কালোঘোড়া – ১

এক

শ্রীমন্তর বি.-এ.-র পরীক্ষার আর কয়েকমাস মাত্র বাকি। সে মাঝারি শ্রেণীর ছেলে। ভালোভাবে তাকে পাস করতে হোলে প্রচুর পরিশ্রম করা প্রয়োজন। তাতে সে ত্রুটি করে না। ভগবান তাকে ক্ষুরধার বুদ্ধি দেননি। কিন্তু সে-ত্রুটি তিনি পুষিয়ে দিয়েছেন অটুট স্বাস্থ্য এবং অসামান্য পরিশ্রম করবার শক্তি দিয়ে।

শ্রীমন্ত পড়ছিলো।

রাত্রি তখন দুটোর কম নয়। ঘোষেদের অত বড় বাড়ি ‘দেবধাম’, একেবারে নিস্তব্ধ। বাইরের দোতলার বালাখানায় বারোটা পর্যন্ত হল্লা চলেছে। মদ্যপান এবং আনুষঙ্গিক অনেক কিছু। তাদের আর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ফটকে রামমনোহর সিং ঘণ্টাখানেক আগেও সুর করে তুলসীদাসী রামায়ণ পড়ছিলো। সেও চুপ করেছে। কেবল দূরের বস্তিতে কারা হোলির গানের একঘেয়ে মহড়া দিচ্ছে। তারাই এখনো স্তিমিত হয়ে পড়েনি। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে তাদের সুর এবং ঢোলের বাজনার শব্দ ভেসে আসছে।

যে ঘরটিতে শ্রীমন্ত থাকে, সেটাকে ঠিক বাইরের ঘর বলা যায় না। অন্দরও নয়। সদর এবং অন্দরের মাঝামাঝি একটি ছোট ঘর। তার একধারে একটা ছোট তক্তাপোশে তার বিছানা পাতা। ঘরটি জীর্ণ হোলেও বিছানা বেশ ধোপ-দুরস্ত। ঝালর-দেওয়া নরম জোড়াবালিশ, সুদৃশ্য বিছানার চাদর। বালিশ এবং চাদরের কোণে সুন্দর লতা-পাতার মধ্যে তার নামের আদ্যক্ষর ‘S’ লেখা।

তক্তাপোশের পাশে একটি ছোট্ট টিপয়। ওদিকে জানালার ধারে একটি ছোট টেবিল এবং চেয়ার। টেবিলের উপর শ্রীমন্তের পড়ার বইগুলো সাজানো রয়েছে। কলমদানিতে একটি মূল্যবান ফাউন্টেন-পেন।

পা-তলার দিকে একটি র‍্যাকে তার কাপড়-জামাগুলোও গোছানো রয়েছে। সেগুলো মলিন নয়।

দেখলে বোঝা যায়, পরের বাড়িতে শ্রীমন্ত দুঃস্থ অনাদৃতভাবে নেই। বরং বেশ আরামেই রয়েছে। তার পোশাক-পরিচ্ছদ চাল-চলন এ বাড়ির নিকট-আত্মীয়ের মতো। যাকে ‘চ্যারিটি বয়’ বলে সে-রকমের নয়।

চেহারাও তার এই বাড়িরই নিকট-আত্মীয়ের মতো। টকটক করছে রং। দীর্ঘচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ, সুঠাম চেহারা। ঠোটে অল্প গোঁফের রেখা। মাথার কোঁকড়া চুল সযত্নে পিছন দিকে ব্রাশ করা। আজকালকার ফ্যাশান অনুযায়ী লম্বা জুলফি। ললাট, ভুরু ও নাক নিখুঁৎ। কেবল খুঁতের মধ্যে চোখ দুটি ছোট এবং ঠোঁট পুরু। কিন্তু সে-ত্রুটি চোখে পড়ে না। চাঁদের কলঙ্কের মতো তার মুখের সঙ্গে তা চমৎকার মানিয়ে গেছে।

নিজের রূপ সম্বন্ধে সে সকল সময় সচেতন। সে জেনেছে, সংসারে এই রূপের মূল্য আছে। সে সৌখিন ছেলে। সকল সময় দিব্য ফিটফাট থাকে। বিকেলে বেড়াতে বেরুবার সময় একটু স্নো-পাউডার মাখে, রুমালে এসেন্সও নেয়। আর, যা ব্যবহার করে সেগুলো সস্তা খেলো জিনিস নয়, ভালো-ভালো দামী জিনিসই।

সন্ধ্যা থেকে রাত্রি বারোটা পর্যন্ত শ্রীমন্ত একনাগাড়ে ঠায় চেয়ারে বসে পড়েছে। তার মেরুদণ্ড টন টন করছিল। ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে আসছিলো।

কিন্তু ঘুমোনো কিছুতেই চলবে না।

বড়লোকের ছেলেদের ফের করা পোষায়। কিন্তু তার নয়। তাকে পাস করতেই হবে এবং এইবারে, এই প্রথমবারেই। রাত্রি তিনটে অবধি সে পড়বে। তারপর ঘড়িতে ছ’টার এলার্ম দিয়ে সে শোবে। এলার্ম বাজামাত্রই সে উঠে, মুখহাত ধুয়ে আবার পড়তে বসবে,—বেলা এগারোটা পর্যন্ত। একবারে যাদের পাস করতে হবে, তিন ঘণ্টা ঘুমই তাদের পক্ষে যথেষ্ট।

তবু ঘুমে চোখ বুজে আসে।

শ্রীমন্ত ঘড়ি দেখলে একটা বেজে গেছে। স্টোভ জ্বেলে নিজেই একটু কফি তৈরী করে খেলে।

হ্যাঁ। ঘুম এবার কেটে যাচ্ছে। চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে থেকে শীতে পা’টা যেন জমে গিয়েছিল। কফি খেয়ে শরীরটা একটু গরমও হোল। কফির গুণ আছে। কিন্তু মেরুদণ্ডের বেদনা কফিতে সারে না। আর চেয়ারে বসে নয়, বাকি সময়টা বিছানায় লেপ-মুড়ি দিয়ে পড়া করাই ভালো।

সেই নভেম্বর থেকে এই পড়ার চাপ আরম্ভ হয়েছে। তার যে অসুরের মতো স্বাস্থ্য, তাও যেন ভেঙে আসছে। নার্ভটা ঠিক রাখতে হবে। ‘ডিক্সোভাইন’টা আরও কিছুদিন ব্যবহার করা প্রয়োজন। এ শিশিটা ফুরিয়ে আসছে। কাল আর এক শিশি কিনতে হবে।

টাকাও কিছু দরকার। ব্যাগে আর বিশেষ কিছু নেই।

শ্রীমন্ত টেবিল-ল্যাম্পটা বিছানার মাথার দিকে টিপয়ের উপর রাখলে। রুপোর ডিবেয় সুগন্ধি পান তৈরী করাই ছিল। গোটা দুই পান মুখে পুরে একটা সিগারেট ধরালে।

সিগারেটটি শেষ করে ‘অ্যাশট্রে’র মধ্যে ফেলে দিয়ে চিৎ হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়া করতে লাগলো।

.

হঠাৎ দরজায় শব্দ হোল, ঠুক ঠুক।

তারপরে আবার ঠুক ঠুক ঠুক।

খুব আস্তে আস্তে শব্দ। শ্রীমন্ত লেপটা সরিয়ে দিয়ে উঠে এসে সন্তর্পণে দরজা খুলে দিলে।

হৈমন্তী!

তাড়াতাড়ি ওর পাশ কাটিয়ে হৈমন্তী ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লো। শ্রীমন্ত দরজাটা বন্ধ ক’রে দিলে।

বিরক্তভাবে হৈমন্তী বললে, দরজাটা বন্ধ করে রেখেছিলে তো? আমি যাতে না আসি সেই তোমার ইচ্ছে, না? আমি বেহায়া, তাই আসি।

রাগে, দুঃখে ওর চোখ ছল ছল করে উঠলো।

শ্রীমন্ত ব্যস্তভাবে ওকে আদর করে নিয়ে এসে বিছানায় বসালো।

আজকে পড়ার দায়ে নিশ্চিন্ত! মনে-মনে তার রাগই হচ্ছিল।

কিন্তু অভিনয়ে সে দক্ষ। মুখখানি সে করুণ করে বললে, ছিঃ! ছিঃ! এমন কথা তুমি ভাবলে হিমু? অবশ্য আমি ভেবেছিলাম, আজ আর হয়তো তুমি আসবে না। কিন্তু দরজা সেজন্যে বন্ধ করিনি! ও-দরজাটা এমনি বেয়াড়া যে একটু হাওয়াতেই খুলে যায়। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে গায়ে লাগে।

হৈমন্তীর মন একটুখানি প্রসন্ন হোল।

বললে, বাইরে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় লাগে। কি জানি, কখন কে দেখে ফেলে। সে-কথা বোঝ না কেন?

শ্রীমন্ত তেমনি কুণ্ঠিতভাবে বললে, বুঝি! কিন্তু ওই যে বললাম, ভেবেছিলাম আজ আর তোমার দয়া হবে না।

হৈমন্তী এবারে ফিক করে হেসে ফেললে। বললে, তোমার পরীক্ষা। আসব নাই-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু এগারোটা, বারোটা, একটা বাজলো, ঘুম আর কিছুতে আসে না। শেষে দুটো যখন বাজলো আর পারলাম না থাকতে। চুপি-চুপি বাইরে বেরিয়ে এলাম। বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে দেখি, তোমার জানালার খড়খড়ি দিয়ে আলো আসছে। ঘরের মধ্যে দিদি অঘোরে ঘুমুচ্ছে। আর থাকতে পারলাম না। চলে এলাম।

—দিদি জানতে পারবেন না তো?

একটা রহস্যময় হাসি হেসে হৈমন্তী বললে, কি জানি!

—তোমার ভয় করছে না?

হৈমন্তীর মুখ হঠাৎ পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠলো। বললে, না। তোমার জন্যে আরও অনেক শক্ত কাজ আমি করতে পারি। হয়তো করতে হবেও। সেদিন দেখো।

হৈমন্তী অন্যদিকে চেয়ে স্তব্ধভাবে বসে রইলো।

শ্রীমন্ত খুশি হয়ে উঠলো। তার মস্তিষ্কে তখন ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দোল খাচ্ছে একটি কথা : ব্যাগ খালি হয়ে এসেছে; কিছু টাকার দরকার।

খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিল হৈমন্তী। শ্রীমন্তর জন্যে অনেক শক্ত কাজ হয়তো একদিন তাকে করতে হবে; এইকথার সম্পূর্ণ অর্থ শুধু সে-ই জানে। শ্রীমন্ত জানে না, জানার আগ্রহও তার নেই। তার ব্যাগ খালি হয়েছে। কিছু টাকার বড় দরকার। সে হৈমন্তীর পায়ের তলায় মেঝের উপর বসলো। তার মুখের নিচের অর্ধেকটায় টেবিল ল্যাম্পের অনাবৃত আলো এসে পড়েছে। উপরার্ধে নীল-সোনালি ঝালরের ফাঁক দিয়ে নীল সোনালি আলো।

নিজের সুন্দর মুখের মূল্য সে বোঝে।

সেই বিচিত্র আলোয় সুন্দর মুখখানি হৈমন্তীর মুখের দিকে তুলে সে বললে, আমি জানি হিমু। কিন্তু তবু তুমি যখন রাগো, তখন আমার ভয় করে। নিজেকে এত অসহায় বোধ হয় যে, চারিদিকে অন্ধকার দেখি।

হৈমন্তীর স্তব্ধতা তখনও কাটেনি। গুরুতর কিছু-একটা হয়তো ঘটেছে। কিন্তু সেটা এখনও শ্রীমন্তকে বলার সময় হয়নি। একা তার মনকেই ভারাক্রান্ত করে রেখেছে। হয়তো এখনও কিছুদিন একা তাকেই সেই ভার বইতে হবে।

শ্রীমন্তের কথায় সে নিঃশব্দে তার মাথার কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো।

হৈমন্তী যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালো।

তখন পাঁচটা বেজে গেছে। কিন্তু শীতের রাত্রি, বেশ অন্ধকার রয়েছে। অন্দর সুখসুপ্ত। সদরে রাজমনোহরের ঘটি মাজার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রাজপথে ট্রাম তখন ও চলছে না। কিন্তু মাঝে মাঝে রিক্সার ঠুং ঠুং শব্দ ভেসে আসছে।

যাবার আগে হৈমন্তী বাইরের দিকের জানালাটা খুলে দিয়ে সেইখানে ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটু দাঁড়ালো।

কী চমৎকার কুয়াশা করেছে বাইরে!

শ্রীমন্ত ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে সেই হাওয়া ফুসফুস ভর্তি করে গ্রহণ করতে লাগলো। ঠাণ্ডা হাওয়ায় হৈমন্তীর উত্তপ্ত মুখ যেন জুড়িয়ে গেল। আঃ!

একটু পরে শ্রীমন্ত বললে, আর নয় হিমু। আর দেরি করা ঠিক নয়।

হৈমন্তী রেগে বললে, তাড়িয়ে দিচ্ছ!

—ছিঃ! ছিঃ! ওকথা বোলো না। আমার বড় ভয় করে। দিদির ঘুম ভেঙে গেলে সর্বনাশ হবে।

ফিক করে হেসে হৈমন্তী বললে, সর্বনাশের কি কিছু বাকি আছে? দিদি ছ’দিন হোল এসেছে, তুমি কি মনে কর, এর মধ্যে সে কিছু টের পায়নি?

ভয়ে শ্রীমন্তের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো। বললে, বলো কি!

অন্ধকারে ওর মুখ হৈমন্তী দেখতে পেলে না। কিন্তু কণ্ঠস্বরে ওর ভয়ার্ত অবস্থা টের পেলে। বললে, আমি ঠিক জানি না। এখনও টের না পেলেও টের শীগগির পাবেই। তাতে তোমার ভয়টা কি?

শ্রীমন্তর সমস্ত দেহ শিউরে উঠলো।

বললে, ছেলেমি কোরো না হিমু। তুমি তো জানো না, কিন্তু আমি নিজে জানি, এইভাবে কত খুনখারাপি হয়ে গেছে।

হৈমন্তী দৃঢ়ভাবে বললে, আমি বেঁচে থাকতে নয়।

ওর সাহস দেখে শ্রীমন্ত মুহূর্তকালের জন্যে হতবাক হয়ে গেল। কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ের বুকে এত সাহস? বোধ করি, জানে না বলেই।

ব্যাকুলভাবে শ্রীমন্ত বললে, অমন কাজও কোরো না লক্ষ্মীটি। দিদি যে ক’দিন আছেন, সে ক’দিন অন্তত সাবধানে থেকো। নইলে তুমিও যাবে, আমিও যাব।

হৈমন্তী ওর ব্যাকুলতা দেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো।

শ্রীমন্ত ওর হাত দুটি জড়িয়ে ধরে বললে, তুমি হাসছ হিমু, কিন্তু ভয়ে আমার সর্বশরীর হিম হয়ে গিয়েছে। তুমি কথা দাও, তুমি সাবধানে থাকবে।

এক মুহূর্ত গম্ভীরভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হৈমন্তী বললে, আচ্ছা, দিলাম কথা। দিদি আরও হপ্তাখানেক থাকবে। এর মধ্যে এ ঘর আর মাড়াবো না।

বলতে-বলতে হৈমন্তীর চোখ ফেটে জল এল। কিন্তু তা শ্রীমন্তর চোখে পড়লো না। সে খুশি হয়ে বললে, কেবল কাল একবার আসতে হবে। রাত্রে নয়, দিনে। আমি যখন থাকবো না সেই সময়, একনমিক্সখানার ভিতরে দু’খানা দশ টাকার নোট রেখে যাবে, কেমন?

হৈমন্তী তখনও নিজেকে সামলাতে পারেনি। কোনোমতে বললে, আচ্ছা। তারপর চুপি-চুপি বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *