১১.
টনি রিজোলির সমস্যার পাহাড় ক্রমশ উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি তাকে দাঁড়াতে হচ্ছে, যার জন্য তাঁকে দোষারোপ করা যায় না।
অনেক ঘটনাই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। ব্যবসাটা আর আগের মতো তেজি অবস্থায় নেই। এথেন্স অবধি মাল আনাটা কোনো সমস্যা নয়। ওয়ারহাউসের মধ্যে সেগুলোকে জমিয়ে রাখা যায়। ইতিমধ্যে টনি বুদ্ধি করে এয়ারলাইন্সের একজন স্টুয়ার্টকে কিনে নিয়েছেন। এথেন্স থেকে নিউইয়র্ক অবধি আকাশ পথে মালের দায়িত্ব তাকে নিতে হয়। দেখা গেল চব্বিশ ঘণ্টা আগে ওই লোকটা ধরা পড়ে গেছে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে তাকে।
সংবাদটা শুনে টনি রিজোলির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। এত ডলারের মাল কি তবে পচে যাবে নাকি! নাঃ, বিকল্প পথের সন্ধান করতে হবে। খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে দিলে কেমন হয়? সত্তর বছর বয়সের একজন ট্যুরিস্ট, নাম সারা মার্চিসন, এথেন্সে এসেছিলেন তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। একটা সুটকেস নিয়ে তিনি নিউহয়র্কে চলে যাবেন। তিনি জানতেই পারবেন না, এই সুটকেসের মধ্যে কি বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
–আমি আমার মায়ের জন্য কতকগুলি স্যুভেনির পাঠাতে চাই। মিঃ রিজোলি বলেছিলেন–আপনাকে দেখে মনে হল, এই কাজের জন্য আপনি উপযুক্ত। আমি আপনার টিকিটের দাম দিয়ে দেব।
সারা মার্চিসন বলেছিলেন-না না, এর জন্য কিছুই দিতে হবে না। আপনার জন্য এই কাজটা করতে পারলে আমি নিজেকে কৃতার্থ বলে মনে করব। আপনার মায়ের অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই আমি থাকি। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে আছি।
–আমার মনে হয়, তিনিও আপনাকে দেখে খুশি হবেন। টনি রিজোলি বলেছিলেন, সমস্যা হল, উনি অত্যন্ত অসুস্থ। এই সুটকেসটা ওঁর কাছে পৌঁছোতে হবে।
-আহা, সারাকে দেখে মনে হয়, এমন ভালো ভদ্রমহিলা সহজে দেখা যায় না। তিনি আমেরিকার গড়পরতা ঠাকুমাদের মতো স্নেহপ্রবণ। কিন্তু ওঁর কাঁধে এমন একটা দায়িত্ব। চাপিয়ে দেওয়া কি উচিত?
–আমি আপনাকে হোটেল থেকে তুলে নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেব।
ঠিক আছে, এত চিন্তা করতে হবে না। আপনার মতো এমন সুসন্তানের জননী হয়ে মা নিশ্চয়ই খুবই অহংকার বোধ করেন।
–হ্যাঁ,…যা বলেছেন।
উনি মিথ্যে করে বললেন, সত্যিটা হল দশ বছর আগে তার মা পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
***
পরদিন সকালবেলা রিজোলি হোটেল থেকে বেরোতে যাবেন, ওয়ারহাউস অভিমুখে যাত্রা করবেন, টেলিফোন আর্তনাদ করতে থাকে।
মিঃ রিজোলি? একটা অচেনা কণ্ঠস্বর।
–কে বলছেন?
–এথেন্স হাসপাতাল থেকে ডক্টর পাটসাকা বলছি। এমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে। শ্রীমতী সারা মার্চিসন নামে একজন এখানে এসে ভর্তি হয়েছেন। গতরাতে তিনি হঠাৎ পড়ে গেছেন। কোমর ভেঙে গেছে। তিনি খুবই উদ্বিগ্ন। এই খবরটা আপনাকে জানাতে বললেন।…টনি রিজোলির মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেল। এখন কী করা যায়? আরেকটা জীবন্ত খচ্চরের সন্ধান করতে হবে।
রিজোলি জানেন, কাজটা ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। আমেরিকান নারকোটিক্স বাহিনী সজাগ হয়ে উঠেছে। তবে এথেন্সের আশেপাশে হয়তো কোনো সরল সাদা মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে। কীভাবে? এথেন্স থেকে যেসব প্লেন উড়ে যাচ্ছে, প্রত্যেক যাত্রীদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। জাহাজের যাত্রীদেরও ছাড়া হচ্ছে না।
–তাহলে? কী হবে? যদি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। পুলিশের কাছে কোনো ভাবে খবর পৌঁছে যায়। বিশ্বাসঘাতকের তো অভাব নেই। ওয়ারহাউসে তল্লাশ চালালেই হল। এমন অনেক নিষিদ্ধ বস্তুর সন্ধান পাওয়া যাবে যার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। সমস্যা বাড়ছে, পরিবারের সকলের কাছে ঘটনাটা বলবে না কি…
টনি রিজোলি হোটেল পরিত্যাগ করলেন। তাকে খুব তাড়াতাড়ি অন্য একটা জীবন্ত খচ্চর খুঁজে পেতেই হবে। প্যাটিসন স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সিটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জে চলে এলেন। তিনি জানেন না, তাঁর হোটেলের ফোন ইতিমধ্যেই সন্দেহের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে কিনা। তিনি কোনো বিপদের সামনাসামনি দাঁড়াতে চাইলেন না।
৮৫নং প্যাটিসন, একটা বাদামি পাথরের বাড়ি। সামনে অনেকগুলো পিলার দাঁড়িয়ে আছে। লেখা আছে? ও টি ই। রিজোলি ভেতরে ঢুকে পড়লেন, চারপাশে তাকালেন। দেওয়ালের ধারে চব্বিশটি টেলিফোন বুথ। প্রত্যেকটাতে আলাদা নম্বর দেওয়া। টেলিফোন ডাইরেক্টরি রয়েছে তাকে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সেগুলোকে আনা হয়েছে। চারজন ক্লার্ক বসে বসে কাজ করছেন। কখন কোথায় কাকে ফোন করতে হবে, সবকিছু তাদের নখদর্পণে।
মানুষজন উদগ্রীব চিত্তে দাঁড়িয়ে আছেন।
টনি ভদ্রমহিলার কাছে এগিয়ে গেলেন। বললেন–সুপ্রভাত।
কীভাবে আপনাকে সাহায্য করব? একটা ওভারসিজ কল বুক করবেন কি?
আপনাকে অন্তত ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু।
–ঠিক আছে, আমার কোনো সমস্যা নেই ম্যাডাম। আমি অপেক্ষা করছি।
আপনি কি সংখ্যাটা আমাকে দেবেন?
টনি রিজোলি ইতস্তত করতে থাকেন। তারপর ভদ্রমহিলার হাতে একটা চিরকূট দিয়ে বলেন–আপনি চেষ্টা করে দেখবেন?
–আপনার নাম?
–ব্রাউন, টম ব্রাউন।
–ঠিক আছে মিঃ ব্রাউন, আপনার পালা এলে আপনাকে ডেকে নেব।
অনেক ধন্যবাদ।
রিজোলি বেঞ্চে গিয়ে বসলেন।
কীভাবে পাঠানো যেতে পারে? অটোমোবাইলের ভেতর কি প্যাকেটটাকে লুকিয়ে রাখা যেতে পারে? কেউ একজন গাড়িটাকে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাবে। তাকে যথেষ্ট টাকা দেওয়া হবে। ব্যাপারটা খুবই বিপজ্জনক। গাড়িগুলোকে ভীষণভাবে তল্লাশি করা হচ্ছে।
–মিঃ ব্রাউন! মিঃ টম ব্রাউন!
নামটা দুবার বলা হল।
রিজোলি বুঝতে পারলেন, নামটা তাকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, ডেস্কের দিকে এগিয়ে এলেন।
–যাকে আপনি ফোন করেছিলেন উনি সাড়া দিচ্ছেন। সাত নম্বর বুথে চলে যান।
-অনেক ধন্যবাদ, আমি কি ওই কাগজের টুকরোটা ফেরত পেতে পারি। নাম্বারটা আমি কেবলই ভুলে যাই।
–হ্যাঁ, কেন পাবেন না?
ভদ্রমহিলা কাগজের চিরকূটটা রিজোলির হাতে তুলে দিলেন।
টনি ৭নং বুথের কাছে চলে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
-হ্যালো।
টনি তুমি কথা বলছ?
–স্পিট, তুই কেমন আছিস?
সত্যি কথা বলতে কি, মোটেই ভালো নেই। টনি, কাজকর্ম আর ভালোভাবে এগোচ্ছে না।
–আমারও ওই একই সমস্যা হয়েছে।
–প্যাকেটটা কি পাঠাতে পেরেছ?
–না, সেটা এখনও এখানে আছে।
এক মিনিটের নীরবতা। সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে চলেছে মনে হচ্ছে।
–অত চিন্তা করার কিছু নেই। আমি অন্য কোনো উপায় বের করবার চেষ্টা করছি।
দশ মিলিয়ন ডলার ব্যাপারটা কি খুব সহজ?
–চিন্তা করিস না, আমি দেখছি, সমস্যাটার সমাধান করব।
–চেষ্টা কর টনি, অনেক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
.
ধূসর রঙের স্যুট পরা একজন টনি রিজোলির ওপর কঠিন কঠোর নজর রেখেছিলেন। টনি সেখান থেকে চলে আবার সঙ্গে সঙ্গে উনি ওই ভদ্রমহিলার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
–যে মানুষটা এখুনি বেরিয়ে গেলেন তার সম্বন্ধে কিছু খবর দেবেন কী?
ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে বললেন–কী?
–আমি জানতে চাইছি উনি কোন নম্বর চেয়েছিলেন?
–আমি দুঃখিত, এইভাবে আমরা কাউকে নম্বর দিই না।
ভদ্রলোক তার পেছনের পকেট থেকে একটা ওয়লেট বের করলেন। পরিচয়পত্র সেখানে ছিল। উনি বললেন, আমি পুলিশের তরফ থেকে আসছি, আমি হলাম ইন্সপেক্টর টিন্যু।
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রমহিলার মনোভাব পালটে গেল। তিনি নাম্বারটা লিখে একটা কাগজের টুকরো ইন্সপেক্টরের হাতে তুলে দিলেন।
–আপনারা তো সব রেকর্ডের একটা কপি রাখেন, তাই নয় কি?
–হ্যাঁ, তা তো রাখতেই হয়।
–আপনি কি নম্বরটা সেখান থেকে আমাকে দেবেন।
–ঠিক আছে।
নাম্বারটা লিখে ভদ্রমহিলা ইন্সপেক্টরের হাতে দিলেন। ইন্সপেক্টর তাকিয়ে দেখলেন। : দেশের কোড নম্বর ৩৯। এক্সচেঞ্জের ৯১। ইটালি। পালেরমো।
-ধন্যবাদ, ভবিষ্যতে দরকার পড়লে লোকটাকে শনাক্ত করতে পারবেন তো?
–হ্যাঁ, উনি হলেন ব্রাউন, টম ব্রাউন।
টেলিফোনের কথাবার্তা টনি রিজোলিকে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তিনি বাথরুমে গেলেন। কী হবে? শেষ পর্যন্ত কাজটা ভালোভাবে হবে তো? নাকি সব কিছু বেচতে হবে।
চারজন মানুষ কনফারেন্স টেবিলে বসে আছেন পালেরমো অফিসে।
–পিট, মনে হচ্ছে এখনই এতটা চিন্তা করার কিছু নেই। সমস্যাটা কী হয়েছে?
–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। টনি রিজোলির দিক থেকে সমস্যা আসতে পারে।
এর আগে তো কখনও টনির সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি।
–আমি জানি। কোনো কোনো সময় মানুষ আরও লোভী হয়ে ওঠে। এখন অন্য কোনো এজেন্টের সন্ধান করতে হবে।
না, আমি টনিকে এখনও বিশ্বাস করি।
.
১০ নং স্টাডিও স্ট্রিট। পুলিশ হেডকোয়ার্টার। ডাউনটাউন, এথেন্স। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলেছে। পুলিশ প্রধান লাইভেরি ডিমিট্রি হাজির আছেন। ইন্সপেক্টর টিন্যুকে ডেকে নেওয়া হয়েছে। আমেরিকান লেফটেন্যান্ট ওয়াল্ট কেলিও হাজির হয়েছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের কাস্টমস্ ডিভিশনের অন্যতম অফিসার।
কেলি বললেন–আমি জানি এখানে একটা মস্তবড় ড্রাগ পাচার চক্র সক্রিয়। এথেন্স থেকে যে-সমস্ত জাহাজগুলো বাইরে যায়, তাদের অধিকাংশ নিষিদ্ধ ড্রাগ বহন করে। সেই ব্যবসাটার সঙ্গে টনি রিজোলি যুক্ত।
ইন্সপেক্টর টিন্যু চুপ করে বসেছিলেন। গ্রিস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট বাইরের দেশের মানুষকে নাক গলাতে দেয় না। কিন্তু এখন তারা অসহায়। সত্যিই তো, ড্রাগ পাচারের সমস্যা সমাধান করা যাচ্ছে না। আমেরিকানরা উন্নাসিক। তারা সর্বত্র নিজেদের কর্তৃত্ব ফলাও করার চেষ্টা করেন।
পুলিশপ্রধান বললেন–আমরা কাজ করার চেষ্টা করছি লেফটেন্যান্ট। টনি রিজোলি পালেরমোতে কিছুক্ষণ আগে একটা ফোন করেছিলেন। আমরা নাম্বারটা বের করে ফেলেছি। সমস্ত সোর্স কাজে লাগানো হয়েছে।
টেলিফোন বেজে উঠল। ডিমিট্রি এবং ইন্সপেক্টর টিন্যু পরস্পরের দিকে তাকালেন।
ইন্সপেক্টর টিন্যু ফোনটা তুললেন–সেটা কি পাওয়া গেছে?
তিনি কী একটা শুনলেন। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
–সবকিছু ঠিক আছে?
নাম্বারটা পাওয়া গেছে।
–আর?
–একটা পাবলিক টেলিফোন বুথে ফোন করা হয়েছে। টাউন স্কোয়ারে।
তার মানে?
মিঃ রিজোলি সংক্রান্ত যে-কোনো খবর আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ওয়াল্ট কেলি অধৈর্য হয়ে বললেন–আমি গ্রিক ভাষাটা বুঝতে পারছি না।
–স্যরি লেফটেন্যান্ট, আমরা বলতে চাইছি রিজোলি লোকটা মারাত্মক।
কেলি বললেন ওর ওপর আরও বেশি নজরদারি রাখুন।
ডিমিট্রি ইন্সপেক্টর টিন্যু-র দিকে তাকালেন। –ঠিক আছে, তোমার দেওয়া তথ্যটাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে।
-স্যার, আমি এখনও বলছি, এর মাথা হল রিজোলি, তাকে একবার ধরতেই হবে।
পুলিশপ্রধান ডেমিট্রি ওয়াল্ট কেলির দিকে তাকিয়ে বললেন–ঠিক আছে, কিছু চিন্তা করবেন না। আসলে ওকে ধরার মতো উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।
কিন্তু রিজোলি?
–, আমাদের নিজস্ব সোর্স আরও বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে, মিঃ কেলি। ভাববার কোনো কারণ নেই। যদি আপনি আর কোনো তথ্য দিতে পারেন তাহলে খুশি হব।
ওয়াল্ট কেলি পুলিশপ্রধানের দিকে তাকালেন, হতাশ এবং বিরক্তিকর ছাপ তার চাউনিতে।
–আমরা কিন্তু বেশি দিন অপেক্ষা করতে পারব না। মনে রাখবেন, জাহাজটা যে কোনো মুহূর্তে বন্দর ছেড়ে চলে যাবে।
.
রফিনা ভিলা। রিয়েলটর কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে বললেন মনে হচ্ছে কাজটা শেষ হয়ে গেছে। আমার কিন্তু কিছু নতুন ফার্নিচার আনাতে হবে।
না, আমি সবকিছু ঠিক আগের মতোই চাই।
নোয়েলে এবং তার প্রেমিক ল্যারি, এরা দুজন বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় নেমেছিল। ডেমিরিস লিভিং রুমে এগিয়ে গেলেন। আহা, এখানেই কি নারী-পুরুষ একে অন্যকে ভালোবাসতো? নাকি কিচেনে? ডেমিরিস বেডরুমে গেলেন। বিশাল একটা বিছানা, শূন্য, একদিকে পড়ে আছে। এই বিছানাতে কত সঙ্গম দৃশ্যের অভিনয় অভিনীত হয়েছে। ডগলাস নোয়েলেকে দেখেছেন, তার উলঙ্গ দেহ, যে দেহটা ডেমিরিস নিজের হাতে সাজিয়েছিলেন। ডগলাসকে তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দাম দিতে হয়েছে। আবারও কাউকে হয়ত দাম দিতে হবে। ডেমিরিস শূন্য চোখে বিছানার দিকে তাকালেন। …আমি এখানে ক্যাথেরিনকে নিয়ে আসব। তার নগ্ন দেহটাকে ভালোভাবে দেখব। ডেমিরিস ভাবলেন তারপর অন্যান্য ঘরে গেলেন। সব কাজ শেষ হয়ে গেলে তিনি ক্যাথেরিনকে ফোন করলেন।
-হ্যালো।
–আজ কেন জানি না সকাল থেকে আপনার কথা খুব মনে পড়ছে।
.
সিসিলি থেকে দুজন অপরিচিত আগন্তুক এসেছেন টনি রিজোলির সঙ্গে দেখা করতে। তারা হোটেলের ঘরে বসে আছেন। রিজোলি বিপদের গন্ধ পেয়েছেন।
দুজনের আলফ্রেডো একজন, চেহারাটা বিরাট, জিনো লাভেরি তার চেয়েও বড়ো আকারের।
আলফ্রেডো বললেন–পেটে লুক্কা আমাদের পাঠিয়েছেন।
রিজোলি নিজের উদ্বেগ চেপে রাখার চেষ্টা করলেন- খুব ভালো এথেন্স শহর আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছে। বলুন, আপনাদের জন্য আমি কী করতে পারি?
–রিজোলি, আপনি সমস্যাটার সমাধান করতে পারেন। আমরা জানি, আপনি কী ধরনের মানুষ, কিন্তু কোথায় সমস্যা তা বলবেন কী?
–হ্যাঁ, ছোট্ট একটা সমস্যা।
আমাদের কোনো সাহায্য লাগবে?
–এক মিনিট অপেক্ষা করুন। রিজোলি বললেন, মনে হচ্ছে এখন প্যাকেটটা নিরাপদ জায়গাতেই আছে।
–পেটে ব্যাপারটার ওপর নজর রাখতে বলেছেন। এই ব্যাপারে উনি অনেক টাকা ঢেলেছেন তো।
লাভেরি রিজোলির দিকে এগিয়ে এলেন। তাকে চেয়ারে বসে থাকতে বাধ্য করলেন। তিনি বললেন–আমি যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। রিজোলি, বুঝতেই তো পারছেন, আপনাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। পেটে কিন্তু খুবই রেগে গেছেন। চড়া সুদে তাকে টাকা ধার করতে হয়েছে। আশা করি, আমার কথার অর্থ আপনি বুঝতে পারছেন?
রিজোলি ভাবলেন, আমি এই দুটো জীবন্ত গরিলার সাথে লড়াই করে পারব তো? নাকি এখন পেটে লুক্কার কথাই শুনতে হবে।
হ্যাঁ, আপনাদের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। রিজোলি নিজেকে আশ্বস্ত করার সুরে বলে উঠলেন–কিন্তু ব্যাপারটা তো এত সহজে সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না। গ্রিক পুলিশ সর্বত্র কড়া নজর রেখেছে। ওয়াশিংটন ডিভিশন থেকেও একজন অফিসারকে পাঠানো হয়েছে। আমি অন্য একটা পরিকল্পনার কথা ভাবছি।
লাভেরি বললেন–পেটেও তাই বলেছেন। ওই পরিকল্পনাটা আমাদের কাছে খুলে বলবেন কী? যে করেই হোক আগামী সপ্তাহের মধ্যে মালটা পাচার করতেই হবে।
রিজোলি বললেন–এত তাড়াতাড়ি কী করে হবে?
–এটাই পেটের নির্দেশ। যদি আপনি কাজটা করতে রাজি না থাকেন, তাহলে আমরা অন্য কোনো এজেন্টের সন্ধান করব।
অন্য এজেন্ট? তার মানে আমার সাম্রাজ্য ভেঙে যাবে? টনি রিজোলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–না, সব কিছু শান্ত হয়ে যাবে। আমাকে আরেকটু সময় দিন।
-ঠিক আছে, দেখা যাবে এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হল।
.
টনি রিজোলি কতগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলেন। তিনি দুপুরের আগে পান করতে ভালোবাসেন না। দুজন লোক চলে গেলে, তিনি স্কচের বোতল খুললেন। বেশ খানিকটা গিলে ফেললেন। আঃ, সমস্ত শরীরে একটা আদরণীয় উষ্ণতা, কিন্তু কে আমাকে সাহায্য করবে? টনি ভাবলেন, কোনো বৃদ্ধ মানুষের শরণাপন্ন হওয়া যায় কি? মাত্র এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। আরেকটা খচ্চর? এখুনি একবার ক্যাসিনোতে যেতে হবে। সেখানে গেলে অনেক বোকা খচ্চরের সন্ধান পাওয়া যাবে।
***
রাত দশটা বেজেছে, রিজোলি এথেন্সের পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী একটি ক্যাসিনোর দিকে ছুটে চলেছেন, অবশ্যই গাড়িতে। ক্যাসিনোতে পৌঁছে দেখলেন সকলেই খেলতে ব্যস্ত। অনেকে হারতে ভালোবাসেন, অনেকে উত্তেজনার বশে এখানে ছুটে আসেন, কাকে চিহ্নিত করা যায়?
রিজোলি একটা গোলটেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। একটা লোকের দিকে তার নজর পড়ে গেল। পাখির মতো চেহারা তার। ধূসর চুল। বয়স মধ্য পঞ্চাশ। মাথা মুছছেন রুমাল দিয়ে। বার বার ভাবছেন, ঘাম হচ্ছে সমস্ত শরীর থেকে।
রিজোলির চোখে বিদ্যুতের দ্যুতি। তিনি আরও ভালোভাবে তাকিয়ে থাকলেন। এই অভিব্যক্তি তার খুবই চেনা। এরা হলেন সেই বোকা গ্যাম্বলারের দল, যারা সাধ্যের অতিরিক্ত খেলতে ভালোবাসেন।
শেষ সম্বলটাও বোধহয় হাতছাড়া হয়ে গেল। রিজোলি বললেন–কী? আরেকটু খেলবেন নাকি? আমি সাহায্য করতে পারি।
লোকটা ফ্যালফ্যাল করে রিজোলির দিকে তাকিয়ে রইল। আবার কপালের ঘাম মুছলেন।
–ঠিক আছে এই শেষ বারের মতো, কেমন?
টনি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন, লোকটা তার পাশের সীটে বসে পড়লেন। এককথায় তিনিই লোকটাকে খেলার আসরে ফিরিয়ে আনলেন। রিজোলি এই খেলার হালহকিকৎ সবই জানেন। তিনি জানেন, কীভাবে জিততে হয়। পরাজয় শব্দটাকে তিনি ঘৃণা করেন। লোকটাকে জেতার রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে পারব কি? রিজোলি ভাবলেন।
শেষ টাকাটাও বোধহয় চলে গেল। আহা, আগন্তুক এখানে বসে আছেন, ভাবলেশ হীন বুকে।
–আরেকটু সাহায্য করব?
এবার লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–না, অনেক হয়েছে।
টনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রিজোলি একই সময় উঠে দাঁড়ালেন।
-খুবই খারাপ, ভাগ্যটা বোধহয় আজ আপনাকে সাহায্য করছে না। আসুন, আপনাকে এক পাত্র মাল খাওয়াই।
লোকটার চোখে কৌতুক আভা। কণ্ঠস্বর ঘ্যাসঘেসে।
–স্যার, তাহলে অশেষ অনুগ্রহ হবে স্যার।
স্যার, তাহলে, আমি আমার খচ্চরকে পেয়ে গেছি! রিজোলি ভাবলেন। লোকটার হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, উনি কপর্দকশূন্য। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। সেই স্বপ্নকে সফল করতে পারেন না। ওঁর টাকার প্রয়োজন। তাহলে? ওই প্যাকেটটা উনি যদি নিউইয়র্কে পৌঁছে দেন। তাহলে একশো ডলার দেওয়া যেতে পারে। সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াতের টিকিট। আর কী চাই?
–আমার নাম টনি রিজোলি।
–আমি ভিক্টর।
–আপনার কাছে এখন কত আছে?
–না না, আমি একেবারে কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছি।
টনি হাত বাড়িয়ে দিলেন এরজন্য চিন্তা করছেন কেন? মনে হয় ভগবান ঠিক সময় আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
অনেক, অনেক ধন্যবাদ।
রিজোলি ওয়েটারকে বললেন রিগ্যাল নিয়ে এসে তো ভাই।
আপনি কি এখানে বেড়াতে এসেছেন?
লোকটা জানতে চাইলেন।
রিজোলি হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, হ্যাঁ, আমি ছুটি কাটাতে এসেছি। এটা খুব সুন্দর জায়গা।
লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। তবে এখানে থাকাটা খুবই খরচের। যদি আপনার হাতে অনেক টাকা না থাকে, তাহলে মনের মতো ফুর্তি করতে । পারবেন না। বিশেষ করে সঙ্গে যখন স্ত্রী আর চার চারটি ছেলে মেয়ে।
ভিক্টরের কণ্ঠস্বরে তিক্ততা। আরও ভালো আরও ভালো, রিজোলি মনে মনে আনন্দিত। হয়ে উঠলেন।
–আপনি কী করেন ভিক্টর?
–আমি এথেন্স স্টেট মিউজিয়ামের কিউরেটার।
–বাঃ, আপনি একজন কিউরেটার? আপনাকে কী কাজ করতে হয়?
বিভিন্ন জায়গা থেকে যে-সমস্ত দুষ্প্রাপ্য স্মারকগুলি আসে সেগুলিকে ঝাড়াই বাছাই করতে হয়। মদের পাত্রে এক চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক বলতে থাকেন, আমাদের বেশ কয়েকটা যাদুঘর আছে। অ্যাক্রোপলিশ আছে, ন্যাশনাল আর্কোলজিক্যাল মিউজিয়াম আছে। প্রত্যেকটা মিউজিয়ামেই নামি দামি জিনিসপত্র থাকে।
টনি রিজোলি ব্যাপারটাতে আরও উৎসাহী হয়ে উঠলেন।
–কী রকম দাম হতে পারে?
–দাম? অমূল্য বললে বোধহয় কম বলা হবে। জানেন তো, এইসব স্মারক বস্তুগুলোকে আমরা দেশের বাইরে পাঠাতে পারি না। তাই সতর্ক নজর রাখতে হয়। মিউজিয়ামে ছোটো ছোটো দোকান আছে, সেখানে অবিকৃত প্রতিকৃতি পাওয়া যায়।
রিজোলির মাথা কাজ করতে শুরু করেছে।
–এই কপিগুলো কি একেবারে আসলের মতো দেখতে?
-হ্যাঁ, চট করে দেখলে তফাতটা বুঝতেই পারবেন না। অভিজ্ঞ চোখ হয়তো বলতে পারবে কোনটা নকল আর কোনটা আসল।
–আমি আপনাকে আরেকটু মদ দেব কী? রিজোলি জানতে চাইলেন।
–অনেক ধন্যবাদ, আপনাকে দেখে আমার কী যে ভালো লাগছে! আমি কি এই সাহায্যের প্রতিদান দিতে পারব?
রিজোলি হাসলেন–তার জন্য অত চিন্তা করছেন কেন। সত্যি কথা বলতে কি, আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। এখন বলুন তো, আমি কবে আপনার মিউজিয়াম দেখতে যাব? আপনার কথা শুনে আমি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছি।
–আসবেন, আসবেন, অবশ্যই আসবেন! এই মিউজিয়ামটিকে আমরা পৃথিবীর অন্যতম সেরা যাদুঘর বলতে পারি। আপনার সেবা করতে পারলে খুব খুশি হব। বলুন আপনি কখন ফাঁকা থাকেন?
কাল সকালে একবার গেলে কেমন হয়?
টনি রিজোলির মনে হল, এই ভদ্রলোকটাকে শুধু একটা খচ্চর বলে ভাবলে হবে না, এর ওপর টাকা লগ্নি করা যেতে পারে। সুদে-আসলে সেই টাকা একদিন টনির পকেটে ফিরে আসবে–এ ব্যাপারে তিনি একশো ভাগ নিশ্চিত।
.
এথেন্সের স্টেট মিউজিয়াম দাঁড়িয়ে আছে প্লাটিয়া সাইনটাগমাতে। শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে, অসাধারণ সুন্দর একটি বাড়ির মধ্যে। বাড়িটিকে দেখলে মনে হয় বুঝি হারানো দিনের এক উপাসনালয়। চারটি আইওনিয়ান কলাম আছে সামনে। মাথায় উড়ছে গ্রিকদেশের জাতীয় পতাকা। সর্বোচ্চ তলের ওপর চারটি সুন্দর ভাস্কর্য।
ভেতরে একটির পর একটি মার্বেল হল। গ্রিক ইতিহাসের নানা স্মারক চিহ্নে ভরপুর। আছে হারানো দিনের প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু। সোনার কাপ, সোনার ক্রাউন, সুন্দর করে সাজানো তরবারি, আরও কত কী!
ভিক্টর টনি রিজোলিকে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রত্যেকটা বস্তুর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল কোষ্টা কী তা জানতে উনি খুবই উদগ্রীব।
ভিক্টর একটি মূর্তি দেখিয়ে বললেন–এটা হল আফিমের দেবীর মূর্তি। তারপর–ফিসফিসানো কণ্ঠস্বরে বললেন, এই দেবীকে আমরা নিদ্রার দেবী বলে থাকি। অনেকে আবার এঁকে মৃত্যুর দেবতাও বলে থাকেন।
কত দাম হবে এটার?
–এটা বিক্রির জন্য নয়। অনেক লক্ষ মিলিয়ন ডলার।
–সত্যি?
কিউরেটারের চোখে আনন্দের পরিস্ফুরন। –আহা, টাকা দিয়ে কি এদের হিসেবনিকেশ হয়? তিনি বলে চলেছেন
৫৩০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের এই স্মারকটি। এটি হল করেনথিয়ান হেলমেট, ১৪৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে এটি পাওয়া গিয়েছিল। এর দাম কত বুঝতেই পারছেন? এটি পাওয়া গিয়েছে আরাকাপলিস থেকে, ষষ্ঠদশ শতাব্দী আগমাশেননের কোষাগারে ছিল।
–ভীষণ অবাক লাগছে আমার। শহরের মধ্যে এমন একটা সুন্দর মিউজিয়াম আছে, অথচ আমি এতদিন খবর রাখিনি!
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটাই আশ্চর্যের। কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে। কী করে লোকটিকে ফাঁদে ফেলা যায়? টনি ভাবতে থাকলেন। চারপাশে আছে মহার্ঘ বস্তু। কিন্তু কোনো কিছুতে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। কী হবে? ভিক্টর এবং টনির মধ্যে কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে।
মিউজিয়াম থেকে টনি বাইরে এলেন। তখন তাঁর মাথায় অনেক স্বপ্নের ভূত। একটু বুদ্ধি করলে ভাগ্যের চাকা আবার ঘুরতে পারে। তিনি সোনার খনির সন্ধান পেয়েছেন। খচ্চরের অনুসন্ধান করছিলেন, তার বদলে গুপ্তধনের চাবিকাঠি এখন তার পকেটে। হেরোইনের ব্যবসা করে তিনি কত টাকা লাভ করেন? নানা দিকে ঝঞ্ঝাট ঝামেলা হতে পারে। পারিবারিক অশান্তি। পুলিশের লাল চোখ। মস্তানের উৎপাত। এখন যদি ব্যবসার ধারাটা পালটানো যায় তাহলে কেমন হয়? গ্রিস দেশে প্রাচীন বস্তুর অভাব নেই। দু-চারটিকে বাইরে পাচার করলে অনেক টাকা আসবে। রিজোলি মনে মনে ভাবতে থাকেন। এখন কী করব? ওই খচ্চরটার সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। মনে হচ্ছে টাকা দেখালে লোকটার মত পরিবর্তিত হতে পারে।
.
সেদিন বিকেলবেলা রিজোলি তার নতুন বন্ধুকে নিয়ে মসট্রভ আথেনাতে গেলেন। এটি শহরের এক বিখ্যাত নাইট ক্লাব। সুন্দরী মহিলারা খদ্দেরদের সেবা করে থাকে। রিজোলি বলেছিলেন- যখন এথেন্সে এসেইছেন, নৈশ জীবনটা একবার দেখবেন না?
-না, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে, বাড়িতে গিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারব না।
–আপনি আমার অতিথি, আমার খরচে সব কিছু হবে। আপনি কেন চিন্তা করছেন।
ভিক্টরকে ঠিক সময় বাড়িতে ফিরিয়ে দিলেন টনি। ধীরে ধীরে তার বিশ্বাস উৎপাদন করতে হবে। তবেই তো আসল খেলা শুরু হবে।
.
পরের দিন সকাল বেলা। টনি মিউজিয়ামে হাজির হয়েছেন। আজ যথেষ্ট জন সমাগম হয়েছে।
ভিক্টর রিজোলিকে তার অফিসে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন–আমি গত রাতের জন্য কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না। টনি, মেয়েটি সত্যিই চমৎকার ছিল। জীবনে এত আনন্দ আমি কখনও পাইনি।
রিজোলি হাসলেন ভিক্টর, এই না হলে বন্ধুত্ব?
–প্রতিদানে আপনাকে কী যে দেব!
–আপনার কাছ থেকে কিছুই আশা করছি না আমি। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আপনার সাহচর্য আমার ভালো লাগে। আচ্ছা, হোটেলে আজ পোকার খেলা হবে। আমি খেলব। আপনি কি আসবেন?
-না, আমি এটা খেলতে ভালোবাসি। কিন্তু এখন আমার আর্থিক অবস্থাটা…
–ঠিক আছে, কেন ভুলে যাচ্ছেন, আমি তো আপনাকে সাহায্য করবই। টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি তার দায়িত্ব নিলাম।
ভিক্টর মাথা নেড়ে বললেন না না, বারবার এভাবে আপনি কেন আমাকে সাহায্য করছেন। যদি আমি ওই খেলাতে হেরে যাই, আপনার টাকা ফেরত দেব কী করে?
উনি বললেন আপনি হেরে যাবেন? এমনটা কখনও আর ভাববেন না।
তার মানে?
রিজোলি হাসলেন–আগে থেকে সব ঠিক করা থাকবে। আমার এক বন্ধু অটো ডালটন ওই খেলাটা চালায়। তার হাতে প্রচুর টাকা আছে। আমেরিকার ট্যুরিস্টরা মনের আনন্দে এই খেলাতে অংশ নেয়। অটো ব্যাপারটা ম্যানেজ করে দেবে। আপনি কিছু ভাববেন না।
ভিক্টরের চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার মানে? তার মানে? আমরা প্রতারণা করব? না না, এ ধরনের কাজ আমি কখনও করিনি।
রিজোলি মাথা নেড়ে বললেন–হ্যাঁ, আমি আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু এভাবেই তো পৃথিবী চলছে। ভেবে দেখুন তো, আধঘণ্টার মধ্যে যদি আপনার পকেটে তিন হাজার ডলার এসে যায় তাহলে কেমন হবে?
ভিক্টরের বিষাদক্লিষ্ট মুখে তখন আনন্দের উদ্ভাস আভা। তিনি বললেন–বলছেন কী! দুই-তিন হাজার ডলার?
–হ্যাঁ, কমপক্ষে।
জিভ কেটে ভিক্টর বললেন–না না, আমি ভাবছি ব্যাপারটা কত বিপজ্জনক! একবার ধরা পড়লে কী হবে?
টনি হাসলেন–না, ব্যাপারটা মোটেই বিপজ্জনক হবে না। তাহলে আমি কি এত টাকা লগ্নি করতাম। অটো সবকিছু জানে, অটোর পরিচিত একজন মেকানিক ডিলার আছে। সে এই ব্যাপারে খুবই তুখোর। বছরের পর বছর ধরে সে এই কাজটা করে আসছে। কখনও ধরা পড়েনি।
ভিক্টর শেষ পর্যন্ত বললেন কত টাকা ঢালতে পারবে?
মাত্র পাঁচশো ডলার। আমি তো বলছি টাকাটা আমি আপনাকে ধার হিসেবে দেব। হেরে গেলেও সেই ধার শোধ করতে হবে না।
-ঠিক আছে, আপনার মহানুভবতার জন্য আবার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি এটা কেন আমার জন্য করছেন?
–আমি তো আগেই বলেছি, আপনার মতো মানুষের সঙ্গে আমার খুব একটা দেখা হয়নি। আপনি কিউরেটরের মতো একটা মহান পদে কাজ করছেন। যে মিউজিয়ামের সঙ্গে আপনি যুক্ত তাকে সারা পৃথিবীর অন্যতম সেরা যাদুঘর বলা যেতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্র কি আপনার যথেষ্ট দেখভাল করে? আপনার হাতে ভালো টাকা দেয় বেতন হিসেবে? আপনার পরিবার নিয়ে আপনাকে বিব্রত থাকতে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি ভিক্টর, ব্যাপারগুলো চিন্তা করে আমি কেমন যেন হয়ে গেছি। আপনাকে উঠে দাঁড়াতেই হবে।
–হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন, ওরা আমাকে দাঁড়াতে দেবে না।
-ঠিক আছে, আপনি এখন আপনার ভাগ্যের চাকাটাকে ঘোরাতে পারবেন ভিক্টর। আজ রাতে আসুন। কথা দিচ্ছি, আজ রাতেই আপনি বড়োলোক হয়ে যাবেন। এক হাজার ডলার আপনার পকেটে এলে মনটা তরতাজা হয়ে যাবে। যেমন খুশি জীবন কাটাতে পারবেন। এই জীবনের ভার আপনাকে বহন করতে হবে না।
টনি, টনি আমি বুঝতে পারছি না আপনার আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া উচিত কিনা!
টনি রিজোলি বললেন–আমি বুঝতে পারছি। আমি এথেন্সে আবার আসব, আবার হয়তো আমাদের দেখা হবে। মনে করুন না আমাদের বন্ধুত্বটা চিরস্থায়ী।
রিজোলি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
ভিক্টর বললেন ঠিক আছে, আজ রাতে আপনার সঙ্গে হোটেলে যাব।
টনি ভিক্টরের হাত চেপে ধরে বললেন, বাঃ, ঠিক আছে, এই তো, এবার আমাকে একটা ধন্যবাদ জানাবে কী?
ভিক্টর ইতস্তত করতে থাকেন আমার বোকামির জন্য ক্ষমা করবেন। কিন্তু পাঁচ ডলারও যদি হারিয়ে ফেলি, তাহলে তো আপনাকে কিছু শোধ দিতে পারব না। ব্যাপারটা আমাকে বিব্রত করছে।
-হ্যাঁ, তবে আপনি ভাববেন না এ নিয়ে সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করা আছে।
–কোথায় খেলাটা হবে?
–মেট্রোপোল হোটেলে, চব্বিশ নম্বর ঘরে। রাত দশটাতে স্ত্রীকে বলবেন, অফিসে কাজ আছে। বাড়ি ফিরতে রাত হবে।
.
১২.
টনি রিজোলি এবং ভিক্টর ছাড়াও হোটেলের ঘরে আরও চারজন ছিল।
রিজোলি বললেন আমি আমার বন্ধু অটো ডালটনের সঙ্গে আপনার আলাপ করিয়ে দিচ্ছি ভিক্টর।
দুজন মানুষ হাত বাড়িয়ে দিলেন। করমর্দন হল।
চকিতে অন্য দুজন ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রিজোলি বললেন–ডালটন, উনি কে? আর ওই ভদ্রলোক?
অটো ডালটন প্রত্যেকের পরিচয় দিলেন এইভাবে ডেট্রয়েট থেকে এসেছেন পেরি ব্রেসলার, হাউসটন থেকে মারভিন সেমেয়ার, নিউইয়র্ক থেকে স্যাল প্রিজি।
ভিক্টর সকলের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। নিজের এই আচরণকে নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।
অটো ডালটনের বয়স ষাটের কোঠা ছাড়িয়ে গেছে। মাথায় চুল কমে এসেছে। পেরির বয়স কম। মুখ দেখে মনে হয়, তিনি কোনো চিন্তায় আচ্ছন্ন। মারভিন এক রোগা পাতলা চেহারার মধ্যবয়স্ক মানুষ। স্যালের চেহারাটা বিরাট। ওক গাছের মতো দেখতে তাকে। হাত পা অনন্ত শক্তির আধার, দেখলেই বোঝা যায়। চোখদুটো ছোট এবং কুতকুতে। মুখটা দেখলে মনে হয়, সেখানে একটা তীক্ষ্ণ ছুরি লাগানো আছে।
রিজোলি ভিক্টরকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। এই লোকগুলোর পকেটে অনেক টাকা আছে। হারলেও তারা কিছু মনে করবেন না। সেমেয়ারের আছে একটা মস্তবড়ো ইনসিওরেন্স কোম্পানি। ব্রেসলার সমস্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে অটো মোবাইল ডিলারের ব্যবসা ছড়িয়ে রেখেছেন। স্যাল প্রিজি হলেন নিউ ইয়র্কের একটা মস্তবড়ড়া ইউনিয়নের সর্বময় কর্তা।
অটো ডালটন বলতে থাকেন মাননীয় ভদ্রমহোদয়রা, এবার কী খেলাটা শুরু করব? সাদা চিপের অর্থ পাঁচ ডলার, নীল চিপের অর্থ দশ, লাল পঁচিশ এবং কালো হল পঞ্চাশ। দেখা যাক আপনাদের হাতে কী রঙের চিপ আছে?
ভিক্টরের হাতে পাঁচশো ডলার আছে। টনি রিজোলি ধার বাবদ ওই টাকাটা তার হাতে তুলে দিয়েছেন। না, ধার তো নয়, দেওয়া হয়েছে উপহার হিসেবে। তিনি রিজোলির মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আহা, ঈশ্বর এমন বন্ধুকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন!
সকলে টেবিলে গিয়ে বসলেন। ভিক্টরের মনে হঠাৎ অপরাধ বোধ জেগে উঠেছে। কোনো কিছু খারাপ হলে কী হবে? পাঁচশো ডলার পকেট থেকে চলে যাবে? শীতল শিহরণ। টনি হয়তো কিছু মনে করবেন না। কিন্তু জিতলে, নতুন এক জগতের দুয়ার খুলে যাবে?
খেলাটা শুরু হল।
প্রথমে ছোটো ছোটো দান খেলা হচ্ছে। পাঁচটি তাসের খেলা। তারপর সাত তাস, এইভাবে তাসের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকবে।
প্রথম দিকে দেখা গেল হারজিতের পরিমাণটা সমভাবে বন্টিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করল।
বোঝা গেল ভিক্টর আর টনি কোনো খেলায় ভুল চাল দিতে পারে না। প্রত্যেকবারই তাদের হাতে ভালো তাস উঠছে। অন্যেরা খারাপ তাস পাচ্ছে। এর অন্তরালে কী রহস্য লুকিয়ে আছে? ঈশ্বর হয়তো আজ ওই দুজনকে সাহায্য করছেন।
ভিক্টর ভাগ্যের এই উত্থানে অবাক হয়ে গেছেন। সন্ধ্যে এগিয়ে চলেছে রাতের দিকে। দেখা গেল ইতিমধ্যে ভিক্টর দুই হাজার ডলার জিতে নিয়েছেন। ব্যাপারটা তার কাছে অলৌকিক এবং আশ্চর্য বলে মনে হল।
মারভিন সেমেয়ার গজ গজ করতে করতে বললেন–তোমরা এত ভালো খেলছ কী করে? ঈশ্বরের বরপুত্র নাকি?
ব্রেসলার বললেন ঠিক আছে, কাল দেখা যাবে।
রিজোলি বললেন–কাল আসুন, আবার দেখা হবে, তখন বোঝা যাবে ভাগ্য কাকে সাহায্য করছে।
ভিক্টর বললেন আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, দুই হাজার ডলার!
রিজোলি হাসছিলেন। সাফল্যের হাসি–এটা তো সামান্য টাকা! আমি বলেছিলাম না, অটোর সাথে পাল্লা দেওয়া সম্ভব নয়। ওই লোকগুলো আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে চেয়েছে। পার কী? মনে হচ্ছে, আপনি এই খেলাটায় উৎসাহী হয়ে উঠেছেন?
-হ্যাঁ, ভিক্টরের একগাল হাসি। এখন বুঝতে পারছি, আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল এক অলৌকিক ঘটনা।
পরবর্তী রাতে ভিক্টর আবার তিন হাজার ডলার জিতলেন।
রিজোলিকে তিনি বললেন আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! ওঁরা কি কিছুই বুঝতে পারছেন না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছেন?
টনি বললেন–এই ব্যাপারটা আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিন। আমি তো আগেই বলেছি সব সাজানো আছে। আসলে ওরা ভাবছে, এইবার বুঝি ওদের জেতা শুরু হবে। কিন্তু আমরা কিছুতেই তা হতে দেব না। কালকে আসছেন তো?
আচ্ছন্নের মতো ভিক্টর বললেন–হ্যাঁ, কাল রাতে আবার এখানেই দেখা হবে কেমন?
.
খেলা শুরু হতে চলেছে। সকলেই নিজের জায়গামতো বসে পড়েছেন।
স্যাল প্রিজি বললেন আপনারা জানেন, একদিন আমরা ক্রমাগত হেরে এসেছি। আজকে ঠিক চাল দিতে হবে।
টনি তাকালেন ভিক্টরের দিকে।
–আমার কোনো অসুবিধে নেই।
–দেখা যাক, আপনার বন্ধুরা কী বলে? সকলে মুখ চাওয়াচয়ি করলেন।
অটো ডালটন চিপ ঢালতে শুরু করেছেন। তিনি বললেন–সাদা চিপের দাম পঞ্চাশ ডলার, নীল চিপের দর একশো ডলার, লাল পাঁচশো ডলার আর কালো এক হাজার ডলার।
ভিক্টর এই কথা শুনে রিজোলির দিকে তাকালেন। এত টাকার খেলা হবে তিনি ভাবতেই পারেননি। রিজোলি মাথা নাড়লেন। আশ্বাসের চিহ্ন ফুটে বেরোচ্ছে তার আচরণের মধ্যে।
খেলা শুরু হল।
ভাগ্য পালটায়নি। ভিক্টরের হাতে যেন ম্যাজিক আছে। যে তাস তিনি ধরছেন, সেটাতেই বাজিমাত করছেন। ট্রায়ো ট্রায়ো বলে চিৎকার করছেন। টনি রিজোলিও জিতছেন, কিন্তু তত বেশি নয়।
প্ৰিজি চিৎকার করে বললেন–শুয়োরের বাচ্চা এই কার্ডগুলো। দেখা যাক, ডেক পরিবর্তন করা হোক।
অটো ডালটন সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা নতুন ডেক এনে দিলেন।
ভিক্টর টনির দিকে তাকালেন। হাসলেন। তিনি জানেন, কিছুতেই তার ভাগ্যের চাকা উলটো দিকে ঘুরবে না।
মধ্যরাত। তাদের জন্য স্যান্ডউইচ পাঠানো হল। পনেরো মিনিটের ব্রেক নেওয়া হল।
টনি ভিক্টরকে বললেন আমি অটোকে সবকিছু বলেছি। ওদের একটু জিততে দিতে হবে।
–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
–ওঁদের হাতে দুটো-একটা জয় পাঠাতে হবে। সবসময় হারলে ওঁরা খেলা থেকে বেরিয়ে যাবেন। আর ফিরে আসবেন না ডেস্কে। তাতে আমাদেরই ক্ষতি হবে।
–বাঃ, ব্যাপারটা খুব সুন্দর তো! আপনার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না।
বুঝতেই তো পারছেন সব কিছু দেখতে হবে। তা নাহলে পকেটে টাকাপয়সা আসবে কী করে?
ভিক্টর কী যেন বলতে গেলেন অনেক টাকাই তো পেলেন। টনি, এবার খেলা থেকে উঠে যাওয়াই উচিত।
টনি ভিক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন ভিক্টর, আজ আপনার পকেটে পঞ্চাশ হাজার ডলার আমি পুরে দেবই। আমি শপথ নিচ্ছি।
.
খেলা আবার শুরু হল। তিন মার্কিনদেশীয় এবার জিততে শুরু করেছেন। তবে ভিক্টরের অবস্থা এখনও ভালো। আর ওঁদের অবস্থা আজ আগের থেকে একটু ভালো।
অটো ডালটনকে এক প্রতিভা বললে কম বলা হয়। ভিক্টর ভাবলেন। খেলার ওপর নজর রেখেছেন। তার প্রতারণা কেউ ধরতে পারছে না।
খেলা এগিয়ে চলেছে। ভিক্টর এখনও হারছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না, সব টাকা চলে গেলে কী হবে? তার মানে…
প্রিজি বলতে থাকেন কী হল? ভাগ্যের চাকা ঘুরছে নাকি?
টনি মাথা নেড়ে বললেন–হ্যাঁ হতেই পারে। তাসের খেলায় কখন কী হয় তা কি বলা যায়?
মারভিন মন্তব্য করলেন এবার দেখো বন্ধুরা, কীভাবে আমরা জিতছি।
পেরি বললেন–তাহলে? স্টেকস বাড়াবেন নাকি?
টনি তার উদ্বেগ-আকুল অবস্থা ঢাকার চেষ্টা করলেন। চিন্তিত অবস্থায় তিনি বললেন–ভিক্টর, আপনি কী মনে করছেন?
ভিক্টর তখনও সুখ স্বপ্ন দেখে চলেছেন। পকেটে পঞ্চাশ হাজার ডলার নিয়ে আজ রাত শেষ হবে। আমি একটা গাড়ি কিনব, নতুন একটা বাড়ি, স্ত্রী-পুত্র পরিবার নিয়ে ছুটিতে বেড়াতে যাব।
ভিক্টর তখন কেমন আচ্ছন্নের মতো হয়ে গেছেন। তিনি চিৎকার করলেন–খেলা চলবে! খেলা চলবে!
স্যাল প্রিজি বললেন–ঠিক আছে, আমরা দাম বাড়াচ্ছি। আকাশ হোক আমাদের সীমা।
পাঁচ তাসে খেলা শুরু হল।
–এবার আমি প্রথম দান দেবো। ব্রেসলার বললেন, পাঁচ হাজার ডলার দিয়ে খেলা শুরু হবে।
প্রত্যেকেই টাকাটা জমা রাখলেন।
ভিক্টর দুটো রানি নিয়ে খেলা শুরু করলেন। তিনটে তাস বের করলেন। আহা, আরেকটা রানি পাওয়া গেছে? রিজোলি তার দিকে তাকালেন। বললেন–এক হাজার।
মারভিন বললেন–আমি দুহাজার দাম দিচ্ছি।
অটো ডালটন তার তাস ছুঁড়ে ফেলেছেন- না, এত বেশি টাকায় খেলা উচিত নয়।
স্যাল প্রিজি বললেন–আমি এখনও ডাক শুরু করিনি।
পরের হাত খেলা হচ্ছে। ভিক্টর আটে গিয়ে থেমে গেছেন। নয় দশ, অনেক পেয়েছেন তিনি। একটি মাত্র তাস.একটি মাত্র কার্ড হলেই এই টেবিলটা তার।
ডালটন বললেন–এক হাজার ডলার?
-আমি আরও এক হাজার বাড়িয়ে দিলাম।
–ঠিক আছে, আমি তিন হাজারে পৌঁছে যাচ্ছি। স্যাল প্রিজি বললেন।
ভিক্টরের মন কাঁপছে। এই খেলায় তাকে জিততেই হবে। পঞ্চাশ হাজার ডলার, পঞ্চাশ। হাজার ডলার, কে যেন তার কানে কানে মন্ত্র পড়ছে।
ভিক্টর কার্ড বের করলেন। ব্রেসলার তার দিকে তাকিয়ে আছেন। শেষ অবধি কী হল?
ভিক্টরের মুখের দিকে সকলে তাকিয়ে আছেন। ভিক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। না, এবারও তিনি জিততে পারেননি। রাগে দুঃখে ঘেন্নায় তিনি সব কার্ড ফেলে দিলেন।
.
খেলা এগিয়ে চলেছে। ভিক্টর একটির পর একটি চিপ তুলছেন। ভাগ্যটা এমন বিরূপ হল কেমন করে? তিনি টনির দিকে তাকালেন। টনি হাসছেন। হাসির মধ্যে লেখা আছে চিন্তা করে কোনো লাভ নেই।
টনি পরবর্তী তাসটা বিলি করলেন।
–একহাজার ডলার পেরি বললেন, মারভিন বললেন–আমি আরও দুই চাপিয়ে দিলাম।
স্যাল প্রিজি বলতে থাকেন বুঝতেই তো পারছেন খেলাটা কোথায় পৌঁছে গেছে। ঠিক আছে আমি আরও পাঁচ চাপিয়ে দিলাম।
ভিক্টর তখন আচ্ছন্নের মতো খেলে চলেছেন। কখন ভাগ্যের চাকা ঘুরবে?
ভিক্টর?
ভিক্টর কার্ডের দিকে তাকালেন। একটির পর একটি টেক্কা, দুটি টেক্কা, তার সাথে একটা রাজা, তার রক্তে কে যেন দামামা বাজিয়ে দিয়েছে।
–আপনি খেলায় ফিরে এসেছেন?
ভিক্টরের মুখে হাসি।তিনি জানেন, এইভাবে তার ভাগ্যের চাকা একদিন ঘুরে যাবে। তিনি চিৎকার করছেন উন্মত্তের মতো। আর একটি মাত্র কার্ড, একটি মাত্র!
অটো বলতে থাকেন–আমি দুটি কার্ডের অর্ডার দিলাম। এক হাজার ডলার বাজি রাখছি।
টনি বললেন ঠিক আছে, আমিও আপনার সঙ্গে একমত।
প্রিজি বলে উঠলেন–আমি পাঁচ হাজার ডলারে উঠে গেলাম।
মারভিন বললেন–আমি আর খেলব না।
ভিক্টর এবং স্যাল ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই।
প্রিজি ডাকলেন–আপনি কী ডাক দেবেন? পাঁচ হাজার ডলার?
ভিক্টর তাকিয়ে আছেন চিপের দিকে। পাঁচ হাজার? কত বাকি আছে? কিন্তু যখন খেলা শুরু হয়েছিল। অবিশ্বাস্য একটা আবেদন।
তিনি চিৎকার করে বললেন–হ্যাঁ আমি খেলব।
তিনটি টেক্কা আছে। প্রিজি বললেন–চারটি টুইন।
ভিক্টর বসেছিলেন, হতভম্ব হয়ে গেছেন। তিনি দেখলেন, পিজি খেলাটা জিতে গেছেন। মনে হল কে যেন তাকে গর্তের ভেতর ঠেলে ফেলে দিয়েছে। তাহলে? স্যাল কি মিথ্যে কথা বলছেন নাকি?
এবার প্রিজির পালা সাত বারে খেলা হবে। প্রিজি ঘোষণা করলেন। প্রত্যেকটা কার্ডের জন্য এক হাজার ডলার দেওয়া হবে।
ভিক্টর টনির মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন–আমার কাছে টাকা নেই।
রিজোলি বললেন–ঠিক আছে, চিন্তা করছে কেন, আমি আরও টাকা ধার দেব। শেষ অবধি আমরা খেলব। কীভাবে জিততে হবে সেটা আমি জানি। লড়াইয়ের আসর থেকে এখন কোথাও যাব না।
অটো ডালটন ভিক্টরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন আপনার কত লাগবে?
টনি রিজোলি কথাটা লুফে নিয়ে বললেন–এখুনি ওঁকে দশ হাজার দাও।
ভিক্টর অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলেন। দশ হাজার ডলার? দু বছর ধরে তিনি এত ডলার আয় করতে পারেননি। কিন্তু রিজোলি নিশ্চয় জানেন এর মধ্যে একটা কারসাজি আছে।
ভিক্টর ঢোক গিলে বললেন–হা তাহলে তো ভালো হয়।
ভিক্টরের সামনে একগাদা চিপস রাখা হল।
.
মনে হল সে রাতে প্রত্যেকটি তাস বুঝি ভিক্টরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। খেলা এগিয়ে চলেছে। নতুন চিপ এনে ঠাই করে রাখা হয়েছে তার চোখের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে চিপ নষ্ট হয়ে গেছে। অদৃশ্য হয়ে গেছে। টনি রিজোলিও যেন পাল্লা দিয়ে হারছিলেন।
রাত দুটো বেজেছে, কিছুক্ষণের বিরতি ঘোষণা করা হল। ভিক্টর টনি রিজোলিকে এক কোণে ডেকে নিয়ে গেলেন।
ভিক্টর জানতে চাইলেন কী হচ্ছে বলুন তো? কত টাকা হারতে হবে আজ আমাকে।
স্পষ্ট বোঝা গেল ভিক্টর এই অভাবিত ঘটনাতে খুবই ভেঙে পড়েছেন। তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে ভয় এবং আতঙ্কের সুস্পষ্ট ছাপ।
–এত ভেঙে পড়ার কী আছে ভিক্টর? আমি আছি না, ঠিক সময় অটোকে আমি ইঙ্গিত করব। এবার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করবে। দেখুন না, আজ কত ডলার আমাদের পকেটে আসে।
আবার খেলা শুরু হল।
রিজোলি বললেন–আমার বন্ধুকে আরও পঁচিশ হাজার ডলার দিয়ে দাও।
মারভিন চিৎকার করে উঠলেন–আপনি কি নিশ্চিত এই বাজি জিততে পারবেন?
রিজোলি ভিক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন–হ্যাঁ, আমরা জিতবই।
ভিক্টর কিন্তু কিন্তু করছিলেন। অটোকে ইঙ্গিত করা হয়েছে কী? তারপর ভিক্টর বললেন–হ্যাঁ আমি খেলব।
-ওকে।
পঁচিশ হাজার ডলারের চিপস রাখা হল। ভিক্টরের সামনে। তিনি চিপসের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভাবলেন, হায়, আজ ভাগ্যদেবী সত্যিই আমাকে সাহায্য করতে চলেছেন।
অটো ডালটন খেলাটি পরিচালনা করছিলেন। তিনি বললেন–আসুন ভদ্রমহোদয়রা, পাঁচ কার্ডের খেলা শুরু হবে। ডাক শুরু হবে এক হাজার ডলার থেকে।
প্রত্যেক খেলোয়াড় টেবিলের ওপর চিপস রেখে দিলেন।
ডালটন পাঁচ কার্ড সকলকে বেটে দিলেন। ভিক্টর হাতের দিকে তাকালেন না। আমি অপেক্ষা করব, তিনি ভাবলেন, মনে হচ্ছে এবার সত্যি সত্যি জিততে চলেছি।
আপনাদের তাস দেখান। মারভিন ডালটনের পাশে বসেছিলেন। তিনি হাত দেখলেন, বললেন, এই হল আমার তাস।
তিনি তাস ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
স্যাল পাশে বসেছিলেন, তিনিও ডাকতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, আমি এক হাজার পর্যন্ত ডাকব।
তিনি টেবিলের ওপর রাখা চিপসের দিকে তাকালেন।
এবার টনি রিজোলির পালা। টনি রিজোলি তার হাত দেখিয়ে বললেন, হ্যাঁ আমিও তাস ফেলে দিচ্ছি।
পেরি হাত দেখে গুনগুনিয়ে বললেন–আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব। পাঁচ হাজার ডলার দাম চড়িয়ে দিলাম।
তার মানে? ভিক্টরকে এখন টিকে থাকতে হলে ছহাজার ডলার ঢালতে হবে। ধীরে ধীরে তিনি হাতের দিকে তাকালেন। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, এ ধরনের হাত হতে পারে। আহা, পাঁচ ছয় সাত আট এবং নয়। হরতনের সবকটি তাস পরপর সাজানো আছে। ভগবান বোধহয় এমন হাত দিয়েছেন। টনি কাজ করতে শুরু করেছেন। হায় ঈশ্বর, আমি এতক্ষণ টনিকে ভুল বুঝছিলাম। ভিক্টর চিৎকার করে বললেন–আমি সকলের তাস দেখতে চাইছি। আরও পাঁচ হাজার ডলার বাড়িয়ে দিলাম।
তার মানে? এই একটি মাত্র হাত খেলেই ভিক্টর বড়োলোক হয়ে যাবেন।
ডালটন বললেন এখনই এই কাজ করবেন না।
স্যাল প্রিজি বলে উঠলেন–ঠিক আছে, মনে হচ্ছে কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। আমি আরও পাঁচ হাজার বাড়িয়ে দিলাম।
ভিক্টরের রক্তের মধ্যে তখন উন্মাদনা জেগেছে। এই প্রথম ভিক্টর বুঝতে পারলেন, এই খেলাটায় একটা মরণজয়ী আকর্ষণ আছে। এটা হল চক্রবহের মতো, ঢোকার মন্ত্র জানলে বেরিয়ে আসারও জানা যাবে।
খেলা জমে উঠেছে। বেশ ভালোই জমে উঠেছে। ভিক্টর জীবনের সবথেকে বড়ড়া জ্যাকপটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
পেরি সাবধানতার সঙ্গে হাত পর্যবেক্ষণ করে বললেন–এবার আমার ডাক শুরু হবে। আমি আরও পাঁচ চড়িয়ে দিলাম।
ভিক্টরের পালা। গভীর শ্বাস নিয়ে তিনি বললেন আরও পাঁচ। ভিক্টর এখন এক অচেনা জগতের বাসিন্দা হয়ে গেছেন। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে তার সমস্ত শরীর। তিনি বুঝতে পারছেন, ধীরে ধীরে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ার দিকে তিনি এগিয়ে চলেছেন।
পেরি কাঁধে একটা ঝকানি দিলেন, মুখের প্রতিটি রেখার বিজয়ীর চিহ্ন আঁকা। তিনি বললেন তিন রাজা।
আমি জিতে গেছি, ভিক্টর ভাবলেন। কিন্তু এখনও খেলাটা শেষ হয়নি। তিনি হাসলেন। কার্ড নামিয়ে দিলেন। ফলাফল জানার জন্য উদগ্রীব।
স্যাল বললেন–ধরে রাখুন, আমি রয়্যাল মেরে আপনাদের সকলকে হারিয়ে দেব। আহা, আমার কাছে তিন টেক্কা রয়েছে।
ভিক্টরের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। মনে হল তিনি যেন অজ্ঞান হয়ে যাবেন। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দন করতে শুরু করেছে।
টনি বলে উঠলেন যিশু, এভাবে জিতব ভাবতেই পারছি না, কী হল? ভিক্টর? তারপর বললেন, ভিক্টর আমি দুঃখিত, আমি জানি না কীভাবে আপনাকে সমবেদনা জানাবো।
অটো ডালটন বলে উঠলেন–আজকের মতো খেলা শেষ হল। তিনি ভিক্টরের দিকে এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন। বললেন, আমার কাছে আপনার ধার হল পঁয়ষট্টি হাজার ডলার।
ভিক্টর বোকার মতো টনি রিজোলির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনে হল কে যেন তাকে মাটির সঙ্গে লেপ্টে দিয়েছে। রিজোলি অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকালেন। ভিক্টর একটি রুমাল বের করলেন, কপাল মুছলেন।
ডালটন জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কীভাবে টাকাটা শোধ দেবেন? নগদ নাকি চেকে?
প্রিজি বললেন–না, আমি চেক নিই না। তিনি কঠিন চোখে ভিক্টরের দিকে তাকালেন। আমি ক্যাশ টাকা নেব।
ভিক্টর তখন কথা ভুলে গেছেন। শব্দরা হারিয়ে গেছে। তিনি থরথর করে কেঁপে উঠলেন। তিনি বললেন–আমি…আমি..আমার কাছে…
স্যালের মুখ অন্ধকার হয়ে এসূেছে। কী বলছেন? তিনি কুকুরের মতো চিৎকার করলেন।
টনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন। ভিক্টর বলছেন এই মুহূর্তে টাকাটা ওঁর সঙ্গে নেই। আমি বলছি, আমি এ ব্যাপারে জিম্মা নিচ্ছি।
না, এ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না রিজোলি। আমি এখুনিই টাকাটা চাইছি।
রিজোলি বললেন ঠিক আছে, কয়েকদিনের মধ্যেই টাকাটা পেয়ে যাবেন।
স্যাল সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বিশ্রী একটা গালাগাল দিয়ে তিনি বললেন–আমি এখানে দানসত্ৰ খুলতে আসিনি। কালকের মধ্যে টাকাটা আমার চাই। তা নাহলে?
স্যালের এই রণংদেহী মূর্তি দেখে সকলে ভয় পেয়ে গেছেন।
তখনও আমতা আমতা করে টনি বলছেন–ঠিক আছে, ভিক্টর টাকাটা দিয়ে দেবেন। আপনি আমার ওপর ভরসা করতে পারেন।
ভিক্টরকে মনে হল, তিনি যেন দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তিনি এমন একটা ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ঢুকে পড়েছেন, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনো মন্ত্র তার জানা নেই। তিনি চুপ করে চেয়ারে বসে থাকলেন। সকলে ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। টনি এবং ভিক্টর ছাড়া আর কেউ নেই সেখানে।
ভিক্টর বললেন আমি বুঝতে পারছি না, এত টাকা জোগাড় করব কী করে?
টনি রিজোলি ভিক্টরের কাঁধে একটি হাত রাখলেন। বললেন–জানি না ভিক্টর, ব্যাপারটা এমন হল কী করে! মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হয়েছে। আমিও আপনার মতোই সর্বস্বান্ত হলাম।
ভিক্টরের চোখ জলে ভরে এসেছে।
কিন্তু আপনি সেটা পূরণ দিতে পারবেন টনি। আমি জানি না, আমি কী করে আমার পরিবারের কাছে মুখ দেখাব। আজ বাদে কাল কী হবে ভাবতে গেলে আমার সমস্ত শরীরটা শিউরে উঠছে।
টনি বললেন কিছু একটা সমাধান করতেই হবে। ভিক্টর, ব্যাপারটা খুবই সাংঘাতিক। স্যাল প্রিজির অতীত ইতিহাস আমার জানা আছে। ইনি হলেন ইস্টকোস্ট সিম্যানস ইউনিয়নের প্রধান। তার হাতে অনেক গুণ্ডা বদমাইশ পোষা আছে।
জানি না কী হবে, কিন্তু আমাকে ছিঁড়ে ফেললেও আমি টাকাটা দিতে পারব না। ওই টাকাটা আমি কোনোদিন স্বপ্নেও দেখিনি। উনি আমার কী করবেন?
বলব? আপনি ভয় পাবেন না তো? রিজোলি জানতে চাইলেন। আপনাকে গুলি করে আঁঝরা করে দেওয়া হবে। ওই ভদ্রলোক এ ব্যাপারে খুব সুনাম অর্জন করেছেন। আপনার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দেওয়া হবে। আপনি একেবারে অন্ধ হয়ে যাবেন। এমন যন্ত্রণা দেওয়া হবে আপনি তা জীবনে ভুলবেন না। আমি জানি না, ওরা কীভাবে আপনাকে হত্যা করবেন। হয়তো একেবারে মেরে ফেলবে না, কিন্তু হাত পা কেটে রাখবে। পঙ্গু হয়ে আপনাকে ভিক্ষা করতে হবে।
ভিক্টর টনির মুখের দিকে চেয়ে হাসবার চেষ্টা করলেন। বললেন না, আপনি সব মিথ্যে করে বলছেন বলুন? আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?
–আমার কোন দোষ নেই ভিক্টর, আমি এভাবে খেলতে আসতে বলিনি। আপনি যা করেছেন সবই নিজের ইচ্ছেয়। স্যাল প্রিজির সঙ্গে লেগেছেন। এই অন্যায়ের শাস্তি তো আপনাকে ভোগ করতেই হবে।
–হায় ঈশ্বর! জানি না কী হবে আমার ভাগ্যে?
টাকা তোলার কোনো পন্থা জানা আছে?
ভিক্টর অবাক হয়ে বললেন টনি, আমি আমার পরিবারের লোকজনের মুখে খাবার তুলে দিতে পারি না আর টাকা তোলা? কী ভেবেছেন আপনি আমাকে?
–তাহলে এই শহর ছেড়ে চলে যান ভিক্টর। সম্ভব হলে দেশ ছেড়ে চলে যান। এমন একটা জায়গায় চলে যান যেখানে প্রিজির কালো হাত আপনাকে ছুঁতে পারবে না।
না, আমি তা করতে পারব না। ভিক্টর বললেন, আমার একটা বউ আছে, চারটে বাচ্চা আছে।
তিনি টনির দিকে তাকালেন আপনি বলেছিলেন সবকিছু আগে থেকে বন্দোবস্ত করা আছে। আমরা কোনোদিন হারব না। আপনিই তো বলেছিলেন।
-হ্যাঁ আমি জানতাম, বিশ্বাস করুন, এই প্রথম আমিও হেরে গেলাম। আগে সেই ব্যাপারটা কাজ করেছে। মনে হচ্ছে কোথাও একটা গণ্ডগোল হয়েছে। আমি একটা ব্যাপার বলতে পারি, প্রিজি আমাদের সকলকে ঠকিয়েছেন।
ভিক্টরের মুখ আশায় দীপ্ত হয়ে উঠল।
-তাহলে? আমরা যদি ওঁকে ঠকাই? শঠে শঠ্যাং হবে।
-না, প্রিজির সঙ্গে লাগতে গেলে ফল ভালো হবে না। লোকটা একেবারে নরপিশাচ। মৃত্যুই তার একমাত্র অস্ত্র।
ভিক্টর আমতা আমতা করতে থাকেন। হায়, আমাকে তো আর বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। কাল কী হবে ভাবতে গেলে হাত পা শিউরে উঠছে।
–হ্যাঁ, আমিও চিন্তা করছি। কোনো জায়গা থেকে টাকাটা ধার করতে পারেন কী?
–না, একশো বার জন্মালেও আমি এই টাকাটা ধার করতে পারব না। হাজার বারেও পারব না। আমার যা কিছু আছে সব বাধা আছে। কোথা থেকে আমি টাকা পাব?
এইবার বোধহয় টনি মুখোশ ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন ভিক্টর। আপনি বলেছিলেন না ওই মিউজিয়ামের জিনিসগুলোর দাম অনেক।
–হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু তাতে কী?
–আমার কথা শেষ করতে দিন। আপনি আরও বলেছিলেন যে নকল জিনিসগুলো আসলের মতো দামি, বলেননি?
-হ্যাঁ, তবে কোনো বিশেষজ্ঞের চোখে আসল আর নকলের পার্থক্যটা ধরা পড়ে যাবে।
–ঠিক আছে, আপনি একটা কাজ করতে পারেন? কোনো একটা আসল দ্রব্যকে সরিয়ে তার জায়গায় নকল রাখতে পারেন? মিউজিয়ামে অনেক ট্যুরিস্ট আসে, তাঁরা কি এই • তফাতটা বুঝতে পারবেন?
–না, তা হয়তো পারবে না, কিন্তু তা আমি করব কেমন করে? বিবেকের কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।
রিজোলি বললেন হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি ভিক্টর। আমি ভাবছি যে এই কাজটা করলে আপনার সমস্যার সমাধান হতে পারে।
ভিক্টর বললেন আমি কুড়ি বছর ধরে মিউজিয়ামে কিউরেটর হিসেবে কাজ করছি। আমি কখনও এই কাজ করতে পারব না। মরে গেলেও না। খেতে না পেলেও না।
আমি দুঃখিত, এই ব্যাপারটা বলা উচিত হয়নি। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো এইভাবে আপনি নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারবেন।
রিজোলি বেরোবার জন্য উদ্যত হলেন। ঠিক আছে, রাত হচ্ছে, আপনার স্ত্রীর কথা ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছে। বউদি নিশ্চয়ই আপনার পথ চেয়ে বসে আছেন।
ভিক্টর বললেন হা, কিন্তু ওই ব্যাপারটা করলে আমার জীবন বাঁচবে কী করে?
–হ্যাঁ বাঁচবেন, যদি আপনি সব আসল জিনিস সরিয়ে আনেন?
–আসল জিনিস?
-হ্যাঁ, আসল জিনিসগুলো, সেগুলো আমার হাতে তুলে দিতে হবে। আমি সেগুলো; দেশের বাইরে পাচার করব। বিক্রি করব। যে টাকা পাওয়া যাবে সেটা প্রিজির হাতে তুলে দেব। তবেই প্রিজির হাত থেকে আপনি বাঁচতে পারবেন। এছাড়া বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। ভেবে দেখুন, আপনাকে বাঁচানোর জন্য আমি কত পরিশ্রম করব। কত সমস্যার সামনে আমাকে দাঁড়াতে হবে। কারণ আপনি যা সমস্যায় পড়েছেন তার অন্তরালে আমার একটা ছোট্ট কালো ভূমিকা আছে। ভাববেন না এর ভেতর আমার কোনো লভ্যাংশ থাকবে। বিবেকের তাড়নায় আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি।
সত্যি এখনও আপনি আমার কত বড় বন্ধু, ভিক্টর বললেন, কিন্তু আমি আপনাকে দোষ দেব কী করে? আমি তো ইচ্ছে করেই এই খেলায় এসেছি। আপনি আমাকে সাহায্য করতে চাইছেন মাত্র।
–হ্যাঁ আমি জানি, ভেবে দেখুন আমার প্রস্তাবটা আপনার মনোমত হবে কিনা। এবার বড় ঘুম পাচ্ছে। আপনার সঙ্গে কাল কথা বলব। শুভ রাত্রি ভিক্টর।
শুভরাত্রি টনি।
***
সকালবেলা। টেলিফোনটা বেজে উঠেছে, মিউজিয়ামে।
ভিক্টর?
–হ্যাঁ।
–আমি স্যাল প্রিজি বলছি।
সুপ্রভাত মিঃ প্রিজি।
–আমি পঁয়ষট্টি হাজার ডলারের ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি। কখন টাকাটা আনতে যাব?
ভিক্টর আমতা আমতা করে বলেন–এখনও টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি, মিঃ প্রিজি।
নীরবতা ভেসে আসে, তারপর কী ভেবেছিস তুই? আমার সাথে খেলা করছিস? তুই জানিস আমি কী?
বিশ্বাস করুন, আমি আপনার সাথে কোনো খেলা খেলতে চাইছি না।
–বল শূয়োরের বাচ্চা, টাকাটা কখন আমাকে দিবি? পরিষ্কার বাংলা বুঝতে পারছিস তো?
-ইয়েস স্যার।
–কখন তোর মিউজিয়াম বন্ধ হবে?
ছটার সময়।
–আমি ওখানে পৌঁছে যাব। ডলারটা আমার জন্য তৈরি রাখবি। নাহলে তোর মুখটা আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব। দেখিস তোর কী করি আমি। হাত পা বেঁধে বস্তায় পুরবো।
লাইনটা কেটে দেওয়া হল।
ভিক্টর কাঁপতে শুরু করেছেন। কোথায় লুকোবেন এখন তিনি? হতাশার মধ্যে দিয়ে তাকে এখন যেতে হবে। একটি মাত্র সুযোগ আছে। কী সুযোগ? না, যদি ঘটনাগুলো না ঘটতো তাহলে, যদি তিনি ক্যাসিনোতে না যেতেন? যদি টনি রিজোলির সঙ্গে দেখা না হত? যদি স্ত্রীর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারতেন, বলেছিলেন জীবনে কখনন জুয়ার আসরে যাবেন না। এখন যা হবার তাই হয়ে গেছে। এখন কী করে মৃত্যুর পরোয়ানা থেকে বাঁচা যায় তাই দেখতে হবে।
–তখনই ভিক্টরের মনে হল, তিনি বোধহয় ঘন অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন। এমন সময় আশার আলোর মতো সেখানে এসে হাজির হলেন টনি রিজোলি। রিজোলি বললেন–ভিক্টর সুপ্রভাত।
.
– ছটা বেজে ত্রিশ মিনিট। মিউজিয়ামের স্টাফেরা সব বাড়ির দিকে যাত্রা করেছেন। আধঘণ্টা আগে যাদুঘরের প্রধান দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রবেশ পথের সামনে ভিক্টর এবং টনি দাঁড়িয়ে আছেন।
ভিক্টর ক্রমশ আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছেন–যদি উনি এখুনি টাকা চান? যদি আর সময় দিতে না চান?
টনি শান্তভাবে বললেন–ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। এই ব্যাপারে যা কিছু বলার আমিই বলব।
–জানি না, জানি না কী হবে! উনি কি কাউকে পাঠাবেন আমাকে হত্যা করতে? উনি কি এত সাহসী হয়ে উঠবেন?
না, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রিজি ভাববেন যে টাকাটা ফেরত দিতে পারেন ততদিন এমন কাজ উনি করবেন না। আপনি মরে গেলে ঋণ চোকাবে কে? রিজোলি শান্তভাবে বললেন।
সন্ধ্যা সাতটা।
স্যাল প্রিজিকে দেখা গেল। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসছেন। ভিক্টর দরজা খুলে দিলেন। একগাল হেসে বললেন–শুভ সন্ধ্যা।
প্রিজি অবাক হয়ে রিজোলির দিকে তাকিয়েছেন–আপনি এখানে কী করছেন? তারপর ভিক্টরের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে মেটাতে হবে। আপনি নাক গলাবেন না।
রিজোলি বললেন–ব্যাপারটা সহজভাবে নিন না, আমি আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি।
আমি কারও সাহায্য প্রার্থনা করি না। প্রিজি ভিক্টরের দিকে তাকালেন। আমার টাকা কোথায়?
–এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই।
প্রিজি ভিক্টরের গলার কলার চেপে ধরে বললেন–শোন, এই মুহূর্তে পুরো টাকাটা আমায় দিতে হবে। তা না হলে তোর কী দশা হবে, আশা করি বুঝতে পারছিস?
টনি রিজোলি বাধা দিয়ে বললেন–কী, হচ্ছে কী? মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করুন। আপনার টাকা পুরো পেয়ে যাবেন।
প্রিজি বললেন–আমি আবার বলছি আপনি নাক গলাতে আসবেন না, এটা আপনার ব্যাপার নয়।
–আমি ভিক্টরের বন্ধু, আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকব নাকি? আমি বলছি, ভিক্টরের হাতে এখন ক্যাশ টাকা নেই। কিন্তু একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিকই হবে।
–পরিষ্কারভাবে বলুন, টাকা আছে কি নেই? আমি আর কিছু শুনব না।
–আছে, আবার নেইও। রিজোলি ধাঁধা জুড়ে দিলেন।
–এটা কী ধরনের উত্তর?
টনি ঘরের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন–টাকাটা ওখানে আছে।
স্যাল থ্রিজি অবাক হয়ে গেলেন কোথায়?
কাচের বাক্সের মধ্যে দুষ্প্রাপ্য বস্তুগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন।
দুপ্রাপ্য বস্তু? কথাটা বেরিয়ে এল ভিক্টরের মুখ থেকে।
–হ্যাঁ, লক্ষ লক্ষ ডলার। কত আপনি ভাবতেও পারছেন না।
প্রিজি কাচের শোকেসের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন আপনারা কি আমাকে পাগল ভেবেছেন? মিউজিয়ামের এই জিনিসগুলো নিয়ে আমি কী করব? আমার নগদ টাকা চাই। এখুনি। তা না হলে আমি কিন্তু….
–আপনি আপনার নগদ টাকা পেয়ে যাবেন, রিজোলি বলতে থাকেন, যত টাকা ধার করা হয়েছে, তার দ্বিগুণ। আপনাকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ভিক্টর কখনোই পালিয়ে যাবেন না। তিনি আর একটু সময় চাইছেন। আপনি পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বলছি। ভিক্টর। এই দামি জিনিসগুলো চুরি করে বাইরে নিয়ে আসবেন। বিক্রি করার চেষ্টা করবেন। বিক্রি হবার সঙ্গে সঙ্গে আপনার হাতে প্রাপ্য টাকা তুলে দেওয়া হবে।
স্যাল প্রিজি মাথা নাড়লেন।
এ ব্যবস্থাটা আমার মোটেই ভালো লাগছে না। এই সব জিনিসগুলোর মাথামুণ্ডু। আমি কিছুই বুঝি না।
আপনাকে বুঝতে হবে না, ভিক্টরকে আমরা এই ব্যাপারে একজন কৃতি মানুষ বলতে পারি।
টনি একটা শোকেসের দিকে এগিয়ে গেলেন। মার্বেলের তৈরি মাথার দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনি কি বুঝতে পারছেন ভিক্টর এটার দাম কত?
ভিক্টর বললেন–এটা হল হাইজিয়া দেবীর মূর্তি। এটার বয়স অনেক হাজার বছর। জিশু খ্রিস্টের জন্মের চোদ্দো শো বছর আগে এটা তৈরি হয়েছিল। এটার জন্য যে-কোনো সংগ্রহক অনায়াসে ২০-৩০ লক্ষ ডলার দিয়ে দেবেন।
রিজোলি স্যাল প্রিজির দিকে তাকিয়ে বললেন–বুঝতে পারছেন, আমি কী বলতে চাইছি?
প্রিজি বললেন আমি এখনও বুঝতে পারছি না। খোলসা করে বলুন তো, আমাকে কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?
–আপনি দ্বিগুণ টাকা পাবেন এক মাসের মধ্যে।
প্ৰিজি কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর গম্ভীরভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন ঠিক আছে, আমি একমাস অপেক্ষা করব। আরও বেশি কিছু আমায় দিতে হবে। তবে আমার মুখ বন্ধ হবে।
টনি ভিক্টরের দিকে তাকালেন।
ভিক্টর হা-সূচক ইঙ্গিত করলেন।
রিজোলি বললেন–ঠিক আছে, আপনার কথা আমরা মেনে নিচ্ছি।
স্যাল প্রিজি কিউরেটরের দিকে এগিয়ে গেলেন তোমাকে আমি তিরিশদিন সময় দিলাম। তার মধ্যে যদি দ্বিগুণ টাকা শোধ করতে না পারে, তা হলে রাস্তার কুকুর তোমাকে খেয়ে ফেলবে। আশা করি, আমার বক্তব্য, তোমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।
ভিক্টর আমতা আমতা করে বলতে থাকেন- হ্যাঁ, স্যার।
-মনে রেখো, আজ থেকে গুনে গুনে তিরিশ দিন। তারপর তিনি তাকালেন টনি রিজোলির দিকে, অনেকক্ষণ। বললেন–না, আপনাকে আমি মোটেই পছন্দ করছি না।
স্যাল প্রিজি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
ভিক্টর ধপ্ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। তাঁর সমস্ত চোখে মুখে ঘাম জমেছে।
উনি বললেন–হায়, ভগবান! আমি ভেবেছিলাম, উনি বুঝি আমাকে মেরেই ফেলবেন। আপনি কি মনে করছেন, তিরিশ দিনের মধ্যে দ্বিগুণ টাকা শোধ করা সম্ভব হবে?
টনি রিজোলি বললেন–হ্যাঁ, আপনাকে একটাই কাজ করতে হবে, ওই আসল বস্তুটাকে বের করে আনতে হবে, আর নকল জিনিসটা সেখানে ভরে দিতে হবে।
–এটাকে দেশের বাইরে পাচার করবেন কী করে? ধরা পড়লে কিন্তু যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
টনি রিজোলি আত্মবিশ্বাসের সুরে বললেন–আমি সব জানি। ওই ব্যাপারটা আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিন। আপনার জন্য আমি এটুকু করব না!
.
এক ঘণ্টা কেটে গেছে। টনি রিজোলি, স্যাল প্রিজি, অটো ডালটন, পেরি ব্রেসলার এবং মারাভিন সেমেয়া ডালটনের হোটেলের স্যুইটে বসে মদ পান করছেন।
রিজোলি বললেন–আহা, লোকটাকে দেখে আমার মায়া হচ্ছিল। ওই বেজম্মার বাচ্চাটা বোধহয় প্যান্টে পেচ্ছাপ করে ফেলেছে।
স্যাল প্রিজি বলল এই লোকের সাথে কারবার করে কী লাভ?
রিজোলি বললেন–আপনি খামোকা আমার প্রতি রেগে যাচ্ছেন। দু-চারটে খচ্চর না পেলে জীবন চলবে কী করে?
মারভিন সেমেয়াজিজ্ঞাসা করলেন পুরো ব্যাপারটা খুলে বলুন তো?
রিজোলি বলতে থাকেন–ব্যবসাটা হল, ও একটির পর একটি দামি জিনিস আমাদের হাতে তুলে দেবে। জিনিসগুলো আমরা দেশের বাইরে পাচার করব। প্রত্যেক ক্ষেত্রে বেশ কিছু টাকা কমিশন বাবদ আমাদের পকেটে আসবে।
পেরি ব্রেসলার বললেন–বাঃ, পরিকল্পনাটা চমৎকার! আমার বেশ ভালো লাগছে।
মনে হচ্ছে, আমরা বোধহয় একটা সোনার খনির সন্ধান পেয়েছি, রিজোলি ভাবতে থাকেন। ভিক্টর একবার এই কাজে হাত দিলে আবার একই কাজ করতে বাধ্য হবেন। এই গর্ত থেকে উনি আর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবেন না। অর্থাৎ মিউজিয়ামের সব কিছু বাইরে চলে আসূবে। কোটি কোটি ডলার!
মারভিন জিজ্ঞাসা করলেন মালটাকে বাইরে পাচার করবেন কী করে?
টনি রিজোলি বললেন–একটা পন্থা বের করতে হবে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, অ্যালফ্রেডো মানকুসো আর জিনো লাভেরি তার অপেক্ষা করছেন।
.
১৩.
স্ট্যাডিও স্ট্রিটের পুলিশ হেডকোয়ার্টার। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বসেছে। ডিমিট্রিকে দেখা গেল, ইন্সপেক্টর টিকেও দেখতে পাওয়া গেল। হাজির হয়েছেন ইন্সপেক্টর নিকোলিনো, ওয়াল্ট কেলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি এজেন্ট এবং আরও জনাছয়েক ধুরন্ধর গোয়েন্দা এবং বাতাসে কেমন একটা গম্ভীরভাব। মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
ইন্সপেক্টর নিকোলিনো বলতে থাকেন আপনার দেওয়া তথ্য সঠিক, এটা আমরা বিশ্বাস করছি মিঃ কেলি। আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পেরেছি যে, টনি রিজোলি বিপুল পরিমাণ হেরোইন এথেন্সের বাইরে পাচার করার চেষ্টা করছে। সব জায়গাতে তল্লাশি শুরু হয়েছে। প্রত্যেকটি ওয়ারহাউসের ওপর কড়া নজর রাখা হয়েছে। এরকম কোনো একটা জায়গায় মালটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে আমার স্থির বিশ্বাস।
–রিজোলির ওপর নজরদারি কায়েম হয়েছে তো?
হ্যাঁ, সকালের লোক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রধান ডিমিট্রি মন্তব্য করলেন।
ওয়াল্ট কেলি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন–ব্যাপারটা হাত ফসকে যাবে না তো?
.
ইন্সপেক্টর নিকোলিনো দু-দল গোয়েন্দাকে নিয়ে এসেছেন। টনি রিজোলির ওপর নজর রাখাটাই তাঁর দায়িত্ব। তবে কাজের গুরুত্ব কতখানি তিনি তা বুঝতে পারেননি। বিকেলবেলা টনি বুঝতে পারলেন, তার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস পড়ছে। ছোট্ট হোটেলটা তিনি ছেড়ে, দিলেন। তাকে অনুসরণ করা হচ্ছে ভেবে যখন তিনি পেছন ফিরে তাকালেন কেউ একজন ঠিক একই সময়ে পেছন ফিরে তাকাল। সত্যি, এই গোয়েন্দারা সত্যিকারের পেশাদার! রিজোলির ভালো লাগল। সমানে সমানে লড়াইটা জমে ওঠে।
তাহলে? এথেন্স থেকে হেরোইনের প্যাকেট বাইরে পাঠানো হবে কী করে? আর, শুধু তো এটাই নয়? অমূল্য কিছু জিনিসপত্রও তো বাইরে পাঠাতে হবে। অ্যালফ্রেডো ম্যানকুসো আর জিনো লাভেরির সঙ্গে কথা হয়েছে। পুলিশ সর্বত্র নজরদারি কায়েম করেছে। অতি দ্রুত কাজ করতে হবে। কার সাহায্য নেওয়া যায়? সেই মুহূর্তে টনির মনে আইভভা ব্রুগির নাম এল। আহা, রোমে উনি একটা ছোটো জাহাজের মালিক। রিজোলি এর আগে ব্রুগির সাথে ব্যবসা করেছেন। ব্রুগির সাহস আছে, চট করে ভয় পান না। দুনম্বরি কাজ করতে গেলে এই সমস্ত লোককে হাতে রাখতে হয়।
.
রিজোলি জানেন, তার টেলিফোন লাইন ট্যাপ করা হয়েছে। তাহলে? অন্য কোনো জায়গা থেকে ফোন করতে হবে। অনেকক্ষণ তিনি চিন্তা করলেন। শেষ অব্দি উঠে গেলেন। হল পেরিয়ে উলটোদিকের প্যাসেজের একটা দরজায় শব্দ করলেন। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন।
-কে আপনি?
রিজোলি বললেন–আমায় ক্ষমা করবেন, আপনাকে বিরক্ত করছি বলে আমি দুঃখিত। আমি আপনার প্রতিবেশী, হলের ওপাশে থাকি। আপনি কি আমার সাথে এক মুহূর্ত কথা বলবেন?
ওই ভদ্রলোক সন্দেহের সুরে বললেন–আপনি আগে আপনার ঘরটা খুলুন তো দেখি। ভেতরে ঢুকতে পারলে তবেই তো আপনি সৎ কি না বুঝতে পারব।
টনি হাসলেন- ঠিক আছে।
টনি আবার হল পার হলেন। চাবি নিলেন, দরজা খুলে দিলেন।
লোকটি বললেন–ঠিক আছে, আপনি ঘরে আসতে পারেন।
টনি রিজোলি নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন। হল পার হয়ে বৃদ্ধের ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন।
–কী চাইছেন আপনি?
–এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা। আমি আপনাকে সমস্যায় ফেলতে চাই না। সত্যি কথাটা হল, আমি ডির্ভোস নিতে চলেছি। কিন্তু আমার স্ত্রী সব সময় আমার ওপর কঠিন নজর রেখেছে। এমনকি সে আমার ফোন ট্যাপ করছে।
ভদ্রলোক বললেন–মেয়েরাই যত নষ্টের গোড়া। আমি গত বছর আমার স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদ দিয়েছি। দশ বছর আগে দিতে পারলে বোধহয় ভালো হত।
–ঠিকই বলেছেন, আমি আপনার কাছ থেকে একটা সাহায্য চাইছি। আমি কি আপনার ঘরের ফোন নাম্বারটা দু-একজন বন্ধুকে দেব? তাঁরা মাঝে মধ্যে ফোন করবেন। আমি কথা দিচ্ছি, খুব বেশি ফোন কল আপনাকে ধরতে হবে না।
ভদ্রলোক কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর বললেন–ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করব না।
রিজোলি সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে একশো ডলার তুলে দিয়ে বললেন–এটা আপনার পরিশ্রমের জন্য দিলাম।
ভদ্রলোক জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বললেন–ঠিক আছে, আমার মনে হচ্ছে, সব কিছু আমি সামলে দেব। আপনার মতো এক দুঃখী লোককে সাহায্য করতে পারছি, এটা ভেবে আমার ভালো লাগছে।
-আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। যখনই কেউ ফোনে আমাকে ডাকবেন, আমার দরজায় শব্দ করবেন, আমি ঠিক সময়ে এখানে পৌঁছে যাব।
-ঠিক আছে।
.
পরের দিন সকালবেলা, রিজোলি পাবলিক পে স্টেশনে গেলেন ফোন করবেন বলে। আইভভা ব্রুগিকে ফোন করলেন। অপারেটরের কাছে নম্বরটা চেয়ে নিলেন।
সিগনর ব্রুগি…।
ইতালি ভাষায়, কিছু কথা হল দুজনের মধ্যে। রিজোলি টেলিফোন নাম্বারটা সুইচবোর্ডের ওপর রেখে দিলেন আর উল্টোদিকের প্রতিবেশীর হাতে নাম্বারটা দিয়ে দিলেন। নিজের ঘরে ফিরে এলেন। এই ঘরটা তার মোটেই ভালো লাগছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, কে যেন তার গতিবিধির ওপর নজর রেখেছে। রিজোলি ভাবলেন, এই ঘরটার পরিবেশ খুবই খারাপ। ফার্নিচারগুলো একেবারে বিচ্ছিরি দেখতে। পুরোনো ধরনের একটা সবুজ সোফা আছে। দুটো টেবিল ল্যাম্প আছে একটা রাইটিং ডেস্ক, ডেস্ক চেয়ার, খাটটাও কহতব্য নয়।
পরবর্তী দুদিন টনি রিজোলি ওই ঘরে ছিলেন। ভেবেছিলেন, কেউ বোধহয় দরজায় শব্দ করবে। কিন্তু কেউ এল কি? আইভভা ব্রুগি, বেজন্মার হল কী!
.
ইন্সপেক্টর নিকোলিনে এবং ওয়ান্ট কেলি নিয়মিত তথ্য বিনিময় করছেন।
রিজোলি হোটেলে নিজের ঘরে আটকে আছেন, আটচল্লিশ ঘণ্টা হয়ে গেল।
এ ব্যাপারে আপনি কি সুনিশ্চিত?
–হ্যাঁ, স্যার। সকালবেলা কাজের মেয়েরা তাকে দেখেছে। রাত্রিরবেলাও তাকে দেখা গেছে।
-কোনো ফোন কল এসেছে কি?
–এখনও পর্যন্ত একটাও আসেনি।
-ঠিক আছে, মনে হচ্ছে এবার রিজোলি কাজে বেরোবে। দেখ, তার ফোন কল ট্যাপ করতে পারো কিনা।
.
পরের দিন রিজোলির ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। সিট! ব্রুগি নিশ্চয়ই এভাবে ডাকবেন না। বলাই আছে, প্রতিবেশীর ঘরে ফোন করতে। আরও সাবধানী হতে হবে কি? রিজোলি টেলিফোনটা তুলে নিলেন।
-কে?
একটা গলা পাওয়া গেল–আমি কি টনি রিজোলির সঙ্গে কথা বলছি?
আইভো ব্রুগির গলা নয়, তাহলে কে?
–একদিন আপনি আমার অফিসে এসেছিলেন একটা ব্যবসায়িক প্রস্তাব নিয়ে, আমি কিন্তু আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আমার মনে হচ্ছে, এবার আবার এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
টনি রিজোলি বুঝতে পারলেন, স্পাইরস লামব্রো। শেষ অব্দি বেজম্মটা পথে এসেছেন। এত সৌভাগ্য তার হতে পারে, রিজোলি ভাবতেই পারেননি! সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। এখান থেকেই আমি হেরোইন বাইরে পাঠাতে পারব। একই সঙ্গে কিছু দামি জিনিসপত্র জাহাজে চাপিয়ে দেব।
–ঠিক আছে, আমি খুব খুশি হয়েছি, আপনার কথা শুনে। কখন যোগাযোগ করা যেতে পারে?
–বিকেলে আপনার সময় হবে কী?
ক্ষুধার্তের কাছে খাবার দিয়ে সময় চাওয়া হচ্ছে?
–ঠিক আছে, কোথায়?
–আপনি আমার অফিসে চলে আসুন।
–আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।
টনি রিজোলি রিসিভারটা রেখে দিলেন।
হোটেলের লবিতে হতাশ গোয়েন্দাকে দেখা গেল হেড কোয়ার্টারে খবর পাঠাচ্ছেন। রিজোলি একটা টেলিফোন পেয়েছেন। কারোর সাথে দেখা করতে চলেছেন ওঁনার অফিসে। কিন্তু ওই লোকটা নিজের নাম বলেনি, আমরা কোথা থেকে ফোনটা এসেছে বুঝতে পারছি না।
– ঠিক আছে। রিজোলি হোটেল ছেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে অনুসরণ করবে। দেখা যাক সে কোথায় যায়।
-ইয়েস, স্যার।
দশ মিনিট পর টনি রিজোলি বেসমেন্টের জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সেখানে ছোট্ট একটা গলিপথ আছে। সেটা দিয়ে হোটেল থেকে বাইরে এলেন। দুবার ট্যাক্সি পালটালেন। যখন বুঝতে পারলেন, কেউ তাকে অনুসরণ করছে না। তিনি সোজা স্পাইরস লামব্রোর অফিসে গিয়ে পৌঁছোলেন।
.
স্পাইরস লামব্রো সেদিন মেলিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন হাসপাতালে। আবার প্রতিশোধের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল স্পাইরসের। কিন্তু কীভাবে এই প্রতিশোধ নেওয়া যায়। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস এক শক্ত ধাঁচের শত্রু। তারপর জর্জিয়াস লেটোর সঙ্গে দেখা হল। মাদাম পিরিস সম্পর্কে কিছু খবর পাওয়া গেল। হাতে কী অস্ত্র আছে? কী অস্ত্র দিয়ে শালাবাবুকে কাত করা যায়?
সেক্রেটারি বলল–অ্যান্থনি রিজোলি নামে কেউ একজন আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন, মিঃ লামব্রো। তিনি কোনো অ্যাপয়মেন্ট করেননি, আমি বলেছি, তিনি দেখা করতে পারবেন না।
ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দাও।
–ঠিক আছে, স্যার।
স্পাইরাস লামব্রো রিজোলিকে দেখলেন, রিজোলির মুখে হাসি। আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিতে রিজোলি সামনের দিকে এগিয়ে আসছেন।
মিঃ রিজোলি, আপনি এসেছেন বলে আমি খুবই আনন্দিত।
টনি রিজোলি বললেন–আমিও খুশি হয়েছি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে। শেষ অব্দি আপনি আর আমি এক সঙ্গে ব্যবসা করব, তাই তো?
না।
টনি রিজোলি অবাক হয়ে গেলেন তাহলে আপনি কেন আমায় ডেকেছেন?
–আমি আবারও বলছি, আপনার সাথে ব্যবসা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।
টনি রিজোলির চোখ স্থির হয়ে গেছে। তিনি বললেন–তাহলে কী জন্য আমায় এখানে ডেকে আনা হল? আপনি বললেন, আমার জন্য একটা ভালো প্রস্তাব আছে।
–হ্যাঁ, আপনি কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের জাহাজ ব্যবহার করবেন কি?
টনি রিজোলি চেয়ারে চুপ করে বসে পড়লেন–কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস? আপনি কার সম্বন্ধে একথা বলছেন? তিনি কখনোই…।
-হ্যাঁ, তিনি রাজি হবেন। এ ব্যাপারে আমি জামিন হচ্ছে। মিঃ ডেমিরিস আপনাকে সব ব্যাপারে সাহায্য করবেন।
–আপনি কী করে এমন কথা বলছেন?
–আমি ঠিকই বলছি।
–ডেমিরিস এমন একটা অনৈতিক কাজে নামবেন?
-হ্যাঁ। লামব্রো ইন্টারকমের বোতামটা টিপলেন। কিছুটা কফি পাঠাবে এখানে? তিনি টনি রিজোলির দিকে তাকালেন–আপনার কী কফি লাগবে?
–ব্ল্যাক, চিনি লাগবে না।
–মিঃ রিজোলির জন্য ব্ল্যাক কফি পাঠাও। চিনি দিও না। ইনফিউশন।
কফি দেওয়া হল। সেক্রেটারি অফিস থেকে চলে গেলেন।
স্টাইরস লামব্রো বললেন–মিঃ রিজোলি, আমি আপনাকে একটা ছোট্ট গল্প বলব?
টনি রিজোলি বললেন–ঠিক আছে, বলুন।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের সাথে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। অনেক বছর আগে ডেমিরিসের এক রক্ষিতা ছিল। তার নাম নোয়েলে পেজ।
–ওই অভিনেত্রী, তাই তো?
-হ্যাঁ, নোয়েলে বিশ্বাসঘাতকের কাজ করেছিল। ল্যারি ডগলাস নামে একজনকে সে বিয়ে করে। ডগলাস আর নোয়েলেকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ডগলাসের বউকে তারা হত্যা করেছিল। কারণ বউটি ডির্ভোস দিতে চায়নি। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস নেপোলিয়ান ছোটাস নামে একজন আইনজ্ঞকে ভাড়া করেছিলেন, নোয়েলেকে সাহায্য করার জন্য।
–হ্যাঁ, মনে পড়ছে, খবরের কাগজের পাতায় এই মামলা সম্পর্কে পড়েছিলাম।
–সব কথা কি আর খবরের কাগজের পাতায় লেখা থাকে। আপনি কি জানেন, আমার শালাবাবু তার বিশ্বাসঘাতিকা উপপত্নীকে মারতে চেয়েছিলেন? সে এইভাবেই প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে। সে নেপোলিয়ান ছোটাসকে ভাড়া করেছিল, যাতে নোয়েলের প্রাণদণ্ড হয়। যখন মামলা শেষ হয়ে আসছে। নেপোলিয়ান ছোটাস অভিযুক্তদের বলেছিল, বিচারকদের সঙ্গে তিনি একটা বোঝাপড়া করেছেন। এটা একেবারে মিথ্যে কথা। তিনি আরও বলেছিলেন, যদি অভিযুক্তরা দোষ স্বীকার করে তাহলে মুক্তি পাবে। তারা দোষ স্বীকার করেছিল। এবং তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়।
হয়তো ছোটাস ভুল করেননি।
–আমাকে গল্পটা শেষ করতে দিন। ক্যাথেরিন ডগলাসের মৃতদেহটা কখনও পাওয়া যায়নি। কোনোদিন পাওয়া যাবে না মিঃ রিজোলি। আসলে উনি বেঁচে আছেন। কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ওঁনাকে কোথাও আটকে রেখেছেন।
টনি রিজোলি তাকালেন পরিষ্কারভাবে–এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন তো, ডেমিরিস জানতেন ওই ভদ্রমহিলা বেঁচে আছেন! অথবা উনি ভেবেছিলেন, তিনি বেঁচে থাকবেন, সাজানো কেসে রক্ষিতা আর তার প্রেমিক মারা যাবে, এই তো?
–হ্যাঁ, আপনার মাথাটা খুবই পরিষ্কার। আমি জানি না, এ ব্যাপারে আইন কী বলেছে। কিন্তু আমি জানি যে এটাই হল আসল সত্যি। আমার শালাবাবুকে বেশ কিছুদিন জেলের ঘানি টানতে হবে। সে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে।
টনি রিজোলি বসে থাকলেন। যে কথাগুলো এই মাত্র শুনেছেন তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেন। শেষ অব্দি বললেন–মিঃ লামব্রো, আপনি আমাকে এসব কথা বলছেন কেন?
স্পাইরস লামব্রোর মুখে শয়তানের হাসি–আমি একটা সাহায্য চাইছি। আমি আন্তরিকভাবে চাইছি, আপনি আমার শালাবাবুর সঙ্গে দেখা করুন। আমার মনে হচ্ছে সে বোধহয় আপনাকে সাহায্য করবে।
.
১৪.
এমন একটা ঝড় উঠল যার ওপর আমাদের কারোর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ঠান্ডা আরও প্রবল হল। এমন কোনো উষ্ণ স্মৃতি নেই, যা দ্রবীভূত হতে পারে। এক বছর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল। নোয়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ, উনি ভেবেছিলেন এখানেই ঘটনাটা শেষ হয়ে গেছে, অতীত ঘুমিয়ে পড়েছে, অথবা কবরস্থ হয়েছে। মনের মধ্যে অনুশোচনা, অভাবিতভাবে। ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার আবার তার নিজস্ব জীবনে ফিরে গেছে। কিন্তু? ফ্রেডারিক স্টাভরস আর নেপোলিয়ান ছোটাস নেই। তাদের সঙ্গে মারাত্মক খেলা খেলা হয়েছিল। এই খেলায় উনি জিতেছেন। সত্যি কী? কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস জানেন না, কতটা দুঃখ তাকে পেতে হবে। উত্তেজনার বশে তিনি এই কাজ করে ফেলেছেন। ব্যবসাটা সাংঘাতিক।
জীবন এবং মৃত্যুর খেলা। আমি একজন খুনি–ডেমিরিস ভেবেছিলেন, না-না, আমি নিয়তি মাত্র। এইসব কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে তার হারানো সাহস আবার ফিরে এসেছিল।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ক্যাথেরিন আলেকজান্ডারের কাজকর্ম সম্পর্কে সাপ্তাহিক রিপোর্ট পেতে থাকেন। এখনও পর্যন্ত সবকিছু সুন্দরভাবে এগিয়ে চলেছে। ক্যাথেরিনের সামাজিক কাজকর্ম সীমাবদ্ধ আছে। ইভলিনের কাছ থেকে নিয়মিত খবর পাচ্ছেন তিনি। ক্যাথেরিন কোনো কোনো সময় কির্ক রেনল্ডসের সঙ্গে বেড়াতে যায়। রেনল্ডস ডেমিরিসের হয়ে কাজ করছেন, তাই সমস্যা হবে না। আহা, ওই বেচারি মেয়েটি বোধহয় এখন অসহায় হয়ে উঠেছে। ডেমিরিস ভাবলেন, রেনল্ডসের সাহচর্য সত্যিই ভালো। রেনল্ডস আইন সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এটাই বোধহয় ভালো হয়েছে। ক্যাথেরিনকে আরও উৎসাহী করে তুলতে হবে, তবেই সে সাহচর্যের জন্য পাগল হবে। আহা, এরজন্য রেনল্ডসকে ধন্যবাদ জানানো উচিত।
কির্ক রেনল্ডসের সঙ্গে ক্যাথেরিনের রোজ দেখা হচ্ছে। তারা নিভৃত নিরালায় বেশ কিছুটা সময় কাটাচ্ছে। কি দেখতে খুব একটা ভালো নয়। কিন্তু আচরণটা আকর্ষণীয়। ল্যারির সাথে দেখা হয়েছিল আমার। তার রূপে আমি মজে ছিলাম। ক্যাথেরিন ভাবতে থাকে। একটা পুরোনো প্রবাদ মনে রাখতে হবে দেখতে সুন্দর হলেই হয় না মনটা ভালো হতে হয়। কির্কের মনটা খুবই ভালো। তাকে বিশ্বাস করা যায়। সে এমন একজন পুরুষ যার ওপর নির্ভর করা যায়। ক্যাথেরিন ভাবল। আমার তো বয়েস হচ্ছে, আমি কি আর আগের মতো উচ্ছলা হতে পারব? ল্যারিকে আমি ভালোবেসেছিলাম, এখন মনে হচ্ছে ওই ভালোবাসার মধ্যে ভুল ছিল। এখন আমি আরও অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছি। আমি এমন একজন পুরুষকে চাইছি, যাকে আমি শ্রদ্ধা করতে পারব। যে আমার সত্যিকারের বন্ধু হবে। যার সাথে আমি একটা সুন্দর জীবন কাটাতে পারব। কোনো ব্যাপারে আর আমাকে চিন্তা করতে হবে না। কেউ আমাকে পাহাড়চূড়া থেকে দূরে ঠেলে ফেলে দেবে না। আমাকে কবরের অন্ধকারে দিন কাটাতে হবে না।
একদিন তারা দ্য লেডিস নট ফর বার্নিং– থিয়েটার দেখতে গেল। ক্রিস্টোফার ফ্রাই এই থিয়েটারের পরিচালক। আর একদিন বিকেলে গেল সেপ্টেম্বর টাইড নামে আর একটি থিয়েটার দেখতে। গারট্রড লরেন্স এই বইতে দারুণ অভিনয় করেছেন। মাঝে মধ্যে তাদের নাইট ক্লাবে দেখা যায়। অর্কেস্ট্রার তালে তালে তারা নেচে ওঠে, বেজে ওঠে দ্যা থার্ডম্যান থিম অথবা লা ভি এন রোজ।
.
–আমি আগামী সপ্তাহে সেন্ট মরি-এ যাব। কিক রেনল্ডস ক্যাথেরিনকে বলল, তুমি কি এই ব্যাপারে কিছু মনস্থির করেছ?
ক্যাথেরিন অনেক দিন ধরেই ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছে। কির্ক তাকে ভালোবাসে, এ ব্যপারে সে সুনিশ্চিত। আমিও তাকে ভালোবাসি, ক্যাথেরিন ভাবল। কিন্তু ভালোবাসা হলেই কি বিয়ে হয়? আমি কি চিরদিন এভাবেই এক বোবা মেয়ের ভূমিকাতে অভিনয় করব? আমি কি আর একজন ল্যারির সন্ধান করব যে আমাকে আঘাত করবে? যে আমার সাথে ভাললাবাসার অভিনয় করবে কিন্তু আর একজন মেয়েকে শরীর দেবে? শেষ পর্যন্ত । আমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করবে। কির্ক কি সেই ধরনের? না, কির্ক এক অসাধারণ স্বামী হতে পারে। আমি কেন এই ব্যাপারে এত চিন্তাভাবনা করছি।
.
সে রাতে ক্যাথেরিন এবং কির্ক মিরাবেল-এ নৈশ আহার সারল। তারা যখন ডেজার্ট খাচ্ছে, কির্ক বলল, ক্যাথেরিন, আমি জানি না, তুমি বোঝ কি না,…আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
এই কথা শুনে ক্যাথেরিনের মন কেমন করল কির্ক,…সে আর কোনো কথা বলতে পারল না। সে হয়তো বলতে চেয়েছিল, তোমার সাহচর্য আমার জীবনটাকে একেবারে পালটে দিয়েছে। কিন্তু মুখে কোনো কথা সে বলতে পারছে না কেন? অতীত কি তাকে ভয় দেখাচ্ছে? সে কি আবার একই পরিণতির আশঙ্কা করছে?
ক্যাথি…
–কির্ক…আমরা একসঙ্গে সেন্ট মরিত-তে যেতে পারি না।
কির্কের মুখে আলো জ্বলে উঠেছে–তুমি কী বলতে চাইছ?
দেখ, তুমি যদি সত্যি সত্যি আমাকে বিয়ে করতে চাও, তাহলে এখন থেকে আরও কিছুটা সময় আমাদের একসঙ্গে কাটানো উচিত।
কির্ক হেসে উঠেছে ঠিকই তো, পৃথিবীর কোনো বাধাকে আমি মানব না। তোমাকে আমি খুব সুখী করব। চলো, নভেম্বরের পাঁচ তারিখটা আমরা একসঙ্গে কাটাই। জানো তো, এই দিনটা কত আনন্দের।
-কেন?
–এটা একটা কাল্পনিক গল্প। রাজা জেমসের নাম শুনেছ? উনি ক্যাথলিক বিরোধী ছিলেন। একদল বিশিষ্ট রোমান ক্যাথলিক সরকার ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। গাই ফক্স নামে একজন সৈন্যকে স্পেন থেকে নিয়ে আসা হয়। তিনি ছিলেন ষড়যন্ত্রের নায়ক। তিনি একটন গানপাউডারের ব্যবস্থা করেছিলেন। ছত্রিশটা ব্যারেলের মধ্যে গানপাউডার ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। হাউস অফ লর্ডস-এর বেসমেন্টের নীচে এগুলি রাখা ছিল। সেই সকালে হাউস অফ লর্ডস উড়িয়ে দেবার কথা ছিল। কেউ একজন পুরো ঘটনাটা ফাস করে দেয়। সকলকে ধরে ফেলা হয়। গাই ফক্স-এর ওপর অত্যাচার করা হয়। কিন্তু তিনি কোনো কথা বলেননি। সকলকে ফাঁসি দেওয়া হল। প্রত্যেক বছর ইংল্যান্ডে এই দিনটা আনন্দের সঙ্গে কাটানো হয়। আতসবাজি পোড়ানো হয়। জায়গায় জায়গায় বনফায়ারের আগুন-আঁচ জ্বলে ওঠে। ছোটো ছোটো ছেলেরা নানা সাজে সেজে ওঠে।
ক্যাথেরিন মাথা নেড়ে বলল–বাহ, এটা তো সুন্দর একটা ছুটির দিন?
কির্ক হেসে বললেন–হ্যাঁ, এসো, এই দিনটা আমরা একসঙ্গে কাটাব।
.
বাইরে যাওয়ার আগের রাত। ক্যাথেরিন চুল পরিষ্কার করছিল। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছে। উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠেছে। সে জানে, এতদিন পর্যন্ত তার জীবনে দুজন লোকের আবির্ভাব ঘটেছে–উইলিয়াম ফ্রেজার এবং তার স্বামী। এবার কি তৃতীয় পুরুষ আসতে চলেছে? ক্যাথেরিন মনে মনে ভাবল, হায় ঈশ্বর, তুমি আমার প্রতি কবে সদয় হবে? আমি কি আবার ভুল করতে চলেছি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই কি আমার সময় কেটে যাবে। জানি না, ভবিষ্যতে কী লেখা আছে আমার।
.
–মিঃ ডেমিরিস?
–বল।
–ক্যাথেরিন এই সকালে সেন্ট মরিত-এর উদ্দেশে যাত্রা করেছে।
এক মুহূর্তের নীরবতা- সেন্ট মরিতজ?
-হ্যাঁ, স্যার।
–সে কি একা গেছে?
–না, কির্ক রেনল্ডসের সঙ্গে গেছে।
বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা।
–অনেক-অনেক ধন্যবাদ ইভলিন।
কির্ক রেনল্ডস! অসম্ভব! কির্কের মধ্যে মেয়েটি কী দেখেছে? আমি বহুদিন অপেক্ষা করেছি, আমাকে এবার আরও দ্রুত কাজ করতে হবে। আমি ওকে ভালোবাসা নিবেদন করব। কিন্তু কী করে?
সেক্রেটারি বলে উঠল–মিঃ ডেমিরিস, মিঃ অ্যান্থনি রিজোলি নামে একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি কোনো অ্যাপয়ন্টমেন্ট করেননি। আমি…।
তাহলে কেন আমাকে বিরক্ত করছ? ডেমিরিস জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি ইন্টারকমটা বন্ধ করে দিলেন।
ওটা আবার বিপ-বিপ শব্দ করতে শুরু করল আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। মিঃ রিজোলি বলছেন যে, মিঃ লামব্রো একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর পাঠিয়েছেন। খবরটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খবর? অবাক কাণ্ড! কী বলতে চাইছে ওই লোকটা?
-ভেতরে পাঠিয়ে দাও।
–ঠিক আছে।
টনি রিজোলি কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের অফিসে ঢুকে পড়লেন। তিনি প্রশংসার চোখে চারপাশে তাকালেন। স্পাইরস লামব্রোর থেকে অনেক সুন্দর সাজানো।
–আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে খুবই ভালো লাগছে আমার।
–আমি তোমাকে দুমিনিট সময় দেব।
–স্পাইরস আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি জানেন, আপনি আর আমি কিছুক্ষণ আলোচনা করলে ভালো হবে।
-সত্যি? কী বিষয়ে আমরা কথা বলব?
–আমি যদি বসি, আপনি কি কিছু মনে করবেন?
মনে হচ্ছে, তুমি বেশিক্ষণ এখানে থাকবে না। তাই তো?
টনি রিজোলি একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।
আমার একটা ম্যানুফাকচারিং প্ল্যান্ট আছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে জাহাজে করে আমি মাল পাঠাই।
এবার বুঝতে পারছি, তার মানে তুমি আমার একটা জাহাজ ভাড়া করতে চাইছ, তাই তো?
–আপনি ঠিক ধরেছেন।
–স্পাইরস কেন তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে বলো তো? স্পাইরসের নিজের জাহাজের কী হল? ওর দুটো জাহাজ তো সবসময় চুপচাপ বসে থাকে।
টনি রিজোলি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন–আমার মনে হচ্ছে, আমার কাজটা উনি করতে পারবেন না।
-কেন? কী ধরনের কাজ তোমার?
ড্রাগস, টনি বললেন, হেরোইন।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস অবিশ্বাসের চোখে তাকালেন–তুমি বলতে চাইছ কী? এখুনি এখান থেকে চলে যাও। তুমি এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য
রিজোলি ফোনের দিকে তাকালেন। বললেন–ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। তার আগে…
ডেমিরিস টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেছেন।
–আমি ওদের দুজনের কথা বলব। আমি বলব নোয়েলে পেজ এবং ল্যারি ডগলাসের বিচারের কথা।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস ফিরে এলেন।
–এসব কথা তোমাকে কে বলেছে?
–আমি জানি, এমন একজন মেয়েকে হত্যার অপরাধে তাদের দুজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে যে মেয়েটি কিন্তু বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে।
মনে হল, কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের মুখ সাদা হয়ে গেছে।
–আপনি কি মনে করেন পুলিশ এই গল্পটা একেবারেই বিশ্বাস করবে না, মিঃ ডেমিরিস? যদি একবার প্রেসের লোকজনদের ডেকে এই মুখরোচক খবরটা খাইয়ে দিই, তাহলে কী হবে? আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, হেড লাইন। আমি কি আপনাকে কোস্টা নামে ডাকতে পারি? স্পাইরস বলেছেন, বন্ধুরা আপনাকে কোস্টা বলে ডাকেন। মনে হচ্ছে, এখন থেকে আমরা দুজন ভালো বন্ধু হব। হব তো, নাকি? বন্ধুরা একে অন্যকে আঘাত করে না। আমি সব ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখব। কী, থাকব তো?
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস চেয়ারে বসে রইলেন। শেষ পর্যন্ত তার ঘড়ঘড় কণ্ঠস্বর শোনা। গেল–তুমি কী বলতে চাইছ?
-আমি আগেই বলেছি, আপনার একটা জাহাজ আমাকে দিতেই হবে। আমি আর আপনি এবার থেকে খুব ভালো বন্ধু হব। আপনি আর কখনও আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না, এটা হল ব্যবসায়িক চুক্তি।
ডেমিরিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–এ ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না। আমি ব্যাপারটা ভাবতেই পারছি না। যদি কোনো সময় পুলিশ জানতে পারে যে, আমার জাহাজে চোরাই ড্রাগস আছে, তা হলে আমার ব্যবসাটা পুরো চৌপাট হয়ে যাবে।
–কে জানবে? এটা আমার ব্যবসা। আমি কোথাও মাইক খুঁকে বলে বেড়াব না। আপনি তো আমাকে দেখে বুঝতে পারছেন।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস বললেন–তুমি আবার ভুল করছ। তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে পারবে না। তুমি কি আমার আসল পরিচয় জানো?
-হ্যাঁ, এখন থেকে আপনি আমার নতুন অংশীদার হবেন। আমি আর আপনি একসঙ্গে অনেক দিন ব্যবসা করব। কাস্টা, থোকা আমার, আমি আপনাকে এই নামে ডাকছি বলে কিছু মনে করবেন না। আমি এখনই পুলিশের কাছে যাব। খবরের কাগজে খবরটা দিয়ে দেব। পুরো গল্পটা বলব। তারপর, তারপর দেখব, আপনার এই প্রভাব-প্রতিপত্তি কোথায় যায়। আপনার বিশাল সাম্রাজ্য তখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাবে। আর আপনি রাস্তার ড্রেনে মুখ লুকোতে বাধ্য হবেন।
দীর্ঘ যন্ত্রণাদগ্ধ নৈঃশব্দ্য।
কী করে লোকটা এত খবর জেনেছে বলো তো?
রিজোলি বললেন–এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, আপনার পুরো ব্যাপার কিন্তু উনি জানেন। আপনি এখনও বোকামি করছেন। আপনি ভেবে দেখুন, কোন দিকে যোগ দিলে আপনার জীবনটা ভালো কাটবে? সামান্য এদিক-ওদিক হলেই কিন্তু বাকি জীবনটা আপনাকে কারাগারের মধ্যে কাটাতে হবে।
টনি রিজোলি ঘড়ির দিকে তাকালেন।
-ওঃ, অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
আমি আপনাকে ষাট সেকেণ্ড সময় দিলাম। এর মধ্যে মনস্থির করুন। আপনি কি আমার অংশীদার হবেন নাকি আমি এখনই অফিস থেকে বেরিয়ে যাব।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসকে দেখে মনে হল, এক মুহূর্তে তার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে। তার মুখের রং হয়েছে ফ্যাকাশে। তিনি কোনো কিছু ভাবতে পারছেন না। সত্যিই তো, এত বড়ো সমস্যার সামনে তাকে কখনও দাঁড়াতে হয়নি। প্রেসের লোকেরা তাঁকে জীবন্ত চিবিয়ে খাবে। তাকে এক ভয়ংকর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। এক জঘন্য হত্যাকারী।
স্টাভরস আর ছোটাসের অপমৃত্যু নিয়েও নতুন করে তদন্ত শুরু হবে।
ষাট সেকেন্ড কেটে গেছে কিন্তু।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস মাথা নেড়ে বললেন–ঠিক আছে, ফিসফিসিয়ে বললেন, ঠিক আছে।…
টনি রিজোলি বললেন–আপনাকে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করছে। আপনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে আমি পারছি না।
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস উঠে দাঁড়ালেন আমি এখনই রাজি হচ্ছি। তবে ব্যাপারটা চাপা থাকবে তো? তোমার কেউ একজন আমার জাহাজে থাকবে। তাই তো?
টনি রিজোলি বললেন হ্যাঁ, এটা ভদ্রলোকের চুক্তি।
মনে মনে তিনি ভাবলেন, আহা, আমার সমস্যার কী সুন্দর সমাধান হয়ে গেল!
মুখে বললেন–ঠিক আছে, এই চুক্তি আমরা কেউ কোনোদিন ভাঙব না।
.
হোটেলে ফিরে টনি রিজোলি আনন্দে আত্মহারা। জ্যাকপট, শেষ পর্যন্ত এই জ্যাকপটে তিনি জিতেছেন। তিনি কখনও ভাবতেই পারেননি, স্বপ্ন সফল হবে। হায় ক্রাইস্ট, তুমি কত সদয় আমার প্রতি! পুলিশ কখনও কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের জাহাজে হাত দেবে না। আর এইভাবে, কত কিছু বাইরে চলে যাবে। হেরোইনের পাশাপাশি দামী প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস। দুঃখিত ভিক্টর, হেসে উঠলেন টনি, আহা, ওই দামি জিনিসগুলো…
রিজোলি পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে দুটো ফোন করলেন। প্রথমটি গেল পেটে লুক্কার কাছে, পালারমোতে।
–দুজন গরিলাকে এখান থেকে নিয়ে যাও পেটে, তাদের চিড়িয়াখানায় ভরে দাও। সেটাই তাদের আসল বাসস্থান। আমি খুব শীঘ্রই কাজ করতে শুরু করব।
–ব্যাপারটা ঠিক থাকবে তো? নিরাপদ?
রিজোলি হেসে উঠলেন–ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড-এর থেকে নিরাপদ। আমি তোমাকে সব কথা বলব দেখা হলে। আরও খুশির খবর আছে। প্রত্যেক সপ্তাহে জাহাজ যাবে।
সুন্দর টনি! তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে আমি পারছি না। সত্যি, সত্যি তুমি প্রশংসার যোগ্য।
টনি মনে মনে একটা খারাপ গালাগালি দিলেন। তারপর? তারপর আর কী?
.
দ্বিতীয় ফোনটি করেছিলেন স্পাইরস লামব্রোকে।
–সবকিছু ঠিকঠাক এগিয়েছে। আপনারা শালা রাজি হয়েছেন। তিনি আমার সঙ্গে ব্যবসা করবেন।
ধন্যবাদ। খবরটা শুনে আমার খুবই ভালো লাগছে মিঃ রিজোলি।
স্পাইরস লামব্রো রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। হাসলেন। তা হলে? নারকোটিক্স স্কোয়াড কাজ করতে শুরু করেছে!
.
কনস্ট্যানটিন ডেমিরিস অফিসে ছিলেন, মধ্যরাত অব্দি। চুপ করে বসেছিলেন ডেস্কের ওপর। তিনি নতুন সমস্যা নিয়ে চিন্তিত। নোয়েলে পেজের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে, এখন বোধহয় কবর থেকে নোয়লে পেজ উঠে এসেছে। তাঁকে অনুসরণ করছে ছায়ার মতো। তিনি ডেস্ক ড্রয়ারের দিকে তাকালেন। নোয়েলের একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ। কুকুরী! ঈশ্বর, ও এখনও এত সুন্দরী! তবে সে কেন আমাকে মারতে চাইছে? দেখা যাক, কী করে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
.
১৫.
সেন্ট মরিতজ একটুকরো স্বর্গ। সেখানে স্কি খেলার উপযুক্ত ব্যবস্থা আছে হাইকিং উপত্যকায়। শ্লেজের পিঠে চড়েও যাওয়া যায়। পোলো টুর্নামেন্টের আসর বসে। বিনোদনের কত উপকরণ থরথরে সাজানো। উজ্জ্বল আলোকিত ঝরনা আছে। আছে নীল জলের হ্রদ। এনগাডিন ভ্যালি, ছ হাজার ফুট উঁচুতে। আলপসের দক্ষিণ দিকে সেলেরিনা এবং পিজ নায়ারের মধ্যে। সেখানে আছে এক ছোট্ট গ্রাম। ক্যাথেরিন তো আনন্দে আত্মহারা।
ক্যাথেরনি এবং কির্ক প্যালেস হোটেলে আছে। লবিতে নানা দেশের ট্যুরিস্টদের ভিড়।
কির্ক রিসেপশন ক্লার্ককে বলেছে- মিঃ এবং মিসেস রেনল্ডসের জন্য একটি ঘর বুক করতে হবে।
ক্যাথেরিন তাকিয়ে থেকেছে, আমার হাতে একটা বিয়ের আংটি পরা উচিত ছিল। সে জানে, সকলেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার কাজকর্ম দেখছে।
–মিঃ রেনল্ডস, ২১৫ নম্বর ঘর। ক্লার্ক জবাব দিয়েছে। বেলবয়ের হাতে চাবিটা তুলে দিয়েছে। বেলবয় বলেছে, এই দিকে চলুন প্লিজ।
আহা, অসাধারণ সাজানো একটি ছোট্ট সুইট। এখানে দাঁড়ালে পাহাড়ের দৃশ্য চোখে পড়ে প্রত্যেকটি জানালা থেকে।
বেলবয় চলে গেছে। কির্ক ক্যাথেরিনকে জড়িয়ে ধরে বলেছে–ডার্লিং, সত্যি করে বলো তো, তুমি খুশি হয়েছ কিনা?
–হ্যাঁ, ক্যাথেরিন জবাব দিয়েছে। অনেক দিন ধরে আমি এমন একটা ছুটির স্বপ্ন দেখেছি।
–ভয় পেও না, তোমাকে আমি আরও সুখ দেব।
ও আমার এত কাছের মানুষ, ক্যাথেরিন ভেবেছে। কিন্তু আমি আমার অতীতের কথা বললে ও কি চলে যাবে? আমাকে ঘৃণা করবে? ল্যারির কথা এখনও পর্যন্ত সে কির্ককে বলেনি। এমনকি ওই হত্যার বিচারের কথা। কিন্তু তার জীবনে যে সব ঘটনা ঘটে গেছে, সেগুলো না বললে সে ভারমুক্ত হতে পারবে না। ক্যাথেরিনের হঠাৎ মনে হল, সবকিছু তাকে বলতেই হবে।
–আমি জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখি, ক্যাথেরিন বলল।
সে ধীরে ধীরে সব কিছু খুলছে। ধীরে ধীরে, আনন্দের মুহূর্তটিকে সে আরও দীর্ঘায়ত করতে চাইছে। সে জানে অতীতের কথা বললে হয়তো স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
অন্য একটা রুম থেকে কির্কের গলা শোনা গেল ক্যাথেরিন…
কির্ক? এখনই কির্ক জামাকাপড় খুলবে নাকি? বিছানায় যাবার জন্য অনুরোধ করবে?
ক্যাথেরিন ঢোক গিলে বলল–কী বলছ?
–চল না, আমরা বাইরে বেরিয়ে আসি, চারপাশ দেখে আসি।
ক্যাথেরিনের মন থেকে আশঙ্কার কালো মেঘ উড়ে গেল।
–বাঃ তোমার পরিকল্পনাটা চমৎকার।
বিশ্বের অন্যতম রোমান্টিক জায়গা। একজন প্রিয় মানুষ আমাকে ভালোবেসেছে। আমি মিথ্যে ভয় পাচ্ছি।
রেনল্ডস, তার দিকে তাকিয়ে আছে তুমি ঠিক আছ তো?
ক্যাথেরিন বলল–ঠিক আছি।
–তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি যেন কোনো ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।
না, আমি অনেক কিছু ভাবছি। স্কি-এর কথা ভাবছি। স্কি করতে আমার খুব একটা ভালো লাগে না। স্কি করা বেশ বিপজ্জনক।
রেনল্ডস হাসলেন। ভয় পেও না, কাল তোমাকে একটা সুন্দর ঢালু জায়গাতে নিয়ে যাব। কাল সকালেই যাবে।
সোয়েটার পরা হয়েছে, জ্যাকেটও। তারা বাইরের ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বেড়িয়ে এল। ক্যাথেরিন একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলল–আঃ, কিক, আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।
-সত্যিই তো! কির্ক বলে ওঠে, গরমকালে এলে দেখবে জায়গাটা আরও সুন্দর হয়েছে।
গরমকালে কেন তারা আসতে চায়? ক্যাথেরিন ভাবল, আমি কি সত্যি সত্যি তার কাছে এক অসাধারণ মহিলা? নাকি সে ভালোবাসার অভিনয় করছে!
.
সেন্ট মরিতজ, নামটি সত্যি সুন্দর। মধ্যযুগীয় ছাপ আছে সর্বত্র। পুরোনো দিনের দোকান, রেস্টুরেন্ট, আছে রাজকীয় সৌন্দর্যের পটভূমি।
তারা এক দোকান থেকে অন্য দোকানে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াল। ক্যাথেরিন ইভালিন আর উইমের জন্য উপহার কিনল। তারা একটা ছোট্ট কাফেতে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। কফি খেল।
বিকেলবেলা কির্ক একটা প্লেজ ভাড়া করেছিল। তারপর তুষার ঢাকা পথ দিয়ে এগিয়ে গেল পাহাড়ের দিকে।
কেমন লাগছে?
দারুণ! ক্যাথেরিন চোখ বুজে জবাব দিয়েছিল। তোমাকে আমি আরও আরও সুখ দেব। আজ রাতে। হ্যাঁ আজ রাতে। তুমি কত সন্তুষ্ট হবে, প্রিয় আমার, ক্যাথেরিন মনে মনে উচ্চারণ করেছিল।
.
সেইদিন বিকেল বেলা, তারা স্টুবলি হোটেলে খাওয়া সারল। এই রেস্টুরেন্টের মধ্যে পুরোেনো কাউন্ট্রি সরাইখানার ছাপ আছে।
–এটা ১৪৮০-র, দেখেছ? কির্ক জানতে চাইল।
–তাহলে তো আমরা পাউরুটি অর্ডার না দিলেই ভালো হয়।
–কী?
–কিছু না। এমনি ঠাট্টা।
ছোটো ছোটো কৌতুক কির্ক কি বুঝতে পারছে? ল্যারি কিন্তু সব জোকস বুঝতে পারত। ল্যারির কথা কেন মনে হচ্ছে? আমি কেন আগামী রাত্তিরের কথা ভাবছি না? আমি কি মারি আর্তোনিয়া যাকে ফাঁসি দেওয়া হবে? ডিজার্টটা তার মোটেই ভালো লাগল না।
মিলটা ছিল সত্যিই সুস্বাদু। ক্যাথেরিন এত ভয় পেয়েছে যে, ভালোভাবে খাওয়াটাকে উপভোগ করতে পারেনি। খাওয়া শেষ হল।
রেনল্ডস বলল–আমরা ওপরে যাব? কাল সকালে তোমার স্কি খেলার আসর বসবে।
দারুণ দারুণ লাগছে। ওরা ওপরে চলে গেল। ক্যাথেরিনের হৃদয় লাফাচ্ছে। এখানে এভাবে কতক্ষণ থাকব? এখনই বিছানায় শুতে যেতে ইচ্ছে করছে। ও কেন এত দেরি করছে।
রেনল্ডস দরজা খুলে দিল। আলো জ্বালাল। বেডরুমের দিকে হেঁটে গেল। ক্যাথেরিন বিরাট বিছানার দিকে তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে, খাটটা বোধহয় গোটা ঘর জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কির্ক তাকে দেখছিল–ক্যাথেরিন, তুমি কি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?
-কেন? ছোট্ট হাসি। নানা, আমি কিছু ভাবছি না।
–কী ভাবছ বলো তো সত্যি করে?
হাসি উজ্জ্বল হল–না, আমি ভালোই আছি।
এসো, আমরা পোশাক খুলে বিছানাতে চলে যাই।
ক্যাথেরিন মনে মনে বলল–এটাই আমি ভয় করছিলাম। কিন্তু এখন ও আর কী বা বলবে? এখন তো এ কথাই বলবে।
–তুমি কী বলছ? ক্যাথেরিন বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল। এবার চিৎকার করে বলল, না, আমি কিছুই বলছি না।
ক্যাথেরিন বিছানার দিকে এগিয়ে গেছে। এত বড়ড়া খাট সে এ জীবনে কখনও দেখেনি, এই খাট কি প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য তৈরি হয়েছে। শুধু প্রেম নিবেদনের জন্য? না, এই খাটে শুধুমাত্র শোওয়া হয় না, তার থেকেও বেশি কিছু।
ডার্লিং, তুমি কি নিজেকে উন্মোচিত করবে না। আমার যে সবকিছু দেখতে ইচ্ছে করছে।
–আমি? ক্যাথেরিন ভাবল, শেষ কবে এক পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি? এক বছরের বেশি হয়ে গেছে, সে ছিল আমার বিবাহিত স্বামী।
-ক্যাথি?
–হ্যাঁ, বল।
আমি পোশাক খুলব কেমন করে? কেনই বা বিছানাতে যাব? না, আমি তোমাকে হতাশ করব। সত্যি কথা বলতে কি আমি এখনও ভালোবাসতে পারিনি তোমায়, কির্ক, একটা সরল সত্য তোমাকে শুনতেই হবে, আজ রাতে আমি তোমার পাশে শোব না।
এই সবই ক্যাথির স্বগতোক্তি।
সে কেবল বলল–কির্ক।
কির্কের পোশাক আর্ধেক খোলা হয়েছে। কির্ক বলল, বল, কী বলছ?
–কির্ক, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে। তুমি হয়তো আমাকে ঘেন্না করবে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমি…
কথারা সব হারিয়ে গেছে, ক্যাথির চোখে মুখে ফুটে উঠেছে এক ধরনের হতাশা।
কির্ক হাসল, জোর করে। ক্যাথি, আমি ধৈর্য ধরতে ভালোবাসি। তুমি যদি আজ তৈরি না হও, আমি কিছুই মনে করব না। এখানে দিনগুলো ভালোই কাটছে, হতাশার মেঘ কেন আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করবে বলো?
ক্যাথি এগিয়ে এল। কির্ক এত বুঝদার, সে ভাবতেই পারেনি। সে কির্কের ঠোঁটে চুমু খেল। বলল–কির্ক, অনেক-অনেক ধন্যবাদ। আমি কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম।
-এত ভাববার কী আছে। আমি বুঝতে পেরেছি।
মনে মনে কির্ক আহত হয়েছে। মুখে প্রকাশ করেনি।
ক্যাথি বলল, তোমাকে এক দেবদূতের মতো মনে হচ্ছে।
কির্ক দীর্ঘশ্বাস ফেলল–আমি লিভিং রুমের কৌচে গিয়ে শুয়ে পড়ছি।
-না, তা কখনো হবে না। ক্যাথি বলল, আমিই তো এই সমস্যার সৃষ্টি করেছি। দেখা যাক। এই সমস্যার কিছুটা সমাধান করতে পারি কিনা। তুমি এই বিছানাতে শোও, আমি কৌচে শোব।
–তা কখনওই হবে না।
.
ক্যাথেরিন বিছানাতে শুয়ে পড়ল। ঘুম এল না তার। রাত এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার চোখদুটো খোলা। অনেক কিছু ভাবছে সে। বিশেষ করে কির্কের কথা। ভাবছে, আমি কি অন্য এক পুরুষের সঙ্গে ভালোবাসার খেলা খেলতে পারি? ল্যারি কি আমাকে ভস্ম করে দেবে? ল্যারি আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ক্যাথেরিন ঘুমিয়ে পড়ল।
.
মাঝরাতে কির্ক রেনল্ডসের ঘুম ভেঙে গেল। একটা আর্ত চিৎকার। সে কৌচের ওপর উঠে বসল। তখনও চিৎকারটা ভেসে আসছে। সে দ্রুত বেডরুমে চলে এল।
ক্যাথেরিন বোধহয় বিছানা থেকে পড়ে যাবে। তার চোখ দুটো বন্ধ। সে গোঙাচ্ছে—না না, আমাকে একা ছেড়ে দাও।
রেনল্ডস ক্যাথেরিনকে তুলে ধরল। কোলে করে রাখল কিছুক্ষণ। তার মুখে হাত দিল–শ-শ-শ! তুমি ঠিক আছো, তুমি ঠিক আছে তো?
ক্যাথেরিনের সমস্ত শরীর কাঁপছে। রেনল্ডস ক্যাথেরিনকে শক্ত করে চেপে ধরে আছে।
–ওরা আমাকে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করছে।
রেনল্ডস বলল–এটা একটা স্বপ্ন, তুমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছ।
ক্যাথেরিন চোখ খুলল, উঠে বসল। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে না, এটা দুঃস্বপ্ন নয়, এটা সত্যি। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
কির্ক ক্যাথেরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক এবং বিব্রত।
কারা তোমাকে মারতে চেয়েছিল?
আমার স্বামী এবং তার রক্ষিতা।
কির্ক অবাক হয়ে গেছে–ক্যাথেরিন, এটা একটা দুঃস্বপ্ন!
–না এটাই সত্যি। ওরা আমাকে খুন করতে এসেছিল। এজন্য ওদের ফাঁসি হয়েছে।
কির্কের মুখে অবিশ্বাসের ছায়া–ক্যাথেরিন?
–আমি আগে বলিনি, কারণ এ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে আমি মনে মনে কষ্ট পাই।
কির্ক বুঝতে পারল, ক্যাথেরিন সত্যি কথাই বলছে–কী ঘটেছিল খুলে বলবে কী?
–আমি আমার স্বামী ব্যারিকে ডিভোর্স দিতে রাজি ছিলাম না। সে শেষ পর্যন্ত আর এক মেয়ের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠে। ওরা দুজনে মিলে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল।
কির্ক আরও ভালোভাবে শুনতে চাইছে কখন এই ঘটনাটা ঘটেছিল বলবে?
–একবছর আগে।
–ওদের কী হয়েছে?
–ওদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র এই অপরাধের বিচার করেছে।
রেনল্ড, একটা হাত তুলল এক মুহূর্ত অপেক্ষা করো, ওদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তোমাকে হত্যার চেষ্টা করার জন্য?
-হ্যাঁ।
রেনল্ডস বলল–আমি কিন্তু এই দেশের আইনকানুন খুব একটা ভালো জানি না। তবে আমি একটা ব্যাপারে বাজি ফেলতে পারি, সত্যি সত্যি যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়নি, তার অপরাধে কখনও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না। কোথাও একটা ভুল হয়েছে। এথেন্সের এক আইনজীবীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। ওই ভদ্রলোক রাষ্ট্রের হয়ে মামলা লড়েন। কাল সকালে আমি ওঁনাকে ডেকে পাঠাব। ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে হবে। ওঁনার নাম হল পিটার ডেমোনিডাস।
.
ক্যাথেরিন ঘুমিয়ে পড়েছে। কির্ক রেনল্ডস জেগে আছে। সে ভালোভাবে পোশাক পরে নিয়েছে। বিছানার দিকে হেঁটে গেছে। সেখানে সে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। ক্যাথেরিনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। আমি ওকে এত ভালোবাসি, আসল রহস্যটা উদ্ঘাটন করতেই হবে। ওর মন থেকে ভয়ের মেঘগুলোকে সরাতে হবে।
.
কির্ক রেনল্ডস হোটেলের লবিতে চলে গেল। এথেন্সে ফোন বুক করল অপারেটর, আমি একজনের সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। পিটার ডেমোনিডাস।
আধ ঘণ্টা বাদে ফোন বেজে উঠল।
–মিঃ ডেমোনিডাস, আমি কির্ক রেনল্ডস বলছি। আপনি কি আমাকে মনে রেখেছেন?
–হ্যাঁ, আপনি তো কনস্ট্যানটিন ডেমিরিসের ওখানে কাজ করেন। তাই না?
–হ্যাঁ।
মিঃ রেনল্ডস, আমি আপনাকে কি কোনো সাহায্য করতে পারি?
–আপনার মতো ব্যস্ত মানুষকে বিরক্ত করছি বলে আমায় ক্ষমা করবেন। একটা খবর পেয়ে আমি খুব অবাক হয়ে গেছি। এটা গ্রিক আইনের ব্যাপার।
–গ্রিক আইন সম্পর্কে আমার সামান্য কিছু পড়াশোনা আছে। কী বলতে চাইছেন, খুলে বলুন তো। হয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব।
–যদি কাউকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়, সেই অপরাধীর কি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে? ওদিকে দীর্ঘ নীরবতা। তারপর
–আমি কি জানতে পারি, কার ব্যাপারে আপনি এই প্রশ্ন করছেন?
-আমি এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে এখানে আছি। সে হল ক্যাথেরিন আলেকজান্ডার। সে তার স্বামী এবং স্বামীর রক্ষিতার কথা বলছে। এরা দুজনে মিলে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। ওই অপরাধের জন্য রাষ্ট্র তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও একটা ফঁক আছে বলে মনে হচ্ছে। আশা করি আপনি আমার কথার অর্থ বুঝতে পেরেছেন।
–হ্যাঁ। ডেমোনিডাসের কথা শুনে মনে হল তিনি চিন্তিত।
আমি ভেবে দেখছি, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করা যেতে পারে। আপনি এখন কোথায় আছেন মিঃ রেনল্ডস?
–আমি সেন্ট মরিতজ-এর প্যালেস হোটেলে আছি।
–দেখছি, আমি আপনাকে ফোন করে সবকিছু জানাব।
–তাহলে তো ভালোই হবে। আমার মনে হচ্ছে, আলেকজান্ডার হয়তো কল্পনা করছে। আমি এই ব্যাপারটা ওর মন থেকে দূর করতে চাইছি।
–আমি বুঝতে পেরেছি, ঠিক আছে, আমি বলছি, শিগগিরই আপনাকে জানাব।
.
বাতাস পরিষ্কার, আলোকোজ্জ্বল একটি দিন। ক্যাথেরিনের চারপাশ আনন্দে ভরপুর। রাতের আতঙ্ক কোথায় উবে গেছে।
তারা একটা গ্রামে বসে সকালের প্রাতঃরাশ সারল। খাওয়া শেষ হয়ে গেছে।
রেনল্ডস বলল চলো, আমরা স্কি স্লোপে চলে যাই, তোমার জন্য একটা দারুণ উপহার অপেক্ষা করে আছে।
কির্ক ক্যাথেরিনকে প্রশিক্ষণের স্লোপে নিয়ে গেল। একজন প্রশিক্ষককে ভাড়া করল।
ক্যাথেরিন অনভ্যস্তের মতো স্কি-তে উঠে পড়েছে। দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
ব্যাপারটা তার কাছে সত্যিই হাস্যস্পদ মনে হতে লাগল।
–কী হল? কির্ক জিজ্ঞাসা করল।
–কির্ক, ভীষণ ভালো লাগছে।
প্রশিক্ষক হেসে উঠলেন- ভয় পাবেন না। প্রথমদিকে এমনই অবস্থা হবে। মিস আলেকজান্ডার, চলুন আমরা কোরভিগ্লিয়ার দিকে চলে যাই। ওই জায়গাতেই স্কি করতে সুবিধা।
খুব তাড়াতাড়ি তুমি এই খেলাটা শিখে যাবে। রেনল্ডস আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে ওঠে।
একটা স্কি দূরে ছুটে যাচ্ছে দেখে সে প্রশিক্ষককে বলল–আমি কোথায় যাব? গ্রিসচাতে?
-হ্যাঁ, সেখানেই ভালো হবে। ক্যাথেরিন জবাব দিল।
–হাসি নয়, এবার সত্যি সত্যি স্কি খেলা শুরু হয়ে গেছে। কির্ক বলল, আমার স্কিটা কিন্তু দৌড়াতে শুরু করেছে।
ক্যাথেরিন কেমন অবাক হয়ে গেছে। আমাকে ওর সঙ্গেই থাকতে হবে, ক্যাথেরিন ভাবল।
প্রশিক্ষক বললেন–গ্রিসচা খুব সুন্দর জায়গা। ভালোভাবে সেখানে স্কি খেলা যেতে পারে। আপনি কোরভিগ্লিয়া স্ট্যান্ডার্ড-এ চলে যান।
-ঠিক বলেছেন, ওখানেই যাব। ক্যাথেরিন, দুপুরে লাঞ্চে দেখা হচ্ছে, কেমন?
–ঠিক আছে।
রেনল্ডস অতি দ্রুত চোখের বাইরে চলে গেল। ক্যাথেরিন চিৎকার করে বলল–ভালোভাবে সময় কাটিও কিন্তু।
–ঠিক আছে, প্রশিক্ষক বললেন, এবার আমাদের কাজ শুরু হবে।
.
কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাথেরিন এই খেলাতে মেতে উঠল। প্রথম দিকে সে খুবই ভয় পেয়েছিল। পরে বুঝতে পারল, না, বরফের মধ্যে পড়ে গেলেও লাগবে না।
–সামনের দিকে ঝুঁকুন। সামনের দিকে স্কি-কে এগিয়ে নিয়ে চলুন।
–ঠিক আছে, এ ব্যাপারে আমি মন দিচ্ছি।
–আপনি খুব তাড়াতাড়ি এই খেলাতে উন্নতি করবেন। যেখানে বাঁক আছে, সেখানে সাবধানে চালাবেন। হাঁটু মুড়ে বসবেন। ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করুন।
প্রথমবার ক্যাথেরিন পড়ে গেল।
–আরও একবার। এবার আপনি পারবেন। আবার ক্যাথেরিন পড়ে গেল। প্রত্যেক বারই পা হড়কে যাচ্ছে তার। শেষ পর্যন্ত সে ভারসাম্য বুঝতে পারল। আহা, সে বুঝি এক মুক্ত বিহঙ্গ, দুপাশে দুটি ডানা হয়েছে তার। সে সাবধানে ঢালুর ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল। আহা, এই খেলাটায় উত্তেজনা আছে। সত্যি সে আকাশে ভেসে উঠেছে। বাঁকের মুখে অদ্ভুত উত্তেজনা। মাটির তলায় এত বরফের টুকরো, বাতাস তীক্ষ্ণ ছুরির মতো তাকে আঘাত করছে।
ক্যাথেরিন বলল–ভালো লাগছে। এখন বুঝতে পারছি কেন লোকেরা স্কি খেলতে চায়। আমি বড়ো ধাপে কখন যাব?
প্রশিক্ষক হাসলেন–আজকে এই পর্যন্ত থাক। কাল আমরা অলিম্পিকসে যাব।
আহা, সব মিলিয়ে মনে রাখার মতো একটি সকাল।
.
কির্কের জন্য ক্যাথেরিন অপেক্ষা করছে, গ্রিল রুমে। কখন কির্ক ফিরবে? কির্ক এল। সে ক্যাথেরিনের কাছে এসে দাঁড়াল।
-কেমন লাগল?
দারুণ! আমি তো বুঝতে পারিনি, এই খেলাটার মধ্যে এত উত্তজনা লুকিয়ে আছে। ছ-ছবার আমি পড়ে গিয়েছি। তোমার কেমন কটেছে? একটা খবর দেব। কাল আমরা অলিম্পিকসে যাব।
রেনল্ডস বলল–বাঃ, একদিনে দারুণ উন্নতি!
পিটার ডেমোনিসের কথা রেনল্ডস শোনালো। ক্যাথেরিনকে আর ভয় দেখিয়ে কী লাভ?
লাঞ্চ শেষ হয়ে গেছে। বরফের রাজত্বে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কদাচিৎ কোনো দোকানে দাঁড়াচ্ছে কিছু কেনাকাটা করার জন্য। ক্যাথেরিন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
চলো, আমরা ঘরে ফিরে যাই। দুপুরবেলা না ঘুমোলে আমি আর পারব না।
-ঠিক বলেছ, এখানে বাতাস বেশ পাতলা? তাই বোধহয় এতটা তাড়াতাড়ি তুমি ক্লান্ত হয়ে উঠেছ। তুমি এতে অভ্যস্ত নও। তোমার ঘুমিয়ে নেওয়াই ভালো।
–কির্ক, তুমি এখন কী করবে?
–আমি ভাবছি, গ্রিসচাতে চলে যাব। সেখানে গিয়ে স্কি করব। সেখানে কখনও স্কি করিনি। এটা আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ।
–তুমি বলতে চাইছ, সবকিছু ওখানেই আছে।
–কী?
–এই উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ।
রেনল্ডস মাথা নাড়ল।
–আমার কাছে এই স্কিটা একটা মস্ত বড়ো চ্যালেঞ্জ।
–ক্যাথেরিন মাথা নেড়ে বলল–কির্ক, কালরাতের ঘটনাটা ভুলে যাও। আজ আমি আরও ভালো হবার চেষ্টা করব।
-না-না, তোমার ব্যবহারে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখ পাইনি। তুমি হোটেলে ফিরে যাও। একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করো।
-ঠিক আছে।
ক্যাথেরিন তাকিয়ে থাকল কির্কের দিকে। আঃ, সত্যি কির্ক এক দারুণ পুরুষ! সে যে কেন আমার মতো একটা বোকা মেয়ের প্রেমে পড়ল!
.
ক্যাথেরিন অনেকক্ষণ ঘুমোল। বিকেলের দিকে ঘুম ভাঙল। কী ভাগ্য তার। আজ ঘুমের মধ্যে সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে আর্তনাদ করেনি। সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে। কির্ক এখনই। ফিরবে।
ক্যাথেরিন চান করল। পরিপাটি করে সাজল। সামনে যে সন্ধ্যাটা এগিয়ে আসছে, সে সম্পর্কে চিন্তা করল। না, রাতটা, এই রাতটা সে আজ কির্ককে উপহার দেবে।
জানালার ধারে এগিয়ে গেল। তাকিয়ে থাকল। অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে। কির্ক নিশ্চয়ই এখনও আনন্দঘন মুহূর্ত কাটাচ্ছে, ক্যাথেরিন ভাবল। সে দূরের ওই পাহাড় চূড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকল। ওটাই কি গ্রিসচা? জানি না, ওখানে স্কি করতে কেমন লাগে?
.
সাতটা বেজে গেজে, কির্ক রেনল্ডস এখনও ফিরল না কেন? গোধূলির আলো চারপাশের পরিবেশকে মায়াবি করে তুলেছে। একটু বাদেই অবশ্য এই আলো ঘন অন্ধকারে হারিয়ে গেল। অন্ধকারে কেউ কি স্কি করতে পারে? ক্যাথেরিন মনে মনে ভাবল। মনে হচ্ছে, ও বোধহয় কোথাও বসে ড্রিঙ্ক করছে।
দরজার দিকে তাকিয়ে থাকল ক্যাথি। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। ক্যাথেরিন হাসল, আমি ঠিকই ভেবেছি। ও বোধহয় আমাকে ডাকছে।
রিসিভারটা তুলল। উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে তার কণ্ঠস্বরে–তুমি কোথায়? তুমি কি কোনো শেরপার দেখা পেয়েছ?
একটা অদ্ভুত কণ্ঠস্বর–শ্ৰীমতী রেনল্ডস?
ক্যাথেরিন নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, হোটেলের খাতায় এই নামই লেখা আছে। হ্যাঁ, আমি শ্ৰীমতী রেনল্ডস বলছি।
–একটা খারাপ খবর আছে। আপনার স্বামীর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
কী ধরনের অ্যাকসিডেন্ট? মারাত্মক কিছু কী?
সত্যি কথাটা বলতে গিয়ে আমার কেমন যেন হচ্ছে।
–বলুন, কী হয়েছে?
–অ্যাকসিডেন্টে উনি মারা গেছেন। লাগাল্প-এ উনি স্কি করছিলেন। ঘাড় ভেঙে পড়ে আছেন।