ছয়
হৈমন্তীর সঙ্গে সুবিমলের বিয়ের ঠিক হতে বিলম্ব হোল না। জানা ঘর, সুন্দরী মেয়ে, তার ওপর নিজেদের মধ্যে। বিশেষ সুবিমলের মা ছেলের বিয়ের জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সুতরাং হিমাংশুবাবু নয়নতারাকে নিয়ে তাঁর দ্বারস্থ হওয়ামাত্র তিনি রাজি হয়ে গেলেন।
বললেন, আমাদের কাল শেষ হয়ে এসেছে, মিথ্যে আমার কাছে মত নিতে এসেছেন বেয়াইমশাই! মত নিন্গে ছেলের কাছে, আর ওই যে আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বড়বৌমা, ওঁর কাছে।
নয়নতারা সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন : সে যা বলেছেন বেয়ান। আজকাল ছেলেতে- মেয়েতে বিয়ে। বাপ-মাকে নিমন্ত্রণ করলে তাঁরা ছাঁদনাতলায় দাঁড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দেবেন। না কি বলুন?
সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা আরম্ভ হয়ে গেল একাল আর সেকাল সম্বন্ধে। কি কালই না ছিল তখন!
সেই অবসরে বাসন্তী ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেল। বলে গেল, পাত্রের মতটা জেনে আসি।
আশ্চর্য এই যে বাসন্তী কথাটা পাড়ামাত্র সুবিমল তার এবং মায়ের উপর সমস্ত ভার দিয়ে দিলে। একবারও তার পুরোনো বাঁধাগতের আপত্তি তুললে না। সেদিন ক্যারম খেলার শেষে হৈমন্তীর ক্রুদ্ধ পরাজিত মুখভাব সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। এত সহজে সুবিমল রাজি হয়ে যাবে, তা বাসন্তী স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। সে ভেবেছিল, সুবিমল অনেক বিদ্রুপ পরিহাস করবে, অনেক সঙ্গত-অসঙ্গত আপত্তি তুলবে, অনেক ধানাই-পানাই করে বাসন্তীকে নাস্তানাবুদ করবে। বাসন্তী রাগ করবে, তিরস্কার করবে এবং শেষ পর্যন্ত কাঁদবে, তবে সে রাজি হবে।
কিন্তু সে সব কিছু হোল না। এমন কি এই নিয়ে সুবিমল একটা সহজ পরিহাস পর্যন্ত করলে না। সমস্ত ভার এমন গম্ভীরভাবে তাদের দু’জনের উপর ছেড়ে দিলে যে, বাসন্তী প্রথমটা শুধু বিস্মিত নয় একটু দ্বিধাগ্রস্তও হোল।
বললে, বেশ। আমার আর মায়ের খুব মত আছে। এর পরে তুমি আর কোনো আপত্তি জুড়বে না তো? পরিষ্কার করে বলো।
এতক্ষণে সুবিমল একটু হাসলে। বললে, পরিষ্কার করেই তো বললাম বৌদি। তোমাদের মত হোলে আমার কোন আপত্তি নেই।
—ঠিক তো?
—ঠিক।
বাসন্তী ছুটতে-ছুটতে এসে সুখবরটা ওঁদের দিলে। শুনে ওঁরা অধীর হয়ে উঠলেন। হিমাংশুবাবু হাত জোড় করে বললেন, তাহলে বেয়ান, এই ফাল্গুনেই যাতে শুভ কাজ হয়ে যায়, তার চেষ্টা করা যাক। আজকালকার ছেলে-মেয়ের মতিগতি!
—সে ঠিকই বলেছেন বেয়াই। আমি এখনই ঠাকুর মশাইকে খবর দিচ্ছি।
তেরো বছর পরে এই বাড়িতে আবার বিয়ের নহবৎ বসবে। সুবিমলের মায়ের চোখ দিয়ে আনন্দের জল গড়িয়ে পড়লো। তাঁর আর সবুর সইছিল না। পুরোহিতকে ডেকে সেই মুহূর্তেই কোষ্ঠী বিচার হয়ে গেল। কোষ্ঠী মিলতেই উভয় পক্ষের আশীর্বাদের এবং বিবাহের দিন পর্যন্ত স্থির হয়ে গেল। দুটি অভিজাত ধনী পরিবারের মধ্যে দেনাপাওনার প্রশ্ন অবান্তর। বিশেষ কুটুম্বের ঘর। সুতরাং সে প্রশ্ন উঠলো না। এক কথায় সমস্ত পাকাপাকি ঠিক হয়ে গেল।
বসু-গৃহিণী মধ্যাহ্ন-ভোজন না করিয়ে সেদিন আর বেয়াই-বেয়ানকে ছাড়লেন না।
.
কিন্তু শ্রীমন্ত কোথায়?
বিবাহের সংবাদ হৈমন্তী নিঃশব্দে শান্তভাবেই গ্রহণ করেছিল। শ্রীমন্তের চোখে সেই রাত্রে সাপের মতো হিংস্র যে জ্বালা দেখেছিল, তাতে সে কেমন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সুতরাং প্রথম দিকে সুবিমলের সঙ্গে বিবাহের সংবাদ শান্তভাবে গ্রহণ করতে তাকে চেষ্টা করতে হয়নি। সহজেই পেরেছিল।
তারপরে যত দিন কাছে আসতে লাগলো ততই যেন তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো।
কিন্তু শ্রীমন্ত কোথায়?
তার পরীক্ষা দিন কয়েক আগে শেষ হয়ে গেছে। পড়ার চাপ আর নেই। তবু সে কি করছে, কোথায় থাকছে, কখন আসছে, কখন যাচ্ছে তার পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।
সে এখানে আছে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। দিন দুই আগে গভীর রাত্রে হৈমন্তী তার ঘর তালাবন্ধ দেখে ফিরে এসেছে।
আশ্চর্য এই লোকটি!
ও কি বিয়ের কথা কিছুই শোনেনি? শুনে কি ওর মনে এতটুকু ঈর্ষারও উদ্রেক হয়নি? ওর নির্বিকার ভাব দেখে হৈমন্তী, যেমন অবাক হচ্ছে, তেমনি কষ্ট পাচ্ছে।
অথচ শ্রীমন্তকে তার বিশেষ প্রয়োজন। মনের সঙ্গে যুদ্ধে সে ক্ষতবিক্ষত। তাকে বাঁচাতে পারে একমাত্র শ্রীমন্ত। কিন্তু কে জানে সে কোথায়। পাঁচজনকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো জানা যেতে পারে। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা করে।
অবশেষে একদিন শ্রীমন্তর পাত্তা পাওয়া গেল। দিন দশ-বারো কলকাতায় সে ছিলই না। বড়বাবুই তাকে পাঠিয়েছিলেন মফঃস্বলে জমিদারীতে। কেন, কেউ জানে না। সকালে সে ফিরেছে।
আড়াল থেকেই সে দেখলে, দুপুরে খেয়ে-দেয়ে শ্রীমন্ত ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। রেলভ্রমণে ক্লান্ত হয়তো। দুপুর রাত্রে ওর ঘরে গিয়ে হৈমন্তী উপস্থিত হল।
শ্রীমন্ত তখন ঘুমোয়নি। দিনে প্রচুর ঘুমুনোর জন্যেই বোধ করি ঘুম আসছিল না।
ঘরে আলো জ্বলছিল।
সেই আলোয় হৈমন্তী এসে যখন দাঁড়ালো, শ্রীমন্ত চমকে উঠে বসলো।
এক মুহূর্তে সমস্ত ঘর যেন ঝলমল করে হেসে উঠলো।
হৈমন্তী সুন্দরী, রূপসী। কিন্তু তার এত রূপ শ্রীমন্ত কখনও দেখেনি।
পরনে তার ফিকে গোলাপী রঙের একখানা জর্জেট। সর্বাঙ্গে মূল্যবান জড়োয়া গহনা থেকে আলো ঠিকরে বার হচ্ছে। প্রসাধনের গন্ধ উঠছে ভুরভুর করে। একটা অপরূপ ভঙ্গীতে দরজার গোড়ায় সে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু শ্রীমন্ত যেন পাথর হয়ে গেছে। তার সাধ্য নেই উঠে গিয়ে হৈমন্তীর হাত ধরে নিয়ে আসে।
ওর প্রস্তরীভূত ওষ্ঠের ফাঁক দিয়ে শুধু একটি শব্দ বার হল : এসো।
সমুদ্র-মন্থনের সময় ভগবানের যে মোহিনী-রূপ দেখে সুরাসুর উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, সেও বোধ করি এমনিই।
হৈমন্তী কলকণ্ঠে হেসে উঠলো : তবু ভালো যে, আসতে বললে! আমি এটুকুও প্রত্যাশা করিনি।
কণ্ঠস্বরে সূচের মতো খোঁচা ছিল। কিন্তু শ্রীমন্ত তা গায়ে মাখলো না।
হেসে বললে, বটে! যার জন্যে খেটে মরি সেই বলে চোর!
হৈমন্তী বিস্ময়ের সঙ্গে বললে, আমার জন্যে খেটে মরছ তুমি? কি রকম খাটুনি শুনি?
শ্রীমন্ত বললে, শুনবে? শোন তাহলে। বড়বাবুর ছোট মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করেই হবে। অন্তত ত্রিশ হাজার টাকা খরচ হবে। সেই টাকাটা যোগাড় করতে গিয়েছিলাম। সেও কি এক জায়গায়? কখনও রেলে, কখনও স্টীমারে, কখনও নৌকায়, কখনও বা হেঁটে। কোনো দিন খাওয়া হয়েছে, কোনো দিন চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে কেটেছে, কোনো দিন তাও জোটেনি। আরও শুনবে?
—না। আমি ভাবছি, তোমার মনে কি লজ্জা ঘৃণা বলতে সত্যিই কিছু নেই?
—না। তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমার জীবনের নীতি হচ্ছে : লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়।
শ্রীমন্ত মিটিমিটি হাসতে লাগলো।
হৈমন্তী দপ্ করে জ্বলে উঠলো। বললে, লজ্জা করে না তোমার হাসতে? তোমার জিনিস অন্যে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। এর জন্যে কোনো দুঃখ, কোনো ক্ষোভ নেই তোমার?
—’কোনো দুঃখ, কোনো ক্ষোভ নাই সুলক্ষণে’।—তারপরে পরিহাস বন্ধ করে শ্রীমন্ত বললে,—তাহলে শোনো বলি : পথের কুকুর আমি। এরই মধ্যে দু’দিনের জন্যেও যদি তোমায় পেয়ে থাকি, সেই আমার ঢের। তারও চেয়ে বেশি যদি লোভ করি, নিজে ও ডুববো, তোমাকেও ডোবাব।
হৈমন্তী তীব্র দৃষ্টিতে ওর দিকে একটুক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বললে, দেখ, তোমাকে আমি চিনি। তাই তুমি যে ডুববে না, সেই কথাটা বোঝাবার জন্যেই এই ক’খানা জড়োয়া গয়না আজ পরে এসেছি। এর দাম জানো?
—না। জানবার দরকারও নেই। তবে আমাকে যদি চিনেই থাক, তাহলে তোমায় বলি শোনো, ওর লোভে যারা ভুল করতে পারে, আমি তাদের চেয়েও চালাক।
ব্যাকুল কণ্ঠে হৈমন্তী বললে, তুমি আমার কথাটাও কি ভাববে না? তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, এও কি আমাকে মুখ ফুটে বলতে হবে?
—কিছুই বলতে হবে না হিমু। সবই দু’দিন পরে সয়ে যাবে। মানুষের মন বড় আশ্চর্য জিনিষ! হাঃ হাঃ হাঃ। বিবেকানন্দ পড়েছ? ‘পুত্রশোকাতুরা নারী বৎসরান্তে পুনরায় পুত্রবতী হয়’। (ওর চোখে আবার সেই সাপের মতো হিংস্র জ্যোতি!) যাকগে বাজে কথা। তোমায় একটু কফি করে খাইয়ে দি, আজ শেষবারের মতো। কফি আমি ভালো তৈরী করি, কি বল?
আশ্চর্য সহজ ওর কণ্ঠস্বর। যেন কিছুই হয়নি। যেন প্রতিদিনের মতো আজও এসেছে হৈমন্তী।
বিস্ময়ে, ঘৃণায়, ক্রোধে এবং বেদনায় হৈমন্তীর সমস্ত দেহ যেন অসাড় হয়ে গেল। ওর যেন সমস্ত সংজ্ঞা লোপ পেয়ে গেছে, এমনি অবশভাবে বসে রইল। কিছুক্ষণের জন্যে ওর বাকশক্তি পর্যন্ত যেন রুদ্ধ হয়ে গেল।
কিছুক্ষণের জন্যে।
শ্রীমন্ত নিঃশব্দ মনোযোগের সঙ্গে কফি তৈরি করলে। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর থেকে একটা রাত্রেও কফি খাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। রাত তো জাগতে হোত না। তার উপর পরীক্ষা শেষের অব্যবহিত পরেই তাকে হৈমন্তীর বিবাহের অর্থসংগ্রহের জন্যে বাইরে যেতে হয়েছিল।
অনেক দিন পরে আজ আবার গভীর রাত্রে কফি তৈরি করতে বসে তার মনে হোল, অনেক দিনের অভ্যাসে এই জিনিসটা তার নেশাতেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অথচ এর মধ্যে একদিনও সে কফির অভাব অনুভব করেনি। আশ্চর্য নয়?
নেশাখোর বহুদিনের পর নেশার বস্তু পেলে তার যেমন সমাদর করে, তেমনি সমাদরে দু’পেয়ালা কফি সে পরিপাটি করে তৈরি করলে।
প্রথম পেয়ালা যখন সে হৈমন্তীর হাতে তুলে দিল, তখন তার চোখ যেন মিট মিট করে হাসছে,–সেই সাপের মতো হিংস্র, ধারালো ছোরার মতো ঝকঝকে চোখ!
মুহূর্ত মধ্যে নিদারুণ ঘৃণায় হৈমন্তীর অবশ দেহের শিরায় শিরায় বিদ্যুৎবেগে যেন আভিজাত্য-নীল উষ্ণ রক্ত ঝিলিক মেরে গেল! হাতের পেয়ালা ছুঁড়ে দিলে মেজের উপর ঝনঝন করে। বাসি রক্তের মতো চকোলেট রঙের কফি ছিটিয়ে পড়লো চারদিকে। ওর মুখে কে যেন হঠাৎ মাখিয়ে দিয়েছে সিন্দূর। স্ফীত নাসিকা উত্তেজনায় কাঁপছে।
বললে, ছিঃ! ছিঃ! তোমার হাতের ছোঁয়া খেলেও পাপ হয়। তুমি শয়তানেরও অধম। শয়তানেরও হয়তো হৃদয় আছে, তোমার তাও নেই। ছিঃ! ছিঃ! তোমায় দিয়েছিলাম ভালোবাসা?
তীরের মতো ছিটকে বেরিয়ে এল হৈমন্তী দরজার কাছে। দু’হাত বাড়িয়ে শ্ৰীমন্ত ওকে আটকালে।
তার চোখে সেই হাসি!
শান্ত কণ্ঠে বললে, কালকে গোটা কুড়ি টাকা পাঠিয়ে দেবে হিমু? হাতে কিছু নেই।
—দোব, দোব, দোব।
হৈমন্তীর গা’টা ঘিন ঘিন করে উঠলো। ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে এসে সে বিছানার উপর যেন ভেঙে পড়লো।
তারপর কী কান্না! যেন অশ্রুর সমুদ্রকে তীরের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দিয়েছে!
কিন্তু কেন কাঁদে সে? ভালোবাসা, না ঘৃণা?