1 of 2

কিলিং মিশন – ২

দুই

গত পাঁচদিন স্বপ্নের ঘোরে ছিল মাসুদ রানা। অবশ্য সবকিছুরই তো শেষ আছে। ওর ছুটি ফুরিয়ে যাওয়ায় স্কটল্যাণ্ডের ইনভার্নেস শহর থেকে বিমানে চেপে এখন ফিরে চলেছে প্যারিসের উদ্দেশে। ডিম্বাকৃতি জানালা দিয়ে নিচে দেখছে সাদা মেঘের ভেলা। মন পড়ে আছে জেসিকার কাছে কিনলোকার্ড গ্রামে। গত তিনমাসে চারবার ওখানে গেছে রানা। তাই সুযোগ পেলেই জেসিকা আর ওকে নিয়ে ঠাট্টা করছে নরম্যাণ্ডির রানা এজেন্সির শাখা-প্রধান তুখোড় গোয়েন্দা জনি ওয়াকার। কোভিড ১৯-এর মহামারিতে চাকরি নেই বলে রানা এজেন্সিতে যোগ দেয়ার প্রস্তাব রানা দিতেই খুশিমনে কাজে যোগ দিয়েছে ঘনিষ্ঠ এই সিনিয়র বন্ধু।

জেসিকার কথা আবারও ভাবল রানা। নিজের কাজকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেয় মেয়েটা। কথায় কথায় বলেছে, কখনও জড়িয়ে যাবে না সংসারের মায়াজালে। বিয়ের শক্ত বাঁধনে জড়াতে হবে না বলে ওর সঙ্গে রানার সম্পর্কটা হয়ে উঠেছে খুব সহজ ও আন্তরিক।

ভোরে গ্রাম ছেড়ে রওনা হওয়ার আগে রানা দেখেছে, বেডরুমে ঘুমিয়ে আছে জেসিকা। গতরাতে বারবার করে বলেছে নিজে পৌঁছে দেবে ইনভার্নেস এয়ারপোর্টে। তবে ওকে মানা করে দিয়েছে রানা- কষ্ট করে ভোরে উঠতে হবে না।

রাতে নাস্তা তৈরি করে টেবিলে রেখেছে জেসিকা। ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে উঠেছে রানা। সুস্বাদু খাবার ভরপেট খেয়ে গ্রাম ত্যাগ করে সাড়ে ছয়টায় ইনভার্নেস এয়ারপোর্টে গিয়ে বিমানে উঠেছে। তার আগে বন্ধু জনি ওয়াকারকে ফোন করে বলেছে, প্যারিসে নেমে গাড়ি নিয়ে নরম্যাণ্ডিতে পৌঁছুতে রাত হবে ওর।

সেই ফোনকলের পর পার হয়ে গেছে ছয়ঘণ্টা। একবার হিথ্রো এয়ারপোর্টে বিরতির পর বিমান এখন উড়ে চলেছে প্যারিস লক্ষ্য করে।

আপাতত নরম্যাণ্ডির রানা এজেন্সির অফিসে আছে জনি ওয়াকার ও রানার প্রিয় অনুচর রামিন রেজা। হাতে কাজ নেই বলে কয়েক মাস আগে অন্যদেরকে লম্বা ছুটি দিয়েছে রানা। দলবেঁধে বাংলাদেশে ফিরে গেছে ওর সহকর্মীরা।

হঠাৎ করেই বিসিআই-এর কথা মনে আসতেই মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের গম্ভীর মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল রানার। বাধ্য না হলে খুব কম সময়ে ওকে ফোন দিয়েছেন তিনি। অথচ গত তিনমাসে কল করেন তিনবার। প্রথমবার জেসিকার বাড়িতে। রানার ধারণা হয়েছিল দারুণ কোন অ্যাসাইনমেন্ট পাবে। পরে বুঝল, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ কর্নেল হপকিন্সের কাছ থেকে খবর পেয়ে ফোন করেছেন ওর বস। কণ্ঠস্বরে ছিল চাপা উদ্বেগ। অস্বস্তি কাটিয়ে বলেন: ‘কোন সমস্যা হলে ফোন দেবে।’ খুট করে কেটে যায় লাইন।

দ্বিতীয়বার ফোন দেন দু’মাস আগে। তাঁর কথা শুনে রানার মনে হয়েছে, আগের চেয়ে নরম হয়ে গেছেন বৃদ্ধ। হয়তো মানসিক চাপ পড়ছে মহামারির দুঃসময়ে। জানতে চান ও ভাল আছে কি না। কোন সমস্যা নেই তো?

ভাল আছে জানাবার পর বলেছিল রানা, ‘স্যর, আমি কি দেশে ফিরব?’

জবাবে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলেন বৃদ্ধ, ‘আপাতত লাগছে না। সাবধানে থেকো।’

তৃতীয়বার ফোন করেন সাতদিন আগে। কুশল বিনিময়ের পর ফোন রেখে দেন। তার আগে বলেন, ‘অন্যরা দেশেই আছে। তবে আজকাল ‘অফিসটা কেমন যেন নিরানন্দ হয়ে গেছে। কার যেন থাকার কথা, অথচ নেই।’ কথাগুলো বলে ফেলে চট করে ফোন রেখে দেন তিনি।

রানা বুঝে গেছে, ওর কথাই বলেছেন বৃদ্ধ। তিনি যে কতটা ভালবাসেন ওকে, সেটা নতুন করে বুঝে অদ্ভুত এক কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে গেছে ওর।

জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে চারপাশে তাকাল রানা। লণ্ডন টু প্যারিসের বিমান প্রায় ফাঁকা। বিজনেস ক্লাসে সারি-সারি সিট খালি। পাশের সিটে ট্র্যাভেল ব্যাগ আর জ্যাকেট রেখেছে ও। জ্যাকেটের ওপর পড়ে আছে কুঁচকে যাওয়া গতরাতের খবরের কাগজ। একটু আগে ওটাতে চোখ বুলিয়ে বুঝেছে, দুনিয়ার কোথাও ভাল কোন সংবাদ নেই।

জানালা দিয়ে নিচের মেঘ আবারও দেখল রানা। চাপা গুঞ্জন তুলে উড়ে চলেছে বিমান। অবশ্য কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়ে এল কারও পায়ের মৃদু শব্দ। পেছন থেকে এসে ওর খুব কাছে পৌঁছে গেছে কেউ। জানালা থেকে চোখ না সরিয়ে রানা ভাবল, যে এসেছে, সে বোধহয় এয়ার হোস্টেস বা কেবিন ক্রু। যদিও কয়েক মুহূর্ত পর ওর পাশের সিটের কাছে থমকে গেল পদশব্দ। নরম সুরে জানতে চাইল কেউ, ‘আমি কি একটু বসতে পারি?’

ঘাড় কাত করে চেয়ে রানা বুঝে গেল, আগে কখনও এই লোককে দেখেনি। বয়স হবে ষাট। প্রথম দর্শনে অবশ্য মনে হবে পঞ্চাশ। দীর্ঘ নন, বেঁটে নন, মোটা নন, আবার চিকনও নন। উঁচু কপাল। ব্যাকব্রাশ করা রুপালি চুল। খাড়া কানদুটো খরগোশের কানের মত বড়। মুখের তুলনায় শিরা- ওঠা নাকটা প্রকাণ্ড। নাকের পাশে তিনটে চুলসমেত লাল জড়ল। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। পুরু কাঁচের ওদিক থেকে যেন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে লেমুরের বিশাল দুটো চোখ। চকচক করছে পলিশড় জুতো। দেখেই মনে হয় ইনি সত্যিকারের একজন ভদ্রলোক। জরুরি কারণ আছে বলেই আলাপ করতে চান। যদিও রানা আঁচ করতে পারল না, তাঁর উদ্দেশ্য আসলে কী।

ওর ঝুঁকিময় গুপ্তচর জীবনে অতিভদ্র অথচ ভয়ঙ্কর ক’জন লোকের দেখা পেয়েছে রানা। তাই সতর্ক হয়ে উঠল। ওর মনে হলো, হয়তো খবরের কাগজটা চান তিনি। অথবা, বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর হাতঘড়ি। তাই জানতে চান এখন কয়টা বাজে। ঘটনা যা-ই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যে সব জানা যাবে। পাশের সিট থেকে ব্যাগ, খবরের কাগজ ও জ্যাকেট তুলে পায়ের কাছে রাখল রানা। ‘চাইলে বসতে পারেন।

অভিজাত ইংরেজদের কায়দায় প্যান্টের ঊরু দু’আঙুলে তুলে ধরে পাশের সিটে বসলেন তিনি। পুরু কাঁচ ভেদ করে কৌতূহলী চোখে দেখলেন রানাকে। নরম সুরে বললেন, ‘আকাশ-যাত্রাটা আপনার ভাল লাগছে তো, মিস্টার রানা?’

নিজের নাম শুনেই হুঁশিয়ার হয়ে উঠল রানা।

অচেনা এই লোকের তো চেনার কথা নয় ওকে!

এটা পরিষ্কার, ওর কাছে সময় জানতে আসেননি তিনি।

‘আপনি বোধহয় ভুল করছেন,’ বলল রানা। ‘আমি রানা নামের কাউকে চিনি না।’

কপট হাসি ফুটল লোকটার মুখে। চশমার ওদিক থেকে চেয়ে আছে বড় দুটো চোখ। দৃষ্টি বরফ-শীতল। নিচু স্বরে বললেন, ‘ভুল বলেছি, সেজন্যে আমি সত্যি দুঃখিত। আমার বোধহয় বলা উচিত ছিল: আকাশ-যাত্রা ভাল লাগছে তো, মেজর রানা? নাকি ডাকব এমআরনাইন বলে? আমি কিন্তু ভাল করেই জানি কার সঙ্গে কথা বলছি। খুশি হয়েছি আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। অনেক প্রশংসা শুনেছি অনেকের মুখে।’

লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল রানা, ‘বিমানে সিটের অভাব নেই, আপনি অন্য কোন সিটে গিয়ে বসলে খুশি হব।’

প্রৌঢ়ের ভদ্রতার হাসিটা আরেকটু চওড়া হলো। ‘দয়া করে মিথ্যা বলবেন না, মেজর। আপনার ব্যাপারে সবই জানি। গড়গড় করে বলে গেলেও অন্তত আধঘণ্টা লাগবে সব শেষ করতে। তবে সেটা করতে চাইছি না।’

এই লোক সাধারণ কেউ নয়, বুঝে গেছে রানা। এর কাছে আছে হাই-লেভেল ক্লাসিফায়েড ইনফর্মেশন। আবারও চারপাশে তাকাল রানা। ওর মনে হলো: এমনি এমনি ফাঁকা হয়ে যায়নি বিমানের বিজনেস ক্লাসের সিট। এ-লোক গোপনে আলাপ করতে চেয়েছে বলেই টিকেট কেটে খালি করে দেয়া হয়েছে এদিকের সব সিট। ওরা যা বলবে, শুনবে না কেউ। রানা টের পেল, বড় কোন ফাঁদে পড়েছে ও। তবে লোকটা নিজে থেকে কিছু না বললে কিছুই জানার উপায় নেই।

‘বুঝলাম, খোঁজখবর নিয়েই এসেছেন,’ বলল রানা, ‘এবং জরুরি কোন কারণ ছাড়া বিরক্ত করছেন না।’

‘ঠিকই ধরেছেন। গন্তব্যে যাওয়ার আগে একটু বিরক্ত করছি। বিমানে বসে কথা সেরে নেয়াই ভাল হবে বলে মনে হয়েছে আমার।

‘আমি তো আপাতত আপনার ক্যাপটিভ অডিয়েন্স,’ বলল রানা, ‘তো বলে ফেলুন কী বলতে চান।’

‘আসলে জরুরি এক কাজে আপনার সাহায্য চাই,’ সহজ সুরে বলল লোকটা।

‘আপনি বোধহয় ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছেন,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘আজকাল কারও হয়ে কাজ করি না, অবসর নিয়েছি।’

‘তা-ই?’ মৃদু হাসল প্রৌঢ়। কুঁচকে গেল গাল। ‘সেক্ষেত্রে বিসিআই-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন কেন? আপনার নামে প্রতিমাসে যে চেক আসছে, চাইলে তার ফোটোকপিও দেখাতে পারব।

চুপ করে থাকল রানা।

‘এবার আপনাকে যেটা দেখাব, তাতে বহুকিছুই আপনার কাছে পরিষ্কার হবে,’ বলল লোকটা।

‘কী দেখাবেন?’ কু ডাকছে রানার মন

কোটের পকেটে হাত ভরে একটা স্মার্টফোন বের করল প্রৌঢ়। অলস ভঙ্গিতে বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।

দ্বিধা কাটিয়ে ওটা নিল রানা।

ডিভাইসটা নতুন।

ডিসপ্লেতে পয করা হয়েছে এক ভিডিয়ো ফাইল।

‘মন দিয়ে দেখুন,’ জানাল আগন্তুক।

রানা স্ক্রিনে টোকা দেয়ায় চালু হলো ভিডিয়ো।

প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটল না।

স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে অন্ধকার এক ঘর।

ভিডিয়োটাতে আরও মন দিল রানা। জানা নেই কী চায় এই লোক। কিন্তু একটু পর সব বুঝে আড়ষ্ট হলো ওর ঘাড়ের পেশি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *