1 of 2

কিলিং মিশন – ২৭

সাতাশ

ফ্রান্সের উপকূল লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে মাসুদ রানার অফরোড প্রিমিয়াম গাড়িটা। ক্যালেই-এর টানেল টার্মিনালে কাস্টমসের তরফ থেকে কোন ঝামেলায় পড়ল না রানা ও ফক্স। একটু পর গাড়ি নিয়ে উঠল ট্রেনে। আধঘণ্টা পর পৌছে গেল ইংল্যাণ্ডে। আগের মতই ডেভ ক্রোকেটের পরিচয় ব্যবহার করেছে রানা। সতর্কতার জন্যে কর্তৃপক্ষকে জিম হকিন্সের বদলে এমিল হলের পাসপোর্ট দেখিয়েছে ফক্স।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওরা আশা করল, দু’ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে পশ্চিমে ব্রাইটন শহরের কাছে সেই গ্রামে। রানার ধারণা: কোন কারণে দেরি না হলে স্টিভ হ্যারিসের বাড়িতে পা রাখবে ওরা দুপুর হওয়ার আগেই।

‘আমাদের তরফ থেকে কোন ভুল হচ্ছে না তো?’ বলল ফক্স। ‘গিয়ে যদি দেখি খুন হয়ে গেছে লোকটা?’

‘সেক্ষেত্রে নতুন করে ভাবব এরপর কী করব,’ বলল রানা।

‘দ্বিতীয় প্ল্যান অনুযায়ী আটঘণ্টার ভেতরে স্কটল্যাণ্ডে পৌঁছে যেতাম। সেক্ষেত্রে কারও সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে হতো না। শুয়োরগুলোকে খতম করে মেয়েটাকে সরিয়ে – নিতাম। আপনি আরেকবার ভেবে দেখুন।

সারারাত ভেবেছে রানা। প্রথমে মনে হলো, স্কটল্যাণ্ডে জেসিকাকে উদ্ধার করতে যাওয়াই ভাল। কিন্তু এ-কথাও ঠিক, হয়তো গোলাগুলির সময় খুন হবে জেসিকা। সুতরাং ওর উচিত হবে না এতবড় ঝুঁকি নেয়া।

‘আসলে আমাদের হাতে দ্বিতীয় কোন প্ল্যান নেই। কয়জন লোক ওর ওপরে চোখ রেখেছে, আমরা জানি না। হয়তো দলে তারা দশ বা বারোজন। ওই গ্রামে আমাকে দেখলেই খুন করবে ওকে।’

‘আমরা এখন দলে দু’জন,’ বলল ফক্স। ‘আগে তো এর চেয়েও অনেক বিপজ্জনক অপারেশনে গেছি।’

‘দু’একবার কঙ্গোতে পিছাতেও হয়েছে, সেটা ভুলে গেলে?’

চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফক্স। ‘তখন কপাল মন্দ ছিল।

‘আমরা ঝুঁকি নেব না,’ বলল রানা। হিরো সাজতে গিয়ে হঠাৎ যিরো হতে চাই না। হ্যারিসের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেব, কারা চালায় অশুভ কাল্ট। হাতে বাড়তি কিছু সময়ও পাব। সেটা কাজে লাগাব।

যেটা ভাল বোঝেন,’ হাল ছেড়ে দিল ফক্স। ‘আমরা খুন না হয়ে গেলেই হলো।’

সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে পড়ছে কালো পিচঢালা পথ। এক মাইল এক মাইল করে এগিয়ে আসছে গন্তব্য। সেইসঙ্গে বাড়ছে রানার দুশ্চিন্তা। জানার উপায় নেই ধোঁকা খেয়েছে কি না লিয়োনেল। হয়তো জেসিকার কাছ থেকে খুনিদেরকে সরিয়ে নেয়নি সে। শেষমেশ কী হবে, আগে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই।

যত প্রবল হলো রানার চিন্তার খরস্রোত, বাড়ল গাড়ির বেগ। পর পর তিনবার স্পিড ট্র্যাপে পড়েও পাত্তা দিল না। সামনে পুলিশের রোডব্লক না থাকলে গতিহাসের ইচ্ছে ওর নেই।

‘আপনি খুব চুপচাপ হয়ে গেছেন,’ একঘণ্টা পর মুখ খুলল ফক্স।

‘বলতে পারো যে আমি ভয় পেয়েছি,’ বলল রানা।

‘জানি, আসলে ভয় পাননি।’ হাসল ফক্স। ‘আমাদের মত মানুষ কোণঠাসা হলে আরও হিংস্র হয়। বাঘকে খোঁচাতে গেলে বিপদ তো নিজেরই হবে!’

চুপ করে থাকল রানা।

ওদের উচিত হয়নি আমাদেরকে ত্যক্ত করা,’ বলল ফক্স। ওর দেখিয়ে দেয়া গ্রাম্য পথে দুপুর বারোটা দুই মিনিটে স্টিভ হ্যারিসের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল রানা। জমিদারী দালানের জানালার ওপরে ঝুঁকে আছে পুরু কার্নিশ। চারদিকে ছাত ফুঁড়ে উঠেছে চারটে চিমনি। দেয়াল বেয়ে ওপরে গেছে আইভি লতা। বাড়ির চারপাশে কয়েক একর জমিতে ফল- ফুলের বাগান। বাড়ি ও জমি ঘিরে উঁচু প্রাচীর। আশপাশে প্রতিবেশীর বাড়িঘর নেই। নাইন-নাইন-নাইন নম্বরে কল দেবে না কেউ। খুন করতে হলে একজন আততায়ীর জন্যে এই পরিবেশ সত্যিই আদর্শ।

গাড়ির গতি না কমিয়ে মেইন গেটের ওদিকে তাকাল রানা।

‘দেখে মনে হচ্ছে কোথাও কোন সমস্যা নেই,’ বলল ফক্স। ‘সত্যিই হয়তো আপনার কপাল ভাল।’

‘আগে কখনও ঘুরে দেখেছ তার বাড়ি আর বাগান?’

‘বাড়িতে না ঢুকলেও ওরা লেআউট দিয়েছিল। বাড়ির প্রতি ইঞ্চির কোথায় কী আছে, মুখস্থ করে ফেলেছি।’

জার্মান শেফার্ডের মত ভয়ঙ্কর না হলেও গ্রাম্য ল্যাবরাডর বা রিট্রিভার হঠাৎ করেই বাঁচার বিশেষ আগ্রহ তৈরি করে যে- কারও মনে। তাই জানতে চাইল রানা, ‘ওখানে কোন কুকুর আছে?’

‘না, নেই,’ বলল ফক্স, ‘কুকুরে অ্যালার্জি আছে হ্যারিসের। তাই খুশি ছিলাম, ওদেরকে ব্যথা দিতে হবে না।’

আরও কয়েক শ’ ফুট গিয়ে পথের বাঁকে পৌঁছে গেল রানা। মোড় নিয়ে ঘাসজমিতে নেমে গাড়ি রাখল। বনেট খুলে ইঞ্জিনের গোপন কম্পার্টমেন্ট থেকে বের করে নিল নাইন এমএম পিএক্স৪ স্টর্ম কমপ্যাক্ট ক্যারি ও ওর প্রিয় .৩৮ ওয়ালথার পিপি। হ্যারিস বেঁচে থাকলে এপারেই যেন রয়ে যায়, সেদিকে বিশেষ মন দেবে রানা। পিস্তল হাতে মুখোমুখি হলে লোকটা বুঝবে না, তাকে খুন করতে আসেনি ও। সুতরাং আশা করা যায়, ভয় দেখিয়ে তার পেট থেকে সবই বের করতে পারবে। অস্ত্র হিসেবে ফক্সের থাকবে অ্যাডোলফোর স্টিলেটো। টিভি ও সিনেমার বদৌলতে মামুলি জিনিস হয়ে গেছে পিস্তল। গুলিতে মরার আগেও মানুষের মনে ভয়টা সেভাবে কাজ করে না। কিন্তু ইস্পাতের চকচকে ক্ষুরধার ফলা অন্যকিছু। পড়পড় করে পেট বা বুকে ঢুকবে ভাবতে গেলে বুক কাঁপে সবার।

গাড়ি লক করে হেঁটে বাড়ির কাছে গেল রানা ও ফক্স। বইছে মৃদুমন্দ হাওয়া। বসন্তের নির্মেঘ আকাশ ঝকঝকে নীল। গাছে চিকচিক শব্দে ডাকছে অচেনা কিছু পাখি। ফক্স দেখাল কোথায় দেয়াল টপকে বাগানে ঢুকেছিল। বড় এক ওক গাছের ডাল ঝুঁকে এসেছে দেয়ালের ওপরে। বাড়ি থেকে এদিকটা দেখা যায় না। এক মিনিট পেরোবার আগেই দেয়াল ডিঙিয়ে বাগানে নেমে পড়ল রানা ও ফক্স। ভূতের মত নিঃশব্দে চলল বাড়ি লক্ষ্য করে। উরুর পাশে ওয়ালথার ধরে রেখেছে রানা। চকিতে দেখে নিচ্ছে ডানে-বামে। বাড়ির ভেতরে কারও কোন নড়াচড়া নেই। নানান ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করছে কিছু ভ্রমর। কিচিরমিচির করছে গাছের ডালে দুটো পাখি। এ-ছাড়া থমথম করছে চারপাশ। আইভি লতা দিয়ে ঢাকা বাড়ির কোনা পার হয়ে বড় এক গ্যারাজ দেখল রানা। ওক কাঠের দুই কবাট খোলা। গ্যারাজে ঝকঝকে নতুন প্রিমিয়ো গাড়ি। গ্যারাজের একদিকের দেয়াল ঘেঁষে রাখা আছে বাগানের যন্ত্রপাতি। কিছুক্ষণ পর রানার মনে হলো, এই বাড়িতে গায়ের জোরে ঢুকতে যায়নি কেউ। দোতলার জানালা আধখোলা। কাছের জানালা গলে আসছে ক্লাসিকাল মিউযিক।

রানা বুঝে গেল, কেউ না কেউ আছে বাড়িতে।

ওর কনুই স্পর্শ করল ফক্স। ‘হ্যাঁ, ওটাই তার স্টাডিরুম।’

রানা ভাবছে কীভাবে ঢুকবে, এমনসময় ওর কনুই ধরে বাড়ির কোনা ঘুরল ফক্স। আঙুল তুলে দেখাল টকটকে লাল গোলাপে ভরা কাঁটাঝোপ। পাশেই বাড়ির সরু খিড়কি দরজা। বিসিআই-এর স্পেশাল ইফেক্ট ডিপার্টমেন্টের প্রধান সরফরাজ আলীর সবক অনুযায়ী সিকিউরিটি তালা খুলতে রানার লাগল সাঁইত্রিশ সেকেণ্ড। পরের ছয় সেকেণ্ডে ওরা ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে। দোতলায় কোকিলের মিষ্টি সুরে বেজে উঠল আধুনিক একটি ঘড়ি।

হাতঘড়ি দেখল রানা। এখন বাজে সোয়া বারোটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *