চৌদ্দ
সন্ধ্যার পরে শ্রীমন্তর বাড়িতে এসে সুমিত্রা শুনলে, বাবু সেই যে সকালে বেরিয়ে গেছেন এখনও ফেরেন নি।
এতে অবাক হবার কিছু নেই। শ্রীমন্তর সঙ্গে তার যতদিনের চেনা, তাকে সে এইরকমই দেখছে। সে যে কি করে, আর কি না করে সুমিত্রা আজও তার হদিস পেলে না কিন্তু কিছুদিন থেকে এইটে সে নিঃসংশয়ে বুঝেছে, শ্রীমন্ত প্রচুর রোজগার করছে। আমীরের মতো দরাজ হাতে সে খরচ করে এবং টাকাও বোধকরি ভালোই জমিয়েছে। এত টাকা সে কি করে কোথা থেকে পাচ্ছে, তা সে জানে না। কিন্তু সদুপায়ে যে নয়—তা বুঝতে পারে এবং যথাসম্ভব তাকে দোহনও করে।
সুমিত্রাও বেরিয়েছিল দুপুর বেলায়। হেনরির সঙ্গে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে লাঞ্চ সেরে ওরই সঙ্গে গিয়েছিল মেট্রোয় সিনেমা দেখতে।
ছ’টায় সেখান থেকে বেরিয়ে ক্যাসানোভায় চা খেয়েছে সাতটা পর্যন্ত।
সেখান থেকে হেনরি চলে গেছে ডিউটিতে, আর ও এসেছে শ্রীমন্তর খবর নিতে। কিন্তু শ্রীমন্ত সেই যে সকালে বেরিয়েছে এখনও ফেরেনি। হয়তো ফিরবে এখনই। সুমিত্ৰা একটু অপেক্ষা করতে পারে। হাতে এখন কোনই কাজ নেই।
রাস্তার দিকের বারান্দায় একখানা বেতের চেয়ার টেনে ও বসলো।
কালা চাকরটা এসে জিজ্ঞাসা করে গেল, চা দিয়ে যাবে কি না। তাকে ‘না’ বলে দিয়ে সুমিত্রা একটা সিগারেট ধরালে। হেনরির সঙ্গে ঘোরবার সময় মাঝে মাঝে এক- আধটা সিগারেট আজকাল সে খাচ্ছে। কিন্তু গোপনে।
সিগারেটের ধোঁয়ার আড়ালেও শ্রীমন্তর কথা ভাবতে লাগল।
অনেক ছেলে সে দেখেছে, কিন্তু এমন আশ্চর্য ছেলে এর আগে কখনও তার চোখে পড়েনি। ওর দেহে যেমন শক্তি, মনেও তেমনি মত্ততা। কিন্তু সে মত্ততা নির্বিকার,—সমুদ্রের তরঙ্গের মতো যেন চলেছে। ওর ছোট দুই চোখের ফাঁক দিয়ে
যেন দুখানা ভোজালির প্রান্ত চকচক করছে। ওর সঙ্গেরও একটা আকর্ষণ আছে। কিন্তু সেই আকর্ষণের উৎস কোথায় বোঝা যায় না। ওর কথা ভাবতে সুমিত্রার অবাক লাগে!
হেনরির একটা শক্তি আছে। হাউই-এর মতো সুমিত্রাকে সে প্রচণ্ডবেগে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে নিজে ফুরিয়ে যায়। মৃৎপিণ্ডের মতো সুমিত্রা তখন মাটিতে এসে পড়ে।
আর শ্রীমন্ত যেন লোনা জলে দুরবগাহ সমুদ্র। সে জল খাওয়া যায় না। সেখানে নামতেও ভয় করে। কিন্তু একবার যে নেমেছে সে ভয়ঙ্কর খেলার নেশায় মেতে উঠবে।
তেমনি নেশা লেগেছে সুমিত্রার এই আশ্চর্য ভয়ঙ্কর মানুষটির উপর।
হঠাৎ সিঁড়িতে শ্রীমন্তর পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। সুমিত্রা তাড়াতাড়ি হাতের সিগারেটটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নির্বিকার বসে রইলো বাইরের আকাশের দিকে চেয়ে।
শ্রীমন্ত ওর দিকে চেয়েই অট্টহাস্য করে উঠলো :
—সুমিত্রা যে! কতক্ষণ?
—এই আধ ঘণ্টাটাক। কোথায় বেরিয়েছিলে, সেই সকাল থেকে?
ওর পাশে একখানা চেয়ার টেনে বসে শ্রীমন্ত বললে, বহু জায়গায়। সর্বশেষ তোমার বাড়ী।
—আমার বাড়ী?
—হ্যাঁ সখি! গিয়ে শুনলাম, দুপুরেই তুমি বেরিয়েছ, কোথায় নাকি লাঞ্চের নেমন্তন্ন আছে।
ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করলে, কার নিমন্ত্রণ সখি! হেনরির?
ওর মুখ দিয়ে ভক ভক করে উগ্র মদের গন্ধ বেরুচ্ছে!
হেনরিকে নিয়ে এই শ্রেণীর রসিকতা শ্রীমন্ত কখনও করেনি।
সুমিত্রা লাফিয়ে চীৎকার করে উঠলো :
—তুমি মদ খেয়েছ?
সে চীৎকারে শ্রীমন্ত চমকে চেয়ার নিয়ে পিছিয়ে এল। তারপর ধীরে ধীরে জড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো :
—মদ? হ্যাঁ খেয়েছি। বেশি নয় একটুখানি। আমার বুক পুড়ে যাচ্ছে সুমিত্রা। আজকে তুমি তিরস্কার কোরো না। চুপ করে একটুখানি আমার কাছে বোসো। হ্যাঁ, that’s like a good girl!
সুমিত্রা বসলো, কিন্তু কাছে নয়, একটুখানি দূরে। ওর বিস্ময় লাগছিল, সেই সঙ্গে আমোদও। ওকে এমন দুর্বল, এমন অসতর্ক এবং অসহায় আর কখনও সে দেখেনি। আটলান্টিক সমুদ্রে কে যেন এক রাশ তেল ঢেলে দিয়েছে। আর সমস্ত তরঙ্গ গেছে থেমে। সমুদ্র যেন বীর্যহীন, নিস্তরঙ্গ পুকুরে পরিণত হয়েছে!
শ্রীমন্ত বললে, কখনও কাউকে ভালোবেসেছ সুমিত্রা?
অন্য সময় শ্রীমন্তর মুখ থেকে এই কথা শুনলে ও অপমানিত বোধ করতো, রেগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতো। কিন্তু শ্রীমন্তর অবস্থা দেখে এ প্রশ্নে ও রাগলে না, বরং হেসেই ফেললে। বললে, কি জানি?
—ঠিক। জানো না। আমিও জানতাম না। দুপুর রাত্রে বিশহাজার টাকার গয়না গায়ে দিয়ে হৈমন্তী আমাকে সেধেছে। কিন্তু টলাতে পারেনি। সেই মেয়ে আজ আমার সঙ্গে দেখা করলে না, এই কথাটা ভাবছি আর আমার বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। কেন বলো দেখি? আমি কি তাকে ভালোবেসেছিলাম!
—তুমি কাউকে ভালোবাসতে পারো, এ আমার বিশ্বাস হয় না।
—আমারও হয় না। কিন্তু বুক যে জ্বালা করছে সুমিত্রা, এ তো অবিশ্বাস করবার ব্যাপার নয়।
হঠাৎ সুমিত্রার চোখ জ্বালা করে উঠলো। বললে, তোমার বুকে আগুন জ্বালাতে পারে, এমন মেয়ে আমি কল্পনাও করতে পারিনা। তোমার হৃদয় নেই, এই আমার বিশ্বাস।
—সেই দৃঢ় বিশ্বাস আমারও ছিল সুমিত্রা। আমার বিশ্বাস টলেছে এবং আশঙ্কা হচ্ছে, তোমারও টলবে। অনুমতি করো সুমিত্রা, আর একটুখানি খাই? খুব সামান্য একটুখানি?
শ্রীমন্ত বাঁ পকেট থেকে একটা ফ্লাস্ক বার করলে।
সুমিত্রা যেন ছোঁ মেরে সেটা কেড়ে নিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।
দৃঢ়কণ্ঠে বললে, না।
—একটা ফোঁটা। Please.
সুমিত্রা তেমনি দৃঢ়কণ্ঠে বললে, একটি ফোঁটাও না। ওঠো, শোবে চলো!
এক রকম জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে সুমিত্রা ওকে খাটের উপর শুইয়ে দিলে। বললে, একটু ঘুমোও দেখি।
অত্যন্ত দুষ্ট ছেলের মতো মিটমিট করে হেসে শ্রীমন্ত বললে, না।
ধমক দিয়ে সুমিত্রা বললে, না কেন?
—হয় আমাকে একটি ফোঁটা মদ দাও, Please,—নয়, তুমি বলো আজ রাত্রে এখানে
থেকে যাবে। আমার বুক পুড়ে যাচ্ছে। মাইরি!
সুমিত্রা হেসে ফেললে। বললে, আচ্ছা থাকব। তুমি ঘুমোও।
—সত্যি? শ্রীমন্ত ধড়মড় করে উঠে বসলো। ও যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
—সত্যি।
সুমিত্রা ওকে খাটের ওপর শুইয়ে একখানা ঈজিচেয়ার ওর খাটের কাছে টেনে নিয়ে এল। টেবিল ল্যাম্পের ঢাকাটা টেনে দিয়ে ওর চোখের দিকটা অন্ধকার করে দিলে। পাখাটা দিলে খুলে। তারপর ওর একখানি হাত বুকের উপর টেনে নিয়ে ঈজিচেয়ারে শুয়ে পড়লো।
বললে, আমি এইখানে রইলাম। দুষ্টুমি না করে লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড় দিকি।
শ্রীমন্তর বোধকরি তন্দ্রা আসছিল। একটু পরেই সে ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু সুমিত্ৰা জেগে রইলো অনেকক্ষণ। ক্ষুধা ছিল না। শুধু একটুখানি কফি খেলে। তারপরে সেই ঈজিচেয়ারে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। এই অসহায় নিদ্রিত মাতাল তার নিদ্রাহীন চোখে যেন পদ্মমধুর অঞ্জন পরিয়ে দিয়েছে। এত সুখের রাত্রি তার জীবনে এর আগে আর আসেনি। সারারাত সে জেগে কাটালে। ভোরের দিকে কখন এক সময় সুমিত্রা ঘুমিয়ে পড়েছিল। পূবের জানালা দিয়ে আলো এসে তার চোখে পড়তে ঘুম ভেঙে গেল। জেগে দেখে খাটে শুয়ে শুয়েই শ্রীমন্ত একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে।
ভোজালির মতো কঠিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনও ওর চোখে জাগেনি। দৃষ্টি এখনও অলস, শ্রান্ত,—ভোর হয়ে আসা আকাশের শুকতারার মতো একটু যেন করুণও।
তাড়াতাড়ি বেশ-বাস সংযত ক’রে সুমিত্রা উঠে দাঁড়ালো। অপাঙ্গে ওর দিকে চেয়ে একটু হেসে বাথরুমে চলে গেল।
ফিরে এসে দেখে শ্রীমন্ত তখনও অলসভাবে চোখ বুজে শুয়ে।
ওর পায়ের শব্দে চোখ মেলে শ্রীমন্ত বললে, নিচে চাকরটার ঘোরাফেরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে যেন। ওকে একটু গরম জলে লেবুর রস দিয়ে নিয়ে আসতে বলবে সুমিত্রা? না হলে বোধ হয় উঠতে পারবো না। সেই সঙ্গে চা’ও।
শ্রীমন্ত ম্লান ভাবে হাসলে।
সুমিত্রা চাকরকে গরম লেবুজল আর চায়ের জন্যে বলে এসে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিক করে নিলে।
শ্রীমন্ত বললে, কাল রাত্রে তোমাকে আটকানো আমার ঠিক হয়নি সুমিত্রা। ভয় হচ্ছে, তোমার বাবা-মা হয়তো রাগ করবেন।
সহজ কণ্ঠে সুমিত্রা বললে, রাগ করবেন কেন? নিজের ভালো মন্দ বোঝবার বয়স আমার হয়েছে। তাঁরা এতে কিছু মনে করবেন না।
কালা চাকর লেবু, গরম জল, চা দুধ চিনি রেখে গেল। সুমিত্রা চা এবং লেবুজল তৈরি করতে বসলো।
শ্রীমন্তকে জিজ্ঞাসা করলে, তুমি কি এখানে আসবে, না তোমার বিছানার কাছে দিয়ে আসব?
হেসে শ্রীমন্ত বললে, চায়ের গন্ধে শরীরে একটু একটু করে যেন শক্তি ফিরে আসছে। উঠতে পারব মনে হচ্ছে।
চায়ের টেবিলে বসে বললে, তোমার মুখে ভোরের আলো এসে পড়েছে সুমিত্রা। সোনালি আলো। শরতের আর বোধ হয় দেরি নেই বেশি।
সুমিত্রা জবাব দিলে না। মুখ নিচু ক’রে হাসতে হাসতে চা তৈরী করতে লাগলো। এক পেয়ালা চা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, দেখো তো, চিনি আর লাগবে কিনা।
চুমুক দেবার আগেই শ্রীমন্ত বললে, বোধ হয় না। তোমার হাত এমনিতেই যথেষ্ট মিষ্টি।
সুমিত্রা হেসে ফেললে। বললে, তোমার কি হয়েছে বলো তো!
—কী জানি! মুখ দিয়ে ক্রমাগত ভালো ভালো কথা বেরুচ্ছে। এমন তো বড় একটা
হয় না! আমার বিশ্বাস, এ একটা ব্যাধি। আশা করছি, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেটে যাবে।
—Amen. তোমার বুকের সেই যন্ত্রণাটা আর নেই তো?
কাল রাত্রের সব কথা শ্রীমন্তর পরিষ্কার মনে পড়ছে না। সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে, কিসের যন্ত্রণা?
চায়ের পেয়ালার আড়ালে ঈষৎ হেসে সুমিত্রা বললে, সে আমি কি জানি? তুমিই বলছিলে তাই জিগ্যেস করলাম।
শ্রীমন্ত সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইলে।
সুমিত্রা জিজ্ঞাসা করলে, হৈমন্তী কে?
—তার নাম তুমি কোথায় শুনলে?
—শ্রীমন্ত প্রায় চীৎকার করে উঠলো।
—শুনেছি। তাকে একবার দেখাতে পারো?
—কেন বলোতো?
—বুক-পোড়ানোর মন্তরটা শিখে আসব।—সুমিত্রা টিপে টিপে হাসতে লাগলো।
একটুক্ষণ স্তব্ধভাবে কাকে যেন শ্রীমন্ত ভেবে নিলে। বোধ করি হৈমন্তীকেই।
তারপর বললে, তাতে কাজ নেই সুমিত্রা। ও মন্তরটা ভালো নয়। তার চেয়ে আমি বলি কি,
শ্রীমন্ত থামলে।
সুমিত্রা চায়ের পেয়ালাটা মুখের কাছে তুলেছিল, আবার নামালে। বললে, কী বলো?
—আমি বলি, এসো আমরা বিয়ে করে ফেলি।
সুমিত্রার হাতের পেয়ালাটা প্লেটের উপর ঠক করে একবার কেঁপে উঠলো।
শ্রীমন্ত বলতে লাগলো, এ মাসটা বোধ হয় ভাদ্র মাস। তা হোক, আমাদের বিয়ে হবে তিন আইনে। কি বল?
সুমিত্রা অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইল। কী বলে শ্রীমন্ত? ও কি পরিহাস করছে? ওর কথা ও যেন বুঝতে পারছে না।
শ্রীমন্ত আপন মনেই বলে চলেছে :
—আমার বিশ্বাস, এ ভালোই হবে। আমরা পরস্পরকে চিনি। কারও সম্বন্ধেই কারও কোনো মিথ্যে আশা, কি মিথ্যে বিশ্বাস নেই। আমরা কেউ কারও ওপর জবরদস্তি করব না। ভুল-ভাঙারও কোন প্রশ্ন উঠবে না। বিনা দাবি-দাওয়ায় আমরা ঘর বাঁধবো, যাকে বলে সংসার। ইচ্ছে করলে তুমি চাকরি করতে পারো। ইচ্ছে করলে নাও করতে পারো। যে টাকা আমার জনেছে, সে নিতান্ত সামান্য নয়। কি বলো, আমি কি মন্দ প্রস্তাব করেছি?
শ্রীমন্ত হয়ত আরও কিছু বলতো, কিন্তু সুমিত্রা হঠাৎ সজোরে হেসে উঠলো। হাতের ঘড়িটা ওর নাকের কাছ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়ে বললে, ক’টা বাজছে খেয়াল আছে মশাই? সাড়ে আটটা। দশটায় অফিস না? আমি চললাম।
—ওঃ তাই নাকি! কী সর্বনাশ!
শ্রীমন্ত লাফিয়ে উঠে বাথরুমে চলে গেল।
সমস্ত পর্বটাই যেন একটা অভিনয়!