1 of 2

কিলিং মিশন – ৮

আট

ঝোড়ো বেগে উত্তর ফ্রান্সের মোটরওয়ে ধরে ক্যালেই-এর দিকে ছুটে চলেছে টয়োটা অফরোড প্রিমিয়াম। পথে মাত্র দু’বার থেমেছে মাসুদ রানা। একবার ফিউয়েল নেয়ার জন্যে, তখন একটা বার্গার ও এক বোতল পানি কিনেছে। দ্বিতীয়বার মেইন রোড থেকে সরে নির্জন এক জায়গায় থেমে বার্নার ফোন দিয়ে বুক করেছে ইউরোটানেল লে শাটলের টিকেট ওই ট্রেন ছাড়বে রাত তিনটে পঁচিশ মিনিটে।

পথের ধারে গাড়ি রেখে প্যাকেট খুলে বার্গার খেয়ে নিল রানা। উইলবার ফক্সের ফাইল পড়ে দেখল। তবে ওটায় এমন কিছু নেই, যেজন্যে যুবককে খুন করতে হবে। কোন কিছু আন্দাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখল রানা। নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। অফরোড গাড়ি কেনার পর ছোট এক কম্পার্টমেন্ট তৈরি করেছে পিস্তল লুকিয়ে রাখার জন্যে আগেও এভাবে অন্য দেশে অস্ত্র স্মাগল করেছে রানা।

একবার দেখল, হাতঘড়ি। এখনও মাঝরাত হয়নি। গাড়ির কম্পার্টমেন্টে পিস্তলদুটো রেখে পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিল। স্থির করল ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেবে। কিন্তু ফ্রন্ট সিট হেলিয়ে শুয়ে পড়ার পর মাথায় গিজগিজ করতে লাগল নানান দুশ্চিন্তা। পনেরো মিনিট মেডিটেশন করে আবারও গাড়ি নিয়ে রওনা হলো। এবার চলেছে মাঝারি গতি তুলে।

ক্যালেই-এর কয়েক কিলোমিটার আগে আবারও উঠল মোটরওয়েতে। বড় করে মাথার ওপরে চ্যানেল টানেল লেখা সাইনবোর্ড পেরিয়ে ঢুকে পড়ল প্রাইভেট ভেহিকেল রাখার ফিল্টার লেনে। তারপর ফ্লাইওভার পেরোতেই সামনে পড়ল অটোমেটেড চেক-ইন টার্মিনাল। ওখানে একটি মেশিন রানার গাড়ির পেছন-কাঁচে সাঁটিয়ে দিল বোর্ডিং পাস। ফ্রেঞ্চ পাসপোর্ট কন্ট্রোল থেকে দেখা হলো ওর পাসপোর্ট। ডেভ ক্রোকেটকে সন্দেহ করল না কর্তৃপক্ষ। একটু এগোতেই সামনে পড়ল সিকিউরিটি চেক এরিয়া। ওখানে কোন চালককে বিপজ্জনক বলে মনে হলে ইন্সপেকশন করা হয়। আগেও এই পথে ব্রিটেনে গেছে বা ফ্রান্সে ফিরেছে রানা। বেশিরভাগ সময় ঝামেলা না করলেও কখনও কখনও গাড়ির নিচে গ্রিডসহ ক্যামেরা রেখে স্ক্যান করে কর্তৃপক্ষ। গাড়িতে ড্রাগ্‌স্‌ বা এক্সপ্লোসিভ আছে কি না তা জানতে ছেড়ে দেয়া হয় প্রশিক্ষিত কুকুর। যেসব গাড়িতে গোলমাল আছে বলে ধরে নেয়া হয়, ওগুলো নিয়ে গিয়ে প্রায় প্রতিটি নাটবল্টু খুলে নেয় বর্ডার ফোর্স। আসলে কে ভাল আর কে মন্দ, সেটা বড় কথা নয়— কাউকে পছন্দ না হলেই কর্তৃপক্ষের খাঁড়া নামে তার মাথার ওপরে।

গাড়ির ইঞ্জিন বে-তে ভারী গ্রিস দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হিট- রেসিস্ট্যান্ট এয়ারটাইট ব্যাগে পিস্তল রেখেছে রানা। ও-দুটো খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। তবুও যদি ধরা পড়ে, অস্ত্র এবং টেরোরিযম মামলায় ওর জেল হবে বহু বছরের। অবশ্য কোন বিপদ ছাড়াই সিকিউরিটি চেক এরিয়া পেরোতে পারল টয়োটা অফরোড প্রিমিয়াম।

রানা ব্রিটিশ কাস্টমসকে ক্রোকেটের পাসপোর্ট দেখাতেই হাতের ইশারায় তারা জানাল: ট্রেনে উঠতে পারেন।

এমবার্কমেন্ট সাইন পেরোতেই কমলা হাই-ভিস জ্যাকেট পরনে এক স্টাফ দেখাল, ট্রেনে উঠে সামনের গাড়ির পেছনে রাখতে হবে রানার গাড়ি।

নির্দ্বিধায় নির্দেশ পালন করল রানা। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে পাশের জানালা খুলে দূরে তাকাল। আপাতত কিছুই করার নেই। কয়েক মিনিট পর সাগরের পঞ্চাশ মিটার তলা দিয়ে রওনা হলো লৌহস। আরেকবার জেসিকার বেডরুমের ভিডিয়ো দেখবে কি না ভাবল রানা। তারপর আনমনে মাথা নাড়ল। ওখানে নতুন কিছু নেই, যেটা কাজে লাগবে।

পঁয়ত্রিশ মিনিট পর স্থানীয় সময় তিনটায় চ্যানেল পেরিয়ে ট্রেন ঢুকল লণ্ডন থেকে সত্তর মাইল দূরে ফোকস্টোন শহরের স্টেশনে। দু’মিনিট পর ট্রেন থেকে গাড়ি নিয়ে নেমে পড়ল রানা। ফক্সের যে ঠিকানা দেয়া হয়েছে, সেটা ল্যামবেথ আর ওঅটারলুর নদীর খুব কাছে। আনমনে রানা ভাবল: যদি এমন হতো, নিজের অ্যাপার্টমেন্টে মগ ভরা কফি হাতে জেগে আছে ফক্স! ওকে দেখেই হেসে বলল, ‘আরে, এতকাল কোথায় ছিলেন, বস? বহুদিন দেখা নেই! ‘

কিন্তু বাস্তবতা আসলে অন্যরকম। কয়েক দিন আগেই গা ঢাকা দিয়েছে ফক্স। একাধিক খুনি গিয়ে তল্লাসী করেছে ওর অ্যাপার্টমেন্ট। ওখানে জরুরি কিছু ছিল না। নইলে এসবে রানাকে জড়িয়ে নিত না অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল।

নির্জন গ্রাম্য পথে থেমে ইঞ্জিন বে থেকে ওয়ালথার পিপি আর গুলি ভরা ম্যাগাযিন সংগ্রহ করল রানা। আবারও গিয়ে উঠল বড় রাস্তায়। ভোর চারটে পঁচিশ মিনিটে পৌঁছে গেল ফক্সের ঠিকানায়। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনের দিকে রয়েছে সিসিটিভি সিস্টেম। কিন্তু বাড়ির পেছনে ক্যামেরার তার কাটা। ভবনের পেছন উঠনে গিয়ে থামল রানা। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দরজায় মিনি-টর্চের আলো ফেলতেই দেখল, তালার ফুটোয় অসংখ্য আঁচড়ের দাগ। নিজে রানা এই তালা খুললে আনাড়ির মত অসংখ্য ঘর্ষণের দাগ ফেলত না। একমিনিট পেরোবার আগেই বাড়িতে ঢুকে পড়ল ও। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওপরের তলায়।

ফক্সের অ্যাপার্টমেন্টের দরজার তালায় অজস্র দাগ। ওটা যে গায়ের জোরে খোলা হয়েছে, সেটা দুধের বাচ্চাও বুঝবে। ফক্স নিজে হলে এই কাজ ভুলেও করত না।

আধমিনিট তালার ওপর সময় ব্যয় করে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে পড়ল রানা। ওয়ালথার হাতে ঘুরে দেখল ঘরগুলো। পাঁচ মিনিট পেরোবার আগেই বুঝে গেল, অ্যাপার্টমেন্টে ও ছাড়া আর কেউ নেই। বাতি জ্বেলে চারপাশ দেখল। তচনচ করা হয়েছে প্রতিটি ঘর। দলে অন্তত তিনজন ছিল তারা। এখানে ডাকাতি হয়েছে এমন কোন তথ্য পুলিশের কাছে নেই, নইলে অ্যাপার্টমেন্টে থাকত ক্রাইম সিন টেপ।

আসবাবপত্র সব গুছিয়ে রাখত ফক্স। প্রতিটি জিনিস দামি। যে কাজই করুক, প্রচুর টাকা পেত সে। রানা ভাবল, টাকার খোঁজেই কি এখানে এসেছে লোকগুলো? উল্টেপাল্টে এখানে-ওখানে ফেলেছে চেয়ার বা সোফা। চিরে দেয়া হয়েছে প্রতিটি সিট। বোধহয় খোঁজা হয়েছে কোন ডকুমেন্ট বা কোন ছবি। অথবা ওটা হতে পারে কোন কমপিউটার ডিস্ক। লিভিংরুমে দেয়াল থেকে সরানো হয়েছে বড় এক বুকশেলফ। দেয়ালে গোপন কোন সিন্দুক নেই। দেয়াল থেকে নামিয়ে ছেঁড়া হয়েছে প্রতিটি ছবির পেছনদিক। দামি এক সাদা সোফা ছিন্নভিন্ন হয়েছে ছুরির পোঁচে। নিচে কিছু আছে কি না দেখতে ফ্লোরবোর্ড উপড়ে তুলেছে লোকগুলো।

ফক্স কোথায় গেছে জানা নেই তাদের, নইলে এসবে জড়িয়ে নিত না রানাকে। জেসিকাকে বাঁচাতে হলে এবার ওর খুঁজতে হবে জরুরি সূত্র। লণ্ডভণ্ড অ্যাপার্টমেন্টে দাঁড়িয়ে রানা ভাবল, ও নিজে ফক্স হলে কী করত? যে-কোন সময়ে পৌঁছে যাবে একদল খুনি। দেরি না করে লুকিয়ে পড়তে হবে ওকে! হাতে একদম সময় নেই!

ঠাণ্ডা মাথায় ফক্সের মত করে ভাবতে চাইল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *