কালোঘোড়া – ২০

কুড়ি 

সে রাত্রে সুমিত্রা যখন বাড়ি ফিরলো তখন রাত দুটো। 

চাকরটা দরজা খুলে দিয়ে ওকে আর হেনরিকে একত্র ফিরতে দেখে অবাক হয়ে গেল। পরদিন সকালে সমস্তক্ষণ সেই অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন তাকে খোঁচা দিতে লাগলো। চাকরটার দিকে সে যেন চাইতে পারছিল না। 

নাচ শেষ হয়েছিল সাড়ে আটটায়। সেখান থেকে হোটেলে ডিনার খেয়ে রাত দুটো পর্যন্ত সে হেনরির সঙ্গে মোটরে কোথায় কোথায় ঘুরেছিল কিছুই তার মনে পড়ে না। আবিষ্টের মতো সে ঘুরেছিল। তার জ্ঞান ছিল না, ইচ্ছাশক্তি পর্যন্ত যেন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। 

শোবার ঘরে এসে দেখে শ্রীমন্ত অঘোরে নিদ্রা যাচ্ছে। তার নাক ডাকছে জোরে জোরে। মুখে মদের উগ্র গন্ধ। মদ্যপানের ফলে মুখ আরক্ত। আজকাল প্রত্যহ শ্ৰীমন্ত মদ খাচ্ছে। 

সুমিত্রার আসা সে টেরই পেলে না। 

তার গায়ের চাদরখানা সুমিত্রা ভালো করে টেনে দিলে। বড় বড় চুলগুলো এলোমেলো ললাটের উপর পড়েছিল। সযত্নে সেগুলো সরিয়ে দিলে। 

তার সুন্দর মুখের দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সুমিত্রা কি যেন ভাবলে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলো নিভিয়ে নিজের খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কাপড় ছাড়বার কথা মনেই হোল না। সে সামর্থ্যও নেই। অপরিসীম ক্লান্তিতে তার মস্তিষ্ক, তার মন যেন পদ্মফুলের মতো বুজে আসছে। 

সকালে উঠে দেখে শ্রীমন্ত তখনও ঘুমিয়ে। মুখ পাণ্ডুর, রাত্রের সে আরক্ত আভা আর নেই। চোখের কোলে কলঙ্ক-লেখা। 

সুমিত্রা উঠে বাথরুমে চলে গেল। স্নান সেরে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বার বার নিজের মুখখানা আয়নায় দেখতে লাগলো। 

তার মুখেও অমনি কলঙ্কচিহ্ন নেই তো? 

না। সুমিত্রা ভালো করে চেয়ে চেয়ে দেখলে শিশিরে-ধোয়া কচি ঘাসের মতো তার মুখশ্রী। কলঙ্কের চিহ্নমাত্রও নেই। একটা রাত্রির গাঢ় ঘুমে সমস্ত ধুয়ে-মুছে গেছে।

কী ঘুম সে ঘুমিয়েছে! ঘুম নয়, যেন মৃত্যু। মৃত্যুর অন্ধকার সমুদ্র পার হয়ে সে যেন নবজীবনের তীরে পৌঁছেছে। 

শ্রীমন্ত পাশ ফিরে শুলো। 

সুমিত্রা সভয়ে বলে উঠলো : সর্বনাশ! আবার ঘুমুবে না কি! সাড়ে আটটা বেজে গেছে। 

শ্রীমন্ত একবার চোখ মেলে চাইলে। জবাফুলের মতো টকটকে লাল চোখ। একবার একটু হাসলে, কি মনে করে কে জানে! আবার চোখ বন্ধ করলে। 

সুমিত্রা বললে, ওঠো। চা হয়েছে। 

শ্রীমন্ত বললে, উঠতে পারছি না মিতা। সমস্ত শরীরে বেদনা; মাথা বোঝার মতো ভারী হয়েছে, তুলতে পারছি না। 

আশ্চর্য ক্লান্ত ওর কণ্ঠস্বর! আশ্চর্য করুণ! 

সুমিত্রা উদ্বিগ্নভাবে ওর খাটের কাছে উঠে আসতেই শ্রীমন্ত একখানা হাত ওর কোলের উপর ছড়িয়ে দিলে। 

সেই হাতখানি নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে অনুযোগের সুরে সুমিত্রা বললে, কেন অত মদ খাও? আজকাল তুমি প্রায়ই খাচ্ছ। এমন করলে শরীর থাকে? দেখতো, চোখের কোলে কালি পড়েছে, মুখ ফ্যাকাশে! 

শ্রীমন্ত জবাব দিলে না। নিঃশব্দে পড়ে রইলো। 

খানিক পরে জিজ্ঞাসা করলে, কখন ফিরলে তুমি? 

ওর কণ্ঠস্বরে সুমিত্রা একটু যেন উত্তাপের আভাস পেলে। উত্তরটা সে একটু ঘুরিয়ে দিলে। 

বললে, তখন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে। 

—ঘড়ি দেখিনি, কিন্তু বোধ হচ্ছে অনেকক্ষণ পর্যন্ত জেগে ছিলাম। তার পরে কখন ঘুমিয়ে গেছি। 

হেনরির উল্লেখমাত্র শ্রীমন্ত করলে না। 

সুমিত্রা বললে, হাঁ। তুমি তখন অঘোরে ঘুমুচ্ছিলে। কিন্তু তোমার গা এত গরম কেন? জ্বর নয় তো? 

ভয়ে ভয়ে শ্রীমন্ত বললে, তাই হবে বোধ হয় সুমি। গায়ে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। চারিদিকে যে রকম বসন্ত হচ্ছে। 

কথাটা শ্রীমন্ত শেষ করতে পারলে না। করুণভাবে সুমিত্রার দিকে চাইলে। 

সুমিত্রার বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠলো। বিচিত্র কিছুই নয়। ওদের ঝিয়ের কি রকম একটি বোনপো ক’দিন হোল এই বসন্তেই মারা গেছে। শহরে বসন্ত হচ্ছে খুবই। 

ওর মুখ শুকিয়ে গেল। 

রোগের মধ্যে এই বসন্তকেই ওর সব চেয়ে ভয় এবং ঘৃণা। আর কোনো রোগই মানুষকে এমন কদাকার বীভৎস করে দেয় না। ওর মনে হয়, সেই বীভৎস মুখ নিয়ে বেঁচে ওঠার চেয়ে মৃত্যুও সহস্রগুণে শ্রেয়। 

ওর ভয় হোল। কিন্তু মুখে সে-ভয় প্রকাশ করলে না। 

বরং শ্রীমন্তকে একটা ধমক দিয়ে বললে, কী বাজে কথা বলছ! জ্বর না ছাই! থার্মোমিটারটা দিই দাঁড়াও। থার্মোমিটারে জ্বর উঠলো দেড়। 

এবারে ও সত্যই ভয় পেলে। দেড় জ্বর নিতান্ত কম নয়। 

ম্লানমুখে বললে, একটু জ্বর হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এক্ষুনি ডাক্তারকে ডাকতে পাঠাচ্ছি। 

সামনের টিপয়ে চাকরটা চায়ের সরঞ্জাম নামিয়ে রেখে গেছে অনেকক্ষণ। পাত্রের গরম জল ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কিন্তু সেদিকে সুমিত্রার খেয়ালই নেই। 

ডাক্তারকে ডাকবার জন্যে সে টেলিফোনের রিসিভারটা তুললে। 

.

ডাক্তার এসে যে খুব অভয় দিয়ে গেলেন, তা নয়। 

চোখ জবাফুলের মত লাল, গায়ে-মাথায় যন্ত্রণাও আছে। এসব যে একমাত্র বসন্তের লক্ষণ তা বলা যায় না। ইনফ্লুয়েঞ্জা হতে পারে, ম্যালেরিয়া হতে পারে, কত কি হতে পারে। আজকেই প্রথম জ্বরটা এসেছে, আরও দু’একদিন না গেলে কিছুই বলা যায় না। তবে সময়টা খারাপ। একটু সতর্ক থাকাই ভালো। 

হঠাৎ ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা টিকে নিয়েছেন? 

বিবর্ণমুখে সুমিত্রা বললে, টিকে নিইনি তো? 

—উনিও নেন নি? 

—না। 

—নেওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, একটা প্রেসক্রিপশন আমি দিয়ে যাচ্ছি। এইটে তিন ঘণ্টা অন্তর খাওয়াবেন, এবং কেমন থাকেন কাল সকালেই আমাকে খবর দেবেন। 

প্রেসক্রিপশন লিখে টুপিটা হাতে নিয়ে ডাক্তারবাবু উঠলেন। তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে সেইখানেই সুমিত্রা অভিভূতের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। 

তারপর ধীরে ধীরে শ্রীমন্তর বিছানায় এসে বসলো। 

শ্রীমন্ত এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে শুয়ে ছিল। সুমিত্রা এসে বসতেই ক্ষীণ স্বরে বললে : 

—এখানে নয় সুমি। ওই চেয়ারটায় বোসো। রোগটা ছোঁয়াচে। 

সুমিত্রা ওর দিকে চাইলে। ওর ছোট ছোট চোখ মৃত্যুর ভয়ে আরও ছোট হয়ে গেছে। মৃত্যুকে যে শ্রীমন্তর এত ভয়, ওর পেশীকঠিন বলিষ্ঠ দেহের দিকে চেয়ে সুমিত্রা তা কোনোদিন কল্পনাও করতে পারে নি। যে চোখ হিংস্রতায় এবং লোভে সাপের চোখের মতো চিকমিকিয়ে ওঠে, সেই চোখে শিশুর অসহায় দৃষ্টি! 

একটু হেসে সুমিত্রা বললে, আচ্ছা, হয়েছে, থাক। 

সুমিত্রার নিজের ভয় ওর ভয় দেখে তখনই উড়ে গেল। সে যেন শক্ত হোল। কোমরে কাপড় জড়িয়ে চায়ের টেবিলে গিয়ে বসলো। 

বললে, এঃ! জলটা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। একটু গরম জল আনতে বলে দিই। তুমি খাবে একটু চা? অল্প জ্বরে চা খেতে দোষ কি? 

—দোষ না থাকে তো দাও। 

ওর কাতর কণ্ঠস্বরে সুমিত্রা হেসে ফেললে। বললে, ওরে বাবা! এ যে আত্মসমর্পণ- যোগ দেখছি! 

শ্রীমন্ত হাসলে। বললে, হ্যাঁ। ‘ত্বয়া হৃষিকেশ হৃদিস্থিতেন যথা নিযুক্তোঽস্মি তথা করোমি’। এ কি খারাপ? 

—না। খুব ভালো। কেবল অসুখটা সারলে থাকবে না এই দুঃখ! 

সুমিত্রা ওকে এক পেয়ালা চা দিলে। চাকরটাকে ওষুধ আনতে পাঠালে। তার পরে নিজের চা নিয়ে ওর বিছানার পাশে এসে বসলো। 

খাটের বাজুতে বালিশে ঠেস দিয়ে আধ-শোয়া অবস্থায় শ্রীমন্ত চা খেতে লাগলো।

একটু পরে শ্রীমন্ত বললে, শরীরটা খুব খারাপ করছে। দুপুরের দিকে জ্বরটা সম্ভবত বাড়বে। যদি বাড়ে, কি হবে সুমিত্রা? 

—কী আবার হবে? জ্বর কি কারও বাড়ে না? 

শ্রীমন্ত খপ করে ওর একখানা হাত চেপে ধরে বললে, তুমি তখন আমাকে ফেলে পালাবে না তো? 

 সুমিত্রার বিস্ময়ের আর অবধি রইলো না : 

—পালাবো? তোমাকে এই অবস্থায় ফেলে? এসব কথা তোমার মনে জাগছে কি করে?

—না, ধরো, যদি ডাক্তার যা বলে গেলেন তাই হয়? 

—ডাক্তার কী বলে গেলেন? 

কথাটা বলতে শ্রীমন্তর মুখে যেন বাধছিলো। কোনো মতে কথাটা বললে, ধরো, যদি মায়ের দয়াই হয়! 

‘মায়ের দয়া’! রোগটার নাম উচ্চারণ করতেও শ্রীমন্তর সাহস হচ্ছে না! এই দুর্বল মুহূর্তে বহুপুরুষ সঞ্চিত কুসংস্কার কি প্রবল হয়ে উঠলো? 

সুমিত্রা বললে, অসুখে তুমি এমন ভেঙে পড়তে পারো এ আমি ধারণাই করতে পারিনি। 

ব্যগ্রভাবে শ্রীমন্ত বললে, আমি অমনিই ভেঙে পড়ি মিতা। রোগে আমার ভয়ানক ভয়, মৃত্যুকে আরও বেশি। নিজের দিকে ছাড়া কারও দিকে কখনও চাইনি। ভয় হয়, আমার এই দুঃসময়েও সবাই বুঝি আমাকে ফেলে পালাবে। 

শ্রীমন্ত করুণ নেত্রে ওর দিকে চাইলে। তার চোখের কোণ বেয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। 

সুমিত্রা বলল, কিন্তু সবাই তোমার মতো স্বার্থপর তো নয়। দয়ামায়া আছে এমন লোকই সংসারে বেশি। তাই সাধারণ লোকে অসহায় রোগীকে ফেলে পালায় না। 

শ্রীমন্ত একথার একটিও জবাব দিলে না। নিঃশব্দে শুনে গেল। 

সুমিত্রা বললে তাছাড়া আমি তোমার স্ত্রী। এই অসহায় অবস্থায় কোনো স্ত্রীই তার স্বামীকে ফেলে পালায় না। দেখেছ কোনো স্ত্রীকে পালাতে? 

—দেখেছি। আমাদের গ্রামের একটি বৌ। 

—হ্যাঁ! একটি বৌ; এবং সেই একটি ঘটনাই মনে এঁকে রেখেছ। কিন্তু একশোটা বৌ কি করে তা দেখনি? 

শ্রীমন্ত উত্তর দিলে না। 

সুমিত্রা হাসলে। 

বললে, সেই বৌটির সঙ্গেই তোমার বিয়ে হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তোমার মতো পাষণ্ডের উপরও ভগবানের কি করুণা দেখো। তোমাকে তিনি তার হাতে দেননি, দিলেন আমার হাতে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, অসুখ তোমার যাই হোক, সেবাযত্নের কোনো অভাব হবে না। দাঁড়াও, তোমার মুখ ধোবার জল নিয়ে আসি। 

বলে সস্নেহে ওর হাতের উপর একটা চাপ দিয়ে বেরিয়ে গেল। 

.

বসন্ত নয়! সাধারণ জ্বরই, তবে ভোগাবে বলে সন্দেহ হচ্ছে। পাঁচ পর্যন্ত উঠছে, নিরানব্বুই এর নিচে আর নামছে না। 

সম্পূর্ণভাবে জ্বর ছাড়লো পাঁচ দিনের দিন। কিন্তু বিকেলে আবার এল প্রচণ্ড জ্বর। রক্তটা আবার পরীক্ষা করানো দরকার। ডাক্তারের সন্দেহ হচ্ছে, ম্যালেরিয়া। 

কিন্তু জ্বর যাই হোক, সেবা করলে বটে সুমিত্রা। কি সুশৃঙ্খল, কী পরিপাটি! ডাক্তারকে স্বীকার করতে হোল, এমন সেবা তিনি কখনো দেখেন নি। 

ছ’দিনের দিন সকালে জ্বরটা যখন ছাড়লো, তখন হেসে তিনি শ্রীমন্তকে বললেন, আপনার স্ত্রীভাগ্যে হিংসে হচ্ছে। দিনরাত্রি এরকম অক্লান্তভাবে এবং প্রাণ ঢেলে সেবা করতে কাউকে কখনো দেখিনি। 

এই প্রশংসা সুমিত্রার বড় ভালো লাগলো। ছোট মেয়ের মতো লজ্জায় সে আরক্ত হয়ে উঠলো। 

ডাক্তার চলে যেতে শ্রীমন্ত সস্নেহে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বললে, এখন তো জ্বর নেই। এলেও বিকেলের মধ্যে আসবে না বোধ করি। এইসময় তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও বরং। এ ক’দিন চোখের পাতা বোঁজনি। 

—তুমি কি করে জানলে? 

মিটিমিটি হেসে শ্রীমন্ত বললে, আমি সব জানি। জ্বর যতই উঠুক, আমার জ্ঞান সহজে লোপ পায় না। পাষণ্ডদের সব গেলেও জ্ঞান শেষ পর্যন্ত টনটনে থাকে। 

সুমিত্রার সেদিনের ‘পাষণ্ড’ অভিধার জবাব! 

সুমিত্রা হেসে বললে, তা বুঝতে পারছি। শুধু জ্ঞান নয়, রাগও টনটনে থাকে।

—রাগ?—শ্রীমন্ত একটু হাসবার চেষ্টা করলে,—রাগ করব কেন সুমি, অন্যায় কিছু বলোনি। আমি যে পাষণ্ড সে কথা আমার চেয়ে নিঃসংশয়ে আর কে জানে? তার জন্যে রাগ করিনি,—নিজের উপরও না, যে ভগবান এমনি করে সৃষ্টি করেছেন তাঁর উপরও না। আমার রাগ করার মুখ নেই। 

—খুব কথা শিখেছ! একটু পাশ ফিরে শোওতো, বিছানার চাদরটা বদলে দিই।

অত্যন্ত নিপুণ হাতে সুমিত্রা ওর বিছানার চাদরটা বদলে দিলে। 

শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করলে, তুমি কি নার্সিং শিখেছিলে সুমি? 

—শিখিনি? নার্সিং-এই তো এম. এ. পাস করেছি। 

—না, ঠাট্টা নয়। তুমি সেবা কর, মনে হয় যেন শিক্ষিত নার্স সেবা করছে। এবারে সুমিত্রা যেন একটু রাগলো। অল্প ঝাঁঝের সঙ্গে বললে, তুমি এই কথা বলছ, ডাক্তারবাবু এই কথা বলেছেন! কিন্তু বুঝিয়ে দাও তো আমি বেশিটা কি করেছি? 

চোখ বন্ধ করে শ্রীমন্ত বললে, বুঝিয়ে দিতে পারব না। এ বুঝিয়ে দেবার ব্যাপারও নয়। কারণ এর বেশি-কমের মাত্রা কিছু নেই। কিন্তু আমার অসুখে যা করেছ, সে অদ্ভুত, অসাধারণ। একথা ডাক্তারবাবুও বলবেন, আমিও বলবো, যে দেখেছে সেই বলবে। কিন্তু তুমি একটু ঘুমুবে না মিতা? একটু ঘুমোও। 

—ঘুমুবো। কিন্তু এখন নয়। তোমার ফলটা ছাড়িয়ে দিই। ওই সোফাটায় শুয়ে একটুখানি ঘুমিয়ে নোব। 

সুমিত্রা হাসলে। 

শ্রীমন্ত বললে, সেই সময় তোমার সোফার এক পাশে একটুখানি আমাকে বসিয়ে দেবে? আজকে আমার শরীরটা তো ভালই বোধ হচ্ছে। 

বিস্মিত নেত্রে সুমিত্রা বললে, তখন সোফার এক পাশে বসবে? কেন বলো তো?

লজ্জিত কাতর কণ্ঠে শ্রীমন্ত বললে, তোমাকে একটুখানি ভালোবাসবার চেষ্টা করব সুমি। আমি নিঃশব্দে চুপ করে বসে থাকবো। তুমি জানতেও পারবে না। 

এবারে সুমিত্রা হো হো করে হেসে উঠলো। বললে, যা পারো না, তা করতে যেও না। তার চেয়ে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবার চেষ্টা করো। এ ক’দিনের অসুখে তোমার চোরাবাজারে কত টাকার ক্ষতি হয়েছে হিসেব করেছ? 

শ্রীমস্ত জবাব দিলে না। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে পড়ে রইলো। 

ফল ছাড়িয়ে একটা প্লেটে রাখতে রাখতে সুমিত্রা বললে, বিকেলে জ্বরটা যদি না আসে, তাহলে ভাবছি একবার ‘দেবধাম’ থেকে ঘুরে আসব। 

‘দেবধামের’ নামে শ্রীমন্ত চমকে চোখ মেলে চাইলে!

জিজ্ঞাসা করলে, ‘দেবধাম’ কেন? 

ফল-কাটা থেকে মুখ না তুলেই সুমিত্রা বললে, ক’দিন থেকে কেবলই ছোটদির কথা মনে হচ্ছে। ভাবছি, তাকে একবার দেখে আসব। 

—ক’দিন থেকে হৈমন্তীকে মনে পড়ছে কেন? 

—কি জানি। একদিন অনেক রাত্রে খাটের বাজুতে মাথা রেখে তন্দ্রা গেছি, তার মধ্যেও তাকে স্বপ্ন দেখলাম। 

শ্রীমন্ত কথা কইলে না। কি যেন ভাবতে লাগলো। 

একটুক্ষণ পরে সুমিত্রা বললে, বেশীক্ষণ দেরি করব না সেখানে। যাব আর আসব। সেইটুকু সময় একলা থাকতে পারবে না? 

—পারব। 

শ্রীমন্ত পাশ ফিরে শুলো। 

ব্যস্তভাবে সুমিত্রা বললে, ওকি, পাশ ফিরছ কি! ফলটুকু খেয়ে নাও।

শ্রীমন্ত সাড়া দিলে না। 

—একটু পরে সুমিত্রা, পাঁচ মিনিট পরে। 

শ্রীমন্ত আবার চোখ বন্ধ করলে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *