1 of 2

কিলিং মিশন – ৪২

বেয়াল্লিশ

রাত দশটা। খালি পেটে প্রচুর ঘুমের ওষুধ গিলে শুয়ে আছে ডায়ানা গান সেটিতে। কাঁদতে কাঁদতে ব্যথা হয়ে গেছে বুকের পাঁজর। ফুঁপিয়ে উঠছে একটু পর পর। কড়া ওষুধের প্রভাবে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে অদ্ভুত এক বিশ্রী ঘোরের ভেতরে। পাশেই ওর স্বামী। সে আনমনে ভাবছে, কখন রেহাই পাব এর হাত থেকে? কিছুক্ষণ পর আলতো করে ধরল স্ত্রীর বাহু। নরম সুরে বলল, ‘চলো, ওপরে যাই। তোমার বিশ্রাম দরকার।’

সেটি ছেড়ে উঠে মাতালের মত টলতে লাগল ডায়ানা। তাকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে বেডরুমের বিছানায় শুইয়ে দিল ক্রিস্টোফার গান। অন্ধকার ঘরে বাধ্য স্বামীর মত স্ত্রীর হাত ধরে পাশে বসে থাকল। অবশ্য মিনিট দশেক পর বুঝল, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে ডায়ানা।

এবার বেটি বিরক্ত করবে না, ভাবল ক্রিস্টোফার গান। স্ত্রীর বাহু থেকে সরিয়ে নিল হাত। বেডরুম ছেড়ে চলে এল অন্ধকার করিডরে। গিয়ে ঢুকল স্টাডিরুমে। নিঃশব্দে বন্ধ করল দরজা। সোজা গিয়ে থামল ড্রিঙ্ক কেবিনেটের সামনে। ডালা খুলে বের করল ক্রিস্টালের স্বচ্ছ গ্লাস। ওটাতে ঢালল ষাট বছর ম্যাচিয়োর করা ফ্রেঞ্চ ব্র্যাণ্ডি। এই ব্র্যাণ্ডের মদের প্রতিটি বোতলের দাম সাত শ’ পাউণ্ড। অবশ্য আজকের এই বিশেষ রাতে টাকা নিয়ে ভাবছে না সে।

সারাদিন অভিনয় করে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আরামদায়ক আর্মচেয়ারে বসে ব্র্যাণ্ডিতে চুমুক দিয়ে মুচকি হাসল। ক’দিন আগেও হাড় জ্বালিয়ে নেহারি করছিল নেলি। তবে শেষমেশ মুক্তি মিলেছে হারামজাদীর খপ্পর থেকে। বেটি যে শেষে মরেছে, এরচেয়ে ভাল কিছু ঘটেনি ক্রিস্টোফারের জীবনে। থঅথ ধর্মের প্রতি ভালবাসা থেকে আত্মত্যাগ করেছে ভেবে দ্য হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যরা তার ওপরে খুব খুশি। নিজে প্রশংসা করেছেন গ্র্যাণ্ড মাস্টার। এবার আরও ভাল এক অনুষ্ঠানে দেখা হবে সবার সঙ্গে। … আর নেলি? ওই হারামজাদীর নোংরা আত্মাটা নিয়ে যা-খুশি করুক শালার ঈশ্বর! বেটি ছিল জীবন্ত এক আতঙ্ক! হাসতে হাসতে অতীত স্মৃতি এবার ভুলে যাবে ক্রিস্টোফার। মেয়েকে বলি দেয়ায় বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই তার মনে। অবশ্য আরও ক’দিন সন্তানহারা ব্যথিত বাবার অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে মিডিয়ার কাছে। এই সুযোগে বুঝিয়ে দিতে হবে, যতই কষ্ট থাকুক তার মনে, দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে যাওয়ার মানুষ নয় সে।

অবশ্য বড় একটা সমস্যা হয়ে উঠেছে হাঁদা মেয়েলোক ডায়ানা। ওর জন্যে বাড়িতে ফিরেও করতে হবে অভিনয়। বেশ্যার চেয়েও খল চরিত্রের নেলির মৃত্যুতে ডায়ানা এত ভেঙে পড়বে, ভাবতেও পারেনি ক্রিস্টোফার। তবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সুন্দরী বলেই সে বিয়ে করেছিল ডায়ানাকে, মগজের জন্যে তো নয়! আজ হোক বা দশদিন পর, নিজেকে সামলে নেবে মহিলা। স্বামী দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে আবারও হাসিখুশি হয়ে উঠবে।

তিন পেগ ব্র্যাণ্ডির প্রভাবে চমৎকার আমেজ এসেছে ক্রিস্টোফারের মনে। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে বের করল দামি হাভানা সিগার। রুপালি মোড়ক খুলে ক্লিপার দিয়ে কেটে ওটা ঝুলিয়ে নিল ঠোঁটে। লাইটার জ্বেলে নিতেই মনে পড়ল স্ত্রীর কথা। যতই ঘুমের ওষুধ দেয়া হোক, হাভানা তামাকের সুগন্ধী ধোঁয়া ভাঙিয়ে দেবে তার ঘুম। ভাল করেই সে জানে, রাজনৈতিক বিজয় বা অন্য কোন ভাল কিছু হলে তবেই শুধু সিগার টানে তার স্বামী। একমাত্র সন্তান মারা যাওয়ায় তার তো ফুর্তি করার কথা নয়!

আপাতত ধূমপান চলবে না, খুব হতাশ হলো গান। ভাবল: কী দুর্ভাগ্য, এমন চরম ফুর্তির মুহূর্তে নিজেকে বঞ্চিত করতে হচ্ছে!

জানালা দিয়ে নিচের বাগান দেখল গান।

চমৎকার রাত। নিচ থেকে ঘুরে এলে ভাল লাগবে তার। সঙ্গে নেবে ড্রিঙ্কের গ্লাস। উত্তর আঙিনায় সামারহাউসে বসে টানবে সিগার। ব্র্যাণ্ডিতে চুমুক দিয়ে দেখবে আকাশভরা নীলচে নক্ষত্রগুলোকে।

আবারও খুশি হয়ে উঠল ক্রিস্টোফার। গ্লাসে ঢালল আরও দু’পেগ ব্র্যাণ্ডি। গ্লাস, হাভানা সিগার ও লাইটার নিয়ে বেরিয়ে এল স্টাডিরুম থেকে। পা টিপে টিপে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। সদর দরজা খুলে দাঁড়াল নক্ষত্রের ম্লান আলোয়। বাড়ির পাশে উইলো গাছের শাখা এদিক-ওদিক দুলছে মৃদুমন্দ হাওয়ায়। চারপাশে বসন্তে ফোটা ফুলের উদাস করা মিষ্টি সুবাস। এসব সময়ে মাঝে মাঝে শয়তানের বদলে ঈশ্বরের প্রশংসা করতে ইচ্ছে করে গানের। বড় ভাল লাগছে আজ। বুকটা ভরে গেছে স্বস্তিতে। চমৎকারভাবে সব সামলে নিয়েছে সে। আর কখনও তার রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করতে হাজির হবে না নেলি। নিজেকে দুনিয়ার রাজা বলে মনে হচ্ছে ক্রিস্টোফারের। আর তা হবেই বা না কেন? খোদ শয়তানও হয়তো এত দক্ষতার সঙ্গে সব গুছিয়ে নিতে পারত না। কত সহজেই না মানুষকে বোকা বানিয়ে দিয়েছে সে!

কখনও কখনও তার মনে হয়, প্রভু শয়তান নিজে মানুষ হলে দুনিয়াদারি তার চেয়ে বোধহয় কম বুঝত। অবশ্য, এসব বলা যাবে না দ্য হ্যাভোক ক্লাবের কাউকে।

আমি শালা পুরোই পচে যাওয়া এক লোক! —আনমনে হাসল ক্রিস্টোফার। বাগান পেরিয়ে পৌঁছে গেল উত্তর আঙিনায় সামারহাউসের কাছে। তিনধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দারুণ এক প্যাভিলিয়নের মত জায়গা। ওখানে বসে মাঝে- সাঝে বই পড়ে সে। অথবা তৈরি করে বক্তৃতার খসড়া। সময়টা থাকে শুধু নিজের জন্যে। তখন ঘাড়ের কাছে থাকে না বডিগার্ড। তাদের জন্যে বরাদ্দ করা দালান পুব আঙিনায়। ফিউনেরাল থেকে ফিরে তাদের কারও সঙ্গে দেখা হয়নি তার। এখন যে-কোন সময়ে পালাবদল করবে গার্ডেরা নতুন প্রহরীরা পাহারা দেবে বাড়ি ও বাগান। অবশ্য আজ রাতে তাদের সঙ্গে দেখা না হলেই ভাল। নিজেকে নিরাপদ ও তৃপ্ত লাগছে গানের। উইকার চেয়ারে বসে সিগারের ধোঁয়া বুক ভরে টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দেবে দামি ড্রিঙ্কে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশংসা করবে নিজের- সত্যিই কি তুলনা আছে তার বুদ্ধিমত্তার?

সামারহাউসের সিঁড়ির প্রথম ধাপে উঠল সে। তারপর দ্বিতীয় ধাপে। কিন্তু তৃতীয় ধাপে আর পা রাখা হলো না।

পেছন থেকে কে যেন খপ্ করে চেপে ধরল তার মুখ। ভীষণ চমকে গেল ক্রিস্টোফার। নিজেকে মুক্ত করে আর্তচিৎকার ছাড়ার আগেই হ্যাঁচকা টানে ঘাসের সবুজ গালিচায় ধুপ্ করে পড়ল সে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *