দ্বাদশ অধ্যায়
৩১ ডিসেম্বর।
১৯৭৬ সাল প্রায় এসেই গেল। ৭৫ সালের শেষ দিনটায় এসে প্রবল তুষারপাত শুরু হয়েছে। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, দোকানপাট সবকিছুই ঢেকে গেছে বরফে। অনেকের মতেই এটা নাকি আগামী বছর ভালো যাওয়ার পূর্বাভাস!
ওদিকে লুৎজ পরিবারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। গত দুই দিন বেশ ব্যস্ত গেছে জর্জের, বাড়ি এবং বাড়ির বাইরে প্রচুর কাজ করেছে। কিন্তু তারপরেও রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আজ রাতেও ঘুমটা ভেঙে গেল! জর্জ অবাক হয়ে খেয়াল করল ঘড়িতে সোয়া তিনটার বদলে আড়াইটা বাজে! চুপচাপ আবার শুয়ে পড়ল সে। খানিক পড়েই ঘুম এসে গেল।
সাড়ে চারটার দিকে আবার ঘুম ভাঙল। বাইরে পুরোদমে তুষারপাত চলছে। কম্বলটার ভেতরে আরও খানিকটা ঢুকে গেল জর্জ, এপাশ-ওপাশ করল। কিন্তু ঘুম আর এলো না। জর্জের নড়াচড়ার কারণে ক্যাথির ঘুমে সমস্যা হলো, এমনভাবে সরে এলো সে… যাতে করে জর্জ একদম বিছানার কোনায় চলে এলো। এই অবস্থায় ঘুমানো যায়? জেগে জেগে ভাবতে লাগল জর্জ। প্রচণ্ড আর্থিক সমস্যায় পড়েছে ওরা, এখন কোথাও থেকে টাকা এলে ব্যাপারটা মন্দ হতো না! কিন্তু কে দেবে টাকা? আচ্ছা, এই বাড়িতে না কি লুকানো টাকা ছিল? সেগুলোর লোভেই তো খুন করেছিল রনি? তাই না? ইশশশ! টাকাগুলো যদি জর্জ পেত।
একগাদা বিল জমা হয়েছে, সেগুলোর কথা ভাবলে জীবনটাই অসহ্য লাগে জর্জের। নতুন বাড়িটা নেওয়াতে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে, বছরের শুরুরেই অফিসের কর্মচারীদের বেতন আর নববর্ষের বোনাস দিতে হবে। ও আর ক্যাথি মিলে বাড়িতে যে টাকাগুলো জমিয়েছিল তা পুরোনো বাড়িটার নানান বিল মেটাতেই চলে গেছে; নৌকাগুলো আর মোটরসাইকেল নিয়ে আসতেও খরচ হয়েছে অনেক টাকা। গাড়ির তেলের পিছনেও টাকা যাচ্ছে। ৭ তারিখে অফিসে আবার আসবে কর বিভাগের ওই পরিদর্শক… ব্যাপারটা রীতিমতো ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হতে যাচ্ছে যাচ্ছে ওর জন্য। আচ্ছা, জিমির টাকার ওই খামটা খুঁজে পেলেও তো মন্দ হতো না! জিমিকে এক হাজার ডলার ধার দিয়েছে সে, ওই হিসেবে ওখানকার এক হাজার ডলার তারই। বাকি পাঁচশ ডলারও ওকে বুঝিয়ে রেখে দেওয়া যেত। এই অভাবের সময়ে পনেরশ ডলার অনেককিছু! জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে তুষারপাত দেখতে লাগল জর্জ। খবরের কাগজে ও পড়েছে মি. ডিফেও মানে রোনাল্ড ডিফেও সিনিয়র বেশ বড়োলোক ছিলেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অনেক টাকা ছিল ভদ্রলোকের। এছাড়া শ্বশুরের বিরাট গাড়ির কারবারেরও অংশীদার ছিলেন তিনি।
শোবার ঘরের দেওয়াল আলমারির দরজার ঠিক নিচে জর্জ একটা চোরা- কুঠুরি খুঁজে পেয়েছে। অবশ্য রনিকে গ্রেপ্তার করার সময়ই পুলিশই প্রথম ওটা খুঁজে পায়। কিন্তু ওর ভেতর কোনো টাকাপয়সা পাওয়া যায়নি। এমনও তো হতে পারে যে অন্য কোথাও টাকা লুকিয়ে রেখেছিলেন মি. ডিফেও? টাকাগুলো খুঁজে পেলে কী যে উপকার হতো! এই বাড়ি এখন ওদের, তাহলে টাকাগুলোও তো ওদের পাওয়া উচিত!
নৌকা রাখা ছাউনিটা! হুট করে রীতিমতো উঠে বসল জর্জ। প্রতি রাতে কেন ওর ওখানে যেতে মন চায়? নিজের ইচ্ছায় যায়? না কি অন্য কারও ইচ্ছায়? তাহলে কি মৃত ভদ্রলোক ওকে নিজের লুকিয়ে রাখা সম্পদের খবর জানাতে চান? অন্য সময় হলে এসব উদ্ভট কল্পনাকে পাত্তাই দিত না জর্জ, কিন্তু সেই রাতটা… একটু আলাদাই ছিল। ওর শুধুই মনে হচ্ছিল, প্রতি রাতে এমনি এমনি ও ছাউনিটার কাছে যায় না… হয়তো কোনো অপার্থিব শক্তি ওকে টেনে নিয়ে যায়। এভাবেই ভোর সাড়ে ছ’টা বেজে গেল। বিছানা থেকে উঠে পড়ল জর্জ, আর ঘুম আসবে না। ঘর থেকে বেরিয়ে নিচতলায় এলো সে। রান্নাঘরে বেশ সময় নিয়ে এক কাপ কফি বানাল।
বাইরে তখনও রীতিমতো অন্ধকার। রান্নাঘরের দরজার কাছে বরফের একটা ছোটোখাটো ‘পাহাড়’ জমেছে রীতিমতো। পাশের বাড়িতেও একটা ঘরে আলো জ্বলছে। হয়তো ওটার মালিকও টাকার চিন্তায় ঘুমাতে পারছে না… আমেরিকার লোকেদের আজকাল বিল পরিশোধ করার চিন্তাই বড়ো চিন্তা। মনে মনে হাসল জর্জ।
আজ আর অফিস যাবে না সে। সব কর্মচারীরা তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে নেবে, কাজ তেমন আর হবে না। বছরের শেষ সন্ধ্যাটা পরিবারের সাথেই কাটাতে ভালোবাসে সবাই, কেউ কেউ বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসে। কফিটা শেষ করে ও ভাবল যে ছাউনি আর বেসমেন্টটা একটু ভালো করে খুঁজে দেখবে। হঠাৎ করে পুরো বাড়িটা একটু বেশিই যেন ঠান্ডা হয়ে এলো… কেঁপে উঠল জর্জ।
গরম বেড়ে গেলে থার্মোস্টাট নিজে থেকেই রাত বারোটা থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত তাপমাত্রা কমাতে থাকে। ছ’টার পর থেকে আবার ঘর গরম করতে শুরু করে, এখন প্রায় সাতটা বেজেছে। মনে হচ্ছে যন্ত্রটা ঠিকমতো কাজ করছে না। বসার ঘরে গিয়ে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালাবার জন্য কিছু কাগজ আর কাঠ দিলো জর্জ। আগুন জ্বলে ওঠার একটু আগে সে খেয়াল করল ফায়ারপ্লেসের পিছনের ইটের দেওয়ালটায় কেমন যেন কালি পড়ে আছে। ঘুমানোর আগে তো কালি পরিষ্কার করেই ঘুমিয়েছিল জর্জ! তাহলে? রাতে কেউ আগুন জ্বালিয়েছিল না কি?
বাইরে একগাদা বরফ দেখে মাকে ঘুম থেকে রীতিমতো টেনে তুলল মিসি।
“মা মা, ওঠো, দেখো বাইরে কত্ত বরফ! সুন্দর লাগছে না? আজ আমি বাইরে গিয়ে স্লেজ নিয়ে খেলবোই খেলব,” এই বলে ক্যাথির কপালে চুমু খেলো সে। আটটার দিকে মিসিকে সাথে করে নিচে নামল ক্যাথি। মিসির জন্য নাস্তা তৈরি করে ওকে খেতে বসিয়ে দিলো সে, কিন্তু নিজে তেমন কিছুই খেলো না। এক কাপ কফি বানিয়ে সিগারেট ধরাল।
“ক্যাথি, এক কাপ কফি দিয়ে যাও তো,” বসার ঘর থেকে চেঁচাল জর্জ।
“আমার মাথা ধরেছে জর্জ,” তুমি একটু রান্নাঘরে এসো।
কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরে এসে জর্জ কফি নিল।
সাধারণত এই সময়ে ক্যাথি নিজেই বসার ঘরে গিয়ে জর্জকে কফি দিয়ে আসে, কিন্তু ওই সিংহ মূর্তির ঘটনাটার পর থেকে ওখানে যেতে ভয় লাগে ওর। তবে হ্যাঁ, মাথা ধরার ব্যাপারটা সত্যি। ঘুম থেকে ওঠার পরেই চিনচিনে একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাথির মাথায়।
নয়টা বাজতে বাজতে বসার ঘরের আগুনটা রীতিমতো গনগনে রূপ ধারণ করল। দশটার দিকেও তুষারপাত থামল না।
“জর্জ,” রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠল ক্যাথি, “রেডিয়োতে বলছে যে আজ রাতের মধ্যেই অ্যামিটিভিল নদী পুরোপুরি জমে যাবে!”
বিরক্ত হয়ে জামা-কাপড় আর বুট পরে বাইরে এলো জর্জ। নৌকা রাখার ছাউনিতে স্পিডবোটটা বেশ ভালো অবস্থাতেই আছে। কিন্তু কেবিন ক্রুজারটা নদীতেই ভাসছে, ওটাকে একটা দড়ি দিয়ে পাটাতনের সাথে বেঁধে রেখেছে জর্জ। অত বড়ো জিনিসটাকে ভেতরে তুলে আনতে অনেক খরচ হবে, সেই টাকা নেই ওর। নদীর পানি জমে গেলে চাপের কারণে দামি জিনিসটার অনেকটাই ভেঙে যাবে। কিন্তু জর্জের মাথায় একটা বেশ ভালো পরিকল্পনা রয়েছে।
নিজের পেইন্ট কমপ্রেসরটা কী যেন ভেবে ছেলেকে দিয়ে দিয়েছিলেন জর্জের মা। যন্ত্রটার একটা প্লাসিক হোস পাইপে বেশ ক’টা ফুটো করে নিয়েছে জর্জ। পাইপটাকে কেবিন ক্রুজারের পাশের পানিতে ডুবিয়ে, যন্ত্রটা চালু করে দিলো জর্জ। পাইপের ফুটাগুলো দিয়ে অসংখ্য বুদ্ বেরিয়ে এলো। যন্ত্রটাকে ওভাবেই রেখে চলে এলো জর্জ। সারাটাদিন এখন ওভাবেই বুদ্ উঠবে আর এই কারণে আশেপাশের পানি অত সহজে জমবে না।
***
সকাল থেকেই হাতের তালু বারবার পরীক্ষা করছেন ফাদার ম্যানকুসো। রাতের বেলা কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছিল হাতগুলো, সেই ভাবটা আর নেই, তবে লালচে ফোসকাগুলো থেকেই গেছে।
জ্বর এখনও একশ তিন। প্রধান যাজক একটু আগেই এসেছিলেন ওনাকে দেখছে। ভদ্রলোককে তিনি কথা দিয়েছেন যে সারাদিন বিছানা থেকে উঠবেন না। যদিও হাতের ব্যাপারে কিছুই জানাননি ফাদার ম্যানকুসো, পুরোটা সময়ই আলখাল্লার পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
প্রধান যাজক চলে যাওয়ার পর পকেট থেকে হাত বের করলেন ফাদার ম্যানকুসো। তালুর দিকে চাইতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। অ্যামিটিভিলের ওই অপয়া বাড়িটাতে মাত্র একবার যাওয়ার জন্য এত দুর্ভোগ? কেন? কেন এসব হচ্ছে? ঈশ্বরের পথে প্রাণ দিতেও কোনো দ্বিধা করবেন না তিনি, কিন্তু সেই প্রাণের বিনিময়ে অন্য কারও প্রাণ তো বাঁচাতে হবে? তাই না? শুধু শুধু প্রাণ দিয়ে কী হবে? বাড়িটার সমস্যা কী? দীর্ঘকাল ধরে যাজকের কাজ করছেন তিনি, ভূত-প্রেত তাড়ানোর হালকা প্রশিক্ষণও নিয়েছেন… কিন্তু এমন ঝামেলায় কখনোই পড়েননি! রাগ উঠছে তার… এ এক অর্থহীন ক্রোধ
রাগের সাথে সাথে হাতের তালুর ব্যথাটাও বাড়তে শুরু করল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার কোনো বিকল্প নেই, একমাত্র তিনিই পারেন পথ দেখাতে। ঈশ্বরের কথা ভাবতেই রাগটা কমে এলো। হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসলেন তিনি, দুই হাত মুঠি পাকালেন। না, এখন আর তেমন ব্যথা করছে না!
উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হাতের মুঠি খুললেন ধীরে ধীরে, তারপর ফোসকাগুলো দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
“হে ঈশ্বর আপনাকে ধন্যবাদ,” চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো ফাদারের, “সবই আপনার পরীক্ষা, আমি জানি!”
আবার হাঁটু গেড়ে প্রার্থনায় বসলেন তিনি।
***
সেদিন দুপুরবেলা ড্যানি আর ক্রিস ক্যাথিকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে বসল, যে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে। এর আগেও একবার এমন করেছিল তারা, ডিয়ার পার্কের বাড়িতে থাকার সময়। সেইবার মিথ্যা বলার অপরাধে ওদের দু’জনকে এক সপ্তাহ বাড়ি থেকে বাইরে না বের হওয়ার শাস্তি দিয়েছিল জর্জ, এই সময়ে টিভি দেখাও বন্ধ। দুই ছেলেই রেগে-মেগে বলেছিল জর্জের হুকুম তারা মানবে না। টিভি যদি দেখতে না দেওয়া হয় তবে ওরা বাড়ি থেকে চলে যাবে। জর্জও জানিয়ে দিয়েছিল যে সে যা করছে ওদের ভালোর জন্যই করছে। ওদের ইচ্ছা হলে বাড়ি থেকে চলে যেতে পারে, জর্জের কোনো সমস্যা নেই।
রাগের মাথায় দুই ছেলেই নিজেদের সমস্ত কাপড়, খেলনা, ক্যাসেট, ম্যাগাজিন, গল্পের বই ইত্যাদি বিছানার চাদরে বোচকা বেঁধে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল। সদর দরজা দিয়েই বেরিয়েছিল ওরা, জর্জ দেখেও আটকায়নি। বাড়ির সামনের রাস্তাটা একটু পেরোতেই ভারী বোচকাদুটোর ওজনে রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়ল বাচ্চাদুটো, হাঁটতেই পারছিল না। এই সময়ে একজন প্রতিবেশী তাদের দেখে ফেলে, তারপর বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এরপর থেকে আর কখনও এমন ছেলেমানুষি করেনি ওরা, কিন্তু এতদিন পর আবার…
রান্নাঘর থেকে তিন তলায় ঝগড়া আর মারপিটের শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠল ক্যাথি। গিয়ে দেখে ড্যানির বিছানায় ওর বুকের ওপর উঠে ঘুসি মারতে চলেছে ক্রিস। ওদিকে পাশের বিছানায় বসে খুশিতে হাততালি দিচ্ছে মিসি… যেন কুস্তি দেখে বেশ মজা পাচ্ছে সে!
দুই ছেলেকে টেনে ছাড়াল ক্যাথি।
“কী ব্যাপার হ্যাঁ?” চেঁচিয়ে উঠল ও, “মানে পেয়েছটা কী তোমরা? পাগল হয়ে গেছ? না কি বাড়িটাকে কুস্তির আখড়া মনে হয়? হুম?”
“তুমি না বলেছিলে যে ড্যানি আজ ঘর গুছাবে? সেই কথা বলাতেই রেগে উঠেছে ও,” পাশ থেকে বলল মিসি।
একদৃষ্টিতে ড্যানির দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইল ক্যাথি, তারপর বলল, “কেন? কেন ঘর গুছাবে না? ঘরের অবস্থা দেখেছ? এটা ঘর? না জঙ্গল?”
ঘরের অবস্থা আসলেই খুব বাজে। মেঝে আর বিছানার এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে খেলনা। গোসল করার আগে নিজেদের ছাড়া পোশাকগুলো মেঝেতেই ফেলে রাখে ড্যানি আর ক্রিস। সেগুলোও পড়ে আছে, উৎকট গন্ধ আসছে রীতিমতো। ক’দিন আগে কিনে দেওয়া রং-তুলি সেটের তুলিগুলোর খোঁজ নেই, রঙের কৌটাগুলো একপাশে জমা করে রাখা, সেগুলো দিয়ে রং পড়ে ভিজে গেছে গালিচা, বড়োদিনে কিনে দেওয়া অনেক খেলনাই নষ্ট হয়ে ভেঙে গেছে সেগুলোও কোনাতে জমা করা।
“তোমাদের নিয়ে যে কী করি,” হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল ক্যাথি, “এত সুন্দর একটা বাড়ি কিনলাম, তোমাদের আলাদা খেলাঘর পর্যন্ত আছে… তা-ও…”
ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল ড্যানি, “ওই ফালতু খেলাঘরে খেলতে আমার ভালো লাগে না!”
“একদম,” ওর সাথে গলা মেলাল ক্রিস, “এই পুরো এলাকাটাই আমাদের ভালো লাগে না, কেউ আমাদের সাথে খেলতে আসে না!”
আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ক্যাথির। আরও কয়েক মিনিট চলল ওদের তর্কাতর্কি। অবশেষে তর্কে না পেরে ড্যানি বলে উঠল, “আমরা আর এই বাড়িতে থাকব না, চলে যাব!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখা যাবে। একবার তো চেষ্টা করেছ, পেরেছিলে কী? দাঁড়াও তোমাদের বাবাকে বলে এমন ব্যবস্থা করছি যে দু’জনের কারও পিঠে চামড়া থাকবে না।”
সন্ধ্যার দিকে বাড়ির পরিবেশ খানিকটা ঠান্ডা হলো। ড্যানি আর ক্রিস রীতিমতো চুপচাপ। ওদেরকে নাস্তার টেবিলে ডেকে নিয়ে গেল ক্যাথি। আজকে টেবিলের পরিবেশ কেমন যেন থমথমে। ক্যাথি জর্জকে সাথে নিয়ে ওর মায়ের বাড়িতে যেতে চেয়েছিল।
কিন্তু জর্জ বলেছে, “আরে ক্যাথি, অত দূর থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। আজ তো মদ খেয়ে সব ট্রাক ড্রাইভার মাতাল হয়ে গাড়ি চালাবে… এই সময়ে রাস্তায় গাড়ি চালানো বেজায় ঝামেলা।”
“তাহলে চলো কাছে কোনো বন্ধুর বাড়ি যাই? নববর্ষের আগের রাত এমন নিরামিষ হলে চলে?”
“আশেপাশে কোনো বন্ধুর বাড়ি নেই আমাদের। ভুলে গেলে না কি?”
“তাহলে চলো রাস্তার পর্দায় সিনেমা দেখি?”
“এই ঠান্ডায়? মাথা খারাপ তোমার? বাড়িতেই থাকো।”
ক্যাথির মনটা তখন থেকেই খারাপ। চুপচাপ খাওয়া শেষ করল সবাই।
“বলছিলাম কী জর্জ, সিরামিকের সিংহটা সেলাইঘরে রেখে আসবে?” বলল ক্যাথি।
“হুম, দাঁড়াও,” উঠে দাঁড়াল জর্জ, ক্যাথির একগাদা প্রস্তাব সন্ধ্যায় নাকচ করে দিয়েছে সে। এটাও নাকচ করলে দাম্পত্য কলহ বেধে যাবে।
সিংহটা রাখতে গিয়ে জর্জ দেখে আবার নদীর দিকে মুখ করা জানালাটায় মাছি জমেছে। রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে গেল সে, কাগজের একটা রোল নিয়ে হামলা চালাল মাছিগুলোর ওপর। কিছু মরল, বেশিরভাগই পালাল। বেশ জোরে দরজাটা বন্ধ করে গজগজ করতে করতে একতলায় নামল জর্জ।
দশটা বাজতে বাজতে বসার ঘরের মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ল মিসি। ক্যাথি কথা দিয়েছে যে সে মিসিকে রাত বারোটার একটু আগেই জাগিয়ে দেবে। বড়োদিনে উপহার পাওয়া নিজের ছোট্ট বাঁশিটা বাজিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেবে মিসি। ড্যানি আর ক্রিস তখনও জেগে আছে, ক্রিসমাস ট্রির নিচে খেলতে খেলতে টিভি দেখছে ওরা, টিভিতে বেশ পুরোনো একটা সিনেমা হচ্ছে।
জর্জ যথারীতি ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে একমনে কী যেন ভাবছে। ওর পাশেই বসে আছে ক্যাথি, দুয়েকবার জর্জের সাথে গল্প করার চেষ্টা করেছে সে, জর্জ কোনো আগ্রহ দেখায়নি। বাধ্য হয়ে টিভি দেখছে সে।
***
রাত বাড়ার সাথে সাথে ফাদার ম্যানকুসোর হাতের ব্যথাটাও আবার ফিরে এলো। ফাসকাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ, ধীরে ধীরে ওগুলো যেন ফোঁড়াতে পরিণত হচ্ছে, ধীরে ধীরে হাতের উলটাপিঠেও ছড়িয়ে পড়ছে সেগুলো। না না, ব্যাপারটা আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। এই ব্যথা নিয়ে রাত কাটানো একেবারেই অসম্ভব।
প্রধান যাজক আবার ডাক্তার ডেকেছেন।
একটু পরেই এসে গেলেন তিনি। ম্যানকুসোর জ্বরের কী অবস্থা তা জিজ্ঞাসা করতেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে ফাদার বললেন, “দেখুন তো, কী হয়েছে!”
খুব ধীরে ধীরে মন দিয়ে ফোসকাগুলো পরীক্ষা করলেন ডাক্তার, ভ্রু কুঁচকে গেল তার, “দেখুন ফ্রাংক, আমি তো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ নই, তাই ঠিক বুঝতে পারছি না… তবে এতটুকু বলতে পারি এসব অ্যালার্জির কারণেও হতে পারে…. আমার দুশ্চিন্তার কারণেও হতে পারে। আপনি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন? খুব বেশি?”
***
“তা বলতে পারেন, “ আস্তে করে জানালার দিকে তাকালেন ফাদার, বাইরে বেশ জোরেই তুষারপাত শুরু হয়েছে, “হয়তো কেউ আমাকে ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করছে,” আবার ডাক্তারের দিকে মুখ ঘুরালেন তিনি, “কিংবা কিছু একটা…
“ভাববেন না, কাল সকালের মধ্যেই আপনার শরীর অনেকটাই ভালো হয়ে যাবে,” এই বলে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার। ওনাকে আবার একটা নববর্ষের পার্টিতে যেতে হবে।
***
ওদিকে টিভিতে দেখাচ্ছে গাই লোম্বারদো[৯], ওয়ালড্রফ অ্যাস্টোরিয়া হোটেলে নববর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। লুৎজরা টিভিতে দেখছিল সবকিছু। টাইম স্কোয়ারের অ্যালায়েড কেমিক্যাল ভবনে একের পর ঘণ্টার বাড়ি পড়ছে। উপস্থাপক বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন গ্রয়ার গুনে গুনে বিদায় জানালের ১৯৭৫ সালের শেষ দশটি মুহূর্তকে।
[৯. কানাডিয় প্রখ্যাত বেহালাবাদক।]
আধ ঘণ্টা আগেই শোবার ঘরে চলে গেছে ড্যানি আর ক্রিস। অনেকক্ষণ টিভি দেখে আর জর্জের ফায়ারপ্লেসের ধোঁয়ার কারণে ওদের চোখগুলো রীতিমতো লাল হয়ে গেছিল। বারোটার আগেই মিসিকে জাগিয়ে দিয়েছিল ক্যাথি, কিন্তু একটু পরেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ওকে কোলে করে দোতালায় শুইয়ে দিয়ে আবার নিচে নেমে এসে জর্জের পাশের চেয়ারে বসল ক্যাথি।
বারোটা এক বাজে। নতুন বছরের প্রথম মিনিট। এক দৃষ্টিতে ফায়ারপ্লেসের দিকে চেয়ে রইল ক্যাথি, আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে কাঠগুলো… লেলিহান শিখার নাচানাচি বড়োই অদ্ভুত। ঠিক তখনই সে খেয়াল করল ব্যাপারটা… আগুনের মধ্যে অদ্ভুত একটা কিছু যেন তৈরি হচ্ছে… কয়লায় কালো দেওয়ালের সামনে যেন সাদা একটা অবয়ব ফুটে উঠছে… ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে সেটা। মুখ… চোখ… নাক… কান… শিং!
চিৎকার করে জর্জকে ডাকতে চাইল ক্যাথি, কিন্তু ওর গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না। যেন কেউ বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে মেয়েটার। ফায়ারপ্লেসের দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের মধ্যে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকা দৈত্যটার দিক থেকে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না সে।
দৈত্যটার মাথায় একটা চোখা সাদা টুপি। আরও বড়ো হচ্ছে ওটা, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওর দিকে! পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ক্যাথি… মাথার অর্ধেকটা বিকৃত! কান আর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে… চোখদুটোও গেলে দেওয়া… যেন কেউ খুব কাছ থেকে শটগান দিয়ে গুলি চালিয়েছে ওর ওপর।
“জর্জ! ও জর্জ!” অবশেষে চেঁচিয়ে উঠল ক্যাথি।
“কী হলো আবার?” মুখ তুলে চাইল জর্জ।
কিছু বলতে পারল না ক্যাথি, শুধু আঙুল তুলে দেখাল… জর্জ দেখতে পেল একটা সাদা ধোঁয়াটে মূর্তি আগুনের পিছনে কাঠের গুঁড়িগুলোর সাথে আস্তে আস্তে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে!