দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ৪

চতুর্থ অধ্যায় 

২২ ডিসেম্বর। 

সোমবার সকাল, অ্যামিটিভিলে রীতিমতো কনকনে শীত পড়েছে। লং আইল্যান্ডের এই অংশটা আটলান্টিক মহাসাগরের একদম ডানপাশে। উত্তর- পূর্ব দিক থেকে আসা সমুদ্রের ঝড়ো হাওয়া রীতিমতো সবকিছু জমিয়ে দিচ্ছিল। থার্মোমিটারে তাপমাত্রা আট ডিগ্রির কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে বড়োদিনের আগেই তুষারপাত শুরু হবে। আরেকটি হোয়াইট ক্রিসমাসের[৬] সাক্ষী হতে যাচ্ছে অ্যামিটিভিল। 

[৬. তুষারাবৃত বড়োদিনকে আমেরিকানরা হোয়াইট ক্রিসমাস বলে।]

ওদিকে ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার পরিবেশ তখন বেশ গম্ভীর। তিন তলার খেলার ঘরটাতে বসে খেলছে ড্যানি, ক্রিস আর মিসি। সারারাত কেঁদেছে বাচ্চাগুলো, মিসি তো একটু আগেও ফোঁপাচ্ছিল। এভাবে কখনও মা-বাবা ওদের মারেনি! তিন জনের মনই বেশ খারাপ। জর্জ আজও অফিসে যায়নি, নিচতলার বসার ঘরে ফায়ারপ্লেসের গনগনে আগুনে একের পর এক কাঠের গুঁড়ি ঢুকিয়ে যাচ্ছে ও। 

রান্নাঘরের টেবিলে একটা কাগজ আর পেনসিল নিয়ে বসেছে ক্যাথি। বড়োদিনের বাজারের ফর্দ বানাচ্ছে আরকি। অনেক কিছুই আছে কেনার, কিন্তু ওর মন বসছে না। গতরাতে বাচ্চাগুলোকে ওভাবে মারাটা ঠিক হয়নি তার… আর জর্জ এসে ওকে থামাবে না? তা করা বাদ দিয়ে ব্যাটা ওর সাথেই যোগ দিলো! কী হয়েছে ওদের? যা-ই হোক, অনেক জিনিসপত্র কেনা বাকি, বাচ্চাদের জন্য উপহার পর্যন্ত কেনা হয়নি! এগুলো ক্যাথিকেই কিনে আনতে হবে, জর্জকে তো ফায়ারপ্লেসের সামনে থেকে নড়ানোই যাচ্ছে না। কিন্তু এত কিছু কিনতে গেলে তো বাড়ির বাকি কাজগুলো মাটি হয়ে যাবে! কেন যেন এই বাড়িতে আসার পর থেকে আর বাইরে বের হতে ইচ্ছা করে না ক্যাথির… বাজারে যেতেও মন চায় না। 

হুম… ওর থেরেসা খালার জন্যও উপহার কিনতে হবে। ওনার নামটা লিখতে যাবে ক্যাথি… ঠিক তখনই কে যেন ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। চমকে উঠল ক্যাথি, পেনসিলটা পড়ে গেল বেচারির হাত থেকে। যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য কেউ আলিঙ্গল করল ওকে, তারপর ওর হাত ধরে আলতো করে একটা চাপড় মারল। ক্যাথি আবার চমকে উঠল কিন্তু ভয় পেল না। যেন কেউ ওকে ভরসা দিচ্ছে… আদর করে চাপড় মেরেছে। স্পর্শটা কেমন যেন মেয়েলি… ঠিক যেভাবে একজন মা নিজের মেয়েকে আদর করেন। ওর হাত দুটো যেন কোনো মহিলা আলতো করে ধরল। 

কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেল ক্যাথি, একবার পিছন ফিরে দেখতেও মন চাইল না ওর। 

“মা, তাড়াতাড়ি ওপরে এসো,” তিন তলার বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠল ক্রিস। ঘোরটা কেটে গেল ক্যাথির, পিছে তাকাল ও… কিন্তু সেখানে কেউ নেই! 

আশ্চর্য ব্যাপার। 

“মা…এসো,” আবার ডেকে উঠল ক্রিস। ওই অদৃশ্য স্পর্শের ব্যাপারে পরে মাথা ঘামানো যাবে, এখন ওপরে যাওয়া প্রয়োজন। তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় উঠে পড়ল ক্যাথি। বাচ্চা তিনটেই বাথরুমে, কমোডের সামনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। ক্যাথি গিয়ে দেখল কমোডের বেসিনের খানিকটা অংশ একদম কুচকুচে কালো হয়ে আছে… যেন কেউ ওপরের প্রান্ত থেকে গোল করে কালো রঙ লেপে দিয়েছে! হাতল টেনে ফ্ল্যাশ করল ক্যাথি, চারদিক থেকে বেরিয়ে এলো পানি… ধুয়ে গেল বেসিনটা। কিন্তু ওই কালো রংটা সরল না! 

খানিকটা টয়লেট পেপার ছিঁড়ে নিয়ে ওই অংশটাতে ঘষল ক্যাথি, কিন্তু কোনো ফল হলো না। 

“আজব ব্যাপার,” আপনমনে বলে উঠল সে, “কাল আমি নিজের হাতে ক্লোরক্স দিয়ে সব পরিষ্কার করেছি! তখন তো এসব কিছুই ছিল না! আচ্ছা… তোমরা কেউ দুষ্টুমি করে রং করোনি তো?” বাচ্চাদের দিকে ঘুরল সে। কেন যেন রাগ উঠছে ওর, ইচ্ছা করছে বাচ্চাগুলোকে আবার একটু পেটাতে। 

“না না, মা, আমরা কিচ্ছু করিনি,” একসাথে বলে উঠল ওরা তিন জন। 

ভালো করে কমোডটা খেয়াল করতে লাগল ক্যাথি, একটু আগে রান্নাঘরে ঘটে যাওয়া অপার্থিব ঘটনাটা একেবারেই সরে গেছে ওর মাথা থেকে। মুখ ধোয়ার বেসিন আর বাথটাবের দিকে তাকাল সে, ওদুটো রীতিমতো চকচক করছে। বেশ মন দিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করেছিল ক্যাথি… কিন্তু কমোডের বেসিনে এই অবস্থা হলো কী করে? তাহলে কি পানি দিয়ে ময়লা এসেছে? বাথটাবের পাশের কলটা ছেড়ে দিলো সে… নাহ, একদম পরিষ্কার পানি পড়ছে। আরেকবার কমোড ফ্লাশ করল, কিন্তু সেই কালো রংটা গেল না! 

নিচু হয়ে কমোডের ধারগুলো ভালো করে খেয়াল করল ও, কিন্তু না… ওখান থেকেও কিছু চুইয়ে পড়ছে না। উঠে দাঁড়াল ক্যাথি, তারপর ড্যানিকে বলল, “আমাদের দোতালার বাথরুম থেকে ক্লোরক্সটা নিয়ে এসো তো, মুখ ধোয়ার বেসিনের নিচের ছোট্ট ড্রয়ারটায় ওটা রাখা আছে।” 

ড্যানির সাথে মিসিও যেতে লাগল। 

“না না, মিসি তুমি এখানে থাকো,” বলে উঠল ক্যাথি, “আর ড্যানি ওখান থেকে ব্রাশটাও এনো।” বেরিয়ে গেল ড্যানি। 

ওদিকে ক্রিস ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে। 

“কী হয়েছে তোমার ক্রিস?” অবাক হলো ক্যাথি। 

“মা… আমি কিছু করিনি… আমাকে আবার মেরো না…” পানি এসে গেল ক্রিসের চোখে। খুব মায়া হলো ক্যাথির, গত রাতে বাচ্চাদের ওভাবে মেরে ঠিক করেনি ও! কী যে হয়েছিল ওর… বাচ্চাগুলো তো ভীতু হয়ে যাচ্ছে রীতিমতো। 

“না বাবা,” ক্রিসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো ও, “আমি জানি তো। তোমার কোনো দোষ নেই। মনে হয় পানিতেই কোনো সমস্যা হয়েছে। কে জানে, কোনো তেল-টেল বেরিয়ে আসছে না-কি। কিন্তু এটা তোমরা আগে খেয়াল করোনি?’ 

“একটু আগে বাথরুমে ঢুকে আমিই প্রথম খেয়াল করেছি,” পাশ থেকে বলল মিসি। 

“হুম আচ্ছা দেখি, ক্লোরক্স দিয়ে উঠে না-কি দাগটা। নইলে তোমাদের বাবাকে বলতে হবে। ও এসে…” 

“মা মা, এদিকে এসো,” দোতালার বারান্দা থেকে ডেকে উঠল ড্যানি।

“কী ব্যাপার ড্যানি?” বাথরুম থেকে মুখ বের করে বলল ক্যাথি, “ক্লোরক্স পাচ্ছ না? বললাম না বেসিনের নিচে আছে?” 

“ওটা পেয়েছি মা, কিন্তু তোমাদের বাথরুমেও ওই কালো দাগ… কী বাজে গন্ধ!” 

ক্রিস আর মিসিকে নিয়ে প্রায় দৌড়ে দুই তলায় নামল ক্যাথি। দোতালার বাথরুমটা শোবার ঘরের এক কোণে। বাথরুমে বাইরে নাক চেপে দাঁড়িয়ে রয়েছে ড্যানি। 

ঘরে ঢুকতেই মিষ্টি একটা গন্ধ পেল ক্যাথি, কোনো পারফিউমের গন্ধ সম্ভবত। থমকে গেল সে… গন্ধটা চেনার চেষ্টা করল। নাহ, এই গন্ধ একেবারেই অপরিচিত ওর! 

“আজব,” মাথা নাড়ল সে, “এমন কোনো পারফিউম তো আমার নেই!” 

ধীরে ধীরে বাথরুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। সাথে সাথে ঝাঁঝাল একটা বিশ্রী গন্ধ এসে আঘাত করল ওর নাকে! কী তীব্র সেই গন্ধ… রীতিমতো বমি এসে গেল ক্যাথির… কাশিও উঠে গেল। রীতিমতো ছিটকে বেরিয়ে এলো সে বাথরুম থেকে, তবে বেরোবার আগে কমোডের বেসিনের দিকে নজর পড়েছিল ওর… ভেতরটা একদম কুচকুচে কালো! 

নিচতলায় দৌড় দিলো ক্যাথি, জর্জকে ডাকতে হবে। ওদিকে বাচ্চারা চুপচাপ দোতালার বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইল। রাতের ঘটনার পর থেকে জর্জকে রীতিমতো ভয় পাচ্ছে ওরা। 

“জর্জ,” সিঁড়ির মুখে এসে ডাক দিলো ক্যাথি। 

“আবার কী হলো?” খেঁকিয়ে উঠল জর্জ, “দেখছ না আমি ব্যস্ত?” 

ফায়ারপ্লেসের সামনে ঝুঁকে বসে আছে জর্জ। দৌড়ে ওর কাছে চলে গেল ক্যাথি, “একটু এসো, ব্যাপারটা ভালো ঠেকছে না আমার। আমাদের বাথরুমে একটা সমস্যা হয়েছে… উফফ কী গন্ধ! ইঁদুর মরলেও মনে হয় এত বাজে গন্ধ হয় না। কমোডের বেসিন পুরো কালো!” 

জর্জের ওঠার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু হাত ধরে ওকে হিড়হিড় করে ওপরে টেনে নিয়ে চলল ক্যাথি। 

দোতালায় এসে জর্জ দেখল ওখানকার আরেকটা বাথরুমের কমোডের বেসিনও অমনই কালো হয়ে আছে! কিন্তু সেখানে কোনো গন্ধ নেই। 

শোবার ঘরের মিষ্টি গন্ধটা কিন্তু তখনও ছিল। 

“কী ব্যাপার? এটা কীসের গন্ধ?” বিরক্ত হলো জর্জ। 

দোতালার সবগুলো জানালা একে একে খুলে দিতে লাগল সে। 

“এ কী করছ জর্জ?” অবাক হলো ক্যাথি। 

“বেরিয়ে যাক গন্ধ… ভালো গন্ধ, বাজে গন্ধ… সব গন্ধ বের করতেই জানালা খুলে দিতে হয়। এভাবে জানালা বন্ধ রাখলে গন্ধ যাবে?” শোবার ঘরের সবগুলো জানালা খুলে পাশের ঘরটায় চলে গেল সে। জানালা খুলে দেওয়ার ভূতে পেয়েছে ওকে! 

“জর্জ,” এদিকে এসো সেলাইঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠল ক্যাথি। 

ক্যাথির সেলাইঘরে দুটো জানালা। একটা দিয়ে পিছনের অ্যামিটিভিল নদী আর নৌকা রাখার ছাউনিটা দেখা যায়। প্রথমদিন, রাত সোয়া তিনটায় ঘুম থেকে উঠে এটাই খুলেছিল জর্জ। আরেকটা ওদের ডানদিকের একটা বাড়ির একেবারে মুখোমুখি। ওই বাড়ি লোকেরা আবার এদিককার জানালাগুলো সবসময় বন্ধ রাখে। ওই জানালাটার ওপর প্রায় কয়েকশ মাছি রীতিমতো ভনভন করছে! 

“যিশুর কসম!” চমকে উঠল জর্জ, “মাছির অত্যাচার! এই সময়ে?”

“ওই পচা গন্ধটার কারণে আসেনি তো?” আস্তে করে বলল ক্যাথি। 

“তা হতে পারে। কিন্তু এতদিন তো মাছিরা বাঁচে না… এই তীব্র শীতে তো আরও না! আর তাছাড়া শুধু এই একটা জানালাতেই ওরা ভিড় কেন করল?” ঘরের চারপাশটা ভালো করে খেয়াল করল জর্জ, কোন রাস্তা দিয়ে এলো মাছিগুলো? ঘরের কোণে একটা দেওয়াল আলমারি রয়েছে। ওটার পাল্লা খুলে দেখল সে। নাহ, কোনো ফাটল বা ফাঁকফোকর নেই! 

“নাহ, ওদের ঢোকার কোনো রাস্তাই নেই এখানে,” গম্ভীরভাবে বলল জর্জ, “তারপরেও ধরে নিলাম এখান দিয়ে ওরা ঢুকেছে। এই আলমারিটা যদি বাথরুমের দেওয়ালের সাথে হতো তাহলে মোটামুটি উষ্ণতায় মাছিগুলো বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু এটার ওপাশে তো খোলা জায়গা,” আলমারির ভেতরের দেওয়ালে হাত দিলো সে, “অনেক ঠান্ডা… এই তাপমাত্রায় মাছি বেঁচে থাকার কথা না। আচ্ছা যা-ই হোক, ক্যাথি তুমি বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে যাও।” 

ওরা সবাই বাইরে চলে যাওয়ার পর সেলাইঘরের দরজাটা বন্ধ করে নদীর দিকের জানালাটা খুলে দিলো জর্জ। তারপর একটা পুরোনো খবরের কাগজ রোল করে মাছিগুলোকে তাড়াতে লাগল সে, কিছু মাছি খোলা জানালা দিয়ে পালিয়ে গেল। কিছু আবার থেকেই গেল, সেগুলো মারা পড়ল জর্জের হাতে। তারপর জানালার পাল্লা নামিয়ে দিলো সে। ততক্ষণে খোলা জানালাগুলো দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকে পুরো দোতালাটা হিমশীতল হয়ে গেছে! তবে পারফিউমের সেই মিষ্টি গন্ধটা আর নেই… বাথরুমের বিশ্রী গন্ধও খানিক কমেছে। 

সব জানালা বন্ধ করে আবার বাড়ি গরম করার কাজে লেগে পড়ল জর্জ। ফায়ারপ্লেসে আরও কিছু গাছের গুঁড়ি গুঁজে দিলো। 

“ঠান্ডা যাচ্ছে না ক্যাথি, একটু বেসমেন্টে ঘুরে আসি,” এই বলে চলে গেল জর্জ। কিছু বলল না ক্যাথি। মানা করে কাজ হবে না সেটা সে ভালো করেই জানে। অয়েল বার্নারটা পরীক্ষা করে এলো জর্জ, ওটা একদম ঠিক আছে। সন্ধ্যার দিকে নিচতলার বসার ঘরের থার্মোস্টাটের দিকে নজর পড়তে চোখ কপালে উঠল ক্যাথির! আশি ডিগ্রি তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ওখানে। 

কিন্তু জর্জের মন ভরছে না। 

ওদিকে কমোডগুলোর দাগ ক্লোরক্সে গেল না। বাধ্য হয়ে ফ্যান্টাসটিক আর লাইজলও দিয়ে দেখল ক্যাথি। এবার খানিকটা কাজ হলো, তবে কালো দাগ পুরোপুরি গেল না। ব্রাশ দিয়ে জোরে জোরে ঘষল অনেকবার… কিন্তু কিছু দাগ থেকেই গেল! যেন ওগুলো একেবারে স্থায়ীভাবে বসে গেছে! সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়ে রইল সেলাইঘরের পাশের বাথরুমটার। 

বাইরের তাপমাত্রা ততক্ষণে বেড়ে বিশ ডিগ্রি হয়েছে। বাচ্চারা হ্যারির সাথে বেশ মজা করে খেলতে লাগল। নৌকা রাখার ছাউনিটার কাছে ওদের যেতে মানা করেছিল ক্যাথি, ওদিকে নদী তো। ভুলক্রমে কেউ যদি পড়ে যায়? বড়ো কেউ সাথে না থাকলে ওখানে বাচ্চাদের খেলা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। 

**** 

সন্ধ্যার আগ দিয়ে গ্যারেজে জমা করা কাঠের গুঁড়িগুলোর মধ্যে বেশ অনেকটাই ভেতরে নিয়ে এসেছে জর্জ। বোঝাই যাচ্ছে সারারাত ওগুলো ফায়ারপ্লেসে ঢোকাবে ও। বর্তমানে মুখটা গোমড়া করে রান্নাঘরে ক্যাথির সামনে বসে আছে সে। একটু আগেই বড়োদিনের উপহারগুলো কে কিনতে যাবে, এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়েছে ওদের। 

পাঁচ-সাত মিনিট চুপ থাকার পর জর্জ বলে উঠল, “অন্তত তোমার মায়ের জন্য পারফিউমটাও তো কিনতে যেতে পারো, তাই না? আর কিছু না পারলেও এটা তো পারা উচিত তোমার।” 

“তাই না?” মুখ ঝামটা মেরে বলল ক্যাথি, “আমার অত সময় নেই। দেখছ না? পুরো বাড়িটাকে গোছাচ্ছি? তোমাকে তো এ ক’দিন কোনায় বসে থেকে কাঠ পোড়ানো আর উদ্ভট কারণে গজগজ করা ছাড়া আর কিছু করতে দেখলাম না। তুমিই যাও?” 

আবার শুরু হলো তর্ক। কিন্তু বড়োদিনের আগে কী আর এসব ঝগড়া মানায়? তাই একটা সময় দু’জনেই চুপ মেরে গেল। হুট করেই ক্যাথির মনে হলো সকালবেলার সেই ‘অদৃশ্য আলিঙ্গনের’ ব্যাপারে জর্জকে খুলে বলা উচিত। তখনই দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল। 

দরজা খুলে দিলো জর্জ। যে লোকটা দাঁড়িয়েছিল তার বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের আশেপাশে। মাথার চুল উঠে গিয়ে বিরাট বড়ো টাক পড়ে গেছে, রুক্ষ চেহারা, নাকটা অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে লাল হয়ে আছে। হাতে ছয় বোতল বিয়ারের একটা পেটি। 

“দেখা করতে এলাম বুঝলেন,” কোনোমতে মুখে হাসি ফোটাল ব্যাটা, “পাড়ার সকলেই আপনাদের সাথে দেখা করতে চায়, কিন্তু ঠিকঠাক সময় করতে পারছে না। একদিন সময় করে আমরা আসব। আপনারা বিরক্ত হবেন না তো?” 

লোকটা পরনে হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে পড়া পশমের কোট, সস্তা কাপড়ের প্যান্ট… সাধারণত এই অঞ্চলের গাড়োয়ানরা এসব পরে। পায়ে ভারী বুট, নির্মাণশ্রমিকেরা যেমনটা পরে। অবাক হয়ে গেল জর্জ! এই লোক এই অঞ্চলের কোনো বাড়ির মালিক তো হতে পারে না… এখানে সব টাকাওয়ালা লোকেরাই থাকে। 

অবশেষে তাহলে প্রতিবেশীরা ওদের সাথে দেখা করতে চায়! ওদের বাড়ির দিকের জানালাগুলো কেন বন্ধ করে রাখে সবাই? ওরা যখন বাড়িতে মালামাল আনছিল তখনও কেউ সাহায্য করতে আসেনি। প্রতিবেশীদের এই উদ্ভট আচরণ নিয়ে ডিয়ার পার্কের বাড়িটায় বেশ কয়েকবার আলোচনা করেছিল জর্জ আর ক্যাথি। কিন্তু এখানে আসার পর আর মাথা ঘামায়নি ওরা। 

“আরে কী যে বলেন, আমরা কেন বিরক্ত হব? আসুন আসুন,” মেকি হাসি ফুটে উঠল জর্জের মুখে, “তবে বুঝলেন, আমাদের বাড়িতে কিন্তু বেশি চেয়ার নেই। আপনারা সবাই যখন আসবেন, অনেককেই কার্ডবোর্ডের ওপর বসতে হতে পারে। অসুবিধা নেই তো? হাহা… হাহা।” 

লোকটাও হেসে উঠল। 

ওকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে ক্যাথির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো জর্জ। লোকটা তেমন মিশুক না, কথাবার্তাও গুছিয়ে বলতে পারে না। জর্জ আর ক্যাথি মামুলি কিছু কথা তুলল, সেগুলোর সাথেও তাল মেলাতে পারল না ব্যাটা। ও শুধু একটা লাইন বার বার বলছিল, “এই ওশান অ্যাভিনিউ থেকে খানিকটা দূরেই এক লোকের বাড়ির ছাউনিতে আমি আমার নৌকাটা রাখি!” 

অবাক লাগছিল ক্যাথির। এই কথা ওদের বারবার বলার কী দরকার? 

“আচ্ছা এগুলো আমি এনেছিলাম না?” বিয়ারের পেটিটা হাতে তুলে নিয়ে বলল সে। 

“হুম, আপনিই এনেছিলেন, “ ভ্রু কুঁচকে গেল জর্জের। 

“আচ্ছা, তাহলে আমিই নিয়ে যাচ্ছি, আজ তবে যাই? ঠিক আছে?” এই বলে বেরিয়ে গেল লোকটা। 

ও চলে যাওয়ার পর জর্জ আর ক্যাথির খেয়াল হলো যে লোকটার নামই জানা হয়নি ওদের! যা-ই হোক, ওই লোকটার সাথে আর কখনও দেখা হয়নি ওদের। 

সেদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে জর্জ নিজের হাতে বাড়ির ভেতর এবং বাইরের যাবতীয় দরজা, জানালা, তালা এবং ছিটকিনিগুলো লাগিয়ে দিলো। প্রতিদিনের মতো সেদিনও রাত সোয়া তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে গেল ওর। কেন যেন খুব ইচ্ছা করছিল নিচে গিয়ে সবকিছু একবার দেখে আসতে, কোনো তালা বা ছিটকিনি বাদ পড়ে গেল না তো? অনেক চেষ্টা করেও ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখতে পারল না সে। 

নিচে নামল। তার জন্য অপেক্ষা করছিল এক উদ্ভট দৃশ্য! 

জর্জ অবাক হয়ে দেখল যে আড়াইশো পাউন্ড ওজনের কাঠের সদর দরজাটা হাট হয়ে খুলে একটা কবজার সাথে ঝুলছে! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *