কালোঘোড়া – ৩

তিন

কিন্তু বিদেশী সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধনীর বালাখানাতে এসেই থেমে গেল না। ধীরে ধীরে মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যেও তা প্রবেশ করতে লাগলো।

বিদেশী বণিকের মুৎসুদ্দির প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। তাঁদের এবং গভর্নমেন্টের প্রয়োজন পড়লো বিশেষ করে কেরাণীর।

সেই উদ্দেশ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হতে লাগলো।

যা ছিল মুষ্টিমেয় একটা সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে, মফঃস্বলের শহরে-শহরে এমন কি সুদূর পল্লীগ্রামে পর্যন্ত। ইংরেজি শিক্ষা যারা পায়, তারা দলে দলে চলে আসে কলকাতায় কেরাণীগিরির প্রত্যাশায়। তখন কেরাণীগিরি দুর্লভ ছিল না।

কলকাতা শহর দিন-দিন বেড়ে চলে।

প্রতাপচন্দ্রের পরে তাঁর দুই ছেলে সম্পত্তির মালিক হোলেন, স্নেহাংশু আর শুভ্রাংশু।

স্নেহাংশু পড়াশুনোয় বেশী দূর এগুলেন না। গোটা পাঁচ ছয় স্কুল ঘুরে তিনি একদিন বাড়িতে এসে বসলেন। চেষ্টা নিষ্ফল বুঝে প্রতাপচন্দ্রও তাঁর উপর আর চাপ দিলেন না। তৎপরিবর্তে বিবাহ দিয়ে স্নেহাংশুকে সম্পত্তি দেখাশুনার কাজে নিযুক্ত করলেন।

ছোট শুভ্রাংশু পড়াশুনায় ভালো। এখানকার পরীক্ষাগুলো কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে তিনি চলে গেলেন বিলেত, আই. সি. এস. পরীক্ষা দেবার জন্যে। আর ফিরলেন না।

কি যে তাঁর হোল, সে খবর নেবার জন্যেও কেউ রইলেন না। প্রতাপচন্দ্র মারা গেলেন। স্নেহাংশু ভায়ের জন্যে বিশেষ উদ্বেগ বোধ করার প্রয়োজন দেখলেন না। বেটা ছেলে, উদ্বেগের কি আছে? তিনি পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ভায়ের কাছে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। এ ছাড়া আর করবার কি আছে?

বছর খানেক পরে প্যারিস থেকে এবং আরও বছরখানেক পরে মান্টিকার্লো থেকে দু’বার শুভ্রাংশু চিঠি দিয়েছিলেন। দু’খানাই তাঁর বাবার নামে। তা থেকে বোঝা যায়, পিতার মৃত্যুসংবাদ তিনি পাননি।

স্নেহাংশু এর উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলে না। কারণ, দু’খানা চিঠিতেই টাকার তাগাদা ছিল।

উত্তর তো দিলেন না, চিঠির কথাটাই একেবারে চেপে গেলেন। মা তখনও বেঁচে। শুভ্রাংশু যে বেঁচে আছেন, এবং টাকা চাইবার মতো বিপজ্জনকভাবে বেঁচে আছেন, সে কথাটা ভারতবর্ষের কেউ জানতেই পারলে না।

অন্তত দশ বৎসরের জন্যে।

তার পরে জানা গেল। তখন স্নেহাংশুর মাও গত হয়েছেন। ভালোই হয়েছিল। কারণ, ছেলের মৃত্যুসংবাদ শোনার চেয়ে বড় আঘাত সে বয়সে আর কী হতে পারতো? ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে, মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে যেতে হয়নি।

.

জানা গেল একটি মেমসাহেবের মুখে।

তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং শুভ্রাংশুর ধর্মপত্নী।

স্নেহাংশুকে তিনি তাঁদের বিবাহের এবং শুভ্রাংশুর মৃত্যুর সার্টিফিকেট দেখালেন এবং আরও অনেক স্মৃতিচিহ্ন, যাতে করে স্নেহাংশুর মতো কূট বিষয় বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেও মনে-মনে মেমসাহেবের উক্তির সত্যতা স্বীকার করতে হোল।

কিন্তু মুখে তিনি কিছুই বললেন না।

মেমসাহেব আপনমনে বলে যেতে লাগলেন, কি করে কলেজে পড়ার সময় শুভ্রাংশুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়, কি করে সেই বন্ধুত্ব বৎসরখানেকের মধ্যে প্রণয়ে পরিণত হয়। তারপরে উভয়ের বিবাহ।

বিবাহের কিছুদিন পরেই শুভ্রাংশু মদ্যপান আরম্ভ করলে। আই. সি. এস. দিতেই পারলে না। বাড়ি থেকে কেন জানিনে টাকা আসাও বন্ধ হোল।

—আপনারা কি তাঁর কোনো চিঠিই পাননি?

স্নেহাংশু অম্লান বদনে ‘না’ বললেন।

—তা হবে। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি। কিন্তু প্রচুর মদ্যপানের ফলে বুদ্ধির তাঁর স্থিরতা ছিল না। হয়তো নেশার মুখে ঠিকানা ভুল করেছিলেন কিংবা সে চিঠি হয়তো শেষপর্যন্ত তিনি ডাকবাক্সে ফেলেনইনি।

একটু থেমে মেমসাহেব আবার বলতে লাগলেন :

—কিন্তু তবু আমি হাল ছাড়লাম না। নিজে একটা চাকরী নিয়ে ওঁর পড়ার খরচ জোগাতে লাগলাম,—ব্যারিস্টারী পড়ার খরচ। আশা ছিল, ব্যারিস্টারী পাস করে এখানে এসে বসলেও চলে যাবে। কিন্তু মন দিয়ে পড়াশুনো করার শক্তিই ওঁর আর ছিল না। তার উপর অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে কঠিন অসুখ হোল। আমার পুঁজি বেশী ছিল না। তবু যা ছিল তাই দিয়েই ওঁর চিকিৎসার ত্রুটি করিনি। ওঁকে মন্টিকার্লো চেঞ্জে পাঠালাম।

দশ বৎসর আগের কথা। সুতরাং পরের পর ঘটনাগুলো স্মরণ করবার জন্যে মেমসাহেব আবার একবার থামলেন। কিন্তু বিশেষ কথা বোধ করি মনে পড়লো না। সংক্ষেপে শেষ করার জন্য বললেন :

—এর পরে তিন বৎসর ইউরোপের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়ে উনি স্বাস্থ্য ফিরে পেলেন। আমি তখন প্রচুর ঋণগ্রস্ত। শেষ পর্যন্ত আমার একটি আত্মীয়কে ধরে ইন্ডিয়া অফিসে ওঁর জন্যে একটা চাকরীও যোগাড় করলাম। ধীরে ধীরে দেনা শোধ হচ্ছিল। আমরা একটু শান্তির মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম। এমন সময়…

মেমসাহেবের ঠোট থরথর করে কেঁপে উঠলো। নিজেকে সামলাবার জন্যে তিনি চুপ করলেন।

স্নেহাংশুও ভায়ের জন্যে অনেক দুঃখ করলেন। তাঁর বিশ্বাস, যে উদ্দেশ্যে শুভ্রাংশু বিলেত গিয়েছিলেন, নিজের কৃতকর্মের দোষে সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায় তিনি বাপের কাছে মুখ দেখাবার লজ্জাতেই আর দেশে ফেরেন নি। বাপের মৃত্যু সংবাদ তাঁকে জানানো হয়েছিল। কেন যে তিনি পান নি বোঝা যাচ্ছে না। পেলে, ইউরোপে অত দুঃখ সহ্য না করে তিনি নিশ্চয় সস্ত্রীক দেশেই ফিরতেন। সবই অদৃষ্ট!

সে কথা মেমসাহেবও স্বীকার করলেন।

কিন্তু—এহ বাহ্য।

আসল কথা, শুভ্রাংশুর অংশের সম্পত্তি মেমসাহেব বিক্রি করে দিতে চান। স্নেহাংশু যদি নেন, তাহলেই সব চেয়ে ভালো হয়! তিনি অর্ধেক দামেই তাহলে ছেড়ে দেবেন। নইলে…

স্নেহাংশু নিলেন না এবং নানারকম টালবাহানা করতে লাগলেন।

তারপরে হঠাৎ একদিন শুনলেন কুড়ি লক্ষ টাকার সম্পত্তি মাত্র এক লক্ষ টাকায় এক ইহুদিকে বিক্রি করে মেমসাহেব বিলেত চলে গেছেন।

.

এর পরে আরম্ভ হোল সেই ইহুদির সঙ্গে মামলা।

ইহুদি নিঃসহায় বিদেশিনী নয়। ঝানু ব্যবসায়ী। সুতরাং তাকে কাবু করা সহজ হোল না। অনেকদিন হাইকোর্টে ধস্তাধস্তির পর অবশেষে ঘোষেদের মর্যাদারক্ষার জন্যে সেই সম্পত্তি স্নেহাংশুকেই পনেরো লক্ষ টাকায় কিনে নিতে হোল।

কিন্তু তাতেই জের মিটলো না।

তার মানে সমস্ত টাকাটাই তাঁকে দেনা করতে হোল। এবং সে দেনা তিনি তো শোধ করতে পারলেনই না, তাঁর ছেলে হিমাংশুও এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তাই নিয়ে বিব্রত হয়ে রয়েছেন। সুদ যথাসম্ভব মেটানো হচ্ছে, কিন্তু আসলে এখনও পর্যন্ত বিশেষ হাত পড়েনি।

হিমাংশুকে নিয়েই এই কাহিনী।

ঘোষ পরিবারের এখন তিনিই কর্তা। বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। রং নীলাভ গৌর। শীর্ণ দেহ, কিন্তু এখনও নুয়ে পড়েনি। সুপক্ক আমের মতো ঢলঢলে মুখ। সেই মুখখানি এবং উজ্জ্বল আয়ত চোখ দুটি দেখলেই বোঝা যায় ভদ্রলোকের মনের মধ্যে গোলমাল নেই। দিলদরিয়া মেজাজ।

শ্রীমন্ত তার সব কিছুর জন্যে এই লোকটির কাছেই ঋণী। বাইরে শিকারে বেরিয়ে অনেক দিন আগে তিনি এই পিতৃমাতৃহীন সুদর্শন ছেলেটিকে সংগ্রহ করে এনেছিলেন।

তখন শ্রীমন্তর বয়স দশ-এগারো বৎসর।

হিমাংশুই তাকে এনে নিজের পরিবারে স্থান দিয়েছিলেন। তার পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাকে নিজ পরিবারের একজনের মতোই রেখেছিলেন। তার খাওয়া-পরা, স্কুল-কলেজের মাইনে, কোনো দুঃখই রাখেন নি।

সাধারণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারে এই অবস্থায় বাইরের লোক অতি সহজেই পরিবারভুক্ত হয়ে যায়। আর বোঝাই যায় না, সে এই পরিবারেরই একজন নয়। অভিজাত পরিবারে তা সম্ভব নয়। অসংখ্য দাস-দাসী ও কর্মচারীদের ব্যবহার ও দৃষ্টি সকল সময়েই তাকে নিজের প্রকৃত মর্যাদা স্মরণ করিয়ে দেয়। স্নেহপরায়ণ আশ্রয়দাতা ও স্নেহভাজন আশ্রিতের মধ্যে একটা স্থায়ী ব্যবধান অব্যাহত রাখার তারা আশ্চর্য কৌশল জানে।

শ্রীমন্তর থাকবার জন্যে নিজস্ব পৃথক ঘর, তার মূল্যবান জামা-কাপড়, ঘরের আবশ্যকীয় আসবাবপত্র, সর্বোপরি প্রিয়দর্শন চেহারা,—সবই ছিল। তবু সে এই অভিজাত পরিবারের মধ্যে মিশে যেতে পারেনি। বরং যতই বয়স বাড়তে লাগলো, ততই যেন এই পরিবারের থেকে সে দূরে সরে আসতে লাগলো।

ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর থেকেই অন্দরের মধ্যে তার যাতায়াত কমে আসতে থাকে। এখন একেবারেই যায় না। পরিবারে নতুন বধূ কেউ আসেনি। তাকে নিষেধও কেউ করেনি। তবু যেতে পারে না। বোধ করি ওই দাসী-চাকর ও কর্মচারীদের ছুঁচ ফোটানো দৃষ্টির জন্যেই।

হৈমন্তীও আগে দিনের বেলায় হামেশাই আসতো তার ঘরে, এখন ক্বচিৎ আসে। তাও লুকিয়ে, সকলের অজ্ঞাতসারে, শ্রীমন্তর অনুপস্থিতিতে।

তাকে নিষেধ করলে কে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *