1 of 2

কিলিং মিশন – ২১

একুশ

ক’দিন আগেও নিজেকে সফল মানুষ ভাবত জিনা ওয়েস। লণ্ডন বিযনেস স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে গতবছর চালু করেছে ফিন্যান্সিং কনসালটেন্সি ফার্ম। পাশে অংশীদার হিসেবে ছিল টম ম্যাককয়। একইসঙ্গে পড়াশোনা করেছে ওরা। বহুদিন ধরেই পরস্পরকে পছন্দ করত। তারপর বছর দুয়েক আগে প্রেমে পড়ল ওরা। ব্যবসা চালু করার পর প্রথম সুযোগে ভাড়া নিল ওয়েম্বলি পার্কে দুই বেডরুমের ছোট্ট এক অ্যাপার্টমেন্ট। প্রতিদিন ছুটির পর বেরোত থিয়েটার দেখতে, বা খুঁজে নিত ভাল মানের কোন রেস্টুরেন্ট। কথা ছিল আগামী বছর বিয়েটা সেরে নেবে ওরা।

জীবনটা ছিল খুব প্রশান্তিময়। অথচ পঁচিশতম জন্মদিনে ধসে গেল জিনার সাধের তাসের ঘর। হঠাৎ করেই জেনে গেল, গত ছয়মাস ধরে ওদের পিএ নোরার সঙ্গে নিয়মিত বিছানায় যাচ্ছে টম। প্রথমে জোর গলায় প্রতিবাদ করেছে কুকুরটা। তবে জিনা প্রমাণ হিসেবে নোংরা একগাদা ছবি দেখিয়ে দেয়ায় দোষ স্বীকার করল সে। হাতজোড় করে মাফ চাইলেও এ-কথা জানাল, জিনা যথেষ্ট সময় দেয় না বলেই ভুল পথে গেছে সে। তা ছাড়া, ভালবাসা না পেলে কী-ই বা করবে নিঃসঙ্গ যুবক?

বুক ভেঙে গিয়েছিল জিনার। আর চায়নি ভাঙা সম্পর্ক এগিয়ে নিতে। ব্যবসায় নিজের অংশ বিক্রি করে বেরিয়ে এল সেই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। উঠল কিংব্রিজ এলাকায় পুরনো এক বান্ধবীর বাড়িতে। পরের মাসেও খুব দুঃসহ লাগল ওর। বসন্তে রঙিন ফুলে ভরা মায়াবী প্রকৃতির মাঝে অনুভব করল নিজের চরম একাকীত্ব। জীবন ছেয়ে গেল ভীষণ হতাশায়। ব্যাঙ্কে বেশ কয়েক হাজার পাউণ্ড আছে জিনার। একদিন ভাবল, নিষ্ঠুর এই সমাজ থেকে বহুদূরে হারিয়ে গেলে কেমন হয়? তাতে হয়তো নতুন করে গুছিয়ে নিতে পারবে নিজেকে। কয়েক দিন ভেবে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে ছোট এক ভ্যান কিনল জিনা। বান্ধবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়ল অচেনা এক পথে।

কিছুদিন ঘুরে একদিন দেখা পেল ওয়েস্ট ও লিনার। ওরা বিবাহিত ভবঘুরে দম্পতি। ব্রিটেন ও ইউরোপে চরকির মত ঘোরে হিপ্পিদের কনভয়ের সঙ্গে। আজ আছে এই সৈকতে, তো পরদিন চলে যাচ্ছে দূরের পাহাড়ে। আগামীকাল কোথায় যাবে কেউ জানে না। হিপ্পিদের দলে ভিড়ে গেল জিনা। আন্তরিকতার সঙ্গে ওকে গ্রহণ করল সবাই। গ্রেগ তাদের একমাত্র কবি। জেডি হাত দেখে বলে দেয় ভবিষ্যৎ কেমন হবে। রেইকি মাস্টার হচ্ছে জেরি। ক্রিস বিশ্বাস করে পুনর্জন্ম নেন ইতিহাসের নামকরা সব ব্যক্তিত্ব। তাঁদের অতীত ও বর্তমান নিয়ে গবেষণা করে সে। ক্যাম্প করার পর বসন্তের শীতল রাতে আগুনের ধারে বসে উদাস হয়ে গিটার বাজায় ডেভ। জিনাকে নতুন কয়েকটা কর্ড শিখিয়ে দিয়েছে সে। মাঝে মাঝে ওদের সঙ্গে যোগ দেয় নতুন হিপ্পিরা। থালা- বাসন পিটিয়ে, হাততালি দিয়ে প্রাণখুলে গান গায় ওরা। মুক্ত জীবনে ভাল আছে জিনা। ওর মন বলে, পৃথিবী থেকে ফুরিয়ে যায়নি সব মানবিকতা।

অন্যের ব্যাপারে নাক গলায় না হিপ্পিরা। সভ্যতা থেকে বহুদূরে ভাল থাকল জিনা। রাতে সবার সঙ্গে ক্যাম্পফায়ারের ধারে বসে গান গেয়ে বা নেচে খুঁজে নিতে চাইল নিজেকে। অনেকে ব্যবহার করে নানান ড্রাগ্‌স্‌। দৈহিক মিলনে দিলখোলা সবাই। জিনা ভেবে দেখেছে, নিজে ও যেহেতু উচ্ছৃঙ্খল নয়, তাই আপাতত এদের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়ে দিলেও বড় কোন ক্ষতি নেই। গ্রীষ্মের পর হেমন্ত এলে স্থির করবে জীবন নিয়ে কী করা উচিত।

দু’সপ্তাহ পর হিপ্পিদের সঙ্গে ও গেল স্টোনহেঞ্জে। ওখানে হবে বসন্ত মহাবিষুবের বিশাল এক অনুষ্ঠান। উইক্ক্যান, ডুইড, পেগান আর কিছু গোত্র যার যার ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী জড় হবে সূর্যোদয় দেখতে। জিনার সঙ্গে যারা আছে, কেউ কেউ উর্বরতা ও জগৎ সৃষ্টির মালকিন হাজার হাজার বছর বয়সী প্রাচীন স্যাক্সন দেবীর পূজা করে। এসবে বিশ্বাস নেই জিনার। তবে তাদের অদ্ভুত সব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এবং তাদের ঐক্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারে না।

স্টোনহেঞ্জে ওদের সঙ্গে যোগ দিল নতুন এক যুবক, নাম রনি হাওয়ার্ড। সে-রাতে জিনা বুঝল, কী এক অমোঘ টানে ওকে কাছে টানছে দুর্দান্ত সুপুরুষ সেই যুবক। হালকা শরীর তার। বয়স বড়জোর সাতাশ। সোনালি চুল যেন গিনি সোনা। চোখদুটো গভীর মহাসাগরের অতল নীল জলের মত। গত কয়েক মাসে রনির মত বুদ্ধিদীপ্ত কারও সঙ্গে দেখা হয়নি জিনার। তাসের খেলা দেখায় না রনি। পুনর্জন্মের গাঁজাখুরি গল্প ফাঁদে না। ফাঁপা জ্ঞানে ভরা কোন মন্তব্য করে না। রাতে আগুনের ধারে বসে কখন যেন অচেনা যুবককে মন দিল জিনা। এ-ও বুঝল, ওর প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ বোধ করছে রনি।

দ্বিতীয় রাতে ক্যাম্পফায়ারের ধারে সবাই যখন গল্পে মগ্ন, রনিকে নিয়ে নিজের তাঁবুতে গিয়ে বসল জিনা। রনি সঙ্গে এনেছে এক বোতল কমদামি ওয়াইন। গ্যাসের লণ্ঠন জ্বেলে গল্পে ডুবে গেল ওরা। একপর্যায়ে গড়গড় করে লণ্ডনে ওর কষ্টকর অতীতের কথা বলল জিনা। বাদ পড়ল না টম ও নোরার বেইমানি। এসব বলতে গিয়ে জিনা বুঝল, গভীর মনোযোগে ওর সব কথা শুনছে রনি। কখনও সান্ত্বনা বা সাহস জুগিয়ে দিচ্ছে। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে দেয়া জীবনের কথা তুলল জিনা। অবাক হয়ে টের পেল, রনিকে এসব বলতে ভাল লাগছে ওর। তালাক হয়ে গিয়েছিল বাবা ও মায়ের। এরপর সর্বক্ষণ মাতাল হয়ে থাকত বাবা। আবারও বিয়ে করল মা। সৎবাবাকে ভাল মানুষ বলে মনে হয়নি ওর। পরে মা আর সৎবাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। জিনা জানাল, মস্তবড় এক চৌরাস্তায় এসে থেমেছে ওর জীবন। এবার ভাবতে হবে কোন পথে এগোবে। জানা নেই আর কখনও কারও কাছ থেকে ভালবাসা পাবে কি না, বা নতুন করে কীভাবে শুরু করবে সব।

এত কথা বলে লজ্জা পেয়ে জানাল জিনা, ‘কই, তুমি তো তোমার জীবনের কথা আমাকে বললে না!’

‘বলার মত যে কিছুই নেই,’ ওয়াইনের গ্লাস হাতে নিচু স্বরে বলল রনি। ‘ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছি ভাষার ওপরে। এরপর কী করব সেটা আর বুঝতে পারিনি। বলতে পারো, আমি আকাশে ভেসে চলা সুতো-ছেঁড়া এক ঘুড়ি কিছুই ভাল লাগে না বলে চলে গেছি দক্ষিণ ফ্রান্সে। ওখানে ইংরেজি পড়াতাম ফ্রেঞ্চ বাচ্চাদেরকে।’

‘তুমি ফ্রেঞ্চ ভাষা জানো?’ অবাক হলো জিনা।

মৃদু হাসল রনি। সুন্দর একটা টোল পড়েছে ওর গালে।

সামনে ঝুঁকে রনির গালে চুমু দিল জিনা। ‘দক্ষিণ ফ্রান্স ঘুরে দেখতে খুব ভাল লাগবে আমার। …আবার ব্রিটেনে ফিরলে কী ভেবে?’

‘ফ্রান্সে এক মেয়ের প্রেমে জড়িয়ে ভেবেছি চিরকালের জন্যে বাঁধা পড়ব ওর কাছে। কিন্তু তা আসলে হওয়ার ছিল না। শেষে পুড়ে ছাই হয়ে গেল আমার মন।’ রনি বলতে লাগল: এরপর কত শত জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছে ও। কোথাও আর থিতু হতে পারেনি। নিজেকে আর খুঁজে পায়নি। অবশ্য এখন ব্রিটেনে এসে হয়তো পাবে অর্থবহুল সত্যিকার কোন জীবন। ‘আসলে চরম অভাবে আছে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ। আমার কেন যেন মনে হয় তাদেরকে আমি সাহায্য করতে পারব।’

‘বাহ্, খুব সুন্দর চিন্তা করেছ,’ অসহায় মানুষের প্রতি রনির নিখাদ ভালবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে জিনা। .

‘তবে জানি না কতটুকু করতে পারব,’ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল রনি।

শুরু থেকেই একের পর এক মিথ্যা বলছে সে। নাম তার রনি হাওয়ার্ড নয়। কয়েকটা ফ্রেঞ্চ শব্দ ছাড়া ফরাসি ভাষার কিছুই জানে না। কখনও কাউকে পড়ায়নি ইংরেজি। জীবনের কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না, তা-ও নয়। নিঃসঙ্গ যেসব মেয়ের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবী নেই, হারিয়ে গেলেও খুঁজবে না কেউ, তাদেরকে নিয়ে বিক্রি করছে গোপন এক ভয়ঙ্কর সঙ্ঘের ক্ষমতাশালী একদল লোকের কাছে। বদলে পাচ্ছে প্রচুর টাকা।

দেশের নানান এলাকায় ঘোরে হিপ্পিরা। কে এল আর কে গেল খেয়াল করে না। তাদের সঙ্গে মিষ্টি চেহারার অচেনা মেয়ে দেখলে তাকে টার্গেট করে যুবক। ওর সুদর্শন চেহারা ও বিনয়ে ভরা কথা শুনে পটে যায় মেয়েরা। প্রতিবছর ছয় থেকে সাতটা মেয়েকে গায়েব করে সে। রদেভু পয়েন্টে প্রতিজনের জন্যে কন্ট্যাক্টের কাছ থেকে নেয় নগদ দশ হাজার পাউণ্ড। এরপর সেসব মেয়ের জীবনে কী ঘটল, সেটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই।

ক’দিন ধরেই জিনার মত কাউকে খুঁজছিল।

সুন্দরী মেয়েটাকে পেলে খুব খুশি হবে তার নিয়োগকর্তারা।

‘ভাল লাগছে যে আমার জীবনে তুমি এলে,’ বলল সে। লালচে হয়ে গেল জিনার গাল। ‘আমারও খুব ভাল লাগছে তোমার সঙ্গে কথা বলে।’

‘এখান থেকে একটু দূরেই ছোট এক কটেজ ভাড়া নিয়েছি। আপত্তি না থাকলে আমার সঙ্গে গিয়ে দেখবে ওটা? তোমার হয়তো পছন্দ হবে?’

লণ্ঠনের হলদে আলোয় খুশিতে চকচক করল জিনার দুই চৌখ। ‘এখুনি যাবে? আজ রাতেই?’

‘ছোট্ট কটেজ। তবে তাঁবুর চেয়ে তো ভাল।’

মিষ্টি করে হাসল জিনা। ‘তোমার সঙ্গে যেতে আমার কোন আপত্তি নেই। ‘ .

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *