কালোঘোড়া – ১২

বারো

দুর্ভিক্ষ যে আসন্ন একথা গবর্নমেন্ট ছাড়া আর সবাই বুঝেছিল।

জাপানী সৈন্য বাঙলা ও আসামের সীমান্তে এসে থমকে গেল। মাঝে মাঝে বোমা ফেলে ভয় দেখায়, কিন্তু আসে না। অথচ মালয়-সিঙ্গাপুর-বর্মার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে তার জন্যে গবর্নমেন্টের সতর্কতার আর অন্ত নেই। নৌকো-সাইকেল তো গেছেই, চালও যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

চালের দর হু হু করে বেড়ে চলে। গবর্নমেন্ট ভরসা দেন, ও কিছু নয়, ইনফ্লেশন। মানুষের টাকা সস্তা হয়েছে।

চাল পাওয়া যায় না। গবর্নমেন্ট বললেন, চোরাবাজার! হুমকি দিলেন, তিনদিনের মধ্যে সব চোরাবাজারীকে সায়েস্তা করে দেওয়া যাবে। তাহলেই আর চালের অভাব থাকবে না।

ফাঁকা ভরসায় পেট মানে না। পাড়াগাঁ থেকে ভিক্ষুকের আমদানী হতে লাগলো। একদিন সন্ধ্যার পরে শ্রীমন্ত করজোড়ে বড়বাবুর কাছে এসে দাঁড়ালো।

বড়বাবু হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার?

—দরবার আছে।

—হুকুম হোক!

—আমাদের মহেন্দ্র গেছে সিভিল সাপ্লাই-এ ভালো চাকরি নিয়ে।

—তারপরে?

—তিন জন মক্কেল আছে, কন্ট্রোলের দোকান চায়।

—কি রকম খরচা করবে?

—বলেছে, দোকান পিছু হাজার টাকা।

—আর কিছু উঠবে না?

—উঠতে পারে।

—বখরা কি রকম?

—মহেন্দ্রের আট আনা, আপনার পাঁচ আনা, আমার তিন আনা।

বড়বাবু ভেবে বললেন, বেশ। এখন কি তাকে ফোনে পাওয়া যাবে?

—বোধহয় না। কাল অফিসের সময় মনে পড়িয়ে দোব বরং। কিংবা যদি বলেন, ফেরবার মুখে তার বাড়িতে খবর দিয়ে যেতে পারি। আমি তার বাড়ি চিনি।

খুশি হয়ে বড়বাবু বললেন, ভালো। শুভস্য শীঘ্রম্। বোলো, কাল সকালে আমার বাড়িতে যেন দেখা করে।

মহেন্দ্র বড়বাবুর বিশেষ অনুগত লোক, একথা শ্রীমন্ত বেশ ভালো করেই জানে। অফিস বদলালেও সেই আনুগত্যের জের এখনও মেটেনি তাও সে জানে।

সুতরাং বড়বাবুর আশ্বাস পেয়ে সে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল।

.

চোরাবাজার! চোরাবাজার! চোরাবাজার!

ক্ষুধিত মানুষ চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট টাকা মণ দিয়ে সেখান থেকে চাল কিনে নিয়ে আসে। আশ্চর্য এই যে গবর্নমেন্ট কিছুতেই সে সব জায়গার ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারলে না। পুলিস হেঁসেলের কোণ থেকে রিভলবার বার করে, কলেজের ছেলের পকেট থেকে বার করে অননুমোদিত ইস্তাহার। কিন্তু হাজার হাজার বস্তা চাল কোন্ গুদামে লুকোনো আছে কিছুতেই তার কিনারা করতে পারলে না।

অবশেষে চোরাবাজারের পাশাপাশি চলতে লাগলো কন্ট্রোলের চালের দোকান।

মহেন্দ্রর অনুগ্রহে শ্রীমন্ত এমনি তিনখানা কন্ট্রোলের দোকান বেনামীতে পেয়ে গেল। একখানা গ্রে স্ট্রীটে, একখানা চিত্তরঞ্জন এভিন্যুতে আর একখানা আমহার্স্ট স্ট্রীটে।

চাল যা আসে তার অর্ধেক, কখনো বা বারো আনা চড়াদামে চলে যায় চোরাবাজারে। সেখান থেকে আরও চড়াদামে যায় ক্ষুধিত নাগরিকের রান্নাঘরে। বাকি যা থাকে, তাই কন্ট্রোলের সারবন্দী লোকদের বিক্রী করা হয়। মুষ্টিমেয় জনকয়েক পায়, অবশিষ্ট লোক সমস্ত সকাল প্রত্যাশার পর হতাশ হয়ে ঘরে ফেরে।

শ্রীমন্তের ব্যাঙ্কের অঙ্ক দিন দিন স্ফীত হয়ে ওঠে।

আর সে কী চাল!

মাত্র দুর্ভিক্ষের দিনে বিচারবিহীন জঠরাগ্নিই সেই কদন্ন গ্রহণ করতে পারে! দুটো বৎসর আগে যে-চাল ভিক্ষুক ভিক্ষা নিতেও সম্মত হত না, তাই কিনছে লোকে চতুর্গুণ মূল্য দিয়ে কত ক্লেশ স্বীকার করে; না পেলে তার ক্ষোভের আর সীমা থাকে না! যেন কত পরম-পদাৰ্থ!

ভোরে উঠে শ্রীমন্ত বেরিয়ে যায় দোকান তদারক করতে। দেখে, দুর্গত মানবের সারি তার দোকানের নিচে থেকে অজগর সাপের মতো এঁকে বেঁকে পাশের গলির ভিতর পর্যন্ত চলে গেছে।

একদিকে পুরুষের—অন্যদিকে স্ত্রীলোকের সারি এক মুষ্টি চালের জন্যে ঠেলাঠেলি করছে।

শ্রীমন্ত ওদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে। ভদ্রঘরের লোকও আছে, স্ত্রী এবং পুরুষ উভয় সারিতেই। সেই কোন্ ভোরে এরা ‘কিউ’তে এসে দাঁড়িয়েছে। সকলের আগের দিকে যারা দাঁড়িয়ে তারা রাত থেকেই ওইখানে রয়েছে।

মাঝে মাঝেই গুঁতোগুঁতি চলছে। সামনের দিকের নীচ শ্রেণীর ক’টি স্ত্রীলোক বিশ্রীভাষায় গালাগালি দিচ্ছে। সে কানে শোনা যায় না। সিভিক গার্ডের ছেলেরা তাদের ধমকাচ্ছে। কিন্তু কে কার কথা শোনে!

তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে একটি কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে।

নিঃশব্দে।

তার শীর্ণ দেহ থেকে সমস্ত লাবণ্য এখনও মিলিয়ে যায় নি। পরনে একখানা মোটা শাড়ী। একটু আগে ওদের মাথার ওপর দিয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভিজে কাপড়খানি ওর গায় একেবারে লেপ্টে রয়েছে। মাথায় ঘোমটা বোধ করি ছিল, কিন্তু ঠেলাঠেলি হুড়োহুড়ির মধ্যে কখন যে তা খুলে গেছে, তা সে নিজেও টের পায়নি।

অদূরে একটা চারা গাছের নিচে এগারো-বারো বছরের একটি শীর্ণদেহ স্ফীতোদর বালক ওর দিকে সতৃষ্ণ নয়নে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পা ব্যথা করলে একটু বা বসছে। বোধ করি, মেয়েটার ভাই কিংবা দেবর হবে।

মেয়েটির অনাবৃত কৃশ মুখের দিকে চেয়ে শ্রীমন্তর চোখে সাপের মতো হিংস্র দৃষ্টি লিক-লিক করে উঠলো।

তারপরে আস্তে আস্তে সে আবার অন্য দোকানের দিকে চলে গেল। সর্বত্রই একই দৃশ্য। অস্থিচর্মসার নর ও নারীদেহের যাদুঘর!

.

কি একটা ছুটির দিন ছিল।

বাইরের দিকের খোলা বারান্দায় একখানা বেতের চেয়ার টেনে শ্রীমন্ত বসে বসে এককানা সস্তা ইংরেজি নভেল পড়ছিল।

একটু আগে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। চাকরটা এসে দক্ষিণ দিকের পর্দাটা ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরেও সেটা এখনও তেমনি ফেলাই রয়েছে।

সামনের রাস্তা দিয়ে পর পর দু’খানা গরুর গাড়ী যাচ্ছে। তার পিছন-পিছন লোক চলেছে এক পাল। কৌতূহলী হয়ে শ্রীমন্ত রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালো।

কয়লার গাড়ি?

গাড়ির উপরেই একটা বস্তার উপর কালো গেঞ্জি-পরা কয়লাওয়ালা বসে ছিল। ভিড় দেখে সে ভয় পেয়ে গিয়েছে। কখনও রেগে, কখনও স্তোকবাক্যে সে অনুসরণকারী জনতাকে প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিল।

কিন্তু কে কার কথা শোনে?

—শুনুন বাবুমশাইরা, সারাদিন শরীরের উপর দিয়ে ধকল গেছে। এখন যাব, চান করব, দুটো খাব। কাল সকাল নইলে আর কয়লা বিক্রী করতে পারবো না।

—ওরে বাবা, কাল সকাল! সকালে তোমার দোকানে কয়লার একটা গুঁড়োও থাকবে না। রাত্রেই তুমি ব্লাক-মার্কেটে চালান করে দেবে। তোমাকে চিনি না, বাবা! চলো, যত রাত্রি হয় আমরা বসে থাকব, কয়লা নোব, তারপর বাড়ী যাব। কাল থেকে রান্না বন্ধ আছে।

শ্রীমন্ত মুচকি হেসে সরে এল।

এ তো সামান্য! তার কন্ট্রোলের দোকান তিনটেয় কান্নাকাটি চলছে প্রত্যহ। সেদিন একটা বুড়ি আধসের চালের জন্যে তার দোকানের বারান্দায় এমন করে মাথা কুটলে যে রক্তারক্তি কাণ্ড!

কি করা যাবে? ছ’ হাজার টাকা শুধু প্রণামীই দিতে হয়েছে। সে-টাকা তুলতে হবে না? মমতা করলে এ বাজারে চলে কই?

সুমিত্রা এল।

পরনে জাফরাণী রংয়ের শাড়ী। যেন ওর দেহের ওপর ক্ষান্ত-বর্ষণের ঘনঘটা নেমেছে।

শ্রীমন্ত উল্লসিত হয়ে উঠলো : এসো এসো।

সুমিত্রা শ্রান্তভাবে একটা চেয়ারে বসে প’ড়ে বললে, কিছু চিনি যোগাড় করে দিতে পারো? কাল থেকে গুড় দিয়ে চা হচ্ছে। আমরা কোনো রকমে চালাচ্ছি। কিন্তু বাবা বুড়োমানুষ, তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে।

শ্রীমন্ত হেসে বললে, এমন চমৎকার বর্ষার অপরাহ্ণে তোমায়-আমায় কথা আরম্ভ হবে কি চিনি, চাল, কয়লা দিয়ে?

অপ্রস্তুতভাবে হেসে সুমিত্রা বললে, কী করা যায়? এখন ওই হয়েছে মানুষের জপ-মন্ত্র। আমাদের একজন প্রফেসর, স্থূল বিষয় নিয়ে তাঁকে কোনো দিন কথা বলতে শুনিনি। একটু আগে রাস্তায় তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলেন, চাল পাচ্ছ তো মা?

দু’জনেই হেসে উঠলো।

সুমিত্রা হাসি থামিয়ে বললে, হাসির কথা নয় মন্টি (হেনরির দেখাদেখি ও আজকাল মন্টি বলছে)! এ আমরা কোথায় চলেছি? চাল-চিনি-নুন-কেরোসিন, এসব কোথায় গেল অদৃশ্য হয়ে? কোন্ অতলস্পর্শী গহ্বরে?

শ্রীমন্ত হাসলে। বললে, সেটা জানতে পারলে তো ভাবনা চুকেই যেত!

-–সে কি কোনো দিন জানা যাবে না?

—কোনোদিনের কথা জানি না সুমিত্রা, তবে এখন যে জানা যাবে না, তা বলতে পারি।

—কারণ, তাহলে ব্ল্যাকমার্কেট বন্ধ হয়ে যায়।

দু’জনেই হেসে উঠলো।

সুমিত্রা বললে, দু-একটা চোরাবাজারী ধরা পড়েছে কিন্তু।

শ্রীমন্ত হেসে বললে, হ্যাঁ। যেমন আমার চাকরের মাসী। দেশে ফসল নেই। সে আসছিল কলকাতায় দাসীবৃত্তি করতে। শুনেছে কলকাতায় চাল পাওয়া যাচ্ছে না। নিজের খাবার জন্যে সের দুই চাল আনছিল সঙ্গে করে। শেয়ালদা স্টেশনে ধরা পড়ে গেল।

—বড়রা ধরা পড়ছে না কেন?

শ্রীমন্ত মুচকি হেসে বললে, কি করে জানব?

—লোকেরাই বা ধরিয়ে দিচ্ছে না কেন?

—কি হবে? চোরাবাজারী কিছু টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়া পেয়ে যাবে। মাঝ থেকে, সে যে চাল পাচ্ছিল তা বন্ধ হয়ে যাবে। দুর্নীতি কতদূর প্রবেশ করেছে বুঝতে পারছ? সমাজের একেবারে মেরুদণ্ডে। এর পরে যুদ্ধ একদিন থামবে, ব্ল্যাকমার্কেটও হয়তো বন্ধ হবে। কিন্তু এই যে দুর্নীতির যক্ষ্মা—এ সহজে সারছে না।

একটু থেমে শ্রীমন্ত দাঁতে দাঁত চেপে বললে, এই চোরাবাজারীদের জনে-জনে শূলে দেওয়া উচিত!

ব্ল্যাক-আউটের রাত্রি। সন্ধ্যার পরেই বারান্দায় ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। এখন আবার নতুন করে বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। ছাঁট আসছে বারান্দায়। সুমিত্রার হাত ধরে শ্রীমন্ত ঘরের মধ্যে নিয়ে এল।

তারপরে কচি কলাপাতা রঙের একখানি মূল্যবান বেনারসী শাড়ী ওর হাতে তুলে দিলে।

বললে, ভেবেছিলাম, এই দিয়ে আজ আমাদের আলোচনা আরম্ভ হবে। কিন্তু তুমি নুন-তেল-লকড়ির কথায় সব মাটি করে দিলে।

খুশিতে সুমিত্রার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো : এ কাণ্ড কখন করলে?

—আজ সকালে।

কিছু চাল ব্ল্যাকমার্কেট করে আজ সকালেই শ্রীমন্ত হাজারখানেক টাকা পেয়েছিল। তাই থেকে পাঁচশো টাকা দিয়ে সুমিত্রার জন্যে এই শাড়ীখানা সে কিনেছে।

জিজ্ঞাসা করলে, পছন্দ হয়েছে?

উত্তরে সুমিত্রা একেবারে ওর বুকের কাছে সরে এলো। হাসিভরা মুখ ওর দিকে তুলে বললে, How nice of you!

একটা দমকা হাওয়া হুড়-মুড় করে ঘরে ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড শব্দে বজ্রপাত হল।

সুমিত্রা সভয়ে বললে, সর্বনাশ আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু।

শ্রীমন্ত হেসে বললে, বৃষ্টিটা থামুক!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *