কালোঘোড়া – ১৩

তেরো

মা, —মাগো,—দুটি খেতে দাও মা!

এই কান্না যেন ক্ষুধার্ত কলকাতার মর্মস্থল থেকে দিন রাত্রি উঠছে। গৃহস্থের আহার- নিদ্রা বিষিয়ে উঠলো। সমস্ত সময় মানুষের কানে এই একটি সুর নিদ্রায়-জাগরণে বেজে চলেছে : মা, মাগো…

পথে-পথে পড়ে রয়েছে দুর্গতের শবদেহ। অস্থিচর্মসার বীভৎস মুখে ওরা যেন প্রচলিত সমাজ ও শাসন-ব্যবস্থাকে মুখ ভেঙাচ্ছে। চোখে দেখা যায় না। প্রথম প্রথম পথচারী চমকে উঠতো। কিন্তু তাও ধীরে ধীরে সয়ে এল।

‘দেবধামে’র ঘোষ-পরিবারে দুর্গতির আর সীমা রইল না।

দেবসেবার জন্যে আতপ চালের প্রয়োজন। সে কোথায় পাওয়া যায়? আশ্রিত- পরিজন, বামুন, চাকর, ঝি, সব মিলিয়ে অনেকগুলি প্রাণী। এতগুলি প্রাণীর চালই বা কোথায় পাওয়া যায়?

হিমাংশুবাবু সদাশিব লোক। এসব কথা তাঁর কানে কেউ বড় একটা তুলতো না। কর্মচারীরা যেখান থেকে পারতো চাল যোগাড় করতো, তাঁর জন্যে মিহি চালও। দামের প্রশ্ন এখন আর ওঠে না। সুতরাং এতে কর্মচারীদেরও দু’পয়সা থাকতো।

ইতিমধ্যে মিহি চাল একদিন আর কোনক্রমেই পাওয়া গেল না। হিমাংশুবাবু খেতে বসে চমকে উঠলেন!

এ কী চাল! যেমন মোটা, তেমনি বিচিত্রবর্ণ, তেমনি কাঁকর!

গৃহিণী কাঁচুমাচু করে বললেন, এ ছাড়া আর কোনো চাল পাওয়া গেল না।

ঋণের দায়ে হিমাংশুবাবু বিব্রত। এবং ঋণ যত বাড়ছে, তাঁর মদ্যপানও তত বাড়ছে; বাড়তে বাড়তে এখন এমন হয়েছে যে, দিন-রাত্রির খুব অল্প সময়ই তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকেন।

কিন্তু চালের দিকে চেয়ে তাঁরও নেশার ঘোর কেটে গেল।

শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, দুর্ভিক্ষ কি তাহলে সত্যিই আরম্ভ হয়েছে? আমি ভাবছিলাম, খবরের কাগজের কারসাজি।

হিমাংশুবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

গৃহিণী বললেন, ভিখারীদের ডাক তোমার কানে যায় নি?

—ডাক! কি ডাক? শুনিনি তো!

নোয়াখালির মহালটা বিক্রি হয়ে যাবার পর থেকেই উনি আর বালাখানায় যান না। মোসাহেবের দলও কিছুদিন ব্যর্থ চেষ্টার পর তাঁকে ত্যাগ করেছে। যে ঘরে আগে শ্রীমন্ত থাকতো, সেই ছোট ঘরটিতেই এখন তিনি একা দিবারাত্রির অধিকাংশ সময় থাকেন!

কেউ তাঁর কাছে আসে না। তিনিও কোথাও যান না। ভিখারীর কান্না এতদূর পৌঁছায় না। নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে যদি বা পৌঁছায়, হিমাংশুবাবু তখন প্রকৃতিস্থ থাকেন

অনুযোগের সুরে গৃহিণী বললেন, তুমি একটু জাগো; চোখ মেলে চাও, কি ঝড় যে বয়ে যাচ্ছে একবার দেখ!

হিমাংশুবাবু একটু চুপ করে থেকে করুণ কণ্ঠে বললেন, আমার আর সামর্থ্য নেই গিন্নী। আমার ভরসা তোমরা ছেড়ে দাও। শঙ্করকে ধরো। তাকে মানুষ করে তোলো। দুঃখ যে কি তাকে চিনতে দাও।

—কী যে বলো তুমি! শঙ্কর ছেলেমানুষ, সে কি করতে পারে?

—না পারে, সব যাবে। আমি কি করব? আমার আর শক্তি নেই।

হিমাংশুবাবু অনেক ভেবেচিন্তে এক গ্রাস ভাত মুখে দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কেমন একটা দুর্গন্ধে নাক সিঁটকে ভাত ফেলে দিলেন। তারপরে একটু মাছ মুখে দিয়ে উঠে পড়লেন।

ম্লান হেসে শান্ত কণ্ঠে বললেন, আজ পারলাম না গিন্নী। কিন্তু তুমি ভেবো না, আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে যাবে। তোমরা এই চাল খাও তো? বেশ, বেশ।

যেমনকার ভাত তেমনি পড়ে রইল।

গৃহিণী কাঠের মতো শক্ত হয়ে বসে রইলেন। একটা কথাও বলতে পারলেন না।

.

দুঃখের তাতে শঙ্কর যেন অকালেই পেকে যাচ্ছে।

নোয়াখালির মহালটা বিক্রি হয়ে যাবার খবর পেয়েই বাসন্তী এবং হৈমন্তী দু’জনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।

কিন্তু হিমাংশুবাবু কোথায়? কার কাছে তারা দুঃখ জানাবে? হিমাংশুবাবু তখন ইয়ার- বক্সি নিয়ে সন্ধ্যার মজলিসের পরিকল্পনা তৈরি করছেন। তাঁকে পাওয়া অসম্ভব।

তাঁর বদলে পেলে শঙ্করকে।

ছেলেমানুষ বলে তাকে তারা নিষ্কৃতি দিলে না। যা-কিছু উপদেশ দেবার, বাবাকে যা-কিছু বলবার, সে সমস্ত তারা তাকেই বলে বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল।

নায়েব-গোমস্তা-কর্মচারীর দল, তারাও তাকেই সব জানাতে লাগলো : বড়বাবু যে- রকম করে চলেছেন, তাতে সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি উড়ে যেতে বেশি দিন লাগবে না। কিন্তু তিনি তো শুনবেন না। তিনি চোখ বুজে ছুটে চলেছেন অন্ধকার গহ্বরের দিকে। এখন শঙ্কর যদি শোনে,–সে যদি বোঝে

শঙ্কর শোনে। যেখানে যা-কিছু দুঃসংবাদ সব তার কানে এসে পৌঁছয়। বোঝবার বয়স তার হয়নি, তবু বোঝবার চেষ্টা করে, ভাবে।

এবং এত অল্প বয়সে ভাবতে শিখলে যা হয়, শঙ্কর অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে গেল। বাইরে বেরুতে তার ইচ্ছা করে না। বেরুলেই চোখে পড়ে অস্থিচর্মসার নরনারী ও বীভৎস মৃতদেহ। সে দৃশ্য সে সইতে পারে না।

বাইরে সে বেরোয় না। বাড়িতেও সঙ্গী কেউ নেই। একলা বসে বসে ভাবে, এই বৃহৎ বাড়ি,–এর পরিণাম কি!

সেদিন হিমাংশুবাবু ভিতরে এলে ও নিঃশব্দে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো।

অনেকদিন পরে ওকে দেখে হিমাংশুবাবু যেন চমকে উঠলেন :

—তুমি এত রোগা হয়ে যাচ্ছ কেন?

শঙ্কর উত্তর দিলে না।

কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে চোখ নামিয়ে বললে, আমি বলছিলাম, এতগুলো ঝি-চাকর রাখার দরকার কি?

ওর বিজ্ঞজনোচিত কথার ভঙ্গিতে হিমাংশুবাবু বিস্মিত হলেন।

একটু ভেবে বললেন, এত বড় বাড়ি, এর চেয়ে কম দাসী-চাকরে কি চলবে?

-–চালাতে হবে। যখনকার যেমন।

হিমাংশুবাবুর মুখ পলকের জন্যে বিবর্ণ হয়ে গেল। এই দুধের ছেলে, এও বুঝেছে তারা ধীরে ধীরে দরিদ্র হয়ে আসছে!

এক মিনিটের জন্যে তাঁর মুখ থেকে যেন কথা বেরুলো না।

কোনো রকমে স্খলিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মা কি বলেন?

—মাও বলেন, এত ঝি-চাকরের দরকার নেই।

—তাহলে তাই করো, আসছে মাস থেকে জনকয়েক ছাড়িয়ে দিও।

হিমাংশুবাবু আবার বেরিয়ে গেলেন।

শঙ্কর বুঝলে, তিনি মনে কষ্ট পেলেন এবং এই কষ্ট ঢাকবার জন্যেই বাইরে গেলেন। দেখে তারও কষ্ট হোল। কিন্তু কি করা যায়? এ সময় একটু শক্ত হতেই হবে। সমারোহ করার দিন আর তাদের নেই। মাথার উপর পর্বতপ্রমাণ দেনা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। এখনও যদি হিসেব করে তারা চলতে না পারে, তাহলে যা আছে, তাও রাখা যাবে না। এই ‘দেবধাম’, এই বিখ্যাত ঘোষ-পরিবার—দেখতে দেখতে এর চিহ্নও থাকবে না।

শঙ্কর স্থির করলে, তার মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে যত দিকে সম্ভব খরচ কমাতে হবে। বাইরের চাল যা নিতান্ত না রাখলে নয়, তাই মাত্র রাখা হবে। হিমাংশুবাবুর দুঃখ হবে, অনেক অসুবিধা এবং কষ্ট হবে। কিন্তু এ অবস্থায় শক্ত না হোলে উপায় কি?

দাসী-চাকর কয়েকজনকে ছাড়িয়ে দেওয়া হোল; অন্দরের জন্য রইল শুধু একজন ঝি। আর সদরে রইলো হিমাংশুবাবুর খাস চাকর রঘুয়া। রঘুয়াকে ছাড়া তাঁর একটা মিনিট চলে না। এতে টাকার দিক দিয়ে যে খুব সুবিধা হোল তা হয়তো নয়। ক’টা টাকাই বা ওরা মাইনে পেতো? সুবিধা হোল চালের। চাল সংগ্রহ করা সম্প্রতি খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সত্য কথা বলতে গেলে, ওদের নিজেদের পরিবার নিতান্তই ছোট। কর্তা, গিন্নী আর শঙ্কর। বাড়ি সরগরম থাকতো চাকর-বাকরেই। তাদের প্রায় সবগুলো চলে যাওয়াতে বাড়ি একেবারে খালি হয়ে পড়লো। নিস্তব্ধ নিঝুম। গিন্নী মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠেন। মনকে সান্ত্বনা দেন, দু’দিন পরে সয়ে যাবে।

ঠাকুরটাকেও ছাড়িয়ে দেওয়া তাঁর ইচ্ছা ছিল। লোকজন নেই, কি হবে শুধু শুধু ঠাকুর রেখে?

কিন্তু এইখানটায় বড়বাবু বেঁকে দাঁড়ালেন।

গিন্নী বললেন, ক’জনই বা লোক! এমন বুড়ো হাবড়াও হইনি, এই ক’জনের রান্না আমি খুব পারব।

বড়বাবু কঠোরকণ্ঠে বললেন, না।

এই সংক্ষিপ্ত বাক্যের গুরুত্ব যে কতখানি, গিন্নী তা জানতেন। সুতরাং ঠাকুরকে সরাতে সাহস করলেন না।

ভাবলেন, থাক। মেয়ের বাড়ি যাওয়া, খবরাখবর নেওয়া, ঠাকুর ছাড়া কেউ পারবে না। থাক ও।

রয়ে গেল বাইরের দরওয়ানটাও।

এই অবস্থায় একদিন হঠাৎ শ্রীমন্ত এসে উপস্থিত। এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে এ বাড়িতে এই তার প্রথম পদার্পণ।

দেউড়ির দরওয়ান ম্লান হাস্যে তাকে সংবর্ধনা করলে।

বললে, ভিতরে চলে যান। সদরের বালাখানা বন্ধ।

শ্রীমন্ত উপরের দিকে চেয়ে দেখলে, বন্ধই বটে। চারিদিক কেমন শ্রীহীন বোধ হতে লাগলো। বাড়ি ঢোকবার গোল রাস্তার দু’পাশে জঙ্গল হচ্ছে। গাড়িবারান্দার এক কোণে কতকগুলো ময়লা জমেছে। ফোয়ারাটা দিয়ে আর জল পড়ে না। সেই শখের লাল- নীল মাছগুলোও আর নেই। নেই সেই কলরব, ছুটোছুটি এবং চঞ্চল সজীবতা।

উপরে উঠে শ্রীমন্ত প্রথমে তার নিজের পুরোনো ঘরটির দিকে উঁকি দিলে।

দেখলে, সেই ঘরে মেঝেয় ফরাস বিছিয়ে বড়বাবু গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে একখানা খবরের কাগজ পড়ছেন।

শ্রীমন্ত গিয়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে।

হিমাংশুবাবু বিস্ফারিত চোখে ওর দিকে চেয়ে সবিস্ময়ে বললেন, শ্ৰীমন্ত! অনেক দিন পরে এলে বলে মনে হচ্ছে যেন!

শ্রীমন্ত উত্তর দিলে না। দেখলে, বড়বাবুর শরীর অনেকখানি কাহিল হয়ে গেছে। সেই গম্ভীর শান্ত কণ্ঠস্বরও যেন দুর্বল।

জিজ্ঞাসা করলে, আপনার কি অসুখ করেছিল?

—না তো।

—শঙ্কর এরা সব কোথায়?

—ভেতরে, ভেতরে। চলে যাও। তোমার আর সঙ্কোচ কি?

শ্রীমন্তর বুক একবার দ্রুততালে নেচে উঠলো : হৈমন্তী কি আছে? ভিতরের প্রশস্ত দরদালানে গৃহিণী তরকারি কুটছিলেন। শ্রীমন্তকে দেখে লজ্জিতভাবে তাড়াতাড়ি বঁটিটা বন্ধ করে এক পাশে সরিয়ে রেখে দিলেন।

—ওমা, শ্রীমন্ত! বুড়ো বাপ-মাকে এতদিনে মনে পড়লো? এসো, এসো।

শ্রীমন্ত হেঁট হয়ে ওঁর পায়ের ধূলো নিয়ে মেঝেতেই বসে পড়লো।

—ওকি, ওকি! দাঁড়াও, একখানা আসন এনে দিক। অ—কদম!

—কিচ্ছু দরকার নেই মা। এই বেশ বসেছি! কেমন আছেন বলুন? শরীর তো ভালো দেখাচ্ছে না!

কেমন থাকার কথায় গৃহিণীর বুকের ভিতরটা যেন হাহাকার করে উঠলো। চোখ জ্বালা করতে লাগলো।

তবু হেসে বললেন, আমাদের আর থাকা-থাকি বাবা! বয়স হচ্ছে, এখন তোমাদের রেখে ভালোয় ভালোয় যেতে পারলেই বাঁচি। তুমি কেমন আছ?

বলে শ্রীমন্তর দিকে চাইলেন।

পরনে তার কোঁচানো দেশী ধুতি। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবিতে ঝলমল করছে হীরার বোতাম। আঙুলে দামী দামী কয়েকটা আংটি। এতগুলো আংটি এক সঙ্গে সে বড়-একটা পরে না। আজকে কেন পরেছে, কে জানে?

গিন্নী হেসে বললেন, যাই বল বাছা, তোমার সেই লাবণ্য যেন নেই! বড্ড কি বেশি খাটতে হয়?

—ঠিক ধরেছেন মা। মায়ের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না।

শ্রীমন্ত হো হো করে হেসে উঠলো।

গৃহিণীর স্নেহের পরিচয় শ্রীমন্ত বরাবরই পেয়ে এসেছে। কিন্তু এই শান্ত অথচ রাশভারী মহিলার এত কাছে বসে এমন জোরে হাসতে শ্রীমন্ত এর আগে কখনও সাহস করেনি। ব্যাপারটা এমনই অভিনব যে, ঘোষ-গৃহিণীর চোখে পর্যন্ত বিস্ময় ফুটে উঠলো।

কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না ক’রেই শ্রীমন্ত বলতে লাগলো :

—খাওয়ার যে কি কষ্ট সে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। ঠাকুরটা বোমা পড়ামাত্র পালিয়েছে, সেই সঙ্গে চাকরটাও। তার বদলে যে চাকরটা পেয়েছি, সে বদ্ধ কালা। ঝোল রাঁধতে বললে ভাজা করে, ডাল বললে টক। আর সে কী রান্না?

—তাহলে তুমি এইখানেই আজ খেয়ে যাবে বাছা! সেইজন্যেই শরীর অমন হয়েছে। অ কদম!

শ্রীমন্ত হাত জোড় করে বললে, আজ থাক মা। আজকে অনেক ঝামেলা, অনেক জায়গায় ঘুরতে হবে। আর একদিন এসে প্রসাদ খেয়ে যাব।

গৃহিণী হেসে বললেন, আর একদিনও আসবে বাবা। আজকেই খেয়ে যেতে হবে। অ কদম!

শ্রীমন্ত বুঝলে, এর পরে বাধা দেওয়া নিরর্থক।

এমন সময় ধীরে ধীরে হিমাংশুবাবু এসে ওদের কাছে দাঁড়ালেন।

গায়ে একখানা সিল্কের কল্কাদার কিমানো। পরনে পায়জামা। মুখে চুরুট। ডান হাতে একখানা ‘স্টেটসম্যান’।

হিমাংশুবাবুর শরীর যে কত খারাপ হয়ে গেছে, শ্রীমন্ত এতক্ষণে পরিপূর্ণভাবে টের পেল। এই দু’বৎসরেই ভদ্রলোক বেশ খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছেন। ডান হাতের খবরের কাগজখানা অনবরত কাঁপছে। দুই হাতেরই বোধ হয় এই অবস্থা। স্খলিত চরণ, জড়িত কণ্ঠ।

এই কিমানোটা শ্রীমন্তের অপরিচিত নয়। অনেকদিন থেকে দেখে আসছে। মাঝে মাঝে ফুটো হয়ে গেছে। বাইরের ছোট ঘরটিতে যখন তিনি বসেছিলেন, এটা গায়ে ছিল না। এখন শ্রীমন্তর কাছে কেন যে পরে এলেন, কে বলবে? দারিদ্র্যের লজ্জা ঢাকবার জন্যে? কে জানে!

বললেন, যুদ্ধের খবর কি হে?

রঘুয়া তাড়াতাড়ি একটা কুশন-চেয়ার এনে দিলে! শ্রীমন্তর কাছে তিনি সেইটাতে বসলেন।

শ্রীমন্ত যুদ্ধের খবর খুব বেশী রাখে না। তবু বললে, খুব ভালো বলে মনে হচ্ছে না।

উত্তেজিত ভাবে হিমাংশুবাবু বললেন, নয়ই তো। সেদিন সলোমন আইল্যান্ডসের কাছে আকাশে আর সমুদ্রে যে বিরাট যুদ্ধ হয়ে গেল, তার ফলাফল কিছু জানো?

ফলাফল দূরের কথা, যুদ্ধের খবরটা সে এই প্রথম শুনলে। কিন্তু ভূগোলের সব এখনও সে ভুলে যায় নি। বুঝলে, যুদ্ধটা ঘটেছে জাপানে আর আমেরিকায়।

সুতরাং তৎক্ষণাৎ সহাস্যে বললে, ফলাফল তো বোঝাই যাচ্ছে। ওকি আর বলবার?

—এই! আমিও সেই কথাই বলছিলাম। ফল যা হয়েছে তা জানাই, কি বলো?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

হিমাংশুবাবু চেয়ারটা শ্রীমন্তর কাছে আর একটু সরিয়ে এনে ফিস্ ফিস্ করে বললেন, আচ্ছা জাপানীরা কি শীগগির ভারতবর্ষ আক্রমণ করবে বলে মনে হয়?

—সে বিষয়ে আর সন্দেহ আছে? এরা তো বাঙলা দেশ ছেড়ে দেবার জন্যে তৈরি হয়েই বসে আছে।

হিমাংশুবাবু হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁর বাহুতে কপালে নীল শিরা স্ফীত হয়ে উঠলো।

বললেন, যাক, যাক! সব ধ্বংস হয়ে যাক, পাপে এই শহর পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আবার যদি এইখানেই শহর পত্তন করতে হয়, তাহলে এর এক হাত মাটি তুলে ফেলতে হবে। এর মাটির নিচে পর্যন্ত বিষ ঢুকেছে, জানো শ্রীমন্ত, মাটির নিচে পর্যন্ত!

হিমাংশুবাবু ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বাইরে চলে গেলেন। শ্ৰীমন্ত অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। এই শান্ত নির্বিরোধী মানুষটির মনে এমন ভূমিকম্পের উত্তাপ জমলো কি করে?

কার উপর ক্রোধ?

শ্রীমন্ত জানে, ঘোষবংশের আভিজাত্যের এই শেষ প্রতীক এখনও বৃটিশ শাসনের অনুরাগী। তবে? কার বিরুদ্ধে, কিসের বিরুদ্ধে ওঁর জীর্ণ মনে এই উত্তাপ সঞ্চিত হচ্ছে? কে জানে!

.

শঙ্কর আর শ্রীমন্ত এক সঙ্গে দোতলার দরদালানে খেতে বসলো অনেককাল পরে।

গৃহিণী সামনে বসে খাওয়াতে লাগলেন।

শ্রীমন্তর উপর গৃহিণীর অনুগ্রহ বরাবরকার। কিন্তু আজকের আয়োজনে যেন একটু বিশেষত্ব আছে। এ যেন একটা সম্মান এবং তার জীবনে এ সম্মান এই প্ৰথম।

গৃহিণী বললেন, তুমি বাড়ির লোক, তাই খেতে বললাম। নইলে যা চাল, বাইরের লোককে আর খেতে বলা যায় না।

হেসে বললেন, জামাই এলে দিনের বেলাতেও লুচি দিই। লজ্জায় সুবিমল দিনে আসে না।

ভাতের দিকে চেয়ে শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করলে, বড়বাবুও কি এই চালের ভাত খান?

—তাঁর ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে। এই ভাত খেতে পারেন না, একটু নাড়াচাড়া করে উঠে পড়েন।

শঙ্করের দিকে চেয়ে শ্রীমন্ত বললে, তুমি আমাকে বলোনি কেন?

সবিস্ময়ে শঙ্কর বললে, তুমি ভালো চাল দিতে পারতে?

—এখনও পারি। তা তোমাকে আর যেতে হবে না, আমিই বরং একদিন মণ দুই ভালো চাল দিয়ে যাব। কিন্তু…

শঙ্করের ভাতের গ্রাস মধ্যপথেই থেমে গেল।

বললে, কিন্তু কি?

শ্রীমন্ত একটু ভেবে বললে, কাল সোমবার। কাল রাত একটার সময় চাল নিয়ে আসব। দরোয়ানকে গেট খুলে জেগে থাকতে বলবে!

শঙ্কর হেসে বললে, দরোয়ান কেন শ্রীমন্তদা, আমরা বাড়িসুদ্ধ সবাই সারারাত গেটের গোড়ায় বসে থাকতে পারি,—এমনি অবস্থা হয়েছে।

গৃহিণী বললেন, হাসির কথা নয় বাবা, সত্যি তেমন অবস্থা হয়েছে। বিশেষ, ওঁর শরীর একেবারেই ভেঙে গেছে।

—শুধু শরীর?—গৃহিণীর মুখের উপর একটা কালো ছায়া নামলো।

শঙ্কর বললে, কিছুদিন থেকে বাবার অবস্থাও খুব ভালো বোধ হচ্ছে না।

গৃহিণী বললেন, ওই শুনলে না তখন? সব ধ্বংস হয়ে যাক, এই হয়েছে ওঁর বুলি।

বিচিত্র কিছুই নয়। আজীবন মদ্যপান করে এসেছেন। দেহ ব্যাধিমন্দিরে পরিণত হয়েছে। তার উপর অর্থসঙ্কট এবং এই ডামাডোল। শ্রীমন্ত ভাবলে, ঋণগ্রস্ত প্রাচীন জমিদারবংশের এছাড়া আর কি পরিণতি প্রত্যাশা করা যায়?

সে নিঃশব্দে খেয়ে যেতে লাগলো।

একটু পরে মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করলে, হৈমন্তীর খবর কি মা? ভালো আছে তো?

গৃহিণী বললেন, এখন পর্যন্ত ভালোই আছে। আশ্বিন মাসে ছেলে হবে বলে দিন পনেরো হোল এখানেই এনেছি। এখন ভালোয় ভালোয় যাদের ছেলে-বৌ তাদের কাছে ফিরে পাঠাতে পারলে বাঁচি।

শ্রীমন্তর কানের ভিতরে হঠাৎ যেন সহস্র ঝিঁঝি পোকা ডাকতে আরম্ভ করে দিলে…

হৈমন্তীর আশ্বিন মাসে ছেলে হবে?…এই বাড়িতেই আছে?…অথচ এর মধ্যে একবারের জন্যেও এসে তার সঙ্গে দেখা করে গেল না?…এও সম্ভব?

শ্রীমন্তর গলার ভিতরটা যেন শুকিয়ে গেল। ভাতের গ্রাস গলা দিয়ে নামতে চাইলো না। এটা-ওটা নাড়াচাড়া করে সে উঠে পড়লো।

—তোমার যে কিছুই খাওয়া হ’ল না বাবা?

শ্রীমন্ত ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। গৃহিণীর কথায় এক গাল হেসে বললে, কী যে বলেন মা! আজ যা খেলাম, এ আমার অনেক দিন মনে থাকবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *