1 of 2

কিলিং মিশন – ৪০

চল্লিশ

আজ রাতে দ্বীপ ছেড়ে লণ্ডনে ফেরার বিমান নেই। রানা ও ফক্স ভেবেছিল শহরের কোন হোটেলে উঠবে, কিন্তু ওদেরকে রাতটা তার বাড়িতে কাটিয়ে দেয়ার জন্যে অনুরোধ করল ডিলান। এ-সুযোগে আলাপ করবে হ্যাভোক ক্লাবের বিষয়ে।

ইতস্তত করে আতিথেয়তা গ্রহণে রাজি হলো রানা ও ফক্স। এদিকে সময় হয়েছে ডিনার সেরে নেয়ার। ওদেরকে কমপিউটার রুমে রেখে লিভিংরুমে ফিরল ডিলান। একটু পর নিয়ে এল ফ্রিয থেকে বের করা বিশাল তিনটে পিৎযা। মাইক্রো আভেনে গরম করে এনেছে। গলা ভেজাবার জন্যে আছে এক বোতল করে এল। একটা ডেস্ক থেকে বই ও ম্যাগাযিন সরিয়ে পিৎযা খেতে, বসল ওরা। মাংসভরা পিৎযায় কামড় দিয়ে বলল ডিলান, ‘ক্রিস্টোফারের ব্যাপারে আসলে কী করতে চান আপনারা?’

‘তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে জেনে নেব হ্যাভোক ক্লাবের ব্যাপারে,’ বলল রানা।

ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল ফক্স। ‘কী বলেন, বস্! ওই লোক নামকরা রাজনীতিক! কিডন্যাপ করা অসম্ভব! চব্বিশ ঘণ্টা তাকে পাহারা দিচ্ছে একদল পেশাদার গার্ড। ফোর্ট নক্সের মতই দুর্গম হবে তার বাড়ি। কারও সাধ্য নেই যে ওটার কাছে যাবে। যতই নিজের মেয়েকে শয়তানের কাছে বলি দিক, তার ধারেকাছে যেতে পারব না আমরা।’

‘পারব,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রানা। ‘পথ বের করে নেব।’

‘বাড়ি চিনবেন কী করে?’ বলল ডিলান। ‘ঝামেলা’ এড়াতে গিয়ে ব্রিটেনের এমপিরা তাদের বাড়ির ঠিকানা সাধারণ মানুষকে জানায় না।

‘নেলির ফিউনেরালে যাব,’ বলল রানা। ‘পরে শোক অনুষ্ঠান শেষ হলে পিছু নিয়ে পৌছুব লোকটার বাড়িতে।’ এরই ভেতরে রানা স্মার্টফোনে দেখেছে, কোন্ গির্জায় হবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। বার্মিংহ্যাম এয়ারপোর্ট থেকে আধঘণ্টায় ওখানে পৌঁছে যেতে পারবে ওরা। ‘একবার ক্রিস্টোফার গানের বাড়ি চিনে নিলে অপেক্ষা করব রাতের জন্যে। পরে তুলে নিয়ে যাব তাকে।’

‘কিডন্যাপ কি এতই সহজ, বস্?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফক্স। ওই শালার সঙ্গে থাকবে পুরো এক ব্রিগেড পেশাদার গার্ড!’

‘তাদেরকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ব আমরা,’ বলল রানা।

‘হয়তো ঝুঁকি নিতে গিয়ে খুন হবেন, বলল ডিলান। উত্তেজনায় চকচক করছে তার দুই চোখ

‘বিপদ ওদেরও কম নয়,’ বলল রানা। ‘আমরা কাজ করব প্ল্যান অনুযায়ী।’

‘কিন্তু প্ল্যান মাঝে মাঝেই ফেইল করে,’ বলল ফক্স।

‘আমি কি আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি?’ বলল ডিলান। ‘মানে, দারুণ লাগবে আমার।’

‘আপনি অনেক করেছেন আমাদের জন্যে,’ বলল রানা। ‘তাই চাই না আরও ঝুঁকি নিতে হোক আপনাকে।’

ফক্স কূটনীতিক নয়, ফট করে বলল, ‘আপনার যে বিশাল ভুঁড়ি, সেইসঙ্গে মস্ত মোটা পাছা, বিপদ হলে ছুটে পালিয়ে যেতে পারবেন না। শেষে খুন হবেন। তাই বলি কী, বরং বসে থাকুন কমপিউটারের সামনে।

তিক্ত চোখে ওকে দেখল ডিলান

‘ভাল হবে আপনি এখানে রয়ে গেলে,’ বলল রানা।

‘আমার কিন্তু ভাল লাগত অ্যাকশনে যেতে পারলে।’

‘শুরুতেই মরতেন,’ আবারও বলল ফক্স। গুলি ছুঁড়লে আপনার ভুঁড়িটাকে ভুলেও মিস করতে পারবে না কেউ।’

‘কেন যে একে ঢুকতে দিয়েছি আমার বাড়িতে!’ বেঞ্চিতে ঝুঁকে বসে বিড়বিড় করল ডিলান।

‘আপনার কিন্তু মেলা কাজ,’ বলল রানা। ‘পড়ে শেষ করতে হবে চার শ’ পৃষ্ঠারও বেশি দ্য হ্যাভোক ক্লাব বইটা। কিছুই বাদ দেবেন না। জরুরি তথ্য পেলে ওটা আমাদেরকে জানাবেন।

উজ্জ্বল হলো ডিলানের মুখ। ‘তো স্টিভ হ্যারিসের ল্যাপটপ আপনারা আমার কাছে রেখে যাচ্ছেন?’

‘অবশ্যই,’ বলল রানা, ‘তবে আমাকে দেবেন পাণ্ডুলিপির একটা কপি।

‘আপনার ফোনে লোড করে দেব, খুশিমনে বলল ডিলান। কয়েক চুমুকে এল শেষ করে উঠে দাঁড়াল। ‘রাত হয়ে গেছে। আপনারা বরং যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। সকালে ঘুম থেকে তুলে দেব।’

রাতের পর রাত ঘুম নেই রানা ও ফক্সের। ডিলানের কথায় আপত্তি তুলল না ওরা। এলের বোতল শেষ করে কমপিউটার বিশেষজ্ঞের দেখিয়ে দেয়া ঘরে চলে গেল।

নিজের ঘরে ঢুকে সরাসরি জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। দূর সাগরের বুকে নেমেছে নক্ষত্রভরা কালো আকাশ। উপকূলে স-স-স আওয়াজে ফিসফিস করছে ঢেউ। আনমনে ভাবল রানা, একবার ফোন দেব জেসিকাকে? আগামীকাল হয়তো জড়িয়ে যাব বড় কোন বিপদে। ফোন হাতে নিয়েও টেবিলে ওটা রেখে দিল রানা। এতরাতে কাউকে বিরক্ত করা ঠিক নয়। সব ঝামেলা মিটে গেলে জেসিকার সঙ্গে কথা বলবে। একটু পর বিলাসবহুল বিছানায় শুয়ে পড়ল রানা। আধমিনিটও লাগল না ঘুমিয়ে যেতে।

.

পরদিন সূর্যালোকে ভরা আকাশটা নিয়ে এল ঝকঝকে সোনালি ভোর। ঘুম ভেঙে যেতেই বিছানা ছেড়ে এক শ’বার বুক ডন দিয়ে বাথরুমে শাওয়ারের জন্যে ঢুকল রানা। দশ মিনিট পর নতুন পোশাকে বেরিয়ে এল। ফোনে ফক্স আর ওর জন্যে বুক করল বার্মিংহ্যামের সকাল দশটার বিমান টিকেট। দুপুরে নেলির ফিউনেরাল। তার আগেই পৌঁছে যেতে হবে গির্জায়।

অতিথিদেরকে সঙ্গে নিয়ে সকাল আটটায় নস্তা সেরে নিল ডিলান। এরপর ফোনে আলাপ করল তার ড্রাইভারের সঙ্গে। একটু পর আসবে লোকটা। গাড়িতে বরে রানা ও ফক্সকে এয়ারপোর্টে পৌছে দেবে। হ্যারিসের লাপটপ থেকে পাণ্ডুলিপির কপি রানার ফোনে পাঠাল ডিলান। আরেক মগ কফি শেষ হতে না হতেই গির্জার সামনে পৌঁছে গেল ড্রাইভার কার্লি ফ্রেডিসন।

ব্যাগ গুছিয়ে ওপরে উঠে এল রানা ও ফক্স। ওদেরকে সঙ্গ দিল ডিলান। ওরা গাড়িতে ওঠার আগে হাত মেলানোর সময় সে বলল, ‘জানবেন, দয়ালু ঈশ্বর আপনাদের পক্ষেই আছেন!’

‘আজই হয়তো সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাব,’ বলল ফক্স।

ওরা গাড়িতে উঠতেই রওনা হলো টেকো জিন্দালাশ।

ঘাড় ফিরিয়ে রানা দেখল, ভারী শরীরে গির্জায় গিয়ে ঢুকল ডিলান।

পঞ্চাশ মিনিট পর রানা ও ফক্স পা রাখল রোনাল্ডস্ওয়ে এয়ারপোর্টের ডিপারচার টার্মিনালে। টুইন প্রপেলারের একই ফকার বিমানে চেপে রওনা হলো ওরা। সিটে হেলান দিয়ে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে হ্যারিসের বইয়ে চোখ বোলাতে লাগল রানা। কখনও টুকটাক নোট নিল। ওদের ভেতরে যে আলাপ হয়েছে, তাতে ওরা ভাল করেই জেনে গেছে কেমন ধরনের পশুর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল বা অ্যালান শ’ রানাকে বাধ্য করেছিল মানুষ খুনের কাজ হাতে নিতে। তবে গোটা বইয়ে তার মত কাউকে খুঁজে পেল না রানা।

ফক্সের বলা এক লোকের নাম পেল বইয়ে। বসন্তে শার্লন হলের অনুষ্ঠানের সেই বুড়ো লোক সে, যার কাছে থাকে শিারি পাখির মুণ্ডওয়ালা ওয়াকিং স্টিক। তার আসল নাম ইমোজন ব্যালার্ড।

তার সম্পর্কে প্রচুর তথ্য দিয়েছে হ্যারিস। গ্রেগরি এন. শার্লনের ফুফাতো ভাই সে। বাবার দিক থেকে জার্মান। একসময়ে নিয়ো নাৎযিদের সঙ্গে ছিল গভীর সম্পর্ক। মৃত্যুর আগে গ্রেগরি এন. শার্লনের করা উইলের জন্যে শার্লনদের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে সে। কখনও কোন চাকরি বা ব্যবসা করেনি। পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তার আছে ইউরোপের প্রভবশালী পরিবারে মেলামেশা। উনিশ শত সাতচল্লিশ সালে ফুফাতো ভাই গ্রেগরি এন. শার্লনের মৃত্যুর পর সে হয়ে ওঠে অশুভ ধর্ম অর্ডার অভ থঅথের গ্র্যাণ্ড মাস্টার। দু’বছর দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পর গ্র্যাণ্ড কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাকে করা হবে দ্য হ্যাভোক ক্লাবের আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট। ততদিনে সে হয়ে উঠেছে গোপন সমাজে থঅথের মতই চরম ক্ষমতাশালী। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা, আর্মি কমাণ্ডার, জাজ, সরকারি মন্ত্রী বা সিনিয়র ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টর- সবাই চলে গেছে তার পকেটে। দেশের যেসব বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে ব্রিটেনের সরকারকে, সেসব প্রতিটি মিটিঙে অনুরোধ করে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তার মতামত না নিয়ে কোন কিছুই করা হয় না। হ্যারিস তার বইয়ে উল্লেখ করেছে, ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর দশ নম্বর বাড়ির সঙ্গে সরাসরি ফোনলাইন আছে ব্যালার্ডের। প্রতিমাসে তাকে নিমন্ত্রণ করা হয় স্যাণ্ডরিংহ্যাম এস্টেট ও ব্যালমোরাল দুর্গে। কাদের সঙ্গে তার খাতির, সেই দীর্ঘ তালিকায় চোখ বোলাতে গিয়ে ক্লান্তি বোধ করল রানা।

মন শান্ত করতে গিয়ে অফ করে পকেটে রেখে দিল ডিভাইসটা। বিশ্রাম নেয়ার জন্যে চোখ বুজল। তবে মিনিট পাঁচেক পর আবারও তাকাল বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে। ধূসর মেঘের মাঝ দিয়ে বহুনচে চোখে পড়ল উত্তর-পশ্চিমে ইংল্যাণ্ডের মাঠ-ঘাট ও গ্রাম।

আনমনে কী যেন ভাবছে ফা। ওর দিকে তাকাল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘এসব শেষ হলে কী করবে বলে ভাবছ, ফক্স?’

‘ফিরব আলদারিসিন গ্রামে,’ সেল প্রাক্তন সৈনিক। ‘শুরু করব নতুন জীবন। ছোট একা বাড়ি। সামনে বাগান। মুরগির খামার। কাছেই কিছু জমিমা। আসলে জানি না কী করব। তবে কোন কিছুতেই খুব তড়াহুড়ো করব না। হয়তো দেখা করব রিটার সঙ্গে। যদি নিয়ে না করে থাকে, তা হলে…’ উদাস হয়ে গেল ফক্স।

চুপ করে আছে রানা। একটু গ্র বলল, ‘মেয়েটা কিন্তু এখনও অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। সেটা হয়তো তুমি জানো না।’

চোখ তুলে ওকে দেখল ফক্স। ‘তা-ই, বস্? তবুও হয়তো ওর সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না। আজ বা কালকে খুন হব। হয়তো থাকব কোন জেলখানায়। বিশবছরেও মুক্তি পাব না। বস্, আমরা আক্রমণে গেলে যে জালে জড়িয়ে যাব, সেটা থেকে হয়তো আর কখনও মুক্ত হতে পারব না।’

‘তুমি এক কাজ করো, এই বিমান নেমে যাওয়ার পর দুশ্চিন্তা না করে সরাসরি চলে যাও লণ্ডনে,’ বলল রানা। ‘তোমার টাকা ভরা ব্যাগ নিয়ে অন্য কোন বিমানে চেপে পৌঁছে যাও স্পেনে। আমি কিন্তু তোমাকে বাধা দেব না।’

বিষণ্ণ হাসল ফক্স। ‘বস্, আমি খুনি হতে পারি, বেইমান তো নই! আপনি চাইলেও আমাকে গা থেকে ঝেড়ে নামাতে পারবেন না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *