পঞ্চাশ
প্রাসাদের জানালা দিয়ে লেকের তীরে ভীতিকর দৃশ্য দেখছে. ইমোজেন ব্যালার্ড ও তার সহকারী রিপার ক্যাসিডি। বাইরে থেকে একদল অচেনা সশস্ত্র লোক এসে ভ্রাতৃসঙ্ঘের সবাইকে ভেড়ার মত জড় করে প্রাসাদের দিকে তাড়িয়ে আনছে!
‘এ অসহ্য! তুমি কিছু করো, রিপার!’ অপমানে হাঁফিয়ে উঠছে ব্যালার্ড। লাঠিতে ভর করে দাঁড়াল। ডানহাতে চেপে ধরেছে বুকের বামদিক। যে-কোন সময়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে মেঝেতে।
ক্যাসিডির মন বলছে: মরুক না বুড়ো শালা! এত হ্যাকড়ামি না করলে এতক্ষণে মাঠে পৌঁছে যেত ওরা। যে-কোন সময়ে পৌঁছে যাবে হেলিকপ্টার। অথচ এখনও প্রাসাদ ছেড়ে বেরোতেই পারেনি! আবারও কালো অসীম আকাশের দিকে চেয়ে ভাবল ক্যাসিডি, ‘আমরা মরে ভূত হলে তখন হাজির হবে কুত্তার বাচ্চা পাইলট?’
ক্ষোভে কাঁপছে ইমোজেন ব্যালার্ড। দু’চোখ ধিকিধিকি জ্বলছে লালচে কয়লার মত। ‘এই ঘটনায় তোমার দায় আছে, ক্যাসিডি! আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে শাস্তি দেব!’
স্যর, আমি কি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারি, প্রথম থেকেই বলেছি যেন বাতিল করা হয় এবারের অনুষ্ঠান? আপনি আমার একটা কথাও শোনেননি। আর এখন এই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে না গেলে খুন হব। প্লিয, সময় নষ্ট করবেন না!’
ক্যাসিডির কথা শেষ হতে না হতেই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে লনের দিকে ছুটে গেল একদল সিকিউরিটি গার্ড। প্রথম কয়েক মুহূর্ত রিপারের মনে হলো, তারা নিয়ন্ত্রণে নেবে পরিস্থিতি। কিন্তু তখনই এল উল্টো ঢেউ। গুলি খেয়ে একে একে পড়ে গেল চারজন গার্ড। আর তখনই লাফ দিয়ে জানালা থেকে পিছিয়ে গেল রিপার। দলছুট এক গুলি ভেঙে দিয়েছে কাঁচের শার্সি। ব্যথা লাগতেই গাল স্পর্শ করে ক্যাসিডি বুঝল, ক্ষত থেকে দরদর করে ঝরছে রক্ত। হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে ব্যালার্ড। কনুই ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে ভাঙা জানালা থেকে সরিয়ে নিল ক্যাসিডি। ‘আসুন! জায়গাটা মোটেও নিরাপদ নয়!’
জঙ্গলের কাছ থেকে এল গোলাগুলির আওয়াজ। একটু পরে ফাটল কয়েকটা গ্রেনেড। ওদিক থেকে শার্লন হলের গার্ডদের ওপরে হামলা করেছে কারা যেন। নিশ্চয়ই রানার দলের লোক তারা!
গ্র্যাণ্ড মাস্টারকে প্রায় টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরোল ক্যাসিডি। সোজা চলেছে প্রাসাদের পাশের দরজা লক্ষ্য করে। উঠন পেরিয়ে পৌছুতে হবে মাঠে। ওখানে নামবে হেলিকপ্টার। বারবার ভাবছে ক্যাসিডি, হয়তো ফাঁদ থেকে এখনও বেরিয়ে যেতে পারবে ওরা। ভীষণ ভয় লাগছে তার, মাসুদ রানার দলের লোকেরা হয়তো এরই ভেতরে ঘিরে ফেলেছে শার্লন হল। দালান ছেড়ে বেরোলেই ধরা পড়বে ওরা। সেক্ষেত্রে মুক্ত হতে গিয়ে গোলাগুলি না করে উপায় থাকবে না। লড়তে আপত্তি নেই ক্যাসিডির, কিন্তু আগে তো চাই একটা আগ্নেয়াস্ত্র! বহুদিন হলো পিস্তল ছুঁয়ে দেখে না সে। এতকাল তার হয়ে খুন করত অন্যরা। এখন খুনিরা হাতের কাছে নেই। একেবারে একা হয়ে গেছে সে। চরম আতঙ্ক বাসা বাঁধল তার বুকে।
তখনই মনে পড়ল, এখান থেকে বেশি দূরে নয় ড্রেসিংরুম। ক্লাবের দু’জন সদস্য তাদের লকারে বেআইনী পিস্তল রাখে। তারা জানে না, সদস্যদের লকারের চাবি আছে ক্যাসিডির কাছে। কী আছে তাদের সিন্দুকে, ভাল করেই জানে সে।
‘ওদিকে চলুন, স্যর!’ ব্যালার্ডের কানের কাছে ফিসফিস করল ক্যাসিডি। মনিবকে টেনে নিয়ে চলল ড্রেসিংরুমের দিকে।
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমি আর এক পা-ও হাঁটতে পারছি না!’
‘কিন্তু বাঁচতে চাইলে হাঁটতে হবে, স্যর!’
যে-কোন সময়ে রানা বা তার দলের লোকের সঙ্গে দেখা হবে, দুশ্চিন্তা বাড়ছে ক্যাসিডির। ব্যালার্ডের কনুই ধরে ব্যস্ত হয়ে ঢুকল ড্রেসিংরুম এলাকায়। চট্ করে চলে গেল নির্দিষ্ট ড্রেসিংরুমের সামনে। চাবির গোছা থেকে সঠিক চাবি খুঁজতে গিয়ে সময় লাগল। থরথর করে কাঁপছে তার হাত। ভয় পেয়েছে বলে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে ব্যালার্ড। তার ওপরে শুরু হয়েছে তার শ্বাসকষ্ট। বুড়ো-হাবড়া আর মরার জায়গা পেল না, মনে মনে বলল ক্যাসিডি।
ড্রেসিংরুমের দরজা খুলে ব্যালার্ডকে প্রায় জোর করে কাঠের টুলে বসিয়ে দিল সে। লকারের তালায় চাবি ভরে খুলে নিল লোহার ডালা। পঁচিশ বছর ধরে ক্লাবের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত এক পুলিশ কমাণ্ডার এই লকারের মালিক। সিন্দুক হাতড়ে ক্যাসিডি বের করল কোল্ট .৪৫ অটোমেটিক পিস্তল। বহুদিন আগে এক ড্রাগ্স্ ডিলারের কাছ থেকে ওটা বাজেয়াপ্ত করেছিল পুলিশ অফিসার। তবে পরে থানার জমাখানায় দেয়নি। হোলস্টার থেকে স্টিলের অস্ত্রটা বের করে চেক করল ক্যাসিডি। ম্যাগাযিনে আছে সাতটা বুলেট। বহু বছর লড়াই না করলেও, ওই বিদ্যা একবার শিখে গেলে ভুলে যায় না কেউ।
কোল্টের চেম্বারে গুলি ভরল ক্যাসিডি। অফ করে নিল সেফটি। টের পেল, পিস্তলটা আবারও বুকে ফিরিয়ে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। সাহস থাকলে আসুক না মাসুদ রানা, এক গুলিতে তার বুক ফুটো করে দেবে সে!
টুলে বসে হাঁপানি রোগীর মত হাঁসফাঁস করছে ব্যালার্ড। রাগ-ক্ষোভ-দুঃখে তিনদিনের মরা মাছের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার মুখের ত্বক। ক্যাসিডির বুকের দিকে কাঁপা তর্জনী তাক করল সে। কর্কশ স্বরে বলল, ‘তোমাকে বাঁচতে দেব না, রিপার! তুমি যে এতবড় গাধা, কখনও ভাবতেও পারিনি! তোমার জন্যে শেষ হয়ে গেল এতদিনের রাজকীয় ঐতিহ্য! তোমাকে খুন করে মুণ্ডটা গেঁথে দেব শিকে। গ্লাস ভরে পান করব তোমার রক্ত। তোমার পচে যাওয়া দেহ খুবলে খেয়ে নেবে ক্ষুধার্ত কাক ও ইঁদুর। আমার কথা কি তোমার কানে ঢুকেছে, নির্বোধ-অপদার্থ?’
জবাবে কড়া চোখে তাকে দেখল ক্যাসিডি। তিক্ত মনে বলল, ‘জী, আপনার বক্তব্য আমি খুব মন দিয়ে শুনেছি। তবে কিছু কথা না বললেই নয়: আপনার নানান হুমকি আর মেয়েলি ঘ্যানঘ্যানানি বহুকাল ধরেই সহ্য করেছি। তাই মনে রাখবেন: আপনার শুঁটকি পোঁদে চপাচপ চুমু দিয়ে নিজের ভালমন্দ না দেখে, বছরের পর বছর ধরে আপনাকে নিরাপত্তা না দিলে, আপনার সব স্বার্থ রক্ষা না করলে, বহু আগেই ভরাডুবি হতো থঅথের কাল্টের! তাই আপনাকে বলছি, স্যর, আমার প্রতি যথেষ্ট সম্মানবোধ আপনার থাকা উচিত। সুতরাং এবার বুজে রাখুন বিষে ভরা আপনার নোংরা মুখটা। আর সেটা যদি না করেন, তো আপনার মুরগির গলার মত সরু গলা দিয়ে পড়পড় করে ভরে দেব আমার হাতের এই পিস্তল। এতেই থামব না। আপনার পোঁদ দিয়ে বের করে নেব অস্ত্রটা। এবং সেটা করব হাসতে হাসতে খুশিমনে। এবার আমার কথা কি আপনার মগজে ঢুকেছে?’
ভীষণ ভয়ে পিছিয়ে বসতে চাইল ব্যালার্ড। এখন চোখে সেই তীব্র আক্রোশ নেই। সেখানে ভর করেছে নিখাদ আতঙ্ক। কয়েক মুহূর্ত কঠোর চোখে বুড়োকে দেখে নিয়ে ফোন হাতে নিল ক্যাসিডি। কল দিল পাইলট ওয়াল্টারকে।
দ্বিতীয় রিঙে ফোন ধরল পাইলট।
ক্যাসিডি ভেবেছিল শুনবে যান্ত্রিক বিকট আওয়াজ। অথচ ওদিকে জোরালো কোন শব্দ নেই। ধক্ করে উঠল তার বুক। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইল, ‘তুমি কই? দেরি হচ্ছে কেন?’
এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিনে বাজে সমস্যা,’ বলল পাইলট ওয়াল্টার। ‘এমনটা যখন-তখন হতে পারে। মেরামত হলে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হব।’
তার কথায় জুতোর ভেতরে সেঁধিয়ে গেল ক্যাসিডির হৃৎপিণ্ড। চাপা স্বরে ধমকে উঠল সে, ‘আরে, জলদি, গাধা!’