1 of 2

কিলিং মিশন – ১৭

সতেরো

‘আপনি বলছেন, অ্যালান শ’র নাম আসলে অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল?’ বলল ফক্স।

‘তার নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছ,’ বলল রানা। ‘প্লেনে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। এখন পর্যন্ত তার দুটো নাম পেলেও জানি না আসলে সে কে। সময়মত সবই জেনে নেব। এবার খুলে বলো এরপর কী ঘটেছে।’

‘আবার রোলস  রয়েসে উঠল ড্রাইভার। সিকিউরিটির লোকদের পেছনে ফেলে গাড়ি রাখল প্রাসাদের এক দরজার কাছে। দুই আরোহী নেমে যাওয়ার পর অন্যান্য গাড়ির মত বাড়ির আরেক দিকে পার্কিং লটে নিয়ে রাখল রোল্স রয়েস। আমার ধারণা, ওখানে ছিল অন্তত বিশটা গাড়ি। ওখানে না থেমে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাড়ির আরেক দিকে গেলাম। বড় এক ঘরে জড় হয়েছে অতিথিরা। জঙ্গল থেকে তাদের ওপরে চোখ রাখলাম।’

‘কী করছিল তারা?’

‘তেমন কিছুই না। অন্তত প্ৰথমে নয়। সবমিলিয়ে পঞ্চাশ বা ষাটজন। মহিলা নেই। বড়লোকদের কিছু পার্টিতে আগেও এমন দেখেছি। সিগার ফুঁকবে, মদ গিলবে, গল্প করবে নিজেদের ভেতর, তারপর উলঙ্গ নর্তকীরা নেচে বিনোদন দেবে তাদেরকে। কেউ চাইলে তার সঙ্গে বিছানায় যাবে। তখন শার্লন হলের পার্টি নিয়ে এসবই ভাবছিলাম।’

ফক্স আরও কিছু বলতে চাইলেও বাধা দিল রানা। ‘তার মানে, সে-রাতে যাকে খুন করতে গেলে, সে ছিল সেই একই পার্টিতে?’

মাথা দোলাল ফক্স। ‘হ্যাঁ, সে তাদেরই একজন। তার বাড়িতে প্রাক্তন স্ত্রী আর বাচ্চারা হাজির হওয়ায় ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল। হয়তো ভাবছিল মাটি হয়ে যাচ্ছে রাতের আনন্দ।

‘সে তাদেরই একজন, অথচ তাকেই খুন করতে চেয়েছে?’

‘তা না হয়েই যায় না। নইলে আমাকে খুন করতে পাঠাত না।’

‘ঠিক আছে। তারপর কী হলো?’

‘তাকে খুন করতে পারব, সে-আশা ক্ষীণ হয়ে গেল। তবুও অপেক্ষায় থাকলাম। লোকটা হয়তো কোন কারণে বাড়ি থেকে বেরোবে, আর তখন নিঃশব্দে তাকে খুন করব। এরপর সময় লাগবে না উধাও হতে। কেউ জানবে না ওখানে গেছি।’

এবার সংক্ষেপে বলো এরপর কী ঘটেছে।’

‘দরকার হলে সারারাত ওখানে থাকতাম,’ বলল ফক্স। ‘কিন্তু এরপর মাঝরাতের আগেই কোথায় যেন গেল অতিথিরা। একসঙ্গে নিভে গেল বাড়ির সব বাতি। একটু পর পেছনের দরজা দিয়ে একসারিতে বেরোল অতিথিরা। সবার পরনে আলখেল্লা, মুখে মুখোশ। মনে হচ্ছিল দেখছি দুঃস্বপ্ন। বাড়ির পেছনের লেকে জঙ্গুলে এক দ্বীপ। লেকের তীরে থেমে ওটার দিকে ফিরল লোকগুলো। শুরু হলো সমবেত প্রার্থনা তার পরের সবই তো আপনি নিজের চোখে দেখেছেন।’

‘এ-ছাড়া আরও কিছু চোখে পড়েছে?’

মাথা নাড়ল ফক্স। ‘মেয়েটা খুন হলে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলে গেলাম দেয়ালের কাছে। তবে কপাল মন্দ, জঙ্গলে ছিল সিকিউরিটি ক্যামেরা। গাধার কাজ করেছি চারপাশে চোখ না রেখে। হয়ে গেলাম তাদের টার্গেট। বুঝে গেলাম, ভিডিয়ো করেছি বলে ব্ল্যাকমেইল করতে পারি, তাই আমাকে আর বাঁচতে দেবে না তারা।’

লণ্ডনে ফক্সের লণ্ডভণ্ড অ্যাপার্টমেন্টের কথা মনে পড়ল রানার। ওখানে তন্নতন্ন করে কী খোঁজা হয়েছে, সেটা এখন বুঝে গেছে ও। নিচু গলায় বলল, ‘ওয়াকিং স্টিক হাতে বয়স্ক লোকটাও কি লেকের তীরে মেয়েটাকে খুন হতে দেখেছে?’

‘ওখানেই ছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সবার আগে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তীরে গেছে হারামজাদা।’

‘অন্যজন, অর্থাৎ অ্যালান শ ওরফে অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল সেখানেই উপস্থিত ছিল?’

‘সবার পরনে আলখেল্লা, মুখে মুখোশ- তাই জানি না লেকের ধারে সে ছিল কি না। লাল আলখেল্লা পরা যে-লোক মেয়েটাকে খুন করেছে, সে আর অ্যালান শ’ একই লোক হলেও অবাক হব না। এটা জানি, আগে ওই বাড়িতেই ছিল সে। যা করার সবাই মিলেই করেছে। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর একদল ইবলিশ!’

মনের আয়নায় জেসিকার নিষ্পাপ মুখ দেখল রানা। লিয়োনেলের কথামত না চললে কিডন্যাপ করে শার্লন হলে নিয়ে যাবে জেসিকাকে। বলি দেবে মূর্তিটার কাছে।

‘যেভাবেই হোক এদেরকে ঠেকাতে হবে,’ বলল গম্ভীর রানা।

জবাবে প্রবলভাবে মাথা নাড়ল যুবক। ‘তা আসলে সম্ভব নয়। একেবারেই নয়। আমার কথা ভুলে যান। আমি এসবে নেই। আর কখনও ফিরব না ব্রিটেনে। বিশেষ করে ওই বাড়িতে। মরে গেলেও না।’

‘অর্থাৎ, ভাবছ এ-এলাকায় তোমার কোন বিপদ হবে না?’ বলল রানা। ‘তুমি কিন্তু আছ বোকার স্বর্গে। আমি খুন না করলেও অন্য কেউ আসবে। সে ব্যর্থ হলে আরেকজন। দুনিয়ার কোথাও লুকিয়ে রেহাই পাবে না।’

শুকনো মুখে বলল ফক্স, ‘এসব বলছেন তাই অশেষ ধন্যবাদ, বস্। এত মিষ্টি কথা আগে কখনও শুনিনি!’

‘এবার ভাল দিকটা ভেবে দেখো,’ বলল রানা। ‘তুমি কিন্তু একা নও। আমিও তোমার পাশে লড়ব। প্রথম সুযোগে উপড়ে দেব এদের শেকড়। আর সেটা যদি না পারি, মস্তবড় ক্ষতি হবে আমাদের। এদিকে আমরা সফল হতে পারলে হয়তো পাব স্বাভাবিক এক জীবন।’

রানার কথার ওজন মেপে দেখছে ফক্স। একটু পর বলল, ‘তো, বসু, আপনি বলতে চাইছেন, আমরা দু’জন মিলে দল হিসেবে কাজ করব? ঠিক সেই আগের মত?’

‘আগের মত নয়,’ বলল রানা। ‘আমরা তখন মেনে চলেছি প্রতিটি সামরিক আইন। এবার আর সেটা করতে হবে না। আমরা লড়ব প্রিয় মানুষগুলোর জন্যে। নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে। লড়াইটা হবে নিজেদের অস্তিত্বের জন্যে।

অস্বস্তি নিয়ে হাসল ফক্স। চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল সোনার দাঁত। ‘একদলে আমরা দু’জন, আর বিপক্ষে একদল ইবলিশ! আপনি কি সেটাই বলতে চাইছেন, বস্?’

‘হ্যাঁ। প্রয়োজনে দলে নেব আরও ক’জনকে।’

‘এতদিনে হয়তো হারিয়ে বসেছি আমার যুদ্ধের দক্ষতা, বলল ফক্স। ‘আপনি ভারছেন এদেরকে একে একে শেষ করবেন। কিন্তু সেটা কি আসলে সম্ভব? সংখ্যায় তোঁ তারা ‘অনেক!’

‘তারা দলে ভারী হলেও জানবে না, কোথা থেকে হামলা হয়েছে তাদের ওপর।

এটা বোধহয় ঠিকই বলেছেন,’ বলল ফক্স। ‘তারা টের পাওয়ার আগেই আক্রমণে যেতে পারব আমরা।’

নরম সুরে বলল রানা, তুমি কী বলো, ফক্স? আছ আমার পাশে?’

পাহাড় থেকে দূরের আলদারিসিন গ্রামের বাতি দেখল ফক্স। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘আছি, বস্। বুঝতে পেরেছি, ওদের অস্তিত্ব থাকলে আমরা কোথাও নিরাপদ নই। তাই শেষবারের জন্যে হলেও লড়ব।’

পাথুরে ঢালে স্প্যানিয়ার্ডের লাশ দেখাল রানা। ‘ওরা মরার আগে বুঝেছে, তুমি যুদ্ধের ময়দান থেকে কোথাও পালিয়ে যাও না।’

‘বলতে পারেন বদ-অভ্যেস,’ মৃদু হাসল ফক্স।

ধীরে ধীরে ওর প্ল্যান খুলে বলল রানা।

চকচক করছে ফক্সের দু’চোখ। ‘অর্থাৎ, লড়াইটা আমরা পৌঁছে দেব তাদের কাছে। কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সম্ভব। কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই পৌঁছে যাব ব্রিটেনে।’

‘স্পেনে তুমি জিম হকিন্স,’ বলল রানা। ‘ছদ্মনামটা বোধহয় তৈরি করে দিয়েছে সেই এজেন্সি?’

‘ঠিকই ধরেছেন, বস্। আপনার নামটা যেন কী?

‘আমি ডেভ ক্রোকেট।’

‘তো আমার পরিচিত মাসুদ রানা এখন কোথায় গেছেন?’

‘সে তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে,’ বলল রানা। ‘কিন্তু সেই কাজে কোথায় যে গেছে, তা বলা মহা মুশকিল!’

‘জ্ঞানীরা সবসময় একইভাবে চিন্তা করে, বস্। আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মিস্টার ক্রোকেট।’

‘এবার নামতে হবে কাজে,’ বলল রানা, ‘প্রতিটি মুহূর্ত এখন জরুরি।’

মাথা দোলাল ফক্স। ‘আপনি শুধু বলুন কী করতে হবে।’

‘আগে নিশ্চিত হতে হবে তুমি আর বেঁচে নেই,’ নির্বিকার চেহারায় জানাল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *