1 of 2

কিলিং মিশন – ৩০

ত্রিশ

‘এবার কী করবেন, বস্?’ বলল ফক্স।

‘বাড়ি থেকে বেরোতে হবে।’ স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির রেলিঙের পাশে থামল রানা। নিচে তাকাতেই দেখতে পেল করিডরে পড়ে আছে হ্যারিসের লাশ। এই অ্যাঙ্গেল থেকে দেখা যাচ্ছে না করিডরের বেশিরভাগ অংশ। স্লেজহ্যামারের বিকট শব্দ হতেই ভেতরের দিকে দড়াম করে খুলে গেল সদর দরজা।

বাড়িতে ঢুকেছে তিন ষণ্ডা। তাদের গলার আওয়াজ শুনল ওরা। কয়েক সেকেণ্ড পর নির্বিকার চেহারায় হ্যারিসের লাশের পাশে থামল অনুপ্রবেশকারীরা। স্লেজহ্যামার দরজার কাছে রেখে এসেছে লম্বা লোকটা। হাতের কিটব্যাগ মেঝেতে রেখে, যিপার খুলে ওটা থেকে নিল স্টিলের দুটো ভারী দণ্ড। এক এক করে ধরিয়ে দিল দুই সঙ্গীর হাতে। ব্যাগ থেকে নিল স্লিংওয়ালা অটোলোডার শটগান। ওটার বাঁট নেই। আছে শুধু পিস্তল গ্রিপ। ডানদিকের লোকটা পেল অস্ত্রটা। দলনেতা ব্যাগ থেকে বের করল নিজের স্টিলের ডাণ্ডা। কারও বাড়ির বারোটা বাজাতে হলে ওই জিনিসই চাই। কারও মাথা চুরমার করে দিতেও ওটা দারুণ অস্ত্র। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে না এরা। মনে হয় দেরি করবে না কাজে নেমে পড়তে।

পিছিয়ে এসে রানা ভাবল, নিশ্চয়ই এদের অন্তত একজন উঠবে দোতলায়। নির্দেশ অনুযায়ী গিয়ে ঢুকবে স্টাডিরুমে। ফক্সকে ইশারায় সেটাই বোঝাল রানা। মৃদু মাথা দুলিয়ে স্টাডিরুমের প্যাসেজ ধরে উল্টোদিকে চলল ফক্স। সিঁড়ির ধাপে পায়ের আওয়াজ পেল রানা। দলের অন্যরা নিচতলায় শুরু করেছে সত্যিকারের প্রলয়কাণ্ড। ধুপধাপ শব্দে উল্টে পড়ছে আসবাবপত্র। ঝনঝন করে ভাঙছে কাঁচ। ফক্সের পিছু নিল রানা। হাতে ওয়ালথার পিপি। বাম বগলে ল্যাপটপ।

দোতলার প্যাসেজে বার্নিশ করা কাঠের একের পর এক দরজা। করিডরের দেয়ালে ঝুলছে সোনাপানি করা ফ্রেমে তৈলচিত্র। বামের প্রথম দরজা বোধহয় বাথরুম। ওখানে লুকাতে পারবে না বলে ডানের এক দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ফক্স। পিছু নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল রানা। পায়ের শব্দে বুঝল দোতলায় উঠেছে এক লোক।

সুসজ্জিত বড় এক বেডরুমে পা রেখেছে রানা ও ফক্স। একপাশে অ্যান্টিক বেড। মেঝেতে পুরু কার্পেট। ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো দিয়ে ওরা দেখল পশ্চিম সাসেক্সের ঘন সবুজ বনভূমি। সামনের ব্যালকনিতে উঠেছে আইভি লতা। নিচে কমলার খেতের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে ছাত। ঘুরে দরজায় কান পাতল রানা। পায়ের শব্দে বুঝল, প্রমাণ সরাতে স্টাডিরুমে ঢুকল লোকটা। ভাবল রানা, ডেস্কে ধুলোহীন চারকোনা একটা জায়গা দেখেই সে বুঝে যাবে ওখান থেকে সরানো হয়েছে ল্যাপটপ।

কয়েক মুহূর্ত পর এল চিৎকার: ‘বিস্‌! রস! তোমাদের নোংরা পোঁদদুটো নিয়ে উঠে এসো! জলদি!’

নিচে থামল ভাঙচুর। শুরু হলো সিঁড়িতে বুটের আওয়াজ। রানার দেখাদেখি দরজায় কান পেতেছে ফক্স। ল্যাণ্ডিঙে শোনা গেল চাপা কণ্ঠ: ‘কী হয়েছে, মিচ?’

প্রথমজন হড়বড় করে বলল, ‘চুতিয়া জিনিসটা নেই!’

‘কীসের চুতিয়া নেই?’

‘কুত্তার বাচ্চার কমপিউটার! ওটা নেই! কেউ আগেই নিয়ে গেছে! ডেস্কের ড্রয়ারও ভেঙেছে! ওটার ভেতরে যা ছিল, সেসব আর নেই!’

পরস্পরকে দেখল ফক্স ও রানা। এক ভুরু কপালে তুলল এসএএস সৈনিক। ‘সেরেছে!’

‘শালা হয়তো অন্য কোথাও রেখেছে ডিস্ক বা হার্ড ড্রাইভ,’ বলল রস।

রানা বুঝে গেছে, হ্যারিসের বইয়ের ফাইল চাই এদের। ‘স্টাডিরুম থেকে কোন কুত্তার বাচ্চা যেন সব লোপাট করেছে,’ বলল মিচ। ‘এতক্ষণে খুলে নিয়েছে কমপিউটার থেকে হার্ড ড্রাইভ!’

‘সর্বনাশ! ওটা যেভাবে হোক চাই! নইলে ওরা বাঁচতে দেবে না!’

নীরবতা নেমেছে করিডরে। তারপর শোনা গেল দলনেতা মিচের নির্দেশ: ‘বিস্‌, রস, নিচে গিয়ে কাজ শুরু করো! আমি দেখছি ওপরের ঘর। হ্যারিস হয়তো অন্য কোথাও রেখেছে।’

সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল দু’জন। নতুন করে শুরু হলো নিচে ধ্বংসযজ্ঞ। স্টাডিরুম সার্চ করবে মিচ। কিন্তু একটু পর বুঝবে ল্যাপটপ আসলেই নেই। তখন আসবে ঘর তল্লাসী করতে। তার বেশিক্ষণ লাগবে না রানাদের বেডরুমে হাজির হতে।

রানার কবজিতে টোকা দিয়ে বেডরুমের আরেক দেয়ালে সরু এক দরজা দেখাল ফক্স। ওর পিছু নিল রানা। ফক্স সরু দরজা খুলতেই রানা দেখল, সামনের ছোট ঘরটা আসলে ওঅক-ইন ওয়ারড্রোব। তিনদিকের র‍্যাকে ইস্ত্রি করা পোশাক। অন্যদিকে হ্যাঙারে ঝুলছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে শতখানেক কোট। ফক্সের পর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল রানা। আঁধার ঘরের দরজার তলা দিয়ে এল মৃদু আলো। কান পাতল ওরা। শ্বাস নিচ্ছে ধীরে ধীরে। হঠাৎ পিঠে বিশ্রী চুলকানি শুরু হতেই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে পাথরের মূর্তি হলো রানা। দুনিয়ার সেরা সেনাবাহিনীর ট্রেইনিং আছে ওদের। চাইলে কয়েক মুহূর্তে খতম করে দিতে পারবে মিচ ও তার দুই স্যাঙাকে। কিন্তু জেসিকার জীবন বিপন্ন হবে ভেবে চোরের মত ওয়ারড্রোবে ঢুকে ওরা ভাবছে: এই বুঝি ধরা পড়লাম!

আরও বাড়ল রানার পিঠের চুলকানি। গাল কুঁচকে ওটা সামলে নিতে চাইল। জেসিকার জন্যে দুশ্চিন্তা মনে আসতেই ভাবল: আমরা বড় কোন ভুল করলাম না তো? আমার কি উচিত ছিল স্কটল্যাণ্ডে চলে যাওয়া?

পাশের বেডরুমে ঢুকে ধুপ্ শব্দে দরজা বন্ধ করল মিচ। থরথর করে কাঁপল দেয়াল। ভারী পায়ে হাঁটছে লোকটা। টান খেয়ে মেঝেতে পড়ল বিছানার পাশে কেবিনেটের ড্রয়ার। ছিটিয়ে গেল নানান হালকা জিনিস। আছাড় খেয়ে ভাঙল টেবিল ল্যাম্প। যা খুঁজছে, সেটা না পেয়ে বিড়বিড় করে গালি দিচ্ছে লোকটা। যে-কোন মুহূর্তে ঢুকবে ওঅক-ইন ওয়ারড্রোবে।

দ্রুত ভাবতে গিয়ে বিদায় নিল রানার পিঠের চুলকানি। দমে গেছে ওর মন। লোকটা হ্যারিসের কাপড়চোপড় ঘাঁটবে না, সেটা হওয়ার নয়। চাইলেও অদৃশ্য হতে পারবে না ওরা। হ্যাঙারে ঝুলন্ত কোটের প্লাস্টিক কাভারে লেগে বিশ্রী খসখস শব্দ হচ্ছে। ওয়ালথার ধরা হাতের তালু দরদর করে ঘামছে রানার।

রেগে গিয়ে নানান জিনিস মেঝেতে ছুঁড়ছে মিচ। রানার মনে হলো লড়াই এড়িয়ে যাওয়ার উপায় আসলে নেই। নিজেকে বোঝাল, খুনোখুনি হলে সেটা হয়তো ওর জন্যে ভালই হবে। হ্যারিস নেই। তার কাছ থেকে কিছুই জানতে পারবে না। তবে এদের কাছ থেকে হয়তো জেনে নিতে পারবে কাদের হয়ে কাজ করে এরা। এদের বস্ কিছু বোঝার আগেই হয়তো সামান্য সময় হাতে পাবে রানা। সেক্ষেত্রে চেষ্টা করবে স্কটল্যাণ্ড থেকে জেসিকাকে সরিয়ে নিতে।

যারা এসেছে, তথ্য পেতে হলে তাদের অন্তত একজনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মাথায় পিস্তল ধরে হুমকি দিলে, সে ফোন দেবে তার বসকে। জানিয়ে দেবে: ঠিকভাবেই শেষ করেছে তাদের কাজ। পরে তার পেট থেকে সব জেনে নেবে রানা। তাতে জানা যাবে এদের বসের কাছে কীভাবে পৌঁছুতে হবে।

হয়তো সহজেই যেতে পারবে শত্রুপক্ষের আস্তানায় এটা ভেবে মনে নতুন উদ্যম পেল রানা। বগল থেকে ল্যাপটপ নিয়ে রেখে দিল একটা তাকে ভাঁজ করা পোশাকের ওপরে। নিঃশব্দে চলল দরজা লক্ষ্য করে। অন্ধকারে ওকে দেখছে ফক্স। নীরবে যেন বলছে: ‘বস্, করেন কী!’ ওর তিক্ত আবছা মুখ দেখে রানা টের পেল, প্রাক্তন এসএএস সৈনিক বুঝে গেছে যে লড়তে হবে।

দরজা আধইঞ্চি খুলে উঁকি দিল রানা। তারপর নীরবে ফাঁক করল আরও নয় ইঞ্চি। কয়েক ফুট দূরে ওর দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিচ। টেনে সরাচ্ছে হ্যারিসের বিছানার ম্যাট্রেস। বোধহয় ভেবেছে ওটার নিচে আছে ল্যাপটপ বা ডেটা ড্রাইভ। লোকটার জিন্সের ওয়েস্টব্যাণ্ডে গুঁজে রাখা হয়েছে এক ১৯।

বরফের মত শীতল হয়ে গেছে রানার স্নায়ু। একবার শ্বাস নিয়ে ওয়ারড্রোব পেছনে ফেলে কয়েক পা গিয়ে ওয়ালথারের বাঁট ঠাস করে নামাল মিচের কানের পেছনে।

প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে বিছানার ওপরে কাত হয়ে পড়ল লোকটা। গলা চিরে বেরোল চাপা গোঙানি। তারই ভেতরে কোমর থেকে নিতে গেল গ্লক ১৯। খপ্ করে ধরে পিঠের ওপরদিকে তার হাতটা ঠেলল রানা। পরক্ষণে টেনে হিঁচড়ে তাকে নামিয়ে নিল কার্পেটে। ঘাড়ে ঠেসে ধরল ওয়ালথারের মাযল। মিচ চেঁচাবার আগেই মাথার তালুর ওপরে পড়ল পিস্তলের জোরাল বাড়ি। তার মুখ বামহাতে চেপে ধরেছে রানা। ওর হাঁটুর নিচে চাপা পড়ে যে-কোন সময়ে মট করে ভাঙবে মিচের বাহুর হাড়।

ওয়ারড্রোব থেকে বেরিয়ে এসেছে ফক্স। লোকটার কোমর থেকে সংগ্রহ করে নিল গুক পিস্তল। পিছিয়ে গেল দু’পা। এরই ভেতরে দেখেছে গুলি আছে পিস্তলের চেম্বারে। এবার হয়তো অস্বাভাবিক শব্দ শুনে উঠে আসবে অন্যদু’জন। ঘরের দরজার দিকে অস্ত্রটা তাক করল ফক্স।

অবশ্য জিনিসপত্র ভাঙতে বেশি ব্যস্ত নিচের ওরা।

মাথায় বাড়ি খেয়ে ঘোর লেগেছে মিচের। বামহাতের তালু দিয়ে তার মুখ চেপে ধরেছে রানা। ফাঁদে পড়া শুয়োরের, মত ওর হাত কামড়ে দিতে চাইল মিচ। এখন গুলি করা হলে তার মগজ ভেদ, করে উড়ে যাবে রানার আঙুল। ও যে আসলে খুন করতে চাইছে না, সেটা বোঝার কথা নয় লোকটার। নরম সুরে বলল রানা, ‘আমার কথা মন দিয়ে শোনো, নইলে খুন হবে। এবার ঢিল দেব হাতে। তাতে ব্যথা কমবে। আমার কথা বুঝে থাকলে মাথা দোলাও।’

কনুইয়ের ওপরে হাঁটুর চাপ কমাল রানা। মিচের মুখ থেকে সরিয়ে নিল হাত।

লোকটা বুঝেছে, গায়ের জোরে ছুটে যেতে পারবে না সে। একবার মৃদু মাথা দোলাল।

‘গুড, দুয়েকটা প্রশ্ন করব,’ বলল রানা। ‘ঠিকঠাক জবাব দেবে। মিথ্যা বললে খুন হবে। তুমি তো মরতে চাও না, তাই না, মিচ?’

দ্বিধাহীনভাবে মাথা দোলাল লোকটা।

‘তো বলো, এ-বাড়িতে তোমাদের আরও কেউ আসবে?’

‘না।’

‘গাড়িতে কেউ রয়ে গেছে?’ জানতে চাইল রানা। ‘না।’

মৃত্যুমুখে পড়লে বেশিরভাগ মানুষ বাঁচতে গিয়ে সত্যি কথা বলে, সেটা জানে রানা। ‘ঠিক আছে, আর কোন প্রশ্ন নেই। এবার আমার হয়ে একটা কাজ করে দেবে।’

‘সেটা কী?’

‘উঠে দাঁড়াবে। দরজা খুলে করিডরে গিয়ে তোমার দুই দোস্তকে ডাকবে। বলবে, দারুণ এক জিনিস পেয়েছ। তারা যেন দেরি না করে ছুটে আসে। আমার হয়ে কাজটা করে দিলে মরতে হবে না তোমাকে।’

ফক্সকে চোখের ইশারায় ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো দেখাল রানা। আগেও এ-ধরনের অপারেশনে গেছে ফক্স। চট্ করে বুঝে গেল এবার কী করতে হবে। মিচ ডাকলে সিঁড়ি বেয়ে উঠবে তার দুই সঙ্গী। কাভার পাবে না তারা। চাইলেও পালাতে পারবে না। ওপরতলায় সিঁড়ির কাছে থাকবে রানা। ওদিকে নিচতলায় নেমে ঘুরে এসে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছুবে ফক্স। দরকার হলে দু’জন মিলে হামলা করবে ওরা দু’দিক থেকে।

লক করা নয় ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো। দরজা খুলে ব্যালকনিতে পা রাখল ফক্স। নিচে বামে-ডানে বাগান। ঢালু ছাত নেমে গেছে কমলার খেতের দিকে। ছাত থেকে সরসর করে পিছলে নেমে গেলে পতনটা হবে বারো ফুট নিচে। প্যারাশুট ল্যাণ্ডিঙের মত কয়েক গড়ান দিয়ে উঠে দাঁড়াবে ফক্স। আগেও বহুবার এই কাজ করেছে। ব্যালকনিতে ওঠা কিছু আইভি লতা মুঠোয় ধরে টান দিল। সিমেন্ট থেকে উপড়ে এল না ওগুলো। ব্যালকনির রেলিং টপকে ঢালু ছাতে নামল ফক্স। কয়েক সেকেণ্ড পর নিচ থেকে এল মৃদু ধুপ আওয়াজ।

একইসময়ে হ্যাঁচকা টানে মিচকে দাঁড় করাল রানা। মুচড়ে ধরা হাতে চাপ বেড়ে যেতেই বেডরুমের দরজার দিকে চলল লোকটা। নিচু গলায় বলল রানা, ‘আমাকে হতাশ কোরো না। দোস্তদের কপালে কী হবে, সেটা তোমার মাথাব্যথা নয়।’

দরজা খুলে মিচকে সামনে রেখে করিডরে বেরোল রানা। কয়েক মুহূর্তে দু’জন পৌঁছে গেল সিঁড়ির কাছে। মিচের ঘাড়ে পিস্তলের নল ঠেসে ধরেছে রানা। নিচে থেমে গেছে রস ও বিগসের করা ভাঙচুরের আওয়াজ। কমলা খেত থেকে ধুপ শব্দটা শুনে সতর্ক হয়ে গেছে তারা। এবার অন্যদিকে সরাতে হবে তাদের মনোযোগ। সিঁড়ির ওপরের ধাপের দিকে মিচকে ঠেলল রানা। নিচু স্বরে বলল, ‘ডাকো।’ নিজে সরে গেল প্যাসেজের দেয়ালের পাশে। এখন নিচতলা থেকে ওকে দেখবে না কেউ।

কর্কশ স্বরে ডাকল মিচ: ‘ওয়ে! দারুণ জিনিস পেয়েছি!’

কয়েক মুহূর্ত পর ডাইনিং ও লিভিংরুম থেকে নিচের করিডরে এল মিচের দুই সঙ্গী। হ্যারিসের লাশের পাশে থেমে ওপরে তাকাল। ডানদিকের জনের হাতে শটগান। বামদিকের লোকটার মুঠোয় পিস্তল। বিপদের জন্যে দু’জনই তৈরি। গলা উঁচিয়ে জানতে চাইল পিস্তলওয়ালা, ‘কী পেয়েছ, মিচ?’

‘দেখে যাও!’ ওপর থেকে হাতের ইশারা করল মিচ।

‘ল্যাপটপটা তা হলে পেয়ে গেছ?’

‘জলদি এসে দেখে যাও, রস!’

অভিনয় মোটেই খারাপ করছে না লোকটা, ভাবল রানা।

সিঁড়ি বেয়ে উঠছে পিস্তল হাতে রস। তবে দ্বিধা করছে শটগানধারী বিস্‌। কয়েক মুহূর্ত পর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল সে। কিন্তু তখনই ফাটা গলায় চেঁচিয়ে উঠল মিচ, ‘সাবধান, রস! বিস্! এই শুয়োরের বাচ্চারা…’

প্রাণের তোয়াক্কা নেই দুঃসাহসী মিচের। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রানা। ওর গুলি বিধল সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় থমকে যাওয়া রসের বুকে। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড় করে নিচে গিয়ে পড়ল লাশ। বন্ধুর মৃতদেহ গায়ে এসে পড়ছে দেখে লাফিয়ে সরে গেছে বিগ্‌স্‌।

এদিকে হাত বাড়িয়ে রানার পিস্তল কেড়ে নিতে চাইল মিচ। কিন্তু তার কোদালের মত সামনের সব দাঁতে খটাস্ করে নামল রানার পিস্তলের নল। নিচের জানালা দিয়ে বাড়ির পাশে গ্লক হাতে ফক্সকে ছুটতে দেখল রানা। আধ মিনিটে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকবে প্রাক্তন এসএএস সৈনিক। পিছলে নেমে সিঁড়ির প্রথম ধাপে থেমেছে রসের লাশ। ততক্ষণে ভারসাম্য ফিরে পেয়েছে বিস্‌। সে নলকাটা বন্দুক তাক করার আগেই তার দিকে পিস্তল ঘুরিয়ে নিয়েছে রানা। পায়ের কাছে শুয়ে আছে দাঁতভাঙা, রক্তাক্ত মিচ। রানার হাঁটুর বাটি লক্ষ্য করে পা ছুঁড়ল সে। লাথিটা এড়াতে গিয়ে একপাশে সরে গেল রানা। তবে এখন আর বাড়তি সময়টা নেই ওর হাতে। শটগানের নল ঘুরিয়ে নিয়েই ট্রিগার টিপে দিল বিগ্‌স্‌।

বদ্ধ পরিবেশে গ্রেনেডের মত বিকট আওয়াজ তুলল বারো গেজ শটগানের গুলি। নলকাটা বন্দুক দিয়ে দূরের কাউকে লক্ষ্যভেদ প্রায় অসম্ভব। দুই আউন্সের তপ্ত সীসা রানাকে মিস করে লাগল ওপরের দেয়ালের কোনায়। কিছু ছররা ম্যাচের কাঠির মত মট-মট করে ভাঙল রেলিঙের ওপরদিকে সরু কয়েকটা খুঁটি।

বিগ্‌স্‌ গুলি করার আগেই দোতলায় ওদিকের প্যাসেজ লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রানা। মেঝেতে পড়ার আগেই শূন্যে শরীর ঘুরিয়ে পর পর দু’বার গুলি ছুঁড়েছে। এদিকে বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে ফক্স। লাফিয়ে টপকে গেছে হ্যারিসের লাশ। ফক্সের একের পর এক গুলি বিধল রিগসের পিঠে। এ-ছাড়া লোকটার বুকে বিঁধেছে রানার দুটো বুলেট। মৃত্যু-মুহূর্তে খিঁচ ধরল বিগসের আঙুলে। তর্জনীর হ্যাঁচকা টান পড়ল বন্দুকের ট্রিগারে। ভয়ঙ্কর শব্দে গর্জে উঠল শটগান। এবারের এক থোকা ছররা লাগল সিঁড়ির ওপরদিকের ধাপে। নানানদিকে গেল কাঠের কুঁচি ও ছেঁড়া কার্পেটের টুকরো। মেঝেতে উঠে বসে আবারও রানা গুলি করতেই বিগসের কপালে জন্মাল দগদগে এক লাল ফুটো। লোকটার হাত থেকে আগেই খসে পড়েছে বন্দুক। সিঁড়ির ধাপে ঠোকর খেয়ে নেমে গেল লাশটা রসের মৃতদেহের পাশে।

মিলিয়ে গেল গোলাগুলির আওয়াজ।

রসের লাশ দেখে নিয়ে বলে উঠল ফক্স, ‘শালা শেষ!’

মেঝেতে ঘুরে বসে দেখল রানা, সিঁড়ির ওপরের ধাপের কাছে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে মিচ। ভাঙা দাঁতের জন্যে মুখ রক্তাক্ত। পিটপিট করে ছাত দেখছে সে। বিড়বিড় করে কী যেন বলল। রানা ভাবল, ঘাড় ধরে দাঁড় করাবে লোকটাকে। কিন্তু তখনই দেখল, মিচের ছেঁড়া শার্টের বুকে ছড়িয়ে পড়ছে লাল ভেজা দাগ। বিগসের বন্দুক সিঁড়ির ধাপ ভাঙার সময় কয়েকটা বাকশট লেগেছে মিচের বুক ও কিডনিতে। ক্ষত থেকে ঝর্নার মত বেরোচ্ছে রক্ত। বড়জোর কয়েক মিনিট বাঁচবে সে। ঠোঁটের কোণে জমছে লালচে বুদ্বুদ। গলার গভীর থেকে এল ঘড়ঘড়ে আওয়াজ।

ছেঁচড়ে এগিয়ে তার কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকাল রানা। ‘শুনছ? হাসপাতালে নিয়ে যাব! তুমি পুরো সুস্থ হয়ে যাবে!’ ভাল করেই জানে, কথাগুলো মিথ্যা। এখন দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে বাঁচাতে পারবে লোকটাকে।

খক-খক করে কাশল মিচ। মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে তাজা রক্ত ভিজিয়ে দিল চিবুক। উল্টে যাচ্ছে দুই মণি। রানার দিকে তাকাল। অস্বচ্ছ হয়ে গেছে দু’চোখ। বড় করে শ্বাস নিয়ে পরক্ষণে শিথিল হলো সে।

সিঁড়ি থেকে নিচু গলায় জানাল ফক্স, ‘ও আর নেই, বস্!’ রানাও সেটা বুঝেছে।

আর কারও কাছ থেকে কোন তথ্য পাবে না ওরা।

বিগসের ঝাঁঝরা বুক-পিঠ দেখল ফক্স। লোকটার কপাল ফুটো হয়েছে রানার গুলিতে। ‘এ-ও খতম! আমাদের আর কিছু করার নেই!’

উঠে দাঁড়িয়ে ফক্সের দিকে তাকাল রানা।

আর তখনই আঁৎকে উঠল ফক্স। ‘হায়, ঈশ্বর!’

‘কী দেখলে?’ ক্লান্ত স্বরে বলল রানা।

বিগসের আইডি খুঁজতে গিয়ে অন্যকিছু পেয়েছে ফক্স।

বুলেট লেগে চুরমার হয়েছে কালো এক বাক্স- দেখতে ছোট রিমোট কন্ট্রোলের মত।

‘বস্, এর কাছে বডি ক্যাম! আপনি যখন গুলি করলেন, চলছিল লাইভ ট্র্যান্সমিশন! কেউ না কেউ সবই দেখেছে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *