1 of 2

কিলিং মিশন – ৪১

একচল্লিশ

বার্মিংহ্যামের ধূসর মেঘরা আকাশ থেকে ঝরছে ইলশে গুঁড়ি। বিমান থেকে নোে নকল পরিচয়ে এয়ারপোর্টের এক কার হায়ার আউটলেট থেকে সুবারু ভ্যান ভাড়া নিল রানা। এমনই গাড়ি বেছে নিয়েছে, যেটার দিকে দ্বিতীয়বার দেখবে না কেউ।

গাড়ি চালাল ফক্স। পাশে বসে স্যাটেলাইট ন্যাভিগেটরে চোখ রাখল রানা। এয়ারপোর্ট থেকে ছাব্বিশ মাইল দূরে হ্যানবারির গির্জা। মোটরওয়ে গেল দক্ষিণে, তারপর বাঁক নিল পশ্চিমে। পথের ধারে এক সার্ভিস স্টেশনে ফিউয়েল নেয়ার পর দোকান থেকে রানা কিনল দুই রোল গ্যাফার টেপ ও টুকটাক আরও কিছু জিনিস। একটু পর মোটরওয়ে ত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত সরু পথে দক্ষিণে চলল ওরা। দুপুরের পর ওদের ভ্যান পৌঁছে গেল গ্রামের সেই গির্জার কাছে। ততক্ষণে থেমে গেছে পশলা পশলা বৃষ্টি। মেঘের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ঝিকমিকে নীল আকাশ। ফক্স পার্কিং লটে গাড়ি নিয়ে ঢুকতেই হাতঘড়ি দেখল রানা। এখন বাজে বিকেল তিনটা পাঁচ। পঁচিশ মিনিট পর শুরু হবে নেলি গানের ফিউনেরাল।

গ্রাম থেকে মাইলখানেক দূরে পথের ধারে খোলা জমিতে সেইণ্ট মেরি দ্য ভার্জিন গির্জা। পথের দু’পাশে গাছগুলো তৈরি করেছে পাতার চাদরের ছাউনি। রটআয়ার্নের বেড়ার ওদিকে গির্জার সামনে ছোট কার পার্কিং, অন্যটা পাশে। শোকানুষ্ঠানে এখনও হাজির হয়নি কেউ। পাশের পার্কিঙে গ্রাউণ্ড মেইনটেন্যান্স কোম্পানির সাদা এক গাড়ি।

‘ওই গাড়ির শালারা গেল কোথায়?’ বিড়বিড় করল ফক্স।

‘ওদিকে,’ তর্জনী তাক করল রানা। সাদা গাড়ির পেছনের জমিতে একটা বেঞ্চিতে বিরক্ত চেহারায় বসে আছে দুই লোক। তাদের গাড়ির পাশে সুবারু রাখল ফক্স। ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পর জানালার কাঁচ নিচু করল রানা। ওদেরকে চিনবে না এদিকের কেউ, কাজেই বিপদ হওয়ার কথা নয়। দোকান থেকে কেনা প্যাকেট করা স্যাণ্ডউইচ রানার দিকে বাড়িয়ে দিল ফক্স। ‘আসুন, দুপুরের খাবার খেয়ে নিই, বস্।’

‘খিদে নেই,’ বলল রানা।

‘খাওয়া-ঘুমে অনিয়ম করতে নেই, গুরুজনের আদেশ।’

চুপ করে থাকল রানা।

কাঁধ ঝাঁকাল ফক্স। ‘তো দেখুন কীভাবে খেতে হয়।’ কিছুক্ষণ পর দুটো স্যাণ্ডউইচ সাবড়ে দিয়ে বলল সে, ‘বস্, মনে আছে, কীভাবে আমাদের ভ্যান হাইজ্যাক করতে এসেছিল ম্যানচেস্টারের সেই ছোকরারা?’

‘রাত তখন অনেক,’ বলল রানা। ‘ভ্যানের পেছনের দরজা খুলে ওরা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সবার হাতে তখন অটোমেটিক অস্ত্র।’

‘সাবমেশিন গান, বস্,’ হাসল ফক্স। ‘পরে চড়িয়ে ওদের গাল ফাটিয়ে দিলেন, ওই দৃশ্যটা বাকি জীবন মনে থাকবে।’

‘এখনও সেসব সময় নিয়ে ভাবো, তাই না?’ জানতে চাইল রানা।

‘কখনও কখনও,’ বলল ফক্স।

‘আবারও যোগ দাও। ওরা আজও তোমার কথা বলে।’

‘তাই বলে মিলিটারি জীবন এত চাইতাম না যে আবারও গিয়ে যোগ দেব ওদের সঙ্গে।’

তিনটে পঁচিশ মিনিটে গির্জার কার পার্কে এল প্রথম গাড়ি। ওটা ফিউনেরাল ডিরেক্টরের কালো মিনি-ভ্যান। পরের তিন মিনিটে পৌছে গেল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেয়া শোকযাত্রার অন্যরা। সামনের গাড়িতে ফুলে ঢাকা কফিন। তারপর কালো জানালার এক রোলস রয়েস। পেছনে ক’টা দামি গাড়ি। গির্জার বাইরে থামল ওগুলো। নেমে পড়ল সবাই। গম্ভীর চেহারায় চারটে দণ্ড কাঁধে নিয়ে গাড়ি থেকে কফিন নামিয়ে গির্জায় নিল লাশ বহনকারীরা। রোল্স রয়েস থেকে নেমেছে ক্রিস্টোফার গান। তার বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে গাড়ি থেকে বেরোল তার স্ত্রী ডায়ানা গান। বয়স পঁয়তাল্লিশ হলেও সত্যি রূপসী। শোকের কারণে পনেরো বছর বেড়ে গেছে তার বয়স। তারা দু’জন আঙিনায় ঢুকতেই গির্জা থেকে বেরিয়ে শোক প্রকাশ করলেন এক যাজক। একবার ইতস্তত করে হাত মেলালেন ক্রিস্টোফার গানের সঙ্গে। স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরে যাজকের পিছু নিয়ে গির্জায় ঢুকল এমপি। কালো পোশাকের শক্তপোক্ত শরীরের দুই বডিগার্ড পাহারা দিচ্ছে তাদেরকে। কালো এক মার্সিডি এসইউভি থেকে নেমেছে দেহরক্ষীদের আরও চারজন। গির্জা পাহারা দিতে চারদিকে গেল তারা।

তিক্ত সুরে বলল ফক্স, ‘কুত্তার বাচ্চা সত্যিই দুর্দান্ত অভিনয় করে! ওকে অস্কার পুরস্কার দেয়া উচিত!’

পরের দু’মিনিটে ভরে গেল কার পার্কিং। এমন কেউ নেই যে সুবারু ভ্যানের দিকে চেয়ে দেখবে। গির্জায় ঢুকল শোকসন্তপ্ত মানুষগুলো। এদিকে জোঁকের মত হাজির হয়েছে ছোঁক-ছোঁক করা দৈনিক পত্রিকা ও টিভির সাংবাদিকেরা। মাঝপথে তাদেরকে ঠেকিয়ে দিল সশস্ত্র সিকিউরিটি গার্ডেরা। সাংবাদিকদের নাকের কাছে বন্ধ হয়ে গেল গির্জার চওড়া দরজা।

আধঘণ্টা পর আবারও খুলে গেল কবাট। কফিন কাঁধে চারজন লোক ধীর পায়ে গেল কবরস্তানে। স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে তাদের পিছু নিল ক্রিস্টোফার গান। মুখ ফ্যাকাসে, চেপে রেখেছে ঠোঁটে ঠোঁট। বারবার রুমালে চোখ মুছে নিচ্ছে তার স্ত্রী। তাদেরকে ঘিরে কবরস্তানে প্রবেশ করল কয়েকজন সশস্ত্র গার্ড।

দূর থেকে চেয়ে রইল রানা ও ফক্স।

নেলি গানের কফিন কবরে নামিয়ে দিতেই করুণ আর্তচিৎকার বেরোল ডায়ানা গানের গলা চিরে। প্রলম্বিত সেই হাহাকার মিশে গেল ঝিরঝিরে হাওয়ায়। মহিলা জানে না, তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে তার হাত যে ধরে রেখেছে, সেই একই লোক আসলে নেলির সত্যিকারের খুনি। কবরের পাশে যারা দাঁড়িয়ে আছে, নিচু করে নিয়েছে মাথা। ব্যক্তিগতভাবে নেলিকে চিনত তারা। যতই নোংরা চরিত্রের মেয়ে হোক নেলি, চিরকালের জন্যে চলে গেছে, সেটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তাদের।

সবার উদ্দেশে বাইবেলের শ্লোক পড়লেন যাজক। তারপর মাটি ফেলে ভরাট করা হলো কবর। অন্যদের জন্যে নেলি স্রেফ অতীত স্মৃতি হয়ে গেলেও আজ থেকে শুরু হয়েছে ওর মা-র জন্যে হুতাশ ভরা বেদনাদায়ক জীবন। ধীরে ধীরে হালকা হলো ভিড়। যে-যার গাড়ি নিয়ে ফিরল বাড়ির পথে। একটু পর নেলির কবরের কাছে রইল শুধু ক্রিস্টোফার গান, তার স্ত্রী ও বডিগার্ডেরা। মিনিট পাঁচেক পর স্বামীর সঙ্গে গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই বেহুঁশের মত টলে পড়ে গেল ডায়ানা গান। দু’দিক থেকে তাকে ধরে ফেলল তার স্বামী আর এক বডিগার্ড। তারা সাবধানে নিয়ে তুলে দিল মহিলাকে গাড়িতে। চিরকালের জন্যে বুক ভেঙে গেছে ডায়ানা গানের। ভয়ঙ্করভাবে ছুরির আঘাতে হৃদয় ক্ষত- বিক্ষত হলেও হয়তো এতটা কষ্ট পেত না সে।

রানা বুঝে গেল, নরকের আগুনে গিয়ে পড়ার চেয়েও বেশি যন্ত্রণা সহ্য করছে মহিলা।

রোলস  রয়েসের সামনের সিটে উঠল দুই বডিগার্ড। অন্যরা গিয়ে চাপল মার্সিডিয এসইউভিতে। স্ত্রীর গালে চুমু দিয়ে দরজা বন্ধ করল ক্রিস্টোফার গান। গাড়ি ঘুরে ওদিকের দরজা খুলল। সিটে ওঠার আগে একবার দেখল মেয়ের কবর। কয়েক মুহূর্ত পর গাড়িতে উঠে দরজা আটকে নিল।

ফক্সের দিকে তাকাল রানা। দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে যুবকের চোয়াল। রানা বুঝে গেল, এখন একই কথা ভাবছে ওরা দু’জন। রোল্স রয়েসের পিছু নিল মার্সিডিয এসইউভি।

‘চলুন, যাওয়া যাক,’ ভ্যানের ইঞ্জিন চালু করল ফক্স।

গির্জা পিছনে ফেলে গাছের ছাউনির তলা দিয়ে গ্রাম্য, পথে ফিরে চলেছে রোলস রয়েস। পেছনে বডিগার্ডদের এসইউভি। দুই গাড়ির কেউ দেখল না, দূর থেকে অনুসরণ করছে এক সুবারু ভ্যান।

বেশিক্ষণ লাগল না ক্রিস্টোফার গানের বাড়ির সোনাপানি করা গেটের কাছে পৌঁছুতে। বিশাল জমি নিয়ে তার বাড়ি ও বাগান। চারপাশে আইভি লতায় ভরা পাথুরে উঁচু দেয়াল। গাড়ি থেকে রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে খুলে নেয়া হলো মেইন গেট। ড্রাইভওয়েতে ঢুকল রোলস  রয়েস ও এসইউভি। রেইলের ওপরে আবারও পিছলে আটকে গেল গেট।

সুবারু চালিয়ে স্বাভাবিক গতিতে মেইন গেট পেরোল ফক্স। ড্রাইভওয়ে ধরে বাড়ি লক্ষ্য করে চলেছে গাড়িদুটো। এডওয়ার্ডিয়ান বাড়িটার ছবি অনলাইনে দেখেছে রানা। ছাতে গাঢ় ছায়া দিচ্ছে প্রকাণ্ড উইলো গাছ। বাগানে সুন্দর করে ছাঁটা ঝোপঝাড় ও হরেক ফুলে ভরা ফ্লাওয়ার বেড।

‘এতই রাজকীয়, ভুলবে না কেউ।’ বাড়িটা পেছনে ফেলে মন্তব্য করল ফক্স। ‘তবে ক্রিস্টোফার গান খুব বেপরোয়া লোক।’

‘হয়তো, তবে সে জানে না, আজ দেখা হবে আমাদের সঙ্গে বলল রানা।

কিছুটা যেতেই সামনে পড়ল নির্জন জঙ্গুলে পথ। ডানে পিকনিক স্পট। সেখানে আছে কিছু টেবিল ও চেয়ার। পাশেই দোলনা, সি-স ছাড়াও ক’টা খেলনাসহ শিশুপার্ক। অসমতল জমিতে ঝাঁকি খেয়ে এগিয়ে চলেছে ভ্যান। একটু পর সামনে বড় এক গাছের ছায়ায় গিয়ে গাড়ি রাখল ফক্স।

হাতঘড়ি দেখল রানা। দু’ঘণ্টা পর সূর্যাস্ত। রানা মনস্থির করল, ওরা কাজে নামবে গভীর রাতে। যেহেতু আপাতত কোন কাজ নেই, তাই উচিত বিশ্রাম নেয়া। সিট পেছনে হেলিয়ে শুয়ে পড়ল রানা। পা-দুটো মেলে দিল সামনে।

‘বাড়ির ওপরে চোখ রাখলে ভাল হতো না,’ বলল ফক্স। ‘আবারও যদি কোথাও চলে যায় শালা?’

চোখ বুজে বলল রানা, ‘আজ তার জন্যে বিশেষ এক দিন। বোঝা নেমে গেছে মাথা থেকে। দুর্দান্ত অভিনয় করে বোকা বানিয়ে দিয়েছে সবাইকে। তারা দেখেছে দায়িত্বশীল এক স্বামীকে। আমার ধারণা: একগাদা ঘুমের ওষুধ গিলে স্ত্রী শুয়ে পড়লে ফুর্তি করতে গভীর রাত পর্যন্ত ড্রিঙ্ক করবে সে। জানে না, এ-সুযোগে তাকে হাতের মুঠোয় নেব আমরা।’

‘তারপর আমরা কী করব, বস্?’ জানতে চাইল ফক্স।

‘আসলে তখন থেকেই শুরু শেষের খেলা,’ বলল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *