৩১.
প্যারিস,
বুধবার, ৯ জুলাই, দুপুর।
ব্রু মতিনের অফিস, হারটগ ট্রেসির সঙ্গে কথা বলছে–সব মানছি কিন্তু ছবিটা জেফ আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। অতএব তাকে কৃতিত্ব দিতেই হবে।
জেফ পুরো ব্যাপারটার ওপর কড়া নজর রেখেছিল। ট্রেসিকে দিয়ে আসল কাজটা করিয়ে শেষ মুহূর্তে বাজীমাৎ করলো। এই প্রথম জেফের কাছে গো-হারান হেরে গেল ট্রেসি।
ওকে হাতের কাছে পেলে আমি খুন করবো–ট্রেসি বলল।
–না না রাগারাগি কোরো না, জেফ আসছে, তোমাদের দুজনের জন্য একটা কাজ রেখেছি।
ট্রেসি কিছুতেই রাজী না, আবার হারটগও ছাড়বে না। শেষ পর্যন্ত ট্রেসি রাজী হল। ব্যাপারটা খুবই জটিল, দ্য বীয়ার্স কোম্পানী চার কোটি ডলারের হীরে পাঠাচ্ছে প্যারিস থেকে আমস্টারডামে। আকাশেই হীরেগুলো চুরি করতে হবে।
ট্রেসি ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলল–মালবাহী প্লেনে? ওড়বার সময় চুরি করতে হবে? কি সম্ভব?
–ছোট্ট খাট্টো লোক থাকবে, তাকে একটা প্যাকিং বাক্সে ভরে হীরের প্যাকিং বাক্সে তাকে পুরে দেবো। মাঝপথে সে হীরে চুরি করে আবার প্যাকিং বাক্সে লুকিয়ে পড়বে। তার আগে নকল হীরের বাক্সটা ওই প্যাকিং বাক্সে ভরে দিতে হবে। আমস্টারডামে তুমি সমেত ওই প্যাকিং বাক্সটা ডেলিভারী নিয়ে নেওয়া হবে। একলাখ ডলারের ৫০ হাজার তুমি পাবে।
–বাকিটা?
–বাকিটা পাবে জেফ, ও প্যারিস এয়ারপোর্টে বলোক রাখবে, তাই তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। আবার আমস্টারডামে সেই-ই থাকবে।
শেষ পর্যন্ত অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে ট্রেসি রাজী হল। প্যারিসের একটা ভালো হোটেলে চলে এল সে। ড্যানিয়েল কুপারও সেখানে হাজির হয়েছে। কিছুতেই এই পরাজয় সে মেনে নেবে না। বার বার ট্রেসি ফসকে যাচ্ছে কি করে?
ইন্টারপোলের সদর দপ্তর তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করেছে।
রামিরো ড্যানিয়েল কুপারের দুর্ব্যবহারের কথাও জানিয়ে দিয়েছেন। ইন্সপোর্টের ট্রিগনান্টেরও ধারণা বৃথা ট্রেসির পেছনে ছোটা হচ্ছে।
জেফ এসে ট্রেসিকে ডিনারে যেতে বলেছিল। ট্রেসি রাজী হয়নি। ট্রেসি হুইটনি নামের আদ্যাক্ষর লেখা একটা ছোট্ট সিল্কের রুমাল জেফ তাকে উপহার দিয়েছিল। ৫ লক্ষ ডলারের বিনিময়ে কি?
শেষ মুহূর্তে বুক ঢিপ ঢিপ করল ট্রেসির। মাত্র এক ঘণ্টার ফ্লাইট। তার মধ্যে কাজ সারতে হবে। প্যাকিং বাক্সের কাঠগুলো খুবই শক্ত, সে কি ঠিকমতো খুলতে পারবে?
নিজেকে তৈরি করে নিল সে, কালো পোশাক পরলো, রবার সোলের জুতো, মাথায় টুপি, বের হবার আগে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা টি. ডবলিউ লেখা রুমালটা বুকের ভেতর খুঁজে নিল।
ড্যানিয়েল কুপারের জাগ্রত চোখকে ফাঁকি দিয়ে ট্রেসি সোজা চলে এল গুদাম ঘরে। সেখানে একজন সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভিতরে নিয়ে গেল। বড়ো কাঠের খাঁচার মতো প্যাকিং বাক্সের মধ্যে তাকে ঢুকে পড়তে বলা হল। একটু ভেবে ট্রেসি ঢুকলো, সঙ্গে নিলো দুফলা ছুরি, লম্বা শক্ত দড়ি, টর্চ লাইট আর নকল হীরের বাক্স।
প্যাকিং বাক্সে কিছু ফার্নিচার যাচ্ছিলো, তার পাশে গুটিসুটি হয়ে ট্রেসি বসে পড়লো। ওপর থেকে ক্যানভাস চাপা দিয়ে দড়ি বাঁধা হল। সামান্য ফুটো আছে তাই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে না।
ভ্যানে তোলার আগে হারটগ বলল–ভয় পাবার কিছু নেই ট্রেসি, সব ঠিকঠাক চলেছ। জেফ তোমার কাছ থেকে হীরের বাক্সটা নিয়ে নেবে। সুইজারল্যান্ড যাবার প্লেনের টিকিট দেবে। যদি অঘটন ঘটে যায় তাহলে এই চাবি নাও, দিয়ে দিলাম, আমস্টারডামে একটা খালি বাড়ি আছে, তুমি সেখানে লুকিয়ে থেকো।
বিশাল ৭৪৭ বোয়িং মালবাহী উড়োজাহাজে ট্রেসি সমেত প্যাকিং বাক্স বোঝাই হয়ে গেল। পাশেই আসল হীরের প্যাকিং বাক্স।
ট্রেসির মনে হল যেন প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে, ট্রেসি জলে ডুবে যাচ্ছে, কেউ তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে না, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে।
ছুরি দিয়ে ক্যানভাস কেটে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল ট্রেসি। মনের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা। কতটা সময় পাওয়া যাবে সে বুঝতে পারছে না।
ক্লান্তিতে তার সমস্ত শরীর ঘামতে শুরু করেছে। হাত তুলতে পর্যন্ত পারছে না। ঘোরের মধ্যে থেকে কিভাবে হীরেটা সরিয়ে আবার ঠিকঠাক করে নিজের প্যাকিং বাক্সে ঢুকেছে সে জানে না। খালি তার মনে হয়েছে এখন ঘুম ছাড়া আর কিছু সে চায় না।
কখন প্লেন আমস্টারডামে নেমেছে, ট্রেসি ভর্তি প্যাকিং বাক্স ডেলিভারী দেওয়া হয়েছে। তাও সে জানে না।
আধো জাগরণের মধ্যে সে দেখলো জেফ সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে–তুমি পেরেছো কাজটা করতে, বাক্সটা দাও। তোমার সঙ্গে লিসবনে দেখা হবে।
গুদাম ঘরের মালিক ট্রেসির ফ্যাকাশে মুখ দেখে ডাক্তার ডাকার কথা বলল। ট্রেসি আপাততঃ আমস্টারডামের সেই খালি বাড়িটায় গিয়ে বিশ্রাম নেবে। প্রাণশক্তি কিছুই অবশিষ্ট নেই তার।
সেই বাড়িতে পৌঁছে বিছানাতে শুয়ে ট্রেসি জ্ঞান হারালো।
ইন্সপেক্টর ট্রিগনান্টের সামনে যখন টি, ডবলিউ লেখা রুমালটা মেলে ধরা হল, তখন তিনি হাঁ করে অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন। এবার বললেন ড্যানিয়েল কুপারকে খবর দাও।
.
৩২.
হল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রাম আলকামার। এখানে ডাচ এয়ারলাইন্সের এক বিমান সেবিকার সঙ্গে বেশ কিছুদিন জেফ কাটিয়েছিল। ভাষাটাও মোটামুটি রপ্ত করেছে। এখানে অনায়াসে লুকিয়ে থাকা যায়। তাই ওই নিরাপদ বাড়িটা থেকে ট্রেসির আধা-অচেতন দেহটা নিয়ে সে চলে এসেছে আলকামার গ্রামে। সেখানে এক হোটেলে উঠেছে। বলেছে আমরা হনিমুনে এসেছিলাম, হঠাৎ স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার ডাকা দরকার কিন্তু এখন নয় সময় হলেই জানাবো।
ঘরে এনে ট্রেসিকে খাটে শুইয়ে দিয়েছে। দেখলো তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে। জামা কাপড় খুলে তোয়ালে দিয়ে ট্রেসির শরীর মুছিয়ে দিয়েছে। রাতে আবার ধুম জ্বর এল। পরদিন সকালে জেফ বেশ কিছু ওষুধ থার্মোমিটার কিনে আনলো।
পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে ট্রেসি অনেকটা স্বাভাবিক হল। এই আটচল্লিশ ঘণ্টা জেফ এক মুহূর্তের জন্যও চোখের পাতা বন্ধ করেনি। ট্রেসিকে সে কি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে?
সত্যিকারের জ্ঞান ফিরলো অনেকক্ষণ বাদে। সব ঘটনা মনে পড়ল। জানলার কাছে বড়ো কোচের ওপর গুটিসুটি মেরে জেফ শুয়ে আছে কেন?
ও ভাবতে ভাবতে জেফ উঠে বসলো, যাক সুস্থ হয়েছে তাহলে?
–জেফ আমি তো তোমাকে হীরেগুলো দিয়েছি, আবার এসেছো কেন?
–হীরেটা নেবার পর আমি এয়ারপোর্টে গেলাম দেখতে তুমি ঠিকমত পালাতে পারলে কিনা। প্লেন ছেড়ে দেবার পর যখন এলে না তখন বুঝতে পারলাম তুমি ওই নিরাপদ আস্তানায় চলে গেছো। তখন তুমি পুরো অজ্ঞান ছিলে, আমি তুলে না আনলে তুমি বোধহয় বাঁচতে না।
ধরা পড়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও জেফ তাকে একদিন ধরে সেবা করেছে ট্রেসির বিশ্বাস হয় না। এর অন্তরালে নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে।
–হারটগকে ফোন করেছিলাম তোমার ৫০ হাজার ডলার সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে দিয়েছে।
সবটাই তুমি মেরে দিলে না কেন? ট্রেসির কথায় স্থল ছিল।
জেফ বলল–আমাদের এইভাবে পরস্পরকে নিয়ে ইঁদুর খেলার অবসান হওয়া উচিত বুঝেছো?
–বুঝেছি, মুখে বললেও ট্রেসি মনে মনে জানে এই খেলা কোনদিন শেষ হবে না।
–তোমার জামা জুতোর সাইজ বলল, সব কিনে আনতে হবে। এই কথা শোনা মাত্র ট্রেসি লজ্জায় কুঁকড়ে গেল, সে বুঝতে পারলো এই কদিন সে বিনা পোশাকেই ছিল, জেফ তার গা মুছিয়েছে, তার জ্বর দেখেছে। নাহ, লোকটাকে বোঝা মুস্কিল।
বিকেলে সুটকেস ভর্তি জামাকাপড় আনলো দুজনের জন্য। সেই সঙ্গে খবরের কাগজ। হীরে চুরির খবর বিস্তারিতভাবে লেখা হয়েছে, সম্ভাব্য চোরের নাম জানা যায়নি বলা হয়েছে।
জেফ হেসে বলল, তাহলে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ।
ড্যানিয়েল কুপারের নির্দেশে ট্রেসি হুইটনির রুমালের কথাটা সাংবাদিকদের বলা হয়নি। তাছাড়া টি, ডবলিউ মানে হাজার হাজার মহিলা আছে ইউরোপে, সেই সূত্র থেকে ট্রেসিকে ধরা সহজ হবে না।
গির্জায় বসে ড্যানিয়েল কুপার প্রার্থনা করলো–প্রভু, ওকে আমার হাতে তুলে দাও। ও আমার হাতে শাস্তি পেলে আমি পাপমুক্ত হব। কিন্তু ট্রেসির নগ্ন শরীরের কথা চিন্তা করলেই তার মাথার ভেতর কেমন যেন কামনার ঝড় ওঠে। ড্যানিয়েল তাড়াতাড়ি গির্জা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।
ট্রেসির ঘুম যখন ভাঙলো তখন বেশ অন্ধকার। জেফকে দেখতে না পেয়ে নিজেকে কেমন অসহায় বলে মনে হল।
জ্বর ছাড়লো একেবারে রাতের বেলায়। গায়ে একটু জোর এল। রাতে শুয়ে শুয়ে জেফকে তার অতীত জীবনের সব কাহিনী বলল। জেফ নিজে অন্য একটি ছোটো খাটো বিছানায় শুতে। সেও তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানালো।
একদিন সকালে জেফ বলল–পুলিশ বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছে, এবার এখান থেকে পালাতে হবে।
উৎসুক চিত্তে ট্রেসি জানতে চাইলো–কবে?
–কালই।
–ঠিক আছে, আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি।
সে রাতে ট্রেসির ঘুম আসছে না, অনেকক্ষণ ছটফট করার পর সে বলল–তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছো?
–না।
–কি চিন্তা করছিলে?
–কালকের কথা, এ জায়গাটা ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে।
–আমার কষ্ট হবে তোমাকে ছেড়ে থাকতে।
–কতটা?
–ভীষণ–
জেফ উঠে এল ট্রেসির খাটের কাছে, ট্রেসি–।
এই মুহূর্তটির জন্য ট্রেসি বোধহয় অপেক্ষা করছিল। সে দুহাত বাড়িয়ে জেফকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে বলল–কোনো কথা নয়, আমাকে ভীষণ ভীষণ আদর করো।
তারপর ঘণ্টাখানেক ওরা দুজন স্বর্গরাজ্যের বাসিন্দা হয়ে গেল।
সকালে ট্রেসিকে আদর করতে করতে জেফ আবদার করেছিল, তুমি কি আমাকে বিয়ে–করবে?
জেফের বুকে মুখ লুকিয়ে ট্রেসি বলল, হ্যাঁ।
কীভাবে আগামী জীবন গড়ে উঠবে দুজনে তার পরিকল্পনা করতে থাকলো। দুজনেই প্রচুর টাকা জমিয়েছে। এখন ভদ্র জীবনে ফিরে যাবে।
তাহলে পুলিশকে জানিয়ে দিই সে কথা–জেফের কথায় হেসে উঠলো ট্রেসি।
পরদিন হারটগের ফোন এল। একটা কাজের ব্যাপার আছে, দুজনে করবে কি?
–না না আমরা এই লাইন ছেড়ে দিয়েছি, আরেকটা কথা আমরা বিয়ে করছি।
হারটগ অভিনন্দন জানিয়ে বলল–কালে আসছি, কথা হবে।
জেফ আর ট্রেসি ঠিক করল হারটগের প্রস্তাবে রাজী হবে না। শেষ পর্যন্ত হারটগ একটা দুঃসাহসী কাজের কথা পাড়ল। ট্রেসি শেষ পর্যন্ত রাজী হল। মনে মনে শপথ করল এটাই আমার শেষ কাজ। কাজটা প্রায় অসম্ভব, করতে পারলে বিশ লাখ ডলার পাওয়া যাবে।
ট্রেসিরা আমস্টারডামে ফিরতে না ফিরতেই পুলিশ তাদের অনুসরণ করতে শুরু করলো। হল্যান্ডের পুলিশ ট্রেসিকে উচিত শিক্ষা দেবে এমন আস্ফালন শোনা গেল।
ড্যানিয়েল কুপারকে সাহায্য করলেন ইন্সপেকটর দুরেন।
এখানেও ট্রেসি আর জেফ দর্শনীয় স্থানগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ড্যানিয়েল কুপার জানে এর অন্তরালে কোনো একটা গোপন কারণ আছে।
গোয়েন্দারা প্রত্যেকদিন ড্যানিয়েল ও দুরেনকে রিপোর্ট দিচ্ছে সন্দেহজনক কিছু নেই।
একদিন সকালে ওরা দুজনে গেল হল্যাণ্ডের বিখ্যাত হীরে কাটার কারখানা দেখতে।
সরকারী গাইড সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগল। কাঁচের ডোমের তলায় রাখা একটা হীরে দেখিয়ে বলল–লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন–এটা হল পৃথিবীর বিখ্যাত লুকুলান হীরে, এর দাম এক কোটি ডলার।
জেফ চেঁচিয়ে বলল–তাহলে চুরির ভয় আছে নিশ্চয়ই।
ড্যানিয়েল কুপার পায়ে পায়ে সামনে এগিয়ে এসেছে। সে বুঝতে পারছে এই হীরেটা চুরি করার চেষ্টা করা হবে।
ড্যানিয়েল কুপার আর গোয়েন্দার মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেল। পরদিন তারা দুজন গেল বিখ্যাত মিউজিয়ামে। রেমব্রার বিখ্যাত ছবি দি নাইট ওয়াচ-এর সামনে দাঁড়িয়ে জেফ গাইডকে জিজ্ঞাসা করল, পাহারার বন্দোবস্ত ঠিক মতো আছে তো?
–তা আর বলতে, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র লাগানো আছে, কেউ সাহস করবে না।
–আশা করি এরপর কেউ চুরি করবে না, কি বলো?
ড্যানিয়েল কুপার আর গোয়েন্দা তখন আরো একবার চোখে চোখ রাখলো।
তৃতীয় দিন ওরা গেল কনভেনশন সেন্টারে। ডাকটিকিটের প্রদর্শনী দেখতে। ব্রিটিশ গায়নার ছকোণা ডাকটিকিট, মরিশাসের একলাখ ডলারের এক পেনীর টিকিট দেখে আবার জেফ পাহারাদারকে শুনিয়ে একই কথা বলল।
তিনদিনের এই রিপোর্ট পেশ করে ড্যানিয়েল তার পুরনো অনুরোধ আবার পেশ করলো, জেফ ও ট্রেসির ঘরে ছোট ছোট মাইক্রোফোন ফিট করতে হবে। তারা কি কথা বলে সবকিছু টেপ করা দরকার। পুলিশ কমিশনার এবার আর না বলতে পারলেন না।
.
৩৩.
পরদিন সকাল থেকে টেপ রেকর্ডারের কাছে হুমড়ি খেয়ে বসে থাকতে দেখা গেল ড্যানিয়েল কুপার, ইন্সপেকটর দুরেন আর সহকারী গোয়েন্দা উইটক্যাম্পকে।
কি কথা হচ্ছে দুজনের মধ্যে?
প্রথম জেফের গলা শোনা গেল–আরেকটু কফি দেবো।
–এই চীজটা খাও, দারুণ খেতে—
–রোটারডামে বেড়াতে যাবে?
–না, বিশ্রাম নেবো।
একটু বাদে জেফের গলা–জানো, এই হোটেলে কোটিপতি ম্যাক্সিমিনিয়াম পিয়ের পন্ত আছে। জাহাজে ওকে বধ করতে পারিনি, মনের ভেতর একটা কাঁটা খচখচ করছে।
–আমিও শুনেছিলাম ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে যাবে।
পুলিশ কমিশনারকে রিপোর্ট দেওয়া হল, ওই হোটেলের ওপর কড়া নজর রাখতে।
সকাল নটাতে আবার খবর পাওয়া গেল–অ্যামরো ব্যাংক ৫৩ লক্ষ ডলার দামের সোনার বাট পাঠাচ্ছে ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজে–
–কত ওজন হবে?
–কতো আর হবে, এক হাজার ছশো বাহাত্তর পাউণ্ড।
–প্রায় কুড়ি মণ, ও নিয়ে পালানো মুস্কিল।
–আমরা চাইলে সব মুস্কিল অবসান হবে।
পুলিশ ব্যাংকের ব্যাপারে সতর্ক হবে ঠিক করলো। ট্রেসিদের পেছনে আরও গোয়েন্দা লাগানো হল।
পরের পাঁচদিন অবিরাম অনুসরণ করে গোয়েন্দারা যে খবর জোগাড় করলো তা বিস্ময়কর। দেখা গেল জেফ একটা ছাপাখানায় ঢুকেছে। ও বেরিয়ে যাবার পর গোয়েন্দা গেল, নিজের কার্ড দেখিয়ে প্রশ্ন করলো, ওই লোকটা কোন্ কাজে এসেছিল?
–কার্ড ছাপাতে।
গোয়েন্দা দেখলো কার্ডে লেখা আছে—
আমস্টারডামের নিরাপত্তাবাহিনী
কর্নেলিয়াস উইলসন, মুখ্য তদন্তকারী।
পরের দিন গোয়েন্দা খবর আনলো ট্রেসি একটা পোষা পশুপাখি বিক্রির দোকানে ঢুকেছে। সেখানে একগাদা পাখির অর্ডার দিয়েছে। তার মধ্যে আছে কয়েকটা পায়রা, দুটো লাভবার্ড, একটা ক্যানারী, কিছু গোল্ড ফিস।
–পায়রা? ডাক পায়রা? যে পায়রার গলায় খবর বেঁধে দিলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে যায়? এ ধরনের পায়রাতো ওখানে বিক্রি হয় না।
ড্যানিয়েল কুপারের মাথা খারাপ হবে বোধ হয়।
আমরো ব্যাংক থেকে জেফ বেরিয়ে আসার পর সেই গোয়েন্দা গিয়ে প্রশ্ন করলো মিঃ উইলসন, উনি কি জানতে এসেছিলেন যে আপনার ব্যাংকের নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো ঠিক আছে কিনা?
–উনি যে সঠিক লোক সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন কি করে?
–কেন? ওই কোম্পানী আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে দেখাশোনা করে, তাছাড়া কার্ডের ফোন নম্বর দেখে ফোনও করেছিলাম, সব ঠিক আছে।
বিকেল তিনটের সময় একটা সাঁজোয়া গাড়ি ব্যাংকের সামনে এসে দাঁড়ালো, জেফ আড়াল থেকে তার কয়েকটা ফটো তুলল। গোয়েন্দা আবার জেফের ফটো তুলল।
পুলিশ কমিশনার যখন শুনলেন বিপুল পরিমাণের সোনা চুরি হতে চলেছে, তিনি আঁতকে উঠলেন।
–কি করে তা সম্ভব? সত্যিকারের গাড়ি আসার আগে ওরা একটা গাড়ি নিয়ে আসবে, সোনা বোঝাই করে বেরিয়ে যাবে। ড্যানিয়েল কুপার বলল।
–বড্ড বেশি কল্পনা করা হচ্ছে না?
–না, ওরা কিছু একটা করবেই।
ট্রেসিকে দেখা গেল জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে থাকতে। সে একটা মাঝারী স্টীমার ভাড়া, করবে। ওখান থেকে বেরিয়ে এসে হারটগকে ফোন করলো।
ওর ওপর ভরসা করতে পারি, আরও দুসপ্তাহ সময় লাগবে।
হারটগ ফোনটা ছেড়ে দিল।
পরদিন ১১টার সময় গোয়েন্দা খবর দিল জেফ একটা কারখানা থেকে সাঁজোয়া গাড়ি কিনছে। সেটা যাতে ভারী লোহা বইতে পারে তার জন্য পাটাতনে লোহর পাত বসাতে হবে।
রঙের কারখানা থেকে খবর পাওয়া গেল সরকারী সাঁজোয়া গাড়ির মতো এই গাড়ির রঙ নীল করতে অর্ডার দেওয়া হয়েছে।
পশুপাখির দোকানের মালিক জানালোপায়রাটা ডাক হরকরা নয়। মাঠ থেকে ধরে এনে ডেলিভারী দেওয়া হয়েছে।
ড্যানিয়েল বুঝতে পারছে না পায়রার মাধ্যমে কিভাবে কুড়ি মণ সোনা পাচার হবে।
অ্যামরে ব্যাংক থেকে সোনা পাঠাবার পাঁচদিন আগে সব ফটো আর রিপোর্ট রাখা হল পুলিশ কমিশনারের সামনে। ট্রেসি সোনাটা ওই ভাবে ট্রাকে চাপিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর স্টীমারে করে একদেশ থেকে অন্য দেশে পাঠাবে।
জেফ আবার উর্দির অর্ডার দিয়েছে, এবার ট্রেসিকে নিয়ে সে গেল গ্যারেজে। জেফ ড্রাইভারের সিটে বসে একটা সুইচ টিপতেই সাঁজোয়া গাড়ীটার দুধারের কাপড় সরে গেল। গাড়ীটার গায়ে লেখা হিংকেন বিয়ার কোম্পানী। দূরে একটা বাড়ির ছাদ থেকে গোয়েন্দারা। ওই ছবিটিও তুলল।
আরও একটা খবর পাওয়া গেল। জেফ রটারডম বন্দর থেকে হংকংগামী জাহাজে কিছু মাল পাঠাবার কথা বলে এসেছে।
–তাহলে ওদের এখুনি ধরা হচ্ছে না কেন?
উত্তেজিত কমিশনার জানতে চাইলেন।
শান্ত হয়ে ড্যানিয়েল কুপার জবাব দিল হাতে নাতে ধরতে চাই, তা নাহলে কেস প্রমাণ করা যাবে না।
আমেরিকান এক্সপ্রেস অফিস থেকে ট্রেসি বেরিয়ে এল। হাতে মাঝারি আকারের একটা বাণ্ডিল।
ট্রেসি সোজা হোটেলে এল। কিছুক্ষণ পরে আবার বেরিয়ে গেল। তারপর পুলিশ গিয়ে দেখলো বাণ্ডিলটা নেই।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেবেলায় ড্যানিয়েল কুপার ট্রেসির হোটেলের ওপর তলায় টেপ রেকর্ডারে মন দিল।
প্রথম জেফের গলা–পাহারাদাররা আসার ত্রিশ মিনিট আগেই আমরা যদি পৌঁছে যাই তাহলে সোনা বোঝাই করে পালাতে কোনো অসুবিধা হবে না। আসল সাঁজোয়া গাড়ি আসার আগেই মাল স্টীমারে উঠে যাবে।
আবার ট্রেসির গলা পাওয়া গেল–আমি পেট্রল ভরে রাখছি।
এবার জেফের গলা–তাহলে কাল সকালে–।
ড্যানিয়েল বলল–দুরেন, কাল সকালের মধ্যেই দুজনকে জেলে পুরতেই হবে।
সমস্ত রাত ড্যানিয়েলের ঘুম এল না। বিভিন্ন চিন্তা তার মাথার ভেতর ঘুরছে। ট্রেসি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে, এবং প্রচণ্ড ভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে–এই কাল্পনিক দৃশ্যটা তার মাঝরাতের ঘুম কেড়ে নিল। বাথরুমে গিয়ে টবে গরম জল ভরে স্নান করলো। নাঃ, মেয়েটাকে চরম শাস্তি দিতে হবে। তারপর ফ্ল্যাটে ফিরবে। বাড়ি বলতে তার কিছু নেই, ছিল এককালে, যখন সে ছিল মার নিরাপদ আশ্রয়ে।
ড্যানিয়েলের যখন বয়স চার বছর তখন ওর বাবা বাড়ি থেকে চলে যান, পরে মার কাছে ড্যানিয়েল শুনেছিল এক মেয়ে মানুষের টানে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ড্যানিয়েল ওই অদেখা মহিলাটিকে ঘৃণা করতো।
ড্যানিয়েল তার মার সঙ্গে শুতো, একদিন বলে ফেলেছিল–আমি বড়ো হয়ে তোমাকে বিয়ে করবো। ওর মা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।
ক্লাসে ড্যানিয়েল সব সময় ফার্স্ট হতো। সবাই বলতো মিসেস কুপারের ছেলেটি বুদ্ধিমান।
সব কিছু ড্যানিয়েলের মনে আছে, যখন তার বয়স সাত বছর তখন ওর মা প্রতিবেশী এক পুরুষকে বাড়িতে ডাকতেন, লোকটার চেহারা বিশাল, সমস্ত শরীরে বড়ো বড়ো লোম। ওর সাথে মাকে অন্তরঙ্গ ভাবে বসে থাকতে দেখে ড্যানিয়েল অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সেটা বুঝতে পেরে মাও কথা দিয়েছিলেন ওই লোকটির সঙ্গে তিনি আর মিশবেন না।
আজ আমস্টারডাম হোটেলের বাথটবে শুয়ে সে দিনের ভয়ংকর দৃশ্যটা তার মনে। পড়ে যাচ্ছে। কানে ব্যথা হওয়ায় স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি পেয়ে যায় ড্যানিয়েল, বাড়ি চলে আসার আরেকটা কারণ ছিল, সে দিনটি ছিল ড্যানিয়েলের জন্মদিন, ভেবেছিল মার কাছ থেকে বেশি আদর পাবে।
মার শোবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো ড্যানিয়েল। মা আর পাশের বাড়ির সেই ষাঁড়ের মতো লোকটা বিছানাতে শুয়ে অদ্ভুত খেলায় মত্ত।
নিজের ঘরে এসে বমি করে সে শান্ত হল। কিছুক্ষণ পরে ও শুনতে পেলো মা লোকটাকে বলছে–এবার তুমি চলে যাও, ড্যানিয়েলের আসার সময় হয়েছে।
এরপর অবাক করা একটা ঘটনা ঘটে যায়। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে ড্যানিয়েল গেল মার বাথরুমে। জলপড়ার শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছিল মা সেখানে ঢুকেছে। তার হাতে ছিল দর্জিদের বড়ো কঁচি।
মা তাকালো, বললো-ড্যানিয়েল তুমি?
শব্দ শেষ হল না, ধারালো কাঁচি দিয়ে বার বার মার বুকে প্রাণপণ আঘাত করতে লাগল ড্যানিয়েল। ড্যানিয়েলের অদ্ভুত একটা চাপা গর্জনে মায়ের কাতর আর্তনাদ কেউ শুনতে পেল না।
ড্যানিয়েল বাথটবে নেমে পড়লো। গায়ের রক্ত ধুতে হবে। স্নান সেরে উঠে এল সে, কঁচিটার হাতল তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেলে দিল বাথটবে।
ঘরে এসে জামাকাপড় পরে ফোন করল পুলিশে।
পাশের বাড়ির লোকটা মাকে খুন করেছে, তাকে শাস্তি পেতেই হবে।
ফ্রেড জিমার ড্যানিয়েলের মায়ের সঙ্গে গোপন প্রেমের কথা স্বীকার করেছিল, কিন্তু খুনের কথা সে মানতে চায় নি। শুধু বলেছিল এই ব্যাপারে আমার কোনো দোষ নেই। বারো বছরের ড্যানিয়েলের সাক্ষ্যতে ফ্রেড জিমারের ফাঁসি হয়ে যায়। কোনো জেরার মুখে ওই ছেলেটি ভেঙে পড়েনি।
ড্যানিয়েলকে পাঠিয়ে দেওয়া হল দূর সম্পর্কের এক পিসীর কাছে, টেক্সাসের ম্যাটি পিসী, ভীষণ গোঁড়া আর ধার্মিক ছিলেন।
কয়েক বছর সেখানে থাকার পর পালিয়ে এল ড্যানিয়েল। সোজা নিউইয়র্কে। যোগ দিল পিওনের কাজে, আন্তর্জাতিক বীমা সংরক্ষণ সমিতিতে। তিন বছরের মধ্যে তদন্তকারীর পদ পেয়ে গেল। তারপর থেকেই ওর মনে হতো সে যেন ঈশ্বরের ডান হাত, পাপীদের শাস্তি দেবার জন্যই তার জন্ম হয়েছে।
আগামীকাল আরেকটা অসৎ মানুষকে শাস্তি দিতে হবে।
.
৩৪.
আমস্টারডাম, শুক্রবার, ২২ আগস্ট সকাল ৮টা
হোটেলের ছাদের ঘরে ড্যানিয়েলরা বসে আছে। জেফ আর ট্রেসি ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে কি বলছে তা শুনেছ–
–রোল দেব একটা? চা না কফি?
–দরকার নেই।
–স্টীমারে করে যেতে ভালোই লাগবে জেফ।
–শুধু তুমি আর আমি—
আবোল তাবোল কথা বলে চলেছে দুজন। ড্যানিয়েল ঘড়ি দেখলো, নটা বেজে গেছে, ওদের তৈরি হতে হবে।
নটা বেজে তিরিশ-ড্যানিয়েল অধীর হয়ে উঠল। এবার তো ওদের বেরিয়ে পড়া উচিত।
এমন সময় টেপ রেকর্ডারে অন্য একজনের গলা ভেসে এল, হায় ভগবান, এখানে তো কেউ নেই দেখছি।
নারীর কণ্ঠস্বর–কেউ নেই অথচ কথা শুনছি।
ট্রেসির গলা–বাজী রাখতে পারি এখানে ওসব নেই।
ড্যানিয়েল কুপার চমকে উঠলোকী হচ্ছে এসব?
শোনা গেল ঘর পরিষ্কার করার ঝি টেলিফোন করছে–ঘরে কেউ নেই, অথচ কথা শোনা যাচ্ছে।
ড্যানিয়েলরা ছুটলো ট্রেসির ঘরে, কফি টেবিলে একটু আড়াল করে রাখা টেপ রেকর্ডার চলছে–না, দাও একটু কফি দাও ট্রেসি।
ড্যানিয়েল বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো। পাগলের মতো এমারজেন্সী নম্বরে ফোন করল পুলিশকে ইন্সপেক্টর ভ্যান দুরেনকে খবর দিন। ট্রেসি আর জেফ হোটেল থেকে হারিয়ে গেছে। এখুনি ওদের গ্যারেজটায় যেতে হবে। আমি ব্যাঙ্কে যাচ্ছি।
দুরেন জানালো ট্রেসিরা গ্যারেজ থেকে সাঁজোয়া ট্রাকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তারপর ওরা তিনজন অ্যামরো ব্যাঙ্কের উল্টো দিকে একটা উঁচু বাড়ির ছাদে গিয়ে লুকোলো।
–আমরা ওদের কথা শুনে নিয়েছি বুঝতে পেরে ওরা বোধহয় তাদের পরিকল্পনাটা বাদ দিয়েছে।
এই কথার কোনো উত্তর দিল না ড্যানিয়েল।
ব্যাঙ্কের ভেতর হৈ চৈ হচ্ছে, দূর থেকে একটা সাঁজোয়া লড়িকে আসতে দেখা গেল। ওয়াকিটকির মাধ্যমে সকলকে সতর্ক করে দেওয়া হল।
ট্রাটা এসে দাঁড়াল ব্যাঙ্কের বড়ো গেটের সামনে। দুজন উর্দিপরা পাহারাদার ব্যাঙ্কের ভেতর চলে এসেছে। ট্রেসি কোথায়?
সোনা বোঝাই করতে মাত্র ৮ মিনিট সময় লাগলো। দরজার তালা বন্ধ করে ড্রাইভারের সিটে পাহারাদার দুজন উঠতে যাবে এমন সময় দুরেনের পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ল ট্রাকটির ওপর। পাহারাদার দুজনকে নামানো হল। কিন্তু কি আশ্চর্য এরা সত্যি সত্যি কোম্পানীর লোক।
ড্যানিয়েল কুপারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো, সে সব কথা গোপনে শুনেছে, কিন্তু চোখের সামনে এসব কি ঘটছে?
নেদারল্যান্ড হীরে কাটা কারখানার বহু দর্শকের মধ্যে জেফ আর ট্রেসিকেও দেখা গেল। দাড়ি-গোঁফে জেফকে চেনা যাচ্ছে না, পিঠে একটা ব্যাগ, ট্রেসিকে দেখলে মনে হচ্ছে সে বোধহয় সাত মাসের পোয়াতি। প্রচণ্ড সেজেছে, হাতে একটা ব্রিফকেস। বাদামী কাগজে মোড়া গোল একটা বাণ্ডিল।
গাইডের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে ট্রেসি দোতলায় চলে এল। কখন যে জেফ কেটে পড়েছে কেউ জানে না, জেফ মাটির তলার বেসমেন্ট ঘরে চলে গেছে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রির পোশাক বের করে পরে নিয়েছে। হাতে যন্ত্রপাতির বাক্স। ঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সে।
ট্রেসিও ঘড়ি দেখলো, ভীড়ের মধ্যে লুকুলান হীরে দেখছে। গাইড বলতে শুরু করেছে এটা হল পৃথিবীর সব থেকে দামী হীরে।
দপ্ করে আলোটা নিভে গেল। অ্যালার্ম ঘণ্টা বাজা আর দরজা বন্ধ হয়ে গেল যন্ত্রের মতো।
ভয় পাবেন না–। আবার আলো ফিরে এল।
দেখলেন তো ভয় পাবার কিছু নেই।
টেলিফোন বেজে উঠল, গাইড বলল–না হেনড্রিক, ভয় পাবার কিছু নেই। ফলস। অ্যালার্ম বেজেছে।
এই দেখুন হীরে–এগুলো বিক্রির জন্য। আবার আলো নিভলো, আবার হট্টগোল। কয়েক সেকেন্ড বাদে আলো ফিরলো। কিন্তু এবার আললাগুলি ভীষণ ভাবে কাঁপছে। জেফ আলো কপার ব্যাপারটি নিশ্চিত করে ওপরে উঠে এল। গাইডের কাছে গিয়ে বলল আলোর কোনো গণ্ডগোল হচ্ছে কি?
–দেখো না, কেমন কাঁপছে তুমি কি ঠিক করতে পারবে?
গাইড ছদ্মবেশী জেফকে নির্দেশ দিয়ে ট্যুরিস্টদের নিয়ে পড়লো–
দর্শকরা এগিয়ে গেল শো কেসের দিকে। সেই ফাঁকে জেফ পকেট থেকে ছোট্ট একটা জিনিস বের করলো। তার পিনটা খুলে ছুঁড়ে দিল লুকুলান হীরের থামের পাশে। জিনিসটা থেকে ধোঁয়া আর আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে।
জেফ গাইডকে লক্ষ্য করে বলল–এখানে সর্ট সার্কিট হয়েছে।
এক মহিলা দর্শক চিৎকার করে উঠলেন–আগুন।
জেফ লুকুলান হীরের স্ট্যান্ডটার দিকে এগোতে গেল। গাইড বলল, ওখানে যাওয়া মানা।
ভালই হল, তাহলে ওটা তোমার দায়িত্ব।
জেফ চলে যাবার ভঙ্গি করলো। ধোঁয়া প্রচণ্ড বেগে বের হচ্ছে। গাইড ফোন করে অ্যালার্মের লাইনটা কয়েক মিনিটের জন্য কাটতে বলল।
–নাও তাড়াতাড়ি সারো।
জেফ এগিয়ে গেল, গাইড চলে এল। সশস্ত্র প্রহরীকে দর্শকদের দিকে নজর রাখতে বলল।
–আপনারা যদি চান হীরে কিনতে পারেন।
এমন সময় ট্রেসি বলল, আপানারা হীরে কেনেন না? আমার স্বামী এই কদিন হল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরেছে। আমি এগুলো বিক্রি করতে চাই।
সে হাতের অ্যাটাচিটা উল্টো করে খুললো, কয়েকশো হীরে ছড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।
মুহূর্তের মধ্যে দর্শকদের ভেতর হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ট্রেসি চেঁচিয়ে বলল, আমার হীরে–আমার হীরে কোথায়?
সশস্ত্র পাহারাদার ওদের শান্ত করতে এগিয়ে এল। ভীড়ের ধাক্কায় তারা মাটিতে পড়ে গেল। যখন উঠে দাঁড়ালো তখন দেখলো লুকুলান হীরে নেই, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আর গর্ভবতী মহিলাকে দেখা যাচ্ছে না।
হীরে কারখানা থেকে অনেক দূরে গিয়ে একটা পাবলিক বাথরুমে ঢুকে ট্রেসি তার ছদ্মবেশ পাল্টালো। বাদামী কাগজে মোড়া বাণ্ডিলটা নিয়ে পার্কে এসে বসলো।
কয়েকটা জারকন ফেলে দিয়ে দর্শকগুলোকে বুদু বানিয়েছে। একটু বাদে জেফ ওখানে এল। লুকুলান হীরের প্যাকেটটা ট্রেসিকে দিয়ে বলল–এই বন্ধুটাকে কাজে লাগাও।
জেফ চলে গেল। ট্রেসি ভাবলো এবার দুজনে চলে যাব ব্রেজিলে, আলাদা আলাদা প্লেনে, চারপাশ দেখে নিয়ে বাদামী কাগজের মোড়কটা ছিঁড়তেই একটা খাঁচা বেরিয়ে এল। ভেতরে একটা পায়রা। তিনদিন আগে এটাই এসেছিল, আমেরিকান এক্সপ্রেস অফিসে, হারটগ এটাকে পাঠিয়েছিল। এটা প্রশিক্ষিত একটা ডাক পায়রা।
হোটেলে এনে এখান থেকে কেনা সাধারণ পায়রাটাকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। খাঁচাতে এটাকে আটকে রাখা হয়। সে হীরে সুষ্ঠু থলেটা পায়রার পায়ে বেঁধে দিল।
বলল, লক্ষ্মীটি মারগো, এবার এটা নিয়ে লন্ডনে চলে যাও।
পায়রাটাকে ওড়াতে যাবে এমন সময় উর্দিপরা পুলিশ এগিয়ে এসে বলল, কি করছেন আপনি? জানেন না এখানে পায়রা ধরা নিষিদ্ধ।
–ভুল হয়ে গেছে অফিসার, আমি বিদেশী তাই বুঝতে পারিনি। আর কখনও করবো না। এটা ছেড়ে দিচ্ছি।
পায়রাটা আকাশে উড়তে শুরু করলো। তার দিকে একবার তাকালো ট্রেসি। বুকের ওপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে গেল।
সন্ধ্যের পর ট্রেসিকে দেখা গেল এয়ারপোর্টে। ব্রাজিলগামী প্লেনে ওঠার জন্য সামনে এগিয়ে গেল। ড্যানিয়েল কুপার তার ওপর নজর রেখেছে। হীরে চুরির খবরটা ড্যানিয়েল কুপার শুনেছে। সে জানে এটা ট্রেসির কাজ। এমন ফন্দি খাঁটিয়ে চুরি করা অন্য কারোর পক্ষে সম্ভব নয়।
অথচ তাকে ধরা যাচ্ছে না। ট্রেসি আর জেফের ফটো দেওয়া হল গাইড আর গার্ডের হাতে। তা সত্ত্বেও কিছু করা গেল না।
মিস্ত্রিটা দাড়িওয়ালা, মহিলা তো গর্ভবতী, চুলের রং কুচকুচে কালো। নাঃ, ফটোর সঙ্গে মিলছে না।
ট্রেসি-জেফের জিনিসপত্র খোলা হল। হীরের নামগন্ধ নেই।
দুরেন বলল–হীরে শহরেই আছে, আমরা খুঁজে পাবো।
ড্যানিয়েল রাগত স্বরে বলল–না মেয়েটা পায়রা বদলে ফেলেছে।
ট্রেসি প্লেনের দিকে চলে যাচ্ছে। ড্যানিয়েল কুপার ভাবতে লাগল, এই প্রথম ও কারো কাছে বুদ্ধির খেলায় হেরে গেল।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার আগে ট্রেসি শেষবারের মতো পেছনে তাকালো। সে জানে ড্যানিয়েল সারা ইউরোপে তাকে অনুসরণ করে চলেছে। ড্যানিয়েলের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না।
ড্যানিয়েল কুপার বুক পকেটটা ছুঁলো, নাহ্, তার রেজিগনেশন লেটারটা ঠিকই আছে।
প্লেনের নরম গদীতে গা এলিয়ে দিয়ে আরামে চোখ বন্ধ করলো ট্রেসি। এখন শুধু জেফ আর সে সুন্দর জীবনের হাতছানি।
একজন মাঝবয়সী মোটাসোটা লোক বলল–ম্যাডাম কোণের সিটটা আমার।
ট্রেসি একটু পাশ কাটাতেই তার হাঁটুর ওপর স্কার্টটা সরে গেল। লোকটা লোলুপ দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে আছে।
লোকটাকে পাত্তা দিতে ইচ্ছে হল না ট্রেসির, লোকটা বলল–দিনটা ভালোই, কি বলেন?
ট্রেসি এখন চোখ বন্ধ করে জেফের কথা চিন্তা করবে। পাশে বসা লোকটি খোঁচা মেরে বলল–একসঙ্গে অনেক দূর যেতে হবে আমাদের, আলাপ পরিচয়টা করে নেওয়াই চালো তাই নয় কি? আমি হলাম ম্যাক্সিমিলিয়ান পিয়ের পন্ত। আর আপনি?
চোখের সামনে পিয়ের পন্তকে দেখে ট্রেসির সমস্ত শরীর ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। সে নিস্পৃহ কণ্ঠস্বরে বলল–আমার নামটা নাই বা জানলেন।
নাহ, এই অন্ধকার অতীতকে সে চিরদিনের মতো ভুলতে চায়। এখন ব্রাজিলের উদ্দাম সমুদ্র সৈকত, নীল আকাশ আর জেফের সান্নিধ্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন ম্যাক্সিমিলিয়ান পিয়ের পন্ত, আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি অসভ্য, অমিশুকে, কিন্তু আসলে আমি তা নই।
চোখ বন্ধ করার আগে শেষবারের মতো ট্রেসি ভাবল, হায়, যদি কয়েকদিন আগে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হতো, তাহলে…।