নয়
বঞ্চনা নীতি!
মে মাসের ৮ তারিখে বাঙলায় জাপবিমানের প্রথম আক্রমণ হোল চট্টগ্রামে। বৃটিশ সৈন্য তখন অত্যন্ত দ্রুতবেগে বাঙলায় পিছিয়ে আসছে। মে মাস যখন শেষ হোল তখন বর্মায় একটিও বৃটিশ সৈন্য আর রইল না, সমরবন্দী ছাড়া।
বাঙলায় তখন অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে নৌকা পোড়ানো এবং সাইকেল আটক চলেছে। যে-কোনো সময় জাপানী-বাহিনী পূর্ব ভারতে প্রবেশ করতে পারে। তখন যাতে তারা স্থানীয় নৌকা কিংবা সাইকেল ব্যবহারের সুবিধা না পায়, তার জন্যেই এত সতর্কতা।
শুধু যানবাহন নয়, খাদ্যের সম্বন্ধেও সতর্কতার অন্ত নেই। অত্যন্ত তাড়াতাড়ি যতটা সম্ভব চালও পূর্ব-বাঙলা থেকে সরানো হোল, ফলাফল চিন্তা না করে।
কলকাতায় তখন একটা থমথমে ভাব।
এমন সময় একদিন উত্তর কলকাতার একটা সিনেমা হলে শ্রীমন্ত আর সুমিত্রা রায়কে দেখা গেল।
সুমিত্রা সুন্দরী নয়, কিন্তু বেশ স্মার্ট। তার একটু জলুস আছে। সেই জলুসে ওকে সুন্দরীই দেখায়। শ্রীমন্তদের অফিসে ওর সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে তরুণদের মধ্যে যথেষ্ট ব্যাকুলতার পরিচয় পাওয়া যায়।
অথচ এত লোক থাকতে আলাপ হোল ওর শ্রীমন্তর সঙ্গে, অফিসে যার মাথা তোলবার সময় নেই, গল্পগুজবের অবকাশ নিতান্তই কম।
সেও এক আশ্চর্যভাবে। এই সিনেমা হলে।
শ্রীমন্ত বসে সিনেমা দেখছিল একটা রবিবারের সন্ধ্যায়। মাঝখানে বিরামের সময়
হঠাৎ দেখলে সামনের সীটে সুমিত্রা।
সুমিত্রাও মুখ ফিরিয়ে ওকে দেখে চমকে গেল!
—একি, আপনি?
শ্রীমন্ত হেসে নমস্কার করলে।
—আমার ধারণা ছিল আপনি কোথাও বেরোন না।
—তবে আমি কি করি বলে আপনার ধারণা?
—শুধু ফাইল ঘাঁটেন আর নোট লেখেন।—সুমিত্রা কলকণ্ঠে হেসে উঠলো।
—রবিবারেও?
—সব বারেই।
খুব চটপটে মেয়েটি তো! শ্রীমন্তর মন উসখুস করে, চোখে আবার সেই পুরানো নেশা ঘনায়।
—কাল অফিসে যাচ্ছেন তো?—সুমিত্রা জিজ্ঞেস করলে।
—কাল তো ছুটি। জানেন না আপনি?
—জানি। আমার ধারণা ছিল, পর পর দু’দিন ছুটি আপনি কিছুতেই সহ্য করতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে অফিস যাবেন।
—ব্যাপার সেই রকমই। সত্যি কথা বলতে কি, সমস্ত দিন একলা হোটেলের ঘরে কাটানোর চেয়ে শাস্তি আর নেই। তার চেয়ে অফিস ভালো।
—আপনি হোটেলে থাকেন বুঝি? কোথায়?
—হোটেল লাজুরিয়াস। কাছেই।
—I see.
ঘণ্টা বেজে গেল। একে একে হলের আলো নিভতে আরম্ভ করলে। কিছু পরে আবার সিনেমা আরম্ভ হোল।
কিন্তু শ্রীমন্তর আর সিনেমা দেখতে মন বসে না। তার দুই চোখ জ্বালা করছে।
সিনেমার শেষে শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করলে, কেমন লাগলো!
—মন্দ নয়।
—কিন্তু গল্পটা যেন ঠিক দানা বাঁধেনি। না?
সিনেমা-ভাঙা জনস্রোতের সঙ্গে সঙ্গে মন্থর গতিতে ওরা দু’জনে পাশাপাশি
চলেছে।
হঠাৎ চুপি চুপি সুমিত্রা বললে, জাপানীরা হোমালিনে এসে গেছে, শুনেছেন?
—হোমালিন? সে কোথায়?
—ইম্ফল থেকে ৬৫ মাইল দূরে। Only sixty-five miles.
—কাছেই তাহলে?—উত্তেজনায় কথাটা শ্রীমন্তর মুখ দিয়ে জোরেই বেরিয়ে গেল।
—চুপ।
সুমিত্রা সাবধান করে দিলে। এই ভিড়ের মধ্যে ও-সম্বন্ধে এত জোরে কথা কওয়া নিরাপদ নয়। এত লোকের মধ্যে কে কি, কেউ জানে?
ওরা সিনেমা-গৃহের ফটকে এসে দাঁড়ালো।
—আপনার সঙ্গে কেউ নেই?—এতক্ষণ পরে এ প্রশ্ন শ্রীমন্তর মাথায় এলো।
সুমিত্রা তাড়াতাড়ি পিছনে চেয়ে বললে, এই যে! আমার বোন মঞ্জরী রয়েছে। আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। ও বেথুনে থার্ড ইয়ারে পড়ে।
ওরা পরস্পর নমস্কার বিনিময় করলে!
—কী ভিড় দেখছেন? ট্রামে বাসে ওঠাই মুশকিল।
—ট্রাম-বাসের দিকে চেয়ে শ্রীমন্ত বললে, সিনেমা-ভাঙার সময় কি না। আপনি কি দূরে থাকেন?
—খুব দূরে নয়।—অন্যমনস্কভাবে সুমিত্রা উত্তর দিলে।
ওর গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে মঞ্জরী বললে, হেঁটেই চলো না দিদি। চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে। বেশ লাগবে এটুকু আস্তে আস্তে হেঁটে যেতে!
—সেই ভালো।—সুমিত্রা সম্মতি দিলে।
তারপর শ্রীমন্তর দিকে ফিরে নমস্কার করে বললে, আচ্ছা আসি তাহলে। কাল ফের অফিসে দেখা হবে।
শ্রীমন্ত ঘাড় বেঁকিয়ে নমস্কার করে হেসে বললে, আবার আপনি ভুল করলেন। কাল ছুটি।
হাসতে হাসতে ওরা একদিকে চলে গেল, শ্রীমন্ত আর একদিকে।
হোটেলে ফিরে জামা খুলতে খুলতে শ্রীমন্তর মনে পড়ল : জাপানীরা হোমালিনে এসে গেছে, ইম্ফল থেকে ৬৫ মাইল দূরে—Only sixty-five miles…সুমিত্রার সেই রহস্যঘন চাপা কণ্ঠস্বর!
.
দিন কয়েকের মধ্যেই ওদের দু’জনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল, —
শ্রীমন্ত আর সুমিত্রার মধ্যে।
চমৎকার মেয়ে এই সুমিত্রা। শ্রীমন্তর এতো ভালো লেগেছে যে, বলবার নয়। রং শ্যামবর্ণ। কিন্তু এই অফিসে আরও তো কত মেয়ে চাকরী করে, তার মধ্যে এমন স্বাস্থ্য কার? চোখে-মুখে, ঘোরা-ফেরায় সেই পরিপূর্ণ নিটোল স্বাস্থ্যের আনন্দ যেন উছলে পড়ছে। বি. এ. পাসের পাণ্ডুর চিহ্ন সকলের উপর সুস্পষ্ট, কেবল এই মেয়েটি বাদে। পরীক্ষা-পাসের পড়া কেবল একেই জব্দ করতে পারেনি। স্বচ্ছন্দ বনলতার মতো পরিপুষ্ট শ্যামশ্রী একেই কেবল ত্যাগ করেনি!
সুমিত্রাও ঠিক এই কথাই ভাবে :
শ্রীমন্তের স্বাস্থ্য একটা দেখবার মতো জিনিস। লোহার মতো শক্ত দেহে বাজে চর্বির বালাই নেই। কিন্তু ওই দীর্ঘচ্ছন্দ ঋজু দেহে যে প্রচুর শক্তি সংহত হয়ে রয়েছে, ওর মসৃণ প্রশস্ত ললাট, ঋজু নাসিকা, ছোট ছোট তীক্ষ্ণ চোখ এবং পুরু ঠোটের দিকে চাইলেই তা বোঝা যায়।
হৈমন্তীর মতো সুমিত্রাকেও এই শক্তিই বুঝি দুরন্তবেগে আকর্ষণ করেছে। তারই জন্যে সমস্ত কাজ ফেলে অফিসের ছুটির পর সুমিত্রা বেঁটে ছাতাটি বগলে করে এপ্লানেডের মোড়ে শ্রীমন্তর জন্যে অপেক্ষা করে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
.
শ্রীমন্তর কাজ আর শেষ হয় না।
বাইরে ক্ষান্ত বর্ষণ শেষে অপরাহ্ণের মেঘ রঙে-রঙে মনোহর হয়ে উঠেছে। গাছের জলে-ধোয়া চিকণ পাতায় লেগেছে রঙের নাচন। মাঠের কচি ঘাসে পড়েছে নবীন মেঘের ছায়া।
শ্রীমন্ত জানে, সুমিত্রা এমনি সময় এপ্লানেডে তার জন্যে প্রতীক্ষা করছে সেই ছ’টা থেকে। তার কচি পাতার মতো লাবণ্যমণ্ডিত মুখে এসে পড়েছে অস্তমেঘের আভা। ছটফট করছে সে।
তবু শ্রীমন্তর কাজ আর শেষ হয় না।
মাথা তোলবার তার অবসর নেই। টেবিলের উপর তখনও অনেক ফাইল। কাজ ফেলে রেখে যাওয়া সে পছন্দ করে না! যখন টেবিলে আর একখানাও ফাইল থাকবে না, তখন সে উঠবে। বাথরুম থেকে বেশ করে হাত-মুখ ধুয়ে আসবে। তারপর কোটটি গায়ে দিয়ে বড়বাবুর সঙ্গে একবার নিরিবিলি দেখা করে আসবে।
কিছুদিন থেকেই বড়বাবুর সঙ্গে খুব ভাব হয়েছে। নিরিবিলি অনেকক্ষণ আলোচনার পরে দুজনেই অফিস থেকে বেরুবে।
তারপরে বড়বাবুকে সেই ভিড়ের মধ্যে বহু ক্লেশে ট্রামে উঠিয়ে দিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে এপ্লানেডের দিকে ফিরবে।
রাস্তায় তখন ব্ল্যাক-আউটের অন্ধকার নেমে এসেছে। কিন্তু শ্রীমন্তর কিচ্ছু ভুল হয় না। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে সুমিত্রার গায়ে হাত দিতেই সুমিত্রা প্রথমটা চমকে ওঠে। তারপর কলকণ্ঠে অনর্গল বকতে আরম্ভ করে। তার মধ্যে কিছু রাগের, কিছু অনুরাগের!
বলে : Brute! ভদ্রমহিলাকে এমনি করে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে লজ্জা করে না তোমার?
শ্রীমদ্ভ হাসে! সাপের জিভের মতো লিকলিকে হাসি। অন্ধকারে সুমিত্রা তা দেখতে পায় না।
শান্ত কণ্ঠে শ্রীমন্ত বলে, Execuse me! আর কোনদিন দেরি হবে না।
রোজই একই কথা বলে; রোজই দেরি হয়।
সেখান থেকে ওরা যায় হোটেল ডি-রিও-তে। তারপরে ন’টার শো’তে সিনেমায়। রাত বারোটায় একটা ট্যাক্সি করে ওকে পৌঁছে দেয়।
সুমিত্রার পিছনে কী খরচটাই না করে শ্রীমন্ত! কে জানে, এত টাকা সে কোথায় পায়? সব কাজেই সে যেন জলের মতো টাকা খরচ করে। দেখে ওর সম্বন্ধে সুমিত্রার সম্ভ্রম জাগে।