পঁয়ত্রিশ
ক’দিন আগে পঞ্চাশ বছরে পা রেখেছে ক্রিস্টোফার গান। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। বাবা ও মা-র টাকার অভাব ছিল না, তার ওপরে ছেলের মাথা ক্ষুরধার, তাই তাঁরা চেয়েছেন সে যেন লেখাপড়া শেষ করে আইন বিষয়ে। ক্রিস্টোফার গান সহজেই ভর্তি হতে পেরেছে ইটনে ও এরপর কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে। পরীক্ষায় সবসময় হয়েছে প্রথম। মাস্টার্স পাশ করে চাকরি নিয়েছে লণ্ডনের নামকরা এক ল ফার্মে। মাত্র পাঁচবছর পর সুযোগ এল রানির পরামর্শক পদে যোগ দেয়ার। তার বয়স তখন মাত্র ত্রিশ। অনায়াসে হতো হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। কিন্তু আইন ব্যবসার বদলে হঠাৎ করেই সে চলে গেল রাজনীতির ময়দানে। তেত্রিশতম জন্মদিনের তিনদিন আগে হলো ব্রিটেনের সবচেয়ে কমবয়সী সাংসদ।
ক্রিস্টোফার গানের উত্থান ছিল সুপারসনিক রকেটের মত দ্রুত। যেমন শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান, তেমনি চলনে-বলনে মুগ্ধ করে দেয়ার মত অভিজাত এক পুরুষ। মুখে সবসময় লেগে আছে মিষ্টি হাসি। এমন কী বিরোধী সাংসদরাও বদনাম করে না তার। জনসভা বা টিভিতে সবাই দেখে, অন্তর থেকে স্ত্রীকে ভালবাসে সে। তাই সবাই ধরে নিয়েছে তারা আদর্শ দম্পতি। পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় ক্রিস্টোফার গান সবসময় বলে, কোন্ পথে কীভাবে এগিয়ে নেবে প্রিয় মাতৃভূমিকে।
সবার ধারণা: এই দুনিয়ায় শত্রু বলতে কেউ নেই তার। প্রতিভাবান নিপাট ভদ্রলোক। অথচ, বাস্তবে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও মার্জনাহীন নীচ মনের মানুষ সে। তার চলার পথে কেউ বাধা হয়ে উঠলে দেরি করে না চরম পথে যেতে। যারা ভোট দিয়ে তাকে সাংসদ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, তারা জানেও না কতবড় এক দানবকে নির্বাচিত করেছে। ক্রিস্টোফার গানের দলের নেতা-কর্মীরা চায়, সে যেন ভবিষ্যতে হয় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। এরই ভেতরে প্রাইভি কাউন্সিলে নীতি-বিষয়ক পরামর্শকের পদ পেয়েছে নীচ লোকটা।
সাধারণ মানুষ জানে না, জটিল এক সমস্যা আছে তার। আর সেটা হচ্ছে তার মেয়ে নেলি গান।
ক্রিস্টোফার ও ডায়ানার একমাত্র সন্তান সে। ছোটবেলা থেকেই বেয়াড়া ও দুর্বিনীত। যতই বড় হয়েছে, নানান বিপদে ফেলেছে তার বাবা-মাকে। মানবে না কোন নিয়ম। শুনবে না কারও কোন কথা। ব্যস্ত বাবা-মায়ের কাছ থেকে যথেষ্ট মনোযোগ পায়নি বলেই বোধহয় তাদের সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিতে মুখিয়ে আছে সে।
এগারো বছর বয়সে সহপাঠীদের কাছে সিগারেট, মদ ও গাঁজা বিক্রি করে ধরা পড়ল স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে। এ-ছাড়া নষ্ট করল স্কুলের নানান দামি জিনিসপত্র। অপমান করত টিচারদেরকে। নেলিকে শুধরে নেয়ার জন্যে বারো বছর বয়সে ব্রিটেনের সেরা গার্লস্-স্কুল সেইণ্ট অ্যালোয়সিয়াস অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করল ওর বাবা। তাতে প্রথমদিকে মনে হলো মানুষ হবে নেলি। কিন্তু ক’দিন পরেই জানা গেল ছাত্রীদের কাছে পর্নোগ্রাফিক ছবি ও ভিডিয়ো বিতরণ করেছে সে। সেইণ্ট অ্যালোয়সিয়াস কর্তৃপক্ষ শাস্তি হিসেবে ডরমিটরিতে আটকে রাখলে ভারী দুটো ভেলভেট পর্দায় আগুন ধরিয়ে দেয় নেলি। কপাল ভাল, ওই অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে যাওয়ার আগেই নিভিয়ে ফেলা হয়, নইলে ছাই হতো অর্ধেক স্কুল। তাতে আঁচ লাগত ওর বাবার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে। এ ঘটনা যেন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করা না হয়, সেজন্যে স্কুল-কর্তৃপক্ষকে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হলো ক্রিস্টোফার গান।
আসলে মেয়েকে নিয়ে তখন মাত্র শুরু হয়েছে তার বিপদ। টিনেজ বয়সে একের পর এক প্রেমে জড়িয়ে গেল নেলি। প্রতিবার শেষসময়ে চাপা দেয়া হলো স্ক্যাণ্ডাল। তেরো বছর বয়সে এক দোকান থেকে কয়েক শত পাউণ্ডের কসমেটিক চুরি করে ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। পনেরো বছর বয়সে তিনজন ছেলের সঙ্গে গাঁজা ও সিসা সেবন করে অচেতন অবস্থায় তাকে পাওয়া গেল এক গাড়ির ভেতরে। সতেরো বছর বয়সে কয়েকজন তরুণের সঙ্গে রক মিউযিক শুনতে গিয়ে মঞ্চে উঠে নিষিদ্ধ স্টান গান ব্যবহার করল নেলি। এরপর কীভাবে যেন ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলো সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু তাতে বদলে গেল না তার স্বভাব। প্রথম বর্ষে এক প্রফেসরের কাছে পাঠিয়ে দিল নোংরা কবিতা আর নিজের নগ্ন ছবি।
আগেই বোঝা গেছে নেলি একজন নিমফোম্যানিয়াক। দোকান থেকে কসমেটিক চুরি করে আবারও গ্রেফতার হলো সে। সমাজে ওর বাবার সম্মান এবং উঁচু মহলে হাত আছে, তাই ছেড়ে দেয়া হলো নেলিকে। পাবলিক যেন এসব জানতে না পারে, সেজন্যে গোপনে খরচ করতে হলো ক্রিস্টোফার গানকে প্রচুর টাকা। আইনী কর্তৃপক্ষকে কথা দিতে হলো, আর কখনও অপরাধ করবে না তার মেয়ে। বহুবার ভেবেছে ক্রিস্টোফার গান, এরপর হয়তো এমন কিছু করবে নেলি, যে-কারণে তার ক্ষমতাশালী বন্ধুরাও সেই বিপদ থেকে তাকে বাঁচাতে পারবে না।
একমাস আগে উনিশে পা দিল নেলি। তার কয়েক দিন পর সত্যি হলো ক্রিস্টোফার গানের দুঃস্বপ্ন।
সকালে বাড়িতে বসে আছে সে, এ-সময় এল উড়ো চিঠি। প্রেরকের নাম নেই খামের ওপরে। কাজে বাইরে ছিল তার স্ত্রী ডায়ানা, নইলে চিঠিটা ওর হাতে পড়লে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হতো। খামের ভেতরে ছিল নেলি আর পাঁচজন যুবকের বিকৃত সম্মিলিত যৌনমিলনের কিছু ছবি।
চিঠি দেয়া হয়েছে ব্ল্যাকমেইল করার জন্যে। তাদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য খুব স্পষ্ট। মাথা-ন্যাড়া যুবকদের গায়ের উল্কি দেখে ক্রিস্টোফার গান বুঝল, নিয়ো-নাযিদের সঙ্গে গিয়ে মিশছে নেলি। কালো কালিতে মুছে দেয়া হয়েছে তাদের মুখ। কিন্তু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে নেলির চেহারা।
চিঠিতে লেখা হয়েছে, এ-ধরনের অসংখ্য ছবি আছে তাদের কাছে। সেগুলো হাতে পেতে হলে দিতে হবে এক মিলিয়ন পাউণ্ড। নইলে সব প্রকাশ হবে দৈনিক পত্রিকায়। একসপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে সব টাকা। নইলে…
নেলির কুকীর্তির জন্যে নতুন করে আর মানসিক যন্ত্রণায় পড়ল না ক্রিস্টোফার গান। বিরক্তও হলো না। বহুবার ভেবেছে, কুত্তীটা জন্ম না নিলেই বোধহয় ভাল ছিল। টাকা দিতে হবে জেনেও ক্ষোভ নেই তার। ভাল করেই জানে, নিয়ো-নাযি হারামজাদারা টাকা পেলেও শেষ হবে না তাদের লোভ। আরও টাকা চাইবে আবারও। তাকে চুষে শেষ করে একদিন না একদিন প্রকাশ করবে এসব ছবি।
সুতরাং, যা করার তা করতে হবে খুব দ্রুত।
মাত্র একবার ফোন দিলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে ক্ষমতাশালী তার একদল বন্ধু। বন্ধ করে দেবে নিয়ো- নাযিদের মুখ। বোকাগুলো জানেও না কার সঙ্গে লাগতে গেছে।
খামে পোস্টমার্ক বা চিঠিতে আঙুলের ছাপ না পেলেও ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নাম্বার দেখে জেনে নেয়া হলো, লণ্ডনের কোন্ বাড়ি থেকে এসেছে চিঠি। সে-রাতে ওখানে গেল পোশাদার ক’জন আততায়ী। বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে লাথি মেরে ঘুম থেকে তুলল নিয়ো-নাযিদেরকে। হাত-পা বেঁধে ভ্যানে করে নিয়ে গেল কাছের জঙ্গলে। ভয়ঙ্করভাবে পিটিয়ে জেনে নিল সব তথ্য। তারপর খুন করে মাটির নিচে পুঁতে দিল লাশ।
দলে ছিল তারা সাতজন। তিনদিন পর অন্যদেরকে গুম করা হলো। পুড়িয়ে দেয়া হলো চিঠি ও ছবি। কোথাও কোন ধরনের প্রমাণ থাকল না।
বিপদ কেটে গেলেও ক্রিস্টোফার গান ভাল করেই চেনে তার মেয়েকে। কাজেই বুঝে গেল, ঝামেলা থেকে বাঁচতে হলে নিতে হবে চরম শখ। কঠিন সিদ্ধান্ত নিল সে। তাতে খুশি হলো তার গোপন বন্ধুরা। গত পূর্ণিমার রাতে চিরদিনের জন্যে পৃথিবী ত্যাগ করল বেয়াদব মেয়েটা।
সাধারণ মানুষ ঘুণাক্ষরেও জানবে না, প্রাইভি কাউন্সিল ও সংসদ সদস্য ক্রিস্টোফার গান আসলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক সঙ্ঘের সঙ্গে। মানুষ খুন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই শয়তান-পূজারী নরপশুগুলোর।
আর তাদের সেই গুপ্তসঙ্ঘের নাম: দ্য হ্যাভোক ক্লাব!