পনেরো
সমস্ত দিন শ্রীমন্তর মন কেমন উড়ু উড়ু করতে লাগলো। কাজে মন বসে না কিছুতেই।
দু’মণ উৎকৃষ্ট মিহি চালের ব্যবস্থা সে করেছে। একটু বেশি রাত্রে যেতে পারলেই ভালো হয়। পুলিশের ধরবার ভয় থাকে না। কিন্তু অত রাত্রি পর্যন্ত তার সবুর সইলো না। একটু ঝুঁকি নিয়ে রাত্রি সাড়ে নটার মধ্যেই সে একখানা ট্যাক্সি করে বেরিয়ে পড়লো। ‘দেবধামের’ একেবারে গাড়িবারান্দার নিচে গিয়ে ট্যাক্সি থামলো কর্কশ শব্দে।
সেই শব্দে একগাল হেসে শঙ্কর বেরিয়ে এলো।
—এনেছ শ্রীমন্তদা?
—হুঁ। একজন কাউকে বলো বস্তাটা ভিতরে নিয়ে যেতে। খবর সব ভালো তো?
সেই ট্যাক্সিতেই শ্রীমন্ত চড়তে যাচ্ছিল। অনুনয়ের সুরে শঙ্কর বললে, একটু চা খেয়ে যাবে না শ্রীমন্তদা?
—চা?—শ্রীমন্ত একটু কি যেন ভাবলে। বললে, আচ্ছা।
ট্যাক্সি ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে সে ভিতরে গেল শঙ্করের সঙ্গে। দোতলায় উঠে ওর আগেকার ঘরের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছে, ভিতর থেকে শব্দ এলো, কে ও?
হিমাংশুবাবুর কণ্ঠস্বর। কিন্তু কালকের মতো ক্ষীণ নয়।
শঙ্কর নিষেধ করবার আগেই শ্রীমন্ত সবিনয়ে জবাব দিলে, আজ্ঞে আমি।
বলে দরজা থেকে উঁকি দিতেই হিমাংশুবাবুর চোখে চোখ পড়ে গেল। বড়বাবু একাই তখন ফ্ল্যাস্কে, ডিকেন্টারে, গ্লাসে, প্লেটে আসর সাজিয়ে বসেছেন।
—শ্রীমন্ত? আরে এসো, এসো।
শ্রীমন্ত না এসে পারলে না।
—বোসো, বোসো। তুমি নাকি খুব বড়লোক হয়েছ? বেশ, বেশ। শুনে ভারি খুশি হয়েছি। খাবে নাকি একটু? তাতে কি হয়েছে? ওসব বাজে সঙ্কোচ আমি পছন্দ করি না। ‘প্রাপ্তে তু ষোড়শ বর্ষে’…তোমার বয়স ষোলো বছর তো পেরিয়ে গেছে। খাও, ভালো জিনিস। আমরা পুরোনো খদ্দের বলেই পাই। নইলে এখন আর এসব জিনিস পাবার উপায় নেই। বাইরে কে রে?
বাবার কবল থেকে শ্রীমন্তকে বাঁচাবার জন্যে শঙ্কর বাইরে থেকে ইসারা করছিল। কিন্তু হিমাংশুবাবু যেন আটঘাট বন্ধ করে সতর্কভাবে বসেছিলেন। তাঁর ধমক খেয়ে শঙ্কর পালালো।
হিমাংশুবাবু নিজের হাতে এক পাত্র ওকে ঢেলে দিলেন।
জিজ্ঞাসা করলেন, যুদ্ধের নতুন কি খবর শুনলে বলো। দেশে নাকি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ আরম্ভ হয়েছে? লোক মরছে পথে পথে? সত্যি? বাইরে তো বেরুই না! কেউ আমাকে খবর এনেও দেয় না। আরেকটু খাবে? খাও না। খুব ভালো জিনিস, নয়? চালের বড় কষ্ট হচ্ছে বাবা। ও চাল তো খেতে পারি না। জাপানীরা কবে আসবে বলতে পারো? কিছু না হোক, একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বোমাই বৃষ্টি করে যাক না। এ আর ভালো লাগে না!
—এক বস্তা সরু চাল নিয়ে এসেছি আজ।
এতক্ষণ পরে শ্রীমন্ত কথা বললে।
—এনেছ? বেশ, বেশ। এসব এলেম চাই, বুঝলে? চাকর-বাকর কর্মচারীদের বলে বলে হয়রান হয়ে গেছি। ওরা পারে না। অথচ তুমি তো পারলে! বেশ, বেশ। Thank you.
শ্রীমন্তর সঙ্কোচ হচ্ছিল। বাপের চেয়ে বড় হিমাংশুবাবু। এই বাড়িতে এই বাড়ির ছেলের মতোই সে মানুষ হয়েছে। সেই বাপের মতো হিমাংশুবাবুর সঙ্গে বসে মদ্যপান! ওর সমস্ত শরীর কাঠের মতো শক্ত হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু আশ্চর্য এই ‘তরল অনলের’ মহিমা! দেখতে দেখতে সেই আড়ষ্ট ভাব কেটে গেল। রাত্রি বারোটার সময় শঙ্কর উঁকি দিয়ে দেখলে, দু’জনে গলা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে নৃত্য করছে! আর সেকি হুল্লোড়!
রাত্রিটা শ্রীমন্তকে ‘দেবধামে’ই থাকতে হোল। একেবারে বেহুঁশ হয়ে সে যায়নি বটে, কিন্তু বাড়ি ফেরার মতো অবস্থাও ছিল না। যে ঘরে তার বাল্য কৈশোর ও প্রথম যৌবন কেটেছে, সেই ঘরেই তার বিছানা হোল।
রঙীন চোখে ঢাকা দেওয়া আলোয় আলো-আঁধারী ঘরের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো :
মেঝেয় একখানা লাল মীর্জাপুরী কার্পেট পাতা। তারই উপর ঢাকার ফাঁক দিয়ে বিজলী আলোর একটা বৃত্ত এসে পড়েছে। শ্রীমন্তর মনে হল রক্ত! কার যেন চাপ চাপ তাজা রক্ত ওইখানে পড়ে রয়েছে।
খাটের ওপর সে ধড়মড় করে উঠে বসলো। মাথা অল্প অল্প ঘুরছে, শরীর দুলছে, চোখ লাল। শ্ৰীমন্ত স্পষ্ট দেখলে, রক্ত!
কিন্তু কার রক্ত?
হৈমন্তীর?
শ্রীমন্তর মনে পড়লো সেই দিন, সেই শেষ দিন। হৈমন্তী এক-গা গয়না পরে ওইখানটিতেই এসে দাঁড়িয়েছিল না? ও কি তারই বুকের রক্ত? তাজা, টকটকে! এতদিন পরে আজ সেই রক্ত তার চোখে পড়লো?
শ্রীমন্ত বুকে যেন একটা বেদনা অনুভব করলে। তার হৃৎপিণ্ডে কে যেন সহস্ৰ ছুঁচ ফোটাচ্ছে। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।
সে খাটের বাজুতে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলে।
তাতেও নিষ্কৃতি নেই।
চোখ বন্ধ করেও সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, গলিত পীচের মতো জমাট কালো অন্ধকারের ঠিক মাঝখানটিতে একটা চাপ লাল রক্ত!
খাটের বাজু থেকে মাথা না তুলেই সে আড়চোখে সম্মোহিতের মতো আলোর বৃত্তটার দিকে চেয়ে রইলো।
কত রক্ত! ওইটুকু বুকে এত রক্ত ছিল!
শ্রীমন্তর চোখে আবার সাপের সেই হিংস্র দৃষ্টি ফুটে উঠলো। প্রভাত সূর্যের আভা- লাগা লাল শিশিরবিন্দু যেমন জ্বলতে থাকে, ওর চোখ তেমনি করে জ্বলতে লাগলো।
ওই রক্তের বিষ লেগেছে ওর দেহে। সেই বিষের জ্বালায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত ওর সমস্ত দেহ যেন পুড়ে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ও ছটফট করতে লাগলো। আর যেন ও সইতে পারছে না, এক্ষুনি যেন বুক ফেটে যাবে।
হঠাৎ ও উঠে দাঁড়ালো।
এ-বাড়ির সমস্ত ওর নখদর্পণে। হৈমন্তী কোন্ ঘরে শোয় সে ও জানে। ও যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, তেতলার সেই সিঁড়ির পাশের ছোট ঘরখানিতে মেহগনির খাটের উপর হৈমন্তী শুয়ে। নিশ্বাসের তালেতালে ওর বুক দুলছে। মাঝে মাঝে নড়াচড়ায় ওর চুড়ির কিঙ্কিণি, শাড়ীর খসখস শব্দ উঠছে। সেই শব্দ যেন এত দূরেও ওর কানে এসে ওকে অস্থির করে তুলছে।
শ্রীমন্ত উঠলো। ঘরের আলো নিবিয়ে দিলে। সন্তর্পণে দরজা খুলে এসে একবার দাঁড়ালো।
আঃ! বাইরের হাওয়া কি ঠাণ্ডা! ওর বুকের ভিতরটা যেন জুড়িয়ে গেল।
ওদিকের একটা তেতলা বাড়ির আড়ালে চাঁদ বোধ করি একটু আগে অস্ত গেছে। পৃথিবীতে অন্ধকার নেমেছে, কিন্তু আকাশের গা থেকে আলোর সমস্ত রেখা এখনও মুছে যায়নি।
সেই অন্ধকারে শ্রীমন্ত সতর্ক দৃষ্টিতে একবার চারিদিকে চেয়ে দেখলে। কোথাও জীবনের চিহ্ন নেই। দু’হাতে দু’দিক ধরে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো টলতে টলতে শ্ৰীমন্ত চললো হৈমন্তীর ঘরের দিকে।
.
দ্বার বন্ধ।
শ্রীমন্ত ঠুক ঠুক করে দরজায় টোকা দিলে। কোথাও সাড়া পাওয়া গেল না। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার টোকা দিলে। এবারও কোনো সাড়া পেলে না। সে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগলো।
হৈমন্তীর দরজা কি তার কাছে চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে?
শ্রীমন্ত তবু অপেক্ষা করে রইলো। সেই দরজার গোড়ায়। সময়ের বোধ তার লোপ পেয়ে গেছে। সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে। অনন্তকালের বটপত্রে সে একা রয়েছে জেগে, হৈমন্তীর জন্যে অপেক্ষা করে।
কিন্তু কবে তার দুয়ার খুলবে কে জানে?
পা টলছে শ্রীমন্তর। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সেইখানে চৌকাঠের গোড়ায় দরজায় মাথা ঠেকিয়ে সে বসে পড়লো।
কতক্ষণ পরে কে জানে, হঠাৎ এক সময় দরজা খুলে গেল।
দরজার গোড়ায় অমনিভাবে একজনকে বসে থাকতে দেখে হৈমন্তী একটা অস্ফুট শব্দ করে পিছিয়ে এল।
শ্রীমন্তর ঘুম আসেনি, তন্দ্রাও না, কেমন একটা আচ্ছন্নের ভাব। হৈমন্তীর অস্ফুট চীৎকারে সে তার ছোট ছোট লাল চোখ মেলে চাইলে।
হৈমন্তী সবিস্ময়ে বললে, তুমি? ওখানে ও রকম করে কেন? কি চাও?
জড়িতকণ্ঠে শ্রীমন্ত কি বললে বোঝা গেল না। ডান হাতখানা সে হৈমন্তীর দিকে বাড়িয়ে দিলে।
হৈমন্তী নড়লো না। আলোর শিখার মতো নিষ্কম্প দাঁড়িয়ে রইলো।
কঠিন কণ্ঠে বললে, দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে এ-বাড়ি ঢুকলে কি করে?
শ্রীমন্ত জড়িত কণ্ঠে যথাসাধ্য পরিষ্কার করে উত্তর দিলে, দারোয়ানের চোখ এড়িয়ে নয়। সন্ধ্যার পর এখানেই আছি।
—কোথায় লুকিয়ে ছিলে?
—লুকিয়ে নয়,—আমার সেই পুরোনো ঘরে বড়বাবুর কাছে ছিলাম।
—মদ খাচ্ছিলে? আগে তো খেতে না।
—না।
—এখন খাও?
—হুঁ।
হৈমন্তী এক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবলে। ওর চোখের কঠিন দৃষ্টি করুণায় ধীরে ধীরে কোমল হয়ে এলো।
বললে, তুমি উঠতে পারো?
—পারি।
হৈমন্তী ধমক দিলে : এ-ঘরে নয়। সেই পুরোনো ঘরে ফিরে যেতে পারো?
শ্রীমন্ত ভয়ে ভয়ে বললে, দেওয়াল ধরে ধরে গেলে হয়তো পারি।
—তাই যাও। এখানে অমন করে দাঁড়িয়ে থেকো না।
শ্রীমন্ত ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়ালে। পা কাঁপছে, সমস্ত দেহ টলছে। সে পড়ে যেতে-যেতে বারান্দার রেলিঙ ধরে সামলে নিলে।
হৈমন্তী ওর কাণ্ড দেখে হেসে ফেললে। মাতাল দেখে দেখে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মাতালে তার ভয় করে না। হাসি আসে।
বললে, দাঁড়াও। তুমি পারবে না যেতে। আমি নিয়ে যাচ্ছি ধরে-ধরে।
হৈমন্তী কোমরে বেশ করে আঁচলটা জড়ালে। তারপর ওর একখানা হাত ধরে বহু কষ্টে ধীরে ধীরে ওর ঘরে নিয়ে গেল। আলোটা জ্বেলে ওকে খাটে শুইয়ে দিলে।
সমস্ত পথ শ্রীমন্ত একটা কথাও বললে না। আচ্ছন্নের মতো খাটে এসে শুয়ে পড়লো। আলো নিবিয়ে দেবার জন্যে হৈমন্তী সুইচের দিকে হাত বাড়াতেই শ্রীমন্ত হঠাৎ অস্ফুট আর্তনাদ করে খাটের উপর উঠে বসলো।
হৈমন্তী চমকে উঠলো : কি হোল?
শ্রীমন্তর চোখের তারা যেন বেরিয়ে আসছে। কার্পেটের দিকে কম্পিত তর্জনী নির্দেশ করলে।
আলোর বৃত্তটার দিকে চেয়ে হৈমন্তী সবিস্ময়ে বললে, কি?
আশ্চর্য অদ্ভুত স্বরে শ্রীমন্ত বললে, ওই দেখ। ওটা কার রক্ত বলতে পারো? তোমার না আমার?
হৈমন্তীর নিষ্কম্প আলোর শিখার মতো দেহ পলকের জন্যে একবার কেঁপেই স্থির হয়ে গেল। একটা ধমক দিয়ে বললে, ও কিছু নয়, শুয়ে পড়ো।
ধমক খেয়ে শ্রীমন্ত আর একটা কথাও বললে না। শান্ত ছেলের মতো নিঃশব্দে শুয়ে পড়লো। হৈমন্তী একটুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে আলো নিবিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চুপি-চুপি বেরিয়ে গেল।