পঞ্চদশ অধ্যায়
২-৩ জানুয়ারি।
ফাদার ম্যানকুসো যে আসবেন না তা বুঝতে বাকি রইল না জর্জ আর ক্যাথির এখন কী করবে ওরা? অন্য কোনো যাজককে ডাকবে? ক্যাথি একবার স্থানীয় অ্যামিটিভিল গির্জার যাজকের কথা বলেছিল, কিন্তু জর্জ না করে দিলো। খবরের কাগজে লোকটার ব্যাপারে দেখেছিল জর্জ, বেশ বয়স্ক মানুষ তিনি। রনি ডিফেওর স্বীকারোক্তি উনিই নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, “এসব অদৃশ্য কণ্ঠ আর ভূত-প্রেত সবই ফালতু কথা, রনি চিরকালই একটা বদ ছেলে ছিল!” এই যাজক ভূত-প্রেতেও বলতে গেলে তেমন বিশ্বাস করেন না। এমন একটা মানুষকে বাড়ি শুদ্ধ করার জন্য ডাকতে গেলে যে জর্জকে অপমানিত হয়ে ফিরতে হবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই।
“আচ্ছা ক্যাথি, কেউ আমাদের ভয় দেখিয়ে বাড়ি থেকে তাড়াতে চাচ্ছে না তো? হয়তো এখানে ভূত-প্রেত নেই… সবই মানুষের কারসাজি?” আস্তে করে বলল জর্জ।
“দেখো জর্জ,” মাথা নাড়ল ক্যাথি, “আমাকে অদৃশ্য কেউ জড়িয়ে ধরে এটা আমার মনের ভুল হতে পারে! কিন্তু… ফায়ারপ্লেসে আমরা দু’জন যে মুখটা দেখেছিলাম? তারপর বরফে ফুটে ওঠা শুয়োরের পায়ের ছাপ? আচ্ছা, ধরে নিলাম কোনো মানুষ আমাদের তাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু এগুলো কীর্তি ঘটানো কি কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব? তুমি যাই-ই বলো না কেন… এই বাড়িতে ভয়ংকর এক অতিপ্রাকৃত শক্তি আছে! যা আমাদের ক্ষতি করতে চায়!”
“হুম,” দীর্ঘশ্বাস ফেলল জর্জ, “কিন্তু এখন আমরা কী করব? ফাদারও তো আসছেন না।”
অবশেষে অনেক চিন্তার পর ঘুমাতে চলে গেল তারা।
“ক্যাথি,” হুট করেই উঠে বসল জর্জ, “আগামীকাল আমি অ্যামিটিভিল পুলিশ বিভাগের সাথে যোগাযোগ করব!”
২ জানুয়ারি রাত সোয়া তিনটায় আবার ঘুম ভেঙে গেল জর্জের। নৌকার ছাউনি দেখতে বের হলো সে, সব ঠিকঠাকই ছিল। হ্যারিও ওর ঘরে অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক আগে থেকেই ঘুমিয়ে কুকুরটা। পরদিন সকালে ভ্যানে করে হ্যারিকে ডিয়ার পার্কের পশু হাসপাতালে নিয়ে গেল জর্জ। এখানকার ডাক্তারদের সাথে বহুদিন থেকেই তার পরিচয়, তাই এখানে আসা। ডাক্তাররা ভালো করে পরীক্ষা করল হ্যারিকে, অবশেষে কিছুক্ষণ পর তারা জানাল হ্যারি একদম সুস্থ আছে। ওকে কোনো প্রকার বিষ বা নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ানো হয়নি। ফাঁক দিয়ে জর্জের পকেট থেকে বেরিয়ে গেল ৩৫ ডলার। ডাক্তার এটাও বললেন যে হুট করেই নতুন পরিবেশ আর বেশি খাওয়ার কারণে কুকুরটা অলস হয়ে গেছে।
***
২ তারিখ সকালবেলা ফাদার ম্যানকুসো আবার নতুন করে অ্যামিটিভিলের বাড়িটার শুদ্ধীকরণ আচার পালন করলেন। তবে তিনি কিন্তু জর্জদের বাড়িতে যাননি, বরং লং আইল্যান্ড রেক্টরির ভেতরের গির্জাতেই সব করলেন। এই ধরনের শুদ্ধীকরণ সাধারণত খুব বিপদে না পড়লে করতে চান না যাজকেরা। তবে খুব শক্তিশালী প্রেতশক্তির খপ্পরে পড়লে এটা না করেও উপায় থাকে না। ফাদার ম্যানকুসোর ধারণা জর্জদের বাড়ির প্রেতশক্তিটা অসম্ভব ক্ষমতাবান, ওটার এলাকায় গেলেই তার বিপদ হবে।
বেদির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে নিজের হাতের গ্লাসভ খুলে ফেললেন ফাদার, তারপর বাইবেল থেকে পড়তে লাগলেন লাগলেন, “ “আমিই মানুষের রক্ষাকর্তা, ‘ প্রভু কহেন, ‘মানুষ যে বিপদেই পড়ুক না কেন, তারা আমাকে স্মরণ করুক, তাদের প্রার্থনার উত্তর দেওয়ার জন্য সর্বদা আমি বিরাজমান।’”
বুকে ক্রুশ এঁকে কয়েক পাতা উলটে আবার পড়তে লাগলেন তিনি, “প্রভু, হে পরমপিতা, আপনিই আমাদের সব। আমাদের বিপদে পথ দেখান, অসুস্থকে সুস্থ করুন, বিপদগ্রস্থকে উদ্ধার করুন! আমাদের দুঃখ দূর করুন… করুণা করুন হে প্রভু!”
মুখ তুলে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ মূর্তির দিকে চাইলেন ফাদার, “হে পরম পিতা, আমাদের যে শাস্তি প্রাপ্য তা আপনিই আমাদের দেন, আবার আপনিই আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। প্রভু যিশুর মাধ্যমে আমরা আপনার কাছেই প্ৰাৰ্থনা করি! শুধু আপনিই পারেন আমাদের উদ্ধার করতে!”
বাইবেল বন্ধ করলেন তিনি, কিন্তু যিশুর মূর্তি থেকে চোখ সরালেন না, “হে প্রভু, লুৎজদের বাঁচান। ওরা আপনারই সন্তান! হে প্রভু অবিশ্বাসীরা যেভাবে আপনার পুত্রকে হত্যা করেছিল… ঠিক সেভাবেই আজ এক ভয়ংকর শক্তি কষ্ট দিচ্ছে লুজদের। লুৎজরা কোনো পাপ করে থাকলে তার যথেষ্ট শাস্তি ওরা ভোগ করেছে হে প্রভু, এবার ওদের মুক্তি দিন… হে পরমপিতা… আমার আহবান শুনুন! প্রভু যিশুর মাধ্যমে আপনার কাছে এই আমার প্রার্থনা… আমেন।”
কাজ শেষ করে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এলেন ফাদার। কিন্তু তালা খুলতেই মানুষের মলের একটা তীব্র গন্ধ এসে আঘাত করল ওনার নাকে! পুরো অ্যাপার্টমেন্টে ওই গন্ধ! গন্ধ রীতিমতো বেড়েই চলেছে! বমি এসে গেল ফাদারের… তাড়াতাড়ি সব জানালা খুলে দিলেন তিনি। ঠান্ডা বাতাসে ভরে গেল অ্যাপার্টমেন্ট। কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন কমজোর হলো সেই গন্ধ, তারপরেই আবার হুট করে বেড়ে গেল! নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ফাদারের… বাথরুমে কোনো সমস্যা হলো না কি? তাড়াতাড়ি সেখানে ছুটে গেলেন তিনি। কিন্তু নাহ, সব ঠিকই আছে। আবার বমি এলো তার।
রেক্টরির সামনের উঠানে একটা ট্যাংকের মতো আছে, ওটা মলাধার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আবার পিছন দিকে কতগুলো পুরোনো কুয়াও আছে। এই দুই জায়গার কোনো এক জায়গা দিয়ে গন্ধ আসছে না তো? রেক্টরির কলের মিস্ত্রিকে ডেকে পাঠালেন ফাদার। তারপর দু’জন মিলে কুয়াগুলো দেখতে গেলেন, নাহ ওখানে কোনো প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে নেই। মলাধারটাও ঠিকই আছে, ওটার পাইপে কোনো ছিদ্র নেই।
রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন ফাদার। হয়তো এতক্ষণে গন্ধটা পুরো রেক্টরিতে ছড়িয়ে পড়েছে। একটু দূরেই কলেজ ভবন, ওখানে ছাত্ররা পড়ছে ওদিকেও গন্ধ যাবে নিশ্চিত! সব যাজকেরা ইতোমধ্যেই হয়তো নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়েও পড়েছেন। প্রধান যাজক এখন কী করে সামলাবেন সব? এক কাজ করা যায়, সবগুলো অ্যাপার্টমেন্টে ধূপ জ্বালিয়ে দিলে কেমন হয়? তাতে হয়তো ওই গন্ধ আর নাকে লাগবে না।
তখনও ফাদার ম্যানকুসো আসল ব্যাপারটাই বুঝতে পারেননি, যে গন্ধের আসল উৎস আসলে ওনার অ্যাপার্টমেন্ট। তাড়াতাড়ি করে অ্যাপার্টমেন্টে কয়েকটা ধূপ জ্বালিয়ে কলেজ ভবনের দিকে ছুটলেন তিনি।
কিন্তু ওখানে কোনো গন্ধ নেই! আর কোথাওই কোনো গন্ধ নেই! ওনার বুঝতে বাকি রইল না যে লুজদের বাড়িটার জন্য সকালে বিশেষ আচার পালন করার ফলেই এমনটা হয়েছে। ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে প্ৰথম যেদিন তিনি গেছিলেন, সেদিনই একটা বিকৃত কণ্ঠস্বর ওনাকে বলেছিল, “বেরিয়ে যাও!” ওই ভয়ংকর শক্তিই এখন রেক্টরিতে এসে তাকে জ্বালাতন করছে! এত ক্ষমতা ওই শক্তির? এমন পবিত্র জায়গাতেও ঢুকতে পারে?
চুপচাপ ভবনে ফিরলেন ফাদার। তারপর ওপরে উঠে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বারান্দায়। কোথাও কোনো গন্ধ নেই, শুধু ওনার অ্যাপার্টমেন্টই ভরে আছে ওই উদ্ভট গন্ধে। উঠানের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের ছাত্রজীবনের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল তার। প্রেততত্ত্ব ক্লাসে একবার একজন বেশ অভিজ্ঞ যাজক বলেছিলেন, “শয়তানের উপস্থিতির একটা বড়ো সংকেত হলো মানুষের মলের গন্ধ। “
***
বিকালবেলা অ্যামিটিভিল পুলিশ বিভাগের ডিটেকটিভ, সার্জেন্ট চার্লি ল্যু জাম্মাতারো এলো জর্জদের বাড়িতে। জর্জের সাথে ভাঙা গ্যারেজের দরজাটা দেখল সে, বরফের ওপর শুয়োরের পায়ের ছাপগুলো তখনও স্পষ্ট আছে। তারপর ভেতরে ঢুকল ওরা। ক্যাথি আর বাচ্চাদের সাথে সার্জেন্টকে পরিচয় করিয়ে দিলো জর্জ। ক্যাথি ওই ‘অদৃশ্য আলিঙ্গন’র কথা খুলে বলল সার্জেন্টকে, তারপর বসার ঘরে নিয়ে ফায়ারপ্লেসটা দেখাল… বলল ওখানে দেখা দানবটার কথা।
খানিকটা বিরক্ত হলো সার্জেন্ট, মনে হচ্ছিল কথাগুলো বিশ্বাস করেনি সে।
অবশেষে তাকে বেসমেন্টের সেই গোপন ঘরে নিয়ে গেল জর্জ আর ক্যাথি।
“দেখুন সার্জেন্ট,” বলে উঠল জর্জ, “আমি নিজের চোখে রনি ডিফেওর ছায়ামূর্তিকে এই ঘরের দরজার আড়ালে মিলিয়ে যেতে দেখেছি।”
“রনি তো জীবিত, না মরেই ভূত হয়ে গেল?” হাসল সার্জেন্ট।
“আমার মনে হয় এই ঘরটা সেই-ই বানিয়েছে। স্থানীয় বারটেন্ডারও বলে এই ঘরটা নিয়ে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখেছে সে। এই ঘরে হয়তো কোনো অশুভ কাজ করত খুনিটা? হুম?
“কী প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে? যে রনিই ঘরটা বানিয়েছিল? কারও স্বপ্নের কথা কিন্তু প্রমাণ হিসেবে আদালতে পেশ করা যায় না!”
চুপ করে রইল জর্জ আর ক্যাথি।
“দেখুন আপনাদের সব কথাই শুনলাম,” হাসল সার্জেন্ট, “আপনারা যা দেখেছেন, যা শুনেছেন… সেইসব কথা আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। তবে এসব ক্ষেত্রে পুলিশের কী করার আছে? আপনারা কোনো যাজকের সাথে যোগাযোগ করুন। আমেরিকার আইন এইসব ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে না, তাই এসব দেখাও পুলিশের কাজ না। তবে হ্যাঁ, ভাঙা গ্যারেজের দরজাটা নিয়ে আমি তদন্ত করে দেখব, ওটা কোনো বদ লোকের কাজ হতে পারে।”
লুৎজদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল জাম্মাতারো। এসব কেসে পুলিশ কী-ই বা করতে পারে? তবে লুৎজদের জন্য খারাপ লাগছে ওর। ওদের গ্যারেজের ভাঙা দরজাটার ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য একজন কনস্টেবলকে বলে দেবে, আপাতত এই। কিন্তু একটা ব্যাপার সে ওদের বলেনি। লুৎজ দম্পতি এমনিতেই ভয়ে আছে, ওরা আরও বেশি ভয় পাক তা চায়নি সার্জেন্ট। ব্যাপারটা হলো, বাড়িটাতে ঢোকার পর থেকেই ওর মনে হয়েছে, কেউ যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে… কেমন একটা অদ্ভুত পরিবেশ, পুরোটা সময় গা ছমছম করছিল ওর। ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে আর কখনোই যাওয়ার ইচ্ছা নেই ওর।
***
ওদিকে সন্ধ্যা নামার পরেও ফাদার ম্যানকুসোর অ্যাপার্টমেন্টের গন্ধটা যায়নি বরং ধূপের গন্ধের সাথে মিশে আরও উদ্ভট এক রূপ ধারণ করেছে। ধোঁয়ায় ভরে আছে ঘরগুলো, রীতিমতো চোখ জ্বলছে ফাদারের… শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বাইরে থেকেও লোকেরা এসে অবাক হয়ে যাচ্ছে, এক তরুণ যাজক তো প্রায় বমিই করে ফেলেছিল! কোনটা ধূপের গল্প আর কোনটা বাজে গন্ধ সেটাই এখন আর বোঝা যাচ্ছে না!
জানালাগুলো এখনও খোলা রেখেছেন ফাদার। ঠান্ডা বাতাসও কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে, ধোঁয়া আর গন্ধটাকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার বদলে আরও বেশি করে ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে! কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। একবার ফাদার ভাবলেন যে প্রধান যাজককে সবকিছু খুলে বলবেন, কিন্তু তখন ঝামেলা আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে… হয়তো সেই অপার্থিব শক্তি আরও রেগে যাবে! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা ছাড়া আর কিছুই করার নেই ফাদারের!
***
সার্জেন্ট জাম্মাতারো চলে যাওয়ার একটু পরেই জর্জ খেয়াল করল যে নৌকা রাখার ছাউনির কমপ্রেসরটা কাজ করছে না। চিন্তায় পড়ে গেল জর্জ, সম্ভবত অতিরিক্ত চাপের কারণে সার্কিটে ঝামেলা হয়ে ফিউজ জ্বলে গেছে। বেসমেন্টে দিকে রওনা দিলো সে, ফিউজ বাক্সটা পরীক্ষা করতে হবে।
বেসমেন্টের সেই দেওয়াল আলমারিটার পাশেই ফিউজ বাক্স। ওপর থেকে কতগুলো ভালো ফিউজ নিয়ে গেছিল সে। পুড়ে যাওয়া ফিউজটা বের করে সেটা পালটে দিলো জর্জ। তারপরেই কমপ্রেসর চালু হওয়ার শব্দ শুনতে পেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল জর্জ, দেখতে হবে… আবার ওভারলোড হয় না-কি। না হলো না, খুশি মনে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল ও।
অর্ধেকটা উঠতেই অদ্ভুত একটা গন্ধ এসে লাগল জর্জের নাকে। ওটা তেলের গন্ধ তো নয়… জর্জের হাতে টর্চ ছিল, কিন্তু ওটা চালু করার দরকার নেই। কারণ বেসমেন্টের আলো তখনও জ্বলছে। সিঁড়ি থেকে পুরো বেসমেন্টটাই দেখা যাচ্ছিল। ভালো করে খেয়াল করল জর্জ, গন্ধটা বেসমেন্টের উত্তর-পূর্ব দিকে থেকে আসছে… মানে প্লাইউডের ওই তাকটার দিক থেকে! ওখানেই তো সেই গোপন ঘর!
আবার নিচে নেমে এসে তাকগুলোর সামনে দাঁড়াল জর্জ। গন্ধটা আরও বেড়ে গেল। নাক চেপে ধরে গোপন দরজাটায় ধাক্কা দিলো জর্জ। তারপর টর্চ মেরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল লাল ঘরটা।
আরে! এ যে মানুষের মলের গন্ধ! কুয়াশার মতো ধোঁয়া উড়ছে ছাদের কাছে। দম আটকে আসছে জর্জের, বমি পাচ্ছে রীতিমতো। কোনোমতে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাইরে এসেই বমি করে ফেলল সে! নষ্ট হয়ে গেল মেঝে আর ওর পরনের কাপড়!
***
কয়েক বছর ধরেই ফাদার ম্যানকুসোর সাথে লং আইল্যান্ড সেক্রেড হার্ট রেক্টরির প্রধান যাজকের বেশ ভালো বন্ধুত্ব, ম্যানকুসো রেক্টরিতে আসার পর থেকেই সম্পর্কটা হয়েছে। দু’জনের সারাদিন নানান কাজে ব্যস্ত থাকলেও সন্ধ্যাবেলা একটু-আধটু আড্ডা না দিলে আর হতো না। কী ভাবছেন? কাছাকাছি বয়স? আরে ধুর। প্রধান যাজকের বয়স প্রায় ৬৫, সেখানে ফাদার ম্যানকুসোর ৪২। প্রায় বিশ বছরের ব্যবধান হলেও উনাদের চিন্তাধারা বেশ মেলে।
কিন্তু ৩ জানুয়ারি রাতে হুট করেই ব্যাপারটা একটা ধাক্কা খেলো।
অ্যাপার্টমেন্টের গন্ধের কারণে মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না ফাদার ম্যানকুসোর। তাই ঝোঁকের বশে তিনি প্রধান যাজকের সাথে এমন ব্যবহার করে বসলেন যে তাদের বন্ধুত্ব চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে গেল! ঘটনাটা শুরু হলো প্রধান যাজকের অফিসেই। ম্যানকুসোর কিছু প্রয়োজনীয় রিপোর্ট টাইপ করা হয়ে গেছিল তাই অফিসে এসে সেগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে ফোন করেছিলেন প্রধান যাজক। কাগজগুলো নিতে গিয়ে ম্যানকুসো দেখলেন অফিস ফাঁকা, ওগুলো তুলে নিয়ে তিনি চলে আসবেন এমন সময়েই আরও তিনজন বয়স্ক যাজককে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন প্রধান যাজক।
ওদিকে গন্ধের কারণে ঠিকমতো খাবারও খেতে পারছিলেন না ম্যানকুসো, রাতের খাবারও গলা দিয়ে নামেনি। তাছাড়া ওনার পোশাকেও গন্ধটা লেগে ছিল! হুট করেই চার জন যাজককে একসাথে দেখে মেজাজটা গরম হয়ে গেল তার। আড়চোখে প্রধান যাজকের দিকে চেয়ে বেশ জোরেই উনি বলে উঠলেন, “শুধু আমার ঘরেই গন্ধ! না জানি কী অপরাধ করেছিলাম যে এমন শাস্তি আমায় দেওয়া হলো আপনাদের তরফ থেকে!”
রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন প্রধান যাজক! ফাদার ম্যানকুসো কখনও এভাবে কথা বলতে পারেন তা উনি ভাবতেও পারেননি।
“দেখো বন্ধু,” কোনোমতে হাসলেন তিনি, “তোমার ঘরের গন্ধের কথা কলের মিস্ত্রির কাছে শুনেছি। ব্যাপারটা দুঃখজনক! কিন্তু কেন যে এমন হলো… তা আমার জানা নেই! বিশ্বাস করো, আমরা কেউ কিছু জানি না!”
“হুহ তাই না? আর কত ঢং করবেন?” হাত দিয়ে বাতাসে ঝটকা মারলেন ম্যানকুসো। অন্য যাজকেরাও হতবাক! ম্যানকুসোর মতো এত ভদ্র একটা মানুষ কী করে প্রধান যাজকের সাথে এভাবে কথা বলে? রাগে লাল হয়ে গেছে ম্যানকুসোর মুখটা, “আপনি মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন… ও শুধু আপনি না, বাকি সবাই এমন! আমার সাথে ফাজলামো করছেন সবাই মিলে? তাই না?”
“হলো কী আর এর?” অন্য যাজকদের দিকে তাকালেন প্রধান যাজক। কিন্তু তারা সবাই ওনার চোখে চোখ মেলাতে ভয় পাচ্ছে, আসলে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতে কে পড়তে চায়? অবশেষে প্রধান যাজক আবার ম্যানকুসোর দিকে ঘুরলেন, “শোনো, মনে হয় গন্ধের কারণে তুমি রেগে আছ… যা-ই হোক, বন্ধু এসব নিয়ে কথা বলার সময় এখন না। পরে কখনও অন্য কোনো জায়গায় কথা হবে, ঠিক আছে?” এই বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
“আরে আরে, আপনি সম্মানী মানুষ, যাবেন কেন? আমি যাচ্ছি!” এই বলে দরজার দিকে হাঁটা দিলেন ফাদার ম্যানকুসো। শেষবারের মতো জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার তাকালেন প্রধান যাজকের দিকে। ওই সময়ে যেন অপার্থিব কিছু ভর করেছিল তার ওপর। এভাবে কখনোই কারও সাথে কথা বলেননি তিনি। পরবর্তীতে ফাদার ম্যানকুসো আমাদের বলেছেন, “আসলে ওই সময়ে আমি নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিলাম না! যে শক্তি আমার অ্যাপার্টমেন্টকে দূষিত করেছিল তা আমার আত্মাকেও দূষিত করে ফেলেছিল!”
***
বেসমেন্টের সেই ঘটনার পর বেশ অনেকটা সময় নিয়ে বমি পরিষ্কার করে জর্জ, তারপর ওপরে এসে নিজেও গোসল করে নেয়। রাত এখন এগারোটার মতো বাজে, রান্নাঘরে ক্যাথির সাথে বসে কফি খাচ্ছে সে। দু’জনের চোখে-মুখে দুঃশ্চিতার ছাপ স্পষ্ট! হচ্ছেটা কী এই বাড়িতে? যে-কোনো ঘরে যে-কোনো সময়ে অনেক কিছুই হতে পারে! এখন তো রান্নাঘরটা শুধু নিরাপদ মনে হচ্ছে ওদের। ঘুমাতে যেতেও ভয় পাচ্ছে দু’জন।
“ক্যাথি,” বলে উঠল জর্জ, “এখানে তো বেশ ঠান্ডা, চলো বসার ঘরে গিয়ে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসি,” উঠে দাঁড়াল সে। কিন্তু ক্যাথি বসেই রইল।
“আমরা কী করব জর্জ?” কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল ক্যাথি, “দিনের পর দিন অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে! আমার শুধু ভয় লাগছে… বাচ্চাদের কিছু হবে না তো?” মাথা তুলে ছাদের দিকে চাইল ক্যাথি, “ঈশ্বর জানেন কার নজর লেগে গেছে আমাদের পরিবারের ওপর! আর কত ভয়ংকর ঘটনা যে ঘটবে!”
“শোনো ক্যাথি,” ওর কাঁধে হাত দিলো জর্জ, “আমি ঠিক করেছি বেসমেন্টে একটা ফ্যান লাগাব, যাতে করে উদ্ভট গন্ধ এলে ওটা ছেড়ে দেওয়া যায়। আর তাছাড়া ক’দিনের মধ্যেই মিস্ত্রি ডেকে ওই ঘরটার গোপন দরজার ওপরে একটা দেওয়াল তুলে দেবো… ওই ঘরটা অশুভ। ততদিন পর্যন্ত তুমি বাচ্চাদের কখনও বেসমেন্টে যেতে দিয়ো না। আমার কেন যেন মনে হয় সব সমস্যার মূলে ওই ঘরটা,” ক্যাথিকে টেনে তুলল সে, “তাছাড়া আমার অফিসে এরিক বলে একটা লোক আছে। ও একবার বলেছিল ওর প্রেমিকা নাকি এসব ভূতুড়ে বাড়ি নিয়ে কাজ করে…”
“ভূতের বাড়ি? তাহলে মেনেই নিলে আমাদের বাড়িটা ভূতের বাড়ি? কিন্তু কার আত্মা আমাদের এভাবে জ্বালাচ্ছে?” জর্জের পিছে পিছে বসার ঘরের দিকে চলল সে, হুট করে থমকে দাঁড়াল, “আচ্ছা জর্জ, তোমার কী মনে হয়? আমরা যে ধ্যান করি… এর সাথে এই ঘটনাগুলোর সম্পর্ক আছে? অনেকেই তো বলে বেশি ধ্যান করলে ভূত চলে আসে!”
“নাহ,” মাথা নাড়ল জর্জ, “যারা এসব বলে ওরা জীবনেও ধ্যান করেনি। কাউকে না কাউকে তো ডাকতেই হতো এই বাড়িতে, তাই না? ফাদার ম্যানকুসো তো আর এলেন না! হয়তো এই মেয়েটা আমাদের সাহায্য করতে পারে…” কথাটা শেষ করতে পারল না জর্জ! তার আগেই চিৎকার করে উঠল ক্যাথি।
সিরামিকের সিংহমূর্তিটাকে জর্জ নিজের হাতে সেলাইঘরে রেখে এসেছিল! কিন্তু ওটা এখন ক্যাথির চেয়ারের পাশের টেবিলে বসে আছে! যেন দাঁত বের করে ভেংচি কাটছে ওদের দু’জনকে।