1 of 2

কিলিং মিশন – ৪৭

সাতচল্লিশ

একটু পর শুরু হবে অপদেবতা থঅথ-এর পূজার অনুষ্ঠান। তার আগে ক্লাব সদস্যদেরকে জানাতে হবে, তারা যেন ড্রেসিংরুমে গিয়ে পোশাক পাল্টে নেয়। ওদিকে শার্লন হলে যে-কোন সময়ে হামলা করবে মাসুদ রানা ও উইলবার ফক্স। অস্থির বোধ করছে রিপার ক্যাসিডি। তার নির্দেশে নিজের লোকদেরকে নিয়ে বিশাল প্রাসাদ ও আশপাশের এলাকা সার্চ করতে গেছে ব্রায়ান্ট হার্ডস্টাফ। গ্র্যাণ্ড মাস্টার ব্যালার্ডের সঙ্গে আলাপ করতে হন্তদন্ত হয়ে মেম্বার্স লাউঞ্জে ফিরল ক্যাসিডি।

সিংহাসনে বসে শ্যাম্পেইনে মৃদু চুমুক দিচ্ছে ক্লাব সভাপতি। হলরুমের কারও জানা নেই কত বড় সমস্যায় আছে ক্যাসিডি। সে মনস্থির করেছে, আপাতত ক্লাবের সদস্যদেরকে কিছুই জানাবে না। সিংহাসনের পাশে থেমে ব্যালার্ডের কানে ফিসফিস করে কথা বলল সে। এ-ছাড়া উপায়ও নেই। বিপদের গন্ধ পেলে চড়ুই পাখির মত ফুড়ুৎ করে জানালা দিয়ে উড়াল দেবে দেশের সেরা সন্তানেরা। অবশ্য এসব নিয়ে এখন ভাবছে না ক্যাসিডি। তার একমাত্র উদ্দেশ্য এই এলাকা থেকে গ্র্যাণ্ড মাস্টারকে সরিয়ে নেয়া।

‘স্যর, আমরা বাজে ঝামেলায় পড়েছি,’ বলল ক্যাসিডি।

কমোডো ড্রাগনের মত ঠোঁটদুটো প্রশস্ত করে এমপি গানের অনুপস্থিতির বিষয়টা শুনল বৃদ্ধ। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ওকে ফোন দাও।’

‘ফোন দিয়েছি, কিন্তু জবাব দিচ্ছে না। স্যর, মনে হচ্ছে এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। ভাল হয় আমরা অনুষ্ঠানে না থেকে ফিরে গেলে।’

কোঁচকানো টাকমাথা এদিক-ওদিক নাড়ল বুড়ো। ‘তুমি বড় বেশি চিন্তা করো, রিপার। অনুষ্ঠান অবশ্যই চলবে। বিপদ হলে সেটা সামাল দেবে সিকিউরিটির লোক। যদি জানা যায় যে ক্রিস্টোফার গান আমাদের নিয়ম ভেঙেছে, তো আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে সে।’

‘বিপদ হলে আপনাকে সরিয়ে নেয়া আমার দায়িত্ব, স্যর,’ নিচু গলায় বলল ক্যাসিডি।

‘কীসের বিপদ? কিছুই তো হয়নি! তোমার কি ধারণা, উপযুক্ত কারণ ছাড়াই অনুষ্ঠানে আমি অনুপস্থিত থাকব?’

‘মাফ করবেন, স্যর। আমি এখনই আপনাকে নিয়ে শার্লন হল থেকে বেরিয়ে যেতে চাই।’

অধীনস্থের কথায় রাগে লালচে হলো বুড়োর মুখ। সিংহাসন থেকে সরে বহু পুরনো এক সদস্যকে হলরুমে খুঁজে নিল ক্যাসিডি। তাকে দূরে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘ব্রাদার, বিপদ হবে বলে আশঙ্কা করছি। তাই এখান থেকে গ্র্যাণ্ড মাস্টারকে সরিয়ে নেব। তাই ভাবছি, আপনি কি আজকের অনুষ্ঠানে তাঁর বদলে সভাপতি হবেন? এটা খুব জরুরি।’

ক্যাসিডির কথায় হাসল বৃদ্ধ। ‘আমি রাজি, ব্রাদার। কোন সমস্যা নেই। আজ আমাকে এত সম্মান দেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ গ্র্যাণ্ড মাস্টারকে।’

তাকে ধন্যবাদ দিয়ে ইমোজেন ব্যালার্ডের পাশে ফিরল ক্যাসিডি। একই অনুরোধ আবারও করল। তাতে বিরক্ত হলেও সিংহাসন ছেড়ে তার পিছু নিল বুড়ো। হলরুমের একদিকের দরজা পেরোবার সময় বলল, ‘তবে মনে রেখো, এসবের কোন দরকার ছিল না!’

‘স্যর, আমরা কোন ঝুঁকি নেব না,’ বলল ক্যাসিডি।

অধর্মের গুরুকে নিয়ে হলরুম থেকে বেরোতেই বেশ কয়েকবার জোরে বেজে উঠল ঘণ্টি। স্পিকারে বলা হলো, ‘ভ্রাতৃগণ, এবার সময় হয়েছে আপনাদের তৈরি হওয়ার। একটু পর শুরু হবে আমাদের অনুষ্ঠান।’

সদস্যরা ড্রিঙ্ক শেষ করে যে-যার মত চলল ড্রেসিংরুমের দিকে। প্রাসাদের মাঝে সারি-সারি ব্যক্তিগত কিউবি। ওখানে আছে প্রত্যেকের জন্যে তালাসমেত লকার। ওগুলোর ভেতরে আছে হুডওয়ালা দীর্ঘ, কালো আনুষ্ঠানিক আলখেল্লা ও পাখির মুখের মুখোশ। ওই মুখোশের জন্যে রক্তাক্ত অনুষ্ঠানে সদস্যদের কারও মুখ দেখা যায় না। ব্যক্তিগত যে- কোন কিছু লকারে রাখতে পারে তারা। কেউ কেউ আরও উত্তেজিত হতে অনুষ্ঠানের আগে ব্যবহার করে কোকেন ও মেথামফেটামিন। ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী অনুষ্ঠানের সময়ে যা-খুশি করতে পারবে তারা।

একটু পর লাইন তৈরি করে বাড়ি ছেড়ে বেরোবে সবাই। চাঁদের আলোয় গিয়ে দাঁড়াবে লেকের তীরে। তখন শুরু হবে পূজার অনুষ্ঠান। কালো জলের লেকের মাঝে আঁধারে ডুবে আছে জঙ্গুলে দ্বীপ। একটু পর দপ করে ওখানে জ্বলবে আগুনের কমলা শিখা। সঙ্গে সঙ্গে এপারে গুঞ্জন তুলে প্রার্থনা ধরবে ক্লাবের সদস্যরা।

আরম্ভ হবে রাতের অশুভ অনুষ্ঠান।

.

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ এক এক করে করিডর পেরিয়ে বিশাল প্রাসাদের অন্যদিকে যেতে গিয়ে হাঁফ লেগে গেছে ইমোজেন ব্যালার্ডের। হাঁটার গতি খুবই কম। শুধু যে বিকল হচ্ছে যকৃৎ, তা নয়, বয়সের জন্যেও চলতে চাইছে না প্রাচীন দেহ। একটু পর পর থেমে বিশ্রাম নিচ্ছে। বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ক্যাসিডিকে। অধৈর্য হয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরছে। ভাবছে, এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি। অনেক আগেই কাজটা করা উচিত ছিল।

‘ওদিকের দরজা দিয়ে উঠানে বেরোব,’ গ্র্যাণ্ড মাস্টার থেমে যেতেই বলল সে।

হাঁফাতে হাঁফাতে বলল ব্যালার্ড, ‘অত দূরে যেতে পারব না। তুমি কি চাও অতি পরিশ্রমে আমি মারা যাই?’

‘প্লিয, স্যর, চেষ্টা করুন হেঁটে যেতে।’

‘তুমি কি পাগল হলে? গাড়ি তো অনেক কাছে! ওটাতে চেপে বিদায় নিচ্ছি না কেন?’

শার্লন হল থেকে হঠাৎ করে চলে যেতে হতে পারে, সেজন্যে নিজের কাছে রোলস রয়েসের বাড়তি এক সেট চাবি রেখেছে ক্যাসিডি। কিন্তু সেই গাড়ি এখন ব্যবহার করা খুব বিপজ্জনক। সেটাই বলল সে, ‘স্যর, রানা আর ফক্স হয়তো গাড়িতে বোমা পেতে রেখেছে। বলা যায় না; গেটের কাছে গেলেই হয়তো অ্যাম্বুশ করবে। অথবা গাড়িতে উঠতে গেলেই দূর থেকে গুলি করে খতম করে দেবে।’

প্রথম থেকেই বিপদের কথা মাথায় রেখেছে ক্যাসিডি। বৃদ্ধকে বিশ্রাম নিতে দিয়ে মোবাইল ফোনে ডায়াল করল সে। ‘ওয়াল্টার? আমি অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল। তোমার এবার চলে আসতে হবে। দেরি না করে রওনা হও।’

গ্র্যাণ্ড মাস্টারের হেলিকপ্টারের পাইলট ওয়াল্টার হ্যান্স। তাকে তৈরি থাকতে বলেছে ক্যাসিডি। এখন সামান্য দূরের এক এয়ারফিল্ডে আছে হেলিকপ্টার। ডাক পেলেই কয়েক মিনিটের ভেতরে বাড়ির পাশে নামবে। তবে এই কাজটা করা হলে একহাজার একটা প্রশ্ন তুলবে সদস্যরা। এবং শেষে যদি দেখা যায় হামলা করা হয়নি শার্লন হলে, সেক্ষেত্রে আস্ত বুদ্ধু বনবে ক্যাসিডি।

গ্র্যাণ্ড মাস্টারের হেলিকপ্টারের পাইলট অত্যন্ত দক্ষ। তার সমস্যা হবে না গাছ ও বিদ্যুতের খুঁটি এড়িয়ে ঠিক জায়গায় নেমে আসতে।

‘আমি রওনা হচ্ছি, স্যর,’ জানিয়ে দিল ওয়াল্টার।

তাকে তাড়া দিল ক্যাসিডি। ‘জলদি এসো!’

দম ফিরে পেয়েছে ব্যালার্ড। আবারও ধীরপায়ে এগিয়ে চলল। দু’জনে ঢুকে পড়ল খোলা এক দরজা দিয়ে বড় একটি ঘরে। চারপাশে সাদা কাপড়ে ঢাকা অ্যান্টিক আসবাবপত্র, আঁধারে গা ছমছমে ভূতের মত। জানালার ওদিকে বাড়ির ঘাসে ছাওয়া লন ও দূরে লেকের বুকে আঁধার দ্বীপ।

‘দেখেছ?’ জানালার ধুলোভরা কাঁচের ভেতর দিয়ে ওদিকে তাকাল বৃদ্ধ। ক্যাসিডির মনে হলো তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে এগিয়ে যেতে। অবশ্য ওটা করা হবে চরম বেয়াদবি। বাধ্য হয়ে জানালা দিয়ে তাকাল সে। ভ্রাতৃসঙ্ঘের সবাই চলেছে লেকের তীরের দিকে।

‘তুমি সত্যিই বোকা,’ বিড়বিড় করল ব্যালার্ড। ‘তুমি যা-ই বলো, এই অনুষ্ঠান আমি মিস করব না।

‘স্যর, আমাদের হাতে সময় নেই। হেলিকপ্টার নেমে আসার আগেই বাড়ির ওদিকের মাঠে পৌছুতে হবে।’

ধমকের সুরে বলল ব্যালার্ড, ‘আমরা এখানে পুরোপুরি নিরাপদ। তবুও যখন জোর করছ, আমি যাচ্ছি তোমার সঙ্গে। তবে অন্তত এক মিনিট দেবে আমার প্রিয় অনুষ্ঠান দেখতে। এটা আমার নির্দেশ, রিপার। কথা বুঝতে পেরেছ?’

অপেক্ষা না করে উপায় নেই ক্যাসিডির। হাতঘড়ি দেখে নিয়ে আকাশে চোখ রাখল। তাকে দেখলে যে-কেউ ভাববে, লোকটা চাইছে মুহূর্তে পৌঁছে যাক হেলিকপ্টার। জানালা দিয়ে ইমোজেন ব্যালার্ড দেখছে, লেকের তীরে পৌঁছে গেছে ভ্রাতৃসঙ্ঘের সবাই

বহু বছর ধরে চলছে থঅথের পূজানুষ্ঠান। লেকের তীর থেকে সবার সম্মিলিত প্রার্থনার গুঞ্জন পৌঁছে গেল দ্বীপে। জঙ্গলের সামনে বালুকাবেলায় দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল কমলা শিখা। রাতের আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওপরে উঠছে ধূসর ধোঁয়া। পেছনদিকে থঅথের বিশাল পাথুরে মূর্তি। অপদেবতার পায়ের কাছে হাজির হয়েছে টকটকে লাল আলখেল্লা পরনে এক যাজক। লেকের তীরের দিকে ফিরে দু’হাতে ওপরে তুলল রাজদণ্ড ও ইস্পাতের ঝিকঝিকে দীর্ঘ ড্যাগার।

ধোঁয়া থেকে বেরোল তার অনুচরেরা। শক্ত হাতে দু’দিক থেকে ধরে রেখেছে সুন্দরী এক মেয়েকে। আগেরজনের মত ফর্সা নয় সে, রোদে পুড়ে গায়ের রঙ বাদামি। পরনে সাদা গাউন। একটু পর ওটা ভরে উঠবে টকটকে লাল রক্তের ছিটায়। মাত্র ক’দিন আগে ক্রিস্টোফার গানের মেয়েকে বলি দেয়া হয়েছে, তবে আবারও কাউকে খুন করা হবে জেনে খুশি পূজারীরা। আঁধার রাজ্যের মালিকের জন্যে রক্ত ঝরাতে পারলে উজ্জীবিত হবে তারা।

ক্রমেই বাড়ছে প্রার্থনার ধ্বনি। হ্যাভোক ক্লাবের সদস্যরা ভাল করেই জানে, কী বলা হচ্ছে অদ্ভুত ভাষায়। একটু পর পর বিকট শব্দে গর্জে উঠে নেকড়ের মত হুঙ্কার ছাড়ছে তারা।

মেয়েটাকে ঠেসে ধরে দু’কবজির চামড়ার ফিতা বেদির দু’পাশের লোহার দুই কড়ায় বেঁধে দেয়া হলো। ওপর থেকে অসহায় শিকারের দিকে চেয়ে রইল অশুভ অপদেবতা থঅথ। ধোঁয়াভরা পরিবেশে আগুনের কমলা শিখায় চিকচিক করছে যাজকের ড্যাগার। দারুণ লাগছে বলে অদ্ভুত ঘোর নিয়ে দৃশ্যটা দেখছে তীরের পূজারীরা। অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে, এবার যে-কোন সময়ে মেয়েটার রক্ত ঝরবে। তাতেই যেন তাদের চরম মুক্তি। শয়তানের স্যাঙাতের পূজা করছে বলে পৃথিবীর বুকে তারা হয়ে উঠবে আরও ক্ষমতাশালী।

চলে এল চরম আনন্দের ক্ষণ। আকাশে ড্যাগার তুলে মেয়েটার ঘাড়ে ফলা বসাবার জন্যে তৈরি হলো লাল আলখেল্লা। এবার রক্তের ছিটায় ভরে উঠবে বেচারির সাদা গাউন। লেকের তীর থেকে বিকট চিৎকার জুড়ল পূজারীরা। কিন্তু ঠিক তখনই হঠাৎ করে খুব দ্রুত সব ঘটতে লাগল। ধারালো ড্যাগারের ফলা চেপে বসল না মেয়েটার ঘাড়ে। টকটকে লাল রক্তে ভরে গেল ওর গাউন। কিন্তু সেই রক্ত আসলে অন্য কারও!

মেয়েটার ঘাড়ে ড্যাগারের ফলা বসাবার আগেই ছিন্নভিন্ন হয়েছে যাজকের মগজ। লেকের তীর থেকে এসেছে সাইলেন্সার্ড রাইফেলের ভোঁতা ‘ধ্যাপ’ আওয়াজ। হাঁটু ভেঙে বালুকাবেলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল লাল আলখেল্লা। আগেই হাত থেকে খসে গেছে ড্যাগার। দ্রুতগতি বুলেট খুলিটা দু’ভাগ করে দেয়ায় দু’টুকরো হয়েছে যাজকের শিংওয়ালা মুকুট।

ভয়াবহ নিষ্ঠুর এই ঘটনায় চমকে গেছে তীরের সবাই। এখন আর নেকড়ের মত হুঙ্কার ছাড়ছে না কেউ। ভীষণ আতঙ্কে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল তাদের কয়েকজন।

আর তখনই তাদের ওপরে এল আকস্মিক আক্রমণ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *