কালোঘোড়া – ৪

চার

বেলা তখন দশটা।

সরকার বালাখানা থেকে উঁকি দিয়ে ফিরে এল। বড়বাবু তখনও ওঠেননি। এ-বাড়ীর দাসী-চাকর থেকে বাইরের মোসাহেবরা পর্যন্ত সকলেই হিমাংশুবাবুকে বড়বাবু বলে। বালাখানার পাশে যে ছোট ঘর, সেই ঘরে তিনি ছিলেন শুয়ে। বাইরের বালাখানায় যেদিন অনেক রাত্রি পর্যন্ত আনন্দ হয়, সে রাত্রে আর তিনি অন্দরে ফেরেন না। ঐ ছোট ঘরটিতেই শুয়ে থাকেন।

তখনও তিনি ওঠেননি।

উঠলেন আরও এক ঘণ্টা পরে।

পুরাতন ভৃত্য রঘুয়া কাল রাত্রি থেকেই বড়বাবুর কাছে হামেহাল হাজির আছে। পানোন্মত্ত প্রভুর পরিচর্যায় সে পোক্ত হয়ে উঠেছে। কোন্ অবস্থায় কি করা দরকার সব জানে।

বড়বাবুর ঘুম ভাঙামাত্র সেই সব প্রক্রিয়া সে আরম্ভ করে দিলে : গরম জল দিয়ে একটুখানি লেবুর রস, একটু মদ্য, একটু চা, খাবার, পরের পর একটি একটি ক’রে আরম্ভ হয়ে গেল।

তারপরে স্নান।

স্নানান্তে বড়বাবু বালাখানায় ফরাসে এসে বসলেন। সরকার এসে কতকগুলো কাগজে সই করিয়ে নিয়ে গেল।

তারপর এলেন ম্যানেজার।

কথাটা ক’দিন বলি-বলি করে তিনি বলতে পারছিলেন না। কিন্তু বিষয়টা জরুরী। আর দেরি করা চলে না।

বললেন, বলছিলাম মৌজা হরিহরপুরের ব্যাপারটা।

—কি ব্যাপারটা?

ম্যানেজার মাথা চুলকে বললেন, জানুয়ারী কিস্তি ফেল করেছি। এক সঙ্গে জানুয়ারী- মার্চ দুটো কিস্তি দিতে হবে।

বড়বাবু অবলীলাক্রমে বললেন, বেশ তো। দিয়ে দিন। টাকা নেই?

ম্যানেজারের মাথা-চুলকানি বেড়েই চললো : সতেরো হাজার সাতশো তিরানব্বই টাকা আট আনা ন’পাই-এর ব্যাপার!

বড়বাবুর মৌজ তখনও কাটেনি। এসব অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ ভালো লাগছিল না। সন্ধ্যার পরে আসতে বললেন। সে সময় মেজাজ কেমন থাকবে, তাই বা কে জানে?

ম্যানেজার অতঃপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন।

বড়বাবু ফরাসে আড় হয়ে শুয়ে খবরের কাগজ খানা ওল্টাতে লাগলেন। যুদ্ধের খবরে তাঁর খুব উৎসাহ।

কিন্তু আজ আর যুদ্ধের খবরে তাঁর মন বসলো না।

কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো ছুটে চলেছে জার্মান সৈন্যদল। পোল্যান্ড শেষ হয়ে গেল দেখতে দেখতে। গেল দুর্বল বেলজিয়াম ও হল্যান্ড। ফ্রান্সও যেতে বসেছে।

শুনলে রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু হিমাংশুবাবু উৎসাহ পেলেন না। তাঁরও যেন যুদ্ধ চলেছে ঋণের সঙ্গে। ঝড়ের মতো হু হু শব্দে এগিয়ে আসছে তাঁকে গ্রাস করবার জন্যে। পৈতৃক ঋণ তো আছেই, তার উপর নিত্য নতুন উপলক্ষে নতুন নতুন ঋণ ও মাঝে মাঝে হচ্ছে।

বিশেষ করে এই জমিদারী।

এ যেন ঋণের উৎস হয়ে উঠেছে। একটা কিস্তি যাচ্ছে, আর একটা আসছে, তার পরে আর একটা। এর যেন আর শেষ নেই। প্রজারা খাজনা দেওয়া এক রকম বন্ধই করেছে। কর্তাদের আমলে প্রজাদের উপর শাসন ছিল। অবাধ্য প্রজার উপর মাঝে মাঝে শাসনের নামে নিষ্ঠুর অত্যাচারও হোত।

সেদিন আর নেই, সেদিন আর নেই!

দুশ্চিন্তায় হিমাংশুবাবুর সুন্দর ললাট রেখাঙ্কিত হয়ে উঠেছে।

.

দুপুরে বড়বাবু খেতে বসলেন। বড় মেয়ে বাসন্তী তাঁর সামনে এসে বসেছে।

এই মেয়েটি হচ্ছে হিমাংশুবাবুর সব চেয়ে প্রিয়।

এত রূপ কদাচিৎ চোখে পড়ে। বিশেষ রূপের সঙ্গে গুণের সমন্বয় বড় একটা দেখা যায় না। কে জানে, বোধ হয় এত রূপ-গুণ স্বয়ং বিধাতারও সহ্য হোল না। তাই যত রূপ তিনি দিলেন, তার সঙ্গে দুঃখও জুড়ে দিলেন ততখানি।

হিমাংশুবাবু বাসন্তীর বিয়ে দিয়েছিলেন খুব ধুমধামের সঙ্গে কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ বসু পরিবারে। ধনে-মানে-বিদ্যায় বসু পরিবার কলকাতার অভিজাত সম্প্রদায়ের শীর্ষস্থানীয়। ধনপতি বসুর বড় ছেলের সঙ্গে বাসন্তীর বিবাহ হয়। তখন বাসন্তীর বয়স মাত্র এগারো।

কিন্তু সে সুখ বেশিদিন সইলো না। দুটি বৎসর যেতে না যেতে প্ৰথমে ধনপতি বসু এবং তারপরে তাঁর বড় ছেলেও দুরারোগ্য রোগে মারা গেলেন।

বাসন্তী তখন তেরো বৎসরের বালিকা।

আশ্চর্য মেয়ে! সেই বয়সেই সে যোগিনী সাজলে। বাপ-মায়ের কান্না তাকে নিরস্ত করতে পারলে না। অথচ ওই বয়সে কী-ই বা সে বুঝেছিল?

এর পর থেকে একাদিক্রমে সে শ্বশুর-বাড়িতেই কাটাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি আসতো, বাপের সামনে দাঁড়াতো না। তার বৈধব্যবেশ হিমাংশুবাবু সহ্য করতে পারতেন না। অল্প কিছুদিন থেকে সে বাপের সামনে আসছে।

বাপের সঙ্গে দুটো কথা কইবার এইটেই সময়।

হাতের পাখাটা অনাবশ্যক দুলিয়ে বাসন্তী বললে, হিমুর বিয়ের জন্যে বলছিলাম। এই শিক্ষাটা বাসন্তীর শাশুড়ীর। তিনি বলেন, গুরুজনের খাওয়ার সামনে শুধু হাতে বসতে নেই। তাই শীতের দুপুরবেলা, তবু বাসন্তীর হাতে পাখা।

হিমাংশুবাবু খেতে খেতে মুখ তুলে চাইলেন।

—তোর হাতে ভাল পাত্র আছে নাকি?

বাসন্তীর বালবৈধব্য দেখে হিমাংশুবাবু বাল্যবিবাহের উপর চটে গেছেন। হৈমন্তীর বিবাহ সেইজন্যেই এখনও তিনি দেননি। এখন বাসন্তীর কথা শুনে মনে হোল, ভালো পাত্র পেলে তার বিয়ে দিতে তিনি প্রস্তুত।

খুশি হয়ে বাসন্তী বললে, আমার দেওরের কথা বলছিলাম। এবারে এম.-এ. পাস করেছে। আসছে বারে ল’ দেবে। ঠিক হয়েছে এটর্নীগিরি পড়বে।

বড়বাবু আনন্দে খাওয়া ভুলে গেলেন।

ছেলেটি তাঁর দেখা। বাসন্তী এ বাড়ী এলে সে মাঝে মাঝেই আসে। বাসন্তী না থাকলেও সে বাসন্তীর খবর নিয়ে এ বাড়ি আসে। ছিপছিপে লম্বা চেহারা। রংও খুব ফর্সা। বাসন্তীর বয়সী।

এমন ছেলে হাতছাড়া করা যায় না।

—ছেলে এখন বিয়ে করবে না শুনছিলাম যেন?

বাসন্তী হাসলে।

আজকালকার ছেলেদের ওই একটা চাল। ছেলে এখনও যে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, তা নয়। কিন্তু বাসন্তী তা আমল দিতে চায় না। ছেলের মা ভয় পান, দ্বিধা করেন। কিন্তু বাসন্তী ভয় পায় না।

বললে, শোনেন কেন ওসব কথা?

বড়বাবু সানন্দে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথাও থেকে সম্বন্ধ আসছে না কি?

—আসেনি। কিন্তু আসতে কতক্ষণ? তাই বলছিলাম, অন্য কোনো সম্বন্ধ আসবার আগেই আপনি আমার শাশুড়ীর কাছে গিয়ে সব পাকাপাকি ঠিক করে ফেলুন।

—বেশ তো।

কিন্তু কথাটা বলতে গিয়ে বড়বাবুর স্বর যেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। তাঁর মনে পড়লো বাসন্তীর বিয়ের কথা। সে সব স্মৃতি স্বপ্নের মতো কোথায় মিলিয়ে গেল?

বাসন্তী এবং তার এই দেবর সুবিমল দু’জনে সমবয়সী। হয় বাসন্তী, নয় সুবিমল একজন অন্যের চেয়ে এক মাসের বড়। কিন্তু কে যে বড় সেটা কিছুতেই সুনিশ্চিতভাবে জানা যাচ্ছে না। সুতরাং এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে গত তেরো বৎসরকাল যে কলহ চলে আসছে, আজও তার চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি।

স্বামীগৃহে এই দেবরটিই তার একমাত্র অবলম্বন এবং সান্ত্বনা। একেই নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি, তার বর্তমান, তার ভবিষ্যৎ।

সেই ভবিষ্যৎ নিয়ে এই বয়সেই তার মনের কোণে গোপনে একটা দুশ্চিন্তা এসে জমেছে। বেটাছেলের পক্ষে চব্বিশ বৎসর বয়সটা ভবিষ্যৎ কেন, বর্তমান নিয়েও দুশ্চিন্তা করার বয়স নয়। কিন্তু মেয়েদের, বিশেষ করে বাঙালী ঘরের বিধবা মেয়েদের মনের গতি স্বতন্ত্র। নিজেদের দুঃখময় অখণ্ড পরমায়ু সম্বন্ধে তারা নিঃসংশয় হয়ে ওঠে এবং অল্প বয়সেই সেই সুদীর্ঘ ভবিষ্যতের কথা তারা ভাবতে শেখে।

বাসন্তীর শ্বশুর রাজার সম্পদ রেখে গেছেন। সুতরাং তার একবেলা হবিষ্যান্নের জন্যে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। জীবিতকালের জন্যে সেই সম্পত্তির অর্ধেকের সে অংশীদার। কিন্তু দেবরের সংসারে নিঃসহায় বিধবা স্ত্রীলোকের জীবনস্বত্বের অর্থ কি?

সুবিমলের শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বে সে সন্দেহ করে না। তার লেশমাত্র কারণও এখনও পর্যন্ত ঘটেনি। কিন্তু বিবাহের পরে পুরুষের মন ও বুদ্ধির কত বড় পরিবর্তন সম্ভব, এই বয়সে সে নিজেই তো তার অনেক দৃষ্টান্ত দেখেছে।

সেই তার চিন্তা।

সত্য কথা বলতে কি, সুবিমলের বিয়ের বয়স এখনও হয়নি। কিন্তু মায়ের আগ্রহে বিয়ে তাকে শীঘ্র করতেই হবে। কতদিন সে মায়ের ইচ্ছায় বাধা দিতে পারে?

তাহলে এখনই সে বিয়ে করুক না, তার বোন হৈমন্তীকে? তাতে আপত্তি করবার কি আছে? হৈমন্তী সুন্দরী, পাস-করা না হোলেও লেখাপড়া মন্দ জনে না! দু’জনে মানাবেও বেশ।

তাহলে হৈমন্তীকেই সে বিয়ে করুক না কেন?

তাতে বাসন্তী খানিকটা নিশ্চিন্ত হতে পারে।

অপরিচিত, নিঃসম্পর্কীয় কোনো মেয়ে জা হয়ে এলে তার উপর বাসন্তী নির্ভর করতে পারে না। কিন্তু হৈমন্তী আর যা-ই করুক, তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তার সঙ্গে বিয়ে হোলে সুবিমলের উপর চিরকালের জন্য সে নিশ্চিন্তে নির্ভর করতে পারে।

এই বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই সে ছুটে এসেছে বাপের বাড়িতে। কার্যোদ্ধার হয়ে যাওয়া মাত্রই সে শ্বশুরবাড়ির ফেরবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।

বাসন্তী কতদিন পরে এসেছে। এর মধ্যে তাকে ছেড়ে দেবে কে? মা এখনো বেঁচে।

কিন্তু শাশুড়ীর দোহাই দিয়ে বাসন্তী মায়ের হাত থেকে যদি বা নিষ্কৃতি পেলে, ছোট ভাই শঙ্কর এসে পথ আগলে দাঁড়ালো।

—তুমি পাগল হয়েছ বড়দি? কাল বাদে পরশু আমার সরস্বতী পূজো। তার আগে তোমার যাওয়া হয়?

—তার আগে আবার আমি আসবো রে পাগলা!

মাথা নেড়ে শঙ্কর বললে, তেমন বোকা আমাকে তুমি পাওনি বড়দি। তোমাকে আমি খুব চিনি। সরস্বতী পূজোর আগে তোমার যাওয়া হতেই পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *