একত্রিশ
স্কটল্যাণ্ডের পাহাড়ি গ্রাম কিনলোকার্ড।
সাড়ে পাঁচঘণ্টা আগের কথা।
এইমাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে ল্যাণ্ড রোভারে চেপে অফিসের দিকে রওনা হয়েছে জেসিকা। দেরি না করে ওর পিছু নিয়েছে কালো মার্সিডিয-বেনযের লোকগুলো। পার্কের কাছে আগের মতই রয়ে গেছে প্লামারের ভ্যান। এখন জেসিকাকে অনুসরণ করলে সন্দেহ করবে নকল প্লামারেরা, তাই বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করছে ওয়াকার ও রামিন। উদ্বিগ্ন হলেও কিছুই করার নেই ওদের।
সকাল সাতটা বাইশে ট্র্যানসিট ভ্যানের পেছনের দরজা খুলে নেমে পড়ল ওয়াকার। এ-মুহূর্তে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ওকে দেখতে পাবে না প্লামারের ভ্যানের লোকগুলো। ফুটপাথ ধরে কিছুদূর গিয়ে পার হয়ে গেল রাস্তা। চট্ করে ঢুকে পড়ল দুই বাড়ির মাঝের সরু গলিতে। বাড়িগুলোর পেছনদিকে সাদা রঙ করা কাঠের পলকা বেড়া। একপাশের বেড়া টপকে এগোল ওয়াকার। বাড়িগুলোর পেছনের জানালায় ঝুলছে ভারী পর্দা। এত সকালে ঘুম থেকে ওঠেনি কেউ, তাই নিজের বাগানে অচেনা লোক দেখে রেগে উঠল না।
মিনিট তিনেক পর এক বাড়ির মেইন গেট খুলে সহজ ভঙ্গিতে পথে বেরিয়ে এল ওয়াকার। প্লামার ভ্যানের লোকগুলোর জানার কথা নয়, ও আসলে এ-এলাকার কেউ নয়। তারা দেখুক, সেটা চাইছে ওয়াকার। রাস্তায় বসে বুটের ফিতা বেঁধে নেয়ার ভঙ্গি করল। তারপর সোজা গিয়ে চাপল ট্র্যানসিট ভ্যানের ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে পেছনে ফেলল জেসিকার বাড়ি ও প্লামার ভ্যান। বাঁক নিয়ে পৌঁছে গেল গ্রামের মুদি দোকানের সামনে। ওখান থেকে কিনল দরকারি কিছু রসদ। এরপর তীরবেগে গাড়ি চালিয়ে পৌছে গেল দক্ষিণে ফোর্ট উইলিয়ামে। মাঝপথে জেসিকাকে কিডন্যাপ করা না হয়ে থাকলে শহরের পুলিশ স্টেশনেই এখন থাকার কথা মেয়েটার।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত রামিন বলল, ‘আমরা কোন ভুল করছি না তো?’
‘অত ভেবো না,’ বলল ওয়াকার। ‘ওকে কিডন্যাপ করলে সেটা রাতেই করত।’
‘তবুও পুলিশ স্টেশনে ওর গাড়ি না দেখা পর্যন্ত স্বস্তি পাব না।’
শহরে পুলিশ-স্টেশনের একদিকে কুয়াশাময় টিলা, অন্যদিকে ঝোপঝাড়ে ভরা মাঠ। থানার পাশে গাড়ি রাখার বিশাল পার্কিং। সকাল আটটায় ওটা পাশ কাটাবার সময় গাড়ির গতি কমিয়ে রামিনকে ওদিকটা দেখার সুযোগ করে দিল ওয়াকার।
অফিসার ও স্টেশনের স্টাফদের বেশকিছু গাড়ি আছে পার্কিং লটে। জেসিকার কলিগরা কিনেছে নতুন মডেলের গাড়ি। সেসবের ভেতরে দেখা গেল কাদামাখা ল্যাণ্ড রোভার। একটু দূরেই পার্ক করা হয়েছে কালো মার্সিডিয-বেন। জানালা টিনটেড বলে বোঝা গেল না ভেতরে কেউ আছে কি না। ওয়াকার ও রামিনের ধারণা, ওই গাড়িতে বসে স্টেশনের ওপরে নজর রাখছে অন্তত দু’জন।
আরও কিছুদূর গিয়ে ওয়াকার দেখল সামনে মেরামত করা হচ্ছে রাস্তা। একপাশে মেশিনারি, পাথর, বালু ও আলকাতরার ড্রাম। ওখানে ট্র্যানসিট ভ্যান রাখলে সন্দেহ করবে না কেউ। নুড়িপাথরের উঁচু এক স্তূপের কাছে থামল ওয়াকার।
‘কপাল ভাল যে জেসিকা পৌছে গেছে,’ বলল রামিন। ‘আমরাও হাজির। অথচ জানি না কীভাবে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করব।’
‘যা করার করতে হবে মাথা খাটিয়ে,’ বলল ওয়াকার। পেটমোটা এক ব্যাগ থেকে নিল দুটো স্যাণ্ডউইচ। ‘নাস্তা করবে না?’
‘আপনার থলেতে আর কী আছে?’
‘স্যাণ্ডউইচ দিয়ে শুরু করো। পরে পাবে বিফ বার্গার আর চারটে সেদ্ধ ডিম। সবশেষে এক বোতল কোক।’
চুপচাপ নাস্তা সেরে নিল ওরা। আলাপ করে নিয়েছে, পালা করে চোখ রাখবে পুলিশ-স্টেশনের ওপরে। সেজন্যে ব্যবহার করবে ওয়াকারের বন্ধু জো ডিগবার্টের বিনকিউলার। গাড়ি নিয়ে স্টেশনে আসছে অনেকে। একটু পর আবার বিদায় নিচ্ছে। কারও পরনে ইউনিফর্ম, আবার কেউ সিভিলিয়ান ড্রেসে। একবারের জন্যেও স্টেশন থেকে বেরোল না জেসিকা। কালো মার্সিডিয থেকেও নামল না কেউ। ওই গাড়িতে যারা বসে আছে, হয়তো ধরে নিয়েছে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসবে না কেউ।
দুপুর ঘনিয়ে এলে সোনালি সূর্যটা ঢালতে লাগল গনগনে আগুন। ভ্যানের ভেতরটা হলো হাবিয়া দোজখের মত উত্তপ্ত। আগের সেই ব্যাগ থেকে বড় দুটো পানির বোতল নিল ওয়াকার। ‘গলা শুকিয়ে মরে যাওয়া কোন কাজের কথা নয়, কী বলো, রামিন?’
একটা বোতল নিয়ে চারভাগের একভাগ পানি গলায় ঢালল রামিন। ধীরে ধীরে পেরোতে লাগল সময়। সাড়ে বারোটায় কনুই দিয়ে ওয়াকারের কোমরে গুঁতো দিল ও।
ওই যে দেখুন, বেরিয়ে আসছে।’
জেসিকার সঙ্গে আছে লালচে চুলের এক মেয়ে। পরনে সিভিলিয়ান’ ড্রেস। জেসিকা এখনও পরে আছে রেইন কোট, মাথায় ক্যাপ। রামিনের কাছ থেকে বিনকিউলার নিল ওয়াকার। স্টেশন থেকে বেরিয়ে বান্ধবীকে নিয়ে কার পার্কিঙে ঢুকল জেসিকা। পাহাড়ি হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে দীর্ঘ কালো চুল। কী নিয়ে যেন হাসছে দুই বান্ধবী।
‘বেচারি জানে না, ওর পিছু নিয়েছে একদল খুনি,’ বলল ওয়াকার।
‘যাচ্ছে কোথায়?’ আনমনে বলল রামিন।
‘বোধহয় দুপুরের খাবার সেরে নেবে কোন রেস্টুরেন্টে।’
‘স্টেশনে স্টাফ ক্যান্টিন নেই?’
‘কখনও পুলিশ ক্যান্টিনে খেয়ে দেখেছ?’ তিক্ত হাসল ওয়াকার। ‘আমার কপাল ভাল, তাই আজও বেঁচে আছি।’
‘রান্না এতই খারাপ?’
‘ওদের দেয়া মাংস হচ্ছে কয়েক শ’ বছর আগের কারও খুলে রাখা বুটের সুখতলি। আর রুটি মানেই হাজার বছরের ফাঙ্গাস পড়া কাঠের টুকরো।’
বান্ধবীকে নিয়ে গাড়িতে উঠল জেসিকা। একরাশ ধূসর ধোঁয়া ছেড়ে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে গেল ল্যাণ্ড রোভার। ওটা স্টেশনের মেইন গেটের কাছে যেতেই চালু হলো কালো মার্সিডিয-বেনযের ইঞ্জিন। জেসিকার পিছু নিল লোকগুলো। গাড়িদুটো স্টেশন থেকে বেরোতেই ট্র্যানসিট ভ্যান নিয়ে অনুসরণ করল ওয়াকার। নিচু গলায় বলল, ‘দেখা যাক, এবার কী করতে পারি।’
বাইপাসে পৌঁছে বামে বাঁক নিল জেসিকা। এক শ’ গজ দূরে থাকল মার্সিডিয। ওটা থেকে পঞ্চাশ গজ পেছনে রইল ওয়াকার। রাস্তায় গাড়ির ভিড় নেই। সামনে রাউণ্ডঅ্যাবাউট। আবার বামে বাঁক নিয়ে শহর লক্ষ্য করে চলল জেসিকা। তাড়া নেই ওর। সিকি মাইল গিয়ে ঢুকল আরেক পার্কিং লটে। ওটার পেছনদিকে আছে থার্স্টি নামের এক পাব।
এখন বাজে দুপুর বারোটা পঁয়ত্রিশ। উপাদেয় লাঞ্চ বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা তুলছে থার্স্টি পাবের মালিকপক্ষ। ফাঁকা টেবিল পেয়ে বান্ধবীকে নিয়ে বসল জেসিকা। এরই ভেতরে পার্কিং লটে ঢুকেছে কালো মার্সিডিয। থার্স্টি পাব পেছনে ফেলে ষাট গজ গিয়ে পথের ধারে থামল ওয়াকার। ভিড়ে ভরা পাবে জেসিকা ও ওর বান্ধবীকে ঢুকতে দেখেছে ওরা। নিজেরা নামল না গাড়ি থেকে।
‘এবার?’ বলল রামিন। ‘ধারেকাছেও তো যেতে পারব না। চুম্বকের মত সেঁটে আছে লোকগুলো। খাবার শেষ করে আবার ফিরবে পুলিশ-স্টেশনে। অর্থাৎ, পুরোটা সময় পণ্ডশ্রম হচ্ছে।’
‘তা নয়, মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে,’ বলল ওয়াকার।
‘বলে ফেলুন।’
‘আরেকটু অপেক্ষা করো। খেতে শুরু করুক, তারপর জাদু দেখিয়ে দেব।’
‘অপেক্ষা না হয় করলাম,’ বলল রামিন, ‘কিন্তু বলবেন তো কী করতে চান!
‘অধৈর্য হয়ো না, নিজেই দেখবে। হয়তো মিটে যাবে সব ঝামেলা।’
জেসিকা পাব-এ ঢোকার সাত মিনিট পর হাতঘড়ি দেখল ওয়াকার। বাজে বারোটা বেয়াল্লিশ। পকেট থেকে বার্নার ফোন বের করল ও।
ওটা দেখে সতর্ক হলো রামিন। ‘করেন কী! ভুলে গেছেন, ওর সঙ্গে কথা বলা যাবে না? সব জেনে যাবে তারা!’
মৃদু হেসে বলল ওয়াকার, ‘ওকে ফোন দিচ্ছি না।’