1 of 2

কিলিং মিশন – ২৯

ঊনত্রিশ

দরজা পেরিয়ে ছোট এক বুটরুমে ঢুকেছে রানা ও ফক্স। দুই দেয়ালের হুকে ঝুলছে কয়েকটা পোশাক। ঘরের একপাশে ছোট্ট বেসিন ও অপরিষ্কার কাপড় রাখার বেতের বাস্কেট ফক্সের কথা ঠিক, এসে কামড়ে দিল না কোন কুকুর। পরের ঘরটা সাজানো এক কিচেন। র‍্যাকে ওয়াইন ও গোটা বিশেক দামি উইস্কির বোতল। ভাবল রানা, শয়তান-পূজারী হলেও রুচি আছে লোকটার। কিচেনের আরেক দরজার ওদিকে করিডর। কোথাও কেউ নেই। দোতলা থেকে এল ক্লাসিকাল মিউযিকের মৃদু আওয়াজ। করিডরে ভোঁতা টিক-টিক শব্দে চলছে পুরনো এক বিশাল গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লক।

রানা ভেবেছিল দোতলায় পাবে হ্যারিসকে, তবে ওর ধারণা সঠিক নয়। সিঁড়ির কাছে করিডরে তাকে পেল ওরা। ঘরের দরজার কাঁচ ভেদ করে রোদ এসে পড়েছে করিডরে। সেই আলোয় ওরা দেখল, উপুড় হয়ে আছে লোকটা। পাশে রক্তের লাল পুকুর।

একপলকে রানা বুঝল, আর বেঁচে নেই হ্যারিস। বেসবল ব্যাট বা লোহার পাইপ দিয়ে চুরমার করা হয়েছে তার মাথার পেছনদিক। তাতেই ক্ষান্ত হয়নি খুনি। অন্তত ছয়বার প্রচণ্ড জোরে মেরেছে নাকে-মুখে-কপালে। ফাটা টমেটোর মত ছেঁচে গেছে লাশের নাক। অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে গলে যাওয়া ডান চোখ। মুখের পাতলা ত্বকের কারণে এখনও ঝুলছে নিচের ভাঙা চোয়াল। মানুষটার ওপরে হামলা করা হয়েছে চকিতে এবং নির্দয়ভাবে।

‘শালা তো দেখি মরে ভূত হয়ে গেছে,’ বলল ফক্স।

পাল্স্ পাবে না জেনেও বসে লাশের ঘাড়ে আঙুল রাখল রানা। মৃতদেহের ত্বক এখনও উষ্ণ। একবার হাতঘড়ি দেখল রানা। বাজে বারোটা বিশ। হ্যারিস খুন হয়েছে বড়জোর আধঘণ্টা আগে। উঠে দাঁড়াল রানা। মনস্থির করেছে, এবার সার্চ করবে প্রতিটি ঘর। বাড়িতে হয়তো রয়ে গেছে খুনি। যে-কোন সময়ে তার তরফ থেকে আসবে আক্রমণ।

ফক্সকে ওপরতলা সার্চ করতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে রানা তল্লাসী করতে গেল নিচতলার ডাইনিংরুম, বেডরুম, ড্রইংরুম, লিভিংরুম ও বাথরুম। পাঁচ মিনিটে বুঝে গেল, নিচে কেউ নেই। লিভিংরুমে ইন্টারনেটের প্রধান সংযোগ খুলে রাখা হয়েছে। রানার মনে হলো, নিজেই বোধহয় এ- কাজটা করেছে হ্যারিস। কিন্তু কেন করেছে, তার কোন ব্যাখ্যা পেল না ও।

একটু পর দোতলা থেকে এল ফক্স। ‘ওপরে কেউ নেই।’

‘এখানেও নেই।’

‘বাড়ি থেকে কিছু সরিয়ে নিয়েছে বলেও মনে হচ্ছে না, বলল ফক্স। ‘এজেন্সি বোধহয় বদলে নিয়েছে তাদের প্ল্যান। অথবা…’

ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল রানা, ‘এরই ভেতরে সব ধরনের প্রমাণ নষ্ট করতে রওনা হয়েছে তাদের অন্য দলটি।’

‘কাজে তারা দক্ষ,’ বলল ফক্স। ‘বলে রাখি, তাদের কাছে অস্ত্র নেই, সেটা ধরে নিলে আমরা ভুল করব।’

শত্রুর সঙ্গে দেখা হলে লড়তে হবে, যেটা চাইছে না রানা। ওর মনে হলো, এবার বোধহয় বিদায় নেয়া উচিত। কিন্তু গতরাতে ফক্সের একটা কথা মনে পড়ল।

টার্গেট খুন হওয়ার পর হাজির হয় অন্য দলটি। পুলিশকে জুগিয়ে দেয় নকল প্রমাণ। সরিয়ে নেয় টাকা, তথ্য, ডেটা ফাইল বা অন্যসব জরুরি জিনিসপত্র।

‘ওরা এসে কী করবে?’ জানতে চাইল রানা।

‘জানি না। আগেই বলেছি, আমার কাজ ছিল খুন করা।’

‘হ্যারিস যেহেতু দলের সদস্য, তাই ওর কাছে হয়তো জরুরি কোন প্রমাণ ছিল। আর সেটা আছে এ-বাড়িতেই।’

‘অসম্ভব নয়। কিন্তু সেসব খোঁজার মত সময় আমরা পাব না।’

দোতলা ঘুরে এসেছে ফক্স, তাই বলল রানা, ‘স্টাডিরুমে কী দেখলে?’

‘বিশাল বুক-শেল্‌ফ্, কফি মেকার, ডেক-সেট, ডেস্ক, চেয়ার, কমপিউটার, ফাইলিং কেবিনেট— এসব।’

‘চলো, ওখান থেকে ঘুরে আসি।’

ঝড়ের বেগে সিঁড়ি বেয়ে উঠল ওরা। স্টেয়ারওয়ের জানালা দিয়ে দেখল বাগান ও ড্রাইভওয়ের দূরে মেইন গেট। এখনও এ-বাড়িতে পৌঁছায়নি কেউ। ওরা উঠে এল গ্যালারি করা ল্যাণ্ডিঙে। ডানে হ্যারিসের স্টাডিরুম। ওটা সিঁড়ির সবচেয়ে কাছের ঘর।

ফক্সের পর ওখানে ঢুকল রানা। আইনী, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক বইয়ে ভরা শেল্‌ফ্। পাশে ডেক- সেট ও কফি মেশিন। শেষেরটা থেকে আসছে দামি কফির সুবাস। ডেস্কে আধখালি কাপ। মনোযোগ বাড়াবার জন্যে সিডির মিউযিক বন্ধ করল রানা। আধখোলা জানালার কাছেই খয়েরি চামড়ায় ছাওয়া অ্যান্টিক ডেস্ক। দোতলার জানালা দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত দেখা গেল গ্রাম্য প্রাকৃতিক সবুজ দৃশ্য। ডেস্কের ওপরে স্লিপ মোডে আছে চার হাজার তিন শ’ ডলার দামের ডালাবন্ধ চকচকে কালো রেযার ব্লেড ১৭ ল্যাপটপ। টিপটিপ করছে মেইন পাওয়ারের বাতি। ঘরে আর কোন কমপিউটার নেই।

গুছিয়ে রাখা ডেস্কের বামে টেবিল-ল্যাম্প, ডানে পুরনো আমলের ডায়াল টেলিফোন। এসবের ভেতরে খুব অগোছালো লাগল আধ-খাওয়া কফির কাপ ও নোংরা তশতরি। কফিতে আঙুল ডুবিয়ে তাপ দেখল রানা। বুঝে গেল, আন্দাজ বিশ মিনিট আগে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে কোন কারণে নিচে নেমে গেছে হ্যারিস। হয়তো শুনেছে অস্বাভাবিক কোন আওয়াজ। ফক্স বা ও বাড়িতে ঢুকলে কিছুই শুনত না সে।

ডালা খুলতেই জেগে গেল ল্যাপটপ। স্ক্রিনের মাঝে রঙিন বক্সে হ্যারিসের শেষ ডকুমেন্টের নাম। বক্সের নিচে চাওয়া হচ্ছে এনক্রিপ করা ফাইলের পাসওয়ার্ড। রায়হান রশিদের কথা মনে পড়ল রানার। ও থাকলে জাদুর মত খুলে নিত ফাইল। কপালমন্দ, ছেলেটা আছে ভারতে। বক্সের লেখার দিকে তাকাল রানা। ওখানে লেখা: দ্য হ্যাভোক ক্লাব.

পেছন থেকে বলল ফক্স, ‘দ্য হ্যাভোক ক্লাব। এর মানেটা কী?’

‘জানি না।’

‘অদ্ভুত নাম তো!’

মনে মনে ফক্সের সঙ্গে একমত হলো রানা। বুঝে গেছে, এ-মুহূর্তে এসব ভাবার সময় ওদের নেই। কমপিউটার কোন কাজে আসবে না। ব্যস্ত হয়ে ডেস্কের ড্রয়ার ঘাঁটল রানা। হ্যারিসের শয়তান-পূজার পোশাক পরা ছবি বা ফোনবুকে দলের কারও নম্বর পাবে ভেবেছিল, কিন্তু তেমন কিছুই নেই। পর পর আটটা ড্রয়ার ঘেঁটেও রিসিট, ইন্স্যুরেন্স ও গাড়ির ডকুমেণ্ট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। অবশ্য নয় নম্বর ড্রয়ারের দিকে হাত বাড়াতেই রানা শুনতে পেল ঝিরঝিরে শব্দ। ভাইব্রেট করছে মোবাইল ফোন। ড্রয়ার টেনে খুলতে গিয়ে রানা বুঝল, ওটা তালাবদ্ধ। ফক্সের দিকে তাকাল। ‘ছোরাটা সঙ্গে আছে না?’

ওর হাতে স্টিলেটো দিল ফক্স। ড্রয়ার ও টেবিলের মাঝের সরু ফাঁকে ছোরার ডগা ভরে চাড় দিল রানা। দক্ষ কাঠমিস্ত্রির তৈরি দামি কাঠের ডেস্ক। ড্রয়ার খোলার আগেই থেমে গেল মোবাইল ফোনের ভাইব্রেশন।

একটু পর ফাটল বড় করে ড্রয়ার খুলল রানা। টুকটাক জিনিসপত্রের ভেতরে আছে কমদামি এক স্যামসাং মোবাইল ফোন। এ-ধরনের ডিভাইসের জন্যে ইউরোপে রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক নয়। হ্যারিস নামকরা মানুষ হলেও এত কমদামি ফোন কেন ব্যবহার করত ভেবে বিস্মিত হলো রানা। স্ক্রিন অন করতেই দেখল, ভয়েস মেসেজ দিয়েছে কেউ। ফক্স যেন শুনতে পায়, সেজন্যে স্পিকার চালু করে বাটন টিপল রানা।

‘হ্যালো, লণ্ডনের ম্যাণ্ডক অ্যাণ্ড কার্ক লিটারারি এজেন্সির ডিরেক্টর রোহান কার্ক বলছি। দ্য হ্যাভোক ক্লাব বিষয়ে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আপনার জন্যে একটি দুঃসংবাদ আছে। আমার কলিগের ধারণা, অভিযোগমূলক আপনার বইটি আমাদের জন্যে উপযোগী নয়। ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় অবলম্বন করে রচনা করা হচ্ছে ওটা, ফলে এ-বিষয়ে আমরা আগ্রহী নই। যদিও জানি আর্থিক সাফল্য পাবে আপনার বইটি।’

চুপ হয়ে গেলেন কার্ক। রানার মনে হলো দ্বিধা আছে তাঁর গলায়। বলবেন আরও কিছু। কয়েক মুহূর্ত পর বললেন, ‘জানি, আপনি হতাশ হয়েছেন। আমি নিজেও হতাশ। বলতে দ্বিধা নেই, আমি চেয়েছি আপনার বইটি। তবে রাজি হলেন না আমার সিনিয়র পার্টনার। তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনার দুর্দান্ত বইটি আমরা প্রকাশ করতে পারছি না। যদিও জানি, অন্যান্য লিটারারি এজেন্সি ওটা লুফে নেবে। আশা করি ভালভাবে সমাপ্ত হবে আপনার প্রজেক্ট। ভাল থাকুন, স্যর।’

মেসেজ শেষ।

কার্ক কী বলেছেন বুঝে গেছে রানা। বিপজ্জনক ধাঁচের বই রচনা করছিল হ্যারিস। ম্যাণ্ডক অ্যাণ্ড কার্ক লিটারারি এজেন্সির সিনিয়র পার্টনার ওটা নিয়ে কাজ করতে চাননি। কার্ক তাতে হতাশ হন। সেটা প্রকাশও করেছেন মেসেজে। হয়তো এই বই নিয়ে তিক্ততাও তৈরি হয়েছে দুই পার্টনারের ভেতরে।

ইংরেজি বইয়ের জগৎ সম্পর্কে যতটা জানে রানা, তাতে সফল একজন লেখক সম্মানী হিসেবে পান শত কোটি টাকা। প্রকাশকের কাছ থেকে তাঁর এজেন্ট পেয়ে থাকেন লাখ লাখ ডলার। মেলা টাকা পাবেন জেনেও এসবে নিজেদেরকে জড়াতে চাননি ম্যাণ্ডক। বইটা প্রকাশ করা হলে ভয়ঙ্কর আলোড়ন তৈরি হবে, সেটা ভেবেছিল হ্যারিস।

কেন বাড়িতে ইন্টারনেট কানেকশন নেই, এখন বুঝে গেছে রানা। হ্যারিসের ভয় ছিল হ্যাক হবে তার বই। একই কারণে ব্যবহার করত বার্নার ফোন। যদিও শেষমেশ গোপনে রাখতে পারেনি কিছুই।

‘লোকটা বই লিখছিল,’ বলল ফক্স। ‘মেয়েদেরকে জবাই হতে দেখে আর আগের মত ফুর্তি হচ্ছিল না মনে। বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে শেষে মরে ভূত হয়ে গেছে।

‘ওর বই অভিযোগমূলক,’ বলল রানা। ‘কিন্তু সেটা কাদের বিরুদ্ধে?’

‘ডকুমেণ্ট খুলতে পারলে বুঝতে পারতাম,’ বলল ফক্স। ‘কেউ জানত ওটার কথা, পকেটে মোবাইল ফোন পুরল রানা। ল্যাপটপ অফ করে টেবিলের নিচে সকেট থেকে খুলে নিল ওটার কেবল। মেশিনটা গুঁজল বগলে। ভাবল এবার বলবে, ‘চলো, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাই।’ কিন্তু তখনই জানালা-পথে শুনল গাড়ির শক্তিশালী ইঞ্জিনের ঘড়-ঘড় শব্দ। নুড়িপাথরে কড়মড় আওয়াজ তুলছে পুরু চাকা। দোতলার কাঁচের জানালা দিয়ে নিচে তাকাল রানা।

বাড়ির কাছেই থেমেছে বড়সড় এক লাল গাড়ি। ওটার উইণ্ডশিল্ড ও টিনটেড জানালায় লেগে ঝিক্ করে উঠল সূর্যের সোনালি রোদ। দেখা গেল না ভেতরে কারা আছে। পাঁচ সেকেণ্ড পর দরজা খুলে নামল, তিনজন লোক। দরজার দিকে হেঁটে এল দৃঢ় পায়ে। শরীরের গড়ন তাদের শক্তপোক্ত। বয়স হবে পঁচিশ থেকে ত্রিশ। মাথায় ক্রু-কাট চুল। পরনে নীল জিন্স। মুখে আগ্রাসী ভাব। তৃতীয়জন অন্যদের চেয়ে লম্বা। বামহাতে ‘ফোলা ব্যাগ, ডানহাতে স্লেজহ্যামার। সবার হাতেই চামড়ার গ্লাভ্স্। প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করতেই এই বাড়িতে এসেছে এঁরা। এবার দরজা খুলে ঢুকবে সামনের ঘরে।

রানা বুঝে গেল, সিঁড়ি বেয়ে আর নেমে যেতে পারবে না ওরা। আটকা পড়েছে বাড়ির দোতলায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *