একুশ
বিকেলের দিকে শ্রীমন্তর জুর এলো না।
বাইরের ঢাকা বারান্দায় একখানি ইজি চেয়ারে ওকে সযত্নে বসিয়ে রেখে সুমিত্রা গেল ‘দেবধাম’।
‘দেবধাম’ যেন অত্যন্ত দ্রুত অধঃপতনের পথে নেমে চলেছে। ক’দিনই বা আসেনি সে! এই ক’দিনেই অধঃপতনের গতি স্পষ্ট বোঝা যায়, বাড়ির দিকে চাইলেই। দেওয়ালে চুনকাম ধসেছে, গাড়িবারান্দার সামনে জঞ্জাল বাড়ছে, দেওয়ালের ঘুলঘুলিতে খোপে- খোপে গোলা পায়রার সংখ্যাও অসম্ভব গতিতে বাড়ছে।
বাইরে দেউড়িতে একটা দারোয়ান টুলে বসে এখনও ঝিমুচ্ছে, কিন্তু ভিতরে চাকর- বাকরের একেবারেই কোলাহল নেই। দারোয়ানটার সঙ্গে এত বড় বাড়িও যেন ঝিমুচ্ছে।
নিচের তলায় কারও সঙ্গে তার দেখা হোল না। সরাসরি উপরে হৈমন্তীর শোবার ঘরের দরজার কাছে এসেই সুমিত্রা থমকে দাঁড়ালো।
একখানি খাটে শীর্ণ স্বর্ণলতার মতো শুয়ে আছে হৈমন্তী। খাটের উপর তার বুকের একান্ত সন্নিকটে বসে সুবিমল তার হাত দু’খানি ধরে কি যেন চুপি চুপি বলছে।
দোরের দিকে পিছন করে সে বসে ছিল। সুমিত্রার আসা টের পায়নি। হৈমন্তী তাকে দেখে শীর্ণ হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করলে। বললে, বোসো।
সুবিমল পিছন ফিরে সুমিত্রাকে দেখেই তাড়াতাড়ি উঠতে যাচ্ছিল। হৈমন্তী উঠতে দিলে না। চোখের ইঙ্গিতে একটা চেয়ার দেখিয়ে বললে, ওটা এইখানে টেনে নিয়ে এসো সুমিত্ৰাদি।
সুবিমলকে এর আগে সুমিত্রা কখনও দেখেনি।
হৈমন্তী হেসে বললে, কে বলো তো?
সুমিত্রা হেসে বললে, বুঝতে পেরেছি। সুবিমলবাবু।
সুবিমলের দিকে চেয়ে হৈমন্তী বললে, শ্রীমন্তদার স্ত্রী।
ওরা পরস্পরকে নমস্কার করলে।
সুমিত্ৰাই আগে কথা বললে। বললে, ভাগ্যিস আগে খবর দিয়ে আসিনি, তাই আপনার দেখা পেলাম।
—নইলে দেখা পেতেন না? —সুবিমলও হাসতে হাসতে জবাব দিল।
—পাইনি তো। কতদিন এ বাড়ি এসেছি, আপনার দেখা একদিনও তো পাইনি।
-–সে আমারই দুর্ভাগ্যের জন্যে। খবর দিয়ে আসার জন্যে নয়। আপনার কথা এত শুনেছি যে, আপনাকে দেখবার লোভ অনেক দিনের।
সুমিত্রা সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে, বলেন কি! এত কথা কার কাছে শুনলেন?
—জিজ্ঞেস করুন ওকে।-বলে ইঙ্গিতে হৈমন্তীকে দেখালে।
হৈমন্তী হেসে বললে, সত্যি ভাই। তোমার কথা আমাদের মধ্যে প্রায়ই হয়।
সুমিত্রা গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলে, তোমার সঙ্গে আমার ক’বারই বা দেখা হয়েছে! এত কথা আমার সম্বন্ধে কী হয়?
হৈমন্তী বললে, তা জানিনে ভাই। কিন্তু মাঝে মাঝেই তোমার কথা হয়।
সুবিমল বললে, কথা হবার জন্যে বেশি বার দেখা হওয়ার দরকার হয় না বৌদি। যাকে ভালো লাগে, তাকে এক মিনিটেই লাগে।
সুবিমলের বৌদি সম্বোধনে সুমিত্রার মুখ কি জানি কেন হঠাৎ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো।
বললে, আপনার সঙ্গে কথায় পারবার জো নেই।
বলেই হৈমন্তীর একখানি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কেমন আছ ছোটদি?
হৈমন্তী জবাব দেবার আগেই সুবিমল বললে, মাঝারি। আগের চেয়ে ভালো। কিন্তু একে ঠিক ভালো বলা এখনও যায় না।
কৃত্রিম কোপে ভ্ৰূ কুঞ্চিত করে সুমিত্রা বললে, ছোটদির শরীরের দিকে চেয়ে একথা বলতে আপনার লজ্জা করছে না?
হাত জোড় করে সুবিমল বললে, প্রথম প্রথম করত বৌদি, এখন আর করে না। কিন্তু বেছে বেছে এমন দিনে এসেছেন, যেদিন আমার সময় কম। আবার কবে দেখা হবে বলুন।
সুমিত্রা হেসে বললে, সে ভার যদি আমার উপর দেন, তাহলে বলব — জানিনে। আর যদি নিজের উপর নেন তাহলে যে-কোনো দিনই দেখা হতে পারে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে সুবিমল বললে, বেশ, নিজের উপর নিলাম। এর মধ্যে যে-কোনোদিন গিয়ে উঠবো আপনার বাড়ি। উৎপাত ভাববেন না তো?
—কী যে বলেন! উৎপাত ভাববো আপনি গেলে?
—বেশ আজ উঠলাম হিমু।
—আচ্ছা।
.
সুবিমল চলে গেলে সুমিত্রা বললে, তোমার কাছে আজকে কিন্তু অকারণ আসিনি ছোটদি!
—তবে?
—একটু মন ভাল করতে এলাম।
হৈমন্তী হেসে বললে, আমার কাছে মন ভালো করার ওষুধ আছে বলে তো জানতাম না।
—তুমি জানতে না, কিন্তু আমি জানতাম।
—তাই নাকি? তাহলে মন ভালো করা আরম্ভ হয়ে যাক।
—আরম্ভ হয়ে গেছে।
—কখন থেকে? ওঁকে দেখার পর থেকেই নাকি?
সুমিত্রা ওর গাল টিপে দিয়েই বললে, না, তোমাকে দেখার পর থেকে। এ ক’দিন যে কি করে কাটলো, সে তোমাকে বলবার নয়।
—কেন?
—ওঁর জ্বর। মরতে এত ভয় আমি কখনও কারও দেখিনি ছোটদি। ওঁর ভয় হত, এই অবস্থায় ওঁকে ফেলে আমি পালাবো। ভাবতে পারো?
সুমিত্রা হাসতে লাগলো।
হৈমন্তী কিন্তু হাসলে না। তার শীর্ণ মুখমণ্ডলে কালি পড়া চোখ দুটো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।
জিজ্ঞাসা করলে, তারপরে?
—তারপর আর কি? পাঁচ দিন পাঁচ রাত্রি ঠায় বসে কেটেছে। একসময় মনে হল, আর পারিনে, ছুটে গিয়ে তোমাকে ডেকে নিয়ে আসি। এলে তুমি যেতে?
—আমি? আমি কেন যাব?
সুমিত্রা রাগ করলে না। বললে, আমিও তাই ভেবেছিলাম, তুমি কেন আসবে? তবু ওঁর এবং আমার অজস্র বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে একা তোমাকে ডাকবার কথাই মনে হত।
—এখন কেমন আছেন?
—ভালো।
একটু পরে সুমিত্রা বললে, এদিকে তো এত শক্ত। কিন্তু জ্বরের সময় উনি যে কত দুর্বল হয়ে যান, তোমার করুণা হত। একটা শিশুর মনে যেটুকু জোর থাকে, ওঁর যেন তাও ছিল না। সে একটা দেখবার জিনিস।
ওর বলার ভঙ্গিতে হৈমন্তী হেসে ফেললে।
তারপর বললে, এত লোক থাকতে আমার কথাই তোমাদের মনে হত কেন?
—সে কি তুমি জানো না?
—না।
—তাহলে আর শুনে কাজ নেই।
—আছে কাজ। তুমি বলো।
সুমিত্রা দ্বিধা করতে লাগলো।
হৈমন্তী অধৈর্যের সঙ্গে বললে, বলো।
—নিতান্তই শুনবে?
—হ্যা।
—তাহলে শোনো।
সুমিত্রা বলতে লাগলো :
—ওঁর মনের মধ্যে দয়া, মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা কিছুই নেই,—সে তুমিও জানো, আমিও জানি। একটা অত্যুগ্র স্বার্থের জ্বালা ওঁকে হাউই-এর মতো নিরন্তর উপরের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। এর মধ্যে কেমন করে জানিনে, তুমিই ওঁর মনের মধ্যে একটুখানি দাগ কেটেছ।
বিস্ময়ের আতিশয্যে হৈমন্তী বিছানায় উঠে বসলো। বললে, আমি?
—তুমি, এবং একমাত্র তুমি। নিজের প্রয়োজন ছাড়া কোনো মানুষকেই কখনও ওঁর মনে পড়ে না। কেবল তোমার কথাই ভুলতে ওঁর কষ্ট হচ্ছে।
হৈমন্তী নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। ওকে সামলে নেবার সময় দেবার জন্যে সুমিত্রাও চুপ করে রইলো।
একটুক্ষণ পরে বললে, ওঁর অসুখের সময় শুধু ওঁর নয় আমারও একটু ভয় হয়েছিল। তখন মনে পড়তো তোমাকে। ভেবেছিলাম, বাড়াবাড়ি হোলে যেমন করেই হোক তোমাকে একবার টেনে আনতেই হবে। তোমাকে দেখলে হয়ত একটু সান্ত্বনা পাবেন, সাহসও পাবেন। ভগবান রক্ষে করেছেন, তার প্রয়োজন হয়নি।
—ভগবান করুন, তার প্রয়োজন যেন কখনও না হয়।—হৈমন্তী আস্তে আস্তে অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলতে লাগল,—তোমাকে জানাচ্ছি, ওঁরও জেনে রাখা ভালো, ওই লোকটির সম্বন্ধে আমার মনে ঘৃণা ছাড়া আর কোনো অনুভূতিই নেই।
—এ কি কখনও সত্যি হতে পারে?
—পারে। কিন্তু এ নিয়ে আর কোনো কথা নয় সুমিত্রাদি। এ প্রসঙ্গ এখানেই থাক। আর কোনো দিন এ প্রসঙ্গ আমার সামনে তুলো না।
সুমিত্রা চুপ করে গেল।
একটু পরে জিজ্ঞাসা করলে, শঙ্করকে দেখছি নে ছোটদি?
হৈমন্তী আবার চঞ্চল হয়ে উঠলো। বললে, তাকে নিয়ে বাড়িসুদ্ধ সকলের আর একটা যন্ত্রণা হয়েছে। বাড়িতে সে থাকে না বললেই হয়। দু’বেলা দুটো খাবার সময় আসে, তাও সব দিন নয়।
—কি করে সে?
—কে জানে! যেমন চোয়াড়ে চেহারা হচ্ছে, তেমনি চোয়াড়ে কথাবার্তা। আমার তো ওর সঙ্গে কথা কইতে ঘেন্না হয়।
হৈমন্তী অসীম ঘৃণায় মুখ ফেরালে।
সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলে, এই বয়সেই ও কি একবারে শাসনের বাইরে চলে গেছে?
হৈমন্তী বললে, বাইরে? কিন্তু শাসন করবে কে সুমিত্রাদি? বাবা?
রাগে দুঃখে হৈমন্তীর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। বললে, তুমি একদিন বলেছিলে, এ বংশের নীলরক্ত শেষ হয়ে আসছে। বোধ হয় তোমার কথাই সত্যি সুমিত্ৰাদি। আমি তো কোনোদিকেই এ বাড়ির কল্যাণ দেখি না। এসেছি ছেলে হতে, কিন্তু কি যে ভয় করছে সে তোমাকে বলবার নয়। এ বাড়ির দেওয়ালগুলো পর্যন্ত যেন বিষে নীল হয়ে গেছে। শুধু মায়ের জন্যে এখানে থাকা সুমিত্রাদি, নইলে এক মুহূর্ত এখানে থাকতে ইচ্ছা করে না।
হৈমন্তী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সান্ত্বনার একটা কথাও সুমিত্রার মুখে জোগালো না। সে নিঃশব্দে পরম স্নেহভরে ওর মাথার চুলে হাত বুলোতে লাগলো। বালিশে মুখ ঢেকে হৈমন্তী কাঁদে। সুমিত্রার মনে হয়, যেন একটা অস্ফুট আর্ত গুঞ্জন ‘দেবধামের’ মর্মের মাঝখান থেকে দেওয়াল ভেদ করে আসছে। ওর কেমন যেন ভয় করে।