৪. হাসপাতালের একটা বিছানায়

জ্ঞান ফিরতে তার অনেকটা সময় লেগেছিল। চোখ খুলতেই সে দেখল হাসপাতালের একটা বিছানায় শুয়ে আছে। বাইরে ঘন অন্ধকার। তার শরীর এত ব্যথা যে সে এপাশ ওপাশ পর্যন্ত করতে পারছে না। কতক্ষণ সে অচেতন হয়ে পড়েছিল তা মালুম করতে পারল না। এবার তার সন্তানের কথা মনে পড়ল। সে ভাবল সে তো দিব্যি বেঁচে বর্তে আছে, তার সন্তানও কি বেঁচে আছে?

বিছানার লাগোয়া কলিংবেল। জেনিফার হাত বাড়িয়ে সেটা জোরে জোরে টিপতে লাগল। সেই আওয়াজ শুনে একজন নার্স ছুটে এল। সে ঘরের ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকে উঁকি মেরে চলে গেল। জেনিফার ক্রমাগত বাজিয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পর ডঃ লিন্ডেন ঝড়ের বেগে ঘরে এসে ঢুকলেন। ডঃ লিন্ডেন তার হাতটা কলিংবেল থেকে সরিয়ে দিলেন।

ডঃ লিন্ডেন কাছে এসে বললেন–এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন, মিসেস পার্কার?

জেনিফার কান্না ভেজা গলায় বলল–আমার বাচ্চা কোথায়? সে কি বেঁচে আছে?

-আপনার বাচ্চা বেঁচে আছে আর সুস্থ দেহে। আমার এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলছি, আপনার ছেলে হবে মিসেস পার্কার। ওকে আপনি অ্যাডাম বলে ডাকছিলেন।

.

১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। এই সময় তুষারপাত হয়। শীতের অবসান হয়। এটাই কাজ থেকে অবসর নেবার উপযুক্ত সময়। তারও শরীর মন কিছুদিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করছে।

একদিন জেনিফার তার অফিসের কর্মচারীদের বলল–আমি আগামী পাঁচ মাসের জন্য ছুটিতে যাচ্ছি। তোমরা আমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা কোরো না। পাবে না।

সহকারী ট্রেড হ্যারিস জানতে চাইল–আপনি কবে যাচ্ছেন?

–এই সপ্তাহের শেষে যাচ্ছি। পরবর্তী মামলাগুলো কিভাবে লড়তে হবে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল তার সহকারীদের জেনিফার।

অফিস ছুটির পর জেনিফার বাদে সবাই যে যার বাড়ি চলে গেল। কেন বেইলি এসে ঢুকল জেনিফারের ঘরে। সে কেনকে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানালো।

–তুমি কি মনস্থির করে ফেলেছে, জেনি?

–হ্যাঁ কেন।

কেন উত্তেজিত হয়ে বলল–যে তোমার এই সর্বনাশ করেছে তাকে আমি ঘেন্না করি।

সব ঠিক হয়ে যাবে, কেন। এ নিয়ে তুমি অযথা মাথা গরম কোরো না।

–ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে? তোমার এই শিশু একদিন বড় হবে, তার মনে নানা প্রশ্ন জাগবে, তোমার সন্তানও জানতে চাইবে তার পিতৃপরিচয় কি?

–সে সবের সামাল আমি দেব।

–ঠিক আছে, প্রয়োজন মনে করলে আমাকে খবর দিতে দ্বিধা কোরো না, চিরকাল আমাকে তোমার পাশে পাবে, কেন বলল।

দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে জেনিফার বলল–অজস্র ধন্যবাদ। তুমি যে আমার জন্য এত চিন্তা করো জেনে খুব খুশী হলাম।

.

অ্যাডামের প্রতি জেনিফারের ভালোবাসা আজও অটুট রয়েছে, অ্যাডামও যে তাকে ভালোবাসে তাতে ওর কোনো সন্দেহ নেই। ওর স্ত্রী মেরিবেথের সন্তান একদিন বড় হবে, ততদিনে অ্যাডাম নিশ্চয়ই প্রেসিডেন্ট হয়ে যাবেন। এদিকে জেনিফারের নিজের ছেলেও বড় হয়ে উঠবে, সে যদি জানতে চায় ওর বাবা কে, তাহলে সে কিছুতেই বলতে পারবে না। অ্যাডামের সন্তান সে গর্ভে ধারণ করেছে সে কথা জানাজানি হলে তার রাজনৈতিক জীবনের আকাশে কালো মেঘে ছেয়ে যাবে।

জেনিফার শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে ম্যানহাটানে গ্রামের স্নিগ্ধ পরিবেশে একটি বাড়ি কিনলো। বাড়িটি বহুদিনের পুরোনো। প্রচুর টাকা খরচ করে বাড়িটির সংস্কার করল। আধুনিক রুচিসম্পন্ন আসবাব দিয়ে বাড়িটিকে সাজালো সে। ছেলের জন্য আলাদা একটা ঘর রাখল, সেই ঘরটিকে প্রচুর দামী খেলনা দিয়ে সাজালো। সেইসব খেলনা সে জোগাড় করেছে বহু বাজার ঘুরে ঘুরে। বাড়ি কেনার কথা একমাত্র কেন বেইলিকে জানাল সে। সে কেনকে একদিন আমন্ত্রণ জানালো। কেন এসে বাড়ির ভেতরের চাকচিক্য দেখে অবাক হল।

ততদিনে জেনিফারের তলপেট বেশ স্ফীত হয়েছে। তাই তাকে এখন মেটারনিটি গাউন পরতে হয়। সেই তলপেটের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বলল–আর কত দেরী?

জেনিফার বলল–আরও দুমাস।

যদিও এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার তবুও জিজ্ঞেস করছি এই বাচ্চার বাবা কি করে? কেন কৌতূহল দমন করতে না পেরে বলল।

জেনিফার হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল–এ প্রসঙ্গ নিয়ে আর ঘাটাঘাটি না করাই ভালো।

দুঃখিত, আর জিজ্ঞেস করবো না।

ডঃ হার্ভে একজন ধাত্রীবিদ্যা বিশারদ। তার কাছেই জেনিফার চিকিৎসা করায়। তিনি সন্তানের জন্মের সম্ভাব্য সময় আগে থেকেই বলে দিয়েছেন। যথা সময়ে জেনিফারের প্রসব যন্ত্রণা শুরু হল। সে নিজে গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে এল। আটঘন্টা অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে সে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিল।

জেনিফার ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। হঠাৎ শিশুর কান্না তার কানে গেল। সে চোখ খোলার আগেই ডঃ হার্ভে বললেন–মিসেস পার্কার, আপনার ছেলের মুখ দেখুন।

জেনিফার চোখ খুলে তাকাল, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে পরম তৃপ্তিতে হাসল।

জেনিফার তার ছেলের নাম রেখেছে যোশুয়া অ্যাডাম পার্কার। ভূমিষ্ট হওয়ার সময় ওর ওজন হয়েছিল সাড়ে আট পাউন্ড। অ্যাডামের মতো দেখতে হয়েছে। ছেলের মুখের দিকে তাকালে জেনিফারের অ্যাডামের কথা মনে পড়ে যায়। এই মুহূর্তে মেরিবেথের সন্তানও ভূমিষ্ট হয়েছে। আর অ্যাডামও ছেলেকে দেখে আনন্দে আত্মহারা। জেনিফার ছেলেকে পেয়ে যেমন আনন্দিত তেমনি অ্যাডামকে হারিয়ে শোকাভিভূত।

কেন বেইলি জেনিফারের সন্তানের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কিছু একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। জেনিফারের মনে ভয়ের সঞ্চার হল। এই বুঝি কেন সন্তানের বাবার নাম জানতে চাইবেন। কিন্তু যখন কেন বলল–আরে, এতো একেবারে মায়ের মুখ বসানো! তখন তার মন থেকে ভয় দূর হয়ে গেল।

কেন অনেকক্ষণ তার ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করল। জেনিফারের বুক তখন ব্যথায় টন টন করছে, এই শিশু কোনদিন বুঝতে পারবে না পিতৃস্নেহ কাকে বলে? সে কোনোদিন তার বাবার আদর যত্ন পাবে না।

দেখতে দেখতে চার মাস কেটে গেল। আর চার সপ্তাহ পরে জেনিফারকে কাজে যোগ দিতে হবে। এখন একজন সৎ বিশ্বাসী কাজের লোকের দরকার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর

একজন মহিলাকে পাওয়া গেল। নাম মিসেস ম্যাকে। জাতিতে স্কটিশ। তাকে কাজে বহাল করা হল।

মিসেস ম্যাকে কাজে যোগদান করার পর এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত। জেনিফার আবার। অফিসে যেতে শুরু করল।

অফিসের প্রত্যেকটি কর্মচারী জেনিফারকে অভিনন্দন জানালো। তার ফিরে আসার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কেন শ্যাম্পেন আনালো।

.

ছেলেকে নিয়ে শুরু হল জেনিফারের নতুন জীবন। সে এখন জীবনী শক্তিতে ভরপুর। নতুন উদ্যমে ঘরের সব কাজ করতে লাগল। তার পাশাপাশি ছেলের যত্নের ত্রুটি রাখে না। এখন থেকে উইকএন্ডে অফিসের কাজ করে না। সে সেইসব দিনগুলি ছেলেকে নিয়ে কাটায়। তার ছেলের এখনও কোনো বোধশক্তি হয়নি। তাসত্ত্বেও সে বই পড়ে গল্প শোনায় ছেলেকে। তার বিশ্বাস, তার সব কথা বোঝে ওই পুঁচকে ছেলেটি।

–অ্যাডাম ওয়ার্নার সেনেটর হওয়ার পর আইনব্যবসা ছেড়ে দিয়েছিল। পুরোপুরিভাবে এখন তিনি আমেরিকার রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করেছেন। অদূর ভবিষ্যতে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ অলঙ্কৃত করবেন, এমন একটা কানাঘুষো শোনা যায়। অ্যাডামের কৃতিত্বের খবর শুনে জেনিফার মনে মনে মোটেই খুশী হয় না।

১৯৭৪ সাল। যোশুয়ার আজ একবছরের জন্মদিন। জেনিফার নিজের হাতে জন্মদিনের কেক বানিয়েছে।

জনা দশেক কচিকাঁচাদের নিয়ে যোশুয়ার জন্মদিন পালিত হল। বড়দের মধ্যে একমাত্র কেনেথ বেইলি নিমন্ত্রিত হয়েছিল। সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার বাড়ি ফিরে গেল।

জেনিফার ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে–ধীরে ধীরে তার ছেলে বড়ো হবে, হয়ে উঠবে পূর্ণ যুবক। নিজের পৃথিবী গড়ে তুলতে সে নিশ্চয়ই তার মাকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।

একদিন যে অ্যাডামকে তার ছেলের কথা বলতে হবে, সেই নিদারুণ সত্যটা জেনিফার অনুভব করল।

দু বছরের যোশুয়া জল রং দিয়ে বাড়ির সবকটা ঘরের দেওয়ালে আঁকিঝুঁকি কাটল। তা দেখে পরিচারিকা মিসেস ম্যাক ছুটে এল। রেগে গিয়ে তাকে চড় মারতে উদ্যত হল।

জেনিফার বাধা দিয়ে বলল–ও ছেলেমানুষ। ওর প্রতিভাকে ফুটতে সাহায্য করুন।

–আস্কারা দিয়ে ছেলেটার ভবিষ্যৎ বরবাদ করে দিলে। মিসেস ম্যাক গজগজ করতে করতে চলে গেল।

.

কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা। মাইকেল মোরেটি তার শ্বশুর অ্যান্টেনিও গ্র্যানেলির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছিলেন। সেখানে পারিবারিক আইন উপদেষ্টা টমাস কোলফ্যাক্সও উপস্থিত ছিলেন। মোরেটিকে টমাস বিশেষ পছন্দ করেন না। তাই মোরেটি যে কোনো প্রস্তাব দিলে তিনি তা যুক্তিতর্ক দিয়ে উড়িয়ে দেন।

কোলফ্যাক্স বিদায় নিলে মোরেটি বলল–কোলফ্যাক্সের বয়স হয়েছে। ওকে বিদায় দিন। অন্য উকিল নিন।

–উনি খুব ভালো লোক। তার শ্বশুর বললেন, অনেক ঝামেলা থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। তা তুমি কারো কথা ভেবেছো কি?

-হ্যাঁ, জেনিফার পার্কারকে।

–মেয়েমানুষকে কখনও কারবারের মধ্যে রাখতে নেই, অ্যান্টেনিও গ্ল্যানেলি বললেন, ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না।

–ওর আইন ব্যবসায় খুব নাম যশ আছে।

–ঠিক আছে।

জেনিফারকে লাস ভেগাসে একদিনের জন্য আসতে হল, এক মক্কেলের কাজের ব্যাপারে। সেখানে সে মাইকেল মোরেটির পাল্লায় পড়ে গেল। মোরেটি তাকে ডিনার খাওয়ালেন। দুজনে একসঙ্গে নাচল। জেনিফার লক্ষ্য করল, তার চোখে জৈবিক কামনার আগুন ধকধক করে জ্বলছে। অ্যাডামের পাশে এই লোকটাকে বন্যজন্তু ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

রাত চারটে নাগাদ মোরেটি জেনিফারকে হোটেলে পৌঁছে দিল।

–আজ যাচ্ছি, বিদায় নেবার মুহূর্তে মোরেটি বললেন, আবার আমাদের দেখা হবে। আজকের এই রাতের কথা আমি জীবনে কোনোদিন ভুলব না।

জেনিফার কিছু বুঝতে পারল না। তবে অদ্ভুত একটা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করল।

আড়াই বছরের শিশু যোশুয়া খুব দুষ্ট হয়ে উঠেছে। মিসেস ম্যাকের সেলাইকল, বাড়ির দুটো রঙিন টিভিসেট, জেনিফারের হাত ঘড়ি সব ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল। কিন্তু তিন বছরে পা দিতেই যোশুয়ার মধ্যে একটা পরিবর্তন এল। সে আর ভাঙচুর করে না। খেলাধুলা করতে ভালোবাসে সে, পাহাড়ে চড়তে আর সাইকেল চালাতেও সে ভালোবাসে।

জেনিফার ছেলেকে স্থানীয় একটা নার্সারি স্কুলে ভর্তি করে দিল। ওর মুখের ধরন, ভুরু কুঁচকে তাকানো, সব কিছুতেই অ্যাডামের প্রকাশ লক্ষ্য করে জেনিফার। অ্যাডাম কোথায় আছে, কী করছে, কেমন আছে, এসব ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই তার। পুরোনো ঘা টা এখনও শুকোয়নি। খবরের কাগজ থেকে জেনেছে, অ্যাডামের একটি মেয়ে হয়েছে সামান্থা।

জেনিফার তার কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনকে একাকার করে দেয় না। এই দুয়ের মাঝে সেতুর মতো দাঁড়িয়ে আছে কেনেথ। সে যযাশুয়ার জন্য খেলনা নিয়ে আসে, দুজনে খেলা করে, ওরা যেন দুই বন্ধু। জেনিফার মনে মনে তৃপ্তি লাভ করে।

রবিবার। কেনেথ এসেছে জেনিফারের বাড়িতে। তারা বাগানে হাঁটছিল। যোশুয়াকে একটা গাছে উঠে বসে থাকতে দেখে কেনেথ বলল–ওর এখন কী প্রয়োজন বলতে পারো?

–না।

–ওর দরকার একজন বাবা। কেনেথ বলল, আসল বাবা তো একটা লোচ্চা…

-কেনেথ। জেনিফার অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। ভবিষ্যতে এই প্রসঙ্গ আর তুলো না।

দুঃখিত। সত্যি, অতীতকে নিয়ে ঘাটঘাটি করে কী লাভ। কেনেথ বলতে থাকে। কিন্তু আমি ভাবছি তোমার ভবিষ্যতের কথা। এভাবে একক জীবনযাপন করা তোমার পক্ষে। কি ঠিক হচ্ছে?

–কেনেথ, আমার পাশে আমার ছেলে যোশুয়া আছে।

–ওর কথা বলছি না। কেনেথ তার হাতে চুমু দিল। দুঃখিত, জেনিফার আমি সত্যিই খুব দুঃখিত।

.

জ্যাক স্ক্যানলনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সে চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে চুরি করে এবং মুক্তিপণ দাবী করেছে। বিচারের পূর্বমুহূর্তে তার কাছে তার উকিলের নাম জানতে চাওয়া হল। সে নির্দ্বিধায় জেনিফার পার্কারের নাম বলে দিল। ফলে জামিনে মুক্তি পেয়েছিল জ্যাকসন।

জেনিফার জ্যাকসনের সঙ্গে দেখা করে সত্যি ব্যাপারটা জানতে চাইল।

জ্যাকসন বলল, সে নির্দোষ, শুধু হৃদয়াবেগের বশে সে ওই বাচ্চাটিকে তুলে এনেছিল। এমন কী সে মুক্তিপণও দাবী করেনি। পুলিশ তার নামে মিথ্যে বলেছে। আসলে তার স্ত্রী সন্তান প্রসবকালে মারা গিয়েছিল, তারপর সে আর বিয়ে-থা করেনি। সেদিন রাস্তার ধারে ওই বাচ্চা-মেয়েটিকে দেখে মৃত স্ত্রীর কথা তার মনে পড়ে যায়। এ যেন ছোট্টো এক ইভলিন। ইভালিন হয়তো পুনর্জন্ম লাভ করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। গুরুতর অপরাধ জেনেও সে মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে নিয়েছিল।

বলতে বলতে জ্যাকসনের দুচোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। জেনিফার ওর কথাগুলো সত্যি বলে ধরে নিল। সে ওর পক্ষে মামলা করতে রাজী হল।

জেনিফার বুঝতে পেরেছিল যে, সন্তানহারা বাবা একটি ছোটো মেয়ের চেহারায় তার মৃত স্ত্রী আর সন্তানের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছে আর সেই আবেগের বশেই সে এই অপরাধ করেছে। এই যুক্তিকে যদি সে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে তাহলে বিচারকের মনে সহানুভূতির উদ্রেক হতে পারে। তাহলে আসামীর শাস্তির পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে।

এই মামলায় সরকারী উকিল ছিলেন আর্ল অসবোর্ন, তাঁর সহকারী হিসেবে ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা।

জেনিফার তার মক্কেলের অপরাধের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আসল কাহিনীটা শোনাল। এবং জামিনের জন্য আবেদন জানাল। হয়তো তার জামিন হয়ে যেত, কিন্তু বাদ সাধল রবার্ট ডি সিলভা।

তিনি একটা পুরোনো ফটো বিচারকের কাছে পেশ করলেন। সম্ভবত পুলিশের দপ্তর থেকে জোগাড় করেছেন।

তিনি বললেন–এই ফটোটা জ্যাকসন নামে এক কুখ্যাত অপরাধীর। চোদ্দো বছর বয়সে সে প্রথম অপরাধ করেছিল। ওরা বাবা ছিলেন একজন বিখ্যাত ডাক্তার, বাবার ডিসপেনসারি থেকে ওষুধ চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল। চার বছর সে শিশু সংশোধনাগারে ছিল। মেয়াদ শেষ হলে ছাড়া পায়। তার এক মাস বাদেই এক ডাকাতির অভিযোগে পুলিশ ওকে আবার গ্রেপ্তার করে।

রবার্ট ডি সিলভার সওয়াল থেকে জানা গেল, সেই কুখ্যাত অপরাধী ফ্রাঙ্ক জ্যাকসনই, বর্তমানের জ্যাকসন স্ক্যানলন। যে এই মুহূর্তে শিশু অপহরণের অপরাধে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। সে একজন পাকা অভিনেতা-ভীষণ মিথ্যেবাদী। সে জীবনে বিয়ে করেনি। পাঁচ বছর আগে একটি তিনবছরের মেয়েকে চুরি করেছিল। পুলিশ এক জঙ্গলের মধ্যে থেকে সেই বাচ্চা মেয়েটির মৃতদেহ পেয়েছিল। ডাক্তারি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, হত্যার আগে তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। জ্যাকসন ওর ওপর তার বিকৃত কাম চরিতার্থ করেছিল।

জেনিফার ফটোটা হাতে নিল। দেখল, অবাক হল। এ তো তার মক্কেল জ্যাকসন স্ক্যানলনেরই। রবার্ট ডি সিলভা আদালতে যা কিছু বললেন, সবই তাহলে সত্যি। তার বুঝতে বাকি রইল না, জ্যাকসন তার মন রাখার উদ্দেশ্যে মিথ্যে গল্প তাকে শুনিয়েছে। জেনিফার স্পষ্ট ভাষায় বিচারককে জানিয়ে দিল যে, সে আর ওই মক্কেলের হয়ে মামলা লড়বে না।

অতএব, জ্যাকসনের জামিন খারিজ হয়ে গেল এবং তার বিরুদ্ধে নতুন করে গ্রেপ্তারের আদেশ দেওয়া হল।

সেদিন সন্ধ্যায় ওয়ালডর্ফ-অ্যান্টোরিয়া রেস্তোরাঁয় জেনিফারের ডিনারের নেমতন্ন ছিল। জজ লরেন্স ওয়াল্ডম্যান তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

 খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে মাঝে মধ্যেই জেনিফার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। জ্যাকসন স্ক্যানলন তাকে যে মিথ্যে কথা বলে প্রভাবিত করতে চেয়েছিল, সেকথাই বারবার মনে পড়ছে।

মিস পার্কার, হঠাৎ রেস্তোরাঁর ম্যানেজার এসে বলল, আপনার একটা ফোন আছে।

জেনিফার উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরল–জেনিফার পার্কার বলছি।

–হারামজাদি, খানকি মাগী, কুত্তির বাচ্চা। অশ্রাব্য গালিগালাজ ছুটে আসছে ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে। আমি জ্যাকসন, জ্যাকসন স্ক্যানলন। আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিতে চাইছিস, তাই তো।

–চুপ করো। জেনিফার রাগে তখন ফুঁসছে। তোমার মতো মিথ্যে কথা আমি বলি না। তোমাকে ধরার দায় পুলিশের, আমার নয়।

চোপ শালি। কথা দিয়েছিলি মনে নেই, আমার হয়ে সওয়াল করবি। আর আদালতে গিয়ে ভোল পাল্টে ফেললি! তোকে আমি হাতে-হাতে এর উচিত শিক্ষা দেব।

ফোন কেটে গেছে। জেনিফার ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে। তাহলে জ্যাকসন এখনও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমি যে এখানে আছি ও জানল কী করে? নিশ্চয়ই পিছু নিয়েছিল।

সে লরেন্স ওয়াল্ডম্যানকে সব কথা বলল। তিনি শুনেই আঁতকে উঠলেন। তিনি তাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেন। কিন্তু জেনিফার রাজী হল না।

বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড়াল। সমস্ত বাড়ি অন্ধকার। জেনিফার সদর দরজায় হাত রাখল, দরজা খুলে গেল। কী এক অজানা আতঙ্কে মন তখন ছেয়ে গেছে তার। আলো জ্বালাল, চমকে উঠল। পোষা কুকুরটা নিথর হয়ে পড়ে আছে। ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে তার গলা কাটা হয়েছে বোঝা গেল।

সে ছেলে ও পরিচারিকার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঘরে এসে ঢুকল। যোশুয়া কোথায়। মিসেস ম্যাক?

–একটা মৃদু গোঙ্গানির আওয়াজ ভেসে এল। জেনিফার আলো জ্বালল। জামাকাপড় যেখানে কাঁচা হয় সেদিকে এগিয়ে গেল। মিসেস ম্যাক মেঝের ওপর পড়ে আছেন, তাঁর চার হাত-পা শক্ত করে বাঁধা।

–একটা লোক বাড়ির ভেতর ঢুকেছিল, মিসেস ম্যাক বললেন, আমি বাধা দিয়েছিলাম, কিন্তু আটকাতে পারিনি। যোশুয়াকে তুলে নিয়ে গেছে।

জেনিফারের বুকটা ধড়াস করে উঠল। বুঝতে দেরী হল না, লোকটা কে?

এমন সময় টেলিফোন বেজে উটল।

 জেনিফার ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলে নিল।

–তুমি তাহলে বাড়িতে এসে গেছো?

–আমার ছেলে কোথায়? জেনিফার গর্জে উঠল।

ভারী মিষ্টি ছেলেটা তোমার।

–জ্যাকসন, দোহাই তোমার, আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। যা বলবে, তাই করব।

–তুমি তো আগেই যা করার করেছে।

–দোহাই, দয়া করো। আমার ছেলেকে…

কাঁদো। মন ভরে কাঁদো, জ্যাকসন বলে চলল, ঘাবড়াচ্ছো কেন? ছেলেকে ফেরত দেব। হ্যাঁ, কাল সকালে খবরের কাগজ খুললেই ওর মৃতদেহের ছবিটা তুমি দেখতে পাবে।

জেনিফার শিউরে উঠল। কিছু বলতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে টেলিফোন নীরব হয়ে গেছে।

এই মুহূর্তে কে তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে? অ্যাডাম ওয়ার্নার? যোশুয়া তো তারই সন্তান। বলবে, যোশুয়াকে হত্যা করে জ্যাকসন জেনিফারের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছে। কিন্তু অ্যাডাম এখন আছেন দুশো পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে। তাহলে উপায়, রবার্ট ডি সিলভা? হয়তো তিনি কাজটা করে দিতে পারবেন। কিন্তু সময় বেশী লেগে যাবে।

এফ বি আই? সে তার নিজের পথ ধরে এগোবে। সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

হঠাৎ একটা নাম পড়ে গেল তার। একটা বিশেষ নম্বর ডায়াল করল।

–হ্যালো।

–আমি মাইকেল মোরেটির সঙ্গে কথা বলতে চাই।

–আমিই মাইকেল মোরেটি।

-মাইকেল, আমি জেনিফার, ভীষণ বিপদ। একমাত্র আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারেন। কান্নায় তার গলা বন্ধ হয়ে এল। সে কোনো রকমে সমস্ত ঘটনাটা জানাল।

মোরেটি লোকটির নাম, চেহারার বিবরণ সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিল। তারপর বললেন–ওকে পেলে কী করব?

–খুন। খুন করে ফেলবেন। তখন কী এক অদৃশ্য শক্তি বুঝি জেনিফারের ওপর ভর করেছিল।

আপনি অপেক্ষা করুন। আমি দেখছি।

ফোন কেটে গেল।

.

মোরেটির তলব পেয়ে তিন বিশ্বস্ত অনুচর–নিক ভিটো, স্যালভাতোর ফিওরে আর জোসেফ কোলেলা এসে হাজির হল। জ্যাকসন স্ক্যানলন সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য জানালেন তিনি। তারপর বললেন–এখন মাঝরাত, যে ভাবেই হোক ওই লোকটাকে তোমরা খুঁজে বের করবে। আট ঘণ্টা সময় পাবে। তবে বাচ্চাটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। প্রয়োজনে ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করো।

তিন বিশ্বস্ত অনুচর তিন পেশাদার খুনে। মাইকেল মোরেটির অঙ্গুলি নির্দেশে তারা নির্দ্বিধায় ঘাড় থেকে মাথা নামিয়ে দিতে পারে। তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অপরাধ চক্রের কুশীলবদের নাড়িনক্ষত্র ওই তিন মস্তানের নখদর্পণে। তাই জ্যাকসানের খোঁজ পেতে তাদের দেরী হল না।

আট ঘণ্টা কাটেনি, তার আগেই মাইকেল মোরেটিকে তারা জানাল ব্রুকলিন কুইনস । এক্সপ্রেসওয়েতে সাত নম্বর বাংলোয় ফ্র্যাঙ্ক জ্যাকসন ওই বাচ্চা ছেলেটাকে আটকে রেখেছে।

পরদিন সকাল সাতটা পঞ্চাশ মিনিটে বিশাল একটি লিমুজিন গাড়ি সাত নম্বর বাংলোর। সামনে এসে দাঁড়াল। মাইকেল মোরেটি গাড়ি থেকে নামলেন। তিন সাগরেদ তার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছিল।

ওদের ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে সাইলেন্সর লাগানো রিভলবার হাতে নিয়ে মোরেটি পায়ে পায়ে সাত নম্বর বাংলোর সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। এক মুহূর্তের স্তব্ধতা। পরক্ষণেই লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললেন। দেখলেন একটি লোক হাঁটু ভাজ করে পেছন ফিরে বসে আছে, পাশে একটি বছর তিনেকের সুন্দর ছেলে।

দরজা খোলার আওয়াজে লোকটা ততক্ষণে মুখ ফিরিয়েছে। দাড়ি গোঁফে ঢাকা তার মুখ। লোকটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাইকেল মোরেটির রিভলবার থেকে গুলি ছুটে এল–এক…দুই…তিন। কপালে…গলায়…আর হৃৎপিণ্ডে। ফ্র্যাঙ্ক জ্যাকসন ওরফে জ্যাকসন স্ক্যানলনের রক্তাক্ত দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ইতিমধ্যে তিন সাগরেদ ঘরের চৌকাঠে এসে পা রেখেছে। মোরেটি তাদের ঘরের ভেতরে ঢুকতে বললেন। তিনি ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেলেন। নাড়ি দেখলেন অত্যন্ত ক্ষীণ গাতি, কিন্তু বেঁচে আছে।

–ডঃ পেট্রনকে খবর দাও। জোসেফকে নির্দেশ দিলেন মোরেটি, ওকে বলো আমরা যাচ্ছি।

জোসেফ ঘাড় নেড়ে ঘর থেকে চলে গেল।

এবার তিনি জেনিফারকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন যে, তার ছেলের খোঁজ পাওয়া গেছে। খুব তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে তিনি ফিরে আসবেন।

.

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যযাশুয়াকে সঙ্গে নিয়ে মাইকেল মোরেটি ফিরে এলেন জেনিফারের বাড়িতে। ছেলের দুহাতের কবজি আর দুপায়ের গোড়ালিতে পুরু ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখে জেনিফার আঁতকে উঠল।

ডাক্তার জানাল–শক্ত করে বেঁধে রাখার ফলে এমনটি হয়েছে। একটু ক্ষত হয়েছে। ওর নার্ভ বা ব্রেনের কোনো ক্ষতি হয়নি। ও সেরে উঠবে। আমি মাঝে মধ্যে এসে ওকে দেখে যাব।

মিসেস ম্যাক যোশুয়াকে খাটে শুইয়ে দিল। জেনিফার ছেলের মাথার কাছে বসল। কিছুক্ষণ বাদে যোশুয়ার ঘুম ভাঙল। মাকে দেখে বলল, আমি জানতাম মা, তুমি ঠিক আসবে।

–আগামী সপ্তাহে আমরা কী করব জানো? ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জেনিফার বলল, তুমি আর আমি একসঙ্গে মিলে–

জেনিফার লক্ষ্য করল যোশুয়া আবার ঘুমের জগতে হারিয়ে গেছে।

কয়েক ঘণ্টা বাদে জেনিফার ড্রয়িংরুমে এসে ঢুকল। সেখানে বসে আছেন মাইকেল মোরেটি। মনে পড়ে গেল অ্যাডাম ওয়ার্নারের সাথে প্রথম পরিচয়ের দিনটির কথা। ওই একইভাবে তিনিও বসেছিলেন তার ছোট্ট ফ্ল্যাটে।

মাইকেল মোরেটি জানালেন-জ্যাকসনের মৃত্যু হয়েছে।

জেনিফার কীভাবে যে মাইকেল মোরেটিকে তার কৃতজ্ঞতা জানাবে ভেবে পেল না। এই লোকটির কাছে সে ঋণী হয়ে রইল। কীভাবে এই ঋণ শোধ করবে সে?

মাইকেল মোরেটি তখন পলকহীন চোখে তাকিয়ে ছিলেন জেনিফারের দিকে।

.

খোলা জানলার পাশে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জেনিফার। সামনে ট্যাজিয়ার উপসাগর। ঢেউ গড়ছে আর ভাঙছে। আছড়ে পড়ছে গর্জন করে। শরৎকালের প্রকৃতি শান্ত। দূরে সাগরের মাঝখানে দু-একটা পালতোলা নৌকা দেখা যাচ্ছে। দুটো বড় ইয়াট দেখতে পেল জেনিফার। নোঙর করে আছে।

হঠাৎ হাতের ওপর পুরুষের স্পর্শ। ঘাড় ফেরাল জেনিফারমাইকেল মোরেটি।

–জেনিফার, ওই সুন্দর প্রকৃতির মতো তোমাকেও সুন্দর লাগছে। জেনিফারের বুকের বোঁটায় হাত বোলাতে বোলাতে মোরেটি বললেন, চলো, আমরা বিছানায় যাই।

মোরেটির হাতের ছোঁয়ায় জেনিফারের শরীর কেঁপে উঠল থরথর করে। তিনি এমন সব জিনিস দাবী করছেন, যা সাধারণ মানুষ চাইবার সাহস পায় না। এমন এমন আচরণ তিনি করছেন যা আগে কেউ তার সঙ্গে করেনি।

গায়ে গা ঠেকিয়ে হাতে হাত রেখে ওরা এল শোবার ঘরে।

সে রাতে তারা বারবার শরীর সংযোগ করেছিল। আকর্ষণীয় এক সুখ সাগরে ভেসে গিয়েছিল জেনিফার।

-তোমাকে পরিতৃপ্তি দিতে পেরেছি তো?

 মাইকেল মোরেটির প্রশ্নে জেনিফার কেবল ঘাড় নাড়ল। লজ্জা এসে তখন তাকে গ্রাস করেছে। মাইকেল মোরেটিকে কাছে পাওয়া, তার সঙ্গে শরীর নিয়ে খেলা, এর মধ্যে যে কী নিদারুণ লজ্জা লুকিয়ে আছে, তা অন্য কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

সেদিন মোরেটিকে সে প্রত্যাখান করতে পারেনি। হয়তো ঋণশোধ করছে সে? অথবা কৃতজ্ঞতাবোধ।

অ্যাডামের সঙ্গে সে এর আগে বহুবার দৈহিক মিলন ঘটিয়েছে। কিন্তু মাইকেল মোরেটির ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। মাইকেল মোরেটি প্রথম রাতেই তাকে মুঠো বন্দী করে ফেলেছে। সমুদ্রের অশান্ত ঢেউয়ের মতো মোরেটির পুরুষালি যৌবন দৃপ্ত শরীর বারবার ভেঙে পড়ছে জেনিফারের শরীরের ওপর। পরম সুখে জেনিফার তাঁকে আঁকড়ে ধরে আছে।

তারা সে রাতে চার ঘণ্টা একসাথে কাটিয়ে ছিল। মোরেটির বন্য চাহিদা তাকে মেটাতে হয়েছিল। জেনিফার বুঝেছিল, এই মুহূর্ত থেকে তার জীবন ধারা অন্য গতিপথ ধরে এগোবে।

জেনিফার অবাক হয়ে ভেবেছে, মোরেটির সঙ্গে তার এই আচরণ শুধু কী কৃতজ্ঞতার নিদর্শন। সে অ্যাডামকে ভালোবাসে এখনও। তবে মোরেটির সঙ্গে যা কিছু ঘটেছে তা তার একাকীত্বের পরিণাম।

কিন্তু? একটা অপরাধ বোধ তার মনকে কাটার মতো বিঁধছে। মোরেটির পরিচয় ও পেশা জেনিফারের অজানা নয়। তার ছেলেকে উদ্ধার করতে সে একজনকে খুন করেছে, এরকম অসংখ্য খুন সে করে। টাকা, ক্ষমতা আর প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করতে একের পর এক মানুষ খুন করতে পারে সে। এরকম একটা পাষণ্ড জঘন্য লোকের কাছে সে কী করে দেহদান করল? কী করে শরীরে শরীর রেখে পরম সুখ লাভ করল?

পরদিন সকালে মোরেটি ফোন করলেন। যোশুয়া কেমন আছে জানতে চাইলেন। তারপর দুপুরে বারোটায় তাকে ডোনাটো রেস্তোরাঁয় লাঞ্চের আমন্ত্রণ জানালেন।

জেনিফার মোরেটির ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হল ওই রেস্তোরাঁয়। কথায় কথায় সে জানতে চাইল, মাইকেল মোরেটি কীভাবে এই অন্ধকার পাতালপুরীর মাফিয়া সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়ে উঠেছে।

মোরেটি বলেছিলেন–ভেবো না, কারো চাপে পড়ে আমি একাজে নেমেছি। ক্ষমতা আর টাকার মোহ ছিল আগাগোড়া। দুনিয়ার অধীশ্বর হব আমি। সেই স্বপ্নই পূরণ হয়েছে আমার। আচ্ছা–মোরেটি জানতে চাইলেন, এক বিছানায় তুমি কেন আমার সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলে, জানতে বড় ইচ্ছে করে।

জেনিফার আমতা আমতা করে বলল তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাবোধই আমাকে..

–ভুল। আসলে তুমি আমার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছ। তোমার মনে আমার সাথে বিছানায় শোওয়ার বাসনা জেগেছিল।

মাইকেল, আমি

জেনিফার, টাকা বা কৃতজ্ঞতার বিনিময়ে আমার মেয়ে কেনার প্রয়োজন হয় না। ওরা এমনিতেই আসে। খুব সাবধান, ভেবো না আমায় নিয়ে খেলবে। সে চেষ্টা বৃথা।

জেনিফার অবাক চোখে মোরেটির দিকে তাকাল। বুঝি এই মুহূর্তে জেনিফারের মনের সব শক্তি উবে গেছে।

লাঞ্চের শেষে ডেসার্ট খেতে খেতে মাইকেল মোরেটি কথাটা পাড়ল।

-জেনিফার, একটা মামলায় তোমাকে দাঁড়াতে হবে।

কে যেন জেনিফারের গালে এক চড় কষিয়ে দিয়েছে।

কাজটা তোমাকেই করতে হবে। ভাস্কো গামবুটি আমার দলের একটি ছেলে। পুলিশকে খুন করে ধরা পড়েছে। ওর হয়ে তোমাকে লড়তে হবে।

জেনিফার নীরব। চাপা পুরোনো রাগটা যেন আবার চাগাড় দিয়ে উঠতে চাইছে।

দুঃখিত মাইকেল। আমার পক্ষে তোমার দলের লোকদের সঙ্গে জড়ানো সম্ভব নয়।

-তাই নাকি? মোরেটির চোখে বিদ্যুতের ঝিলিক। কোথায় যাবে তুমি? যেদিকে তাকাবে, শুধু জঙ্গল আর ঘন জঙ্গল।

জেনিফার নীরব। মাইকেল মোরেটি, ভুল কিছু বলেনি। শহরের কংক্রীট সভ্যতার আনাচে-কানাচে যে জঙ্গল তিলে তিলে গড়ে উঠেছে, তার অস্তিত্ব অস্বীকার করবে কী করে সে। সেই জঙ্গলের সম্রাট মাইকেল মোরেটি, অবশ্য এই সম্রাটের মাথায় তাজ নেই। সভ্য আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই অন্ধকার গভীর জঙ্গলে বসে সে তার অন্ধকার জগতকে শাসন করে চলেছে। জেনিফার কোনোদিন সেই অন্ধকার জঙ্গলের বাইরে আসতে পারবে না। সে উপলব্ধি করল, মাইকেল মোরেটির সেই অন্ধকার জঙ্গলে প্রবেশ করে সে পথ হারিয়েছে।

তবুও সে ঠিক করল, অন্তত একবারের জন্য মাইকেল মোরেটির কাজটা করে দেবে।

পরদিন অফিসে এসে জেনিফার কেনেথকে জানাল সব কথা।

সব শুনে কেনেথ চমকে উঠল–অবিশ্বাস্য চোখে জেনিফারের দিকে তাকাল জেনিফার, তুমি জানো, ও একজন মাফিয়া। অন্ধকার জগতের ডন। এই ধরনের মক্কেলের কাজ আমরা নেব কেন?

–ভাস্কো একজন মানুষ। সুবিচার পাবার অধিকার তারও আছে। জেনিফার ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিল–আমি ওর হয়ে আদালতে দাঁড়াব।

না, তা তুমি কিছুতেই করতে পারো না।

-এই অফিসের মালিক আমি। অতএব সিদ্ধান্ত আমিই গ্রহণ করব। জেনিফারের কাঠোর হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কী পরিস্থিতিতে পড়ে সে যে এই মামলার দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা যদি শুনত কেনেথ। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এমন কী নিজের কাছে সে তা ব্যাখ্যা করতে পারবে না।

.

পরদিন শহরের সমস্ত খবরের কাগজে বড়ো বড়ো হরফে ছাপানো হল ভাস্কো গামবুটির মামলার ব্যাপারে। কম্বলের দোকানে ঢুকে ডাকাতি করতে গেলে এক পুলিশ কর্মচারী বাধা দিলে তাকে খুন করে। ওই মামলার আসামী পক্ষের হয়ে সওয়াল করবেন জেনিফার পার্কার।

খবরটা বিচারক লরেন্স ওয়াল্ডম্যানের নজর এড়াল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন–জেনিফার, কাগজে যা ছাপিয়েছে তা কি সত্যি?

–হ্যাঁ।

–তুমি জানো, ও কার দলের লোক? ওয়াল্ডম্যানের কন্ঠে বিস্ময়।

–হ্যাঁ, জানি।

–জেনিফার, তুমি জেনেশুনে একটা মারাত্মক ফাঁদে পা দিতে চলেছে।

না, তা নয়। আমি আমার এক বন্ধুর উপকার করছি মাত্র।

–তবুও সাবধান থাকাই ভালো।

–ধন্যবাদ। জেনিফার ফোন নামিয়ে রাখল।

জেনিফার জানত, ভাস্কো গামবুটির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব নেই। এই মামলায় জেতার মতো অস্ত্র কিছু নেই। তবে একটা উপায় আছে, সে নিহত পুলিশ অফিসার নরম্যান, স্কটের স্বভাব চরিত্র এবং অন্যান্য বিবরণ খুঁটিয়ে জানার জন্য কেনেথ বেইলিকে কাজে লাগাল।

টানা দশদিন ধরে মামলাটা চলল।

খোঁজ খবর নিয়ে কেনেথ বেইলি এসে জানাল, নিহত পুলিশ অফিসার নরম্যান স্কটের চাকরিতে বিশেষ সুনাম ছিল না। কুড়ি বছর চাকরি জীবনের মধ্যে তিনি তিনবার অকারণে গুলি চালানোর অপরাধে সাসপেন্ড হয়েছিলেন। নিরস্ত্র অবস্থায় একাধিক সন্দেহভাজন লোককে খুন করেছেন, বারে ঢুকে মাতালদের পিটিয়েছেন।

জেনিফার এইসব তথ্যগুলিকে অস্ত্র হিসাবে আদালতে পেশ করল। কাজ হল। জুরীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এলেন যে, ভাস্কো গামবুটি যে অপরাধ করেছে, তাকে খুন বলা যায় না। হাতাহাতির ফলে পুলিশ অফিসার নরম্যান স্কটের মৃত্যু হয়েছে। বিচারক জুরীদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ভাস্কো গামবুটিকে মৃত্যুদণ্ড দিলো না।

খুশী হয়ে মাইকেল মোরেটি হীরের আংটি উপহার দিলেন জেনিফারকে। সে রাতে আবার তারা শরীর নিয়ে খেলেছিল এক চরম ও পরম খেলা।

এরপর থেকে মাইকেল মোরেটি একের পর এক মামলা তুলে দিলেন জেনিফারের হাতে। আসামী পক্ষের হয়ে তাকে কাজ করতে হল। এইভাবে চলতে চলতে একসময় জেনিফার বুঝতে পারল, মাইকেল মোরেটির খপ্পরে সে একেবারে বন্দী হয়ে গেছে।

জেনিফারকে একদিন মোরেটি নিজের শ্বশুরবাড়িতে ডিনারের আসরে নিয়ে এলেন। জেনিফার মোরেটির স্ত্রী রোজা, শ্বশুর অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলি আর আইন উপদেষ্টা টমাস কোলফ্যাক্সের সঙ্গে বসে ডিনার সারল।

মোরেটির শ্বশুর গ্রানেলি শোনালেন মাফিয়া চক্রের পূর্ব ইতিহাস।

আমাদের আদি গোষ্ঠীর নাম ছিল ইউনিয়ান সিসিলিয়ামা। ক্ষমতাসীন ধনী ও বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের অত্যাচারের হাত থেকে গরীব ও দুর্বল লোকদের রক্ষা করাই ছিল এই দলের উদ্দেশ্য। গরীবদের ওপর অত্যাচার যে চালাত, তাকেই মরতে হত। ধীরে ধীরে এই দলের প্রভাব ও প্রতিপত্তি এত বেড়ে গেল যে, সরকারী আইনও তার কাছে পাত্তা পায় না। আমরা কখনও বিশ্বাসঘাতককে প্রশ্রয় দিই না। বিশ্বাসের অমর্যাদা করলে মৃত্যুঅনিবার্য।

.

গোষ্ঠীর ইতিহাস বর্ণনা করার ফাঁকে জেনিফারকেও যে হুঁশিয়ারি দেওয়া হল, সেটা বুঝতে দেরী হল না তার। বর্তমানে আমেরিকার আনাচে কানাচে মাফিয়াদের শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বহু বিলিয়ন ডলারের লেনদেন হয়। এইসব দলের যেসব সদস্যরা আইনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে, তাকেই উদ্ধার করে আনতে হবে জেনিফারকে।

একের পর এক এই ধরনের মামলা আসতে লাগল জেনিফারের কাছে। কেনেথ বেইলি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।

সে বলল–জেনিফার, এসব কী হচ্ছে? গুণ্ডা-বদমাশদের হয়ে তুমি মামলা লড়ছ, ওদের পাল্লায় পড়ে আমরা তো শেষ হয়ে যাব।

–তুমি ভেবো না। জেনিফার আশ্বাস দেয়–পাপের শাস্তি ওদের ভোগ করতেই হবে একদিন।

–ভেবো না, তুমি ওদের থেকে রেহাই পাবে।

তখনকার মতো জেনিফার এই প্রসঙ্গ থামিয়ে দিল।

.

একদিন ফাদার রায়ান এলেন জেনিফারের সঙ্গে দেখা করতে।

–তুমি নাকি আজকাল খারাপ আর বদ লোকদের সঙ্গে আইনি কারবার করছ?

বদ লোক বা অসৎ তোক কারা, ফাদার। আপনার কাছে কোনো লোক সাহায্যের জন্য এলে তাকে পাপী বলে দূরে সরিয়ে দেন? সৎ অসৎ-এর বিচার করেন?

-না, তা কখনোই করি না, ভুল করে কোনো মানুষ অপরাধ করতেই পারে। কিন্তু দুর্নীতি আর পাপ যখন হাতে হাত মিলিয়ে চলে, তখন তা ক্ষমার অযোগ্য। এসব লোককে সাহায্য করা মানে নিজেকেও ওই রকম হতে হয়।

–ফাদার, জেনিফার বলল, বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করাই আমার পেশার ধর্ম।

মাঝে মাঝে জেনিফার ভাবে, অ্যাডাম ওয়ার্নার আর মাইকেল মোরেটি মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। তারা কর্তব্যে অটল। অবশ্য দুজনের কাজের ধারা আলাদা।

.

ছয় বছরের ছেলে যোয়া এখন বাইসাইকেলে চেপে বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে যায়। জেনিফার চায়, তার ছেলে মনে ও দেহে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে উঠুক। স্বাধীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হোক। তাই সে ছেলের প্রতি অন্তহীন ভালোবাসা প্রকাশ করে না।

যোশুয়া বই পড়তে শিখেছে। গানের প্রতি আগ্রহ আছে তার। ছেলেকে নিয়ে জেনিফার মাঝে মাঝে ঘুরতে যায়। নাটক বা সিনেমা দেখে সময় কাটায়। রেস্তোরাঁয় বসে খায়। রবিবার তারা নৌকোয় চেপে জলভ্রমণ করে। বাপের অভাব বুঝতে দেয় না তাকে।

পড়াশুনা আর খেলাধুলায় চৌখস হয়ে উঠেছে সে। ক্লাসের সেরা ছাত্র। বুদ্ধি ধরে দারুণ।

স্কুলের ছুটি পড়েছে। ছেলেকে নিয়ে জেনিফার হল্যান্ডে ছুটি কাটাতে এল। গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে একসময় যোশুয়া বলে উঠল–মা, আমি এখানকার স্কুলে পড়াশুনা করতে পারব?

জেনিফারের যেন টনক নড়ল। তাইতো যোয়া বড়ো হচ্ছে। সে আরো বড়ো স্কুলে পড়বে, কলেজে পড়বে। নিজের ভাগ্য নিজে তৈরী করবে। বিয়ে করে সংসারী হবে। তখন কী আর এই মায়ের কথা সে মনে রাখবে?

এক রবিবারে কথা। সকাল বেলা। মিসেস ম্যাকের ছুটির দিন। যোশুয়া কোথায় যেন বাইরে গেছে। রাতের খাবার বানাতে হবে। ফ্রিজ খুলল। এক টুকরো কাগজ নজরে পড়ল। টেনে বের করল। তাতে লেখা আছে

আজ রাতে অ্যালানকে আমাদের বাড়িতে ডিনারে নেমতন্ন করেছি। তুমি রাগ করবে নাতো মা?

অ্যাডাম, অ্যাডামও এককালে এইভাবে তার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে ফ্রিজের ভেতরে রেখে যেত। বাপের অনেক স্বভাব ছেলে পেয়েছে।

মাঝে মধ্যে যোশুয়া তার বাবার পরিচয় জানতে চায়।

 জেনিফার কেবল বলে–তোমার বাবা ভিয়েতনামের যুদ্ধে মারা গেছেন?

–কোনো ছবি নেই?

আবার মিথ্যে বলতে হয় জেনিফারকে আমাদের বিয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাই আর ছবি তোলার সুযোগ হয়নি।

শুধু যোশুয়া নয়, মাইকেল মোরেটিও একবার যোশুয়ার পিতৃপরিচয় জানতে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। ..

জেনিফার জানে, সত্যি কথাটা মোরেটি জানলে কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাবে। যদি শোনে অ্যাডাম ওয়ার্নার ওর বাবা, তাহলে কী যে, প্রতিক্রিয়া হবে ওর মধ্যে, ভেবে পায় না জেনিফার।

সে শুধু বলল নাম জেনে কাজ নেই। কেবল জেনে রাখো, উনি ভিয়েতনামের যুদ্ধে মারা গেছেন।

.

মেক্সিকো থেকে নিষিদ্ধ মাদক দ্রব্যের পাচার সাঙ্ঘাতিক ভাবে বেড়ে যাওয়াতে সরকার গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। মাফিয়া সংগঠনগুলি এর জন্য সর্বাধিক দায়ী। মাদক দ্রব্যের বেআইনি চালান বন্ধ করতে হবে। গঠিত হল একটি তদন্ত কমিশন। সেনেটর অ্যাডাম ওয়ার্নারকে করা হল কমিশনের চেয়ারম্যান। যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো সরকার এবং অ্যাডাম ওয়ার্নারের উদ্যোগে তিন মাসের মধ্যে মেক্সিকো থেকে নিষিদ্ধ মাদকের চোরাচালান অস্বাভাবিকভাবে কমে গেল।

ব্যাপারটা মাইকেল মোরেটিকে ভাবিয়ে তুলল। নিউজার্সির কাছে ছোটো এক খামারবাড়িতে তিনি তার দলের সকলকে ডেকে পাঠালেন। ঘটনাচক্রে জেনিফারকেও সেই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে হল। এমন কি শ্বশুর অ্যান্টোনিও গ্র্যানেলি এবং আইন উপদেষ্টা টমাস কোলফ্যাক্সও সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছেন।

জেনিফার পার্কারের বুদ্ধির তারিফ করেন টমাস কোলফ্যাক্স। কিন্তু মাইকেল মোরেটি ওই মেয়েটির ওপর বড্ড বেশী ভরসা করেন, তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না, একথা ভেবে হিংসায় তার গা রি-রি করে। এই দলে তার প্রভাব ছিল যথেষ্ট, কিন্তু ওই উকিল মেয়েমানুষটা এসে সব ভণ্ড কর দিয়েছে।

বৈঠক শুরু হয়নি তখনও দেখা গেল পার্কারের বিরুদ্ধে মোরেটির কান ভাঙানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বললেন–এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ গোপন বৈঠকে একজন মেয়ে মানুষকে। ডেকে আনা ঠিক হয়নি। দলের অন্যান্য শাখার নেতাদেরও তিনি বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু তার কাথায় কেউ পাত্তা দিল না। দলের প্রধান নেতা যখন তাকে ডেকে এনেছে, এ ব্যাপারে তাদের আর কী বলার থাকতে পারে।

–তুমি অ্যাডাম ওয়ার্নারের নাম শুনেছো জেনিফার?

মাইকেল মোরেটির আচমকা আক্রমণে জেনিফার হকচকিয়ে গেল। মনে হল তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাইকেল মোরেটি ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

–আপনি, মানে–ওই সিনেটরের কথা বলছেন? কোনো রকমে ঢোক গিলে জেনিফার জবাব দিল।

-হ্যাঁ, লোকটা ভীষণ বাড় বেড়েছে। এবার ওর ডানাদুটো ছেটে দিতে হবে। ও এবার নিপাত যাবে।

-কেন মাইকেল? জেনিফারের বুকের ভেতরটা যেন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে।

–ও আমাদের কারবার লাটে তুলতে চাইছে। এর মধ্যে ওর মাথা গলাবার কী ছিল? ওর কথা শুনেই মেক্সিকো সরকার সেখানকার অনেকগুলো কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের কারবারের মালও সেখানে তৈরী হত। না, আর নয়! লোকটার এবার পরপারে যাবার সময় হয়েছে।

–মাইকেল। জেনিফার উত্তেজনা চেপে রেখে বলল, জেনে রেখো, ওকে খুন করলে তোমরাও বাঁচবে না। তাছাড়া, এখন অ্যাডাম ওয়ার্নারকে সরিয়ে দিলে দেখবে সেখানে আরও দশটা এসে দাঁড়িয়েছে, দশটাকে মেরে ফেললে আসবে একশোটা। আর খবরের কাগজগুলো ওরা কি তোমাকে ছেড়ে দেবে? রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। অ্যাডাম ওয়ার্নার খুন হলে যে তদন্ত শুরু হবে, জেনে রেখো বর্তমান তদন্ত তার কাছে কিছুই নয়।

–আমি বলছি, অ্যাডাম আমাদের ক্ষতি করছেন, আক্রোশে ফেটে পড়লেন মোরেটি।

-মাইকেল। রাগের মাথায় বোকামি করো না। এই ধরনের তদন্ত নিশ্চয়ই তুমি প্রথম দেখছ না? কতদিন ধরে চলে এসব তদন্ত। সেনেটর দীর্ঘদিন ধরে নিশ্চয়ই একটা বিষয় নিয়ে লেগে থাকবে না। কয়েক মাস পরে দেখবে, তোমাদের ব্যবসা আগের মতো রমরম করে চলছে। তোমাদের বন্ধ কারখানাগুলি আবার খুলে যাবে। এর ফলে কোথাও কোনো ঝামেলা দেখা দেবে না, অথচ তোমার ব্যবসা ঠিকই রইল। আমার কথা মতো কাজ করো মাইকেল।

–আমি আপনার যুক্তি মেনে নিতে পারছি না। টমাস কোলফ্যাক্স বলে উঠলেন। আমি বলি–

–আপনি থামুন। মাইকেল মোরেটি গর্জে উঠলেন। মনে হল কে যেন তার গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত অ্যাডাম ওয়ার্নারের প্রসঙ্গ সেবারের মতো চাপা রইল।

মাইকেল মোরেটি বললেন–ঠিক আছে, এ প্রসঙ্গ এখন থাক। সোনার ভারী লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরাতে ধরাতে তিনি বলতে শুরু করলেন, জেনিফার তোমার জন্য একটা কাজ আছে। আমার দলের এক সদস্য, নাম মার্কো লোরেঞ্জো, ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।

কী করত চাও? জেনিফার জানতে চাইল, আপিল?

না, আমি ওকে জেলের মধ্যেই রাখতে চাই।

মাইকেল মোরেটির মনোভাব বুঝতে না পেরে জেনিফার তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।

আমার কাছে খবর আছে, রবার্ট ডিসিলভা ওকে আবার সিসিলিতে ফেরত পাঠাতে চাইছেন। কিন্তু ওখানে গেলে মার্কো একদিনও বাঁচবে না। ওর শত্রুরা ওকে খতম করে দেবে। সিং সিং জেল ওর পক্ষে উপযুক্ত বছর দুয়েকের মধ্যে নিশ্চয়ই ওর শত্রুরা ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন না হয় ওকে গরাদের বাইরে আনা যাবে। এই কাজটা তোমাকে করে দিতে হবে। পারবে?

রবার্ট ডি সিলভা কোনো সমঝোতায় আসতে চান না। ওর সঙ্গে রফা করা মুশকিল।

-বেশ, তাহলে অন্য কারোকে দায়িত্বটা দেওয়া হোক। টমাস কোলফ্যাক্স ফোড়ন কাটলেন।

–না। টমাস কোলফ্যাক্সকে চুপ করিয়ে দিয়ে মোরেটি বললেন, আমি চাই, মামলাটা তুমি করো।

বৈঠক শেষ হল। যে যার বাড়ি ফিরে গেল।

জানলার পাশে এসে দাঁড়ালেন মাইকেল মোরেটি, তার ডানদিকে দাঁড়িয়ে আছে নিক ভিটো।

দেখা গেল, টমাস কোলফ্যাক্স তার সিডানে উঠে বসেছেন। স্টার্ট দিচ্ছেন।

সেদিকে তাকিয়ে মোরেটি টমাসকে লক্ষ্য করে নিককে বললেন, লোকটা বুড়ো হয়েছে। ওকে আর বাঁচিয়ে রাখার দরকার নেই।

–ওই কোলফ্যাক্সকে?

–হ্যাঁ, ওকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। আমার শ্বশুরের মতোই বুড়ো হয়ে গেছে।

বেশ তো ওস্তাদ, যেদিন বলবে, সেদিনই সাবাড় করে দেব।

–হ্যাঁ, আমি তোমায় বলব, কিছুদিন পরে।

 জজ লরেন্স ওয়াল্ডম্যানের খাস কামরায় তার উল্টোদিকের চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছেন রবার্ট ডি সিলভা আর জেনিফার পার্কার। মাকো লোরেঞ্জোকে কোন জেলে ফেরত পাঠানো হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল।

জেনিফার বলল, আমার মতে ওকে সিসিলিতেই ফেরত পাঠানো উচিত। একজন বিদেশী, বেআইনিভাবে এখানে বসবাস করবে, তা ঠিক নয়।

জেনিফারের এই প্রস্তাবে রবার্ট ডি সিলভা চমকে উঠলেন। তিনি নিজেই মার্কোকে সিসিলিতে ফেরত পাঠানোর পক্ষপাতী। কিন্তু জেনিফার যখন তার যুক্তিকে সমর্থন করছে, তখন তাকে তো অন্য কিছু বলতে হয়।

–ওকে বরং সিং সিং জেলে পাঠানো হোক। রবার্ট ডি সিলভা মন্তব্য করলেন, ওখানে। ও ঠান্ডা হয়েই থাকতে পারবে। নতুন করে কোনো ঝামেলা করবে না।

–লোরেঞ্জোর বয়স হয়েছে, জেনিফার বলতে থাকল, জেলে বন্দী থাকলে ওর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে পারে। তাছাড়া সিসিলিতে ওর বন্ধুরা আছে। জীবনের বাকি দিনগুলি ও শান্তিতেই কাটাতে পারবে।

–ওই গুণ্ডবদমাশটার জন্য আপনার দরদ দেখছি উথলে উঠছে। রবার্ট ডি সিলভা রাগে ফেটে পড়লেন।

দরদ নয়। আর পাঁচজনের মতো ওর সুবিচার পাবার অধিকার আছে।

–না, কোনো অধিকার নেই। ওর বিরুদ্ধে সবরকম অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে জজ, ওয়াল্ডম্যানের দিকে তাকিয়ে রবার্ট ডি সিলভা বললেন–ধর্মাবতার, বাজে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আপনি ওকে সিং সিং জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।

–আপনারও কি ওই একই অভিমত? কিছু বলবেন?

–জেনিফারের দিকে বিচারক ওয়াল্ডম্যান প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন।

-না, ধর্মাবতার। জেনিফার তাকাল রবার্ট ডি সিলভার দিকে। বুঝি ভষ্ম করে দেবে তাকে।

জজ ওয়াল্ডম্যান বললেন আপনারা তাহলে আসুন। এই মামলার রায় আগামীকাল। বেরোবে।

জেনিফার ওখান থেকে বেরিয়ে এসে ঢুকল একটা পাবলিক বুথে। ফোন করে মোরেটিকে জানিয়ে দিল যে, চিন্তার কোনো কারণ নেই, মার্কোকে সিং সিং জেলেই ফেরত পাঠানো হবে।

.

বিকেলবেলা অফিসে ফিরে এল জেনিফার। দেখল কেনেথ বেইলি বসে আছে।

কথাটা আমায় আগে বলেনি কেন? সরাসরি প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল কেনেথ জেনিফারের দিকে।

-কোন কথা?

–মাইকেল মোরেটির সঙ্গে তোমার যে গোপন প্রেম ও প্রণয় গড়ে উঠেছে, সেই কথা বলছি আমি।

এ নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই, কথাটা বলতে গিয়েও জেনিফার বলতে পারল না। কেনেথ তার বন্ধু। অতীতে কোনো একদিন কেনেথের সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ফলে টেবিল চেয়ার নিয়ে অফিস খুলে বসতে পেরেছিল সে। এমন কী সপিনা বিলি করার কাজও তাকে জুটিয়ে দিয়েছিল। তখন জেনিফারের আর কোনো রোজগার ছিল না।

–এ প্রসঙ্গ থাক কেনেথ। জেনিফার শান্ত গলায় বলল।

–কেন? থাকবে কেন? কেনেথ গর্জে উঠল। যে লোকটা তোমার একদিন সর্বনাশ করতে চেয়েছিল, তার সঙ্গেই কিনা। ছিঃ ছিঃ, কান পাতা যাচ্ছে না। সবাই বলছে তুমি নাকি মাইকেল মোরেটির রক্ষিতা হয়ে গেছে। সে একটা নরকের কীট। নর্দমার পোকা। তুমি ওই নর্দমার যত নোংরা এই অফিসে এনে তুলেছে। আর নিজের স্বার্থরক্ষার জন্যই আমাদেরও ওই কাজে লাগিয়েছে। তুমি জাহান্নামে যাও, আমি দেখতে যাব না। আমি আর এই অফিসে থাকতে চাই না। আমি চললাম।

জেনিফার বলল–কেনেথ, তুমি শুধু শুধু উত্তপ্ত হচ্ছে। লোকটার মনটা ভারী ভালো। আলাপ হলে তোমার এই ধারণা পাল্টে যেত।

উত্তেজনার বশে কথাটা বলে জেনিফার বুঝতে পারল, কী সাংঘাতিক ভুল করে ফেলেছে, নিজের মনের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিয়েছে।

জেনিফার, তুমি অনেক পাল্টে গেছে। কেনেথের কণ্ঠে এক রাশ বেদনা, তোমার প্রথম দিনের প্রতিমূর্তি আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। আমি সেদিনের সেই জেনিফারকে মনে রেখে বিদায় নিলাম তোমার কাছ থেকে, যোশুয়াকে আমার বিদায় জানিও।

কেনেথ চলে গেল। জেনিফার কান্নায় ভেঙে পড়ল। ডেস্কের ওপর মাথা রেখে বসে রইল।

রাত হয়েছে। জেনিফার চোখ মেলে তাকাল। চারপাশ অন্ধকার। জানলার সামনে এসে দাঁড়াল। শহরের পথ আলোতে ঝলমল করছে। গোটা শহরটা যেন এক জঙ্গল। এই জঙ্গলের রাজা একজন–মাইকেল মোরেটি। এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসার পথ আজ বন্ধ।

.

আমেরিকান বার অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হবে আকাপুলকোয়। জেনিফার সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ পত্র পেয়েছে। আকাপুলকো মেক্সিকোর একটি বিখ্যাত শহর। সমুদ্রের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। মার সঙ্গে বেড়তে যাবে শুনে যোশুয়া খুশিতে নেচে উঠল।

বিকেল চারটের সময় বেলিটো জুয়ারেজ এয়ার পোর্টে প্লেন থেকে নামল জেনিফার আর যোশুয়া। আকাপুলকো থেকে আট মাইল দূরে লাসরিসাসের একটা বড়ো হোটেলের বাংলো আগে থেকে সে ভাড়া করেছিল, সেখানে গিয়ে উঠল।

.

বিশাল হল ঘরের ভেতর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাড়ে সাত হাজার প্রতিনিধি এখানে এসে জড়ো হয়েছে। তারা গল্পগুজব করছে। মঞ্চের ওপর কয়েকজন প্রতিনিধি বসে আছে। একজনকে দেখে জেনিফার চমকে উঠল–অ্যাডাম। অ্যাডাম ওয়ার্নার।

বেশ কয়েক বছর পর সে অ্যাডামকে আজ সামনা সামনি দেখল। তাদের শেষ দেখা হয়েছিল যখন ওর বউ মেরিবেথ গর্ভবতী ছিল।

জেনিফার ঠিক করল সভা শেষ হবার আগেই এখান থেকে চলে যাবে। অ্যাডাম জানে না, এখানে তার ছেলে যোশুয়া উপস্থিত আছে।

মাননীয় সুধিবৃন্দ, বার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান বলতে শুরু করলেন। আমাদের প্রধান অতিথি সেনেটর অ্যাডাম ওয়ার্নার আপনাদের সামনে এখন বক্তব্য রাখবেন। উনি হলেন নিউইয়র্ক বার অ্যাসোসিয়েশনের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কৃত করবেন বলে আমরা আশা রাখি।

অ্যাডাম ওয়ার্নার মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন–

মাননীয় সভাপতি এবং সদস্যবৃন্দ। আমরা আজ এখানে সবাই মিলিত হয়েছি একটাই উদ্দেশ্যে তা হল ভাবের আদান প্রদান।

আজকের যুক্তরাষ্ট্রের আইনবিদরা বিভিন্ন মহলের তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছেন। এমন কী, সুপ্রীম কোর্টের চিফ জাস্টিস নিজেও আমাদের মহান পেশার প্রতি কটাক্ষপাত করেন মাঝে মাঝে, যা আগে কখনও ঘটেনি…

অ্যাডামের ভাষণ শেষ হল। জেনিফার এবার বেরিয়ে আসার জন্য তৈরী হল। কিন্তু তাকেও ঘিরে ধরেছে কত মানুষ। কারণ আইনজীবী হিসেবে জেনিফার যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে। তার সঙ্গে অনেকেই আলাপ করতে চাইছে। ভিড় কাটিয়ে বেরিয়ে আসতেই অ্যাডাম ওয়ার্নার তাকে দেখে ফেলল।

-জেনিফার।

অ্যাডামের কণ্ঠস্বর। পালাবার সুযোগ পেল না জেনিফার। অ্যাডাম নিজেই তার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়াল।

-তোমাকে কতবার টেলিফোন করে, চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। তুমিও তো যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনি।

অ্যাডামের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জেনিফার চুপ করে রইল।

তোমার অনেক কথা কাগজ পড়ে জানতে পাই। অ্যাডাম আবার বলল।

–আমিও কাগজে তোমার সম্পর্কে অনেক খবর পড়েছি। জেনিফার বলল, মনে মনে আমি খুব গর্ববোধ করি।

-জেনিফার, তোমার জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। মাইকেল মোরেটির বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ যোগাড় করাই আমার কমিটির কাজ। লোকটা আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না।

–অ্যাডাম, ও আমার মক্কেল। তাঁর সম্পর্কে কোনো আলোচনা আমি তোমার সাথে করতে পারি না।

–তুমি বিয়ে করোনি জেনিফার।

না।

অল্পক্ষণের নীরবতা। অ্যাডাম জানতে চাইলেন–আজ রাতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি। তুমি রাজী?

-না।

–জেনিফার, তুমি এভাবে আমার সামনে থেকে পালিয়ে যেতে পারো না। তোমাকে অনেক কথা বলার আছে আমার।

–অ্যাডাম। জেনিফারের কণ্ঠে মিনতি, আমরা এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি না। বিশেষ করে মাইকেল মোরেটি তোমার শত্রু যেখানে

আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে ডিনার খাবে। আমার এক বন্ধুর মোটর বোট পেয়েছি। পালোমা ব্লাঙ্কা। ঠিক আটটায় ইয়ার্ট ক্লাবে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।

–আমি যেতে পারব না।

–কোনো কথা শুনব না। তোমার জন্যই বসে থাকব।

ওরা যখন কথোপকথনে ব্যস্ত ছিল তখন বারের এককোণে বসে মাইকেল মোরেটির এক সাগরেদ নিক ভিটো ওদের ওপর নজর রেখেছিল। কিন্তু জেনিফার বা অ্যাডাম ওয়ার্নার তা জানতে পারল না।

.

নিউইয়র্কে ফিরে এসেছে জেনিফার। যোশুয়া অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার মাথার পেছনদিকটা আলুর মতো ফুলে উঠেছে। আকাপুলকোয় থাকার সময় সমুদ্রে ওয়াটার স্কি করতে গিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গিয়েছিল সে। সম্ভবত সেই কারণে–

ছেলেকে নিয়ে জেনিফার হাসপাতালে এল। মাথায় চোট লাগার ফলে যোশুয়ার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাথা অপারেশন হল। কিন্তু যোশুয়া আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল না।

জেনিফারের বিশ্বাস হল না যে, তার একমাত্র সন্তান আজ আর বেঁচে নেই। সে একটুও ভেঙে পড়ল না। নিজের হাতে ছেলেকে শেষ সাজে সাজিয়ে দিল।

যোশুয়া কবরের অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে। জেনিফার বাড়ি ফিরে এল। সে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেল। বাড়ির সর্বত্র যোশুয়ার স্মৃতি চিহ্ন, খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করে সে একাকিনী পাঁচদিন কাটিয়ে দিল যোশুয়ার ঘরে।

জেনিফারের খোঁজ না পেয়ে মাইকেল মোরেটি তার সাঙ্গপাঙ্গদের পাঠালেন। ঘরের জানলা ভেঙে তারা ভেতর ঢুকল। অর্ধ অচেতন জেনিফারকে তারা হাসপাতালে ভর্তি করে দিল।

.

 এদিকে টমাস কোলফ্যাক্সকে খুন করার নির্দেশ পেয়েও নিক ভিটো কাজটা করতে পারল না। হাজার হোক ওই লোকটা তাকে আর ভাইকে একাধিক খুনের মামলা থেকে বাঁচিয়েছে। সেই কৃতজ্ঞতার কথা মনে রেখে সে কোলফ্যাক্সকে নিউইয়র্ক ছেড়ে প্লেনে চেপে ওয়াশিংটনে চলে আসতে সাহায্য করল।

টমাস কোলফ্যাক্স উঠলেন ক্যাসিটন হোটেলের ১৪ নম্বর ঘরে। অ্যাডাম ওয়ার্নারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করলেন। মাইকেল মোরেটির যাবতীয় অপরাধের বিবরণ তিনি জানাবেন, কিন্তু তার বিনিময়ে তাকে দিতে হবে নিরাপত্তা।

অ্যাডাম ওয়ার্নার টমাস কোলফ্যাক্সের এই প্রস্তাবে রাজী হলেন। এতো মেঘ না চাইতেই জল।

তিনি ক্যাসিটন হোটেলে এলেন। টামস কোলফ্যাক্সের সঙ্গে কথা বললেন। অ্যাডাম প্রতিশ্রুতি দিলেন, দেশ ছেড়ে চলে যাবার মতো প্রচুর টাকা সরকারের পক্ষ থেকে টমাস পাবেন এবং একটি নতুন পরিচয় পত্র।

টমাস কোলফ্যাক্সকে জেরা করতে অ্যাডাম ওয়ার্নারের সঙ্গে এসেছিলেন ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা এবং এফ বি আই-এর সহকারী ডিরেক্টর।

–আপনার অবর্তমানে মোরেটির আইন উপদেষ্টার কাজ কে করবেন?

ডি সিলভার প্রশ্নের জবাবে টমাস বললেন মিস জেনিফার পার্কার। উনি মোরেটির খুব কাছের লোক হয়ে উঠেছেন।

অ্যাডাম জানেন, মাইকেল মোরেটি জেনিফারের মক্কেল। কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলেন, কোলফ্যাক্স যেন অন্য প্রসঙ্গে চলে আসেন।

কিন্তু টমাস তখন জেনিফারের মুন্ডছেদ করে গায়ের ঝাল মেটানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন।

–মোরেটির নানারকম আর্থিক প্রতারণার সঙ্গে, এমন কী একটা খুনের সঙ্গেও জেনিফার জড়িয়ে পড়েছেন।

খুন? প্ররোচনা? জেনিফার? ঘরের ভেতর বোমা ফাটলেও অ্যাডাম এতটা বিচলিত হতেন না। তিনি বুঝতে পারছেন, জেনিফার ভয়ানক একটা ঝামেলার মধ্যে পড়তে চলেছে। ওকে সাবধান করে দেওয়া উচিত। যেভাবেই হোক জেনিফারকে খুঁজে বের করবেন তিনি।

মাফিয়াদের সবকটি সংগঠনের বিরুদ্ধে এবার তারা চূড়ান্ত অভিযানে নামলেন, এত বড়ো অভিযান যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম।

এর পাশাপাশি অ্যাডাম জেনিফারের খোঁজ করতে লাগলেন। তার অফিসে বারবার ফোন করলেন। ওর সহকর্মীরা সঠিক কোনো খবর জানে না তার।

অ্যাডাম খুব ভালো ভাবেই জানেন, এফ বি আই, কাস্টমস, ইন্টারন্যাল রেভিনিউ এইসব সংগঠন মোরেটি সমেত মাফিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামলে যাদের গ্রেপ্তার করা হবে, তাদের নামের তালিকায় জেনিফার পার্কারের নামও থাকবে।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে জেনিফার। পাহাড়ের ওপরে একটা বাড়িতে সে এসে উঠেছে, মাইকেল মোরেটিরই বাড়িটি।

মাইকেল একদিন সেই বাড়িতে এলেন। জানালেন বিশেষ একটা কাজে জেনিফারকে সিঙ্গাপুরে যেতে হবে। সন্তানের অসময়ে মৃত্যু, একাকীত্ব এবং অপরাধবোধ জেনিফারের মনে তখন এক নতুন চেতনার জন্ম দিয়েছে। সে স্থির করল আর নয়, মাইকেল মোরেটির কাছ থেকে দূরে অন্য কোথাও চলে যাবে। নতুন করে জীবন শুরু করবে। সিঙ্গাপুরের কাজটাই হবে তার শেষ কাজ।

.

জেনিফারের ওপর মাইকেল মোরেটির আগেই সন্দেহ হয়েছিল। আকাপুলকোতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার সেই সন্দেহকে আরও দৃঢ় করল।

জেনিফার এখন সিঙ্গাপুরে। মাইকেল মোরেটি লোক লাগিয়ে জেনিফারের সমস্ত অতীত খবর সংগ্রহ করলেন। জানতে পারলেন, জেনিফার আগে বেলমন্ট টাওয়ার্সে একটি পাঁচ কামরার অ্যাপার্টমেন্টে থাকত। সেখানে অ্যাডাম ওয়ার্নার নামে এক পুরুষ বন্ধু আসত। এবং তারা এক সঙ্গে রাত কাটাত।

তার মানে? তার মানে জেনিফার আর অ্যাডাম ওয়ার্নার একসঙ্গে শলা-পরামর্শ করে তার সর্বনাশ করার খেলায় মেতে উঠেছে। প্রতিহিংসার নেশায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন মাইকেল মোরেটি। এমন কি টমাস কোলফ্যাক্স যে বেঁচে আছে, সে খবরও তার অজানা রইল না। বাইরে থেকে পুসিক অ্যাসিড মেশানো খাবার চরের মাধ্যমে ম্যারিনস বাহিনীর অফিসার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিলেন। সেই বিষাক্ত খাবার খেয়ে টমাস কোলফ্যাক্সের মৃত্যু হল।

সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এল জেনিফার। নিউইয়র্কের মাটি স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে তাকে এফ বি আই গোয়েন্দারা গ্রেপ্তার করল।

জেনিফার এফ বি আই-এর হাজত থেকে মাইকেলকে ফোন করল–মাইকেল, আমি জেনিফার। রাইকার আইল্যান্ডে আমি বন্দী, আমার জামিনের ব্যবস্থা কে করবে?

শান্ত হও। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। জিনো যাচ্ছে। ও সব ব্যবস্থা করবে। ফোন নামিয়ে রেখে মোরেটি জিনোকে ডেকে পাঠালেন।

–শোনো জিনো, জেনিফার পার্কারকে এফ বি আই রাইকার আইল্যান্ডে আটকে রেখেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ওর জামিন হয়ে যাবে। তারপর সোজা ওকে এখানে নিয়ে আসবে। আর হ্যাঁ, পথে আসতে আসতে, জেনিফারকে জানিয়ে দিও যে অ্যাডাম ওয়ার্নারকে নিয়ে আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই।

তার মানে? জিনোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

-হ্যাঁ। আজ নিউ ক্যানানের ব্রীজে একটা দুর্ঘটনা হবে। বক্তৃতা দিয়ে যাবার পথে অ্যাডাম ওয়ার্নারের মৃত্যু হবে।

.

জেনিফার পার্কার যাতে জামিন না পায়, তার জন্য অনেক চেষ্টা করলেন রবার্ট ডি সিলভা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করতে হল তাকে। পাঁচ লক্ষ ডলার জামিনে জেনিফার খালাস হল।

আদালত থেকে ফিরছে জেনিফার। জিনো একথা সেকথার পর জানিয়ে দিল যে, নিউ ক্যানানের ব্রীজে এক দুর্ঘটনায় ভাষণ দিতে যাবার পথে অ্যাডাম ওয়ার্নারের মৃত্যু হবে। কথাটা শুনে জেনিফারের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। সে ছুতো করে একটা ওষুধের দোকানে গাড়ি দাঁড় করাল। জিনোর নজর এড়িয়ে একটা টেলিফোন বুথে ঢুকে পড়ল। রবার্ট ডি সিলভাকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে মাইকেল মোরেটি অ্যাডাম ওয়ার্নারকে খুন করার এক মারাত্মক ষড়যন্ত্র করছেন।

.

জেনিফারের অপেক্ষাতেই মাইকেল মোরেটি বসেছিল।

-মাইকেল, তোমায় দেখে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, তা তোমায় বুঝিয়ে বলতে পারছি না। জেনিফার সরাসরি কথাটা বলল।

আমিও তোমার অপেক্ষায় বসে আছি জেনিফার।

 মেয়েটার অভিনয়ের প্রশংসা করলেন মোরেটি মনে মনে। অ্যাডাম ওয়ার্নারের সঙ্গে যোগসাজশ করে তার সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে, আর এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।

–তুমি ভালো আছে তো?

জেনিফারের প্রশ্নের জবাবে মোরেটি বললেন, খুব ভালো। এত ভালো এর আগে কখনও ছিলাম না। সেনেটর অ্যাডাম ওয়ার্নার দুর্ঘটনায় মারা যাবেন। একটু পরেই খবরটা পাব।

জেনিফার উঠে দাঁড়াল–আচ্ছা, আমি এখন আসি।

বসো। মাইকেলের কণ্ঠস্বর হিমশীতল।

মাইকেল

শান্ত হয়ে বসো।

ঘরের বন্ধ দরজায় তখন ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিনো। তার কঠিন মুখ, ভাবলেশহীন দৃষ্টি।

–মাইকেল, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

–একটাও কথা বলবে না, চুপ করে বসে থাকো।

এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। মোরেটি ফোন তুললেন। কথা বললেন। ফোনের লাইন কেটে গেল।

–নিউ ক্যানান ব্রীজে পুলিশের ঢল নেমেছে।

তার মানে?

তার মানে ওখানেই তো অ্যাডাম ওয়ার্নার খুন হবে।

.

ব্যারিটন নদীর ওপর জোড়া ব্রীজের দিকে সেনেটর অ্যাডাম ওয়ার্নারের লিমুজিন গাড়িটা ছুটে আসছিল। তার সঙ্গে ছিলেন তিনজন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট। ব্রীজের মুখে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছিল একটা ট্রাক। লিমুজিন ব্রীজে উঠে এল। ট্রাকটিও উঠে এল। দুটি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষের খেলা শুরু হল।

–গাধা নাকি! লিমুজিনের ড্রাইভার বিরক্ত হল। এইটুকু ছোটো ব্রীজের ওপর দিয়ে পাশাপাশি দুটো গাড়ি কখনও যেতে পারে, সে হুঁশ নেই।

লিমুজিন স্পিড বাড়িয়ে দিল। ট্রাকও সেই গতিতে ছুটল। পর মুহূর্তেই লিমুজিন এক ধাক্কা খেল। লিমুজিন ব্রীজের ডানদিকের রেলিং ভেঙে বিপদজনকভাবে ঝুলে রইল। ট্রাকটি লিমুজিনকে বারবার আঘাত করল, যাতে দুশো ফুট নীচে ব্যারিটন নদীর অতলে ডুবে যায়।

অ্যাডাম এবং অন্যান্য আরোহীদের জীবন তখন মৃত্যুর কিনারায় এসে গেছে।

ট্রাকের ধাক্কা খেতে খেতে লিমুজিন ব্রীজের একেবারে কানায় এসে এমনভাবে ঝুলে রইল, যে একচুল নড়লেই জলে পড়ে যাবে।

ঠিক এই সময় কোথা থেকে দুটো হেলিকপ্টার এসে হাজির হল ব্রীজের ঠিক মাথার ওপর। হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁকে ঝাকে গুলি ছুটে আসছে ট্রাক এবং তার ড্রাইভারকে লক্ষ্য। করে। ট্রাক স্তব্ধ হল। গোটা দুয়েক স্কোয়াড কার এসে থামল। উর্দিপরা পুলিশ অফিসাররা নেমে এলেন। তাদের হাতে উদ্যত রিভলবার। লিমুজিন গাড়ি থেকে অ্যাডাম ওয়ার্নার এবং অন্যান্য আরোহীদের বেরিয়ে আসতে সাহায্য করলেন, অবশ্য জানলা দিয়ে।

.

বাবা, নিশ্চিন্ত হলাম। মাইকেল মোরেটি বলে উঠলেন, তোমার পুরুষ বন্ধুর ভবলীলা সাঙ্গ।

না, এ অসম্ভব। ফ্যাকাশে মুখে জেনিফার চিৎকার কর উঠল।

–আহা-হা, চটছো কেন। তুমিও সুবিচার পাবে। মোরেটি লাফিয়ে উঠে জেনিফারের মুখে কয়েকটা আঘাত করলেন। জেনিফার মেঝের ওপর পড়ে গেল।

জিনোকে গাড়ি আনতে বলল মোরেটি। জিনো প্রভুর নির্দেশ পালন করতে ঘরের বাইরে চলে গেল।

–তোমায় আমি ভালোবেসেছিলাম। আর তুমি কিনা এইভাবে আমার সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিলে?

জেনিফার নীরব। ওকে হ্যাঁচকা টানে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করাল মোরেটিআমাকে দিয়ে শরীরের সাধ মেটাবে তাই না। ওসব ভুলে যাও। যে নদীতে অ্যাডাম ডুবে মরেছে, তোমাকেও ওখানে পাঠিয়ে দেব। তারপর তোমরা দুজনে জলের গভীরে শুয়ে যত খুশী সোহাগ করো।

বস্। জিনো গ্যালো প্রায় ছুটতে ছুটতে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। তার মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আতঙ্কে আর উত্তেজনায় কাঁপছে সে সর্বনাশ হয়ে গেছে বস্। বাইরে… ।

জিনোর কথা শেষ হল না। প্রচণ্ড একটা শব্দ শোনা গেল, কী যেন ভেঙে পড়েছে। মাইকেল মোরেটি ড্রয়ার থেকে রিভলবারটা হাতে তুলে নিলেন।

সাবধান। একপাও নড়বেন না। ইতিমধ্যে দুজন এফ বি আই এজেন্ট ঘরে এসে ঢুকে পড়েছেন। তারা রিভলবার উঁচিয়ে আছেন।

নিমেষের মধ্যে মাইকেল মোরেটি তার আশু কর্তব্যটি স্থির করে ফেললেন। পরপর । তিনটি গুলি ছুঁড়ে দিলেন জেনিফারকে লক্ষ্য করে।

এজেন্ট দুজনের রিভলবার গর্জে উঠল। দুটি বুলেট এসে বিদ্ধ করল মাইকেল মোরেটির হৃৎপিন্ড। তারপর আরো একটি গুলি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মাইকেল মোরেটি পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন।

.

অপারেশন থিয়েটার থেকে জেনিফারকে নিয়ে আসা হল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে। তখনও তার জ্ঞান ফেরেনি।

উর্দি পরা পুলিশ কর্মচারী, সাদা পোশাকের গোয়েন্দা আর খবরের কাগজের রিপোর্টারে গোটা হাসপাতাল গিজগিজ করছে।

রিসেপশনে এসে দাঁড়াল কেনেথ বেইলি–আমি জেনিফার পার্কারকে একবার দেখতে যেতে পারি কি?

আপনি কি ওর আত্মীয়?

না, বন্ধু।

দুঃখিত বাইরের লোকেদের এখন ঢোকার অনুমতি নেই। ওর এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

–বেশ, আমি তাহলে অপেক্ষা করি।

হাসপাতালের লাগোয়া একটি ছোটো ঘরে এসে ঢুকলেন অ্যাডাম ওয়ার্নার, সঙ্গে একদল সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট।

–মিস পার্কারের শরীর এখন কেমন? একজন ডাক্তারকে অ্যাডাম প্রশ্ন করলেন।

আমরা পুরোপুরি ওর সেরে ওঠার ওপর ভরসা করতে পারছি না। তিনটে বুলেট তার শরীরে গেঁথেছিল।

এই সময় ডিস্ট্রিক্ট এ্যাটর্নি রবার্ট ডি সিলভা ওই ঘরে প্রবেশ করলেন–অ্যাডামকে দেখে বললেন–আপনি নিশ্চয়ই সুস্থ আছেন?

–আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব। অ্যাডাম বললেন, আচ্ছা আপনি খবরটা জানলেন কী ভাবে?

জেনিফার পার্কারের কাছ থেকে। আমাকে ফোন করে বলেছিল নিউক্যানান ব্রীজে ওরা আপনাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছে। আমি ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দিইনি নিশ্চয়ই শত্রুপক্ষের কোনো চাল, আমাদের বিভ্রান্ত করতে চাইছে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম ঝুঁকি নিয়ে কাজ নেই। তাই পুলিশকে খবর দিলাম। ওরা ব্রীজ ঘিরে ফেলল। আপনি যেখান দিয়ে আসছেন সেখানেও পুলিশের হেলিকপ্টার গেল। জেনিফার পার্কারই এসবের মূল পান্ডা। সে আপনাকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল বলে মনে হয়।

–না, অ্যাডাম কঠিন এবং কঠোর গলায় বলে উঠলেন, জেনিফার সম্পূর্ণ নির্দোষ। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই।

–ডাক্তারদের সঙ্গে অ্যাডাম ওয়ার্নার এসে ঢুকলেন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, সেখানে জেনিফার অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। চোখ দুটি বন্ধ। মুখ ফ্যাকাসে। স্যালাইন আর রক্ত চলছে ফোঁটা ফোঁটা।

অ্যাডাম তাকালেন জেনিফারের দিকে। মনে পড়ে গেল সেই সেদিনের কথা। সেদিন জেনিফার রেগে গিয়ে তাকে বলেছিল–টাকা নিলে আমি এমন নোংরা পরিবেশে বাস করতাম? আপনি আপনার যা খুশী রিপোর্ট দিন, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি একা থাকতে চাই।

সেই জেনিফার ছিল সাহসী, সে ছিল আদর্শবতী। সততা ও ন্যায়বিচারের পক্ষপাতি। আদর্শকে সে কখনও বিসর্জন দিতে চায়নি। তাহলে আজ? আজ কেন তার এই দুর্মতি? জেনিফারকে তিনি ভালোবেসেছেন। আজও একইরকম ভালবাসেন তাকে। একটা মারাত্মক ভুলের জন্য আজ তাদের সবার জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে। এর জন্য অ্যাডাম নিজেকেই দায়ী করেন। তিনি জানেন, ওই অপরাধবোধ তাকে আমৃত্যু খুবলে খুবলে খাবে।

-উনি কেমন থাকেন, আমায় জানাবেন–অ্যাডামের কথা যেন বন্ধ হয়ে এল।

নিশ্চয়ই। ডাক্তার জবাব দিলেন।

জেনিফারের দিকে তাকালেন অ্যাডাম ওয়ার্নার। নীরবে তাকে বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে তখন সাংবাদিকদের দল তার জন্য অপেক্ষা করছে।

তন্দ্রাচ্ছন্ন জেনিফার শুনতে পেল সেই গলার আওয়াজ–যোশুয়া নেই। অ্যাডাম নেই, মাইকেল নেই। কে যেন তার কানে কানে এই দুঃসংবাদ শুনিয়ে গেল।

নিঃসঙ্গ এবং একাকিনী জেনিফার তখন শান্তির এক জগতে বিরাজ করছে। একটা শীতল অনুভূতি তার সর্বাঙ্গে ছেয়ে গেল। তার সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটে গেল।

.

জানুয়ারি মাস। হাড় কাঁপানো শীত। যুক্তরাষ্ট্রের চল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাডাম ওয়ার্নার শপথ গ্রহণ করবেন।

ওয়াশিংটনের কেলসোতে একটা ছোট্ট আইন, প্রতিষ্ঠানের অফিসে বসে আছে জেনিফার। সে টিভি সেট চালিয়ে দিল। প্রেসিডেন্ট অ্যাডাম ওয়ার্নারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান সে দেখতে থাকল। তার পাশে বসে আছে স্ত্রী মেরীবেথ, সম্ভবত সে আবার মা হতে চলেছে, তাদের মেয়ে সামান্থাকেও দেখা গেল।

অনুষ্ঠান শেষ। দেখা গেল অ্যাডাম ওয়ার্নার স্ত্রী মেরীবেথ ও কন্যা সামান্থাকে সঙ্গে নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন। এবার তারা বাড়ি ফিরে যাবেন হয়তো।

জেনিফার টিভি সেট বন্ধ করে দিল। অফিসের বাইরে দেওয়ালে আঁটা সাইনবোর্ডের দিকে আচম্বিতে তার নজর পড়ে গেল–জেনিফার পার্কার। এ্যাটর্নি অ্যাট ল।

এখন থেকে জেনিফার ন্যায় ও সুবিচারের প্রতি আত্মনিবেদিত থাকবে। সে আদালতের দিকে হেঁটে চলেছে। সেখানে কেউ নেই। কেবল তুষার পড়ছে। সেই তুষার কণার মধ্যে দিয়ে সে ভবিষ্যতের পথকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে।

আসলে জেনিফার পার্কার তখন একটাই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে–কেন আমার জীবনের সব হাসি আর আনন্দ এভাবে স্তব্ধ হয়ে গেল?