1 of 2

কিলিং মিশন – ১৮

আঠারো

মাসুদ রানা যখন কথা বলছে উইলবার ফক্সের সঙ্গে, ওই একইসময়ে ফ্রান্সের নরম্যাণ্ডিতে রানা এজেন্সির কিচেনে বসে আলাপ করছে জনি ওয়াকার ও রামিন রেজা। ভোরে সূর্যের লালচে কিরণ দিগন্তের কোলে হেসে ওঠার আগেই দশম কাপ কফি শেষ করে সিদ্ধান্ত নিল ওরা, ওদের পক্ষে সম্ভব নয় রানার অনুরোধ রাখা।

‘তবে আরও ভাবতে হবে,’ বলল রামিন। ‘মাসুদ ভাই যা বলেছেন, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, আমাদের কোন ভুল হলে খুন হবে জেসিকা।’

‘তাই বলে তো আর ঠুটো জগন্নাথের মত বসে থাকা যায় না,’ বলল ওয়াকার। ‘অবশ্যই সতর্ক থাকব। ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা স্নেহের ছোট ভাই হিসেবে বিপদে রানাকে সাহায্য করা আমাদের উচিত।’

‘তা-ই চাই। কিন্তু জানিই তো না কী ঘটছে। জানা নেই কোথায় গেছেন মাসুদ ভাই। লণ্ডন তো ছোট কোন শহর নয়।

মাথা দোলাল ওয়াকার। ‘ওখানে ওকে খুঁজতে যাওয়া খড়ের স্তূপে সুঁই খোঁজার মত।’

‘সেক্ষেত্রে আমাদের কী করা উচিত?’

কী যেন ভেবে নিয়ে বলল ওয়াকার, ‘এখন পথ খোলা মাত্র একটা। যে-কারণেই হোক স্কটল্যাণ্ডে যায়নি রানা। তাই বলে এমন তো নয় যে আমরা ওখানে যেতে পারব না।’

কথাটা শুনে অস্বস্তি বোধ করল রামিন। ‘তাতে হয়তো ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে পড়বে জেসিকা। কেউ না কেউ চোখ রেখেছে ওর ওপর।’

‘আগে কখনও স্কটল্যাণ্ডে গেছ?’ জানতে চাইল ওয়াকার।

মাথা নাড়ল রামিন। ‘না। সেই সুযোগ হয়নি।’

‘শেষবার গেছি কয়েক বছর আগে,’ বলল ওয়াকার। ‘গ্লাসগোর পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে নেভাল বেস এইচএমএনবি ক্লাইড-এ। ওখানে আছে নিউক্লিয়ার ওয়েপন্স ডিপো। রয়েল নেভির শক্তিশালী বেস। ওখানে আছে নেভির স্পেশাল ফোর্সের ইউনিট। …তো, যা বলছিলাম, জেসিকার গ্রামে আমাকে বা তোমাকে দেখেনি কেউ। যারা ওর ওপর চোখ রেখেছে, তারাও চেনে না। গ্রামে আমরা হাজির হব আগন্তুকের মত। নজর রাখব চারদিকে। দরকারে যা করতে হবে, সেটা করব।

‘শুনেছি কিনলোকার্ডের জনসংখ্যা বড়জোর দু’শ’, বলল রামিন। ‘আমার মত বাদামি চামড়ার কেউ ওখানে গেলে দুইবার ঘুরে দেখবে তারা।

‘তুমি থাকবে চোখের আড়ালে,’ বলল ওয়াকার। ‘আর আমাকে নিয়ে কেউ কৌতূহলী হবে বলে মনে হয় না। সাদা আদমি, বেড়াতে গেছি গ্রামের কোন আত্মীয়ের বাড়িতে।’

‘আমাদের ছবি আছে রানা এজেন্সির ওয়েব সাইটে,’ বলল রামিন। ‘যারা জেসিকার ওপরে চোখ রেখেছে, তারা হয়তো দেখলেই সতর্ক হয়ে উঠবে।’

‘হয়তো। তবে তার সম্ভাবনা খুব কম। তা ছাড়া, আমরা থাকব ছদ্মবেশে।’

চুপ করে থাকল রামিন

‘কী বলো, রামিন?’ ঝুঁকে বসল ওয়াকার।

‘ধরে নিন, শত্রুপক্ষ মাসুদ ভাইকে বলেছে, যেন জেসিকার সঙ্গে তিনি যোগাযোগ না করেন। তা-ই না?’

মৃদু মাথা দোলাল ওয়াকার। ‘হয়তো। তো?’

‘তো জেসিকার সঙ্গে মাসুদ ভাই কথা বললে তারা জেনে যাবে। সেক্ষেত্রে মেয়েটার সঙ্গে আমরা কথা বললেও তো ওর সেই সর্বনাশই হবে।’

‘বলতে থাকো,’ বলল ওয়াকার।

‘হয়তো আমাদের ফোন মনিটর করছে। কান পাতা হচ্ছে ল্যাণ্ড ফোনেও। আর সেজন্যেই বাধ্য হয়ে নিজের স্মার্টফোন ফেলে গেছেন মাসুদ ভাই। অবস্থা আসলে কতটা খারাপ, সেটা বুঝতে পেরেছেন?’

‘বুঝেছি।’

‘আমরা একদল চোরের সঙ্গে ডিল করছি না। এদের যেমন আছে ক্ষমতা, তেমনি তারা সতর্ক। পেশাদার একদল লোক।’

‘আমরাও তো পেশাদার,’ বলল ওয়াকার।

‘তাদের মত নই আমরা,’ বলল রামিন। ‘কাদের কাছে ই-মেইল বা মোবাইল ফোন মনিটরের টেকনোলজি থাকে, বলুন তো? ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি আর সরকার।’

‘তুমি কিন্তু আঁধারে ঢিল ছুঁড়ছ,’ বলল ওয়াকার। ‘তোমার প্রথম কথা মেনে নিয়েছি। তবে পরের কথা মেনে নিতে পারলাম না। ওগুলো শুধুই তোমার করা আন্দাজ।

‘এরা কারা, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে না আপনার?’

‘তাদের সঙ্গে মোকাবিলা হলে তখন ভাবব। আমার মনে হয় না রানা বা জেসিকার ওপরে চোখ রেখেছে সরকারি কোন এজেন্সি। এমন হওয়ার কোন কারণ দেখছি না। জেসিকা গ্রামের মহিলা পুলিশ। এদিকে গত কয়েক মাসে বিসিআই থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়নি রানাকে। কখনও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে কিছুই করেনি। সেক্ষেত্রে ওর ওপরে চোখ রাখবে কেন তারা?’

‘মাসুদ ভাই তো সাধারণ কেউ নন,’ বলল রামিন। ‘এটা কি ভুলে গেছেন?’

‘তবুও মেনে নিতে পারলাম না তোমার কথা। …সরকারি এজেণ্ট? ধুর! তুমি বেশি বেশি ভাবছ!’

‘আমি ঝুঁকি নিতে চাইছি না,’ বলল রামিন। ‘ফোন ট্যাপ করছে, চোখ রাখছে ই-মেইলে। এই অবস্থায় কীভাবে নিশ্চিত হব স্যাটেলাইট দিয়ে আমাদের ওপরে চোখ রেখেছে কি না?’

কাঁধ ঝাঁকাল ওয়াকার। ‘সেটা পারবে না ওরা। আগেই এসব ভাল করে ভেবে নিয়েছি। এরা জানে না, নকল নামে ব্রিটেনে ঢুকেছে রানা। তো ধরে নাও, আমাদের বেলায়ও কিছুই জানবে না।’

‘আপনি কীভাবে ব্রিটেনে ঢুকবেন? আমাদের কাছে তো নকল পাসপোর্টও নেই।’

‘তা ঠিক।’

‘সেক্ষেত্রে বিসিআই-এর স্পেশাল ইফেক্ট ডিপার্টমেন্টের শাহিন মাদবরের সঙ্গে কথা বলতে পারি,’ বলল রামিন। ‘অবশ্য তাতেও ঢাকা থেকে নকল পাসপোর্ট আসতে লাগবে কয়েক দিন।’

‘পাসপোর্ট লাগবে না, অন্য উপায় আছে,’ বলল ওয়াকার। এবার নিজের প্ল্যান খুলে বলতে লাগল সে।

মন দিয়ে শুনছে রামিন। একটু পর মাথা দোলাল। ‘এটা হয়তো সম্ভব।’

পরের একঘণ্টায় ওরা থাকল খুব ব্যস্ত। অফিস বন্ধ লেখা বড় এক নোটিশ বোর্ড রানা এজেন্সির সামনের গেটে ঝুলিয়ে দিল। রানার স্মার্টফোন থেকে নিজেদের ফোনে নিল জরুরি সব তথ্য। বাদ পড়ল না জেসিকার গ্রামের ঠিকানা। প্রতিটি দিকে নজর রাখল ওয়াকার ও রামিন। তারপর সকাল আটটায় ল্যাণ্ড ক্রুয়ারে চেপে নয় মাইল দূরের এক ফ্লাইং স্কুলের দিকে রওনা হলো ওরা। ওখানে ব্যক্তিগত হ্যাঙারে ওয়াকার রেখেছে ওর জীবনানন্দ। প্রচুর ফিউয়েল আছে ওটার টেটম্বুর পেটে। ওয়াকার জানাল, অনায়াসে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনের উত্তর ওয়েলসের রেক্সহ্যাম শহরে পৌঁছে যাবে সেসনা ১৮২ স্কাইলাইন। ওটার রেঞ্জ আট শ’ মাইল। গন্তব্যে যেতে এবং আবার ফ্রান্সে ফিরতে উড়তে হবে ওদেরকে বড়জোর ছয় শ’ ষাট মাইল।

‘রেক্সহ্যাম শহরে কেন?’ জানতে চাইল রামিন।

‘কারণ ওখানেই খামার করেছে জো ডিগবার্ট।’

‘সে কে? আপনার কোন বন্ধু?’

‘নেভিতে একইসঙ্গে চাকরি করতাম দুই বন্ধু। ওর খামারে একটা এয়ারস্ট্রিপ আছে।’

‘ফ্রান্স থেকে বেরোতে কাগজপত্র লাগবে না? সীমান্তে বাধা দেবে না বর্ডার কন্ট্রোল?’

রামিনের দিকে চেয়ে করুণার হাসি দিল ওয়াকার। ‘কীসের আবার সীমান্ত রক্ষী?’

‘বুঝলাম,’ উদাস হলো রামিন। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘কিন্তু উত্তর ওয়েল্স থেকে স্কটিশ হাইল্যাণ্ড তো বহুদূরে!’

ওর কোমরে কনুইয়ের গুঁতো দিল ওয়াকার। ‘ওয়াকার আঙ্কেলের ওপরে ভরসা রাখো, বাছা! ডিগবার্টের বিশেষ এক ভ্যান আছে। ওটা নিয়ে ছয় ঘণ্টায় পৌঁছে যাব জেসিকার গ্রামে। সহজ কাজ।

‘তারপর যা ঘটবে, সেটা নিয়েই যত দুশ্চিন্তা,’ বিড়বিড় করল রামিন।

সোয়া আটটায় ফ্লাইং স্কুলে পৌঁছে গেল ওরা। ছোট এক হ্যাঙারের সামনে কড়া ব্রেক কষে থামল ওয়াকার। লাফ দিয়ে নামল জিপ থেকে। তালা খুলে কর্কশ আওয়াজে সরাল হ্যাঙারের স্টিলের চওড়া দরজা। জিপ থেকে নেমে রামিন দেখল, নাকে সিঙ্গেল ইঞ্জিন নিয়ে বসে আছে উঁচু দুই ডানাসহ আকাশী নীল রঙের এক বিমান। ভুরু কুঁচকে গেল ওর। তুবড়ে যাওয়া এয়ারক্রাফটের বয়স হবে নিদেন পক্ষে পঞ্চাশ বছর!

ওয়াকারের বিমান দেখে গলা শুকিয়ে গেছে রামিনের। তিক্ত স্বরে বলল, ‘একটু আগে কথা হয়েছে রাইট ব্রাদারদের সঙ্গে। ওরা ফেরত চেয়েছে ওদের প্রথম মেশিনটা।’

‘অত টিটকারির কিছু নেই,’ গম্ভীর হয়ে গেল ওয়াকার। ‘এবার হাত লাগাও, ওকে হ্যাঙার থেকে বের করতে হবে।’

‘ভাবছেন মরচের স্তূপটা সত্যিই আকাশে উড়বে?’ আবারও বড় করে শ্বাস ফেলল রামিন।

আদর করে সেসনার ফিউজেলাজে চাপড় দিল ওয়াকার। তাতে খসে পড়ল না কিছু। ‘বাজে কথা বাদ দাও, রামিন রেজা! তুমি জানো না, একদিন ইতিহাস গড়বে এই মেয়ে! ঘোড়ার মত লম্বা চেহারা না করে টেনে বের করো ওকে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *