পঁচিশ
বায়না পত্র সম্পাদন করে হিমাংশুবাবুকে নিয়ে শ্রীমন্ত যখন ফিরলো তখন রাত্রি এগারোটার কাছাকাছি।
‘দেবধাম’ নিঃঝুম।
ট্যাক্সি থেকে নেমে শ্রীমন্ত দাঁড়ালো : ‘দেবধাম’ কি মরে গেল?
এদিকে অন্ধকার, ওদিকের দেওয়ালে শীতের পাণ্ডুর চাঁদের আলো এসে পড়েছে। সে তো আলো নয়, যেন ‘দেবধামের’ মৃতদেহের উপর সাদা চাদর বিছানো রয়েছে।
এই ‘দেবধাম’—বলতে গেলে এই শ্রীমন্তর জননী, তার ধাত্রী। সাড়া দিচ্ছে না কেন? এর সমস্ত আলো কেমন করে নিবলো? কি তবে কিনলো সে? সে কি কতকগুলো ইট-কাঠপাথর? এর আত্মার আলো কই?
শ্রীমন্ত ভিতরে-ভিতরে ব্যাকুল হয়ে উঠলো। তার পা টলছে। কিন্তু তার চেয়েও বেশী টলছে হিমাংশুবাবুর পা। ভদ্রলোক বোধ হয় তাঁর জীবনের শেষ মদ্যপান সেরে নিলেন।
তাঁকে নিয়ে শ্রীমন্ত খুব মুশকিল বোধ করলে।
রঘুয়াকে ডাকা যায়, কিন্তু শ্রীমন্তর কণ্ঠ যেন বসে গেছে। এ-বাড়িতে যেন চীৎকার করা চলে না।
অন্য সময় বাবুর ফেরার সাড়া পেলে রঘুয়া নিজেই ছুটে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু আজকে সে যেন যাদুমন্ত্রে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে আসছে না।
শ্রীমন্ত নিজেই টলছে। তবু এক মাতাল আর এক বৃদ্ধ মাতালকে ধরে ধরে নিয়ে চললো। বারান্দা, বারান্দা পেরিয়ে একটা ঘর, তার পরে দোতলায় ওঠবার একটি সিঁড়ি, সেখান থেকে আবার বারান্দা ঘুরে-ঘুরে তবে সেই ছোট ঘর, যেখানে বড়বাবু মদ্যপান করেন।
এই পথটা আসতে, শ্রীমন্তর মনে হোল, যেন অনন্তকাল লাগলো। পথেরও শেষ নেই, সময়েরও না।
কী ভয়ঙ্কর আজকের রাত্রি!
মরা ছাগলের চোখের মতো নিষ্প্রভ ওই মহাকাশ, অনন্তকালের সূক্ষ্ম সুতোয় ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলের মালা গেঁথে গলায় পরেছে। পায়ের তলায় মৃত অজগরের মতো পড়ে রয়েছে নির্জীব মহাপথ, যেখানে পা বাড়াতেও ঘেন্না করে!
কী হোল এই পৃথিবীর? এর কি অন্তিম ঘনিয়ে আসছে?
ঘরের মধ্যে তখনও মদের বোতল, ডিকান্টার এবং এঁটো প্লেট ছড়ানো। ফরাসের উপর বসবার জায়গা নেই। ওরা ঘর থেকে গেছে অনেকক্ষণ। এর মধ্যে রঘুয়া এসে যে ঘর পরিষ্কার করে যায়নি কেন কে জানে!
নেশার ঘোরে আলো জ্বালবার কথা শ্রীমন্তর মনেই পড়লো না। সে একটা কোণে হিমাংশুবাবুকে দাঁড় করিয়ে সেই স্বল্পালোকে নিজেই ঘর পরিষ্কার করতে লেগে গেল। তারও সর্ব শরীর নেশায় টলছে। চোখে যেন ভালো দেখতে পাচ্ছে না। অনেক কষ্টে বোতল-ডিকান্টার-প্লেটগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখলে। হাত দিয়ে জাজিমখানা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করলে। এবং সেইখানে হিমাংশুবাবুকে শুইয়ে দিলে।
মদ্যের প্রভাবে হিমাংশুবাবু যেন তুরীয় লোকে পৌঁছে গেছেন। তাঁর সাড়াও নেই, শব্দও নেই। মাঝে-মাঝে শ্রীমন্তর দিকে জবাফুলের মতো লাল লাল চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে চাইছেন, আবার চোখ নামিয়ে নিচ্ছেন। মাঝে মাঝে কি যেন তাঁর বলবার ইচ্ছা হচ্ছে, কিন্তু বলতে পারছেন না। গলার কাছটা একবার থরথর করে নড়ে উঠছে, তার পর চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল ঝরছে।
শ্রীমন্ত ওঁকে শুইয়ে দিতেই একবার ছটফট করে হিমাংশুবাবু চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর নাক ডাকা আরম্ভ করলো!
এইবারে শ্রীমন্ত যেন ঝাড়া হাত-পা হোল। তার যেন একটা বোঝা নেমে গেল। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে সে নিশ্চিতভাবে চারিদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে।
এবার তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। এবং আরও যেন কি একটা ব্যাপার আছে তার ঠিক মনে পড়ছে না। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দুই হাতে বুক চেপে ধরে সেই ব্যাপারটা সে স্মরণ করবার চেষ্টা করতে লাগলো।
এমন সময় জুতোর শব্দ করে কতকগুলো লোক তার ঘরের পাশ দিয়ে নিচে নেমে চলে গেল।
কে ওরা?
শ্রীমন্ত কান পেতে শুনলে ওদের পায়ের শব্দ নিচে মিলিয়ে গেল। মোটরের স্টার্ট দেওয়ার শব্দ হোল। সঙ্গে সঙ্গে মোটরখানা শব্দ করে বাইরে চলে গেল।
ওর সবই কেমন যেন অদ্ভুত বোধ হচ্ছে। এ কি ভৌতিক বাড়িতে সে এসে পড়লো!…
ওই আবার যেন কারা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে না? শ্রীমন্তর ভারি কৌতূহল হচ্ছে, বাইরে গিয়ে দেখে আসে ওরা কারা। কিন্তু সে সামর্থ্য নেই। ওর দুটো পা-ই কে যেন মেঝের সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে।
হঠাৎ ঘরের আলোটা জ্বলে উঠলো।
শ্রীমন্ত নিঃশব্দে চেয়ে দেখলে, রঘুয়া। উপরে আসতে আসতে রঘুয়ার কি মনে হয়েছে, আলোটা জ্বেলে একবার দেখলে।
—কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা? কখন এলেন?
উত্তরে জড়িত কণ্ঠে শ্রীমন্ত কি বললে, বোঝা গেল না।
রঘুয়া ছুটে গিয়ে কোথা থেকে একটা বিছানা নিয়ে এলো। নিপুণ ক্ষিপ্রহস্তে সেটা এক পাশে পেতে বড়বাবুকে সেইখানে ভালো করে শুইয়ে দিলে।
অঘোরে ঘুমোচ্ছেন ভদ্রলোক। এত কাণ্ডেও তাঁর ঘুম ভাঙলো না।
রঘুয়া শ্রীমন্তর দিকে চেয়ে বললে, ছোটদিদিমণির অসুখ খুব কঠিন দাদাবাবু। ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিলেন, কত কি করলেন, কিন্তু এখনও জ্ঞান হোল না। সেই অবস্থায় পেট চিরে ছেলে প্রসব করানো হোল-মরা ছেলে। কি হবে বাবু, বাঁচবেন তো?
রঘুয়া হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো।
বললে, এমন মেয়ে আর হয় না। যেন লক্ষ্মীপ্রিতিমে। যেদিন থেকে এ-বাড়ি ছাড়লেন, সেইদিন থেকেই এ বাড়ির মালক্ষ্মীও যেন ছেড়ে গেলেন। এমন গুণের মেয়ে আর হয় না। কখনও কাউকে একটা কড়া কথা বলেনি। চাকর-বাকরের উপর দয়া কত?
কাপড়ের খুঁটে রঘুয়া চোখ মুছলো।
বললে, যাবেন উপরে বাবু?
শ্রীমন্ত ঘাড় নেড়ে বললে, না।
—চলুন না বাবু। সবাই রয়েছেন। বাগবাজার থেকে জামাইবাবু বড়দিমণি, তাঁর শাশুড়ি সবাই এসেছেন। বৌদিও রয়েছেন। আহা! ছোটদিমণিকে একবার যে দেখেছে, সেই ভালোবেসেছে। বৌদির সঙ্গে ক’দিনেরই বা পরিচয়। কিন্তু বিকেল বেলায় সেই যে তাঁর কাছে বসেছেন, কেউ নড়াতে পারলে না।
বৌদিদি?
সুমিত্রা যে এ-বাড়ি এসেছে সেইটেই শ্রীমন্ত এতক্ষণ স্মরণ করতে পারছিল না।
বললে, আমি যাব না রঘুয়া। দেখছ তো আমার অবস্থা! এই অবস্থায় কোথাও যাওয়া যায় না। তোমার বৌদিদিকে তুমি এইখানে একবার ডেকে দেবে? তাড়াতাড়ি।
—যাই।
বলে রঘুয়া দ্রুতপদে চলে গেল।
শ্রীমন্ত আর দাঁড়াতে পারছে না। সাবধানে সেইখানে সে বসে পড়লো। পকেটের ফ্লাস্কে এখনও একটু মদ বোধ করি আছে। বাঁদিকের পকেট থেকে ফ্লাস্কটা সে বের করলে।
.
সুমিত্রা ঝড়ের মতো ছুটতে ছুটতে এল :
এইখানে বসে রয়েছ তুমি! আর উপরে কি কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে খবর রাখ না? ছোটদি যে যায়!
নির্বিকারভাবে শ্রীমন্ত বললে, তা আমি কি করব? তার সময় ফুরিয়েছে, সে যাচ্ছে। আমাদের যখন সময় ফুরোবে, আমরাও যাব।
ওর নির্বিকার কথা শুনে সুমিত্রার বিস্ময়ের আর সীমা রইল না। বললে, এই কথা তুমি বলছ? ছোটদির সম্বন্ধে!
—এই কথা সবাই বলবে সুমিত্রা। কেউ দু’দিন আগে যায়, কেউ দু’দিন পরে। ঠিক কি না বলো?
এতক্ষণে সুমিত্রার দৃষ্টি পড়লো অর্ধশূন্য ফ্লাস্কটার দিকে। বিস্ময়ে, ক্রোধে, ঘৃণায় তার বাক্যস্ফূর্তি হোল না। কাঠের মতো শক্ত হয়ে সেইখানে দাঁড়িয়ে রইল।
শ্রীমন্ত নিশ্চিন্তভাবে টেনে টেনে বলতে লাগলো : দুঃখ করবার কিছু নেই সুমিত্ৰা। ভাগ্য যার ভালো, সেই আগে যেতে পারে। হৈমন্তী চললো, আর ওই দেখ হৈমন্তীর বুড়ো বাবা মদ খেয়ে অঘোরে ঘুমুচ্ছেন! উনি যেতে পারলেন না। এই দুনিয়া! এতে দুঃখ করবার কিছু নেই।
ফ্লাস্কের সেই তীব্র সুরা বিনা জলে শ্রীমন্ত গড় গড় করে গলায় ঢেলে দিলে।
সুমিত্রা চিৎকার করে উঠলো : অমনি করে মদ খাচ্ছ তুমি?
বিষাক্ত সরীসৃপের মতো ছোট ছোট লাল চোখ মেলে শ্ৰীমন্ত সুমিত্রার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে চাইলে। বললে :
—হ্যাঁ। এমনি করেই মদ খাব সুমিত্রা। আগুনের মতো তীব্র নির্জলা মদ। খাব না? তুমি বলো কি সুমিত্রা! যে দেশে দেনার জ্বালায় ‘দেবধাম’ বিক্রি হয়ে যায়, আর শ্রীমন্ত মিত্তির ব্ল্যাক-মার্কেটে লাখ-লাখ টাকা করে, আর সোনার মেয়ে হৈমন্তী মরে অকালে, সেদেশে মানুষ মদ খাবে না তো খাবে কি?
একটু থেমে অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে শ্রীমন্ত আবার বললে, তুমি ঠিক কথা বলেছ সুমিত্রা। হৈমন্তী এই ‘দেবধামের’ আত্মা। সে যাচ্ছে চলে। তার বুড়ো বাপ মাতাল হয়ে ওই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর আমি এই মরা বাড়ি তিন লাখ টাকা দিয়ে কিনলাম! এর পরেও মদ খাব না? কিন্তু আর নয়, এইবার বাড়ি চলো।
বলে এঁটো প্লেট আর হাড়ের টুকরো আর খালি ডিকান্টারের পাশে সেই ঝোলের দাগ ধরা জাজিমের উপর শ্রীমন্ত নিশ্চিন্তভাবে শুয়ে পড়লো।