কালোঘোড়া – ২৪

চব্বিশ 

সকাল থেকেই হৈমন্তীর শরীরটা খারাপ করছিল। পেটের মধ্যে মন্দ মন্দ ব্যথা তো ছিলই, থেকে থেকে বুকটাও কেমন ধড়ফড় করছিল। কিন্তু সে-কথা গোপন করে লোকচক্ষুর আড়ালে আড়ালেই সে ঘুরছিল। এমনই আড়ালে আড়ালে যে, কদম-ঝির সতর্ক দৃষ্টিকেও ফাঁকি দিতে পেরেছিল। 

কিন্তু বেলা যত বাড়ে যন্ত্রণাও তত বাড়ে। অবশেষে দুপুরে সে শয্যা নিলে। কদম- ঝির চোখ পড়লো তখন। গিন্নীমাকে সে ছুটে গিয়ে খবর দিলে। তখন তিনি ঠাকুরঘর থেকে সবে বেরুচ্ছেন। 

তাঁরও কি যেন হয়েছে। সংসারে কি হচ্ছে, কি হচ্ছে-না সেদিকে চোখ মেলে তাকানই না। ছেলে-মেয়ে, চাকর-বাকর কে খেলে কে না খেলে তাও আর দেখেন না। এমন কি, শাশুড়ীর মৃত্যুর পর থেকে একখানা হাত পাখা নিয়ে স্বামীর খাওয়ার কাছে বসার যে দীর্ঘকালীন অভ্যাস, ভালো চাল দুর্লভ হওয়ার পর থেকে তাও যেন ছেড়েছেন। কারও সঙ্গে কথাবার্তা, গল্প-গুজব তাও নেই। এই সংসার যেন তাঁর কাছে বিষ হয়ে উঠেছে। 

ভোরে উঠে স্নান করে সেই যে ঠাকুরঘরে যান, বার হন দুপুরে। দুটি খেয়ে আবার সেই ঠাকুরঘরের বারান্দায় বসে কিছু ধর্মপুস্তক হয়তো পড়েন। পড়তে পড়তে ঘুম এলে সেইখানেই আঁচল বিছিয়ে হয়তো একটু গড়িয়ে নেন। তখন তাঁকে বিরক্ত করা নিষেধ। ঝি এসে মাঝে মাঝে তাঁর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। কিন্তু সে তিনি টের পান কি না বোঝা যায় না। 

‘দেবধামে’র ঘোষ পরিবারের গৃহিণী-জীবন পরিত্যাগ করে তিনি যেন এই বিগ্রহদেবতাকে কেন্দ্র করে নতুন জীবন আরম্ভ করার সাধনায় মগ্ন। 

কিন্তু কদমের মুখে হৈমন্তীর শারীরিক অবস্থা শুনে তিনি ব্যস্তভাবে নেমে এলেন।

তখনই খবর দেওয়া হোল তাঁদের পারিবারিক ধাত্রীকে। অভিজ্ঞ ধাত্রী। পাস করা যদিচ নয়, কিন্তু দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতার ফলে এ পাড়ায় তার নামযশ আছে। নানারকম পরীক্ষা করেও তার মনে হোল না যে প্রসবের সময় আসন্ন। অথচ এই যন্ত্রণা, বিশেষ করে বুকের ধড়ফড় ভাব কেন হচ্ছে, তার কিছুই বুঝতে পারলে না। সে ভয় পেয়ে গেল। বললে, একজন ভালো লেডী ডাক্তারকে খবর দিতে। 

লেডী ডাক্তার যখন এলেন তখন হৈমন্তী সংজ্ঞাহীন। 

তিনিও তার নাড়ী, বুক এবং পেট পরীক্ষা করে ভয় পেয়ে গেলেন। পরামর্শ দিলেন এখনই অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিয়ে হাসপাতালে পাঠাতে। এ চিকিৎসা বাড়িতে সম্ভব নয়।

অ্যাম্বুলেন্স! হাসপাতাল! ঘোষ-পরিবারে যা কখনো হয়নি! বাড়ির মধ্যে ঝি-চাকরের মুখে একটা হাহাকার পড়ে গেল। তারা যেন বুঝলে আর রক্ষা নেই। 

বাগানের কোণ থেকে নিশীথ রাত্রে কে যেন অত্যন্ত চাপা সুরে কাঁদে, কদম কতদিন শুনেছে। মোক্ষদা-ঝি নিজের চোখে ওদিকের ছাদের কোণে টকটকে লালপাড় শাড়ি- পরা একটি মূর্তিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। এমন কি অমন যে- অসমসাহসী দারোয়ান সেও স্বীকার করেছে, সারারাত্রি বাড়িময় কারা যেন টিপে টিপে পা ফেলে সন্তর্পণে ঘোরা-ফেরা করে, ফিসফাস কথা কয়। 

কিন্তু নয়নতারা, ওই যে বেঁটে-খাটো থুপথুপে মানুষটি, তাঁর মনের মধ্যে এত শক্তি কোথা থেকে এল কে জানে। পরিষ্কার দৃঢ়কণ্ঠে লেডী ডাক্তারকে তিনি বলে দিলেন : ঘোষ-বাড়ির মেয়ে-বৌ কখনও হাসপাতালে যায় না, যাবেও না। যা করা দরকার, যত টাকা লাগে, আপনি এইখানে ব্যবস্থা করুন! 

ব্যাপার দেখে লেডী ডাক্তার তখনই ফোন করলেন একজন বড় বিশেষজ্ঞকে। রোগীর সমস্ত অবস্থা, এমন কি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে এবং হোলে এই বাড়ীতেই হতে হবে, তাও তিনি জানালেন। 

ডাক্তার জানালেন, তিনি তাঁর একজন সহকারীকে নিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে আসছেন। অপারেশনের দরকার হোলে তারও ব্যবস্থা করার অসুবিধা হবে না। ইতিমধ্যে তাঁর এবং তাঁর সহকারীর ফিজের কথাটাও যেন রোগীর অভিভাবকদের জানিয়ে রাখা হয়। 

নয়নতারা সরকারকে নিভৃতে ডেকে একটি গহনার পুঁটলি তার হাতে দিয়ে বললেন, পাঁচ হাজার টাকা খুব পাওয়া যাবে। টাকাটা কিন্তু এক ঘণ্টার মধ্যে দরকার। 

নয়নতারা সুবিমল ও বাসন্তীকে তখনই খবরটা জানাতে বললেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এত বড় একটা বিপদের খবর হিমাংশুবাবুকে জানাবার কথা, কি নয়নতারা, কি ঝি-চাকর, কারও মনেই উদিত হোল না। 

তিনি তখন তাঁর ঘর থেকে শঙ্করের উদ্দেশে অজস্র গালিবর্ষণ করছেন। সুমিত্রা এবং শ্রীমন্ত এল সেই মুহূর্তে। 

.

সুমিত্রাকে দেখে নয়নতারা যেন একটু আশ্বস্ত হোলেন। বাড়িতে জনকয়েক ঝি- চাকর মাত্র। এমন কেউ নেই বিপদের সময় যার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়। 

বললেন, এসো বৌমা। দেখছ তো হিমুর অবস্থা। ভগবান জানেন, আমাদের অদৃষ্টে কি আছে। শ্ৰীমন্ত আসেনি? 

—এসেছেন। নিচে রয়েছেন। 

সুমিত্রা দরজা থেকেই দেখতে পেলে লেডী ডাক্তার তখনই একটা ইনজেকশন দিয়ে নিঃশব্দে তার ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছেন। ধাত্রী পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সাহায্য করছেন। 

সুমিত্রা নয়নতারাকে জিজ্ঞাসা করলে, ছোটদির কি জ্ঞান নেই? 

—না, ঘণ্টা দেড়েক হোল এই অবস্থা। লেডী ডাক্তার সাহস পাচ্ছেন না। বড় ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছে, তিনিও এখনই এসে পড়বেন। হয়তো অপারেশনের দরকার হবে। 

এতক্ষণে নয়নতারার চোখে একবিন্দু জল দেখা গেল। 

—বাড়িতেই অপারেশন হবে?—সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলে। 

—দরকার হোলে তাই হবে মা। ঘোষ-বাড়ির বৌ-ঝি কি কখনও হাসপাতালে গেছে? যা কখনও হয়নি, অন্তত আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ তা হতে দোব না। 

সুমিত্রা বুঝলে এটা সংস্কারের প্রশ্ন। এ নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। বললে, কিন্তু সে তো অনেক খরচের ব্যাপার মা। 

—তা বললে কি করা যায় বলো। খরচ করতে হবে। 

এমন সময় বড় ডাক্তার এবং তাঁর পিছু পিছু তাঁর সহকারী এসে উপস্থিত হলেন। লেডী ডাক্তার চিন্তিত মুখে একটা চেয়ারে বসে ছিলেন। বড় ডাক্তারকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। 

রোগিণীর অবস্থা সম্পর্কে লেডী ডাক্তারের মুখভাবই যথেষ্ট ব্যাখ্যা। সুতরাং বিনা প্রশ্নে বড় ডাক্তার রোগিণীকে পরীক্ষা করতে লেগে গেলেন। 

পরীক্ষা শেষে ডাক্তার ইংরাজিতে বললেন, এঁকে অনেক আগেই হাসপাতালে পাঠানো উচিত ছিল। 

বলে একবার লেডী ডাক্তারের দিকে এবং তারপরে দ্বারপ্রান্তে অর্ধাবগুণ্ঠিতা নয়নতারার দিকে চাইলেন। 

লেডী ডাক্তার জবাব দেবার আগেই সুমিত্রা ইংরাজিতেই জবাব দিলে, তা হবার নয়। এ বাড়িতে হাসপাতালে পাঠাতে সংস্কারে বাধে। 

বড় ডাক্তার আর কথা বাড়ালেন না। তাঁর সহকারীর দিকে চেয়ে বললেন, আর নষ্ট করবার মতো সময় নেই। তুমি গাড়িখানা নিয়ে যাও এবং সমস্ত ব্যবস্থা করো। 

তারপরে সুমিত্রাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি রোগিণীর কে? 

—আত্মীয়। 

—এ তো অনেক ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। 

—তাতে অসুবিধা হবে না। 

সুবিধা-অসুবিধা সম্বন্ধে কিছুই সুমিত্রার জানা নেই। নয়নতারার কথায় বোধ হয়েছিল তাতে অসুবিধা হবে না। তথাপি ঘোষ বংশের আর্থিক অবস্থাও তার অবিদিত নয়। সুতরাং শ্রীমন্ত যে নিচে রয়েছে, এও হয়তো তার একটা মস্ত ভরসা। 

তা ছাড়া সুবিমল আছে। সেও এই মুহূর্তে উদ্বিগ্ন মুখে ব্যস্তভাবে এসে নিঃশব্দে দাঁড়ালো। 

সুমিত্রা পরিচয় করিয়ে দিলে, ইনিই রোগিণীর স্বামী। 

বড় ডাক্তার একটু মুশকিলে পড়েছিলেন। এসে পর্যন্ত একজন পুরুষেরও তিনি সাক্ষাৎ পাননি। দ্বারপ্রান্তে ওই অর্ধাবগুণ্ঠিতা মহিলা এবং ভিতরে সুমিত্রা। কিন্তু সুমিত্রার মুখের ইংরাজি কথা সত্ত্বেও তিনি রোগের অবস্থা সম্বন্ধে তার সঙ্গে আলোচনায় ঠিক উৎসাহ বোধ করছিলেন না। সুবিমলকে দেখে যেন তিনি একটা অবলম্বন পেলেন। 

বললেন, ও আপনি এসে গেছেন। চলুন ওঘরে। 

সুবিমলকে নিয়ে ডাক্তারবাবু অন্য ঘরে যেতেই সুমিত্রা এসে নয়নতারার কাছে দাঁড়ালো। 

নয়নতারা বোধহয় অন্য কথা ভাবছিলেন। ওর দিকে চেয়ে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন, কি মা? 

—আমিও তো আপনার মেয়ে, না মা?

—তাই তো মা। তুমিও আমার মেয়ে। 

—তাহলে কোনো সংকোচ করবেন না। অনেক টাকার ব্যাপার মনে হচ্ছে। সে ব্যবস্থা কি করা হয়েছে? 

সরকার তখনও ফেরেনি অবশ্য। কিন্তু সে যে ব্যবস্থা করেই ফিরবে সে বিষয়ে তাঁর সংশয় নেই। 

বললেন, অনেক টাকা বলতে কত টাকা তা তো বুঝতে পারছি না মা। তবে মনে হয় সে অসুবিধে হবে না। কিন্তু হিমু আমার বাঁচবে তো মা? 

বলেই তিনি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন। 

সন্দেহ সুমিত্রার মনেও আছে। তবু আশ্বাস দিয়ে জোর করে বললে, বাঁচবেন বই কি মা। ভগবান কি এত বড় অবিচার করতে পারেন? 

—তাই বলো মা। তোমরা সবাই আমার হিমুকে আশীর্বাদ করো। 

বাসন্তী এতক্ষণ হিমুর কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। জিজ্ঞাসা করলে, ঠাকুরপো কোথায় গেল মা?

বাসন্তীর সঙ্গে সুমিত্রার পরিচয় নেই। কোনোদিন সাক্ষাতের সুযোগও ঘটেনি। কিন্তু দেখেই চিনতে বিলম্ব হোল না যে, ইনি হৈমন্তীর দিদি। 

নয়নতারার হয়ে সে-ই উত্তর দিলে, উনি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ওঘরে কথা কইছেন।

বাসন্তী এই অপরিচিতা মেয়েটির দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইতেই নয়নতারা বললেন, এটি শ্রীমন্তর বউ। হিমুর সঙ্গে খুব ভাব। 

সুমিত্রা যুক্তকরে নমস্কার করলে। 

বাসন্তী প্রতি নমস্কার করলে, কিন্তু আলাপ করার মতো মনের অবস্থা তার নয়। সে বোধ করি সুবিমলকে খোঁজবার জন্যে ওদিকে চলে গেল। 

.

তখন অপারেশন টেবিল থেকে আরম্ভ করে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এসে গেছে। ইনজেকশনের পরেও হৈমন্তীর জ্ঞান ফিরে আসেনি। 

সুবিমল ব্যস্তভাবে এসে নয়নতারাকে ডাকলে। বললে, মা, একটু এদিকে শুনুন। নয়নতারা কাছে আসতেই সুবিমল বললে, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি মা। আমার ফিরতে দেরি হবে না। 

নয়নতারা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, না বাবা, এসময় আমি কাউকে এক মিনিটের জন্যেও ছেড়ে দোব না। 

—কিন্তু বড্ড দরকার যে মা! 

—যত দরকার হোক যে দরকারের সামনে আজ দাঁড়িয়ে রয়েছি এমন দরকার আর কিছুই নয়। 

সুবিমল একটু দ্বিধা করতে লাগলো। তারপর বললে, কিছু টাকা নিয়ে আসি মা! যাব আর আসব। 

সরকারকে দেখা গেল। ওদিকের বারান্দা পেরিয়ে হন হন করে ব্যস্তভাবে আসছে। হাতে পুটলীটি নেই। 

নয়নতারা বললেন, টাকার কিছু দরকার হবে না বাবা। তুমি সবসময় কাছে কাছে থাক। নইলে আমি পাগল হয়ে যাব বাবা, আমি পারছি না। 

সুমিত্রা নিচে গিয়েছিল শ্রীমন্তকে খবরটা দেবার জন্যে। শ্রীমন্তর নোটগুলো তখনও তার মুঠোর মধ্যে। সেগুলো ব্যাগে পোরার কথা তার মনেই নেই। 

নিঃশব্দে এসে সে ওদের দু’জনের কাছে দাঁড়ালো। 

সুবিমল এবং সে নিঃশব্দে নমস্কার বিনিময় করলো। 

বাসন্তী এসে জিজ্ঞাসা করলে, ডাক্তার কি বলছেন? 

—অপারেশন করতে হবে। এখনই।–সুবিমল উত্তর দিলে।

–জ্ঞান হচ্ছে না কেন?—বাসন্তী প্রশ্ন করলে। 

এ প্রশ্নের কে উত্তর দেবে? 

—ডাক্তার ভরসা কিছু দিলেন? পুনরায় বাসন্তী জিজ্ঞাসা করলে। 

নিরুত্তরে সুবিমল আকাশের দিকে চাইলে। অর্থাৎ সেটা ভগবানের হাতে।

—শঙ্করকে দেখছি না কেন মা?—একটু পরে বাসন্তী পুনরায় প্রশ্ন করলে।

নয়নতারা প্রথমে এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, যেন শুনতেই পাননি। কিন্তু বাসন্তী প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করতে যেন একটা অব্যক্ত যন্ত্রণায় দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরলেন। 

তারপর ধীর কণ্ঠে বললেন, কাল সকাল থেকেই সে উধাও। 

—উধাও? কোথায়?-এক সঙ্গে বাসন্তী এবং সুবিমল প্রশ্ন করলে।

আবার একটু থেমে দম নিয়ে নয়নতারা বললেন, জাহান্নমে। 

—বাবা?—এবারে বাসন্তী খুব ভয়ে ভয়েই প্রশ্ন করলে। তার গলায় জোর নেই। প্রশ্ন করেই সে যেন আরও একটা মর্মভেদী উত্তরের জন্যে প্রতীক্ষা করতে লাগলো। 

হিমাংশুবাবু সম্বন্ধে নয়নতারা কিছুই জানেন না। তাঁর জীবনযাত্রা অমনই দাঁড়িয়েছে এবং তার ফলে এই পরিবারে তাঁর প্রয়োজন এমনই নিঃশেষ হয়েছে যে, এতবড় একটা বিপদের সামনে দাঁড়িয়েও নয়নতারা তাঁকে স্মরণ করার আবশ্যকতা অনুভব করেননি। 

কন্যার প্রশ্নে তিনি বিব্রতভাবে এদিক-ওদিক চাইতেই সরকার উত্তর দিলে, তাঁকে এক্ষুনি ট্যাক্সি করে শ্রীমন্তবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে যেতে দেখলাম। 

শ্রীমন্তবাবুর সঙ্গে? এই সময়? 

সুবিমলের বিস্ময়ের আর অবধি নেই। শ্রীমন্ত হিমাংশুবাবুকে নিয়ে কোথায় গেছে না জানলেও এই সময়ে ভ্রুক্ষেপহীন বেরিয়ে যাওয়া এমনই কদর্য যে, সুবিমলের প্রশ্নে লজ্জায় সুমিত্রার মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো। 

তার উপর নয়নতারার কেমন যেন একটা স্নেহ পড়েছে এবং শ্রীমন্তকে অজ্ঞাতসারে কেমন যেন তিনি ভয় করতে আরম্ভ করেছেন। 

তাড়াতাড়ি বললেন, ও কথা এখন থাক বাবা। যা করবার আমাদের এই ক’জনকেই করতে হবে। খরচের কথা ডাক্তারবাবু কি বললেন বলো। 

সুবিমল বাসন্তীর দিকে চেয়ে বললে, সেজন্যে চিন্তা করতে হবে না মা। সে হয়ে যাবে’খন। 

দৃঢ়কণ্ঠে নয়নতারা বললেন, তা হয় না বাবা। আমার মেয়ে আমার বাড়িতে অসুখে পড়েছে। এর খরচ আমিই দোব! তুমি টাকা তোমার কাছে রেখে দাও। ঠিক সময়ে ডাক্তারকে দিয়ে দেবে। 

সুবিমল বললে, তাই হবে মা। ঠিক সময়ে আমি আপনার কাছে চেয়ে নোব। 

—মনে করে চেয়ে নিও যেন বাবা। আমার কাছে চাইতে হবে না, এই কেদারের কাছে চাইলেই হবে। 

বলে নয়নতারা সরকারকে দেখিয়ে দিলেন। 

.

ইতিমধ্যে আরম্ভ হয়ে গেছে রাজসূয় যজ্ঞ। 

বড় একখানা ঘর মেঝে থেকে দেওয়ালের অনেকখানি পর্যন্ত ডেটল দিয়ে ধোয়া হয়ে গেছে। সেখানে পড়েছে অপারেশন টেবিল। পাশে আর একখানা টেবিলে নানা আকারের ঝকঝকে যন্ত্রপাতি। দেখলে ভয় করে। একজন সহকারী সেগুলি গরম জলে ফুটিয়ে বিশোধন করে পরের পর সাজাচ্ছেন। এসে গেছেন অ্যানিস্থেটিস্ট, সিস্টার, নার্স। গাড়ি নিয়ে লোক চলে গেছে রোগিণীর রক্তের নমুনা নিয়ে ব্লাড ব্যাঙ্কে। অবিলম্বে সে আসবে বোতল-ভর্তি রক্ত নিয়ে। প্রয়োজন হোলে আরও রক্ত যাতে পাওয়া যায়, বড় ডাক্তার টেলিফোনে সে ব্যবস্থাও ব্লাড ব্যাঙ্কের সঙ্গে করেছেন। তার ফলে ঘোষ- পরিবারের দু’জন কর্মচারী রক্তদানের জন্যে তৈরী হয়েছেন এবং ব্লাড ব্যাঙ্কের একজন কর্মচারী রক্ত নেবার জন্যে আসছেন। 

রোগিণী তখনও সংজ্ঞাহীন। তার অবস্থা আরও খারাপ। ডাক্তারবাবু সুবিমলকে সন্তানের জীবনের আশা ত্যাগ করবার জন্যে বলেই দিয়েছেন। হৈমন্তীকে যদি বাঁচানো যায় তাহলেই তিনি শ্রম সার্থক মনে করবেন। 

ঘরের মধ্যে ডাক্তার ও নার্স ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার রইলো না। দ্বারে ঝোলানো হোল একটা ভারি পর্দা। কোয়ার্টার তিনেকের মধ্যে ঘরখানি গন্ধে, যন্ত্রসজ্জায় এবং উৎকণ্ঠিত স্তব্ধতায় একটি ক্ষুদ্র হাসপাতালে পরিণত হোল। 

আরম্ভ হয়ে গেল হৈমন্তীর দেহে রক্ত-সঞ্চার। তার অভিজাত রক্তধারার সঙ্গে ধীরে ধীরে সংমিশ্রিত হতে লাগলো কার রক্ত কে জানে! হয়তো কোনো উদার হৃদয় দাতার রক্ত, নয়তো ক্ষুধার্ত পরিজনের মুখে দু’মুঠো অন্ন দেবার জন্যে কয়েকটি মুদ্রার বিনিময়ে রক্তদান করে গেছে যে অভাগা, তারই রক্ত। 

রোগিণীর রক্তচাপ এবং নাড়ী পরীক্ষা করে অ্যানিস্থেটিস্ট ক্লোরোফর্ম দেওয়া আরম্ভ করলেন। বড় ডাক্তার এবং তাঁর সহকারী দু’জন ডাক্তার প্রস্তুত। তাঁদের সাহায্যের জন্যে রয়েছেন একজন নার্স। সকলেই পর্যায়ক্রমে একবার অ্যানিস্থেটিস্ট, একবার রোগিণীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইছেন। অ্যানিস্থেটিস্টের ইঙ্গিতমাত্র আরম্ভ হবে অস্ত্রোপচার। 

থমথম করছে ‘দেবধাম’। নিস্তব্ধ, নিঃঝুম। বাইরে হাওয়া দিচ্ছে ঝির ঝির। সেই হাওয়ায় মনে হচ্ছে সমস্ত বাড়িখানা যেন বেতপাতার মতো থর থর করে কাঁপছে। 

ক্লোরোফর্মের পাঁচ মিনিটের মধ্যে অ্যানিস্থেটিস্টের ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র চক্ষের পলকে সহকারী তুলে দিলেন স্ক্যালপেল বড় ডাক্তারের হাতে। সেই তীক্ষ্ণ ছুরিকা তখনই বিঁধে গেল হৈমন্তীর জঠর-নিম্নে। তারপরে আরও অনেকখানি। জঠরের আরও অনেকখানি ফাঁক হয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে শুশুকের মতো ভুস্ করে বেরিয়ে এল ভ্রুণকোষ। 

কিন্তু রক্ত? রক্ত কই? কয়েকটি শিরা বেয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ ধারায় বেরিয়ে আসছে ঘোষবংশের নিঃশেষিত-প্রায় অভিজাত রক্ত। অত্যন্ত ক্ষিপ্র হস্তে সেই সামান্য ক’টি রক্তধারার মুখ আর্টারী ফর্সেপ দিয়ে ধরে বেঁধে দেওয়া হোল। 

কিন্তু জঠর-গহ্বরে রক্ত কত? যেন একটা বিশুষ্ক প্রায় পল্বলের নিচে টলটল করছে। সঙ্গে সঙ্গে সেই রক্ত মুছে ফেলে ভ্রুণকোষ নিয়ে পড়লেন ডাক্তারবাবু। নির্দিষ্ট সময় মাত্র হাতে। অ্যানিস্থেটিস্ট মাঝে মাঝে নিচ্ছেন রক্তচাপ, গুনছেন নাড়ী এবং নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস। লক্ষ্য করছেন রোগিণীর দেহে কি ভাবে রক্ত-সঞ্চার হচ্ছে এবং যিনি রক্ত- সঞ্চার করছেন তাঁকে মাঝে-মাঝেই তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন কখনও দ্রুত, কখন আরও মন্থর রক্ত-সঞ্চারের জন্যে। 

বড় ডাক্তারের হাতে এপাশ থেকে এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটির পর একটি অস্ত্র। কাজ হওয়ামাত্র তাঁর হাত থেকে তুলে নিয়ে ওপাশে গুনে রাখা হচ্ছে। বড় ডাক্তারের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তন্ময় হয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন অত্যন্ত ক্ষিপ্র নিপুণ হাতে। সময় নেই। সময় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং সীমাবদ্ধ। দেখা এবং করার মধ্যে চিন্তার অবকাশ অল্প। 

ভ্রূণকোষের দিকে চেয়ে দেখেন সেখানে প্রকাণ্ড একটা ছিদ্র। বুঝতে বিলম্ব হোল না কেন এমন ঘটেছে। প্রসব-বেদনা ভোগ করতে হয়েছে দীর্ঘক্ষণ। জাতকের মাথাটা বেশ বড়, কিন্তু অস্থিময় অংশগুলি নিতান্ত অপুষ্ট। সুতরাং ভ্রূণকোষের নিম্নাংশ গেছে অনেকখানি ফেঁসে! জাতকের দেহের প্রায় আধখানা বেরিয়ে এসেছে ভ্রূণকোষ থেকে। 

অতি সন্তর্পণে সেই দেহ মুক্ত করা হোল। ছোট্ট একটি অপরিণত মৃত শিশু। নার্স সঙ্গে সঙ্গে সেটি তোয়ালে ঢেকে সরিয়ে রাখলে। তারপরে বার করে নেওয়া হোল ভ্রূণ- পুষ্প।

কিন্তু ভ্রূণকোষের ঐ ছিদ্র? ওটা যদি মেরামত হয়, আগামীবারের প্রসবকালে আবার রোগিণীর জীবন বিপন্ন হবে। যদি না করা হয়, তাহলে সন্তান লাভের আশা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। 

ডাক্তারের ললাটে একটা ভ্রুকুটি দেখা গেল। গুরুশ্রমে বিন্দু বিন্দু ঘামও জমেছে। ধীরে সুস্থে চিন্তা করার সময় নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বার করে দিলেন ভ্ৰূণকোষ।

কি হবে রেখে? সূর্যবংশ, চন্দ্রবংশই যদি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে, কাঁটাপুকুরের বসুবংশের একটি শাখা ক্ষুদ্র একটি বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে গেলে, সেটা বাংলাদেশের পক্ষে এমন কিছু একটা শোকাবহ ঘটনা হবে না। 

বড় কাজ চুকে গেছে। অস্ত্রোপচার শেষ। এর পরের কাজ নিতান্ত সহজ এবং মামুলী। অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি, স্পঞ্জ, তোয়ালে, এক এক করে গুনে নেওয়া এবং স্তরে স্তরে জঠর প্রদেশ সীবন করে যাওয়া। 

এতক্ষণে ডাক্তারবাবু রোগিণীর দিকে এবং চারিপাশে চাইবার সময় পেলেন। অস্ত্রোপচার শেষ। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তিনি। 

হৈমন্তী তখনও সংজ্ঞাহীন। 

অতি সন্তর্পণে তাকে সরিয়ে নেওয়া হোল তার বিছানায়। তার সঙ্গে রইলেন একজন সহকারী এবং নার্স—অস্ত্রোপচারের পরে তার ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করবার জন্যে। 

কিন্তু আরও রক্ত চাই—অ্যানিস্থেটিস্ট বললেন। দু’বোতল নিঃশেষ হয়েছে। নীল রক্তপ্রবাহ বিরুদ্ধ ধরণীর বালুকাস্তূপে যাতে না হারিয়ে যায়, তার জন্যে আরও অন্তত এক বোতল রক্তের প্রয়োজন। 

তার জন্যে দাতা প্রস্তুত? বাইরের জগতে তার রক্ত নীল নয়, কালো বলা যেতে পারে। সাধারণ মানুষের বিচারে হৈমন্তীর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সাধারণ মানুষের বিচারে এর ধর্ম পৃথক, জাতি পৃথক এবং মূল্যও পৃথক। কিন্তু প্রাণীতত্ত্বের শ্রেণীবিভাগে তা নাকি হৈমন্তীর সঙ্গে হুবহু এক। 

আরম্ভ হোল সেই রক্তমোক্ষণ। কতক্ষণেরই বা কাজ? নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত দেওয়া, আধঘণ্টাটাক শুয়ে থাকা, তারপর এক পেয়ালা চা খেয়ে আবার দৈনন্দিন বাঁধা কাজে লেগে যাওয়া।

 সেই রক্ত হৈমন্তীর সংজ্ঞাহীন দেহে ধীরে ধীরে সঞ্চার করা হতে লাগলো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *