তেত্রিশ
স্কটল্যাণ্ডের ফোর্ট উইলিয়াম।
দুপুর পৌনে একটা।
অনলাইনে থার্স্টি পাবের ফোন নম্বর খুঁজতে তিন মিনিট ব্যয় করেছে ওয়াকার। রিসেপশনে কল দিতেই ওদিক থেকে তোলা হলো ফোনের রিসিভার। এক তরুণী বলে উঠল: ‘হ্যালো, থার্স্টি পাব থেকে বলছি, আমি তেরেসা!’ ওদিকে বহু মানুষের গুঞ্জন ও প্লেট-গ্লাসের শব্দ শুনল ওয়াকার ও রামিন।
ফুর্তিভরা কণ্ঠে বলল ওয়াকার, ‘হাই, তেরেসা! আমি জানি, এমন একটা অনুরোধ করা একদম ঠিক নয়, কিন্তু তোমার সাহায্য আমার এখন বড়ই দরকার! এ-মুহূর্তে তোমাদের পাবে বান্ধবীকে নিয়ে বসে আছে দারুণ সুন্দরী এক রাজকুমারী। মেঘকালো চুলের ওপরে চাপিয়ে নিয়েছে নীল ক্যাপ। নাম ওর জেসিকা। জেসিকা থমসন। তুমি কি দয়া করে ওকে ফোনে একটু ডেকে দেবে?’
মনে সন্দেহ এলেও লাইন কাটল না তেরেসা।
এই সুযোগে বলল ওয়াকার, ‘আসলে হয়েছে কী, বহু বছর ধরেই আমি ওর বয়ফ্রেণ্ড। যুদ্ধে ছুটি পেয়ে একটু আগে ফিরে এসেছি বিদেশ থেকে। কিন্তু জেসিকা সেটা জানে না। দাঁড়িয়ে আছি তোমাদের পাবের বাইরে। হাতে লাল গোলাপের তোড়া। পকেটে হীরা বসানো সোনার আংটি। আজ ওকে বলে দেব, এই জীবনে ওর চেয়ে বেশি কাউকে ভালবাসিনি আমি। ওকে চিরকালের জন্যে সঙ্গিনী হিসেবে চাই।’
ওয়াকার জানে, তেরেসা ভাবছে নামকরা কোন সুদর্শন নায়কের কথা। যুদ্ধে গেছে সে, আর তারপর বীর বেশে ফিরে এসেছে নিজের দেশে। নেভির ইউনিফর্মের বুকে সোনালি- রুপালি মেডেল। প্রেমিকার জন্যে হাতে করে এনেছে ফুলের মস্ত তোড়া। আজ প্রিয় মানুষটাকে বলে দেবে, তাকে ছাড়া বাঁচতে চায় না সে। বিয়ে করতে মেয়েটার হাত ধরে হাজির হবে গির্জায়। এত ভাবার পর হৃদয় না গলে উপায় আছে তেরেসার!
‘আসলে, তেরেসা, তোমার সাহায্য আমার খুব দরকার। ওকে অবাক করে দেব। তুমি শুধু বলবে ওকে, ফোন করেছে মাসুদ রানা। পাবের বাইরে ভাইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। জেসিকা পাব থেকে বেরোলেই ছুটে এসে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলব: ভালবাসি! তোমাকে ভালবাসি! তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? তো এখন, তেরেসা, তুমি কি আমার জন্যে এ-কাজটা করে দেবে?’
হতবাক রামিন ভাবছে: ব্যাটা পাগল হয়ে গেল? কিন্তু তা-ই বা হয় কী করে? নিশ্চয়ই ভয়ানক কোন ভণ্ডামি শুরু করেছে!
এদিকে বিয়েতে অবদান রাখতে পারবে ভেবে ঘায়েল হয়ে গেছে তেরেসা। খিলখিল করে হেসে উঠল সে। মজা পেয়ে বলল, ‘একটু অপেক্ষা করুন। এক্ষুণি ওকে ডেকে দিচ্ছি!’
তেরেসার চাপা কণ্ঠস্বর শুনল ওরা।
জেসিকা থমসন? আপনাকে ফোনে ডাকছেন মাসুদ রানা! তাঁর ভাইও বোধহয় কথা বলবেন আপনার সঙ্গে!’
এক মিনিট পেরোবার আগেই লাইনে এল জেসিকা। খুশিমনে বলে উঠল, ‘হ্যালো, রানা? তুমি জানলে কী করে যে আমি এখানে? তোমার তো কোন ভাই ছিল বলে শুনিনি?’
মুহূর্তে গম্ভীর হলো ওয়াকার। নিচু কণ্ঠে বলল, ‘মিস জেসিকা, মন দিয়ে শুনবেন আমার প্রতিটা কথা। আর যাই করুন, ফোন রেখে দেবেন না। আমার নাম জনি ওয়াকার। রানার পুরনো বন্ধু। রানা এজেন্সিতে কাজ করছি বেশকিছু দিন ধরে। আপনাকে ফোন দিয়েছি, কারণ মস্ত বিপদে আছেন আপনি। আর তাই এসেছি আপনাকে সরিয়ে নেয়ার জন্যে।’
জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে তুষারের বল ছুঁড়লে যেভাবে ভুস করে উবে যায়, সেভাবেই ফুরিয়ে গেল জেসিকার উচ্ছ্বাস। ‘আরে, এক মিনিট! এসব কী বলছেন? আসলে কী হচ্ছে?’
‘ভাল করেই জানি আপনাকে সব খুলে বলা উচিত। কিন্তু আপাতত বলার মত সে-সময় আমার হাতে নেই।’
‘রানার মুখে আপনার কথা শুনেছি। তবে আপনিই যে সেই লোক, সেটা জানব কী করে?’
মেয়েটার পুলিশি সন্দেহপ্রবণ মন জেগে উঠেছে, বুঝে গেছে ওয়াকার। তাই বলল, ‘তা হলে রানার ব্যাপারে এমন কোন তথ্য জানতে চান, যেটা বাইরের কেউ জানে না। আমি জবাব দেব।
একটু ভেবে বলল জেসিকা, ‘বেশ, বলুন তো মরুভূমিতে কী হয়েছিল ওর বোন ক্যারেনের?’
হাসল ওয়াকার। ‘ক্যারেন নামে ওর কোন বোন নেই। তবে লিলিয়ানা নামের এক মেয়েকে বোনের মতই ভালবাসে। তাকে লিবিয়ার মরুভূমি থেকে উদ্ধার করেছিল রানা।’
‘রানার ছোট ভাইয়ের নাম কী?’
ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করে রামিন রেজাকে। এখন আমার সঙ্গেই আছে সে। জেসিকা, দয়া করে আমার কথা বিশ্বাস করুন। হাতে সময় নেই। মহাবিপদে আছেন আপনি।’
চিন্তিত জেসিকা বলল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! ধরে নিলাম আপনার কথা সত্যি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমার কী করা উচিত? আপনি আমাকে কী করতে বলেন?’
‘স্বাভাবিক আচরণ করুন। ওরা আপনাকে লক্ষ করছে।’
‘কারা?’
ওয়াকার স্থির করেছে, কালো মার্সিডিযের লোকগুলোর সম্পর্কে কিছুই জানাবে না। নইলে হয়তো রেগে গিয়ে তাদের .মুখোমুখি হবে জেসিকা। তার চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারে। হয়তো খুনিদের গ্রেফতার করতে গিয়ে মরবে মেয়েটা। ‘আপনার সঙ্গে লাঞ্চে এসেছেন যিনি, তিনি তো আপনাদের স্টেশনে কাজ করেন, তাই না?’
‘লিনা,’ বিস্মিত কণ্ঠে বলল জেসিকা। ‘ও কাজ করে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টে।’
‘তার সঙ্গে মোবাইল ফোন আছে?’
‘আজকাল তো সবার সঙ্গেই থাকে।’
‘ঠিক আছে, এবার ওটা ধার নিন তার কাছ থেকে। সেজন্যে অজুহাত তৈরি করুন। চাইলে বলতে পারেন, ভুলে নিজেরটা বাড়িতে রেখে এসেছেন। অথচ জরুরি কল করতে হবে। এরপর সোজা বেরিয়ে এসে উঠবেন আপনার গাড়িতে। নির্জন কোন এলাকায় চলে যাবেন। তবে বহুদূরে কোথাও নয়। যদি বুঝতে পারেন পিছু নেয়া হচ্ছে, তবুও রেগে গিয়ে কিছু করবেন না, বা কাউকে ফাঁকি দিতে যাবেন না। ভাল মেয়ের মত শান্তভাবে ড্রাইভ করবেন।’
‘কিন্তু একটু পর আমাকে স্টেশনে ফিরতে হবে।’
‘এটা ইমার্জেন্সি, জেসিকা। পরে ঊর্ধ্বতন অফিসারকে বানিয়ে কিছু বলে দেবেন।’
‘মিথ্যা কেন বলব?’
‘কারণ আমি অনুরোধ করেছি। জেসিকা, এটা খুব জরুরি যে বিপদের মাত্রা আপনি যেন বুঝতে পারেন। দয়া করে আমার কথামত কাজ করুন।’
দ্বিধা করল জেসিকা। গোটা ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না ওর। কিন্তু বিষয়টার গুরুত্ব বুঝে গেল। নইলে এখানে হাজির হতো না রানার বন্ধু। নিচু স্বরে বলল জেসিকা, ‘ঠিক আছে, এখান থেকে দশ মিনিটে পৌঁছে যাব জঙ্গুলে এক উপত্যকায়। কখনও কখনও ওখানে জগিং করি। নির্জন এলাকা, কেউ যায় না ওদিকে।’
‘গুড। পৌঁছে যাওয়ার আগে আমার নম্বরে ফোন দেবেন।’ বার্নার ফোনের নম্বর জানাল ওয়াকার।
‘ফোনের নম্বর লিখে নিয়েছি,’ বলল জেসিকা।
‘আপনার কোন বিপদ হবে না,’ প্রতিশ্রুতি দিল ওয়াকার। ‘আমাদেরকে দেখতে না পেলেও খুব কাছেই থাকব আমরা।’
‘কিন্তু বলবেন তো, আসলে এসব কী হচ্ছে?’ অনুনয়ের সুরে বলল জেসিকা।
‘নিশ্চয়ই বলব, জেসিকা,’ বলল ওয়াকার। ‘তবে এখন হাতে সময় নেই। আপনি রওনা হয়ে যান।’
কল কেটে বড় করে শ্বাস নিল ওয়াকার।
‘আপনার কি ধারণা মেয়েটা কথামত কাজ করবে?’ জানতে চাইল রামিন।
‘এ-ছাড়া ওর কোন উপায় নেই, রামিন।’
তিন মিনিট পর পাব থেকে জেসিকাকে বেরোতে দেখল ওরা। চট করে গিয়ে উঠল ল্যাণ্ড রোভারে। চোখ-মুখ শান্ত থাকলেও হাঁটার ভঙ্গি ছিল একটু দ্রুত। এদিক-ওদিক না চেয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে রওনা হয়ে গেল।
‘লক্ষ্মী মেয়ে,’ মৃদু হাসল রামিন।
‘দেখতেও দারুণ। রানার রুচি আছে।’
ডিযেলের ধূসর ধোঁয়া পেছনে ফেলে পার্কিং লট থেকে বেরোল জেসিকার ল্যাণ্ড রোভার। পাঁচ সেকেণ্ড পর হঠাৎ করে ওটার পিছু নিল কালো মার্সিডিয। গাড়িদুটো অনেকটা দূরে চলে যাওয়ার পর ইউ টার্ন নিয়ে অনুসরণ করল ওয়াকার। ওরা বুঝে গেছে, মনে ভয় নিয়ে ড্রাইভ করছে না মেয়েটা।
‘বেশি কাছাকাছি না যাওয়াই ভাল,’ সতর্ক করল রামিন।
‘আমি জানি কী করতে হবে, বাছা।’
ফিরতি পথে পুলিশ স্টেশন পাশ কাটিয়ে গেল জেসিকা। মাইলখানেক গিয়ে বাঁক নিতেই শেষ হলো বাইপাস। পাহাড়ি এলাকায় পাইন গাছের জঙ্গলের মাঝ দিয়ে গেছে মাটির সরু পথ। গোপনে কীভাবে কাছাকাছি থাকতে পারবে, সেটা ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়ল ওয়াকার। সামনের গাড়ির চালকও চাইছে মেয়েটা যেন কিছু টের না পায়। পাহাড়ি পথে দূরত্ব বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে তিন গাড়ির ক্যারাভান।
দশ মিনিট পর ওয়াকারের বার্নার ফোনে এল অপরিচিত ফোনকল। ওটা রিসিভ করে জিজ্ঞেস করল ও, ‘জেসিকা?’
‘পঞ্চাশ গজ পেছনে একটা কালো মার্সিডিয দেখছি।’
পাত্তা দেবেন না। গন্তব্যের কতটা কাছে গেছেন?’
‘এক মিনিট পর পৌছুব,’ বলল জেসিকা। ‘বামে সরু এক পথ গেছে জঙ্গলের ফাঁকা জায়গায়। সবসময় ওখানে গাড়ি রাখি।’
‘বেশ।’ কল কেটে দিল ওয়াকার। গাড়ির গতি বাড়িয়ে বাঁক নিয়ে দেখল ল্যাণ্ড রোভারের পেছনে চলেছে কালো মার্সিডিয। সামনের বাঁকের ওদিকে অদৃশ্য হলো ল্যাণ্ড রোভারের লাল ব্রেক লাইট।
‘পিছু নিলে কৌটোর ভেতরে লুডুর তিনটে গুটি হব,’ মন্তব্য করল রামিন। ‘নড়াচড়ার জায়গা নেই।’
বামে সরু ট্র্যাক দেখে ওদিকে চলল ওয়াকার। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পথ গেছে খাড়া টিলার ওপরে। গর্তে ভরা জমিতে পিছলে যাচ্ছে চাকা। বারবার বিপজ্জনকভাবে কাত হচ্ছে ট্র্যানসিট ভ্যান। যে-কোন সময়ে একদিকে ধুম করে আছড়ে পড়বে। দু’দিক থেকে পাইন গাছের ডালপালা এসে লাগছে ভ্যানের বড়িতে। ছুটন্ত গাড়ির নিচে ঠুংঠাং শব্দে তাল ঠুকছে ছোটসব পাথর। খেপে যাওয়া উন্মাদের মত অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে ভ্যান ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে ওয়াকার।
একটু পর ফোন দিল জেসিকা। ‘ঠিক আছে, পৌঁছে গেছি ঠিক জায়গায়।
‘আপনি কি কালো মার্সিডিযটাকে দেখতে পাচ্ছেন?’
‘না, আপাতত পেছনে কেউ নেই। এবার কী করব?’
‘আপনার ফোন দিয়ে আমাকে কল করুন।’
‘কেন?’
‘তা হলে জানতে পারব কেউ কান পেতেছে কি না।’
‘কী বললেন? এর মানে কী?’
‘কাজটা করুন, জেসিকা। আমি জবাব দেব না। এরপর আপনি পাঠিয়ে দেবেন রানার ফোনে ভয়েস মেইল।’
‘কী বলব তাতে?’
বলবেন, ‘রানা, যোগাযোগ করতে বলেছ? কী হয়েছে, বলো তো?’ উদ্বেগ নিয়ে উঁচু গলায় কথা শেষ করবেন।’
‘আমি সত্যিই দুশ্চিন্তায় আছি। জানিই তো না আসলে কী ঘটছে!’
আমিও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, আনমনে ভাবল ওয়াকার।
‘যা করতে বলেছেন, তা-ই করছি,’ বলল জেসিকা। ‘তবে পরে প্রতিটা ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেবেন।’ কল কেটে দিল মেয়েটা।
এবড়োখেবড়ো জমিতে ছুটে চলেছে ভ্যান। খারাপ পথের জন্যে তৈরি নয় এই গাড়ি। আরও কিছুদূর গিয়ে ওয়াকার বুঝল, ওর ধারণা সঠিক। সামনে হালকা হয়ে গেছে গাছের সারি। টিলার ওপর থেকে নিচে দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের মাঝে বৃত্তাকার মাঠের মত এক জায়গা। ল্যাণ্ড রোভার রেখে ওখানে অপেক্ষা করছে জেসিকা। কড়া ব্রেক কষে ভ্যান থামাল ওয়াকার। ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে বলল, ‘রাইফেলটা নাও! এবার হেঁটে এগোতে হবে!’
বাঙ্কের তলা থেকে ব্যাগ নিয়ে ভ্যান থেকে নামল রামিন। ততক্ষণে রওনা হয়ে গেছে ওয়াকার। সামনে টিলা নেমে গেছে খাড়া প্রাচীরের মত। কিনারায় পৌঁছে ঘাসের ওপরে উপুড় হয়ে শুল ওয়াকার। জঙ্গুলে উপত্যকা বেশ নিচে। বিনকিউলার ব্যবহার করে দূরে দেখল ওদের টার্গেট জেসিকাকে। ওয়াকারের পাশে পৌঁছে বসে পড়ল রামিন, হাতে রাইফেলের ব্যাগ।
‘মেয়েটার হাতে ফোন,’ বলল ওয়াকার। ‘যে-কোন সময়ে কল দেবে।’
কথা শেষ হওয়ার আগেই থরথর করে কাঁপল সাইলেন্ট করা ফোন। কল রিসিভ করল না ওয়াকার। এবার রানার কাছে ভয়েস মেসেজ দেবে জেসিকা। সেক্ষেত্রে হয়তো শত্রুপক্ষ ধরে নেবে রানার সঙ্গে যোগাযোগ করছে মেয়েটা।
এবার যে-কোন সময়ে হাজির হবে ওরা,’ বলল ওয়াকার।
‘আমি যা ভাবছি, আপনিও কি তা-ই ভাবছেন?’ বলল রামিন।
মৃদু মাথা দোলাল ওয়াকার। ‘হ্যাঁ, সময় হয়েছে।’
রাইফেলের পার্টস্ সংযুক্ত করতে এক মিনিটও নিল না রামিন। দেয়ালের মত খাড়া জায়গার আগে ঝুরঝুরে মাটিতে বসিয়ে নিল বাইপড়। শুয়ে পড়ে স্কোপ দিয়ে দেখল ডানে- বামে। হাই-ম্যাগনিফিকেশন লেন্সের কল্যাণে মুহূর্তে খুব কাছে চলে এসেছে জেসিকা। ল্যাণ্ড রোভারের গায়ে কোমর ঠেকিয়ে মোবাইলে ভয়েস মেসেজ দিচ্ছে মেয়েটা। কোনদিকে খেয়াল নেই। রামিন আন্দাজ করল তিন শত ত্রিশ মিটার দূরে আছে মেয়েটা। তবে স্কোপের ইনবিল্ট লেযার রেঞ্জ ফাইণ্ডার জানাল, আধফুট বেশি ভেবে নিয়েছে ও।
অপেক্ষা করল ওরা। ধীরে ধীরে পেরোল তিনটে মিনিট। শত্রুপক্ষ বোধহয় জেসিকার মেসেজ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। যে-কোন সময়ে হাজির হবে। ওয়াকার ভাবল, জঙ্গুলে এলাকায় পেয়ে মেয়েটাকে বোধহয় কিডন্যাপ করতে চাইবে খুনিরা।
শামুক গতি তুলে পেরোল আরও এক মিনিট। তারপর বিড়বিড় করল ওয়াকার, ‘ওই যে, ঘণ্টার কাঁটা তিনটার ওপরে।’
রাইফেলের মাযল দুই ডিগ্রি সরিয়ে নিল রামিন। বিনকিউলার দিয়ে নিচের দৃশ্য দেখছে ওয়াকার। জঙ্গুলে পথে রেঞ্জ রোভারের দিকে এল দুই লোক। নিজেদের ভেতরে কোন কথা বলছে না। প্রতিটি পদক্ষেপে ঝরছে দৃঢ়তা। বেশিক্ষণ লাগবে না জেসিকার কাছে পৌঁছে যেতে। অন্যদিকে ঢেয়ে আছে বলে তাদেরকে দেখছে না মেয়েটা।
লোকদু’জনের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে রাইফেলের বোল্ট টানল রামিন। সড়াৎ শব্দে ম্যাগাযিন থেকে বেরিয়ে চেম্বারে ঢুকল ভয়ঙ্কর শক্তিশালী .৩৩৮ লাপুয়া কান্ট্রিজ। দৈর্ঘ্যে ওটা প্রায় তর্জনীর সমান লম্বা।
বিনকিউলার থেকে চোখ না সরিয়ে বলল ওয়াকার, ‘খুব সাবধান, রামিন।’
‘ভাববেন না। ওদের দু’জনের জন্যে দুশ্চিন্তা করুন।’
‘মরুক শালারা!’
তিন শ’ বা চার শ’ মিটার দূরের টার্গেটে লক্ষ্যভেদ করা কিছুই নয় রামিনের জন্যে। হাঁটতে হাঁটতে গুলি করে শুইয়ে দিতে পারবে যে-কাউকে। না থেমে এই দূরত্বে এক এক করে ফুটো করতে পারবে নারকেল গাছের প্রতিটা ডাব। স্কোপের মাঝ দিয়ে দেখছে লোকদু’জনকে। বামে মোটা লোকটা একটু কাছে। তার বুকেই ক্রস-হেয়ার রাখল রামিন। প্রায় নিঃশব্দে অফ করল সেফটি ক্যাচ।
ত্রিশ কদম গেলেই তারা পৌঁছে যাবে জেসিকার সামনে। এখনও কিছুই জানে না মেয়েটা। অবশ্য তখনই ওর নাম ধরে ডাকল ডানদিকের লোকটা। হঠাৎ চমকে গিয়ে ঘুরে তাকাল জেসিকা, চোখে বিস্ময়। লোকগুলোকে দেখে পকেটে হাত পুরল।
ওয়াকারের মনে হলো, জেসিকা বের করছে পুলিশ ওয়ারেন্ট কার্ড। ঠোঁট নড়ছে ওর। এতদূর থেকে কিছুই শোনা গেল না। হয়তো বলছে: ‘আমি পুলিশ অফিসার! আর এক পাও এগোবেন না!’
নির্বিকারভাবে জেসিকার দিকে হেঁটে চলেছে তারা।
‘মিস কোরো না, বাছা,’ বিড়বিড় করল ওয়াকার।
‘এত কম রেঞ্জে?’ মাথা নাড়ল রামিন।
আরও এক পা এগোল লোকগুলো।
তারপর আরেক পা।
পিস্তল বের করতে জ্যাকেটের পকেটে হাত ভরল তারা। ঝট্ করে বের করল অস্ত্রদুটো। সরাসরি মাযল তাক করেছে জেসিকার বুকে। আবারও কথা বলল ডানদিকের লোকটা। পিস্তল দেখে চমকে গেছে জেসিকা।
‘সময় নেই, রামিন,’ নিচু স্বরে বলল ওয়াকার।
তখনই মোটামত লোকটার মাথার পাশে ভুস্ করে ভেসে উঠল লালচে মেঘ। কাত হয়ে ধড়াস্ করে মাটিতে পড়ল সে।
কাঁধে রিকয়েল মিলিয়ে যাওয়ার আগেই বোল্ট পিছিয়ে নিয়ে আবারও সামনে ঠেলল রামিন। চেম্বারে ঢুকেছে লাপুয়া গুলি। সঙ্গীর তাজা রক্ত আর মগজের ধূসর পদার্থে মেখে গেছে দ্বিতীয়জনের মুখ। এতই হতভম্ব, নড়তে পারল না। যন্ত্রের মত তার মাথায় ক্রস-হেয়ার এনে ট্রিগার স্পর্শ করল রামিন।
উত্তপ্ত ব্যারেলের ভেতর দিয়ে গুলি গেলে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করা কঠিন। রামিন যেখানে চেয়েছে, তার সিকি ইঞ্চি দূরে বিধল দুই নম্বর বুলেট। তাতে মন খারাপ হলো ওর। অবশ্য উড়ে গেছে লোকটার করোটির একপাশ। হাই- ভেলোসিটি বুলেট ছিটিয়ে দিয়েছে হাড়ের গুঁড়ো, মাংস ও রক্তের লালচে বাষ্পের মত মেঘ। ধুপ করে মাটিতে পড়ল লাশ।
‘সত্যিই চমৎকার লক্ষ্যভেদ!’ মন্তব্য করল ওয়াকার।
মাথা নাড়ল রামিন। ‘মাসুদ ভাই হলে ঠিকমত লাগিয়ে দিতেন।’
বিনকিউলারের মাধ্যমে জেসিকাকে দেখল ওয়াকার। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে দুই লাশ দেখছে বেচারি।
‘এবার ওকে গিয়ে বলবে, এদেরকে খুন না করে আমাদের কোন উপায় ছিল না,’ বলল ওয়াকার। ‘পরে সবই ওকে বুঝিয়ে বলব। আপাতত একটা ফোন করতে হবে, ওটা জরুরি।’
টিলা থেকে নেমে জেসিকার সামনে গিয়ে থামল ওরা। ওয়াকার আর নিজের পরিচয় দিল রামিন
একবার হাতঘড়ি দেখে নিল ওয়াকার।
এখন বাজে দুপুর একটা একত্রিশ।