দ্য অ্যামিটিভিল হরর – ১৬

ষোড়শ অধ্যায় 

৪-৫ জানুয়ারি। 

টেবিল থেকে সিংহটা তুলে নিয়ে সাথে সাথে বাইরের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এলো জর্জ। ওদিকে ক্যাথি তখনও ভয়ে কাঁপছে। ওকে শান্ত করতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল জর্জের। আর তাছাড়া কী বলবে ও বউকে? সিংহটা কীভাবে সেলাইঘর থেকে নিচে এলো এটার ব্যাখ্যা তো ওর কাছেও নেই… একটা জড়বস্তুকে কেউ নিচে না নিয়ে এলে ওটা নামে কী করে? বাচ্চাদের গায়ে অত শক্তি নেই যে ওরা ওটা নামাবে! ক্যাথির দৃঢ় বিশ্বাস যে বাড়িতে কোনো ভয়ংকর অপার্থিব শক্তি রয়েছে, সেটাই এমন কাজ করেছে! শুধু একটা কথাই ও বারবার বলছিল, “জর্জ আমি আর এক মুহূর্তও এই অভিশপ্ত বাড়িটাতে থাকতে চাই না! আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো!” 

“আহা ক্যাথি,” খানিকটা বিরক্ত হলো জর্জ, “দেখো সিংহটা কীভাবে নিচে এলো তা আমি নিজেও জানি না। কিন্তু এভাবে পালিয়ে যাওয়াটা কি আসলেই কোনো সমাধান? আমাদের খুঁজে বের করতে হবে যে এই বাড়িতে আসলে সমস্যাটা কী! শেষ পর্যন্ত লড়ব আমরা।” 

“কীভাবে লড়বে তুমি জর্জ?” ফুঁপিয়ে উঠল ক্যাথি, “এসব ভূত-প্রেত তো অদৃশ্য! এরা যা ইচ্ছা করতে পারে… যেখানে খুশি যেতে পারে!” 

“দেখো ক্যাথি,” মানা নাড়ল জর্জ, “ব্যাপারগুলো আসলেই অদ্ভুত। কিন্তু এগুলো যে ভূত-প্রেতের কাজ তা মানতে আমার আপত্তি আছে। হয়তো কোনো দুষ্ট লোক আমাদের এখান থেকে তাড়াতে চাইছে… এমনও হতে পারে অনেক ঘটনাই আমাদের কল্পনা! অলৌকিক কোনো জিনিসে আসলে আমার তেমন বিশ্বাস নেই। কখনও করবও না… এগুলো স্রেফ ফালতু ব্যাপার!” 

“তাহলে তুমি এই ভয়ংকর বাড়িটাতেই থাকবে? “ 

“শোনো, আমাকে আর একটা দিন সময় দাও,” মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল জর্জ, “আগামীকালের মধ্যে যদি কোনো ব্যবস্থা করতে না পারি… তাহলে কিছুদিনের জন্য বাইরে থাকব আমরা। কাছাকাছি কোনো মোটেলে উঠে যাব। আজকে ঘুমিয়ে পড়ি চলো, অনেক রাত হয়েছে। 

দোতালায় উঠে গেল ওরা। প্রচণ্ড মানসিক চাপে বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ক্যাথি, তাই একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। জর্জও ক্লান্ত ছিল, তবে অত তাড়াতাড়ি ঘুম আসে না ওর। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে কান পেতে রইল সে। কেন যেন ওর মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই অদ্ভুত কোনো শব্দ শুনতে পাবে। এভাবেই খানিকটা ঘুম এসেও গেছিল… তখনই ওর মনে হলো নিচতলায় অদ্ভুত এক বাজনা বাজছে, অনেকটা সৈনিকদের কুচকাওয়াজের সময় যেমন তালে বাজনা বাজে, তেমন। প্রথমে ওর মনে হলো স্বপ্ন দেখছে… বাজনার তালে তালে নিজের অজান্তেই খানিকটা মাথাও ঝাঁকাল সে, তারপরেই ঘুমের ভাবটা কেটে গেল… আর ও বুঝল আসলেই নিচে বাজনার শব্দ হচ্ছে! ক্যাথির দিকে তাকাল ও, এখন জেগে উঠলে মেয়েটা বেজায় ভয় পাবে। কিন্তু সে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। 

প্রায় দৌড়ে দোতালার বারান্দায় বেরিয়ে এলো জর্জ। বাজনাটার শব্দটা যেন আরও খানিকটা বেড়ে গেল। এমনকি অনেক মানুষের পায়ের শব্দও শোনা যাচ্ছিল! জর্জের জবানিতে, “আমার মনে হচ্ছিল প্রায় পঞ্চাশ জন সৈনিক আমাদের বসার ঘরে বাজনার তালে তালে এগিয়ে চলেছে! আমি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আলো জ্বালিয়ে দিলাম। কেউ কোথাও নেই… বাজনাও থেমে গেছে!” 

ভয়ে রীতিমতো জমে গেল জর্জ। সে হলফ করে বলতে পারে যে স্পষ্ট বাজনার আওয়াজ শুনেছে, কিন্তু এখন আলো জ্বালানোর পর সব কোথায় গেল? আশেপাশে তাকাল সে, কোথাও কেউ নেই! পুরো ঘরটা থমথম করছে। সেই বাজনার শব্দ এখনও ওর কানে ভাসছে… জর্জের মনে হচ্ছে ও একটা ইকো চেম্বারে চলে এসেছে… যেখানে হুট করেই সব থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। হুট করেই জর্জের মনে হলো ওর পিছে যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে… 

কে যেন ওর ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে! মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের একটা তীব্র স্রোত বয়ে গেল জর্জের। দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল সে। কেউ নেই! হুট করেই ওপর থেকে যেন ক্যাথির গলা শোনা গেল। 

হয়তো ঘুম থেকে উঠে ওকে দেখতে না পেয়ে মেয়েটা ভয় পেয়েছে! তাড়াতাড়ি ওপরে দৌড় দিলো সে, একেকবারে দুটো করে সিঁড়ির ধাপ টপকে খুব তাড়াতাড়ি ওপরে পৌঁছে গেল জর্জ। ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে ও যা দেখল… সেটা জীবনেও ভুলতে পারবে না! বিছানা থেকে দুই ফুট উঁচুতে ভাসছে ক্যাথির দেহ… ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও। গভীর ঘুমে মগ্ন ক্যাথি, ও কিছুই বুঝতে পারছে না। 

“ক্যাথি!” চিৎকার দিয়ে বউয়ের পা চেপে ধরল জর্জ। কিন্তু একি! অদৃশ্য কেউ যেন টানছে ক্যাথিকে। জর্জও জান-প্রাণ দিয়ে টেনে চলল। একটা সময়ে হুট করেই ক্যাথিকে ছেড়ে দিলো সেই অদৃশ্য শক্তি। মেঝেতে রীতিমতো মুখ থুবরে পড়ল জর্জ আর ওর পাশে ক্যাথি। 

ঘুম ভেঙে গেল ক্যাথির। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আশপাশে চেয়ে রইল সে।

“জর্জ, আমরা মেঝেতে কেন?” ফুঁপিয়ে উঠল সে, “কী হয়েছে?” 

ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে জর্জ, ক্যাথিকে দাঁড় করালো সে। রীতিমতো কাঁপছিল মেয়েটা। 

“তেমন কিছুই হয়নি,” ক্যাথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো জর্জ, “তুমি একটা স্বপ্ন দেখে মেঝেতে পড়ে গেছিলে।” 

ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল ক্যাথি। “ওহ, আচ্ছা” জর্জকে আর কোনো প্রশ্ন না করে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল জর্জ। ঘরের আলো নিভিয়ে জানালার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল সে, আজ আর ঘুম আসবে না ওর। একটু পরেই সকাল হবে, আকাশের দিকে উদাস চোখে চেয়ে রইল সে। 

*** 

নিজের মায়ের বাড়ির জানালায় বসে সূর্যোদয় দেখছেন ফাদার ম্যানকুসো। প্রধান যাজকের সাথে ঝামেলা করার কিছুক্ষণ পরেই তিনি রেক্টরি ছেড়ে নাসাওতে চলে এসেছেন। এমন না যে তিনি প্রধান যাজককে ভয় পান… আসলে মল আর ধূপের গন্ধে ভরা অ্যাপার্টমেন্টে আর থাকতে পারছিলেন না তিনি। এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে ওনার ওপর অশুভ কোনো শক্তির নজর পড়েছে, তাই কয়েকদিন রেক্টরি থেকে দূরে থাকলেই হয়তো ভালো হবে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন যে, কোনো মোটেলে গিয়ে উঠবেন, এই বয়সে মায়ের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য থাকাটা কেমন যেন দেখায়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওনার মনে হলো যদি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন? তবে? এখানেই আসাই ভালো, অসুখ হলে মা দেখে রাখবেন। এই ক’দিনে রেক্টরির অশুভ প্রভাবও হয়তো কেটে যাবে। 

রাতে ঘুম ভালো হয়নি, ভোর হওয়ার একটু আগেই ভেঙে গেছে ঘুমটা। হাতের তালুটা আবার চুলকাচ্ছে, দু’পাশই ভালো করে দেখলেন ফাদার। মাকে এটার কথা খুলে বললে কেমন হয়? না না, এমনিতেই মহিলা বেশ চিন্তায় আছেন ওনার জ্বর নিয়ে… তার ওপর এটার কথা বললে আরও চিন্তায় পড়ে যাবেন। 

আকাশে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বেশ নিচ দিয়ে যাচ্ছে ওগুলো। কনকনে বাতাস আবার বইতে শুরু করেছে, এর অর্থ—খুব তাড়াতাড়ি নতুন করে তুষারপাত শুরু হবে। জানালার পাশ থেকে সরে এসে টেবিলের ওপর রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালেন ফাদার। সকাল সাতটা বাজে কেবল। জর্জ লুজকে একবার ফোন করা যেতে পারে… ওকে জানাতে হবে যে তিনি রেক্টরির গির্জাতেই ওদের বাড়ি শুদ্ধীকরণ করেছেন… কোনো ফল যদি হয়ে থাকে জর্জও সেটা ওনাকে জানাবে। কিন্তু এত সকালে ফোন দেওয়া ঠিক হবে না। আর একটু পর ফোন করা যাবে। বিছানায় উঠে কম্বলের তলায় ঢুকে গেলেন ফাদার 

বেশ উষ্ণ হয়ে আছে জায়গাটা। রান্নাঘর থেকে মায়ের বাসন-কোসন নাড়ার টুং-টাং শব্দ ভেসে আসছে। ছোটোবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল ফাদারের…. এই সকাল সকাল ওনাকে তুলে দিতেন মা, তারপর স্কুলে যেতে বলতেন। নিজের অজান্তেই হাসিতে ভরে উঠল ওনার মুখ। হাতের ব্যথা, দুশ্চিন্তা, জর্জদের কথা সবকিছুই ভুলে গেলেন… ছোটোবেলার নানান স্মৃতি মনে করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লেন ফাদার ম্যানকুসো। 

*** 

সকাল দশটা বেজে গেছে, ক্যাথি এখনও গভীর ঘুমে মগ্ন। গত রাতের ঘটনার পর থেকে বেশ ভয়ে আছে জর্জ। কাল যদি ও সময় মতো ওপরে না যেত তবে কি ক্যাথিকে জানালা দিয়ে ফেলে দিত ওই অদৃশ্য শক্তি? আর দেরি করা যাবে না, ফাদার ম্যানকুসোকে আবার ফোন দিতে হবে। 

ওদিকে সকালে ড্যানি আর ক্রিস ওকে জানিয়েছে যে রেডিয়োতে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ বিভাগের বিশেষ সমস্যার কারণে অ্যামিটিভিলের সবগুলো স্কুলের বৈদ্যুতিক হিটার বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই ঠান্ডার মধ্যে হিটার না চালিয়ে ক্লাস কী করে নেওয়া সম্ভব? তাই স্কুলগুলোও অনির্দিষ্ট কালের জন্য আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওরা দু’জন বেশ হতাশ, সেদিন থেকে নতুন স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল ওদের। বড়োদিনের লম্বা ছুটির পর স্কুলে গিয়ে নতুন কিছু বন্ধু পেলে ভালোই লাগত। 

ওদিকে জর্জ কিন্তু মনে মনে খুশিই। স্কুল থাকলে ড্যানি আর ক্রিসকে গাড়িতে করে ওকেই রেখে আসতে হতো। বাড়ির এই অবস্থাতে মিসি আর ক্যাথিকে একা রেখে বের হয়ে শান্তি পেত না ও। তাড়াতাড়ি সকালের নাস্তা বানিয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে দিলো জর্জ, তারপর ওদের ওপরের খেলাঘরে পাঠিয়ে দিয়ে দোতালায় ক্যাথির কাছে ফিরে গেল। 

মুখটা বেজায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ক্যাথির। ঠোঁটের পাশে কেমন যেন দাগ পড়ে গেছে। ক্যাথিকে না জাগিয়ে আবার নিচতলার রান্নাঘরে চলে গেল জর্জ। বেলা এগারোটা বেজে গেছে, এবার ফাদারকে ফোন করাই যায়। 

ফাদার ম্যানকুসোর ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করল জর্জ, কিন্তু কেউ ধরল না। রেক্টরির অফিসে ফোন দেওয়ার পর ওরা জর্জকে জানাল, ফাদার ম্যানকুসো নিজের মায়ের বাসায় বেড়াতে গেছেন। 

জর্জ ফাদারের মায়ের বাড়ির নম্বরটা চাইল, কিন্তু রেক্টরি থেকে বলা হলো, কোনো যাজকের আত্মীয়ের বাড়ির নম্বর দেওয়ার নিয়ম তাদের নেই, তবে হ্যাঁ ওরা ফোন করে ম্যানকুসোকে জানিয়ে দিচ্ছে যে জর্জ এসেছিল। 

বেশ কিছুক্ষণ ফাদারের ফোনের আশায় রান্নাঘরে বসে রইল জর্জ। হুট করেই নিজের প্রতি ঘেন্না হচ্ছে ওর, কোন দুঃখে আগের রাতে ক্যাথিকে বলেছিল যে সে অপার্থিব ব্যাপার-স্যাপার বিশ্বাস করে না? ক্যাথির কথাই ঠিক…. অদৃশ্য শক্তির সাথে যুদ্ধ করে ওরা পারবে কেন? ওই শক্তি এতটাই ক্ষমতাবান যে একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরকেও কাঠের টুকরার মতো বিছানা থেকে তুলে নিতে পারে! সাবেক মেরিন অফিসার জর্জ লুজের আর স্বীকার করতে দ্বিধা নেই… ওর ভয় লাগছে! এই বাড়িতে আসলেই ভূত আছে। 

খানিকটা পরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো ক্যাথি। প্রায় সাথে সাথেই বেজে উঠল ফোনটা। জর্জের সিয়োসেটের অফিস থেকে একজন ফোন দিয়েছে। আজকে ওই পরিদর্শকের আসার কথা, এই অবস্থায় কোম্পানির মালিক না থাকলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তাই সে জানতে চাচ্ছে জর্জ কখন অফিসে আসবে। চিন্তায় পড়ে গেল জর্জ, এই মানসিকতা নিয়ে অফিসে যেতে একেবারেই ইচ্ছা করছে না। অবশেষে সে বলল, “তুমি হিসাবরক্ষককে বলো ও যেন ওই কর্মকর্তাকে ফোন করে ওনাকে আরও এক সপ্তাহ পর আসতে বলে। আজ আমি অফিস আসতে পারব না। ক্যাথির শরীরটা ভালো নেই, বাড়িতে একজন ডাক্তার ডেকে পাঠিয়েছি… উনি আসবেন, দেখবেন। বুঝতেই পারছ, এই অবস্থাতে বের হই কী করে? 

ওদিকে টেবিলের অপর প্রান্তে বসে অবাক হয়ে জর্জের কথা শুনছিল ক্যাথি, ওর মুখ দিয়ে আপনা-আপনিই বেরিয়ে গেল, “ডাক্তার!” 

হাত দিয়ে ক্যাথিকে ইশারা করে থামিয়ে দিলো জর্জ, তারপর বলল, “যা-ই হোক, তোমরা আজকে সামলে নাও। আমি পরে ফোন দিচ্ছি!” ফোনটা রেখে দিলো সে। 

“কী ব্যাপার? ডাক্তার ডেকেছ না কি?” অবাক হলো ক্যাথি। 

“আরে না,” মাথা নাড়ল জর্জ, “আজ অফিস না যাওয়ার বাহানা বানালাম 

আরকি। কিন্তু কাল আর কামাই দেওয়া যাবে না। এমনটা চলতে থাকলে আমার লোকেরা চাকরি ছেড়ে দেবে!” 

হাই তুলে কাঁধ ঝাঁকাল ক্যাথি, এখনও ঘুম-ঘুম ভাবটা আছে ওর। তারপর ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ কপালে উঠল তার, “আরে জর্জ! এত বেলা হয়ে গেছে? তুমি আমাকে ডাকোনি কেন? বাচ্চারা নাস্তা খেয়েছে? ড্যানি আর ক্রিসকে স্কুলে রেখে এসেছ?” 

“বাপরে, এত প্রশ্ন একবারে?” মৃদু হাসল জর্জ, একটা আঙুল তুলে বলল, “প্রথমত, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভালো করে ঘুমাওনি তুমি, তাই আরকি জাগাইনি, ‘ তারপর আরেকটা আঙুল তুলে বলল, “হ্যাঁ ওদের খাইয়ে দিয়েছে। আর আঙুল না তুলি, গুনেগুনে উত্তর কেন দেবো? হাহা, তোমার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর হলো, নাহ, ওরা স্কুলে যায়নি। ওদের ওপরে পাঠিয়ে দিয়েছি, মিসির সাথে খেলছে।” 

“হুম,” গম্ভীরকণ্ঠে বলল ক্যাথি। 

জর্জ ভাবল যে ক্যাথির গত রাতের ঘটনার কথা কিছুই মনে নেই। তাই সে ওই ব্যাপারে আর কোনো কথা তুলল না। “বুঝলে ক্যাথি,” উঠে দাঁড়াল সে, “ফাদার ম্যানকুসোকে আবার ফোন দিয়েছিলাম। রেক্টরির লোকেরা জানাল উনি ওনার মায়ের বাড়িতে গেছেন। ওরা এটাও বলেছে যে আমি ফোন করেছি সেটা তাকে জানানো হবে। ফাদারের ফোনের অপেক্ষাতেই আছি।” 

*** 

ছেলেকে গভীর ঘুমে মগ্ন দেখে ফাদার ম্যানকুসোর মা আর ডাকাডাকি করেননি। দুপুর তিনটার দিকে ঘুম ভাঙল ফাদারের। মাথার ভেতরের ঝিম ধরা ভাবটা আর নেই, তার মানে জ্বর কমেছে। তাড়াতাড়ি রেক্টরিতে ফোন দিলেন তিনি। একজন অল্পবয়স্ক যাজক ধরল ফোনটা। সে বেশ ভালো একটা খবর দিলো ম্যানকুসোকে, “ফাদার, আপনি চলে যাওয়ার পর থেকে আপনার অ্যাপার্টমেন্টের ওই গন্ধ আর নেই। একটু সুস্থ হলেই চলে আসুন, না কি?” 

মনটা বেশ ভালো হয়ে উঠল ফাদারের, “আসব আসব, আর কোনো খবর?”

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ, জর্জ লুৎজ নামে একজন আপনাকে ফোন দিয়ে খুঁজছিল।”

“আরে ভালো জিনিস মনে করালে। ওকে ফোন দেওয়ার কথা ছিল আমার। কিন্তু আজ উঠতে একটু বেলা হয়ে গেল। ওর সাথে কথা বলে নিই, কেমন? আর বিকালের মধ্যে রেক্টরিতে ফিরে আসছি।” 

মনে মনে বেজায় খুশি ফাদার। হয়তো জর্জদের বাড়ির উপদ্রব কেটে গেছে, তাই ও ফোন দিয়েছিল। 

কয়েক মিনিট পর জর্জদের নম্বরে ফোন করলেন তিনি, কয়েকটা রিং হওয়ার পরেই ফোনটা ওঠাল জর্জ। 

“হ্যালো জর্জ, আমি ফাদার ম্যানকুসো,” মৃদু হেসে বললেন ফাদার। 

“ফাদার, আপনার ফোন পেয়ে কী যে ভালো লাগছে! আপনার সাথে আমাদের কিছু কথা ছিল… জরুরি… এখনই কি একবার আমাদের এখানে আসতে পারবেন?” 

“আরে আমি ইতোমধ্যেই বাড়িটার শুদ্ধীকরণ করেছি আবার, আমাদের রেক্টরির গির্জা থেকে,” উত্তর দিলেন ফাদার, “এর মধ্যে কি আবার কিছু…” 

“ফাদার আমার মনে হয় না কোনো শুদ্ধীকরণে আর কাজ হবে,” বেশ জোরে বলে উঠল জর্জ, “ব্যাপারটা রীতিমতো মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ক্যাথি আর বাচ্চাদের নিয়ে ভয়ে আছি আমি।” পরবর্তী কয়েক মিনিট ধরে ওরা ওশান অ্যাভিনিউয়ের ১১২ নম্বর বাড়িটাতে আসার পর কী কী হয়েছে তা সংক্ষেপে ফাদারকে খুলে বলল জর্জ। তারপর ক্যাথিকে ওপরে সিগারেট আনতে পাঠিয়ে দিয়ে গত রাতের ঘটনাটা খুলে বলল। 

“শুনলেন তো ফাদার? আমি নিজে দেখেছি ক্যাথির শরীরটা বাতাসে ভাসছিল! আপনি একবার এখানে আসুন,” গলা ধরে এলো জর্জের, “আমি বুঝতে পারছি না এদের নিয়ে কী করব… কোথায় যাব!” 

ব্যাপারটা লজ্জার হলেও সত্য যে ফাদার নিজেও ওই বাড়িতে যেতে ভয় পান। কিন্তু জর্জের কথাগুলো শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে গেছেন তিনি! ব্যাপারটা তো ভয়ানক আকার ধারণ করেছে! ভয় পেলেও এখন ওনাকে ওখানে যেতে হবে। তাছাড়া তিনি একজন যাজক, তিনি যদি এভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে যান… তবে ওদের কে সাহায্য করবে? 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফাদার, তারপর বললেন, “আচ্ছা জর্জ, আমি চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি…” 

এরপর ফাদার কী বললেন তা শুনতে পেল না জর্জ। টেলিফোনের ওপাশ থেকে একটানা ক্যাচক্যাঁচ শব্দ ভেসে এসে ওর কান ঝালাপালা করে দিলো! 

“ফাদার, আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি না,” চেঁচিয়ে উঠল জর্জ। কিন্তু জবাবে ওই শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেল না সে। 

ওদিকে ফাদার ম্যানকুসোর গালে একটা অদৃশ্য হাত জোরে চড় মারল! রিসিভারটা হাত থেকে পড়ে গেল ওনার। গালে হাত দিয়ে রীতিমতো কেঁদে ফেললেন তিনি, “না না, আমি আর ওখানে যাব না… কখনোই না,” হাতের ফোসকাগুলো আবার ব্যথা করছে, “হে ঈশ্বর রক্ষা করুন আমায়, রক্ষা করুন লুজদের! দয়া করুন… দয়া করুন!” 

চেয়ারে বসে পড়ল জর্জ। ফাদারের ফোনের অপেক্ষা করে আর কাজ নেই। এই বাড়ির অশুভ শক্তি তাকে ফাদারের সাথে কথা বলতে দেবে না। তবে আশার একটা টিমটিমে আলো এখনও সে দেখতে পাচ্ছে, শেষের দিকে সম্ভবত ফাদার বলেছিলেন যে তিনি আসবেন। কিন্তু কখন আসবেন সেটা বলেননি… দেখা যাক। 

*** 

রাত আটটার দিকে রেক্টরিতে পৌঁছলেন ফাদার। 

এখন রাত ন’টার মতো বাজে, এক দৃষ্টিতে টেলিফোনটার দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। মলের সেই বাজে গন্ধটা এখন আর নেই ওনার অ্যাপার্টমেন্টে, তবে ধূপের খানিকটা কড়া গন্ধ থেকে গেছে… এটা সহ্য করা যায়। কী করবেন এখন তিনি? যাবেন ওশান অ্যাভিনিউতে? খুব ভয় লাগছে… কিন্তু জর্জদের কী হবে? বাচ্চাদের কথা ভেবে হলেও ওনার যাওয়া উচিত! কিন্তু ১১২ নম্বর বাড়িটার কোনো ভরসা নেই… একবার গিয়েই যে অবস্থা হয়েছে… 

অবশেষে ফাদার ঠিক করলেন যে ওই অঞ্চলের বিশপের অফিসে ফোন করে কারও সাহায্য নেবেন। কিন্তু রিসিভার তুলেই মনে হলো, সকালবেলা নিজে অফিসে গেলেই তো হয়। বেজায় ঘুম পাচ্ছে তার, মায়ের বাসায় অনেক ঘুমিয়েছেন, তারপরেও এই হাল! তাড়াতাড়ি পায়জামাটা পরে নিলেন। বাথরুমে গিয়ে হাত থেকে সাদা গ্লাভসগুলো খুলে ফেললেন, ওষুধ মেশানো পানিতে কিছুক্ষণ হাত ডুবিয়ে রাখতে হবে। 

কিন্তু হাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলেন তিনি! দুটো হাতই ঠিক হয়ে গেছে! কোনোটার তালুতে কোনো ফোসকা নেই! লাল লাল দাগ, ব্যথা কিচ্ছু নেই… এমনকি পুঁজও বের হচ্ছে না! পুরোপুরি ভালো হয়ে গেছে! 

*** 

সারাটাদিনই ক্যাথির আচরণ কেমন যেন অদ্ভুত লাগল জর্জের। বেশি কথা বলছিল না, চুপচাপ ফায়ারপ্লেসের সামনে বসেছিল। রান্না করে বাচ্চাদের খাইয়ে আগেভাগেই ওদের ওপরে পাঠিয়ে দিলো জর্জ। আজ আর আগে-ভাগে ঘুমাতে যেতে আপত্তি করেনি ছেলেরা। একটু আগেই রেডিয়োতে বলা হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের সমস্যা ঠিক হয়ে গেছে, তাই আগামীকাল থেকে অ্যামিটিভিলের সব স্কুল খোলা হবে। ওরা যাওয়ার পর হালকা গরম পানিতে মিসিকে গোসল করাল জর্জ। তারপর ওকে বই থেকে একটা গল্প শোনাল সে। ঘুম এসে গেল মিসির, ওকে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলো জর্জ, তারপর আলো নিভিয়ে বের হওয়ার আগে বলল, “শুভরাত্রি মিসি।” 

জবাবে মিসি বলল, “শুভরাত্রি বাবা, শুভরাত্রি জোডি।” 

এভাবেই রাত এগারোটা বেজে গেল। হতাশ হলো জর্জ, ফাদার ম্যানকুসো তাহলে আজ আর আসবেন না। ফায়ারপ্লেসের সামনে বসে চেয়ারে দোল খাচ্ছিল ক্যাথি, ঘুমে ওর চোখদুটো প্ৰায় বুজে এসেছে। জর্জকে দেখেই উঠে দাঁড়াল সে, “জর্জ, আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।” 

অবাক হয়ে ক্যাথির দিকে চাইল জর্জ। মেয়েটার চোখে কেমন যেন শূন্য দৃষ্টি, আজকে একবারও বাড়িটা ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেনি সে। যেন আগে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ভুলে গেছে সে। ব্যাপারটা অদ্ভুত, একটু বেশিই অদ্ভুত। ক্যাথি একটু যেন বদলে গেছে। দু’জনে একসাথেই দোতালায় উঠল। 

“খুব ঘুম এসছে বুঝলে?” বিড়বিড় করে বলল ক্যাথি, “আজ আর রাতে গোসল করব না, কাল সকালে করে নেব।” বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে, বালিশে মাথা রাখার কয়েক মূহূর্ত পরেই ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে। বিছানার এক কোনায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল জর্জ, ক্যাথির হলোটা কী? হ্যারির ঘরের দিকে একবার যেতে হবে। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো জর্জ। 

হ্যারি ঘুমাচ্ছে, সন্ধ্যায় দেওয়া খাবার ছুঁয়েও দেখেনি। 

হালকা নাড়া দিয়ে কুকুরটাকে তুলে দেওয়ার জন্য ঝুঁকল জর্জ, তখনই বাড়ির ভেতর থেকে সেই অদ্ভুত বাজনার শব্দ ভেসে এলো! তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল জর্জ, ড্রাম আর শিঙার শব্দ আসছে বসার ঘর থেকে। সেগুলোর তালে তালে যেন মার্চ করে চলেছে অনেক মানুষ… 

তাড়াতাড়ি করে আলো জ্বালাল জর্জ। ফলাফল? আগের রাতের মতোই। পুরো ঘর ফাঁকা, কেউ নেই। যেন ও আসতেই সব বাজনা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! হুট করেই মেজাজটা গরম উঠে গেল জর্জের। “কুত্তার বাচ্চারা, কোথায় পালালি সব?” চিৎকার করে উঠল সে। 

গজগজ করতে করতে পায়চারি শুরু করল সে আর তখনই খেয়াল করল ব্যাপারটা। বসার ঘরটা কেমন যেন আলাদা লাগছে। ঘরের প্রতিটা আসবাবপত্র একটু সরিয়ে ফেলা হয়েছে, গালিচাটাও খানিকটা ভাঁজ করা। চেয়ার, টেবিল আর কাউচগুলোকে ঠেসে যেন কেউ দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে… কেন? মার্চ করতে থাকা ওই অদৃশ্য লোকগুলোর দাঁড়ানোর জায়গা করে দেওয়ার জন্য? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *