উনিশ
‘অথচ বলেছিলেন আমাকে খুন করবেন না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল উইলবার ফক্স।
‘এবং সেটা জানবে না অ্যালেক্যাণ্ডার লিয়োনেল,’ বলল রানা। ‘সে ভাবছে, তোমার লাশের ছবি তুলে তার কাছে পাঠাব।’
এই কাজে পাঠাবার আগে ওকে কী বলা হয়েছে, সেটা জানাল রানা। সত্যিই ফক্স খুন হলে, তার লাশ নিজের চোখে দেখার জন্যে দলের কাউকে এখানে পাঠাবে লোকটা।
‘কিন্তু খুন হয়ে গেলে আবার বাঁচব কী করে, বলুন?’
কী যেন ভাবছে রানা। হঠাৎ তর্জনী তুলল ফক্সের সোনার দাঁতের দিকে। ‘আগে জিজ্ঞেস করিনি, ওগুলো বোধহয় বেশ দামি?’
এ-প্রশ্নে অবাক হয়েছে ফক্স। মাথা দোলাল। ‘তখন টাকার বড্ড খ্যাচ। তবুও ইংল্যাণ্ডের সেরা ডেন্টিস্টের কাছে গেছি।’
‘বিশেষভাবে তোমার জন্যে তৈরি?’
‘এই জিনিস আর পাবেন না।’
এখন তো তোমার টাকার অভাব নেই,’ বলল রানা। ‘বিপদের কথা ভেবে পরে বোধহয় আরও দুই পাটি দাঁত তৈরি করে নিয়েছ?’
যে দুই পাটি দাঁত পরে আছি, সোনা ও টাইটেনিয়ামের তৈরি এই একই আরেক সেট আমার কাছে আছে।’ হোল্ডঅল দেখাল ফক্স।
‘তোমার উচ্চতা কি পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি, ফক্স?’
মাথা দোলাল প্রাক্তন সৈনিক। ‘পাঁচ ফুট সাড়ে দশ। আপনার চেয়ে আধ ইঞ্চি কম।’
ওজন বোধহয় আন্দাজ এক শ’ পঁচাশি পাউণ্ড?’
‘প্রায় তা-ই। এক শ’ আশি।’
‘সেক্ষেত্রে তোমার মতই কাউকে চাই।’ বাটির মত নিচু জায়গার পাশে মৃত আঁকশিওয়ালাকে দেখাল রানা। ‘ও কোন কাজে আসবে না। হাতের বদলে আঁকশি দেখলে সব বুঝে যাবে ব্রিটিশ লোকটা।
রানা কী ভাবছে বুঝে গেছে ফক্স। ‘আপনি বোধহয় আমার ডিকয় হিসেবে কাউকে ব্যবহার করতে চান।’
‘ভাগ্য ভাল হলে তোমার সঙ্গে মিলবে তার দেহের গড়ন। ওরা পরীক্ষা করতে গিয়ে চট্ করে কিছু বুঝবে না। একইঞ্চি উচ্চতার কমবেশি বা সামান্য ওজন সমস্যা করবে ‘না।’
‘বুঝতে পেরেছি কী চান।’ দুষ্টু হাসল ফক্স। ‘জঘন্য কাজ, বস্। তবে তাতে কাউকে বোকা বানাতে পারবেন?’
‘খুব বেশি কিছু আশা করছি না,’ বলল রানা। ‘হয়তো সোনার দাঁত দেখেই সন্তুষ্ট হবে। আবার ভাগ্য মন্দ হলে তোমার অ্যাপার্টমেন্টে রেখে আসা স্যাম্পলের সঙ্গে ডিএনএ মিলিয়ে দেখবে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়ব আমরা।’
‘সেক্ষেত্রে এত খেটে আর লাভ কী!’
‘তবুও সামান্য সময় পাব। অন্তত একটা দিন ওরা আমাদের চালাকি বুঝবে না।’
‘একেবারেই কম সময়,’ বলল ফক্স।
‘কিন্তু ততক্ষণে আমাকে তুমি পৌঁছে দেবে তাদের আস্তানায়,’ বলল রানা।
দ্বিধায় পড়ল ফক্স। ‘ততক্ষণ বাঁচবে আপনার বান্ধবী? একবার স্কটল্যাণ্ডে ফোন গেলেই তো সে শেষ। অ্যালান শ’র পাঠিয়ে দেয়া খুনিরা কখনও কাজে ভুল করে না।’
রানা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘যাতে ফোন না করে, সেটা নিশ্চিত হতে হবে। সেজন্যেই দেরি না করে আক্রমণে যাব।’
‘কিন্তু সত্যিই যদি ফোন করে, তখন কী করবেন, বস্?’
‘আপাতত ওটা নিয়ে ভাবছি না।’
‘অর্থাৎ, আপনার হাতে আর কোন তাস নেই।
‘সত্যিই নেই,’ স্বীকার করল রানা। ‘এসো, দেখা যাক ভালভাবে সব কাজ আমরা শেষ করতে পারি কি না।’
চাঁদের আলোয় খুঁজতে গিয়ে ওরা দেখল, পাথুরে ঢালে ফক্স শেষ করে দিয়েছে পাঁচ স্প্যানিয়ার্ডকে। রানার গুলিতে মরেছে হুকওয়ালা। তাকে ধরে দলে তারা ছয়জন। আরও কেউ থাকলে আগেই ভ্যান নিয়ে পালিয়ে যেত।
ছয়টা লাশ জড় করতে গিয়ে সময় লাগল রানা ও ফক্সের। জঙ্গুলে, গভীর এক খাদে লাশ রেখে একে একে তাদের আকার ও উচ্চতা দেখল ওরা।
‘একেই আমার চাই,’ একটা লাশ দেখাল ফক্স।
নীরবে সায় দিল রানা। ফক্সের আধইঞ্চি খাটো এই স্প্যানিয়ার্ড। ওজনে হবে দশ পাউণ্ড বেশি
জঙ্গুলে খাদে লাশগুলোর পাশে তাদের রাইফেল-বন্দুক রাখল ওরা। খুঁজলে দু’একদিন পর লাশ পাবে কেউ। ফক্সের ডিকয়ের ওয়ালেটে রানা পেল আইডি, কিছু টাকা ও ড্রাইভিং লাইসেন্স। তার নাম গ্যাব্রিয়েল গঞ্জালেস। বুটের খাপে ভারী স্টিলেটো। ওটা নিজের কাছেই রাখল রানা।
পরের কাজ খুব নোংরা। কৈশোরে দুর্দান্ত কিছু পেশার প্রতি প্রবল আকর্ষণ বোধ করলেও কখনও ডেন্টিস্ট হতে চায়নি রানা। একটু আগেও জানত না হয়ে উঠবে শিক্ষানবিশ দন্ত-চিকিৎসক। তবে ওর কপাল ভাল, অ্যানেসথেশিয়া ছাড়া দাঁত তুলে নিলেও সিটে লাফ দিয়ে উঠে তুলকালাম করবে না ওর রোগী। ডানহাতে খপ করে ধরে লাশের চোয়াল খুলল রানা। মুখটা হাঁ করে রাখতে গিয়ে ব্যবহার করল একটুকরো লম্বাটে পাথর। স্টিলেটোর ভারী বাঁটের গোড়া দিয়ে গুঁতো মেরে ভাঙতে লাগল পোকা ধরা, গুল খাওয়া খয়েরি দাঁত। কাজ শেষে মুখের গর্তে বসাতে হবে ফক্সের দেয়া দু’পাটি। এমনিতেই গঞ্জালেস দেখতে যেমন, তাতে কখনোই সেরা হাসির মালিক হিসেবে তাকে পুরস্কার দিত না কেউ; কিন্তু রানার কাজ শেষ হলে তার ভয়াবহ বীভৎস, এবড়োখেবড়ো মুখের গহ্বর দেখাল ধেড়ে ছুঁচোর তৈরি বিশ্রী গর্তের মত।
রানা একরাশ ভাঙা দাঁত সরিয়ে নেয়ায় বলল ফক্স, ‘বস, আপনি হচ্ছেন হরর সিনেমার সফল পরিচালক। এই ক্যারিয়ার নিয়ে ভালভাবে ভেবে দেখতে পারেন।’
চুপচাপ লাশের মুখের পাথর বের করে সেখানে দুই পাটি দাঁত পুরল রানা। এক ফুট পিছিয়ে গিয়ে দেখল অদক্ষ হাতের কাজ। সঠিকভাবে না বসলেও গঞ্জালেসের আসল দাঁতের চেয়ে সোনার দাঁত হাজারগুণ ভাল। হাত ও স্টিলেটো থেকে লাশের থকথকে রক্ত ও লালা মুছে বমি পেল রানার। ফক্সের কাছ থেকে পানি নিয়ে ভাল করে ধুয়ে নিল দু’হাত। ওকে বলল ফক্স, ‘পোশাক পরাতে চাইলে হোল্ডঅল থেকে দিতে পারি।’
‘চাই না,’ বলল তিক্ত রানা। ‘এসো, এবার লাশ নিয়ে নিচে যেতে হবে। ওখানে রয়ে গেছে ওদের ভ্যান।’