আট
১৯৪১ সালের ২২শে জুন জার্মানী রাশিয়া আক্রমণ করলে। ফিল্যান্ড থেকে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত ১৫০০ মাইল ফ্রন্টে বেধে গেল প্রচণ্ড যুদ্ধ। ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে জার্মান বাহিনী। সাত দিনের মধ্যে ব্রেস্টলিস্ক, ভিনা, কাউনাস এবং গ্রাদনোর পতন ঘটলো। পনেরো দিনের মধ্যে সমগ্র বেসারেবিয়া জার্মানির করতলগত হোল। অক্টোবরের শেষে জার্মান বাহিনী মস্কোর মাত্র ৩৫ মাইল দূরে গিয়ে পৌঁছুলো। স্ট্যালিন নিজে মস্কো রক্ষার ভার নিলেন।
এর মাসখানেক পরেই, ৭ই ডিসেম্বর, জাপান, বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে। সঙ্গে সঙ্গেই খবর পাওয়া গেল, জাপানী বিমান আক্রমণে পার্ল হারবার বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। দু’দিন পরেই আরও খবর পাওয়া গেল, উত্তর মালয়ের উপকূলে বৃটিশ ব্যাটলশিপ ‘প্রিন্স অব্ ওয়েল্স’ এবং ক্রুজার ‘রিপাস’ নিমজ্জিত।
বৃটেন এবং আমেরিকা এত বড় ধাক্কায় থমকে গেল। এত বড় আঘাতের জন্যে তারা প্রস্তুত ছিল না।
১২ই ডিসেম্বর তারিখে জার্মানি এবং ইটালীও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে এবং জার্মানি, জাপান ও ইটালীর মধ্যে একটা সামরিক চুক্তিও সম্পাদিত হোল। খবর সাংঘাতিক। কিন্তু এই দুর্যোগেও দিগন্ত-কোলে একটি রূপালি রেখার সাক্ষাৎ মিললো : এতদিন পরে আমেরিকাকেও অবশেষে এক্সিসের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে নামতে হোল। তার ধনবল, জনবল এবং সম্পদ অপরিমিত। অনেকে আশা করতে লাগলো, তার চেষ্টায় অদূর ভবিষ্যতে এই যুদ্ধের মোড় ফিরলেও ফিরতে পারে।
কিন্তু সে কতটুকু আশা?
থাইল্যান্ড থেকে এগিয়ে আসছে জাপানী সৈন্য। ১৪ই ডিসেম্বর তারা দক্ষিণ বৰ্মায় ভিক্টোরিয়া পয়েন্টে প্রবেশ করলে। আর বাঙলা দেশে আরম্ভ হয়ে গেল একটা বিপর্যয়
ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই কলকাতা থেকে লোক পালাতে আরম্ভ করলো। শেয়ালদা আর হাওড়া স্টেশনে সকল সময় একটা জনসমুদ্রের কল্লোল উঠেছে। কেউ টিকিট কিনতে পারছে না। ঘুষ চলছে বেপরোয়া। পুলিশ, মিলিটারী আর রেলের কর্মচারীরা লাল হয়ে উঠলো। এক একদিনে তারা এক এক মাসের রোজগার করছে। যত ঘুষ পাচ্ছে তত লোভ যাচ্ছে বেড়ে। এবং আরও ঘুষের লোভে যাত্রীদের উপর অত্যাচার আরও বাড়ছে।
৩১ শে জানুয়ারীর মধ্যে মালয়ের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল।
কলকাতায় তখন স্ত্রীলোক ও শিশুর চিহ্ন নেই বললেই চলে। বহু বাড়ি খালি। স্কুল-কলেজ বন্ধ। যারা রয়েছে তাদের মুখে সকল সময় একটা আতঙ্কের ভাব। কখন কি হয় বলা যায় না।
এদেশের সত্যকার অবস্থা কি, তা তারা জানে না। কিছুই তারা নিশ্চিত করে বুঝতে
ভয় পাশের বাড়িতে সংক্রমিত হচ্ছে মহামারির মতো। দেখতে দেখতে পাড়া শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
গুজব উঠছে নিত্য নতুন! তার বৈচিত্র্য কি!
যারা শোনে তাদের পিলে চমকে ওঠে। আবার একটা পালাবার হিড়িক পড়ে যায়।
অর্থের অভাবে, বাইরে আশ্রয়ের অভাবে অথবা অন্য কোন কারণে যারা রয়ে গেল, তাদের দুর্দশার অবধি রইলো না।
ব্ল্যাক আউটের অন্ধকার রাত্রি। সন্ধ্যার পরেই গলি রাস্তা জনশূন্য হয়ে যায়। ঘরের মধ্যে বসে থেকেও লোকের গা ছমছম করে। রাত্রে ঘুম হয় না ভালো করে। কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠলে লোকে বিছানার উপর উঠে বসে। শরীরে রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
১৫ই ফেব্রুয়ারী গেল সিঙ্গাপুর।
আর আশা কোথায়? গভর্নমেন্ট পর্যন্ত কাগজ-পত্র সরাতে আরম্ভ করলেন। চিড়িয়াখানা, যাদুঘর পর্যন্ত খালি হয়ে গেল। সিঙ্গাপুর ভারতের পূর্বদ্বার। সেই সিঙ্গাপুর গেলে আর রইলো কি?
আরও কিছু লোক কলকাতা ছেড়ে চলে গেল!
১০ই মার্চ গেল রেঙ্গুন।
ব্যাস!
.
হ্যারিসন রোডের মেসের অবস্থাও তথৈবচ।
ঠাকুর-চাকর দুই পালিয়েছে। দু’চারজন বাবুও চাকরি ছেড়ে পালিয়েছে দেশে। ক’দিন ওরা নিজেরাই রেঁধেছে, বাসন মেজেছে। সম্প্রতি দ্বিগুণ মাইনেতে একটা ঠাকুর আর একটা চাকর পাওয়া গেছে। কিন্তু তারাও কখন পালায় কে জানে! ওদের কাছে বাবুরা সব সময় জোড়হাতে থাকে।
হরিশের এখন তিলমাত্র অবসর নেই। কখন আসছে, কখন যাচ্ছে তার ঠিক নেই। মাথার চুল রুক্ষ। দাড়ি কামাবার সময় নেই। চোখ কোটরে বসে গেছে। তবু সর্বদাই যেন হাসিখুশি।
—খুব হাসিখুশি যে! ব্যাপার কি?—শ্রীমন্ত জিজ্ঞাসা করে।
হরিশ হাসে, জবাব দেয় না। দেওয়ার আবশ্যকতাও নেই। দুই পকেট তার নোটে, আধুলিতে, সিকিতে, দুয়ানিতে ভর্তি।
—আপনার তো দেখাই পাওয়া যায় না। চব্বিশ ঘণ্টাই ডিউটি?
হরিশ হেসে বললে, ডিউটি কি আর চব্বিশ ঘণ্টাই থাকে মশাই? ব্যাপার কি জানেন? গেলেই দু’পয়সা পাওয়া যায়।
—ভালো, ভালো। কিন্তু মেসের কি করা যায় বলুন তো?
—কেন?
—’লেসি’ তো চলে যাচ্ছেন।
—কোথায়?
—শোনেননি? ওঁদের অফিস চললো লক্ষ্ণৌ।
—তাতে কি?
—বাড়ির ‘লীজ’ কার নামে নেওয়া যায়?
—আমার নামে নিন। কি আপনার নামে?
—আপনার আপত্তি নেই তো?
—আপত্তি কি? থাকতে তো হবে।
‘লেসি’র ঝামেলা অনেক। বিশেষত এই দুর্যোগের মধ্যে। কিন্তু হাতে দু’পয়সা আসছে ব’লে হরিশ এখন সে ঝামেলা গ্রাহ্যই করে না। তার জন্যে ভয়ও পায় না।
তার নামেই নতুন ‘লীজ’ নেওয়া হোল। বহু বাড়ি খালি। সুতরাং একটু চেষ্টা করতেই বাড়িভাড়াও বেশ কিছু কমলো।
কয়েকজন নতুন মেম্বারও এলেন। একটু বয়স্ক। ওঁরা জাপানী বোমার ভয়ে স্ত্রীপুত্র দেশে পাঠিয়ে দিয়ে মেসে আশ্রয় নিয়েছেন। একটু আয়েশী লোক। মেসে বেশ কষ্ট হয়। কিন্তু কি করবেন? উপায় তো নেই। বিশেষ সকলেরই বিশ্বাস আর ক’টা দিন মাত্র! তারপর সবাইকেই তো কলকাতা ছাড়তে হবে। মেসের দুঃসহ জীবনে সেইটুকুই একমাত্র সান্ত্বনা।
ইতিমধ্যে দলে দলে আসতে লাগলো লোক। রেঙ্গুন থেকে ‘ব্ল্যাক রুট’ দিয়ে পায়ে হেঁটে এরা আসাম সীমান্তে পৌঁছায়। সেখানে থেকে ট্রেনে কলকাতায়।
.
সর্বহারার দল!
এদের অনেকেই একদিন ভাগ্যান্বেষণে রিক্তহস্তে দেশ ছেড়েছিল। সেখানে বিবিধ প্রকারে যথেষ্ট অর্থও করেছিল। ভাগ্যের চক্রান্তে সমস্ত সম্পদ বর্মাতেই ফেলে রেখে আবার রিক্ত হস্তেই দেশে ফিরলো।
কী চেহারা!
দেখলে মনে হয়, যেন চিতা থেকে এইমাত্র উঠে এল। চোখমুখ ঝলসে গেছে।
শ্রীমন্ত ওদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে! কি যেন ভাবে। কি ভাবে, সেই জানে।
দেখতে দেখতে সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের আশ্চর্য শ্রীবৃদ্ধি হতে লাগলো। নবাগত তরুণ-তরুণী কেরাণীতে ফুলে ফেঁপে উঠলো। রঙ-বেরঙের শাড়ীতে আর রকম- বেরকমের স্যুটে অফিস সরগরম।
কাজও হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার চাপ এসে পড়েছে মুষ্টিমেয় কয়েকজন কেরাণীর উপর। বাকি অধিকাংশই যেন বরযাত্রী এসেছে, এমনিভাবে হালকা হাওয়ায় প্রজাপতির মতো ভেসে বেড়ায়।
শ্রীমন্তের মুরুব্বির জোর আছে। কিন্তু সে জানে মুরুব্বির জোরে চাকরি রাখা যেতে পারে, কিন্তু উপরে উঠতে গেলে ফাঁকির কারবার চলবে না। কাজ শিখতে হবে এবং তার জন্যে খাটতে হবে।
সে অটুট স্বাস্থ্য পেয়েছে। খাটতে ভয় পায় না। খাটেও প্রচুর। আর যে খাটে, স্বাভাবিকভাবেই তার টেবিলে ফাইলও জমে প্রচুর। সেই স্তূপ ঠেলতে অধিকাংশ দিনই তার সন্ধ্যা উৎরে যায়। তার জন্যে সে বিরক্ত হয় না। যতক্ষণ অফিসে থাকে ততক্ষণ অবিশ্রান্ত খাটে। ফাইল থেকে মুখ তোলবার সময় পায় না।
বৃদ্ধ বড়বাবু এর জন্যে তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন।
কিন্তু এতাবৎ তাঁর সেই স্নেহ ফাইলের পর ফাইল পাঠানোর মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল। যত কঠিন এবং জটিল ফাইল তার কাছে পাঠিয়ে তিনি বাধিত করতেন। সোমেশ—বিজনের দল তার জন্যে তাকে বিদ্রুপও কম করতো না! শ্রীমন্ত তাদের কথার উত্তর দিত না। নিঃশব্দে একটু হেসে সমস্ত বিদ্রূপ শিরোধার্য করে নিত।
ও শুধু অপেক্ষা করছিল।
কিসের জন্যে? সে ও নিজেও জানতো না। বোধ করি ওর ভবিতব্যের জন্যে, —নিঃশব্দে এবং পরম শ্রদ্ধা ও গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে।
দিন যায়, মাস যায়। খাটুনির উপর খাটুনি বাড়ে। সে তবু নিঃশব্দে প্রতীক্ষা করে চলে। কোনো ব্যর্থতায় ওর বিশ্বাস এতটুকু শিথিল হয় না।
ভবিতব্য? কি ওঁর ভবিতব্য?
কেউ জানে না। ও নিজেও না। ও কেবল স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্নে বিশ্বাস করে।
ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন বড়বাবু ওর টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। মাথা নিচু করে একমনে ও কাজ করে যাচ্ছিল। বড়বাবুর আসা টের পায়নি।
—শ্ৰীমন্ত!
জোরে নয়, আস্তে ডাকলেন।
—Yes, Sir!
শ্রীমন্ত সোজা উঠে দাঁড়ালো।
—যাবার সময় আমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবে।
—আমার যেতে সাতটা বেজে যায় স্যার। আপনি কি তখন পর্যন্ত থাকবেন?
—থাকব।
বড়বাবু মশমশ করে নিজের টেবিলে ফিরে গেলেন।
শ্রীমন্ত অন্যমনস্কের মতো ওঁর দিকে চেয়ে রইলো :
গলাবন্ধ তরেটের একটা কোট, ভাঁজহীন একটা ট্রাউজার, পায়ে বার্নিশ অভাবে মলিন একজোড়া দামী জুতো। কষের ফাঁকে একটা পান, তার জন্যে একদিকের গাল ফোলা। দাঁত অনেকগুলিই পড়ে গেছে। যে ক’টা আছে তাও পানের ছোপে পাকা তরমুজের বীচির মতো কালো।
বৃদ্ধ মানুষ!
মাথার ছোট-ছোট-করে ছাঁটা চুলগুলি সব পেকে বিরল হয়ে এসেছে। পুরাপুরি চাকরি সেরে অবসর নিয়ে এই অফিসে এসেছেন বানপ্রস্থ উপভোগ করতে।
.
ওঁকে দেখে শ্রীমন্তর করুণা হয়।
কেন যে ডেকেছেন কে জানে! কাজ সেরে ও যখন বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন অফিসে বড়বাবুর খাস বেয়ারা ছাড়া আর কেউ বড় নেই।
গোপনে দু’জনের অনেকক্ষণ অনেক কথা হোল।
কী যে কথা তা কেউ জানলে না।
অফিস তখন খালি।
বেয়ারাটা দূরে একটা টুলের উপর বসে ঝিমুচ্ছে।