1 of 2

কিলিং মিশন – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

ক্রিস্টোফার গানের দিকে পূর্ণ মনোযোগ ছিল রানা ও ফক্সের, তাই দেখেনি কাছের এক গাছের পাশে এসে থেমেছে ডায়ানা গান। খালি পায়ে দাঁড়িয়ে মাতালের মত টলছে মহিলা। সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। পরনে লেস দেয়া নাইট ড্রেসের ওপরে নীল গাউন। চুল উস্কোখুস্কো। চোখের কোলে গভীর কালো দাগ, যেন ঘুষি মেরেছে কেউ। সম্মোহিত মানুষের মত অপলক চোখে দেখছে, কবজি ও গোড়ালি টেপ দিয়ে আটকে বসিয়ে রাখা হয়েছে তার স্বামীকে। অস্ত্র হাতে জেরা করছে অচেনা দু’জন লোক। অবশ্য সেজন্যে কোন ধরনের বিকার দেখা গেল না মহিলার ভেতরে।

হঠাৎ তাকে দেখে চমকে গেছে রানা। আবছাভাবে শুনতে পেল বিড়বিড় করল ফক্স, ‘যা শালা!’

স্ত্রীকে বাগানে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে ক্রিস্টোফার গান। হুঁশ ফিরতেই বলল, ‘তুমি এখানে কী করছ, ডায়ানা?’

‘ঘুমাতে পারিনি,’ ভোঁতা স্বরে বলল মহিলা। ‘কড়া ওষুধ খেয়েও বুকের ব্যথা কমেনি। বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে নিচে চেয়ে দেখলাম বাগানে আলো। একতলায় নেমে বুঝলাম সামনের দরজা খোলা। মনে হলো তুমি বাগানে আছ। তাই খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছি। আর তারপর দেখলাম এই দু’জনকে। এদের সঙ্গে কথা বলছিলে তুমি।’

‘কতক্ষণ আগে এসেছ?’ কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল ক্রিস্টোফার গানের।

মহিলা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই কথা শুনেছে, ধারণা করল রানা। সত্যিটা তার জানতেই হতো। হয়তো এ-ই ভাল হয়েছে যে নিজের কানে শুনেছে স্বামীর বক্তব্য। খালি পায়ে টলতে টলতে এগোল সে। ঘোলা চোখে দেখল রানা ও ফক্সকে। রানা বুঝল, ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘন ঘোরের ভেতরে আছে মহিলা। তবে প্রতি মুহূর্তে কেটে যাচ্ছে নেশা। বুঝতে শুরু করেছে, এখানে আসলে কী ঘটছে। ডায়ানা আরও দু’পা এগোতেই সে যেন ভয় না পায়, তাই অস্ত্রটা মাটিতে নামিয়ে রাখল রানা। নরম সুরে বলল, ‘মস্তবড় ক্ষতি হলো আপনার। সেজন্যে আমি দুঃখিত। চাইনি আমাদের সঙ্গে আপনার দেখা হোক। আমরা আপনার কোন ক্ষতি করতে আসিনি।’

‘এখানে আসলে কী হচ্ছে?’ বেসুরো কণ্ঠে বলল ডায়ানা। ‘আপনারা কারা? আমার স্বামীকে আটকে রেখেছেন কেন?’

‘আপনার স্বামী ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে জড়িত,’ বলল রানা। ‘শুধু যে আপনার মেয়ে নেলির হত্যার সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে, তা নয়, বহু মানুষের মৃত্যু ঘটেছে তার জন্যে। আমরা এখানে এসেছি চরম অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে।’

‘ওদের একটা কথাও শুনবে না,’ বলে উঠল ক্রিস্টোফার গান। ‘এরা ভয়ঙ্কর খুনে ডাকাত। এখানে এসেছে সিন্দুকের তালার কম্বিনেশন জেনে নেয়ার জন্যে।

স্বামীর দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল ডায়ানা। ‘কিন্তু আমি যে শুনলাম তুমি কী বললে! এরা মিথ্যা বললে এভাবে গড়গড় করে স্বীকারোক্তি দিলে কেন?’

ক্রিস্টোফার গান বুঝে গেল তার কথাগুলো শুনে ফেলেছে ডায়ানা। এখন আর মিথ্যা বলে পার পাবে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। ‘এসব তো তোমার জানার কথা নয়, ডায়ানা! তুমি এসব শুনলে কেন!’

‘তুমি বলেছ নিজেই নেলিকে খুন করিয়েছ। তার আগে ওকে ড্রাগস্‌ দেয়া হয়েছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, ক্রিস্টো! নেলি না মারা গেল গাড়ি-দুর্ঘটনায়?’

‘ওটা দুর্ঘটনা ছিল না,’ বলল ফক্স। ‘নিজের ক্ষমতার বলে ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখিয়ে দিয়েছে আপনার স্বামী।’

ঘোর থেকে ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠছে মহিলা। চোখের ভাষায় চরম যন্ত্রণার ছাপ। কাঁপা হাতে ঢেকে ফেলল মুখ। কাঁদতে শুরু করে বলল, ‘আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না! এখানে এসব কী ঘটছে?’

‘আপনি বরং আপনার স্বামীকে জিজ্ঞেস করুন, কীভাবে মারা গেছে আপনাদের মেয়ে, নরম সুরে বলল রানা।

‘আমি কিছুই বলব না!’ জেদী গলায় বলল ক্রিস্টোফার গান। ‘আমাকে জোর করে কিছু বলাতে পারবেন না!’

‘বলতে তোমাকে হবেই,’ কঠোর সুরে বলল রানা। ‘প্রথম থেকে সব খুলে বলবে।’

‘আমি নেলিকে খুন করিনি!’ ফুঁপিয়ে উঠল সাংসদ। ‘ওরা আমাকে বাধ্য করেছে এসব করতে!’

মৃদু মাথা নাড়ল ডায়ানা। ‘কারা কী করতে বাধ্য করেছে তোমাকে, ক্রিস্টো?’

বিড়বিড় করল লোকটা, ‘জানোও না ওরা কত ভয়ঙ্কর! যা-খুশি করবে! ওটা একটা অশুভ ধর্ম! শয়তান-পূজা করে ওরা! সত্যিকারের উন্মাদ!’

‘আর তুমি হচ্ছ তাদের মধ্যে সেরা হারামি,’ বলল ফক্স।

‘না!’

‘কীসের ধর্ম?’ জানতে চাইল ডায়ানা গান।

‘আপনার স্বামী আর তার বন্ধুরা নিজেদের মঙ্গল কামনা করে শয়তানের কাছে নরবলি দেয়,’ বলল রানা। ‘খুন হওয়া নিরীহ মানুষগুলোর একজন হচ্ছে আপনার মেয়ে নেলি।’

গাল কুঁচকে গেল মহিলার। বিড়বিড় করল, ‘নরবলি!’

‘মানুষকে ধরে নিয়ে জবাই করে আপনার স্বামী আর তার বন্ধুরা,’ বলল রানা। ‘খুনের পর সব এমনভাবে সাজায়, যেন সবাই মনে করে যে মানুষটা মারা গেছে দুর্ঘটনায়।’

বড় করে শ্বাস নিল ডায়ানা। ‘তার মানে, আপনি বলতে চাইছেন… নেলি… ওকে এভাবে খুন করা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘আমাদের কাছে তার প্রমাণ আছে।’ চাইছে না মেয়ের মৃত্যুদৃশ্য দেখুক মহিলা।

‘ক্রিস্টো? তুমি সব খুলে বলো!’ স্বামীর দিকে তাকাল ডায়ানা। মুখে ভীষণ আতঙ্ক। ভাবছে: ঘুম ভেঙে গেলেই শেষ হবে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন।

কোণঠাসা জন্তুর মত কুঁজো হলো ক্রিস্টোফার গান। তার জ্বলন্ত দুই চোখ থেকে রানা ও ফক্সের প্রতি ঝরছে তীব্র ঘৃণা। খেপা কুকুরের মত বেরিয়ে এল দাঁত। চাপা স্বরে বলল, ‘আমি আর কিছুই গোপন করব না! মিথ্যা বলে আমার কী লাভ?’

‘হায়, ঈশ্বর!’ আঁৎকে উঠল ডায়ানা, ‘তা হলে সব সত্যি?’

‘আমার সামনে মিথ্যা স্রষ্টার নাম বলবে না!’ ধমকের সুরে বলল ক্রিস্টোফার গান। ‘হ্যাঁ, কুকুরগুলো যা বলেছে, তার সবই ঠিক! কোন মিথ্যা কথা বলেনি! ইচ্ছে হলে যা-খুশি ভাবতে পারো, তবে তাতে আমার কিছুই যায় আসবে না!’

প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে টলে উঠল ডায়ানা গান। রানা ও ফক্স ভাবল, মাটিতে লুটিয়ে পড়বে মহিলা। কোমরের পাশে হাত রেখে প্রায় দু’ভাজ হলো সে। ফাঁকা হয়ে গেছে মগজ। তবে কিছুক্ষণ পর আবারও সোজা হয়ে দাঁড়াল। রাগ ও দুঃখে চোখ দিয়ে দরদর করে ঝরছে অশ্রু। ফিসফিস করে বলল, ‘কিন্তু এটা তো হতে পারে না! তুমি নিজে কী করে খুন করালে আমাদের বাচ্চা মেয়েটাকে!’

‘এহ্, আবার বলে বাচ্চা মেয়ে!’ নিষ্ঠুর চোখে স্ত্রীকে দেখল সাংসদ। থরথর করে কাঁপছে রাগে। ‘তোমার আদরে বখে যাওয়া মেয়ে তো শেষ করে দিচ্ছিল আমার জীবন! আমাকে ঘৃণা করত কুত্তীটা! সর্বনাশ করছিল আমার ক্যারিয়ারের! আমার উচিত ছিল বহু আগেই তাকে সরিয়ে দেয়া! আমার লোকবলের অভাব নেই! এবার তাদের সাহায্য নিয়েছি! এ-ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না! কুত্তীটা যে শেষমেশ মরে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, সেজন্যে আমি খুশি!’ দেশের ক্ষমতাশালী একদল লোক আমার ভালর জন্যে ওকে সরিয়ে দিয়েছে! আমার কথা বুঝতে পেরেছ, ডায়ানা?

হতবাক হয়ে গেছে তার স্ত্রী। চোখ থেকে মিলিয়ে গেল ঘোলাটে ভাব। এখন অদ্ভুত শান্ত ও আবেগশূন্য হয়ে গেছে সে। চোখে একফোঁটা অশ্রু নেই। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘আমাদের মেয়েটার অনেক সমস্যা ছিল। হয়তো ভাল মেয়ে ছিল না। তবুও তো আমার কাছে ছিল ছোটবেলার সেই লক্ষ্মী পুতুল! নিজের চেয়ে বেশি ওকে ভালবাসতাম! অথচ নিজের ক্যারিয়ারের জন্যে আমার কোল খালি করে দিয়েছ তুমি! ভাল করেই জানতাম নীচ মনের মানুষ তুমি, বড় বেশি স্বার্থপর। নিজেরটা ছাড়া কিছুই বুঝতে না। কিন্তু তাই বলে ভাবতেও পারিনি, তুমি আসলে এতবড় দানব! আমি… আমি এটা কোনভাবেই বুঝতে পারছি না, কী করে নিজের মেয়েকে খুন করালে তুমি!’

‘তুমি বুঝবে কীভাবে, গাধী মেয়েলোক!’ গলা ফাটিয়ে চেঁচাল ক্রিস্টোফার গান। ‘তোমার কি সেই বুদ্ধি আছে! মাথা-নষ্ট, নির্বোধ কুত্তী! দুনিয়ার কিছুই তোমার মগজে ঢোকে না! আমার সঙ্গে বিয়ে না হলে এতদিনে বস্তিতে গিয়ে উঠতে! দিনে দশবার করে বিছানায় যেতে পেটের দায়ে! আমার উচিত ছিল তোমাকেসহ কুত্তী নেলিকে গ্র্যাণ্ড মাস্টারের হাতে তুলে দেয়া!’

চুপ করে আছে ডায়ানা। হঠাৎ তার চোখ পড়ল মাটিতে রাখা রানার অস্ত্রের ওপরে। কয়েক পা সরে সাবমেশিন গান তুলে নিল সে। রাগে থরথর করে কাঁপছে তার স্বামী। কঠোর চোখে দেখছে স্ত্রীকে। মানসিক যন্ত্রণা দিতে পেরে খুশি। ক্রিস্টোফার গানের দিকে না চেয়ে রানার চোখে চাইল ডায়ানা গান। ‘আগে এই অস্ত্র আমাদের সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে দেখেছি। তারাও কি ক্রিসের সঙ্গে এসবে জড়িত?’

‘আমরা সেটা ভাবলে এতক্ষণে খুন হতো ওরা,’ বলল রানা।

‘দয়া করে বলুন আপনারা কারা।’

‘শয়তান-পূজারীদের বিরুদ্ধে লড়ছি এমন দু’জন মানুষ আমরা,’ বলল রানা।

‘এখান থেকে বেরিয়ে কী করবেন আপনারা?’

‘লড়ব অশুভ এক দলের বিরুদ্ধে। এতদিন ধরে আপনার স্বামী আর তার বন্ধুরা যা করেছে, সেজন্যে তাদেরকে শাস্তি দেব। নেলি বা আরও যারা খুন হয়েছে, তাদের পক্ষ নিয়ে প্রতিশোধ নেব।’

ধীরে ধীরে মাথা দোলাল ডায়ানা গান। ‘বেশ। এবার কি আপনি দয়া করে দেখিয়ে দেবেন কীভাবে লোড করতে হয় এই অস্ত্র?’

‘ম্যাগাযিনে গুলি আছে। প্লিয, ওটা রেখে দিন।’

‘এই শুয়োর কিন্তু ঠিকই বলেছে, নির্বোধ মেয়েলোক!’ কর্কশ স্বরে বলল ক্রিস্টোফার গান। ‘যে-কোন সময়ে ওটা থেকে গুলি বেরিয়ে যেতে পারে!’

কথাগুলো শুনেও অস্ত্র নামাল না ডায়ানা। স্বামীর বুক লক্ষ্য করে ঘোরাল সাবমেশিন গানের নল। বেকায়দাভাবে ধরেছে অস্ত্র। অবশ্য এত কম রেঞ্জে টার্গেট মিস করবে না কেউ।

ক্রিস্টোফার গানের চোখ থেকে মিলিয়ে গেল রাগের ছাপ। ওখানে ফুটল অসহায় দৃষ্টি। প্রাণপণে খুলতে চাইল কবজির টেপ। কাঁপা গলায় বলল, ‘ডায়ানা! মস্ত ভুল করছ! নাহ্! বিশ্বাস করো, এসব তোমাকে বলতে চাইনি!’

অস্ত্রের নলের ওপর দিয়ে স্বামীকে দেখল ডায়ানা গান। শান্ত গলায় রানা ও ফক্সকে বলল, ‘আজ আমার স্বামীকে খুন করতে এসেছেন। তবে সেটা কেন করতে চেয়েছেন, কোন দিন কেউ জানবে না। আপনারা হয়তো টেরোরিস্ট, ভাড়াটে খুনি বা সাধারণ কোন লুটেরা। যদিও তাতে এখন আর কিছুই যায় আসবে না। সিকিউরিটি গার্ডদের বন্দি করেছেন। তারপর তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া অস্ত্র দিয়ে খুন করেছেন আমার স্বামীকে। বাড়ি ডাকাতি করে চলে গেছেন। কেউ জানে না কোথায়। অর্থাৎ কোন সাক্ষী নেই। আমি ছিলাম দোতলায় বেডরুমে, ঘুমন্ত। কিছুই জানি না। আপনাদের কি মনে হচ্ছে আমার এই গল্পটা অবিশ্বাস করবে পুলিশের লোক?’

রানা চুপ করে থাকলেও ফক্স মুখ খুলল, ‘আমার মনে হয় না যে এই গল্পে কোথাও কোন ত্রুটি আছে

মুক্ত হওয়ার জন্যে ঘাসের ওপরে কেন্নোর মত শরীর মোচড়াতে শুরু করেছে ক্রিস্টোফার গান। ‘ডায়ানা! … কেউ কি নেই? … দয়া করুন! … আমাকে মেরে ফেলল এরা!’

‘কেউ নেই যে প্রাণে বাঁচাবে,’ শীতল স্বরে বলল ডায়ানা গান। ‘এবার বিদায় নাও, ক্রিস্টো! প্রার্থনা করি, চিরকাল যেন নরকের আগুনে পুড়ে ছাই হতে থাকো!’

একটু দ্বিধা করে ট্রিগারে চাপ দিল মহিলা।

তাতে কিছুই ঘটল না।

‘অস্ত্রের সেফটি অফ করতে হবে,’ বলল ফক্স। ‘বুড়ো আঙুলের কাছে পাবেন ঘুরিয়ে নেয়ার মত ছোট লিভার।’

‘বুঝেছি,’ ক্যাচ লিভার পেয়ে ঠিক জায়গায় ওটা বসিয়ে নিল ডায়ানা। ‘পাশের সুইচটা কীসের?’

‘ফুল অটোমেটিক ফায়ারের জন্যে,’ বলল ফক্স। সেক্ষেত্রে শুরু হবে টানা ঠেকা-ঠেকা-ঠেকা!’

‘সেটা কি ভাল?’

‘তাতে মুহূর্তে মরবে শত্রু।

‘তবে তো সেটাই ভাল। নোংরা এক কুকুরকে খামোকা কষ্ট দিয়ে কী লাভ আমার?’ সিলেক্ট ফায়ার সুইচ ঠিক জায়গায় নিল ডায়ানা।

‘আপনি এটা না করলেও পারেন,’ বলল রানা।

ওর কথা শোনো, ডায়ানা! আমাকে মাফ করে দাও!’ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল ক্রিস্টোফার গান। ভীষণ ভয়ে সাপের মত কিলবিল করে গিয়ে ঢুকতে চাইছে একটু দূরের ঝোপে।

‘আমার ভাল লাগবে ওকে গুলি করতে,’ বলল ডায়ানা।

‘যা ভাল মনে হয়, সেটাই করুন,’ বলল ফক্স।

‘আমার জীবনে আর কিছুই নেই,’ বলল ডায়ানা। ‘এবার অন্তত নিজের ইচ্ছেমত কিছু করতে পারব।’

ট্রিগারে চাপ দিল মহিলা, দ্বিধা নেই মনে। একগাদা গুলির বিশ্রী কর্কশ আওয়াজ কমিয়ে দিল সাইলেন্সার। প্রতি মিনিটে আট শ গুলিবর্ষণ করবে সাবমেশিন গান। দু’সেকেণ্ডের সামান্য বেশি সময়ে ম্যাগাযিন থেকে বেরোল বত্রিশ রাউণ্ড গুলি। অস্ত্র খালি হওয়ার আগে ট্রিগারে চাপ কমাল না ডায়ানা। এখন বাগানে হাঁচড়েপাঁচড়ে সরতে চাইছে না ক্রিস্টোফার গান। মাত্র ক’বার ঝাঁকি খেয়েছে সে। চাঁদের আলোয় ঘাসের গালিচায় ছড়িয়ে পড়ছে কালচে তরল।

হঠাৎ চারপাশে নেমেছে নীরবতা। অস্ত্রটা নিচু করে নিল ডায়ানা। গাউনের পকেট থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে সাবধানে মুছে দিল অস্ত্রের ওপরে পড়া হাতের আঙুলের ছাপ। তারপর রানার দিকে ছুঁড়ে দিল সাবমেশিন গান। খপ্ করে ওটা ধরল রানা। শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি থেকে ওর বলতে ইচ্ছে হলো: আমি সত্যিই দুঃখিত। যদিও মুখে কোন কথা এল না ওর। মনে পড়ল গতকালের সেই দৃশ্য: অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে মহিলা!

‘এবার বাড়িতে গিয়ে শুয়ে পড়ব,’ বলল ডায়ানা। ‘ডাক্তার যেসব কড়া ওষুধ দিয়েছে, তাতে হয়তো ঘুমিয়ে কেটে যাবে আগামীকাল। এমনও হতে পারে, ঘুম ভাঙবে দেড় বা দু’দিন পর। তখনই বুঝব ডাকাতি হয়েছে বাড়িতে। খুন হয়েছে আমার প্রাণপ্রিয় স্বামী। ফোন দেব পুলিশে। আশা করি এর ভেতরে আপনারা নিজেদের কাজ গুছিয়ে নেবেন। পারবেন না?’

মহিলা কী বলতে চায়, বুঝে গেছে রানা। নরম গলায় বলল, ‘আপনি আমাদের কথা থেকে জেনেছেন, আগামীকাল রাতে কী ঘটবে।’

মাথা দোলাল ডায়ানা। ‘আমার স্বামী মারা গেছে সেটা শুনলে হয়তো তার বন্ধুরা সেই অনুষ্ঠানে যাবে না। খবর সবসময় আগুনের চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।’

‘কথাটা মিথ্যা নয়।’

‘তবে আপনারা চান তাদেরকে এক জায়গায় পেতে, তাই না?’

মাথা দোলাল রানা। ‘হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন।’

‘তো আপনাদেরকে বাড়তি সময় এনে দেব।’

‘ছত্রিশ ঘণ্টা হাতে পেলে সব কাজ শেষ করতে পারব।’

এরপর পাগল হয়ে উঠবে ব্রিটেনের সভ্য সমাজ,’ বলল ফক্স। ‘তবে ততক্ষণে বহুদূরে চলে গেছি আমরা।’

‘সিকিউরিটি গার্ডরা বন্দি থাকুক,’ বলল ডায়ানা। ‘দেড়দিন পর ওদেরকে মুক্ত করব। আপনাদের কথা অনুযায়ী সত্যিই যদি ওরা নিরপরাধ হয়, তো খুন’ করব না। এবার বলুন, এই দেড়দিন সময় পেলে আপনাদের চলবে তো?’

‘সিকিউরিটির লোকদেরকে রাখা যাবে এমন এক জায়গা দরকার,’ বলল রানা। ‘ওদেরকে দেব কিছু খাবার ও পানি। পরে উদ্ধার করবে পুলিশের লোক।’

‘বাড়িতে আছে পুরনো সেলার,’ বলল ডায়ানা। ‘আজকাল বোতলজাত পানি ও শুকনো খাবার রাখি। মাটির নিচের সেই ঘরে আগে কয়লা রাখা হতো। মজবুত কাঠের ট্র্যাপডোরের বল্টু বেশ ভারী। গার্ডদেরকে ওখানে নামিয়ে মই তুলে নিলে তারা আর বেরোতে পারবে না।’

‘নিচে নিয়ে হাত-পায়ের টেপ খুলে দেব,’ বলল ফক্স। ‘উঠে এসে সরিয়ে নেব মই।’

‘আমরা নিয়ে যেতে চাই আপনাদের রোল্স রয়েস গাড়িটা,’ বলল রানা।

বাড়ির দিকে আঙুল তাক করল ডায়ানা। ‘নিয়ে যান। গ্যারাজে পাবেন। ওখানেই আছে ওটার চাবি।’

‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘চলে যাওয়ার আগে এমন কিছু কি আছে, যেটা আপনার জন্যে আমরা করতে পারি?’

‘না, তেমন কিছু নেই। বাড়িতে আমার কোন সমস্যা হবে না। অন্তত সেটাই ধারণা করছি। যদিও পরে কী হবে, তা জানি না।’

‘ভাল থাকুন,’ বলল রানা। ‘আশা করি কোন বিপদে পড়বেন না। সবকিছুর জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। অন্য পরিবেশে আপনার সঙ্গে পরিচিত হলে খুশি হতাম। ভাবতাম, সত্যিকারের এক ভদ্রমহিলার সঙ্গ পেয়েছি।’

‘আমি আপনাদের নাম জানি না, জানতেও চাই না,’ বলল ডায়ানা। ‘তবে আজ যা ঘটল, আমিও ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না। এবার পরের কাজগুলো শেষ করুন। আপনারা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ব। মঙ্গল হোক আপনাদের।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *