কিছু ব্যাপার পরিষ্কার করেছিলেন আমার কাছে। যেমন: 

জর্জ এবং আরও অনেকেই বলেছে বাড়িটাতে ওদের ঠান্ডা লাগত। হুট করে তাপমাত্রা কমে যাওয়াটা প্রেতশক্তির উপস্থিতির প্রমাণ। বিশেষ কিছু কারণে পরিবেশকে ঠান্ডা করে দেয় ওরা (একটি কারণ হলো—সাধারণত অশরীরী প্রেতরা আশেপাশের পরিবেশ থেকে তাপ শুষে নিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ায়। এই শক্তির মাধ্যমে ওরা মানুষকে ভয় দেখাতে পারে, জিনিসপত্র নড়াতে পারে। ) 

প্রেতশক্তির উপস্থিতিতে পশু-পাখিরা অস্বস্তি বোধ করে। হ্যারির আচরণ এ কারণেই বদলে গেছিল। এতটাই বদলে গেছিল যে অচেনা কিছু মানুষ বাড়িতে ঢুকলেও সে কিছুই বলেনি (যেমন—ক্যাথির খালা, ড্যানি আর ক্রিসের সাথে খেলতে আসা ছেলেটা আর বিয়ার নিয়ে আসা সেই রহস্যময় লোকটা।)। মূলত প্রেতশক্তিরা পশুদের শরীর থেকে শক্তি শুষে নিয়ে এদের উদাসীন বানিয়ে দেয়। 

ড্যানির হাতের ওপর জানালার পাল্লাটা পড়ে যাওয়ার মতো একটা ঘটনা ইংল্যান্ডে একবার ঘটেছিল। একজন মহিলার হাতের ওপর বন্ধ হয়ে গেছিল গাড়ির দরজা, ভৌতিক বিষয়ে তদন্ত করতে বেরিয়েছিলেন তিনি। তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে ওনাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, কিন্তু কয়েক মিনিট পর এমনিতেই ঠিক হয়ে গেছিল হাতটা। 

বেসমেন্টের ওই ঘরটার দরজায় রনি ডিফেওর মুখ ভেসে ওঠা, রাত সোয়া তিনটার দিকে জর্জের প্রতিদিন জেগে ওঠা (যে সময় খুনগুলো করেছিল রনি), ক্যাথির স্বপ্নে লুইস ডিফেওর অবৈধ প্রেমের দৃশ্য… এগুলো সবই একটা বিশেষ প্রক্রিয়ার অংশ। কোনো জায়গায় কোনো অশুভ ঘটনা ঘটলে পরবর্তীতে মাঝে মাঝেই সেই ঘটনার দৃশ্যগুলো অলৌকিকভাবে আবার ভেসে ওঠে। এছাড়া দরজা- জানালা ভেঙে যাওয়া, সিরামিকের সিংহের স্থান পরিবর্তন, বেসমেন্ট আর রেক্টরির মলের গন্ধ… এগুলো সবই বিশেষ এক প্রকার নিচু জাতের প্রেতদের কাজ। এদেরকে ‘পোল্টারজিস্ট’ বা ‘আওয়াজ করা প্রেত’ বলে। জিনিসপত্র সরিয়ে, গন্ধ আর আওয়াজ সৃষ্টি করে এরা মানুষকে ভয় দেখায়। জর্জ মাঝে মাঝে যে বাজনা শুনতে পেত, সেটাও এদের কারসাজি। এমন অনেক নজিরই আছে পৃথিবীতে (এক ভদ্রলোকের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় তিনি মাঝে মাঝেই শুনতে পেতেন যে বাড়ির একতলায় অসংখ্য লোক পিয়ানো বাজাচ্ছে, কিন্তু নিচে নেমে কাউকেই দেখতে পেতেন না)। 

বাড়িতে খুব ছোটো কোনো বাচ্চা থাকলে তার ওপর পিশাচদের প্রভাব বেশি হয়। এক বা দুই বছরের বাচ্চাদের ওপর সবচেয়ে বেশি চোখ থাকে ওদের। কিন্তু লুজদের কোনো বাচ্চাই এত ছোটো ছিল না। আর একটা কথা, বইয়ের শুরুতে ফাদার নিকোলা যা বলেছেন-“শয়তান কিন্তু মাঝে মাঝেই তার চিহ্ন রেখে যায়।” ক্যাথির আলমারিতে ঝুলানো উলটা ক্রুশ, হুট করেই তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, মাছিগুলো… এগুলো সবই কি তবে শয়তানের উপস্থিতির প্রমাণ? 

.

আমি জানি লুজদের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলবে, কেউ কেউ তো হেসে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু এসবে আসলে কিছুই যায় আসে না। 

তো এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওদের বাড়িতে কতগুলো অপশক্তি ছিল? 

এই নিয়েও বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা হয়েছে আমার। 

লুজদের বাড়িতে মোটামুটি তিন ধরনের অপশক্তির অস্তিত্ব রয়েছে… সাধারণ হিসেবে এমনটাই বলা যায়। মনে আছে, ফ্রান্সিন দুটো প্রেতের অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছিল? যারা না-কি এক সময় মানুষ ছিল, কিন্তু কোনো একটা কারণে ওই বাড়িতে আটকা পড়ে গেছে। মাঝে মাঝে মানুষের আত্মা নিজেদের মৃত্যু মেনে নিতে পারে না, তাই ওরা বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা ঘরে। হয়তো ওই দুটো আত্মা এই বাড়ি কোনো আগের মালিক আর মালকিনের? ক্যাথি মাঝে মাঝেই পারফিউমের গন্ধ পেত, ওকে জড়িয়েও ধরা হয়েছিল… এই কাজ কি বাড়ির আগের সেই মালকিন করেছিল? (যাকে ফ্রান্সিন বলেছিল ‘বুড়ি’)। ক্যাথির বেশ পছন্দের জায়গা ছিল রান্নাঘরটা… হয়তো বুড়িও বেশ পছন্দ করত জায়গাটাকে, সেজন্যই ক্যাথিকে একটু আদর করেছিল সে? 

মিসি আর আর ক্যাথির ভাইয়ের বউ ক্যারি যে বাচ্চাটার কথা বলেছিল সে-ও এক সময়ে জীবন্ত মানুষ ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে খুব অল্প বয়সে মারা যাওয়ার কারণে ছেলেটা বুঝতেই পারেনি যে ‘মৃত্যু’ আসলে কী, সে জানেই না যে ও আর জীবিত নয়। পুরো বাড়িতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায় ও। ছোট্ট মিসিকে দেখে হয়তো পছন্দ হয়েছিল ওর, তাই মিসির ঘরে আশেপাশে একটু বেশিই যেত। হুট করেই ওই বিছানাতে ক্যারি আর জিমিকে ঘুমাতে দেখে, ক্যারিকে মিসির কথা জিজ্ঞাসা করেছিল সে। তবে চিরকালের জন্য মিসিকে নিজের খেলার সাথী বানানোর বুদ্ধিটা ওর মাথা থেকে আসেনি, সম্ভবত এটা জোডির বুদ্ধি। 

আচ্ছা, জোডি তাহলে কী? জোডি আর ফায়ারপ্লেস থেকে উঠে আসা সেই দানবটার হিসাব একেবারেই আলাদা। প্রথমদিকে আমি ভেবেছিলাম যে জোডি ওই বাড়িতে মৃত কোনো শুয়োরের আত্মা, কিন্তু তাহলে ও মিসির সাথে কথা বলত কী করে? জীবজন্তুর আত্মার তো এমন ক্ষমতা থাকে না! আর তাছাড়া জর্জ ওর দুটো জ্বলন্ত চোখ দেখেছিল, সাধারণত কোনো মৃত পশুর আত্মা এভাবে মানুষকে ভয় দেখায় না! অভিজ্ঞ প্রেত বিশেষজ্ঞদের মতে, পতিত আর অভিশপ্ত দেবদূতেরা চাইলেই পশুদের রূপ ধারণ করতে পারে, মাঝে মাঝে বিকৃত চেহারার মানুষের রূপে দেখা দেয় ওরা। সম্ভবত যে পতিত দেবদূত জোডির রূপ ধরে মিসির সাথে ঘুরত, সেই-ই ভয়ংকর দানবটার রূপ ধরে জর্জদের ভয় দেখিয়েছিল। কিছু যাজকের মতে এই পতিত দেবদূতেরাই- ডিমন। 

অনেকেই মনে করতে পারে যে বেসমেন্টের ওই লাল ঘরটাতে অদ্ভুত রকমের প্রেতচর্চা চলত কোনো এককালে আর এসবের কারণেই বাড়িতে এতগুলো অশুভ জিনিস এসেছে। চিন্তাটা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না। তবে জর্জরা আসার আগে কোনো ভৌতিক ঘটনার কথাও কিন্তু শোনা যায়নি। 

এরপর আসে জর্জ আর ক্যাথির মাঝে মাঝে হাওয়ায় উড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা… এছাড়া জর্জ একবার ক্যাথিকে ভয়ংকর এক বুড়ি মহিলার রূপে দেখেছিল! আসলে মাঝে মাঝে কিছু অতৃপ্ত প্রেত মানুষের শরীরে ঢুকতে চায়, আরও ভালো করে বললে ওই শরীরটাকে দখল করতে চায়। যাতে করে তারাও সকল প্রকার জাগতিক আনন্দ আহরণ করতে পারে। মাঝে মাঝে এসব নিয়ে বেজায় বিপদে পড়ে যায় মানুষ, কিন্তু জর্জ আর ক্যাথির শরীরে যারা ঢুকেছিল তারা সম্ভবত অতটা ক্ষমতাবান ছিল না। তাই বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। 

ফাদার ম্যানকুসোকে ধমকেছিল কে? কে উনাকে ফোন দিয়েছিল? বিশেষজ্ঞদের মতে এটাই ওই বাড়ির সবচেয়ে ভয়ংকর খল শক্তি। বেশিরভাগের মতেই জোড়ির রূপ ধরে থাকা পিশাচটাই এসব ঘটিয়েছিল। এটা এতটাই ক্ষমতাবান যে ফাদারের গাড়ির ওপর পর্যন্ত হামলা করেছিল… এ থেকেই বোঝা যায় ওর ক্ষমতা শুধুমাত্র ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতেই সীমাবদ্ধ নয়। শুধু কি তাই? ইস্ট ব্যাবিলনে ক্যাথির মায়ের বাড়িতেও তো হানা দিয়েছিল সেই শক্তি… যা আমরা জর্জ আর ক্যাথির জবানবন্দির একদম শেষে দেখতে পাই। ওটার উৎপাতেই লং আইল্যান্ড ছেড়ে চলে যায় লুজরা। 

ক্যালিফোর্নিয়া যাওয়ার পর ওদের সাথে আর অদ্ভুত কিছু ঘটেনি। 

কেন ঘটেনি? 

বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রেত শক্তিরা কখনও প্রবাহমান পানি পেরিয়ে গিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এজন্যই হয়তো ওদের আর কিছু হয়নি? কে জানে? অদ্ভুত ব্যাপার হলো এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করার সময় আমার শরীরটাও হুট করে খারাপ হয়ে যেত মাঝে মাঝে, বমি পেত, মাথা ঘুরত। লং আইল্যান্ডের অফিসে বসেই কাজ করতাম আমি। তো ভাবলাম একবার নদী পেরিয়েই দেখি? কী হয়? ইস্ট রিভার পেরিয়ে ম্যানহ্যাটনে চলে গেলাম। তারপর আর কোনো সমস্যা হয়নি। 

যা-ই হোক, আবারও বলছি… লুজদের বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমি পাইনি। ভবিষ্যতে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমার ধারণা, কিছু কিছু জিনিস চিরকাল বিজ্ঞানের আওতার বাইরেই থাকবে। ওই বাড়িতে যে অপার্থিব কিছু একটা আছে, তা বিজ্ঞান কখনোই মানবে না… তবে এটাও সত্য যে লুজদের বাড়ির ঘটনাগুলো গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করা যায় না। কেউ বলতে পারে ওদের হ্যালুসিনেশন হয়েছিল… আমার মনে হয় না। আশা করছি ভবিষ্যতে বাড়িটা নিয়ে আরও অনেক বেশি গবেষণা হবে, যদি ঘটনাগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তবে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না। 

লুৎজ পরিবার ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আর কোনো অদ্ভুত ঘটনার কথা আমার কানে আসেনি। বিশেষজ্ঞদের মতে এসব ব্যাপার হুট করে শুরু হয় আবার হুট করেই বন্ধ হয়ে যায়! মাঝে মাঝে বাড়ি সংস্কার করলে, আসবাবপত্র বদলালে কিংবা মালিকানা পরিবর্তন হলেও উৎপাত থেমে যায়। 

ফিরে আসি জর্জ আর ক্যাথির ব্যাপারে। বাড়িটা সম্পর্কে ওদের আর কোনো আগ্রহই নেই। কখনও ফিরেও যাবে না। কিন্তু অনেক মানুষেরই কৌতূহল মেটেনি, ভবিষ্যতে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও তা মিটবে না, তা সে যত গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাই হোক না কেন। 

আমেরিকার ইতিহাসে অ্যামিটিভিলের এই বাড়িটি চিরকালই এক রহস্যময় অধ্যায় হয়ে থাকবে। আসলেই কি ওখানে কোনো ভূত ছিল? না কি পুরোটাই কল্পনা? এই বিতর্কের অবসান কখনো ঘটবে না। 

জে অ্যানসন 

অনুবাদকের কথা 

অন্য সব বইয়ের ক্ষেত্রে অনুবাদক হিসেবে আমার কিছু কথা বইয়ের শুরুতে রাখলেও এখানে পরে রাখা হয়েছে। কেন? সেটা এসব পড়লেই বুঝতে পারবেন। একটা কথা বলে রাখি, যাদের কাছে বইটি খুব বেশি ভালো লেগেছে, তাদের এই অংশটুকু না পড়াই ভালো। 

আমি এমন অনেক কিছুই লিখব যেগুলোর সাথে বইয়ে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর কোনো মিল পাবেন না। 

বিশেষ ধন্যবাদ আমেরিকা প্রবাসী, মাহিন মাহজাবিন টার্ভার (মুমু) আপুকে। বাড়িটা নিয়ে বর্তমান আমেরিকানদের চিন্তাধারা এবং আরও অনেক তথ্যই তিনি আমাকে দিয়েছেন। 

তো শুরু করা যাক? প্রথমেই আসি সেই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে। 

সেই ভয়ংকর খুনি, মানে রোনাল্ড ‘রনি’ ডিফেও এলাকাতে আলাদা একটি ডাকনামে পরিচিত ছিল। সেটা হলো ‘বুচ’। অতিরিক্ত মদ খাওয়া, নেশা করা এবং আরও নানান কারণেই এলাকার লোকেরা ওকে খুব একটা পছন্দ করত না। 

বুচ ডিফেওর জবানিতে ঘটনাটা এমন: 

১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর ভোর চারটার দিকে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওর বাবার গাড়ির শো রুমে চলে যায়। মালিকের ছেলে হওয়ার জন্য ওকে তেমন একটা কাজ করতে হতো না। রোনাল্ড ডিফেও সিনিয়র একটু বেলা করেই অফিসে আসতেন। কিন্তু সেদিন সকাল দশটা বেজে যাওয়ার পরেও তিনি আসলেন না। একটু অবাকই হলো বুচ। ওর বাবা সাধারণত অফিস কামাই দেন না। বাড়িতে ফোন করল সে, কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। 

অবশেষে দুপুর তিনটার দিকে অফিস শেষ করে নিজের প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যায় বুচ। ওরা দু’জনে মিলে একটা পার্টিতে যায়, তারপর বারে যায়। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বাড়িতে ফোন দিয়েছিল বুচ, কিন্তু ওর ফোন কেউ ধরেনি! অবশেষে বাড়িতে চলে আসে সে। দেখে যে ওদের গাড়িগুলো ঠিকই বাড়ির সামনে পার্ক করা আছে। 

দরজা খুলে বুচ ওর পরিবারের সবার মৃতদেহ খুঁজে পায়! নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ওদের, সবাই উপুড় হয়ে শোয়া। 

এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টার দিকে সে স্থানীয় হেনরি’স বারে গিয়ে বারম্যানকে জানায়, “তোমরা সবাই চলো আমার সাথে! আমার মা-বাবাকে কারা যেন গুলি করেছে!” হ্যাঁ, এটাই পানশালাটার মূল নাম। উইচেস ব্রু বলে অ্যামিটিভিলে কোনো পানশালা তখন ছিল না। 

একদল লোক ওর সাথে ওশান অ্যাভিনিউতে গিয়ে লাশগুলো দেখে, ওদের মধ্যেই একজন পুলিশকে ফোন করে। 

এমন ভয়ংকর ঘটনা অ্যামিটিভিলের ইতিহাসে কখনোই ঘটেনি! শান্ত একটা এলাকা। তাই বাকি সবার মতোই পুলিশও হতবাক। তারা সবগুলো লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেয়। এরপর বুচ ডিফেওকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে ও কাউকে সন্দেহ করে না-কি। বুচ জানায় ওর বাবার চাচা ‘পিটার ডিফেও’ একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী আর ওই লোকের ডানহাত ‘লুই ফ্যালিনি’ বেশ কিছুদিন ওদের বাড়িতে ভাড়া ছিল। এই সময়ে বুচের বাবার সাথে ফ্যালিনির অনেকবারই ঝামেলা হয়েছিল। 

হ্যাঁ, এটাই সত্য। বাড়িতে লুই ফ্যালিনিই ভাড়া ছিল। কোনো চিত্রশিল্পী নয়। বইয়ের উল্লেখিত লুইস ডিফেওর পরকীয়া প্রেমেরও কোনো প্রমাণ নেই। 

তো যা-ই হোক, বুচের নিরাপত্তার জন্য ওকে নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নেয় পুলিশ। এরপর লুই ফ্যালিনিকে জেরা করা হয়। কিন্তু ওই দিন রাত দুটো থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত ফ্যালিনি একটা পানশালায় ছিল এবং ওখানে ওকে প্রচুর মানুষ দেখেছে! তাহলে সে কী করে খুন করবে? 

পুলিশ আবার ভালো করে বাড়িটা ঘুরে দেখতে শুরু করল, এবার বোঝা গেল যে খুনি সব ঘরেই গেছে… শুধু একটা ঘর ছাড়া! আর সেটা হলো বুচের ঘর। ওই ঘরের বিছানার তলা থেকেই পুলিশ নিজেদের প্রথম সূত্র পায়। 

দুটো মার্লিন রাইফেলের বাক্স! একটা .২২ ক্যালিবারের আরেকটা .৩৫ ক্যালিবারের। এর মধ্যেই ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসে যায়। সবাইকে .৩৫ ক্যালিবারের একটি মার্লিন রাইফেল দিয়ে গুলি করা হয়েছিল। গুলি লাগার সময় লুইস ডিফেও আর অ্যালিসন দু’জনেই জেগে ছিল! শুধু তাই নয়, বুচ বলেছিল সে ভোর চারটার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল এবং ওই সময়টাতে সব ঠিকঠাকই ছিল। মানে ওর মতে খুনগুলো হয়েছিল ভোর চারটার পর। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা যায় মৃত্যুগুলো হয়েছিল ৩:১৫-৩:৩০টার মধ্যে। মানে যে সময়ে বুচ বাড়িতে ছিল! 

বুচকে কঠিন জেরা শুরু করে পুলিশ। অবশেষে চাপের মুখে বুচ স্বীকার করে যে সে-ই নিজের মা-বাবা আর ভাই-বোনকে খুন করেছিল। এই সময়েই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে সেই বিখ্যাত লাইনটা—— “হ্যাঁ, আমিই মেরেছি ওদের। কিন্তু জানি না কেন! হুট করেই সব শুরু হলো… আবার হুট করেই শেষ। এত দ্রুত সবকিছু শেষ হয়ে গেল যে আমি কিছু বুঝতেই পারলাম না। নিজেকে সামলানোর সুযোগটুকুও পাইনি।” 

ওদের খুন করার পর বুচ কাপড় বদলায়, ভালো করে গোসল করে। তারপর রাইফেলগুলো আর নিজের রক্তমাখা জামাকাপড় দূরের একটা খালে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসে। 

শুরু হলো বুচের বিচার। ওর আইনজীবী অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। বিচারের ফলাফল কী হয়েছিল তা তো আপনারা জানেনই। 

কিন্তু এরপরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়, যার উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।

যেমন—সেই রাতে মোট আটটি গুলি চালিয়েছিল বুচ। চার ভাই-বোনের জন্য একটা করে আর মা-বাবাকে দুটো করে গুলি করেছিল সে। এত শক্তিশালী রাইফেলের গুলির শব্দ ছয় ব্লক দূর থেকেও শোনা যাওয়ার কথা, কিন্তু প্রতিবেশীরা কেউই কোনো শব্দ শোনেনি! শুধু কী তাই? ওদের বাড়িটা এত বড়ো, আর সবাই আলাদা আলাদা ঘরে ঘুমাত। তাহলে বুচকে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গিয়ে গিয়ে খুন করতে হয়েছিল। তাহলে তো এক ঘরে গুলি করার সময়ে বাকি ঘরগুলো লোকেদের জেগে যাওয়ার কথা, তাই না? কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে দেখা গেছে, কারও শরীরেই কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। দু’জন তো জেগে ছিল, তারপরেও তারা পালাল না কেন? 

এই প্রশ্নের উত্তরে বুচ বলে যে, সে না-কি রাতের খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ময়নাতদন্তে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি, কোনো ঘুমের ওষুধ তারা সেই রাতে খায়নি! 

তবে? এখান থেকেই অনেকে বলে, ওই রাতে বুচের সাথে হয়তো আরও অনেকেই ছিল। নইলে এতগুলো মানুষকে এভাবে খুন করা অসম্ভব! 

আর বুচ যদি খুন করেই থাকে, তবে কেন করেছিল? বুচের সাথে ওর বাবার সম্পর্ক একেবারেই ভালো যাচ্ছিল না। মাঝে মাঝেই তর্কাতর্কি হতো। কিন্তু সেজন্য খুন? তাহলে মা আর ভাই-বোনদের ও মারল কেন? 

বুচ জেলে যাওয়ার পরেও কিন্তু ওর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনেকে। আর অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন রকম কথা বলেছে বুচ! 

১৯৮৬ সালে দেওয়া একটা সাক্ষাৎকারে বুচ জানায়, “পুরো পরিকল্পনাটা ছিল আমার বোন ডনের। মা-বাবার সম্পর্কের টানাপোড়েন আর নিতে পারছিল না ও। আমি তো দীর্ঘকাল বাড়িতেই ছিলাম না। নিউজার্সিতে বিয়ে করেছিলাম, আমার বউয়ের নাম জেরার্ডলিন গেটস। তো এক রাতে ডন আমাকে ফোন করে বলল বাড়িতে ঝামেলা হয়েছে। সাথে সাথে শ্যালক রিচার্ড রোমন্ডের সাথে ওখানে আসি আমি। প্রিয়জনদের লাশ দেখে আর মাথা ঠিক ছিল না, তাই ডনকে গুলি করে মেরে ফেলি। এরপর সব দোষ নিজের কাঁধে তুলে নিই। কেন? কারণ আমার নানা ডনকে খুব ভালোবাসতেন, ওনার কারণেই আজ আমাদের এত সম্পত্তি। ডন এমন কাজ করেছে শুনলে তিনি খুব কষ্ট পেতেন! রিচার্ডকে জিজ্ঞাসা করুন আপনারা, ও সব জানে।” 

এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর সবাই অবাক হয়ে গেল। বুচ যে বিয়ে করেছিল তা কেউ জানত না! ওর প্রেমিকা মিন্ডি ওয়েসকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে সে-ও অনেক বড়ো ধাক্কা খায়! 

অবশেষে মেয়েটা জানায়, বুচের সাথে ১৯৭৪ সালের জুন মাস থেকে ওর প্রেম শুরু হয়। বুচকে সে অবিবাহিত বলেই জানত। 

ওদিকে বুচের সেই কথিত স্ত্রী জেরার্ডলিন গেটসের খোঁজ শুরু হয়। পাওয়াও যায় তাকে। মেয়েটা দু’বছর ধরে অন্য কারও সাথে বিবাহিত এবং এক সন্তান নিয়ে নিউইয়র্কে ওর সুখের সংসার। সে বলে, “বুচ আমার পরিচিত, এটুকুই আরকি….. রিচার্ড বলে আমার কোনো ভাই নেই।” 

অবশেষে ১৯৮৯ সালে এক পত্রিকার কাছে গেটস স্বীকার করে যে ১৯৭০ সালে আসলেই বুচের সাথে ওর বিয়ে হয়েছিল। তার যে সন্তান রয়েছে, তার বাবা আসলে বুচ! লং ব্রাঞ্চে থাকত ওরা, নিউজার্সিতে কখনও যায়নি। আর রিচার্ড বলে আসলেই ওর কোনো ভাই নেই। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে ওদের তালাক হয়ে যায়। 

১৯৯০ সালে আরেকটি সাক্ষাৎকারে বুচ বলে, “আমার মা-বাবা আর ভাইবোনদের আসলে খুন করেছিল ডন। ওর সাথে আলখাল্লা পরা একটা লোক ছিল। আমি ডনকে তো মেরে ফেলেছিলাম, কিন্তু আলখাল্লা পরা লোকটাকে ধরতে পারিনি!” 

২০০০ সালের ৩০ নভেম্বর বুচের সাথে দেখা করেন লেখক রিক ওসুনা। দুই বছর পর প্রকাশিত হয় ওনার বই, ‘দ্য নাইট দ্য ডিফেওস ডায়েড’। 

তাকে বুচ বলে, “আমি আর ডন মিলে মা-বাবাকে খুন করি। কেন করব না? ওনারা আমাদের মেরে ফেলতে চাইতেন। আমার দু’জন বন্ধুও সাথে ছিল। অগি ডিজেনেরো আর ববি কেলস্কি। সত্যি বলছি, ভাই-বোনদের মারার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু ডন ওদের মেরে বসল! কেন? সব সাক্ষ্য-প্রমাণ মুছে দিতে। আর সহ্য করতে পারলাম না! লাথি মেরে ফেলে দিলাম কুত্তিটাকে, তারপর এক গুলিতে সব ঠান্ডা!” 

কিন্তু আগেই বলেছি, ময়নাতদন্তে ডন-সহ কারও শরীরেই কোনো ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই। 

অনেক প্রশ্নেরই উত্তর নেই, তাই না? 

বিশেষজ্ঞ জো নিকেলের মতে, “বুচ ডিফেওর এক একবার একেক কথা বলা ওর মানসিক সমস্যারই বহিঃপ্রকাশ। আরেকবার তদন্ত হওয়া উচিত, এমনটাও তো হতে পারে যে বুচকে আসলে ফাঁসানো হয়েছিল?” 

ওদিকে অনেকে আবার মনে করে যে এই হত্যাকাণ্ডের পিছনেও বাড়ির অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলো হাত আছে! হ্যাঁ, এবার একটু বুচকে রেখে লুৎজ পরিবারের ব্যাপারে ফিরে আসি। 

ফাদার ম্যানকুসো নামে যে ক্যাথলিক যাজকের কথা বলা হয়েছে তার আসল নাম হলো ফাদার পেকোরারো। জর্জরা চলে যাওয়ার কয়েক মাস পর এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে লুজদের সাথে ওনার শুধু ফোনেই কথা হতো, উনি কখনও ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে যাননি! কিন্তু পরের বছর আরেক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন! 

অবশেষে ১৯৭৯ সালে টিভি শো ‘ইন সার্চ অফ’র একটি এপিসোডে হাজির হন তিনি, নিজের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছিলেন বলে ওনার মুখটা অন্ধকারাচ্ছন্ন রাখা হয়। এখানে তিনি বলেন, “হ্যাঁ আমি ওশান অ্যাভিনিউয়ের ওই বাড়িটায় গিয়েছিলাম। ওই ভয়ংকর কণ্ঠ শুনে সাথে সাথেই জর্জকে বলেছিলাম বাড়িটা ছেড়ে দিতে। ফোনে কথা বলার সময়ে নানান ঝামেলার ব্যাপারে বইতে যা বলা আছে, সেগুলো সত্য নয়। এছাড়া আমার অ্যাপার্টমেন্টে কখনোই মলের গন্ধ পাওয়া যায়নি।” 

ওদিকে জর্জরা চলে যাওয়ার পর ১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে বাড়িটা কিনে নেন জিম ও বারবারা ক্রোমাটি দম্পতি। প্রায় দশ বছর ওখানে ছিল তারা। এর মধ্যে কোনো অতিপ্রাকৃত সমস্যাই হয়নি। ১৯৮০ সালে এক সাক্ষাৎকারে জিম জানান, “কোনো ঝামেলাই হয় না, মাঝে মাঝে কিছু লোক আসে… ওই যে বই আর সিনেমাটা আছে না? ওইজন্য আরকি। বইতে লেখা অনেক কথাই মিথ্যা। দরজা জানালা মেরামতের কোনো চিহ্নই আমরা দেখতে পাইনি। আর ওই লাল ঘর? ওতে লুজদের বাচ্চারা মাঝে মাঝেই খেলতে যেত… ওদের কতগুলো খেলনাও ওখানে পড়ে আছে।” 

পহেলা জানুয়ারিতে বরফের ওপর শুয়োরের পায়ের ছাপ ফুটে ওটার যে দাবি লুৎজরা করে তা-ও পরবর্তীতে নাকচ করে দেন গবেষক রিক মোরান এবং পিটার জর্ডান। ওই রাতে অ্যামিটিভিলে বরফই পড়েনি! 

যে রাতে ঝড়ের কারণে দরজা-জানালা ভেঙে গিয়েছিল বলে দাবি করা হয়, ওই রাতে পুরো লং আইল্যান্ডেই কোনো ঝড় হয়নি। 

এছাড়া অ্যামিটিল পুলিশ বিভাগে যোগাযোগ করেও জানা যায় যে ওই বাড়িতে কখনোই কোনো পুলিশ অফিসার যায়নি, কেউ খেয়ালও রাখেনি। 

অবশ্য জর্জ পরবর্তীতে বাড়ি আর গ্যারেজের ভাঙা দরজার কিছু ছবি প্রকাশ করে। 

১৯৭৭ সালে জর্জ আর ক্যাথি, আইনজীবী উইলিয়াম ওয়েবার আর কিছু ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। অভিযোগ? ওরা জর্জ আর ক্যাথির অভিজ্ঞতাকে বানিজ্যিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে। 

১৯৭৯ সালে পিপল ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারে উইলিয়াম ওয়েবার বলেন, “আরে বাড়ির ব্যাপারটা পুরো ভুয়া! আমারই মাথা থেকে বেরিয়েছিল সব। ক্যাথি আর জর্জকে বই লেখার প্রস্তাবটাও আমিই দিয়েছিলাম… কিন্তু তারপরেই ওদের সাথে জে অ্যানসনের চুক্তি হয়ে গেল!” 

১৯৭৯ সালে ‘গুড মর্নিং আমেরিকা’-তে আসে জর্জ আর ক্যাথি। সেখানে জর্জ বলে, “বইতে লেখা বেশিরভাগ কথাই সত্য, কিছু হয়তো অতিরঞ্জিত।” 

কিন্তু ততদিনে নানান মহল থেকে ঘটনার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। হলিউডেও একটি সিনেমা আসতে চলেছে। নানান চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে পলিগ্রাফ টেস্ট দেয় জর্জ আর ক্যাথি। ওই সময়ে আমেরিকার বিখ্যাত দুই পলিগ্রাফ এক্সপার্ট ‘মাইকেল রাইস’ আর ‘ক্রিস গুগাস’ তাদের পরীক্ষা নেন। পাঁচটি প্রশ্ন করা হয়েছিল জর্জ আর ক্যাথিকে। 

আপনাদের অভিজ্ঞতাগুলো কি সত্যি? 

ক্যাথি, আপনাকে কি আসলেই অদৃশ্য কোনো সত্তা জড়িয়ে ধরেছিল?

ক্যাথির চেহারা কি আসলেই ভয়ংকর এক বুড়ি মহিলার মতো হয়ে গিয়েছিল?

আপনারা দু’জন কি সত্যিই হাওয়ায় ভেসেছিলেন? 

আপনারা কি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ওই বাড়িতে ভূত আছে? 

জর্জ আর ক্যাথি প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছিল, ‘হ্যাঁ’। টেস্টের ফলাফল আসার পর দেখা গেল ওরা সত্যি বলছে! তবে? 

১৯৮০ সালে তালাক হয়ে যায় জর্জ আর ক্যাথির। 

১৯৭৯ সালের সিনেমাটা দারুণ ব্যাবসা সফল হয়। এতে জর্জের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ‘জেমস ব্রোলিন’ এবং ক্যাথির চরিত্রে ‘লোইস লেন’ খ্যাত বিখ্যাত অভিনেত্রী ‘মার্গট কিডার’। বইয়ের সাথে সিনেমার কাহিনির বেশ কিছু পার্থক্য আছে। 

অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ইনাদেরও কিছু অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা আছে। 

জেমস ব্রোলিনের মতে, “যখনই আমি চিত্রনাট্য পড়তে বসতাম, আমার প্যান্টটা আলনা থেকে পড়ে যেত!” 

মার্গট কিডারের ক্যারিয়ারেও ঝামেলা শুরু হয় এরপর থেকে। ওনার অনেকগুলো সিনেমা ফ্লপ হয়, ব্যক্তিগত জীবনও ভালো যাচ্ছিল না। তিনি আর কখনোই সেভাবে ফিরতে পারেননি। ২০১৮ সালে মৃত্যু হয় এই অভিনেত্রীর। 

লেখক জে অ্যানসনের অভিজ্ঞতা? জর্জ আর ক্যাথির রেকর্ড করে দেওয়া প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা শুনে বইটি লিখেছিলেন তিনি। এর মধ্যে একবার হার্ট অ্যাটাকও হয়েছিল তার। তবে তিনি মনে করেন না যে বইটির কারণে এমনটা হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা ওই বাড়িটাতে রাত কাটানোর সময় ক্যামেরাতে একটি অদ্ভুত ছবি ওঠে। কথিত আছে ক্যামেরাতে টাইমার দিয়ে সরে গিয়েছিলেন ক্যামেরাম্যান। ছবিতে দেখা যায় একটা কোনা থেকে উঁকি মারছে ভূতুড়ে চেহারার একটা ছেলে! পরবর্তীতে এই ছবিটাকে পাবলিক ডোমেইন বলে ঘোষণা করে জর্জ। অনেকের মতে এই ছেলেটাই সেই ‘মৃত বাচ্চা’ যার কথা বইতে বলা আছে, আবার কারও মতে পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পাবাজি। 

এড আর লোরেন ওয়ারেনের মতে ওই বাড়িতে সত্যিই ভূত আছে। 

২০০০ সালে দ্য হিস্ট্রি চ্যানেল অ্যামিটিভিলের ওপর একটি ডকুমেন্টারি বানায়। প্রায় পঁচিশ বছর পর একসাথে এতে দেখা যায় জর্জ আর ক্যাথিকে। এখানে জর্জ বলে, “মিথ্যা বলে আমরা টাকা কামাইনি, অতগুলো টাকা নষ্ট হলো… বাড়ি চলে গেল, তারপরেও আমার কথা মিথ্যা হয় কী করে?” 

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা একমত নন জর্জের সাথে। জর্জের ব্যাবসা একেবারেই ভালো যাচ্ছিল না। আর এটাও সত্য যে বইটার কারণে প্রচুর টাকা গেছিল লুজদের অ্যাকাউন্টে। হতেই পারে, সব সাজানো? 

২০০২ সালে ‘দ্য অ্যামিটিভিল হরর’ লাইনটি নিজের নামে রেজিস্টার করে নেয় জর্জ। 

২০০৫ সালে মুক্তি পায় আরেকটি সিনেমা। এটি মূলত ১৯৭৯ সালের সিনেমাটির একটি রিবুট সংস্করণ। এতে কাহিনি আরও বদলে ফেলা হয়েছিল, যদিও নাম একই ছিল। এতে জর্জের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রায়ান রেনল্ডস আর ক্যাথির ভূমিকায় মেলিসা জর্জ। 

সাক্ষাৎকারে অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা বলেছিলেন রায়ান, “শ্যুটিংয়ের সময় মাঝে মাঝেই দেখা যেত যে আমাদের পুরো দলের ঘুম রাত সোয়া তিনটার দিকে ভেঙে যাচ্ছে! অবশ্য এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই! মোটামুটি সবাই-ই বইটা পড়েছিলাম, অবচেতন মনের খেল, বোঝেনই তো!” 

পরবর্তীতে এই সিনেমাটিকে ফালতু এবং বানোয়াট হিসেবে অভিহিত করেন জর্জ। তার কাছ থেকে কোনো অনুমতি না নেওয়ার জন্য প্রযোজকের বিরুদ্ধে মামলা করে দেন তিনি। ২০০৬ সালে জর্জের মৃত্যুর পর এই মামলার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি, ক্যাথি মারা গিয়েছিল দুই বছর আগেই। 

তবে ২০০৫ সালে হুট করেই দৃশ্যপটে এসে হাজির হয় নতুন একজন। ছোট্ট ক্রিসকে মনে আছে? সে ততদিনে ক্রিস্টোফার কোয়ারেন্টিনো হয়ে গেছে। ‘লুজ’ পদবি দীর্ঘকাল ধরেই ব্যবহার করে না। 

‘ইনসাইড’র একটি পর্বে হাজির হয় ক্রিস্টোফার। সে জানায় ২০০৫ সালে হওয়া সিনেমাটা পুরোই ভুয়া এবং এতে তাদের স্মৃতির প্রতি অসম্মান হয়েছে। শুধু তাই নয় সে আরও বলে, “অনেক আগে থেকেই ‘দ্য অ্যামিটিভিল হরর’ নামটার স্বত্ব নিয়ে জর্জের সাথে ঝামেলা চলছিল আমার। বইয়ে ওর সম্পর্কে যা লেখা আছে তার বেশিরভাগই মিথ্যা… জর্জ কখনোই আমাদের পছন্দ করত না। ও ছিল খুবই খারাপ একটা মানুষ। কালোজাদুর চর্চাও করত লোকটা… ওর কারণেই বাড়িতে ভূত-প্রেতের উপদ্রব শুরু হয়েছিল। বইতে অতিপ্রাকৃত যে ব্যাপারগুলো উল্লেখ আছে, সবই সত্য। জর্জ ওই বাড়ি থেকে চলে এসেছে তাই ওখানে আর কোনো ঝামেলা হয় না।” 

ড্যানি? সে-ও দৃশ্যপটে এসে হাজির হয় ২০১০ সালের দিকে। জানায় যে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চায়। ২০১২ সালে ড্যানিয়েল লুজকে নিয়ে নির্মিত হয় ডকুমেন্টারি ‘মাই অ্যামিটিভিল হরর’। ড্যানির মতেও বইয়ে উল্লেখিত ঘটনাগুলো বেশিরভাগই সত্য, যদিও ক্রিসের মতো সৎ বাবার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই তার। জর্জকে এখনও বাবা বলেই ডাকে সে। ২০১৩ সালের একটি সাক্ষাৎকারে ড্যানিয়েল জানায়, “আমার হাতের ওপর আসলেই জানালার পাল্লাটা পড়ে গেছিল, বাবা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন… কিন্তু যেতে আর হয়নি। বইয়ে তো আবার লেখা যে হাসপাতালে গেছিলাম। যা-ই হোক, ওই দাগগুলো এখনও আমার আঙুলে রয়ে গেছে।” 

ওদিকে মেলিসা? মানে পুচকে মিসির কী হলো? ওর বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। দুই ভাইয়ের কেউই জানে না ও কোথায় আছে। ড্যানি আর ক্রিসের সম্পর্কও বর্তমানে ভালো নয়। ‘দ্য আমিটিভিল হরর’ নামটির কপিরাইট নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে বেজায় ঝামেলা চলছে, তবে ব্যাপারটা এখনও আদালত পর্যন্ত যায়নি। 

এই বছরে প্রচারিত হবে আরেকটি ডকুমেন্টারি ‘অ্যামিটিভিল অ্যান অরিজিনাল স্টোরি’। এতে মুখ্য চরিত্র হিসেবে থাকছে ক্রিস্টোফার। 

অ্যামিটিভিলের মানুষেরা বাড়িটা নিয়ে কী ভাবে? এলাকার লোকেরা খুবই বিরক্ত। এমনকি বাইরে থেকে কেউ যদি এসে বাড়িটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে তবে তারা ঠিকমতো উত্তরই দেয় না। বেশিরভাগ বাসিন্দাই মনে করে জর্জ আর ক্যাথির অভিজ্ঞতাগুলো মিথ্যা। ‘অ্যামিটিভিল ইতিহাস সংস্থা’র ওয়েবসাইটে লুৎজ পরিবারের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছুই লেখা নেই; এমনকি ডিফেওদের নিয়েও কিছু নেই। এমনকি হিস্ট্রি চ্যানেলের ২০০০ সালের ডকুমেন্টারি বানানোর সময়ও ইতিহাস সংস্থার কোনো সদস্য সাক্ষাৎকার দেননি। 

এবার আসি, পুরো আমেরিকার মানুষেরা এই বাড়িটা নিয়ে কী ভাবে? কারণ এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ভূতুড়ে বাড়ি তো এটাই। শুরুতে যে প্রবাসী আপুর কথা বললাম, ওনার স্বামীও একজন আমেরিকান। সেই সূত্রে বেশ কিছু আমেরিকানের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। আসলে আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে বাড়িটা একটা স্ক্যাম, আর কিছুই না। বাড়িটা যারা দেখতে আসে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ইউরোপ আর এশিয়া থেকে আসা পর্যটক। আমেরিকানদের ওই বাড়ি নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহই নেই। 

জর্জরা চলে যাওয়ার পর বাড়িটা আরও চারবার বিক্রি হয়েছে। শেষবার হয়েছে ২০১৮ সালে, মালিকের নাম প্রকাশ করা হয়নি। 

যা-ই হোক বুচ ডিফেওকে মনে আছে তো? জেল থেকে কখনোই ছাড়া পায়নি সে। ওখানেই থেকেছে আর দিয়ে গেছে নানান বিতর্কিত বক্তব্য। একবার তো জর্জ আর ক্যাথিকে নিয়েও বলেছিল, “আমার বাড়ি নিয়ে লাখ-লাখ টাকা কামিয়ে ফেলল, আমার তো মনে হয় ওরাই আমার মা-বাবাকে মেরেছে!” 

অবশেষে ২০২১ সালের ১২ মার্চ, ৬৯ বছর বয়সে অ্যালবানি মেডিকেল সেন্টারে মৃত্যু হয় রোনাল্ড রন ডিফেও বা বুচ ডিফেওর। 

কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়তো কখনোই পাওয়া যাবে না! যেমন ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের রাতে আসলেই কী হয়েছিল? বুচ কি সত্যিই মানসিকভাবে অসুস্থ? 

বুচের সাথে জর্জের চেহারার বেশ মিল রয়েছে। কন্সপিরেসি থিওরিস্টরা বলে থাকেন এই ব্যাপারটা খেয়াল করার পর থেকেই জর্জ আর ক্যাথি অমন মিথ্যা কাহিনি বানায়। 

কিন্তু ওরা তো লাই ডিটেক্টর টেস্টেও পাশ করেছিল! তবে? 

অনিশ্চয়তা আর অনিশ্চয়তা! প্রকৃতি হয়তো কিছু রহস্য গোপনই রাখতে পছন্দ করে। 

অ্যামিটিভিলের সেই বাড়িটা কিন্তু এখনও আছে। ভেতরে পরিবর্তন আনা হয়েছে, ঘরগুলোও আর আগের মতো নেই। ঠিকানাটাও বদলে ফেলা হয়েছে, যাতে করে পর্যটকেরা চিনতে না পারে। ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটা এখন ১০৮ নম্বর বাড়ি। 

কী ভাবছেন? সব সত্য? না কি স্ক্যাম? 

এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো কখনও পাওয়া যাবে না। 

মুমু আপুকে আবারও ধন্যবাদ, এতটা সাহায্য করার জন্য। উনি না থাকলে হয়তো ভূমিকাতে এতটা বকবক করতে পারতাম না। আপু অসাধারণ একজন মানুষ। আমাদের দেশের অনেক প্রবাসীরা যেখানে নিজেদের সন্তানকে বাংলা শেখান না এবং কিছুক্ষেত্রে তা নিয়ে আবার গর্বও করেন, সেখানে আপু সুদূর আমেরিকাতে বসে মানুষকে বাংলা শেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আপু এবং ‘বাংলা ইনস্টিটিউট’র প্রতি শুভকামনা। 

লুৎফুল কায়সার
রাজশাহী। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *