1 of 2

কিলিং মিশন – ২৪

চব্বিশ

ফ্রেঞ্চ কাস্টকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইংলিশ চ্যানেলের বিক্ষুব্ধ নীল-সবজেটে জলরাশি ছুঁয়ে উড়ে চলেছে আকাশি নীল রঙের পুরনো এক সেসনা। রেডিয়ো বন্ধ করে রেখেছে পাইলট। গ্রেফতার হলে বর্ডার গার্ডের লোকেরা ধরে নেবে, সে এবং তার সঙ্গী ড্রাগস্‌ স্মাগলিং বা অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। চিন্তাটা মনে আসতেই বলল রামিন, ‘সাগরে ডুবে না মরলে কপালে আছে কয়েক বছরের জেল!’

‘শালারা পারলে ধরুক তো!’ হাসল ওয়াকার। ‘আরাম করে বোসো, রামিন। ভরসা রাখো ভাল পাইলটের ওপরে।’

সত্যিই ওদেরকে ধরতে এল না কেউ।

প্রতিঘণ্টায় শ’ মাইল বেগে নরম্যাণ্ডি থেকে উত্তর ওয়েলসের এয়ারস্ট্রিপে যেতে লাগবে তিনঘণ্টারও বেশি। আকাশ থেকে দেখে ওদের মনে হলো, লোয়ার ডি ভ্যালি ও ওয়েলসের রেক্সহ্যাম শহরের মাঝের জমি যেন আয়ারল্যাণ্ডের সবুজ ঘাসে ভরা মাঠের মতই সমতল।

.

ইংল্যাণ্ডের বর্ডার থেকে তিন মাইল দূরে ওয়াকারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জো ডিগবার্টের নব্বুই একরের খামার। রেসের কিছু নামকরা ঘোড়া কিনে প্রজনন করাচ্ছে সে। ধনী ব্যবসায়ীদের কাছে দেদারসে বিক্রি করছে ঘোড়ার শাবক। আরবি শেখদের মত গোটা বিশেক নিকা করে নিলেও টাকার অভাব হবে না তার। যদিও কাঁচা বয়সে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ভেবেছে, সুন্দরী শেলি পিয়ার্সকে জীবনে না পেলে কখনও বিয়ে করবে না। সেই থেকে অপেক্ষায় আছে একদিন না একদিন ওর কাছে ফিরবে মেয়েটি

দু’সারি সাদা কাঠের খুঁটি দিয়ে তৈরি বেড়ার মাঝে সরু ড্রাইভওয়ে, শেষমাথায়’ সতেরো শতকে তৈরি ডিগবার্টের ফার্মহাউস। লিভিংরুমের জানালা দিয়ে সোনালি রোদে ভরা মাঠে ঘোড়া চরতে দেখছে সে। মৃদু গুঞ্জন শুনে বাড়ির পেছনের এক জানালায় উঁকি দিল। দূরে ছোট্ট বিমানটা দেখেই বুঝল, সঠিক সময়ে পৌঁছে গেছে ওর বন্ধু।

.

আকাশ থেকে ফার্মহাউসের পেছনের মাঠে ঘোড়া চরতে দেখল না ওয়াকার। বিমানের উচ্চতা কমাতে শুরু করে বলল, ‘জোর ঝাঁকুনির জন্যে তৈরি হও, রামিন! নিচে কিন্তু সিমেন্টে বাঁধাই করা রানওয়ে নেই!’

‘আগেও নিশ্চয়ই মাঠে নেমেছেন?’ বলল রামিন।

‘জীবনে প্রথম বলে একটা কথা আছে না, বাছা!’

ঝোড়ো বেগে ঘাসের বুকে নেমে পর পর দীর্ঘ দুই লাফ দিয়ে ঘাস-মাটি উপড়ে নিল সেসনা। তৃতীয়বারে আবারও নামল এয়ারস্ট্রিপে। গতি ওটার তুমুল! সাঁই-সাঁই করে পিছনে যাচ্ছে সবুজ মাঠ! সামনে প্রাচীরের মত মাথা তুলেছে একসারি গাছ! বিধ্বস্ত হয়ে মরার ভয়ে আবারও আকাশে উঠতে চাইল ওয়াকার। নতুন করে গতি পেয়ে নাক উঁচু করল সেসনা। বিপজ্জনক কয়েক মুহূর্ত পর একটা গাছের মগডালের ছয় ইঞ্চি ওপর দিয়ে গেল বিমানের চাকা।

‘বাপরে!’ বিড়বিড় করল ওয়াকার। আকাশে এক শ’ ফুট উঠে বিমান ঘুরিয়ে আবারও চলল মাঠের শুরুর দিকে। দ্বিতীয় দফায় নিরাপদে এয়ারফিল্ডে নামল সেসনা। কিছুক্ষণ ছুটে থামল মাঠের শেষে। ইঞ্জিন বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে ওয়াকার দেখল, কাদা-ঘাস ছিটিয়ে এদিকে আসছে এক ফোর-হুইল- ড্রাইভ।

‘হায়রে, আপনিও বলে পাইলট?’ আনমনে বলল রামিন।

বিমানের পাশে জিপ রেখে নামল জো ডিগবার্ট। এদিকে সেসনার ককপিট থেকে মাটিতে নেমেছে ওয়াকার ও রামিন। বয়সে ওয়াকারের চেয়ে দশবছরের বড় ডিগবার্ট। বুকের ওপরে উঠে আসা ভুঁড়িটা উল্টে থাকা গামলার মত। বন্ধুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলল ডিগবার্ট, ‘ওটা কেমন ল্যাণ্ডিং, জনি? শেষদিকে মনে হলো এবার দুটো লাশ পাব!’

আন্তরিক হাসল ওয়াকার। ‘খবরদার, আরও মোটা হয়ো না! এরপর ধসে পড়বে তোমার গাড়ির চেসিস!’

‘বেশি ড্রিঙ্ক করে বুড়ো হয়ে গেছ,’ পাল্টা বলল ডিগবার্ট। ‘এখন আমার বুলডগ কুকুরটাও তোমার চেয়ে হ্যাণ্ডসাম।’

রামিন বুঝল, একে অপরকে কোণঠাসা করে এরা।

‘এই ছেলেটা আমার সহযোগী,’ ডিগবার্টকে বলল ওয়াকার। ‘নাম রামিন রেজা।’

রামিনের হাত ধরে বারকয়েক ঝাঁকি দিল ডিগবার্ট। তারপর বলল, ‘তুমি সত্যিই সাহসী ছেলে। নইলে বেয়াক্কেলে এক বুড়ো-হাবড়ার কথা শুনতে না। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও উঠতে না পুরনো ওই কফিনে!’ বিমানটাকে দেখে নিয়ে মাথা নাড়ল সে। ‘জনি, তুমি কি ভাবছ বিশ্রী জঞ্জালটা আমার মাঠে ফেলে, তার বদলে নেবে আমার দুর্দান্ত সেই ভ্যান? আমি অবশ্য জানতেও চাই না কী অকাজে এসেছ।’

‘ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বিপদে,’ বলল ওয়াকার। ‘তবে সে কে বা কী ধরনের ঝামেলা, সেসব জানতে চেয়ো না।’

মাথা দোলাল ডিগবার্ট। ঠিক আছে। তবে শুধু এটা বলো, তোমার সেই বন্ধু আসলে কোন জাতের প্রাণী?’

‘না-না, প্রাণী নয়, ডিগি! সে, বিশ্বে নেমে আসা মহান এক দেবতা,’ নাক ফুলিয়ে বলল ওয়াকার।

গম্ভীর হলো ডিগি। ‘ও? তবে তো আমার দামি হাতদুটোও তোমাদের কাজে লাগতে পারে।’

‘আপাতত লাগছে না। ঘোড়া পোষার ফাঁকে নজর রেখো আমার পঙ্খিরানির ওপরে।’ সেসনা দেখাল ওয়াকার। ‘আমরা ফেরার পর হয়তো চট্ করে উড়াল দেব।’

চকচক করছে ডিগবার্টের চোখ। ‘আমিও সেটাই ভেবেছি। তো উঠে পড়ো জিপে। বার্নেই আছে আমার ভ্যান।

কেন চিকচিক করছে তার চোখ, জানা নেই রামিন ও ওয়াকারের। ওরা তিনজন জিপে উঠতেই রওনা হলো ডিগবার্ট। একটু পর পৌছে গেল বার্নের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে খুলে দিল গোলাবাড়ির দুই কবাটের বিশাল দরজা। ভেতরে ওরা দেখল পেরোজেও কোম্পানির পুরনো, লম্বাটে এক ট্র্যানসিট ভ্যান। ওটার পেছনে ও দু’পাশে অস্পষ্ট নীল কালিতে লেখা: ট্রুম্যানের হালকা মালামাল পরিবহন। নিচে বহুদিন আগে বাতিল হওয়া এক টেলিফোন নম্বর। গাড়ির পেছনের মাটিতে একগাদা খড়। ওয়াকার ও রামিন বুঝল, ওখান থেকেই যায় ঘোড়ার খাবার।

‘ছোট এক কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় নিলামে কিনতে পেরেছি এই ভ্যান,’ বলল ডিগবার্ট। ‘দেখে হয়তো ভাবছ ধচাপচা গাড়ি। জেনে রেখো, জীবনেও ওটা কাউকে ডোবাবে না। পেটে আরও কিছু মাল আছে। ভাল করে দেখো।’ ভ্যানের সাইড ডোর খুলল সে। গাড়ির পেছনদিক বদলে নিয়েছে সে। একপাশে কাঠের বাঙ্কের ওপরে বিছিয়ে দিয়েছে ফোমের ম্যাট্রেস। নিচে মেঝেতে চোখ যেতেই একইসঙ্গে শিস বাজাল রামিন ও ওয়াকার।

‘দেউলিয়া হওয়া কোম্পানির নিলামে ওটা ছিল না, মন্তব্য করল ওয়াকার।

খুশির ছাপ পড়ল ডিগবার্টের আপেলের মত লালচে গালে। ‘আমি চাই না যে তুমি কিছু জিজ্ঞেস করবে! আমার মনে হয়েছে ওটা তোমাদের লাগতে পারে।’

‘সত্যিই হয়তো লাগবে,’ নিচু গলায় বলল ওয়াকার।

বাঙ্কের নিচে মেঝেতে বাইপড়ে শুয়ে আছে স্টেট-অভ-দ্য- আর্ট বোল্ট-অ্যাকশন রেমিংটন মিলিটারি স্নাইপার রাইফেল। ম্যাগাযিনে আঁটে দশটা বুলেট। মাঘলের ডগায় সাইলেন্সার। ভাঁজ করা যায় অস্ত্রের বাঁট। এ-ছাড়া, আছে নিখুঁত একটি হাই ম্যাগনিফিকেশন স্কোপ। পেশাদার স্নাইপারের হাতে এই রাইফেল পড়লে যে-কাউকে সাবড়ে দেবে পনেরো শ’ মিটার দূর থেকে। রানা নিজে অস্ত্রের ট্রেইনিং দিয়েছে রামিনকে। রেমিংটন রাইফেল দেখে ওর মনে পড়ল, বাংলাদেশ আর্মির সার্জেন্ট রশিদ হায়দারের কথা। টিলার ওপরে উঠে কঙ্গোর নিষ্ঠুর এক ওঅরলর্ডের মাথার তালু দু’হাজার চার শ’ বিরাশি মিটার দূর থেকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন মাসুদ ভাই।

‘আমি কি একটু দেখতে পারি?’ জানতে চাইল রামিন।

‘নিশ্চয়ই,’ খুশি হয়ে বলল ডিগবার্ট

রাইফেলটা হাতে নিল রামিন। ওটার ওজন মাত্র সতেরো পাউণ্ড। মিনিটখানেকের ভেতরে খুলে নেয়া যায় প্রতিটি পার্ট। ম্যাগাযিনে চকচকে বটল-নেক কার্ট্রিজ দেখে রামিন বলল, ‘.৩৩৮ লাপুয়া ম্যাগনাম। ভেরি গুড!’

‘সিটের নিচে ব্যাগে পাবে এক শ’ রাউণ্ড,’ বলল ডিগবার্ট। ‘তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, বাছা, তুমি এ জিনিস চেনো!

‘আমার দেখা দুর্দান্ত ক’জন স্নাইপারের ভেতরে প্রতিযোগিতা হলে দ্বিতীয় হয়েছিল রামিন,’ গর্বের সঙ্গে বলল ওয়াকার।

রামিন জানাল না, সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন ওর ওস্তাদ এবং প্রাণপ্রিয় বড় ভাই মাসুদ রানা।

‘রাইফেল যেন ঠিকঠাক ফেরত পাই,’ বলল ডিগবার্ট, ‘আমার ভ্যানের ব্যাপারেও ওই একই কথা!’

তার পিঠে কষে গোটা তিনেক চাপড় বসাল ওয়াকার। ‘সত্যিই, তোমার তুলনা নেই, ডিগি! বন্ধুরা যতই বলুক মোটা গাভীটা কোন কাজের নয়, আমি কিন্তু এই কথা কখনও মেনে নেব না!’

চাপড় খেয়ে চুলকানি শুরু হয়েছে ডিগবার্টের পিঠের পুরু চর্বিতে। বিড়বিড় করল সে, ‘ধুশালা, হারামি কোথাকার!’

তার কাছ থেকে বিদায় নিল ওয়াকার ও রামিন। ট্র্যানসিট ভ্যানে চেপে বেরিয়ে এল খামার ছেড়ে। ঝড়ের বেগে চলেছে উত্তরের সড়ক ধরে। সাতঘণ্টার পথ ছয়ঘণ্টায় পেরোতে চাইছে ওরা। ভাবছে, স্কটল্যাণ্ডের হাইল্যাণ্ডে জেসিকার বাড়ির কাছে পৌঁছে যাবে সন্ধ্যা সোয়া সাতটার আগেই।

এরই ভেতরে রাইফেলের পার্টস খুলে বাঙ্কের নিচে ব্যাগে রেখেছে রামিন। আরেকবার দেখল ওটা চোখের আড়ালে আছে কি না। নিচু গলায় বলল, ‘জানি না কী ঘটবে স্কটল্যাণ্ডে, তবে ভাল হয় অস্ত্রটা ব্যবহার করতে না হলে।’

‘বুক বা মাথায় গুলি লাগলে কোন ব্যথা পাবে না,’ মন্তব্য করল ওয়াকার। ‘মৃত্যু হবে ওদের এক পলকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *