কালোঘোড়া – ১১

এগারো

১৯৪২ সালের ডিসেম্বর।

সে এক স্মরণীয় দিন।

রাত্রে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। চাঁদ ওঠার দু’ঘণ্টা পরেই বাজে সাইরেন। ভীত মানুষ যে যেখানে পারে, আশ্রয় নেয়। জাপানী এরোপ্লেন আসে শহরের মাথায়। বোমা পড়ে,—কখনও শহরের ভিতরে, কখনও বাহিরের শিল্পাঞ্চলে; পরদিন সকাল থেকে আরম্ভ হয় শহর ছাড়বার ধুম।

হাওড়া আর শিয়ালদহ,—দু’দিকের দুটো স্টেশনে সমস্ত দিন রাত্রি জনসমুদ্র গর্জন করছে। ট্রেনের সংখ্যা কমে গেছে। নির্দিষ্ট সংখ্যক টিকিট সকালের দিকে কিছুক্ষণের জন্যে বিক্রি হয়! সে আর ক’খানা? তারপরে সারাদিন চলে ঘুষের খেলা। ধনীরা মুঠো- মুঠো নোট দেয় গুঁজে, ট্রেনে ওঠবার তাড়ায়, শহর থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার ব্যাকুলতায়।

মধ্যবিত্তেরাও দিচ্ছে তাদের সর্বস্ব উজাড় করে। যারা চালাক, তারা ফন্দিফিকির খুঁজছে। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসবার আগেই কেউ বা দু’টাকা ঘুষ দিয়ে, কেউ বা লুকিয়ে বেড়া টপকে ইয়ার্ডে গিয়ে ঢুকছে।

যারা পারছে না তারা স্টেশনের প্রবেশপথে অপমানিত হচ্ছে, মার খাচ্ছে। যারা জখম হচ্ছে, দয়া করে তাদের স্টেশনে ফার্স্ট এড দেওয়া হচ্ছে এবং স্ট্রেচারে করে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে উঠিয়েও দেওয়া হচ্ছে। তাদের আহত বিবর্ণ মুখে তখন পরিতৃপ্তির কী হাসি!

এত ঝামেলা যারা পোয়াতে রাজি নয়, তারা চলছে হেঁটে। কেউ কেউ সপরিবারেই।

নিরবচ্ছিন্ন ধারায় চলেছে মূষিকের মতো মানুষের দল।

কারও মাথায় পাগড়ি, কারও হাতে লাঠি, কারও বাঁক—তাতে তার সমস্ত সম্পত্তি। কেউ চলেছে একা, কেউ সপরিবারে, কচি-কাচা ছেলেপুলে নিয়ে, কারও সঙ্গে গরু- বাছুর-মহিষ।

জনতার যেন আর শেষ নেই!

দেখতে দেখতে চোখ ক্লান্ত হয়ে আসে। এত লোকও এই কলকাতা শহরে ছিল? চলেছে তো চলছেই। এর আর ছেদ নেই। চৌবাচ্চা খুলে দিলে যেমন হুড় হুড় করে জল বেরিয়ে যায়, এই দুটি নির্গমপথ দিয়ে তেমনি হুড় হুড় করে লোক বেরিয়ে চলেছে।

এ ছাড়া নদীপথও আছে। নৌকা ভাড়া করেও বহু পরিবার চলে যাচ্ছে। তিন ঘণ্টার পথ, তিন দিনে পৌঁছুবে। কি আর করা যায়? হাঁটবার শক্তি নেই, ট্রেনে ভিড় ঠেলাও অসম্ভব। তার চেয়ে তিন দিন, তিন দিনই সই।

যারা রইল তাদের অবস্থাও সুখকর নয়।

সকাল হোলেই রকম-বেরকমের গুজব উঠছে। সে-সমস্ত শুনলেও বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। সন্ধ্যা হোলে যখন পথের লোক যায় বিরল হয়ে, পল্লী স্তব্ধ হয়ে আসে, —তখন ঘরের মধ্যে বসে থেকেও গা ছমছম করে। ঘুম আসে না, কখন সাইরেন বাজে!

এই সাইরেন!

আহত মুমূর্ষু কুকুরের আর্তনাদের মতো এই যে ডাক,—বোমার চেয়েও সে ডাক ভয়ঙ্কর। শুনলে মুখ শুকিয়ে যায়, হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়, দেহের গাঁটে গাঁটে ঝিনঝিনি ধরে।

যেন শ্মশানের প্রেতের আর্তনাদ।

শ্রীমন্ত কোথাও যায় নি।

সে অবশ্য বড় কথা নয়। যারা পালাচ্ছে তাদের মধ্যে ঝি-চাকর, রিকশওলা- ঘোড়াগাড়িওলা, ফিরিওলা, কুলী-মজুর আর ছোট-বড়-মাঝারি ব্যবসাদারের সংখ্যাই বেশি। চাকুরি-জীবি সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব কমই পালাচ্ছে। তারা যে সাহসী বেশি বলে পালাচ্ছে না তা নয়, এখনই-এখনই চাকরি ছেড়ে পালানো তারা শ্রেয় মনে করছে না। তারাও পালাবে। সত্য কথা বলতে কি, পালাবার জন্যে তারা সকল সময় তৈরি হয়েই রয়েছে। কেবল আরেকটু না দেখে পালাতে প্রস্তুত নয়।

সুতরাং শ্রীমন্ত যে পালায়নি তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। তাদের অফিসের মোটে তিনজন ছাড়া আর কেউ পালায়নি। আশ্চর্য এইখানে যে, সে বলে, তার ভয় করে না।

কলকাতা শহরে এখন বাড়ির অভাব নেই। সস্তায় চমৎকার একখানা বাড়ি সে ভাড়া করেছে।

সেই রাত্রের পর হোটেলে বড় একটা আর যায় না। সন্ধ্যার পরে আজকাল বাইরে কোথাও বেরুনো ঠিক নয়। অফিসেও আজকাল সে আর অত রাত্রি করে না। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে।

হাত মুখ ধুয়ে পোশাক ছেড়ে আজকাল সে বাইরের বারান্দায় এসে বসে।

মেয়েছেলে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার পর বাড়ি পাহারা দেবার কাজ় বড়বাবুর কমেছে। তিনিও মাঝে মাঝে আসেন। মাঝে মাঝে আসে আলেকজান্ডার। তার সঙ্গে শ্রীমন্তরও খুব ভালো জমেছে। দু’জনে দু’জনকে নাম ধরেই আজকাল ডাকে। শ্রীমন্ত ডাকে হেনরি বলে, আর আলেকজান্ডার বলে মন্টি।

ওদের দু’জনের এই ঘনিষ্ঠতায় সুমিত্রা খুশি নয়।

শ্রীমন্ত তা বুঝতে পারে। কিন্তু কি করবে? রাগ ওর আসে না, ওর মনে ‘জেলাসি’ বলে কিছু নেই। মনের ‘ফ্রন্টে’ সুমিত্রা ক্রমাগত সৈন্য-সমাবেশ করছে। কিন্তু শ্রীমন্তর সেজন্যে কিছুমাত্র দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। সে যুদ্ধ করবেই না।

এমনি কি সেই হাওয়াই-হামলার রাত্রে সুমিত্রা যে হেনরির সঙ্গে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল, তাকে একলা ফেলে রেখে, তার জন্যে আজ পর্যন্ত কোনো দিন একটা কৈফিয়ৎও সে চায়নি।

সুমিত্রা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে একটা কৈফিয়ৎ হয়তো দিতে চেয়েছে। কিন্তু তার ভণিতাতেই আন্দাজ পেয়ে শ্রীমন্ত তাড়াতাড়ি অন্য বিষয়ের অবতারণা করেছে।

ভেবে পায় না সুমিত্রা, এ রাগ, না অভিমান, না ঔদাসীন্য?

শুধু শ্রীমন্ত জানে, ওসব কিছুই নয়। হৃদয়বৃত্তির চর্চা করার সময় তার নেই। জীবনের গতিপথে কালো ঘোড়ার মতো সে ছুটে চলেছে আপন লক্ষ্যের দিকে। তার ভাগ্যদেবতাই জানে, সেখানে তার জন্যে কি সঞ্চিত হয়ে রয়েছে—অভিশাপ, না আশীর্বাদ। যা-ই থাক, সে-ই তার একান্ত লক্ষ্য। এ পথে হৃদয়ের কোনো স্থান নেই।

মানুষের মূল্য তার কাছে প্রয়োজনের তুলাদণ্ডে ওজন করা হয়। কারবার চলে ‘cash and carry’-র। তার মধ্যে রাগ-অভিমানের বালাই নেই।

বড়বাবু, সুমিত্রা, হেনরি, এদেরকে তার প্রয়োজন। সেই হিসাবেই এদের সে খাতির করে, যত্ন করে এবং এদের পিছনে খরচও করে। তার জন্যে ওরা সবাই খুশি।

বাদে সুমিত্রা। সেই কেবল মাঝে মাঝে বিগড়ে যায়। মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না শ্রীমন্তর ব্যবহারে সে চটবে কি খুশি হবে। পুরুষমানুষের মনে ‘জেলাসি’র বাষ্প পর্যন্ত নেই, একথা ভাবতেও ওর অবাক লাগে।

এ কি করে সম্ভব হয়?

সুমিত্রা ভাবে, কিন্তু ভেবেও কোন কিনারা পায় না।

প্রতিদিনের মতো আজকেও শ্রীমন্ত অফিস থেকে ফিরে বারান্দার উপর থেকে চলমান জনতা দেখছিল।

প্রথমে দু’দিনের পরে জনতা অনেক ফিকে হয়ে এসেছে। তবু এখনও কম নয়। সেই জনতার স্রোতে তার মন করবী ফুলের মতো নিরুদ্দেশে ভেসে চলেছে।

হঠাৎ পিছন থেকে তার পিঠের উপর একটা টোকা পড়লো।

—সুমিত্রা? এসো, বসো।

শ্রীমন্ত খুশি হয়ে উঠলো। তার মন কোনো কারণেই এমন করে ভেসে চলে, এ সে সহ্য করতে পারে না। সুমিত্রা এলো, ভালোই হোল। একটা নোঙ্গরের তার দরকার ছিল।

—কি দেখছিলে? জনতা?

—হ্যাঁ।

শ্রীমন্ত পাশের চেয়ারে বসে বললে, দেখছিলাম, ওদের মুখে কি লেখা রয়েছে।

—কি দেখলে?

—দেখলাম, শুধু ভয় নয়।

—তবে?

—পিছন থেকে ভয়ের একটা ঠেলা অবশ্য আছেই। কিন্তু সেই সঙ্গে সামনের একটা টানও আছে।

—সে টানটা কিসের?

—বুঝলে না? গেল বারে ইভ্যাকুয়েশ্যনে যাদের বাইরে পাঠিয়েছে, মা-বাপ-স্ত্রী- পুত্র-কন্যা, টানছে তারা। ট্রেনে এখনও যথেষ্ট ভিড়। বড়বাবুকে বললাম, এই ভিড়ে একটা দিনের জন্যে কেন কষ্ট করে দেশে যাচ্ছেন? বললেন, ‘বোঝ না ভায়া, বাড়িতে সবাই ভাবছে! কাগজে যা পাচ্ছে তা তারা বিশ্বাস করতে পারছে না। চোখে না দেখা পর্যন্ত তারা শান্ত হতে পারবে না।’ সেই থেকেই কথাটা ভাবছি।

—ভেবে কিছু কিনারা পেলে?

এমন সময় ভারি বুটের শব্দ করে হেনরি এল। তাকে সংবর্ধনা জানিয়ে শ্রীমন্ত সুমিত্রার কথার উত্তর দিলে।

—কিনারা ঠিক পাইনি। তবে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে যেন পায়ে মাটি ঠেকছে।

হেনরি জিজ্ঞাসা করলে, কিসের মাটি?

শ্রীমন্ত হেসে বললে, কবরের। শোনো হেনরি, আমাদের সম্বন্ধে তুমি কি-ধারণা নিয়ে যাবে জানিনে। কিন্তু ক’টা কথা তোমার জানা দরকার।

হেনরি সাগ্রহে বললে, কি? বলো।

শ্রীমন্ত বললে, আমাদের একটা বদনাম—আমরা ভীরু। বাইরে থেকে দেখলেও তাই মনে হবে। সেটা সত্যি নয়। সত্যি এই যে, আমরাও তোমাদেরই মতো সাহসী।

—প্রমাণ করো।

—প্রমাণ করছে ভারতের সৈন্যবাহিনী।

—আর যারা পালাচ্ছে?

—তারাও ভীরু নয় সবাই।—শ্রীমন্ত চেয়ারে সোজা হয়ে উঠে বসলো—ইউরোপের যে সব শহরে বোমা পড়েছে সেখানকার কথা ভাবো। এমন কি, তোমার লন্ডনের লোকেরাও এর চেয়ে সাহস দেখায়নি। তারপরে, বলতে পারো এখানে থেকে এরা প্রাণ দেবে কিসের জন্যে? একি স্বাধীন দেশ? না ওদের হাতে অস্ত্র আছে?

হেনরি জিজ্ঞাসা করলে, অস্ত্র তুমি কাকে বলো? তলোয়ার? রিভলবার? বন্দুক? কিন্তু সে নিয়েও তো হাওয়াই-হামলা ঠেকানো যায় না।

এবারে সুমিত্রা উত্তর দিলে। বললে, না, যায় না। তবু তাতে বল বাড়ে। ভাবো তো হেনরি, এত বড় দুর্দিনেও যারা আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও বন্দুক-রিভলবার ব্যবহারের অনুমতি পেলে না, আত্মরক্ষার জন্যে তাদের পলায়ন ছাড়া কি রইল?

এই উত্তরে হেনরি এবং শ্রীমন্ত উভয়েই হেসে উঠলো।

শ্রীমন্ত বললে, তাছাড়াও কথা আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমরা তোমাদের মতো মরিয়া হতে পারি না।

—কেন পারো না?

—সেই কথাই সুমিত্রাকে বলছিলাম। পারি না আমাদের এই সমাজব্যবস্থার জন্যে। আশ্চর্য একটা ব্যবস্থা! কিন্তু দাঁড়াও, তার আগে তোমাদের চায়ের কথাটা বলে আসি।

হেনরি না বলে পারলে না : বলে আসতে হবে কেন মন্টি, এখানেই তাকে ডাকো না?

—তা সম্ভব নয়;—গম্ভীরভাবে শ্রীমন্ত বললে,—কারণ এই নতুন লোকটি বদ্ধ কালা।

—সর্বনাশ!

—কিছু সর্বনাশ নয়, বরং ভালোই হয়েছে। সাইরেন যখন বাজে তখনও নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। বোমার শব্দে ওর ঘুমও ভাঙে না, ভয়ও করে না।

শ্রীমন্ত হাসতে হাসতে চলে গেল।

ফিরে এসে বলতে লাগলো :

—আমাদের এই দেশকে যদি বুঝতে চাও, তাহলে সব চেয়ে আগে বুঝতে হবে এদেশের সমাজ-ব্যবস্থা। একান্নবর্তী পরিবার যে কি বস্তু সে তোমার ধারণা নেই। একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তির উপর নির্ভর করে থাকে বৃদ্ধ বাপ মা, বিধবা পিসিমা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, নাবালক ভাইবোন, অনেকে। তারপরে ধরো,—এদেশে বিধবা-বিবাহ নেই। তোমরা যুদ্ধে এসেছ, তোমাদের এই ভরসা আছে, কারও মৃত্যু হোলে তার স্ত্রী একেবারে পথে বসবেন না। প্রথমত, তাঁর নিজের উপার্জন করবার শক্তি আছে; দ্বিতীয়ত, তিনি হয়তো আবার বিবাহ করে ঘর-সংসার পাতবেন। কিন্তু এদেশের কথা ভাবো : স্বামীর মৃত্যু হোলে স্ত্রীর ভাই কিংবা দেওরের গলগ্রহ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

হেনরি বললে, কিন্তু এই তো, মিস্ রয় চাকরী করছেন?

সুমিত্রা হেসে বললে, করছি। কিন্তু এত বড় দেশে আমাদের মতো মেয়ের সংখ্যা কত? তাছাড়া, তুমি জানো না, এর জন্য আমাদের এই মুষ্টিমেয় ক’জনকে কত বাধা এবং নিন্দার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়।

শ্রীমন্ত বললে, তাছাড়াও বাধা আছে। আজ যুদ্ধের জন্যে চাকরি সুলভ হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় বারো আনা ছেলে বেকার থাকে। এর উপর মেয়েরাও যদি চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করে, তাহলে বেকার সমস্যা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।

চাকর চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এল। সুমিত্রা উঠলো চা তৈরি করতে।

সুমিত্রা হেসে জিজ্ঞাসা করলে, এই লোকটি কালা?

শ্রীমন্ত বললে, হ্যাঁ। বদ্ধ কালা। প্রথম দিন বোমা পড়তেই সে চাকরটা পালিয়েছে। বহু কষ্টে দ্বিগুণ মাইনেতে একে পেয়েছি। কানে শোনে না, ভরসা হচ্ছে, বোমায় একে ভয় দেখাতে পারবে না। কি বল?

সবাই হেসে সম্মতি দিলে।

ওর হাতে একটা টাকা দিয়ে শ্রীমন্ত ইসারায় এক প্যাকেট সিগারেট আনতে বললে।

লোকটি বললে, ভাঙানী ছাড়া দেবে না।

বিরক্ত কণ্ঠে চীৎকার করে শ্রীমন্ত বললে, ভাঙানীর দরকার নেই, ওতে যত প্যাকেট হয় নিয়ে আয়। পয়সা কিছু বাঁচলে দেশলাই নিয়ে আসবি। বুঝলি?

লোকটি বুঝলে কি না, কে জানে! বাবুর চীৎকারে ভয় পেয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল।

শ্রীমন্ত ওদের দিকে চেয়ে বললে, এই আর এক বিপদ হয়েছে। চাকরটা পালিয়ে যাওয়ার পর দুদিন চা খেতেই পেলাম না। এ পাড়ার চায়ের দোকান সব বন্ধ। মুদির দোকান, তাও বন্ধ। এ রকম করে ক’দিন চলবে?

চিন্তার কথা!

সুমিত্রা বললে, এমনি একটা কালা আমাকে যোগাড় করে দিতে পার?

শ্রীমন্ত হেসে বললে, দেখব। তারপর বলল, কী লোকটাই পালালো এবং এখনও পালাচ্ছে! কদিন ধরেই ভাবছি এদের কথা! আমার কি মনে হচ্ছে জানো? প্রাণের ভয় একটা মস্ত বড় কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের সমাজ-ব্যবস্থাও এর জন্যে অনেকখানি দায়ী। অনেকে কিন্তু বুড়ো বাপ-মা, স্ত্রী-পুত্রের চিন্তিত মুখ স্মরণ করেই পালিয়েছে। নইলে হয়তো থেকে যেত।

হেনরি অনেকক্ষণ নিঃশব্দে ঘাড় নীচু করে ব্যাপারটা ভেবে দেখতে লাগলো। তারপর বললে, তুমি যা বলছ মন্টি, সে অসম্ভব নয়। অন্তত এর মধ্যে ভেবে দেখবার ব্যাপার আছে। আমার কি মনে হচ্ছে জানো? মেয়েদের অসহায় করে তোমরা নিজেরাই নিজেদের বিড়ম্বনা বাড়িয়েছ। এখন দুঃখ করা বৃথা। তোমাদের পায়ে পরাধীনতার বেড়ি এবং সমাজ-ব্যবস্থার বেড়ি পরস্পর জড়িয়ে গেছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কিছু চিন্তা করেছ?

শ্রীমন্ত হাসলে। বললে, আমার কথা ছেড়ে দাও। এদেশের যাঁরা জ্ঞানে, চিন্তায়, কর্মে সকলের বড়—যাঁরা অন্য দেশের কারো চেয়েও ছোট নন, তাঁরা চিন্তা করছেন। কিন্তু কিনারা পেয়েছেন ব’লে মনে হয় না। আমাদের দেশের যত কিছু সমস্যা সব পরস্পর সম্বন্ধ হয়ে একটা দুষ্টচক্রে ঘুরছে। এর মধ্যে একক কোনোটিকে আলগোছে তুলে নিয়ে সেই সমস্যাটির সমাধান করবে, তার উপায় নেই। অনেক চিন্তা করে দেখা গেছে, আমাদের দেশের পরাধীনতার সমাধান না হোলে কোনোটিরই সমাধান সম্ভব নয়।

হেনরি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে, ততদিন অন্য সমস্যাগুলি অপেক্ষা করে থাকবে?

—উপায় কি?—হেনরির মুখের দিকে চেয়ে হেসে শ্রীমন্ত বললে, আমি বুঝতে পারছি, তোমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মার্কিন স্বাধীনতাযুদ্ধের কালে যাঁরা জন্মেছিলেন, তোমার সেই পূর্বপুরুষদের জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা আমার কথাতেই সায় দিতেন।

অজ্ঞাতসারে শ্রীমন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললে। সেটা ওর পক্ষে এমনই একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার যে সুমিত্রা পর্যন্ত চায়ের পেয়ালার ফাঁক দিয়ে অবাক হয়ে ওর দিকে চাইলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *