1 of 2

কিলিং মিশন – ১৩

তেরো

ছুটে চলেছে অফরোড প্রিমিয়াম। দূরে একাধিক গুলির চাপা গর্জন। আলদারিসিন গ্রাম পিছিয়ে যেতেই হেডলাইট অফ করে দিল রানা। ক্রমে ওপরে গেছে পাহাড়ি পথ। আকাশে হাসছে মস্তবড় চাঁদ। সেই আলোয় সমস্যা হচ্ছে না ড্রাইভ করতে। একটু পর পথটা হয়ে গেল সরু আঁকাবাঁকা ট্র্যাক। চাকার আঘাতে লাফিয়ে উঠে ঠক-ঠক শব্দে ছুটন্ত গাড়ির বড়িতে লাগছে ছোট সব পাথর-খণ্ড। ইঞ্জিনের গোঁ-গোঁ ছাপিয়ে এল একের পর এক গুলির আওয়াজ। এখন আর মনে হচ্ছে না ওগুলো পটকা।

পাহাড়ি ট্র্যাকের ওপরদিকে দাঁড়িয়ে আছে একটা ভ্যান। ওটা দেখে অ্যাক্সেলারেটর থেকে পা সরাল রানা। ইঞ্জিনের সাহায্য না পেয়ে গতি কমে গেল গাড়ির। ভ্যানের কয়েক গজ পেছনে পৌঁছে ব্রেক কষে থামল রানা। সামনের গাড়ি সত্তর দশকের পুরনো মাযদা ভ্যান। তুবড়ে যাওয়া বড়ি। চটে গেছে রঙ। দুই দরজা ও পাশের স্লাইডিং ডোর খোলা, ভেতরে কেউ নেই। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে পিস্তল হাতে গাড়ি থেকে নামল রানা। চট করে চলে গেল ভ্যানের পাশে।

কিছুক্ষণ হলো থেমে গেছে গোলাগুলি।

ভ্যানের ইগনিশনে ঝুলছে ক্ষয়ে যাওয়া পুরনো চাবি। গাড়ির স্লাইডিং ডোর খুলে হুড়মুড় করে নেমে গেছে আরোহীরা। বনেট এখনও উত্তপ্ত। ঠাণ্ডা হতে গিয়ে ধাতব টিক-টিক শব্দ তুলছে প্রাচীন ইঞ্জিন।

গাড়িটার পাশে বসে পড়ল রানা। খাড়া ট্র্যাক ধরে ছুটে ওপরে গেছে ড্রাইভার। চাঁদের আলোয় শুকনো ধুলোয় কয়েকজনের জুতোর জাবড়ে যাওয়া দাগ। দলে তারা পাঁচ বা ছয়জন। হন্তদন্ত হয়ে ছুটবার সময় মাটি থেকে উপড়ে নিয়েছে ছোটবড় কিছু পাথর। পায়ের চাপে কোমর ভেঙে ঝুঁকে গেছে পানিশূন্য, হলদে দূর্বা ঘাস।

উঠে ট্র্যাক ধরে এগোল রানা। কী কারণে বন্ধ হলো গুলি, সেটা ভাবতে না ভাবতেই কয়েক শ’ গজ ওপরে পাথুরে এক জায়গায় শুরু হলো গুলিবর্ষণের আওয়াজ। পাহাড়ি ঢালে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে অন্তত তিনজন লোক। ওই আওয়াজ লক্ষ্য করে ওপরে উঠতে লাগল রানা। ক্রমেই আরও খাড়া হচ্ছে পাথুরে ট্র্যাক। বারবার পা পিছলে গেলেও এক মিনিটের ভেতরে কয়েক শ’ গজ উঠে এল রানা। একবার ঘুরে দেখল বহুদূরে জ্বলছে গ্রামের হলদে বাতি। নিচে বাচ্চাদের ম্যাচবক্স গাড়ির মত দেখাচ্ছে অফরোড প্রিমিয়াম ও ভ্যান। ঘুরে তাকাল রানা। উঁচু ঢালের বড় এক ঢিবি ঘিরে ঘন ঝোপঝাড়। বেল্টে পিস্তল গুঁজে দু’হাতে মাটি খামচে উঠতে লাগল রানা। সতর্ক চোখে দেখছে সামনের এলাকা।

চাঁদের ঘোলাটে আলোয় অদ্ভুত সব ছায়া ফেলেছে রুক্ষ বোল্ডার। কেউ আশপাশে আছে কি না জানতে ডানে-বামে তাকাল রানা। বামে পাথুরে জমিতে ঝিক্ করে উঠল মাযল ফ্ল্যাশ। পরক্ষণে গুলির আওয়াজ। কয়েক মুহূর্ত পর উপত্যকা থেকে ফিরে এল দুর্বল প্রতিধ্বনি। যেখানে আগুনের ঝিলিক দেখেছে রানা, বেল্ট থেকে পিস্তল নিয়ে ছায়ার ভেতর দিয়ে সেদিকে চলল। ষাট গজ দূরে পাথুরে জমিতে দেখতে পেল স্কোপওয়ালা হান্টিং রাইফেল হাতে একজনকে। থেমে গিয়ে অপেক্ষা করল রানা। এইমাত্র দ্বিধা নিয়ে পেছনে চেয়েছে লোকটা। আসলে কী ঘটছে, সেটা বুঝতে চাইছে রানা। লোকটার খুব কাছে নড়ে উঠেছে কিছু একটা। অবশ্য ওটা চোখের ভুলও হতে পারে রানার।

কেন যেন ভয় পেয়েছে লোকটা। চমকে গিয়ে ঘুরেই কাঁধে তুলল রাইফেল। অবশ্য সেটা মুহূর্তের জন্যে, পরক্ষণে অস্ত্রসহ অন্ধকারে হারিয়ে গেল সে। এইমাত্র ছিল, পরমুহূর্তে নেই। ছায়া যেন গিলে নিয়েছে তাকে।

থমথম করছে ওদিকটা।

সতর্ক চোখে চেয়ে রইল রানা।

মাযল ফ্ল্যাশ যেখানে দেখেছে, ওদিক থেকে স্প্যানিশ ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল কেউ: ‘অ্যাডোলফো? তুই কই?’

রাইফেলের মালিকের নাম জেনে গেল রানা। ভ্যানে চেপে এসেছিল লোকটা।

ভয়ে কাঁপছে তার বন্ধুর কণ্ঠ। এর কাছেও বোধহয় অস্ত্র আছে। সঙ্গীর গায়ে গুলি লাগবে ভেবে অপেক্ষা করছে।

আঁধারে কাকে যেন খুন করতে এসেছে এরা। এখন ভাবছে, দলে আরও ভারী হয়ে আসা উচিত ছিল। একটু আগে যাকে ভেবেছে খুব সহজ শিকার, সে হয়ে উঠেছে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক শিকারি।

আত্মবিশ্বাস শেষ হয়ে গেছে স্প্যানিয়ার্ডদের। ভয় পাচ্ছে। যখন-তখন উল্টো আক্রমণে খুন হবে।

কার বিরুদ্ধে এরা লড়ছে, বুঝে গেছে রানা। শেষবার যেখানে অ্যাডোলফোকে দেখেছে, সেদিকে চলল। এক ঝোপ থেকে আরেক ঝোপে ছুটে আধমিনিটে পৌছে গেল গন্তব্যে। শেষ দুই ঝোপ পেরোল পিস্তল হাতে খুব সাবধানে। চোখ রেখেছে, চারপাশের ছায়ায়। ওকে দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবে অ্যাডোলফোর সঙ্গীরা। আরও বড় বিপদ হচ্ছে, পাহাড়ে আছে এদের চেয়েও বিপজ্জনক এক শিকারি।

অ্যাডোলফো এখন কারও জন্যে বিপজ্জনক নয়। ছায়ার মাঝ দিয়ে চলে তার লাশ দেখল রানা। মাথাভরা কোঁকড়ানো চুল, মুখে গোঁফ। নিষ্পলক চোখে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। ঘাড়ের পাশে রক্তের ছোট্ট পুকুর। এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত ফাঁক করে দেয়া হয়েছে তার গলা। অ্যাডোলফোর রাইফেলটা কোথাও নেই।

সতর্ক কাউকে খতম করতে হলে চাই বিশেষ দক্ষতা। আর সে যোগ্যতা আছে প্রশিক্ষিত সৈনিক উইলবার ফক্সের।

হঠাৎ গুলির শব্দে বড় এক বোল্ডারের আড়ালে সরে গেল রানা। প্রথমে ভাবল ওর দিকে গুলি করছে অ্যাডোলফোর সঙ্গীরা। কিন্তু তা নয়। গুলি এসেছে ওপরে V আকৃতির উঁচু এক ফাটল থেকে। ওখানে মাযল ফ্ল্যাশ দেখেছে রানা। গুলি করা হচ্ছে অ্যাডোলফোর সঙ্গীদেরকে লক্ষ্য করে। ফাটলে যে-লোক বসে আছে, সে বেছে নিয়েছে নিখুঁত পযিশন। ভালভাবেই দেখছে চারপাশ।

দ্বিতীয়বারের মত গুলি করল সে।

আর্তচিৎকার ছেড়ে এক বোল্ডারের ওদিক থেকে বেরোল একজন। পড়ে গেল কয়েক পা সরে। চাঁদের আলোয় রানা দেখল, গড়িয়ে নিচের এক বোল্ডারের পাশে থামল দেহটা। উপুড় হয়ে পড়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। পরনে জিন্সের প্যান্ট ও ডেনিম জ্যাকেট। ঘাড়ে উল্কি। মাথার তালু ফুটো হয়েছে গুলির আঘাতে। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। আবছা আলোয় রানা দেখল, রক্তের কালচে স্রোত নামছে লাশের মুখ ও মাথা বেয়ে। ঘুরে পাথুরে ফাটলের দিকে তাকাল রানা। মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হলো, কয়েকটা বোল্ডার পার করে আরেক দিকে হারিয়ে গেল কেউ। দু’সেকেণ্ড পর রানা বুঝল, ভুল দেখেনি ওর চোখ। গুলির জবাবে ওপরে গেল বুলেটের সংক্ষিপ্ত তোড়। আওয়াজ গুনছে রানা। রাইফেলের ছয়টা গুলির পর শুনল করুণ আর্তনাদ। জোরালো গর্জন ছাড়ল আরও দুটো গুলি। কর্কশ আর্তচিৎকার ছেড়ে বোল্ডারের আড়াল থেকে বেরোল আরেকজন। মাটিতে রাইফেল ফেলে দু’হাতে চেপে ধরেছে বুক। তখনই আরেক গুলি ফুটো করল তার কপাল। ঢালু জমিতে গড়িয়ে বহু নিচে চলে গেল লাশ।

গুলি থেমে যেতেই নেমে এল পিনপতন নীরবতা। পাহাড়ি ঢালে পড়ে আছে দুটো লাশ। রানার ধারণা: নিচে আছে একাধিক মৃতদেহ। লড়াই বোধহয় শেষ। পাহাড়ি ঢালে পলকের জন্যে দেখল এক ছায়ামূর্তি। শেষ লোকটাকে খতম করে চলে গেছে কার্নিশের মত উঁচু এক জায়গায়।

রানা এখন নিশ্চিত, ওই যোদ্ধা আসলে কে।

আলদারিসিনের একদল বদমাসের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে উইলবার ফক্স। অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেলের দলের কেউ নয় অ্যাডোলফো বা তার সঙ্গীরা। এত অদক্ষ কাউকে কাজে নেবে না হারামি ব্রিটিশ লোকটা। তা ছাড়া, রানা বাদে কেউ জানে না কোথায় আছে ফক্স। এবার তার সঙ্গে দেখা হলে হয়তো নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পড়বে রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *