কালোঘোড়া – ২

দুই

ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলের কথা।

হরেরাম ঘোষ সেই আমলে একটি ইংরেজ ব্যবসায়ী ফার্মের মুৎসুদ্দি ছিলেন। তিনি নামে রাজা হননি বটে, কিন্তু মুৎসুদ্দিগিরি থেকে যে অর্থ করেছিলেন তা রাজারই ঐশ্বর্য। ওদিকের চমৎকার ঠাকুরবাড়ী, নাটমন্দির, রাধাবিনোদের নিত্যভোগ, অতিথিশালা এবং এদিকের নহবৎখানা, চাকর দরওয়ানের থাকবার ঘর, বালাখানা, ভিতরের বিরাট অন্দরমহল,–এর অধিকাংশই তাঁর তৈরী।

অনেককাল তিনি গত হয়েছেন, কিন্তু বালাখানায় ইংরেজ-শিল্পীর হাতে আঁকা তৈলচিত্র দেখলে তাঁকে অনেকটা বোঝা যায় : মাথায় ছোট-ছোট করে ছাঁটা চুলে পরিপুষ্ট টিকি, কণ্ঠে মোটা-মোটা তুলসী কাঠের মালা, ললাটে নাসিকায় অনাবৃত লোমশ বক্ষে বাহুতে তিলক, হাতে হরিনামের ঝুলি,–ঘোষ মশাই ভগবানের নাম করছেন। প্রশস্ত ললাট, আয়ত চক্ষু এবং গরুড়ের মতো বক্রাগ্র নাসিকা দেখলে বোঝা যায় তাঁর তীক্ষ্ণ বিষয়বুদ্ধির অভাব ছিল না। বৈষ্ণবী বিনয় বিষয়বুদ্ধি অর্জনে সাহায্যই করেছে।

তাঁর পুত্র রামরাম অনেকটা পিতার মতোই বৈষ্ণব। তবে পিতার চেয়ে সুপুরুষ এবং অর্থের ঔদ্ধত্য চোখের কোণে ঈষৎ প্রকাশ পাচ্ছে। তাঁর যে তৈলচিত্র বালাখানায় টাঙানো আছে তাও ভক্ত বৈষ্ণবেরই ছবি। কিন্তু পিতার মতো অনাবৃত গাত্রে নয়, গায়ে হালকা জরির কাজ করা একখানা মিহি চাদর আছে।

বলতে গেলে, এই বংশের আভিজাত্যের পরিচয় পাওয়া যায় রায় বাহাদুর প্রতাপচন্দ্র ঘোষের তৈলচিত্র থেকে। তিনি মুৎসুদ্দিগিরি করতেন না। পিতৃত্যক্ত বিপুল অর্থ ও সম্পত্তি থেকে রাজার মতো বিলাসে দিনযাপন করতেন। ছবিতেও এই পার্থক্য দেখা যায়। প্রতাপচন্দ্রের ছবি বিনীত বৈষ্ণবের নয়, সেকালের অভিজাত ভদ্রলোকের। মাথায় কার্নিসওয়ালা পাগড়ী, পরিধানে মূল্যবান চোগাচাপকান, বক্ষে গণিত চিহ্নের মতো পাকদেওয়া চাদর।

হরেরাম এবং রামরাম ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠতেন। প্রাতঃকৃত্য এবং পূজা সেরে বাহিরের বালাখানায় এসে বসতেন। গঙ্গাস্নান-প্রত্যাগত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা ফেরার পথে পায়ের ধূলো দিয়ে যেতেন। সেই রজ তাঁরা মূল্যবান রেশমী রুমালে করে নিয়ে একটি রূপার কৌটায় সংগ্রহ করে রাখতেন। পাড়ার পাঁচজন ভদ্রলোক এবং প্রার্থীর সমাগম হোত। সাধ্যমত প্রার্থীদের কিছু-কিছু দিতেনও।

পাড়ার তিনকড়ি মুদী হঠাৎ মারা গেছে। নাবালক ছেলে অসহায়। শ্রাদ্ধের খরচ তাঁরাই দিতেন। নুটু দত্ত দুপুর রাত্রে মদ খেয়ে বাড়ী ফিরে স্ত্রীর উপর অত্যাচার করেছে। দরওয়ান দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে এসে সকলের সামনে কানে ধরে ওঠ-বস করিয়ে ছেড়ে দিতেন। সেই লোকটাই দুদিন পরে সন্ধ্যাবেলায় এসে বাবুর কাছ থেকেই মদ খাবার জন্যে দুটো টাকা নিয়ে যেত।

পাড়ার লোকের রোগে শোকে, বিপদে-আপদে তাঁরা যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। প্রয়োজন হোলে খালি গায়ে একজোড়া খড়ম পায়ে দিয়েই তাদের বাড়িতে উপস্থিত হতেন। পাড়ায় কোনো ক্রিয়াকর্ম হোলে তাঁদের বালাখানা থেকেই তার ব্যবস্থা হোত। আবার তাঁদের নিজের প্রয়োজনের সময়ও পাড়ার ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই এসে প্রাণ দিয়ে খেটে সাহায্য করত।

তখন কলকাতা এতবড় শহর হয়নি।

পাড়াও ছিল ছোট। ধনীর প্রাসাদকে কেন্দ্র করে কতকগুলি দালান এবং কতকগুলি গোলপাতার ঘর। গরুতে-মহিষে, ধনীতে-দরিদ্রে একটি পল্লী, একটি ইউনিট।

প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের চেনা। যেতে-আসতে দেখা হোলে পরস্পর অভিবাদন বিনিময় করে, কুশল জিজ্ঞাসা করে। সমাজের শ্রেণী-বিভাগ তখনও অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তখনও বর্ণাশ্রমের পূর্ণ প্রতাপ। ব্রাহ্মণ তো বর্ণের গুরু। তাঁদের কথা স্বতন্ত্র। ক্রিয়াকর্মে স্বজাতির কাছেও জোড়হস্তে থাকতে হয়।

হরেরাম অথবা রামরাম কারও পক্ষেই ব্রাহ্মণ অথবা স্বজাতির কাছে জোড়হাত করে থাকাটা ক্ষোভ অথবা লজ্জার বিষয় ছিল না। তখন সেইটেই ছিল সামাজিক ভদ্রতা। তার ব্যতিক্রমই ছিল লজ্জার বিষয়।

সামাজিক ছাড়া অন্য ক্রিয়াকর্মও অবশ্য ছিল। তার চাল কিন্তু আলাদা।

সন্ধ্যার পরে উপরের বালাখানায় কার্পেট বিছানো হোত। ঝাড়ের আলো ঝলমল করতে লাগত।

বাইজির নাচ হবে।

তাতে নিমন্ত্রিতের দল কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশী নয়। শহরের গণ্যমান্য বিশিষ্ট লোক, হরেরাম-রামরামের সমপদস্থ ব্যক্তি, সাহেব-সুবো। আতর-গোলাপ-পানের ছড়াছড়ি। মদ্য এবং গড়গড়ায় সুগন্ধি তাম্রকুটের আয়োজনও থাকত।

এ মজলিস বর্ণাশ্রমী নয়। অর্থনৈতিক সমাজ-ব্যবস্থা এরই সাহায্যে বর্ণাশ্রমকে ধীরে ধীরে স্থানচ্যুত করার চেষ্টা করছিল, অথচ কেউ তা টের পাচ্ছিল না। এখানে দরিদ্রের স্থান ছিল না। ইংরেজ শাসক ও ব্যবসায়ীকে কেন্দ্র করে নতুন অভিজাত সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে উঠছিল প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে যথাসম্ভব সামঞ্জস্য রক্ষা করে।

হরেরাম-রামরামের দল টিকি রাখতেন, সন্ধ্যাহ্নিক করতেন। পূজা-পাৰ্বণ, দোল- দুর্গোৎসবও ভক্তির সঙ্গে অনুষ্ঠিত হোত। আবার মজলিসে গিয়েও বসতেন। সাহেব- সুবোদের সঙ্গে পান-তামাকও চলতো। একসঙ্গে বিলাতী মদ্যপানেও আপত্তি করতেন না।

কিন্তু সমাজের সম্বন্ধে তখনও তাঁরা বেপরোয়া হননি। সমাজ ব্যবস্থার উপর শ্রদ্ধাও একটা ছিল। তাই অনাচার যা করতেন তা গোপনেই করতেন, ভয়ে ভয়ে। এবং প্রকাশ্যে বর্ণাশ্রমী সমাজের নিয়মকানুন যথাসাধ্য মেনে চলতেই চেষ্টা করতেন। ব্রাহ্মণ-সজ্জন, ইতর-ভদ্র, ভালো-মন্দ নিয়ে দোষে-গুণে যে সমাজ, তার সঙ্গে সংযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন।

এমন কি, নিজেরা তাঁরা যা গোপনে করতেন, প্রকাশ্যে তাই অন্যে যারা করতো তাদের বিরুদ্ধে খড়গ ধারণ করতেও তাঁরা দ্বিধা করতেন না। অর্থাৎ অনাচারের উপর রাগ তাঁদের প্রবল ছিল না, কিন্তু সমাজের উপর অনুরাগ ছিল প্রবল। তাই প্রকাশ্যভাবে সমাজকে উপেক্ষা করবার ঔদ্ধত্য কেউ প্রদর্শন করলে তাকে তাঁরা কিছুতেই প্রশ্রয় দিতে চাইতেন না। আমাদের সমাজে শাস্তিদানের যতগুলি ব্যবস্থা আছে একে একে সেইগুলো তাদের উপর প্রয়োগ করা হোত। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত সমাজের তাঁরা বশংবদ সহযোগী ছিলেন।

কিন্তু কলকাতা শহর অত্যন্ত দ্রুতবেগে বাড়তে লাগলো।

ইংরেজের শাসন যত সুপ্রতিষ্ঠিত হতে লাগলো, বাংলার বাইরের অন্যান্য প্রদেশেরও শহর এবং গ্রামাঞ্চল থেকে তত লোক এসে কলকাতায় জমতে লাগলো। কেউ চাকুরীর চেষ্টায়, কেউ ব্যবসার জন্যে।

পাড়ায়-পাড়ায় ঝোপ-জঙ্গল, খানা-ডোবা ভর্তি হয়ে যেখানে সেখানে ছোটবড় নানারকম বাড়ি উঠতে লাগলো। রাত্রে শেয়ালের ডাক ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগলো। যে সব রাস্তার দুইদিক জঙ্গলে আবৃত ছিল, লোকে সন্ধ্যার পরে যে সব রাস্তা দিয়ে হাঁটতে ভয় পেত, তার দু’ধারে বাড়ি তৈরী হতে লাগলো। নানাদিকে নতুন নতুন রাস্তা তৈরীও আরম্ভ হয়ে গেল।

নানা দিক থেকেই অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তন দেখা যেতে লাগলো।

আগে অভিজাতদের এবং সাধারণ ভদ্র গৃহস্থ রমণীদের একমাত্র যান ছিল পালকী। দেখতে-দেখতে কলকাতার রাজপথে নতুন দেশী ও বিলাতী প্যাটার্নের ঘোড়ার গাড়ি যেতে লাগলো। বাতি ও প্রদীপের জায়গায় এল কেরোসিনের আলো।

এতদিন রেড়ীর তেলের আলোয় যারা অভ্যস্ত ছিল, কেরোসিনের জ্যোতিতে তাদের বিস্ময়ের আর শেষ রইল না। ইংরেজি সভ্যতার হাওয়া চারিদিক থেকেই তাদের চমক লাগিয়ে দিলে।

ঘোষেদের ‘দেবধামে’ও হাওয়া বদলাতে লাগলো।

.

হরেরাম গত হলেন। সদরে এবং অন্দরে রামরাম পিতার পুরোনো ব্যবস্থাই যথা সম্ভব অব্যাহত রাখবার চেষ্টা করলেন। সদরে সকালে সন্ধ্যায় পাড়ার ব্রাহ্মণ-সজ্জন এবং প্রতিবেশীরা আসেন। প্রার্থীরা কিছু কিছু পায়। যে সব সম্পর্কীয় আত্মীয় এবং অনাত্মীয়দের হরেরাম অর্থ সাহায্য করতেন, রামরাম তাঁদের পূর্ববৎই সাহায্য পাঠাতে লাগলেন। কাশীতে যে সব দুঃস্থ বিধবাদের জন্যে টাকা যেত, তাও যেতে লাগলো।

সদরে বিশেষ পরিবর্তন বোঝা গেল না। কিন্তু অন্দরে?

অন্দরেও বাইরে থেকে কিছুই পরিবর্তন বোঝা যায় না। কিন্তু ভিতরে ভাঙন ধরেছে।

প্রতাপচন্দ্র তখন হিন্দু কলেজের উঁচু ক্লাসের ছাত্র। সেকালে হিন্দু কলেজে পড়ার গৌরবই আলাদা। তার পড়ার ঘর, লাইব্রেরী এবং ড্রইং-রুমের মূল্যবান বিলাতী সজ্জা একটা দেখবার জিনিস।

বাড়ির এই অংশটা সদর এবং অন্দরের মাঝামাঝি জায়গা। রামরাম ভিতরে পুত্রের ইংরেজি চাল-চলন সম্বন্ধে গর্ব অনুভব করতেন, এবং পুত্রের অনুপস্থিতিতে মাঝে-মাঝে প্রতিবেশীদের নিয়ে গিয়ে ছেলের ঘরগুলো দেখাতেন।

সকালে-বিকালে প্রতাপের বন্ধুরা মাঝে মাঝে পাল্কীতে এ-বাড়ি আসতো। সে ও একটা দেখবার জিনিস।

এমনি করে বিলাতী চাল-চলন প্রতাপের ঘরে এবং সেখান থেকে রামরামের অজ্ঞাতসারে, মেয়েদের মধ্যেও সঞ্চারিত হচ্ছিল।

যাঁরা বলেন, আমাদের দেশের মেয়েরা স্বভাবত রক্ষণশীলা, তাঁরা শুধু আমাদের দেশেরই নয়, কোনো দেশের মেয়েকেই জানেন না। মেয়েরা যত সহজে এবং বিনায়াসে পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে পারে এমন পুরুষেও পারে না।

বলতে গেলে রামরামের গৃহিণী ছাড়া আর সকলেই রামরামকে লুকিয়ে হাত-ওলা বডিস ও হাত-কাটা শেমিজ ব্যবহার করতে লাগলো এবং মাথার চুলে ‘এলবার্ট’ও কাটতে লাগলো।

রামরামকে লুকানো কিছুই কঠিন ছিল না। সেকালে পুরুষেরা অন্দরে যেত অল্পই। দুপুরে আহার ও নিদ্রার জন্য ঘণ্টাকয়েক এবং রাত্রে বারোটা একটার পর তাঁরা অন্দরে যেতেন। দিন-রাত্রির অধিকাংশ সময় তাঁরা বাইরেই কাটাতেন। সুতরাং অন্দরে যা খুশি করবার অবাধ সুবিধা মেয়েদের ছিল।

.

রামরাম জীবিত কালেই দেখে গেলেন, তাঁদের বাড়ি এবং পরিবারকে কেন্দ্র করে যে পল্লীটি গড়ে উঠেছিল, প্রতাপচন্দ্র তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

পল্লী বেড়ে গেছে।

এসেছে সেখানে অনেক অপরিচিত লোক। তাদের সংখ্যা অনেক। সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। তাদের সঙ্গে সমাজ বন্ধনে আবদ্ধ হতে সময় লাগে। কিন্তু মানুষের হাতে সময় কম হয়ে আসছে।

প্রতাপচন্দ্রের সঙ্গে ওদের আচারে-আচরণেও যথেষ্ট পার্থক্য এসেছে। ওরা যেন এক সমাজের লোকই নয়। প্রতাপের ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজবিহারী মন আর ওদের সঙ্গে যেন খাপ খাচ্ছে না। প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থার উপর সে শ্রদ্ধাও তাঁর নেই, সে ভয়ও নেই। মস্ত বড় বাড়ি, অপরিমিত অর্থ এবং জুড়ি-ব্রহাম নিয়ে প্রতাপ স্বতন্ত্র হয়ে গেলেন। বাড়িতে পাড়ার ইতর-ভদ্র, অর্থী-প্রত্যর্থীর আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

বন্ধ হয়ে গেল শুধু সদরেই নয়, অন্দরেও।

‘দেবধামের’ অন্দরের তেতলার জানালাগুলো খুললেই পাড়ায় অনেকগুলি বাড়ি দেখা যায়। রামরামের গৃহিণী যতদিন বেঁচে ছিলেন সেই দিক দিয়ে পাড়ার গৃহিণী ও বধূদের সঙ্গে তিনি সংযোগ রেখেছিলেন। দুপুরে প্রতিবেশিনীরা ছাদে এলে তিনি জানালা দিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন। কার কি দিয়ে রান্না হোল, কার ক’টি ছেলেমেয়ে, কার মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে কি কষ্ট পায়,—সব খবর তিনি রাখতেন। নিজের বাড়ির সুখ- দুঃখের কথাও অসঙ্কোচে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। কারও মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে ছেলে হতে এলে তার সাধ পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর নিজের অন্তঃস্বত্ত্বা মেয়ের জন্যে কেউ সামান্য কুলের আচার পাঠালে হাসিমুখে হাত পেতে নিতেন। বিপদে-আপদে দু’পয়সা দিয়ে লোককে সাহায্যও করতেন এবং তার জন্যে গর্ব বোধ করতেন না।

মানুষের মধ্যে ছোট বড় বিচার তিনি করতেন জাত নিয়ে।

দরিদ্র ভট্টাচার্য গৃহিণী মোটা গড়া পরে এবং ফাটা পা নিয়ে তাঁর বাড়ি এলে তিনি ভক্তি সহকারে তাঁকে প্রণাম করতেন। দত্ত গৃহিণীকেও দরিদ্র বলে ঘৃণা করতেন না। বাড়ি এলে সমাদরে নিজের পাশে বসাতেন। কত সুখ-দুঃখের গল্প করতেন।

তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সে পাট উঠে গেল। জানালায় জানালায় পর্দা পড়লো।

পুরোনো অভ্যাসবশে প্রতিবেশিনীরা ছাদে এসে জানালার দিকে চাইলেই এ-বাড়ির মেয়েরা দ্রুতবেগে পর্দা টেনে দিয়ে সরে যেতে লাগলেন।

প্রতিবেশীর সঙ্গে মনের কথার আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গেল।

ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের এই যে ব্যবধান ইউরোপীয় সভ্যতার পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই রচিত হোল, তা আজও পর্যন্ত রয়ে গেছে, বরং আরও প্রসারিত হয়েছে।

কিন্তু এই ব্যবধানও সম্পূর্ণরূপে অর্থগত ছিল না। অনেকখানি সংস্কৃতিগত।

তখন হিন্দু কলেজ থেকে যাঁরা বেরিয়ে আসতেন, আচারে ব্যবহারে চিন্তাধারায় এবং দৃষ্টিভঙ্গীতে তাঁদের সঙ্গে পুরাতন সমাজের শুধু যে মিল ছিল না তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা প্রাচীন সমাজের বিরোধী ছিলেন।

প্রতাপের বালাখানার পুরাতনপন্থী সজ্জা বদলে গেল। সেই সঙ্গে সেখানকার পুরোনো মজলিসের রূপও। তাঁদের আলাপ আলোচনা এ-পাড়ার লোকদের দুর্বোধ্য।

সুতরাং ব্যবধান একতরফা ছিল না। উভয়পক্ষই স্বেচ্ছায় পরস্পরের থেকে সরে এসেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *