1 of 2

কিলিং মিশন – ১৪

চোদ্দ

পাহাড়ি কার্নিশ লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছে রানা, সতর্ক। নিশ্চিত নয় যে গোপনে যেতে পারবে ফক্সের খুব কাছে। হয়তো ওর প্রতিটি পদক্ষেপ দেখছে সে। এবং সেক্ষেত্রে যে- কোন সময়ে ওর বুক বা মাথায় বিধবে রাইফেলের বুলেট।

দশ গজ যেতেই চারপাশে নেমে এল ঘুটঘুটে আঁধার। হঠাৎ করেই চাঁদটাকে ঢেকে দিয়েছে একরাশ কালো মেঘ। এ- মুহূর্তে দশ ফুট দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। সুযোগটা নিয়ে ঝড়ের বেগে কার্নিশে উঠে এল রানা। সামনেই কাঁটাঝোপে ভরা বাটির মত নিচু এক জায়গা। পেছনে ছাউনির মত উঁচু পাথুরে শেল্‌ফ্। বিশ গজ দূরে বাটির মত গর্তে বসে আছে উইলবার ফক্স। ছায়ার ভেতরেও তাকে পরিষ্কার চিনল রানা।

যোগীদের ধ্যানের ভঙ্গিতে পা ভাঁজ করে বসে আছে যুবক। চিকন হয়ে গেছে আগের চেয়ে। একটু আগে ক’জনকে খুন করলেও কিছুই যেন স্পর্শ করছে না তাকে। চেহারায় নিশ্চিন্ত একটা ভাব। বাম পায়ের পাশে হান্টিং রাইফেল। বামে পেটমোটা হোল্ডঅল। সামনে পাথুরে চুলো। নিভে গেছে আগুন। পাশেই চেরাই করা চ্যালাকাঠ। বেস ক্যাম্প হিসেবে জায়গাটা বেছে নিয়েছে ফক্স। ওর পছন্দ দেখে মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না রানা। ও নিজেও একই জায়গা বেছে নিত। দেড় মাইল দূরে আলদারিসিন গ্রামের টিমটিমে বৈদ্যুতিক বাতি। দরকার হলে মাত্র কয়েক মিনিটের ভেতরে ওখানে পৌঁছুতে পারবে ফক্স।

স্বর্গের মত সুন্দর জায়গা বেছে নিলেও ওর পিছু নিয়ে হাজির হয়েছে একদল হারামি বদমাস।

চাঁদের তলা থেকে মেঘ সরে যেতেই জ্যোৎস্নায় ভেসে গেল বাটির মত জায়গাটা। আরও কয়েক পা গিয়ে বসে পড়ল রানা। আরও এগোলে ওকে দেখতে পাবে ফক্স। কোমরে গোঁজা পিস্তলটা হাতে নিল রানা। ওটা লোডেড এবং কক করা। .৩৮ ক্যালিবারের ওয়ালথার পিপির ম্যাগাযিনে আছে আটটা বুলেট। কিন্তু প্রিয় সহযোদ্ধাকে হত্যা করতে এখানে আসেনি রানা।

মূর্তির মত বসে আছে যুবক। হয়তো ডুবে গেছে ধ্যানের গভীরতায়। চাঁদের আলোয় তাকে ভালভাবেই দেখছে রানা। ওয়ালথারের ট্রিগারে মৃদু চাপ দিলেই বুম শব্দে বেরিয়ে বুলেট ছিঁড়েখুঁড়ে দেবে ফক্সের হৃৎপিণ্ড। এবার কীভাবে তার সঙ্গে আলাপ শুরু করবে, ছায়ায় বসে সেটা ভাবছে রানা।

কিন্তু ঠিক তখনই মুহূর্তে বদলে গেল পরিস্থিতি।

বাটির পেছনে পাথুরে শেলফের ওপরে রানা দেখল সামান্য নড়াচড়া। সঙ্গে সঙ্গে বুঝল, ফক্সের মত একই ভুল করেছে ও। স্প্যানিয়ার্ডদের দলের সবাই মারা যায়নি!

এক লোক উঠেছে পাহাড়ি শেলফের মত জায়গাটায়। মোটাসোটা গণ্ডারের মত দেখতে। নলকাটা এক বন্দুক হাতে নিঃশব্দে পেটে ভর করে এগোচ্ছে। কিনারায় পৌছুলেই গুলি করবে ফক্সকে। রানা আর ওই লোকের উপস্থিতি সম্পর্কে একেবারেই বেখবর ফক্স। কিনারা লক্ষ্য করে ধীরগতিতে অ্যানাকোণ্ডার মত এগোচ্ছে লোকটা। ডানহাতে ধরেছে বন্দুকের পিস্তল গ্রিপ। চাঁদের আলোয় দেখা গেল নলের নিচে বামহাতের বদলে তার আছে চকচকে, বাঁকা এক আঁকশি। প্রায় পৌঁছে গেছে কিনারায়। সাবধানে নিচু করল বন্দুকের নল। তাক করছে ফক্সের মাথা লক্ষ্য করে। বারো গেজের দুই রাউণ্ড গুলি লাগলে বাঁচবে না প্রাক্তন এসএএস সৈনিক। দুনিয়ার খেয়াল নেই তার। দু’সেকেণ্ড পর মরবে করুণভাবে।

ঝট্ করে ওয়ালথার তুলেই মোটা লোকটার মাথায় তাক করল রানা। পরক্ষণে স্পর্শ করল ট্রিগারে। নল থেকে তপ্ত সীসার বুলেট ছিটকে বেরোতেই রানার হাতে লাফিয়ে উঠেছে পিস্তলটা। টার্গেট খুব কাছে বলে এক সেকেণ্ডের দশভাগের একভাগ সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে বুলেট। করোটির হাড় ভেঙে ছিন্নভিন্ন করে দিল লোকটার মগজ।

কার্নিশের কিনারা থেকে ভারী বস্তার মত নিচের পাথুরে মাটিতে ভূমিষ্ঠ হলো স্প্যানিয়ার্ড। ডানহাতে এখনও নলকাটা বন্দুক। খটাং শব্দে আঁকশি লাগল পাথরের ওপরে। দু’সেকেণ্ড থরথর করে কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল লোকটার শরীর।

চমকে ওঠা চিতাবাঘের মত লাফিয়ে সরে গেছে উইলবার ফক্স। একইসময়ে ওয়ালথারটা মাটিতে রেখে দু’হাত ওপরে তুলে উঠে দাঁড়াল রানা। যে-কেউ বুঝবে ও এখন নিরস্ত্র। নরম সুরে বলল, ‘ভয় নেই, ফক্স। আমি মাসুদ রানা।’

ওকে দেখে থমকে গেছে ফক্স। কুঁচকে গেল তার দুই চোখ। কয়েক মুহূর্ত পেরোলেও কোন কথা বলল না।

‘তুমি তো আমাকে ভাল করেই চেনো,’ বলল রানা। ‘হ্যাঁ, চিনি,’ সন্দেহ নিয়ে বলল ফক্স। ‘আপনি বাংলাদেশ আর্মির মেজর। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনি হঠাৎ এখানে কেন?’

‘আমি এখন আর মেজর নই।’

‘তবে কি আপনিও হয়ে গেছেন ভাড়াটে খুনি?’ ঝড়ের বেগে মাটি থেকে রাইফেল তুলে নিতে চাইল ফক্স।

কিন্তু ওর চেয়ে অনেক দ্রুত রানা। মাটি থেকে পিস্তল তুলে নরম সুরে বলল, ‘হঠাৎ করে কোন ভুল কোরো না, ফক্স। আমি তোমাকে খুন করতে এখানে আসিনি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেহের পাশে দু’হাত ঝুলিয়ে দিল যুবক। পায়ের কাছে পড়ে আছে রাইফেল। ক্লান্ত সুরে বলল ফক্স, ‘তো কী করতে এসেছেন?’

‘জরুরি আলাপ করতে,’ বলল রানা। ‘আগে কয়েক পা সরে যাও রাইফেলের কাছ থেকে।’

কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে দু’ফুট সরে দাঁড়াল ফক্স। কঠোর হয়ে গেছে চাহনি। ‘ওরা আমার পেছনে আপনাকে লেলিয়ে দিয়েছে, তাই না?’

‘আগেও তোমাকে কখনও কোন মিথ্যা বলিনি, ফক্স।’

‘তার মানে, ওরা পাঠিয়ে দিয়েছে আমাকে খুন করতে।’

‘কথাটা মিথ্যা নয়,’ বলল রানা। ‘খুন করতেই বলেছে।

তিক্ত হাসল ফক্স। ‘আমার কপালটাই আসলে খারাপ। আজকাল দেখছি সবাই খুন করতে চাইছে। জানতাম না যে এত জনপ্রিয় হয়ে গেছি!’

‘আমি তোমাকে খুন করতে চাইলে ক্যাপ্টেন হুককেই সেটা করতে দিতাম,’ পিস্তলের নল দিয়ে লাশটা দেখাল রানা।

বাঁকা হাসল ফক্স। চাঁদের আলোয় ঝিলিক দিল মুখের সোনার দাঁত। ‘আমি বোধহয় অনেক ধীর হয়ে গেছি। নইলে সবই টের পেতাম। ঠিক আছে, মেজর, বলে ফেলুন কী বলতে চান।’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘আগেই বলেছি, জরুরি কথা আছে। আর সেজন্যেই এসেছি। খুন করতে নয়।’

‘ওই লোককে সে-কথা বলুন,’ লাশটাকে দেখাল ফক্স।

‘একে ভাল লোক বলে মনে হয়নি, তাই তুমি খুন হওয়ার আগেই তাকে খতম করে দিয়েছি।’

‘তবে কি ধরে নেব, আপনি আমাকে খুন করবেন না?’

‘তোমার কি মনে হচ্ছে আমি গুলি করব?’

শ্রাগ করল ফক্স। ‘আমি কী ভাবছি, সেটা জেনে আপনার আসলে কী লাভ? আপনার হাতে তো পিস্তল!’

‘আমি জানতে চাই, কেন একদল বদমাস তোমাকে খুন করতে চাইছে,’ বলল রানা, ‘এটাও জানি না তারা কারা।’

‘জিপসিদের কথা বলছেন?’

‘না। অন্যদের কথা বলছি।

‘ভয়ঙ্কর নরপশু তারা,’ বলল ফক্স।

‘তুমি নিজেও ফেরেশতা নও,’ বলল রানা।

‘তা হয়তো নই, তবে ওদের তুলনায় আমি দুধের শিশু।’ মৃদু মাথা নাড়ল ফক্স। ‘অনেক আগেই তাদের কাজ বাদ দিয়ে আমার উচিত ছিল পালিয়ে যাওয়া।’

‘বুদ্ধি কখনও কখনও পরে আসে। জরুরি কোন কারণে তোমাকে খুন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে তারা।’

‘ওরা আপনাকে কত টাকা দিচ্ছে?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘বাজে কথা বলবে না, ফক্স।’

‘কিন্তু কাজটা তো আপনি হাতে নিয়েছেন।’

‘কারণ, আর উপায় ছিল না,’ বলল রানা।

‘তা হলে খুন করছেন না কেন? আমাকে তো হাতের মুঠোয় পেয়েছেন।’

‘তোমাকে খুন করতে চাই না বলেই অন্য উপায় খুঁজছি,’ বলল রানা।

‘আপনার কথা যে ঠিক, তার কোন প্রমাণ দিতে পারবেন? পারলে হাত থেকে ফেলে দিন পিস্তলটা।’

নিচু হয়ে পায়ের কাছে ওয়ালথারটা রাখল রানা।

‘এবার লাথি দিয়ে ওটা দূরে সরিয়ে দিন,’ বলল ফক্স।

রানা পা দিয়ে ঠেলে দিল ওয়ালথার। ঠনঠনাৎ শব্দে কার্নিশের কিনারায় পৌঁছে নিচের ঢালু জমিতে খসে পড়ল অস্ত্রটা।

মাথা দোলাল ফক্স। চাঁদের আলোয় ঝিক্ করে উঠল সোনার কয়েকটা দাঁত। ‘ভাল দেখালেন, মেজর!’ একলাফে রাইফেলের পাশে পৌঁছেই ওটা তুলল সে। ‘নিজেকে বাঁচানো জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবৃত্তি। বহু আগেই এটা জেনে গেছি।

‘তুমি আমাকে খুন করতে চাইলে, আমি আশা করব মৃত্যুটা আমার জন্যে খুব কষ্টকর করে তুলবে না।’

কাঁধে রাইফেলের কুঁদো ঠেকিয়ে স্কোপের ভেতর দিয়ে রানাকে দেখল ফক্স। ট্রিগারে চেপে বসছে তর্জনী। সম্ভাবনা নেই গুলি ফস্কে যাওয়ার। চাপা শ্বাস ফেলে মৃত্যুর জন্যে তৈরি হলো রানা। শীতল হয়ে গেছে হৃৎপিণ্ড। মনে মনে বলল, ‘তা হলে গুড বাই, মাসুদ রানা!’

কয়েক মুহূর্ত পর সিদ্ধান্ত পাল্টে ধীরে ধীরে কাঁধ থেকে রাইফেল নামাল ফক্স। মাথা নেড়ে বলল, ‘না, বস্, আপনার মতই আমারও বোধহয় নরম হয়ে গেছে হৃদয়।’

‘আজ রাতে যে চারজনকে খুন করলে, ওরা তোমার সঙ্গে একমত হবে না,’ বলল রানা, ‘নাকি ওরা পাঁচজন?’

পাঁচ,’ বলল ফক্স। ‘যেদিন আলদারিসিনে এলাম, বুড়ো এক কুকুরের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালতে চাইল তারা। তখন সামান্য মনোমালিন্য হয়েছিল। তখনই বুঝলাম, দলের আরও ক’জনকে নিয়ে হাজির হবে আমার ক্যাম্পে।’

মৃদু হাসল রানা। ‘আজও রোমশ বন্ধুদের জন্যে মৃত্যু- ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করো না, তাই না, ফক্স?’

‘আপনি হলেও তাই করতেন, বস্।’

‘হয়তো তা-ই।’

‘আপনাকে এখানে আশা করিনি। আমাকে খুঁজে নিলেন কীভাবে?’,

‘যত গোপনে ডুব দিতে চেয়েছ, সেটা পেরে ওঠোনি,’ বলল রানা। ‘সতর্ক মানুষও নানান ধরনের সূত্র রেখে যায়। জানতাম তোমাকে কোথায় খুঁজতে হবে। যেহেতু ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী একদল লোক পেছনে লেগে গেছে, এটা কিন্তু তোমার জন্যে বড় ধরনের সমস্যা। এখন থেকে আরও হুঁশিয়ার হতে হবে।’

চুপ হয়ে গেল রানা।

নীরবতা নেমেছে দু’জনের মাঝে।

কয়েক মুহূর্ত পর বলল ফক্স, ‘তো এবার কী, বস্?’

‘এবার কীভাবে সমস্যা থেকে বেরোনো যায়, সেটা ভেবে বের করতে হবে,’ বলল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *