1 of 2

কিলিং মিশন – ১০

দশ

সারারাত কিচেনে বসে আছে জনি ওয়াকার ও রামিন রেজা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করেছে ওরা। স্বাভাবিকভাবেই ওদের মনে প্রশ্ন জেগেছে: ফিরে এসেও হঠাৎ করে আবারও ইংল্যাণ্ডে গেল কেন রানা? নিশ্চয়ই বড় কোন বিপদে পড়েছে। ভোরে সাত নম্বর কফির মগ খালি করে বলল ওয়াকার, ‘জানি না তুমি কী ভাবছ, তবে আমার মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কোন গোলমালে জড়িয়ে গেছে রানা।’

‘তা বোধহয় নয়,’ দুশ্চিন্তা এড়াতে চাইল রামিন। ‘নিশ্চয়ই এসবে জেসিকা জড়িত, নইলে তার ফোন রিসিভ করতে মানা করতেন না মাসুদ ভাই। বোধহয় ঝগড়া হয়েছে দু’জনের। তাঁদের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক না গলানোই ভাল। পরে সবই জানব আমরা। এখন ধৈর্য ধরতে হবে।

মাছি তাড়াবার মত করে হাত নাড়ল ওয়াকার। ‘রানার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। গোপন করছে কিছু। স্বাভাবিক আচরণ করছে না।’

‘মাসুদ ভাই ব্যক্তিগত বিষয়ে পারতপক্ষে আলাপ করেন না,’ বলল রামিন। ‘এটা তো আমরা জানি।’

ওর চোখে তাকাল ওয়াকার। ‘মনে হচ্ছে বড় ধরনের কোন ঝামেলা হয়েছে।’

‘আমি আশাবাদী মানুষ। তবে আপনার কথাও ঠিক হতে পারে।’

‘তোমার মনে হয়নি যে নিজের ভেতরে নেই রানা?’

‘তা মনে হয়েছে।

‘খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে,’ বলল ওয়াকার। ‘বলতে পারো ভয়ই পেয়েছে। কিন্তু সহজে বিচলিত হওয়ার মানুষ নয় ও। সবকিছু আড়াল করেছে। অথচ, আগে কখনও কিছুই গোপন করেনি আমাদের কাছ থেকে।’

‘বোধহয় ব্যক্তিগত সমস্যা?’

‘আমরা রানাকে বহুদিন ধরে চিনি। আগে কখনও ওকে এভাবে ঘাবড়ে যেতে দেখেছ?

কয়েক মুহূর্ত ভেবে বলল রামিন, ‘এসবে জেসিকার কোন সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে। মাসুদ ভাই বলেছেন যাচ্ছেন লণ্ডনে। জেসিকা তো আছে অন্তত পাঁচ শ’ মাইল দূরে। এ- ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন, ওয়াকার?’

ভুরু কুঁচকাল দক্ষ ডিটেকটিভ। ‘হয়তো লণ্ডনে যাচ্ছে না. রানা। ভুল তথ্য দিয়েছে আমাদেরকে এড়াতে।’

‘মাসুদ ভাই মিথ্যা বলবেন না,’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল রামিন।

‘কিন্তু যদি বলে থাকে?’

‘সেক্ষেত্রে আমাদের হাতে আরও কমে গেছে সূত্র।’

কী যেন ভাবছে ওয়াকার। কফি শেষ করে মগটা ঠক করে টেবিলে রাখল। চেয়ার পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াল। তিক্ত স্বরে বলল, ‘হয়তো তোমার কথাই ঠিক, রামিন। তবে আসলে কী হয়েছে, সেটা জানতে হবে। আর সেজন্যে ঘুরে আসতে হবে রানার অ্যাপার্টমেণ্ট থেকে।’ কিচেন থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে চলল ওয়াকার। ‘এসো।’

সামান্য দ্বিধা করে ওর পিছু নিল রামিন। রানা এজেন্সির এই শাখায় দোতলায় চারটে ছোট অ্যাপার্টমেন্ট আছে। একটা ব্যবহার করে রানা। অন্যদুটো রামিন রেজা ও জনি ওয়াকার। শেষেরটা অতিথির জন্যে। ওয়াকারের পেছনে হেঁটে রানার অ্যাপার্টমেন্টের দরজার কাছে পৌঁছে গেল রামিন। দরজা আধখোলা। বাতি জ্বলছে ভেতরে। যাওয়ার সময় খুব তাড়া ছিল রানার, আলো নিভিয়ে যেতে পারেনি।

‘অনুমতি ছাড়া ঢোকা ঠিক হবে?’ বলল রামিন। ‘মাসুদ ভাই হয়তো বিরক্ত হবেন।’

‘তা হলে অপেক্ষা করো। আমি ভেতর থেকে ঘুরে আসি।’ ওয়াকার দরজার ওদিকে যেতেই পিছু নিল রামিন। সূত্র খুঁজতে অ্যাপার্টমেন্ট সার্চ করতে শুরু করেছে ওয়াকার। ডাইনিংরুম পেরিয়ে বেডরুমে ঢুকে ওর চোখে পড়ল চরম অস্বাভাবিকতা।

ভেঙে গেছে দেয়াল আয়না। বিছানায় দুটো পাসপোর্ট, সরু আইফোন ও খালি একটা খাম। দেয়াল সিন্দুকের ডালা খোলা। ওটার ভেতরে উঁকি দিল ওয়াকার। কয়েক সেকেণ্ড পর ঘুরে তাকাল বিছানার দিকে। চাদরে মেখে আছে শুকনো খয়েরি রক্ত। ‘আয়না ভেঙে হাত কেটেছে রানা।’

‘কিন্তু জেনে-বুঝে ঘুষি মারলেন কেন?’ বলল রামিন।

‘জানি না।’

‘দুশ্চিন্তায় ছিলেন, তাই রেগে গিয়ে ঘুষি মারেন,’ রায় দিল রামিন।

‘অথচ রানা মানুষ হিসেবে বদমেজাজি নয়,’ বলল ওয়াকার। আইফোনটা হাতে নিল। ‘এটা ফেলে গেছে।

ভুরু কুঁচকে ডিভাইসটা দেখল রামিন। কিন্তু সেটা করবেন কেন মাসুদ ভাই?’

‘সেটা জানি না, শার্লক হোম্‌স্‌!’ আইফোন চালু করে স্ক্রিন দেখল ওয়াকার। ‘ভয়েস মেসেজ এসেছে জেসিকার।’

‘মাসুদ, ভাইয়ের ব্যক্তিগত মেসেজ আপনি শুনবেন?’ আপত্তির সুরে বলল রামিন।

ওকে পাত্তা দিল না ওয়াকার। গতরাতে এগারোটার পর এসেছে জেসিকার মেসেজ। কিন্তু আগেই ব্যাগ গুছিয়ে এখান থেকে চলে গেছে রানা। স্পিকার চালু করে মেসেজ শুনল ওয়াকার। খুশি-খুশি কণ্ঠে বলছে জেসিকা: ‘সব ঠিক তো? তোমার টেক্সট্ মেসেজ পেয়েছি। মন চাইছে উড়ে আসি তোমার কাছে। বিশ্রাম নিয়ে পরে ফোন দিয়ো। অপেক্ষায় থাকলাম। ভাল থেকো। আমি তোমাকে ভালবাসি।’

আইফোন বিছানায় রাখল ওয়াকার। খালি খাম হাতে নিয়ে ঝাঁকিয়ে দেখল। ওটার ভেতরে কিছুই নেই। এক এক করে দেখল দুই পাসপোর্ট। বলল, ‘দুটোই রানার পাসপোর্ট। তবে নকলটার ডেট ফুরিয়ে গেছে।’

‘সিন্দুকে আরও দুটো পাসপোর্ট থাকার কথা, যেগুলো নেই,’ বলল রামিন। ‘মাসুদ ভাই মিশনে না গেলে নকল পাসপোর্ট সঙ্গে নিলেন কেন? এখন তো মনে হচ্ছে নকল পরিচয়ে লণ্ডনে গেছেন। ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছে আমার কাছে।’

‘আরও একটা ব্যাপার,’ বলল ওয়াকার। ‘বিপদে লাগবে বলে সিন্দুকে টাকা রেখেছিল রানা। সেই নগদ টাকা এখন উধাও।’

‘মাসুদ ভাইয়ের বার্নার ফোনদুটোও সিন্দুকে নেই,’ বিড়বিড় করল রামিন। ‘এ-ছাড়া পিস্তলদুটোও।’

ওরা বুঝে গেল, ব্রিটেনে অস্ত্র নিয়ে গেছে রানা।

‘এটা প্রেম বিষয়ক কিছু নয়,’ বলল ওয়াকার।

‘তাই তো মনে হচ্ছে।’ গলা শুকিয়ে গেছে রামিনের।

‘খুব ব্যস্ত ছিল রানা,’ বলল ওয়াকার, ‘মনে ছিল দুশ্চিন্তা।’

‘কিন্তু কী কারণে?’

ভাঙা আয়না আবারও দেখল ওয়াকার। শরীরের ভর অন্য পায়ে চাপিয়ে দেয়ায় জুতোর নিচে মুড়মুড় করে ভাঙল কিছু। ওদিকে তাকাল ও। কার্পেটে ভাঙা কাঁচের পাশেই খাটের নিচে অর্ধেক ঢুকে গেছে জিনিসটা। ঝুঁকে ওটা তুলল ওয়াকার। ছোট একটা ছবি। রানা আর এক মেয়ের। পেছনে তুষারে ভরা পাহাড়।

‘এই মেয়েই তা হলে জেসিকা,’ বিড়বিড় করল রামিন।

ছবির মধ্যে ভাঁজ করার দাগ। ওয়াকার বলল, ‘মনে হয় ওয়ালেটে রাখত রানা। তাড়াহুড়োয় ফেলে গেছে কার্পেটে।’

‘ছবি দেখে রাগ হওয়ায় আয়নায় ঘুষি মেরেছেন মাসুদ ভাই,’ বলল রামিন। ‘তখন হাত ফস্কে নিচে পড়েছে ছবি।’

‘প্রেমঘটিত সমস্যা নয়,’ বলল ওয়াকার। ‘গুরুতর কিছু হয়েছে। আর সেজন্যে সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র নিতে বাধ্য হয়েছে রানা। তা হলে আমরা কি ধরে নেব, বড় কোন বিপদে আছে জেসিকা? এখন তো তেমনই মনে হচ্ছে!’

‘কিন্তু জেসিকার ভয়েস মেইলের সঙ্গে তো এসব মিলছে না,’ বলল রামিন, ‘কথা বলার সময় ফুর্তিতে ছিল সে।’

‘নিজেই হয়তো জানে না মস্ত বিপদে আছে?’ আনমনে বলল ওয়াকার।

‘হয়তো। কিন্তু মেয়েটা গ্রামের পুলিশ অফিসার। গোটা ব্রিটেনে আইন-শৃঙ্খলা অমান্যের রেট ওদিকে সবচেয়ে কম।’

‘হয়তো ওর সঙ্গে এসবের কোন সম্পর্ক নেই,’ বলল ওয়াকার। ‘অন্যকিছুও হতে পারে।’

‘যেমন?’

‘জানি না। নিজেই হয়তো ভয়ঙ্কর কোন বিপদে আছে রানা। তবে সেক্ষেত্রে কথা হচ্ছে: সেই বিপদটা আসলে কী? কোন না কোনভাবে আটকে গেছে কোন জালে।’

‘গতকাল যখন এয়ারপোর্ট থেকে ফোন দিলেন, খুব স্বাভাবিক ছিল মাসুদ ভাইয়ের কণ্ঠস্বর,’ বলল রামিন।

‘ঠিকই বলেছ। অর্থাৎ, ফ্রান্সে আসার সময় কিছু ঘটেছে,’ বলল ওয়াকার। ‘ওটা ছিল খুব আকস্মিক। নীল আকাশ থেকে বাজ পড়ার মত। চমকে গিয়েছিল। আর তাই এখানে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে আবারও যেতে হয়েছে ওকে ব্রিটেনে। জানত, যে-কোন সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র লাগবে।’

‘ধরলাম ঝামেলায় পড়েছে জেসিকা,’ বলল রামিন, ‘কিন্তু বিপদটা ঘটছে না স্কটল্যাণ্ডে। সোজা লণ্ডনে গেছেন মাসুদ ভাই।’

মাথা দোলাল ওয়াকার। ‘আমাদেরকে বলেছে জেসিকার ফোন যেন রিসিভ না করি। অর্থাৎ, কিডন্যাপ হয়নি মেয়েটা। টাকার জন্যে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কিডন্যাপাররা। জিম্মিকে কথা বলতে দেয়, যাতে প্রমাণ হয় সে বেঁচে আছে। তবে জেসিকার বিষয়টা এমন নয়।’

‘জেসিকা জিম্মি হলে মাসুদ ভাই চাইতেন কিডন্যাপাররা যোগাযোগ করলে আমরা যেন তাঁকে জানাই।’

‘তেমন কিছু ঘটলে ভয়েস মেসেজ দিত না জেসিকা,’ বলল ওয়াকার। ‘এ থেকে বোঝা যাচ্ছে কিডন্যাপ হয়নি সে।’

‘সবকিছু বড় বেশি জটিল লাগছে,’ বলল রামিন।

‘বোধহয় হুমকি দেয়া হয়েছে রানাকে,’ বলল ওয়াকার। ‘কথামত কাজ না করলে এক বা একাধিক লোক ক্ষতি করবে জেসিকার। তারা চোখ রেখেছে ওর ওপর। আপাতত কিছু না করলেও যখন-তখন কিডন্যাপ করতে পারে। এদিকে কিছুই জানে না জেসিকা। অবশ্য ভাল করেই সব জানে রানা।’

‘ইনভার্নেস এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসার সময় কেউ না কেউ ফোন করেছে মাসুদ ভাইকে, বা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ফলে হঠাৎ করেই বদলে গেছে সব সমীকরণ।’ ওয়াকারের দিকে তাকাল রামিন। ‘আপনি তো এটাই বলতে চাইছেন?’

গম্ভীর মুখে ওয়াকার বলল, ‘আমার তা-ই ধারণা। মেয়েটাকে হুমকির মুখে রেখে, কারা যেন রানার কাছ থেকে কিছু একটা আদায় করতে চাইছে।’

‘বিষয়টা বোধহয় খুব জটিল, তাই আমাদেরকে জড়াতে চাননি মাসুদ ভাই,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রামিন। ‘তিনি চেয়েছেন আমরা যেন জেসিকার ফোন বা মেসেজ রিসিভ না করি।’

‘এটা মোটেই ভাল লাগছে না আমার,’ বলল ওয়াকার।

‘আমিও আপনার সঙ্গে একমত,’ বলল রামিন। ‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: এক্ষেত্রে আমরা এবার কী করব?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *