কালোঘোড়া – ২৩

তেইশ 

শ্রীমন্তদের কালো রঙের ট্যাক্সিটা কালো কলকাতার বুক চিরে চোখ পিট পিট করতে করতে ছুটলো। প্রথমে এটর্নীর বাড়ি। সেখানে গিয়ে শুনলে তিনি এখনও ফেরেননি, চেম্বারেই রয়েছেন বোধ হয়। সুতরাং সেখান থেকে চললো হাইকোর্টপাড়ায়, এটর্নীর চেম্বারে। শ্রীমন্ত মরিয়া। সে স্থির করেছে, বায়নাপত্র না করে আজ ফিরবে না। এটর্নীকে পেতেই হবে। চেম্বারে যদি না পাওয়া যায় তাহলে যেখানে তিনি আছেন সেখান থেকে তাঁকে আনতে হবে। উপবাস-ক্লিষ্ট অজগর যেমন করে তার শিকারকে পাকে পাকে বেষ্টন করে থাকে তেমনি করে হিমাংশুবাবুর অর্ধ-অচেতন শিথিল দেহটাকে সে জড়িয়ে ধরে আছে। 

ভাগ্যক্রমে এটর্নীকে তার চেম্বারেই পাওয়া গেল। 

রায়বাহাদুর পান্নালাল ঝুনঝুনওয়ালার একটা জটিল মামলা নিয়ে তিনি ব্যারিস্টারের সঙ্গে পরামর্শ করতে গিয়েছিলেন। এইমাত্র রায়বাহাদুরের ম্যানেজারকে নিয়ে সেখান থেকে ফিরেছেন। 

সিঁড়ির মাথাতেই সে খবর শুনে শ্রীমন্ত আশান্বিত হয়ে মা-কালীর উদ্দেশে যুক্তকর ললাটে ঠেকাল। মনে মনে প্রার্থনা জানাল, তার অভীপ্সা যেন পূর্ণ হয়, পূর্ণ হয়। 

ট্যাক্সি থেকে সযত্নে হিমাংশুবাবুকে নামিয়ে সে উপরের বসবার ঘরে একটা ঈজিচেয়ারে তাঁকে শুইয়ে দিলে। বেয়ারাটার হাতে একটা টাকা দিয়ে বললে, এঁর দিকে লক্ষ্য রাখবে যে পড়ে না যান। 

তারপর এটর্নীর ঘরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলে। 

—কি খবর শ্রীমন্তবাবু? অসময়ে দর্শন?—এটর্নী সহাস্যে জিজ্ঞাসা করলেন।

–একটা জরুরী কাজ ছিল। একটু গোপনীয়।—বলে শ্রীমন্ত রায়বাহাদুরের ম্যানেজারের দিকে চাইলে। 

এটর্নী অফিসে গোপনীয়তার বালাই বড় একটা নেই। সবাই পাশাপাশি বসে নিজের নিজের মামলার কথা বলে। নিরিবিলি আলোচনা করার সময় কোথায়। কেবল সুবিধা এই যে, কে কাকে চেনে! সবাই নিজের নিজের তালে রয়েছে। অন্যের ব্যাপারে উৎসাহের অবসর নেই। 

কিন্তু ম্যানেজারের কাজ শেষ হয়ে এসেছিল। ফিরে গিয়ে মনিবের কাছে তাঁকে মামলার বিবরণ দাখিল করতে হবে। তিনি এ নিয়ে খুব উৎকণ্ঠিত আছেন। কয়েক লক্ষ টাকার মামলা। এর মধ্যে তিনি টেলিফোনও করেছেন। 

সুতরাং এই সুযোগে ম্যানেজার উঠলেন। নমস্কার জানিয়ে বললেন, আজ আমি উঠি দেবেশবাবু। দরকার হোলে রাত্রে টেলিফোনে আপনাকে একটু তকলিফ দিতে পারি। নয়তো কাল সকালে আপনার বাড়িতে। 

নতুন মক্কেলের আবির্ভাবে দেবেশবাবুও একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন। বললেন, আচ্ছা, আসুন। 

ম্যানেজার চলে যেতেই তিনি শ্রীমন্তর দিকে চেয়ে সম্মিত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, তারপরে? বলুন তো কি ব্যাপার? 

—সেই বাড়ি কেনার ব্যাপারটা। 

—হ্যাঁ, হ্যাঁ। কতদূর এগুলেন? 

—মালিক এসেছেন। এই রাত্রেই বায়নাপত্রটা সেরে ফেলতে হবে। 

—কোথায় তিনি? 

—পাশের ঘরে। একটু অসুস্থ। 

দেবেশবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর কণ্ঠে ঈষৎ বিরক্তির আভাসও জাগলো। বললেন, কী রকম অসুস্থ? হার্ট ট্রাবল নেই তো? দেখবেন, ফ্যাসাদে ফেলবেন না যেন। অসুস্থ অবস্থায় এখনই নিয়ে আসবার কিছু দরকার ছিল না। ছেলে মানুষ, ধৈর্য কম। এসব ব্যাপারে…চলুন, চলুন, দেখিগে তাঁকে। 

গড় গড় করে অনেক কথা বললেন তিনি। অনেক তিরস্কার করলেন। শ্রীমন্ত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। ধৈর্যাভাবের অভিযোগের উত্তরে তার ঠোটের কোণে হয়তো একটু হাসির রেখা বিদ্যুৎস্ফরণের মতো চমক দিয়েই মিলিয়ে গেল, হয়তো তাও না। 

শান্ত কণ্ঠে সে বললে, আজ্ঞে, না স্যার, ঠিক অসুস্থ নয়। একটু ড্রিঙ্ক করেছেন বলেই বোধ হয়। 

—ও ড্রিঙ্ক!-দেবেশবাবু আশ্বস্ত হয়ে বললেন,—আমি ভেবেছিলাম…ঠিক আছে, চলুন, চলুন। 

.

ঈজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন হিমাংশুবাবু। একটু আগেই বিড় বিড় করে বোধহয় কিছু বলছিলেন। তার রেশটা যেন এখনও ঠোটের কোণে লেগে রয়েছে। কিন্তু নেশা তাঁকে এখনও কাবু করতে পারেনি। 

ওদের পায়ের শব্দ পেতেই তিনি চোখ মেলে চাইলেন। দেবেশবাবুর নমস্কারের উত্তরে প্রতি নমস্কার জানালেন। এবং শ্রীমন্তর দিকে চেয়ে একটু অসহিষ্ণুভাবেই বললেন, কত দেরি হে শ্রীমন্ত? 

দেবেশবাবু তিন পুরুষে এটর্নী। মাথার চুলেও পাক ধরেছে। হিমাংশুবাবুর দিকে একবার চেয়েই বুঝে নিলেন, তাঁর আভিজাত্যের আয়ু শেষ হয়ে এসেছে। শ্রীমন্ত উপলক্ষ্য মাত্র। হয়তো শ্রীমন্ত তার লোভার্ত তৎপরতায় সেই পরমায়ু আরও দ্রুত শেষ করে দিলে। হয়তো তৈলহীন প্রদীপ শুধু সলিতার জোরে আরও কিছুদিন জ্বলতো। কিন্তু তারপরে কোনো মাড়োয়ারী কিংবা কালোয়ার, কিংবা যে কোনো লোক এসে দাঁড়ালে তার শুধু নিশ্বাসেই ‘দেবধাম’ ঝুর ঝুর করে পড়ে যেত। 

শ্রীমন্তর আগেই দেবেশবাবু উত্তর দিলেন, কিছু দেরী হবে না স্যার। শুধু দলিলগুলো একবার দেখেই- 

—দলিলগুলো?- হিমাংশুবাবু শ্রীমন্তর দিকে চাইলেন। 

শ্রীমন্ত তাড়াতাড়ি বললে, এই যে, আমার কাছেই রয়েছে। 

দেবেশবাবু বললেন, তাহলে একটু এ ঘরে বিশ্রাম করুন। আমরা পাশের ঘর থেকে এক্ষুনি আসছি। চলুন শ্রীমন্তবাবু। 

শ্রীমন্ত একটু ইতস্তত করলে। বললে, উনি একলা থাকবেন? 

দেবেশবাবুও একটু ভাবলেন। বললেন, বেয়ারাটা রয়েছে। 

বলে তাকে ওঁর দিকে লক্ষ্য রাখবার জন্যে ইঙ্গিত করলেন। 

পাশের ঘরে ঢুকেই দেবেশবাবু শ্রীমন্তর পিঠ চাপড়ে বললেন, আমাকে মাফ করবেন শ্রীমন্তবাবু, আপনার সম্বন্ধে আমার হিসেবে ভুল হয়েছিল। বাহাদুর আছেন! আমি তিন পুরুষে এটর্নী, ওই বুড়োকে নিয়ে আসতে আমারও বুক কাঁপতো। সাবাস্! কিন্তু একটু অসুবিধাও যে আছে শ্রীমন্তবাবু। 

অসুবিধার নামে শ্রীমন্তর মুখ শুকিয়ে গেল। বললে, কি অসুবিধা? 

কুটিল হাস্যে দেবেশবাবু বললেন, যদি ওঁর উত্তরাধিকারীরা পরে কেউ আপত্তি করেন যে মদ খাইয়ে এই বায়না করা হয়েছে তাহলে বায়নাপত্র বাতিলও হয়ে যেতে পারে। 

শ্রীমন্তর ললাটে ভ্রুকুটি দেখা দিল। শঙ্করকে তার ভয় নেই। সে অধঃপাতের পথ খুঁজে পেয়েছে। কিছু টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ করা খুব কঠিন হবে না। ভয় সুবিমলকে। তার পক্ষে বাধা সৃষ্টি করা অসম্ভব নয়। সে ধনীর সন্তান, শিক্ষিত, প্রভাব-প্রতিপত্তিও যথেষ্ট। 

শ্রীমন্তর ললাটে ভ্রকুটি আরও ঘনীভূত হোল। 

সে পারে। কিন্তু করবে না, অথবা করার উৎসাহ বোধ করবে না যদি হৈমন্তী না বাঁচে। কে জানে হৈমন্তী বাঁচবে কি না। কে জানে তার অসুখটাই বা কি। 

দেখতে দেখতে শ্রীমন্তর ছোট ছোট চোখদুটো যেন চিক চিক করে জ্বলতে লাগলো, নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস জোরে বইতে লাগলো। চোয়ালে চোয়াল ঘষে সে মনে মনে বললে, শঙ্কর হোক, হৈমন্তী হোক, সুবিমল হোক, আর বড়বাবু নিজেই হোক, তার ওঠবার পথে যে এসে দাঁড়াবে, সে মরবে। 

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সে সামলে নিলে। মুচকি হেসে বললে, সম্পত্তি করতে গেলে ঝুঁকি তো কিছু নিতেই হবে স্যার। 

—Good!—দেবেশবাবু কুটিল উল্লাসে বললেন,—সেটা যদি বুঝে থাকেন, তাহলে আপনাকে নিয়ে আমার কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না। তথাপি সমস্ত রকম সম্ভাবনা সম্বন্ধে আপনাকে সচেতন রাখা আমার কর্তব্য। দেখি, দলিলগুলো দিন। 

শ্রীমন্ত দলিলগুলো দিলে। 

দলিলগুলোর উপর চোখ বুলোতে বুলোতে দেবেশবাবু বললেন, এগুলোর একটা রসিদ করে দিচ্ছি। কাল বিকেলে বায়না-পত্র তৈরি থাকবে। 

শ্রীমন্ত যেন লাফিয়ে উঠলো : কাল বিকেলে কি মশাই! আজ এখনই বায়নাপত্র সই হয়ে যাবে! 

—অসম্ভব! সে কি করে হবে! 

শ্রীমন্ত দেবেশবাবুর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বললে, সেই অসম্ভবই সম্ভব করতে হবে দেবেশবাবু, যত রাত্রিই হোক। কাল বিকেলকে আমি বিশ্বাস করতে পারি না। তার মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ‘দেবধাম’ আমার চাই। এ সম্বন্ধে কোনো অনিশ্চয়তার ঝুঁকি নিতে আমি রাজি নই। 

দেবেশবাবু স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে দেখলেন, যুদ্ধের ঘোড়ার মতো শ্রীমন্তর নাসারন্ধ্র স্ফীত হয়ে উঠেছে। ওর চোখ ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় চক্‌চক্ করছে। 

দেবেশবাবু হাসলেন। বললেন, শ্রীমন্তবাবু, বিশ বছর এটর্নীগিরির পরে আজ প্রথম একজন লোক পেলাম, যাকে না বলা যায় না। দেখি কি করা যায়। ইতিমধ্যে আপনি একটা কাজ করুন। 

—কি বলুন। 

—জানা উকিল আছে? 

—আছে। 

—এখন আনতে পারবেন? 

–পারতে পারি। 

—তাহলে তাঁকে নিয়ে আসুন। হিমাংশুবাবুর উকিল হিসেবে তাঁকেও এই বায়নাপত্রে সই করতে হবে। 

—তাতে কি হবে? 

—এই হবে যে, কাল হিমাংশুবাবু যদি বলেন যে, তাঁকে মদ খাইয়ে বায়নাপত্রে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে, তাহলে হিমাংশুবাবুর উকিল হিসেবে তিনি বলতে পারবেন যে, না, তা নয়। 

শ্রীমন্তর চোখ আবার চকচক করে উঠলো,—এবারে খুশিতে। 

বললে, তাহলে আমি আর দেরি করব না। 

—না, দেরি করবেন না। কিন্তু এই ব্ল্যাক-আউটের রাত্রে যাবেন কি করে বলুন তো?

—আমার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি যত শীঘ্র পারি ফিরে আসব। ইতিমধ্যে হিমাংশুবাবুর দিকে কিন্তু লক্ষ্য রাখবেন। 

শ্রীমন্ত বেরিয়ে গেল। 

.

‘স্টেনো’কে ডেকে দেবেশবাবু বলে যেতে লাগলেন আর সে লিখে যেতে লাগলো। শেষ হতেই বললেন, ওটা একখানা স্ট্যাম্প কাগজে তখনই টাইপ করে দিতে। তারপরে তিনি গেলেন পাশের ঘরে হিমাংশুবাবুর সঙ্গে গল্প করতে। 

তিনি তখন পিছনে দুই হাত সম্বদ্ধ করে ঘরের মধ্যে চঞ্চলভাবে পদচারণা করছিলেন। দেবেশবাবুর পদশব্দে চমকে মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন, কে আপনি? 

—আমি এটর্নী। 

—শ্রীমন্ত কোথায়? 

—তিনি একটু বেরিয়েছেন! এখনই ফিরবেন। 

—এত দেরি করছে কেন? আমাকে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। হিমাংশুবাবুর কণ্ঠে বিরক্তির সুর। 

দেবেশবাবু আশ্বাস দিলেন, না দেরি হবে না। তিনি এখনই এসে পড়বেন। আপনার পক্ষ থেকে একজন উকিল দরকার। তিনি উকিল আনতে গেছেন। তাঁরা এসে পড়লেই দলিলে সই হবে। দলিল প্রায় তৈরি। 

হিমাংশুবাবু এতক্ষণ যেন অন্য লোকে ছিলেন। দলিলের কথায় তাঁর মুখের চেহারা বদলে গেল। প্রায় প্রকৃতিস্থভাবে বললেন, হ্যাঁ। বাড়ির দলিল। দেখুন, বাড়িটা আমাকে বেচতেই হবে। এ বিষয়ে আমি মনঃস্থির করেছি। 

তারপর লজ্জিত হাস্যে বললেন, এই কথাটাই আমি এতক্ষণ ধরে ভাববার প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না, কি জন্যে এখানে এসেছি। কিছু মনে করবেন না। 

দেবেশবাবুর মনে করার কিছু ছিল না। বললেন, কিছুই মনে করিনি। আপনি ব্যস্ত হবেন না। 

কিন্তু হিমাংশুবাবু সত্যসত্যই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, ব্যস্ত হব না? বলেন কি! জানেন, শ্রীমন্ত আমার ছেলের মতো? আমারই বাড়িতে থেকে সে লেখাপড়া শিখেছে। আমার স্ত্রী ওকে যা স্নেহ করেন, ওর নিজের মাও তার চেয়ে বেশি করতে পারতেন না। জানেন এ সব? তা ওকে মানুষ করা সার্থক হয়েছে। শ্ৰীমন্ত সত্যিই শ্রীমন্ত। যথেষ্ট পয়সা করেছে। 

বলে গর্বিত হাস্যে দেবেশবাবুর দিকে চাইলেন। 

দেবেশবাবু এতখানি বিস্ময়ের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি অবাক হয়ে শ্রীমন্তর আশ্রিত-জীবনের কাহিনী শুনে যেতে লাগলেন। সায় দেবার মতো স্বরও তাঁর গলা থেকে বার হচ্ছিল না। 

ইতিমধ্যে চার গুণ ফি দেবার প্রতিশ্রুতিতে শ্রীমন্ত কোথা থেকে একজন উকিল নিয়ে এসে উপস্থিত হোল। ছিন্ন মলিন বেশধারী শীর্ণদেহ একটি উকিল। 

এই অল্প সময়েই হিমাংশুবাবুর কাছ থেকে শ্রীমন্তর যেটুকু পরিচয় দেবেশবাবু পেয়েছেন, তাতে নিঃসংশয়ে তিনি বুঝেছেন, এই লোকটির অসাধ্য কিছুই নেই। সুতরাং তাঁর সন্দেহ হোল, আগন্তুক ভদ্রলোক সত্যই উকিল কি না। এবং শ্রীমন্তকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হোল সেকথা। 

শ্রীমন্ত হেসে বললে, সে কি কথা! বাজে উকিল নিয়ে এসে নিজের স্বার্থের হানি করব এই কি আপনি বিশ্বাস করেন? 

—না তা করি না। কিন্তু আপাত- প্রয়োজনে অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোকও অনেক সময় বেকুবি করে বসেন। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম। যাই হোক, রাত্রি হয়ে যাচ্ছে। কাজটা সেরে নেওয়া যাক। 

বায়নাপত্র টাইপ হয়ে গিয়েছে। 

সেটা হিমাংশুবাবুর সামনে ফেলে দিয়ে দেবেশবাবু একটা জায়গায় আঙুল দিয়ে বললেন, এইখানটায় সই করুন। ইনি আপনার উকিল, আপনার পরে ইনিও সই করবেন। 

অকস্মাৎ হিমাংশুবাবুর সমস্ত মুখভাব যেন বদলে গেল। তিনি যেন দেবেশবাবুর কথার একটা বর্ণও বুঝতে পারলেন না, এমনি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। 

দেবেশবাবু কলমটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন, সই করুন। 

হিমাংশুবাবু দৃঢ়ভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, না। 

এবং নিশ্চিন্তভাবে চেয়ারে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। 

সকলে অবাক।

দেবেশবাবু বললেন, এই এক্ষুনি যে আপনি বাড়ি বেচবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। হঠাৎ আবার কি হোল? 

কে জানে কি হোল। মদের প্রভাবে মস্তিষ্ক যে কখন কি ভাবে কাজ করে তার হিসাব রাখা কঠিন। কি যে হোল, হিমাংশুবাবুও তা হয়তো জানেন না। 

বললেন, কিছুই হয়নি, সব ঠিক আছে। কেবল সই আজ হবে না, কাল হবে।

শ্রীমন্তর চোখ আবার সাপের মতো জ্বলছে। মনে হোল, সে হয়তো এখনই বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে বৃদ্ধের জীর্ণ দেহটাকে পাকে পাকে জড়িয়ে মড় মড় করে ভেঙে ফেলবে। 

দেবেশবাবু শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, কাল কেন? আপনার ছেলের সঙ্গে একবার পরামর্শ করবেন? 

—ছেলে!—হিমাংশুবাবু গুলি-খাওয়া বাঘের মতো গর্জন করে উঠলেন—আমার ছেলেকে জানেন আপনি? একটা জোচ্চোর, লোফার, বদমাইস! তাকে জিগ্যেস করব আমি! কি বলেন আপনি! তার জন্যেই আমি এত তাড়াতাড়ি বাড়ি বিক্রির জন্যে ব্যস্ত হয়েছি। 

—তাহলে আর অনর্থক দেরি করছেন কেন? 

—না। আর দেরি করব না। দিন, সই করি। 

খস খস করে নামটা সই করেই হিমাংশুবাবু পাগলের মতো হঠাৎ অট্টহাস্য করে উঠে দাঁড়ালেন। শ্রীমন্ত আস্তে আস্তে তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে দিলে। 

দেবেশবাবু বায়নাপত্রটা উকিলের সামনে দিলেন। 

তিনি এতক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ব্যাপারটা নিরীক্ষণ করছিলেন। বললেন, আমি তো এখনও ইনস্ট্রাকশন পাইনি স্যার! 

—ইন্‌স্ট্রাকশন! বিস্মিতভাবে দেবেশবাবু শ্রীমন্তর দিকে চাইলেন। 

শ্রীমন্ত পকেটে হাত দিয়ে কয়েকখানা নোট বার করতেই উকিল গম্ভীরভাবে বললেন, একশো টাকার কমে সই করব না। 

শ্রীমন্ত তৎক্ষণাৎ একশো টাকার একখানা নোট উকিলের হাতে দিতেই তিনি বললেন, ট্যাক্সি ভাড়াটা? 

নিঃশব্দে শ্রীমন্ত আরও একখানা দশ টাকার নোট তাঁর হাতে গুঁজে দিতেই তিনি প্রসন্নবদনে সই করে দিলেন। 

শ্রীমন্ত আরও কতকগুলো নোট এটর্নীর হাতে দিয়ে বললে, পাঁচ হাজার আছে।

এটর্নী নোটগুলো হিমাংশুবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, পাঁচ হাজার আছে, গুণে নিন।

হিমাংশুবাবু আবার অট্টহাস্য করে উঠলেন : শ্রীমন্তর দেওয়া নোট গুনে নোব! নেশা কি বেশি হয়েছে নাকি! বলিনি শ্রীমন্ত আমার বড় ছেলে? 

খুশির আমেজ শ্রীমন্তর শিরায় শিরায় কেবল রিন রিন করে উঠছিল। হঠাৎ সে ঘামতে আরম্ভ করলে। 

দেবেশবাবু নমস্কার করে বললেন, এবারে ওঠা যাক তাহলে। আপনাদের ট্যাক্সিটা ছেড়ে দেননি তো? 

উকিলবাবু বললেন, আপনাদের ট্যাক্সিতেই আমাকে তাহলে বাড়ি পৌঁছে দেবেন স্যার।

শ্রীমন্ত বললে, আমাকে একটু জল দিতে বলবেন? 

জল আসতেই এক গ্লাস ঢক ঢক করে নিঃশেষে পান করে শ্রীমন্ত গ্লাসটা ঠক করে টেবিলে নামিয়ে দিলে। একটুক্ষণ কি যেন ভাবলে। তারপর হিমাংশুবাবু ও উকিলের দিকে চেয়ে বললে, চলুন তাহলে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *