একবিংশ অধ্যায়
১০ জানুয়ারি।
শনিবার সকাল। হুট করেই বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে মাকে ফোন করে বসল ক্যাথি, “মা, তুমি এখনই আমাদের এখানে চলে এসো! এখনই!”
“কী হয়েছে ক্যাথি?” অবাক হলেন মিসেস কনার্স।
“কী হয়েছে সেটা ফোনে বলে বোঝাতে পারব না!” প্রায় কেঁদে ফেলল ক্যাথি, “তুমি এসো! দয়া করে একবার এসো!”
অবশেষে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ইস্ট ব্যাবিলন থেকে অ্যামিটিভিলে এলেন জোয়ান কনার্স।
দরজাটা জর্জই খুলল।
“মা,” গম্ভীর মুখে বলল সে, “ক্যাথি ওপরে আছে, আপনি সোজা দোতালায় চলে যান।” তারপর খাবার ঘরে এসে বাচ্চাদের নাস্তা খেতে দিলো। কোনো একটা কারণে সে নিজেও বিব্রত।
“তোমরা খেয়ে নাও, আর শোনো… ওপরে যেয়ো না, তোমাদের নানি এসেছেন,” আস্তে করে বলল সে, “আমি ওপরে যাচ্ছি, কেমন? “
“আচ্ছা বাবা,” উত্তর দিলো ড্যানি। মাথা নিচু করে নাস্তা খেতে লাগল ওরা, সকাল থেকে বেশ চুপচাপ সবাই। কাল রাতের পর থেকেই ওদের এই অবস্থা, তবে হ্যাঁ… কেউই ঠান্ডা লেগে অসুস্থ হয়ে পড়েনি।
শোবার ঘরে ঢুকে জর্জ দেখল যে মিসেস. কনার্স ক্যাথির দিকে ঝুঁকে বসে আছেন। বিছানায়, খোলা বাথরোবের ওপর নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে ক্যাথি। ওর যোনির একটু ওপর থেকে স্তনের নিচ পর্যন্ত লাল একটা দাগ… কেমন যেন দগদগে। বেশ ভালো করে হাত দিয়ে জায়গাটা দেখছেন ওর মা। মনে হচ্ছে যেন কেউ লোহার শিক গরম করে ওকে ছ্যাঁকা দিয়েছে।
স্তনের একদম নিচে হাত পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস কনার্স, “এত গরম কেন এই জায়গাটা? আমার আঙুল পুড়ে গেল রীতিমতো!”
“বলেছিলাম না? সাবধানে দেখো?” বিরক্ত হলো ক্যাথি, “জর্জও অমন ছ্যাঁকা খেয়েছে।”
জর্জের দিকে তাকালেন ক্যাথির মা।
“ক্যাথি ঠিকই বলেছে, “ মাথা নাড়ল জর্জ, “খানিকটা মলম লাগাতে গেছিলাম… কিন্তু এমন ছ্যাঁকা খেলাম! বাবারে বাবা!”
“ডাক্তার ডেকেছ বাবা?”
“না মা, ডাক্তারের দরকার নেই,” বলে উঠল ক্যাথি।
“ক্যাথিই মানা করেছে,” বিরক্ত হলো জর্জ, “ও শুধুই আপনার কথা বলছিল। আপনি এলেই নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“খুব ব্যথা করছে ক্যাথি?” মেয়ের দিকে ঘুরলেন জোয়ান।
উত্তর দিতে গিয়ে ভয়ে বিকৃত হয়ে গেল ক্যাথির মুখটা, রীতিমতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করল সে।
“এমনিতে ব্যথা করে না,” ওর হয়ে জর্জই উত্তর দিলো, “কিন্তু স্পর্শ করলে খুব লাগে।”
মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন মা, তারপর আদর করে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন, “আহারে আমার মেয়েটা! ভয় পেয়ো না। আমি এসে গেছি না? এবার সব ঠিক হয়ে যাবে,” এগিয়ে এসে ক্যাথির অশ্রুভেজা গালে চুমু খেলেন তিনি। তারপর বেশ যত্ন করে দু’পাশ থেকে বাথরোবটা তুলে ঢেকে দিলেন ক্যাথির শরীর।
“জর্জ,” উঠে দাঁড়ালেন তিনি, “আমি ডা. আইলোকে ফোন করছি।”
“না!” চেঁচিয়ে উঠল ক্যাথি, “জর্জ, তুমি মাকে বোঝাও… দয়া করে একটু বোঝাও!”
এগিয়ে গিয়ে জোয়ানের হাত ধরল জর্জ, “দাঁড়ান মা, আপনি ডাক্তারকে কী বলবেন? বলুন তো?”
“আরে! এ আবার কী কথা?” অবাক হলেন জোয়ান, “বলব আমার মেয়ে অসুস্থ। ওর বুকের কাছটা পুড়ে গেছে!”
“কিন্তু উনি যখন জিজ্ঞাসা করবেন কী করে এসব হলো? তখন? কী করে ব্যাখ্যা দেবেন? আমরা নিজেরাও তো জানি না কী করে এমনটা হলো! ঘুম থেকে ওঠার পর ক্যাথি খেয়াল করে জিনিসটা! এসব বললে ডাক্তার বিশ্বাস করবেন? উনি তো পাগল ভাববেন আমাদের!”
“হুম,” সোফায় বসে পড়লেন মহিলা।
খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল জর্জ। ক্যাথির মাকে সবকিছু খুলে বলা বিপদ। গত রাতের কথা তো বলাই যাবে না! মহিলা বেজায় গোঁড়া, কথায় কথায় গির্জাতে চলে যান। সব শুনলে উনি জোর করে ক্যাথি আর বাচ্চাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবেন! তারপর ইস্ট ব্যাবিলন গির্জার যাজককে নিয়ে আসবেন! ভদ্রলোককে চেনে জর্জ, ভূত-প্রেতের ব্যাপার-স্যাপার একদমই বিশ্বাস করেন না তিনি। অনেকটা অ্যামিটিভিল গির্জার যাজকের মতো। এমন যাজকদের বাড়িতে এনে কী লাভ? হ্যাঁ, ভূত-প্রেতের ব্যাপারে দক্ষ কেউ এলে জর্জের আপত্তি নেই। তাছাড়া খুব তাড়াতাড়ি নর্থ ক্যারোলাইনার ওই সংস্থার তদন্তকারী চলে আসবে। তার অপেক্ষায় রয়েছে জর্জ।
“ক্যাথি এখন বিশ্রাম নিক মা,” অবশেষে বলে উঠল সে, “সকালে ওঠার পর দাগটা যেমন দেখেছিলাম, এখন অনেকটাই কমে গেছে। হয়তো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।” ক্যাথির মুখের দাগগুলোর কথা মনে এলো জর্জের, ওগুলো তো এমনিই ঠিক হয়ে গেছিল।
“হ্যাঁ মা, জর্জ ঠিকই বলেছে,” ক্যাথিও চাচ্ছিল না ওর মাকে আর এসবে জড়াতে, “আমি আরেকটু শুয়ে থাকি। তুমি আমার সাথে এখানে একটু থাকো, না কি?”
“আচ্ছা থাকছি,” ক্যাথির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জর্জের দিকে তাকালেন জোয়ান। ওনার মেয়ে আর জামাই কিছু একটা লুকাচ্ছে। ক্যাথিকে একটা কথা অনেকদিন ধরেই বলব বলব করেও বলা হয়ে উঠেনি তার, ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটা কেন যেন ওনার ভালো লাগে না। বাড়িটাতে ঢুকলেই কেমন যেন অস্বস্তি হয়! কেন হয় তিনি জানেন না…
যা-ই হোক, এতদিন পরেও বাড়িটার কথা ভাবতেই রীতিমতো ভয় পান মিসেস কনার্স।
নিচে নেমে এলো জর্জ। ড্যানি, ক্রিস আর মিসির নাস্তা খাওয়া শেষ। টেবিলটা পরিষ্কার করছে এখন ওরা, কাজ প্রায় শেষ। জর্জ আসতেই মুখ তুলে তাকাল বাচ্চাগুলো।
“তোমাদের মা ভালো আছে,” হাসল জর্জ, “তোমাদের নানি আছেন ওপরে।”
তারপর মিসির হাত ধরে ছেলেদুটোকে ও বলল, “চলো আমরা সবাই একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। দোকান থেকে কিছু জিনিস কিনতে হবে, তাছাড়া লাইব্রেরিতেও তো যেতে হবে!”
বাচ্চাদের নিয়ে জর্জ বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ক্যাথিকে একা রেখে নিচে নামলেন জোয়ান। রান্নাঘর থেকে জিমিকে ফোন করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি ক্যাথির বাড়ি চলে এসেছেন তিনি, যে জিমিকে কিছুই খুলে বলা হয়নি। অবশ্য জিমি একবার বলেছিল, “চলো মা, তোমাকে আমিই গাড়িতে করে রেখে আসি।”
জবাবে জোয়ান বলেছিলেন, “আরে না না, তুমি এখানেই থাকো। ওখানে তো জর্জ আছে, আর তাছাড়া কে জানে? যদি এখান থেকে কিছু নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়? তখন? কে নিয়ে যাবে? অমন কিছু হলে তোমাকে ফোন দেবো!”
কিছুক্ষণ পরেই ফোনটা ধরল জিমি, “হ্যাঁ মা, ক্যাথির কিছু হয়েছে না কি?”
“আরে না না, তেমন কিছু না, ওর সামান্য পেটব্যথা। ভয়ের কিছু নেই।”
“ধুর! পেট ব্যথার জন্য ওভাবে ডাকবে তোমাকে? আমি ক্যারিকে নিয়ে আসি ওখানে?”
“এই ছোড়া? বেশি বোঝো? তোমাকে আমি জন্ম দিয়েছি না তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছ?” চেঁচিয়ে উঠলেন জোয়ান, “কোনো দরকার নেই। তুমি ক্যারিকে নিয়ে ওখানেই থাকো!”
আসলে মিসেস কনার্স ভয় পাচ্ছিলেন। ক্যারি যদি ভেবে বসে যে ক্যাথির মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে? তখন? ওর বাপের বাড়িতে তো রটিয়ে বেড়াবে সমানে! ব্যাপারটা বেজায় বিব্রতকর হয়ে যাবে তখন।
বিছানায় শুয়ে নিচতলায় মায়ের চিৎকার শুনতে পেল ক্যাথি। ছোটো থেকেই জিমি আর ওকে মাঝে মাঝেই বকেন মা, বেজায় বদরাগি মহিলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাথরোবটা সরিয়ে আবার স্তনের নিচের দাগটা দেখতে লাগল সে… অনেকটা সেলাইয়ের মতো দাগ। তবে খানিকটা হালকা হয়ে গেছে। ডানদিকে হাত দিলো ক্যাথি। নাহ, তেমন ব্যথা হচ্ছে না। তবে জায়গাটা বেশ গরম… যেন চুলায় ফুটতে থাকা হালকা গরম পানিতে আঙুল দিয়েছে সে! আবার রোবটা জড়িয়ে নেবে সে, ঠিক তখনই ওর মনে হলো কে যেন ওর নগ্ন শরীরটা দেখছে! পিছনে কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফিরে তাকাতে ভয় লাগছে, ওদিকেই বড়ো আয়নাটা… কেন যেন মনে হচ্ছে তাকালেই ভয়ংকর একটা কিছু দেখতে পাবে সে! ভয়ে রীতিমতো অবশ হয়ে এলো ওর শরীর, হাত নাড়াবারও শক্তি নেই… রোবটা যে টেনে নেবে, সেটাও সম্ভব না। চোখ বন্ধ করে ওভাবেই শুয়ে রইলো ক্যাথি… নগ্ন শরীর… কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে! মনে হচ্ছিল… অপার্থিব কোনো প্রাণী যেন এখনই স্পর্শ করবে ওকে।
“আরে ক্যাথি! এ কী অবস্থা তোমার?” ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলেন জোয়ান, “ঠান্ডা লেগে যাবে তো তোমার!”
হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ক্যাথি, ফিরে এসেছেন ওর মা।
***
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাথির দাগটা পুরোপুরি মিলিয়ে গেল। মিসেস কনার্স তখনও ওর পাশেই বসে, কেন যেন মেয়েকে ছেড়ে এক চুল নড়ছে ইচ্ছা করছে না তার। কিছুক্ষণ পর জর্জ আর বাচ্চারা ফিরে এলো। ক্যাথির মা বেশ কড়া গলাতেই জর্জকে বললেন, সবার এখনই ওশান অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটা ছেড়ে দেওয়া উচিত। জর্জ চাইলে থাকতে পারে, কিন্তু তিনি মেয়ে আর নাতিদের নিয়ে চলে যাবেন।
বিপদে পড়ে গেল জর্জ, ক্যাথি তখন ওপরে ঘুমাচ্ছে। এতকিছুর পর ওকে তোলার কোনো ইচ্ছা ছিল জর্জের।
“আচ্ছা মা, ক্যাথি আরেকটু ঘুমাক,” বলল সে, “ও ওঠার পর না হলে আমরা সবাই একসাথে চলে আসব আপনার ওখানে? আপনাকে ফোন করব।”
“ঠিক আছে জর্জ, কিন্তু তোমরা যদি না আসো আমি কিন্তু আবার এখানে চলে আসব,” রীতিমতো হুমকি দিলেন জোয়ান।
জর্জ নিজেই একটা ট্যাক্সি ডেকে দিলো, বিকার চারটার সময় ইস্ট ব্যাবিলনে ফিরে গেলেন জোয়ান।
অনেক কষ্ট করে অ্যামিটিল গ্রন্থাগারের ‘অস্থায়ী গ্রাহক’ কার্ড পেয়েছে জর্জ ভূত-প্রেত আর দানবদের ব্যাপারে বেশ মোটা একটা বইও নিয়ে এসেছে। জোয়ান চলে যাওয়ার পরেই বসার ঘরে সোফায় বসে বইটা পড়া শুরু করে দিলো সে, অধ্যায়ের নাম—’শয়তান আর তার প্রভাব’।
বইটা শেষ করতে করতে রাত আটটা বেজে গেল জর্জের। বিকালবেলা চলে যাওয়ার আগে ক্যাথির মা স্প্যাগেটি আর মিটবল রান্না করে দিয়ে গেছেন। সন্ধ্যাবেলা বাচ্চাদের ওসবই খেতে দিয়েছিল জর্জ। নিজে অবশ্য কিছুই খায়নি, চুপচাপ ওদের পাশে ডাইনিং টেবিলে বসে বইটা পড়ে গেছে। শেষবার যখন ওপরে উঠেছিল তখনও ক্যাথির ঘুম ভাঙেনি, তবে একটু নড়ে উঠেছিল মেয়েটা। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই জেগে যাবে। রান্নাঘরে এসে কয়েকটা মিটবল নিয়ে বসল জর্জ। বাচ্চারা বসার ঘরে টিভি দেখছে।
বইটা পড়ার সময় একটা প্যাডে ছোটো ছোটো নোট নিয়েছে জর্জ। খেতে খেতে সেগুল দেখতে লাগল সে। অদ্ভুত রকমের কয়েক প্রকার পিশাচের নামও লিখেছে… কোনো নামই সে আগে শোনেনি। নামগুলো উচ্চারণ করতে রীতিমতো কষ্ট হচ্ছিল ওর… দাঁত ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা। ফাদার ম্যানকুসোকে একটা ফোন করল সে।
ওরা এখনও ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতেই আছে শুনে রীতিমতো রেগে উঠলেন ফাদার, “তুমি এমন কেন জর্জ? বিশপের অফিসের চ্যান্সেলররাও কিন্তু চান না যে তোমরা ওখানে থাক! মাত্র কয়েকদিন দূরে থাকলে কী হয়?”
“হুম ফাদার, ওনারা হয়তো ঠিকই বলেছেন,” উত্তর দিলো জর্জ, “তবে হয়তো এখন এই বাড়িটার একটা ব্যবস্থা করা যাবে,” টেবিলের ওপর থেকে বইটা তুলে নিল সে, “ভূত-প্রেত আর পিশাচদের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানলাম…”
হাত থেকে রিসিভারটা পড়ে যাচ্ছিল ফাদার ম্যানকুসোর। বাড়িটার অশুভ প্রভাবে জর্জের সংসার শেষ হতে বসেছে আর ও এই সময়ে বাড়ি না ছেড়ে ফাদারকে ফোন দিয়েছে ভূত-প্রেতের ব্যাপারে জ্ঞান জাহির করতে? ছোকরার মাথা খারাপ হয়ে গেল না কি?
“…কিছু বিশেষ উপায় আছে,” বলে চলল জর্জ, “একটা বইয়ে পড়লাম। পিশাচদের নাম তিনবার উচ্চারণ করে ওদের ডাকতে হয়। কিছু বিশেষ আচার- অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওদের মানুষের পৃথিবীতে নিয়ে আসা যায়। ইসকারন, ম্যাডেস্টি… এগুলো সব পিশাচদের নাম ফাদার!”
“জানি আমি এসব! ওরা সবাই অশুভ!” ধমকে উঠলেন ফাদার।
“তারপর আছে ইসাবো… এরজ… এরজ… ধুর উচ্চারণই করতে পারছি না! এরজলেন্ডেইড, এ একজন নারী… কালোজাদুর রানি… আর এসলেন্ডার…”
“জর্জ,” চেঁচিয়ে উঠলেন ফাদার, “ঈশ্বরের দোহাই, এসব নাম উচ্চারণ করো না! কখনও না… জীবনেও না!”
“কেন ফাদার?” বিরক্ত হলো জর্জ, “বইতেই তো লেখা আছে এসব!”
ওপাশ থেকে অদ্ভুত একটা আর্তনাদ শুনতে পেল জর্জ। কিছুক্ষণ ধরে একটানা ‘ক্লিক-ক্লিক’ শব্দ, তারপরেই ফোনটা কেটে গেল। রিসিভার ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল জর্জ। ফাদার ম্যানকুসো কি বিরক্ত হয়ে ফোনটা রেখে দিলেন না কি? আর ওই সংস্থার তদন্তকারী লোকটার কী খবর? ও এলো না কেন?
“মা ফোন করেছিলেন না কি?”
পিছনে ঘুরল জর্জ, দরজার কাছে যে কখন ক্যাথি এসে দাঁড়িয়েছে তা সে বুঝতেই পারেনি। বাথরোব ছেড়ে চুল আঁচড়ে ব্লাউজ আর সোয়েটার পরেছে সে। মুখটা কেমন যেন লালচে দেখাচ্ছে ওর।
“আরে সোনা,” এগিয়ে গেল জর্জ, “এখন কেমন লাগছে? ঘুম ভালো হয়েছে?”
সোয়েটারটা একটু তুলে নাভির ওপরটা দেখালো ক্যাথি, “দেখো দাগটা আর নেই!” পেটে হাত বুলাল সে, “একেবারেই হাওয়া হয়ে গেছে,” একটা চেয়ারে বসে পড়ল, “বাচ্চারা কই?”
“ওরা টিভি দেখছে,” ক্যাথির হাত ধরল জর্জ, “তোমার মাকে ফোন করবে?”
“হ্যাঁ করি ফোন,” মাথা নাড়ল ক্যাথি। কেন যেন বেজায় আরাম লাগছে ওর। পুরোপুরি যৌনতৃপ্তি পাওয়ার পর যেমনটা লাগে… অনেকটা তেমন। ঘুমের মধ্যে কয়েকবার ওর মনে হয়েছিল যেন পাশে কেউ শুয়ে আছে… ওই লোকটা জর্জ ছিল না। এরপর অদ্ভুত কয়েকটা স্বপ্ন হানা দিয়েছে ওর ঘুমের মধ্যে… অচেনা একটা লোকের সাথে সঙ্গম করছিল সে ওখানে!
মায়ের নম্বরে ফোন করল ক্যাথি। বসার ঘরে বাচ্চাদের কাছে চলে গেল জর্জ। তখনই মেঘের গর্জন শুনতে পেল সে। বৃষ্টি শুরু হলো, জানালার কাচে ফোটা ফোটা পানি… রীতিমতো মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। অ্যামিটিভিলে এই সময়ে বৃষ্টি তেমন হয় না।
“এই শোনো জর্জ,” ঘরে ঢুকল ক্যাথি, “মা বললেন ওনাদের ওখানেও বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। তাই জিমিকে আর এখানে পাঠানো সম্ভব না। আমাদেরই ভ্যান নিয়ে ওখানে যেতে বললেন!”
বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে, জানালাতে একটু পরপরই পানির ঝাপটা লাগছে। “বাইরে কী শুরু হয়েছে দেখছ?” বিরক্ত হলো জর্জ, “এর মধ্যে আমরা অতো দূর যাব কী করে?”
কী আর বলবে ক্যাথি? তখনই ওর মনে পড়ল শোবার ঘর থেকে বের হওয়ার আগে জানালাটা একটু ফাঁক করে রেখে এসেছিল সে। ওইটুকু ফাঁক দিয়ে বেশি পানি আসবে না। কিন্তু তারপরেও… জানালা লাগিয়ে দেওয়াই ভালো।
“ড্যানি, আমার আর তোমার বাবার ঘরের জানালাটা একটু লাগিয়ে দিয়ে এসো তো। একদম শক্ত করে লাগাবে, ঠিক আছে?” ড্যানির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে।
হ্যারিকে ভেতরে আনার জন্য ছুট দিলো জর্জ। বৃষ্টির পানি ঠান্ডা, তবে বরফের চেয়ে কম! বৃষ্টিতে উঠান আর রাস্তায় জমে থাকা বরফ গলে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বেশ ভালো। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে অ্যামিটিভিল নদীর পানির অনেকটাই গলে যাবে, তখন আবার স্পিডবোটটার জায়গা পরিবর্তন করতে হবে। নদীর পাশে থাকার এই এক সমস্যা।
হ্যারিকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকল জর্জ। ক্যাথির মুখটা কেমন যেন থমথমে ঠিক তখনই দোতালা থেকে ভেসে এলো ড্যানির চিৎকার! কোনো কারণে যেন ব্যথা পেয়েছে ছেলেটা! সাথে সাথে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ছুটল ক্যাথি, ওর পিছে পিছে জর্জ।
ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ড্যানি, ওর ডান হাতের আঙুলগুলো দরজার পাল্লার নিচে চাপা পড়েছে, আর ডান হাত দিয়ে কাঠের ভারী পাল্লাটাকে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।
“হে ঈশ্বর!” চেঁচিয়ে উঠে প্রায় অজ্ঞানই হয়ে যাচ্ছিল ক্যাথি।
“সরো তো, এখন ঢংয়ের সময় না,” এই বলে ক্যাথিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল জর্জ। পাল্লার ওপর হাত দিয়ে বেশ জোরে কয়েকটা বাড়ি মারল সে, কিন্তু খুলল না। বরং বাড়ির কারণে জানালা কেঁপে উঠে আরও ব্যথা পেতে লাগল ড্যানি। রাগে প্রায় মাথা খারাপ হয়ে এলো জর্জের, “কুত্তার বাচ্চারা,” অদৃশ্য কারও উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল সে, “তোরা কি ভাবিস? ছোটো বাচ্চাদের কষ্ট দিয়ে আমার হাত থেকে বেঁচে যাবি?”
হুট করেই জানালার পাল্লাটা নিজে থেকেই কয়েক ইঞ্চি ওপরে উঠে গেল! ছাড়া পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ড্যানি।
“মা, আমাকে বাঁচাও,” জখম আঙুলগুলোকে ধরে কেঁদে ফেলল ড্যানি।
“আহারে বাছা আমার,” ওর হাতটা ধরল ক্যাথি। কিন্তু কেন যেন ডান হাতের মুঠো খুলছে না ড্যানি।
“কী ব্যাপার?” রেগে উঠল ওর মা, “খোলো… দেখাও… আরে! এই ছোড়া দেখি আমাকে বিপদে ফেলবে! না দেখলে বুঝব কী করে কতটা জখম হয়েছে? ধমকে উঠল সে।
বাধ্য হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে জখম হাতটা বাড়িয়ে দিলো ড্যানি। আঙুলের অবস্থা দেখে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল ক্যাথি। বুড়ো আঙুল ছাড়া বাকি সবগুলো আঙুল কেমন যেন চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। ফলাফল—আরও ভয় পেয়ে গেল ড্যানি, ঝাঁকি মেরে হাতটা সরিয়ে নিল সে।
ওদিকে জর্জের মাথা রীতিমতো খারাপ হয়ে গেছে। এ ঘর থেকে ওঘরে ছুটে যাচ্ছে সে আর প্রতিবারই চেঁচিয়ে বলছে, “এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আক্রমণ আর কত? সামনা-সামনি এসো কুত্তার বাচ্চারা! তোমাদের ভয় পাই না!” আর ক্যাথি ওর পিছে পিছে ছুটছে, আর বলছে, “একটা ডাক্তার ডাকো জর্জ, ড্যানির হাতের অবস্থা ভালো ঠেকছে না!”
হতভাগা মানুষগুলো! ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটার ভেতরেও ঝড়, বাইরেও ঝড়
কিছুক্ষণ ছুটাছুটি করার পর জর্জের মাথা ঠান্ডা হয়ে এলো। ঠিকই তো বলেছে ক্যাথি! ড্যানির হাত ডাক্তারকে দেখাতেই হবে। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে ক্যাথিদের পারিবারিক চিকিৎসক, ডা. জন আইলোকে ফোন দিলো সে। কিন্তু ফোনের লাইন কাজ করছে না! পরে জানা গেছিল ঝড়ের কারণে টেলিফোন লাইনের একটা পোল পড়ে যাওয়ার কারণে ওই অঞ্চলের সবার ফোন ডেড হয়ে গেছিল।
জর্জের বুঝতে বাকি রইল না যে ঝড়ের মধ্যে ওই অশুভ বাড়িটাতে ওরা আটকা পড়েছে!
“আমি গাড়ি বের করছি, ড্যানিকে হাসপাতালে নিয়ে যাব,” চেঁচিয়ে উঠল জর্জ, “ক্যাথি, তুমি ওকে জ্যাকেট পরিয়ে দাও।”
ব্রডওয়েতে অবস্থিত ‘অ্যামিটিভিল ব্রান্সউইক হাসপাতাল’ জর্জদের বাড়ি থেকে এক মাইলেরও কম দূরে। কিন্তু ঝড়ের কারণে ওখানে পৌঁছতে প্রায় পনেরো মিনিটের মতো লেগে গেল ওর।
হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক তো ড্যানির হাতের অবস্থা দেখে রীতিমতো অবাক। চারটে আঙুলের প্রতিটার মাথা থেকে দ্বিতীয় গিট পর্যন্ত একেবারে থেঁতলে গেছে! তবে হ্যাঁ, ভেঙে যায়নি। তাই বিশেষ ভয়ের কিছু নেই। ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজ করে তারপর ড্যানিকে বাচ্চাদের অ্যাসপিরিন খাইয়ে দিলো ডাক্তার।
“আর কোনো সমস্যা হবে না তো ডাক্তার?” বলল জর্জ।
“আরে না না, ঝামেলা হলে আবার সকালে আসবেন, তখন বড়ো ডাক্তারেরা থাকবেন। আপাতত আর কিছু করার নেই আমার। বাড়ি নিয়ে যান।”
ওদিকে ভয়ে একেবারে চুপসে গেছে ড্যানি, প্রথমে ভেবেছিল ওর হাত আর কখনও ঠিক হবে না। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে খানিকটা ভরসা পেয়েছে। হাতটা বুকের কাছে ধরে ফোঁপাচ্ছে সে, একমনে গাড়ি চালাচ্ছে জর্জ। বাড়ি ফিরতে প্রায় বিশ মিনিট লেগে গেল ওদের। বাতাসের গতি আরও বেড়ে গেছে। ড্যানিকে ভেতরে ঢুকিয়ে বাড়ির দরজা লাগাতে বেশ কষ্ট হলো জর্জের। ভ্যানটা আর গ্যারেজে তুলল না সে।
ওদিকে দোতালার শোবার ঘরে ক্রিস আর মিসিকে ঘুম পাড়িয়ে বসার ঘরে অপেক্ষা করছিল ক্যাথি। ড্যানিকে দেখেই কোলে তুলে নিল সে, তারপর চুমু খেলো! কাঁদতে শুরু করল ড্যানি, ওকে দোল দিতে লাগল ক্যাথি। ব্যথা আর ভয়ে একদমই কাহিল ছিল ড্যানি, তাই ঘুম আসতে বেশি দেরি হলো না ওর। ড্যানিকে কোলে নিয়ে দোতালার শোবার ঘরে গেল জর্জ। ক্রিস আর মিসি অঘোরে ঘুমাচ্ছে, জুতা খুলে ওদের পাশে ড্যানিকেও শুইয়ে দিলো জর্জ। তারপর জানালার কাছের চেয়ারে বসে ঝড়-বৃষ্টি দেখতে লাগল সে আর ক্যাথি। যেন বাড়ির ভূতগুলো বাইরে গিয়ে মাতামাতি শুরু করেছে!
ক্যাথির মুখে অজানা আতঙ্কের ছায়া, জর্জের চেহারাতে হতাশার ছাপ। ওরা এই বাড়িতে বন্দি! এই অবস্থাতে কোনোভাবেই ক্যাথির মায়ের ওখানে যাওয়া সম্ভব না… আশেপাশে কোনো মোটেলও নেই। এদিকে এই বাড়িতে যা হচ্ছে… যা-ই হোক, যত কিছুই হয়ে যাক না কেন, বাচ্চাদের কিছু হতে দেবে না ওরা। ভোরের একটু আগে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা দ ‘জন
সকাল সাড়ে ছ’টার দিকে মুখের বৃষ্টির ফোটা পড়ার কারণে ঘুম ভেঙে গেল জর্জের। প্রথমে ওর মনে হলো সে যে বাড়ির ভেতরে নেই… বাইরে… তারপরেই খেয়াল করল এখনও সে জানালার সামনের ওই চেয়ারেই বসে আছে! লাফিয়ে উঠল জর্জ… ঘরের সব ক’টা জানালা খোলা! ফ্রেম থেকে উপড়ে এসেছে জানালার পাল্লাগুলো… কতগুলোর আবার ফ্রেমও ভেঙে গেছে! বাড়ির অন্য জায়গাগুলো থেকেও বাতাস আর বৃষ্টি ঢোকার শব্দ আসছে! ঘর থেকে প্রায় ছুটে বেরিয়ে এলো সে।
প্রতিটা ঘরের একই অবস্থা! জানালার পাল্লা ভেঙে গেছে… দোতালা আর তিন তলার প্রতিটি ঘরের দরজাও ভেঙে পড়েছে! জর্জের স্পষ্ট মনে আছে ওগুলো নিজ হাতে লাগিয়ে ছিটকিনি দিয়েছিল সে। এসব ভেঙে পড়ল কী করে?
আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, পুরো বাড়ি জুড়ে এমন তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল… কিন্তু ওদের কারোই ঘুম ভাঙল না?