৪. জেট বিমানের শব্দ

এত জোরে জেট বিমানের শব্দ হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল বুঝি বিল্ডিংটার ওপরে আছড়ে পড়বে।

লোকটা তার ডেস্ক থেকে উঠে একটা বাইনোকুলার হাতে নিয়ে জানলার দিকে ছুটে গেল। বিমানটা দ্রুত নেমে আসছিল আধ মাইল দূরে ছোট্ট একটা বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য। রানওয়ে ছাড়া সবটাই বরফের ঢাকা। কারণ এটা সাইবেরিয়া এবং এখন শীতকাল।

লোকটি তার সহকারীকে বলল, চাইনিজদেরই প্রথমে আসার কথা। আমাদের বন্ধু লিঙ অঙ আর ফিরে যাবে না। গতবার শেষ মিটিং-এর পরে খালি হাতে তাকে ফিরতে হয়েছিল। তিনি চমৎকার লোক।

এমন সমসয় দ্বিতীয় জেট বিমানের তীব্র গর্জন শোনা গেল। সেই বিমান মাটিতে অবতরণের পর পুরু লেন্সের চশমা চোখে লাগিয়ে লোকটা টারম্যাকের দিকে তাকাল। মন্তব্য করল–এবার প্যালেস্তিনীয়রা এলো।–

আর একটা জেট বিমানের গর্জন শোনা গেল। এখনও বারোটা বিমান আসার কথা। আগামীকালের সবচেয়ে বড় নিলামে গোলমাল হতেই পারে। সে তার সহকারীকে মেমো লিখতে বলল

সমস্ত অপারেশন পার্সোনেলদের প্রতি গোপন ও ব্যক্তিগত মেমো। এটা পড়েই নষ্ট করে ফেলতে হবে। নির্ধারিত লক্ষ্যের ওপর কড়া নজর রেখে যেতে হবে। তার গতিবিধি রিপোর্ট করো এবং তার সম্ভাব্য পরিণতি পরিহারের জন্য প্রস্তুত থেকো।–

.

পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই ড্যানা টিম ড্রিউকে ফোন করল। সে জানতে চাইল,–রাষ্ট্রদূত হার্ডির কাছ থেকে কিছু শুনলে?– ড্যানা বলল,–না, আমার মনে হয় উনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। টিম, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।–

–ট্যাক্সি নিয়ে বয়রক্সি ক্লাবে চলে এসো।

–ঠিক আছে। আমি রওনা হচ্ছি।–

ক্লাবটি রীতিমতো আধুনিক। সেখানে টিম অপেক্ষা করছিল। ড্যানা তাকে বলল,–টেলর উইনথ্রপের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমি এমন কিছু রুশের সঙ্গে কথা বলতে চাই।– টিম বলল,–তাহলে একটু নীচু পদের কোন লোকের সঙ্গে তোমাকে কথা বলতে হবে। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের কমিশনার শ্যাডনফের সঙ্গে তুমি কথা বলতে পারো। আমার মনে হয় উইনথ্রপ তার সঙ্গে সরকারি ও সামাজিক দুদিক থেকেই দেখা করতেন বা পরামর্শ করতেন। তবে তুমি ঠিক কী জানতে চাইছ বলতো?–আমি নিজেই ঠিক জানি না।–

লাল রঙের ইটের বিল্ডিং-এর ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের অফিস। প্রহরী রয়েছে দুজন। তৃতীয় জন ডেস্কের সামনে বসে। ড্যানা তাকে জিজ্ঞেস করল,–কমিশনার, শ্যাডনফের সঙ্গে দেখা করা যাবে কী?–

অ্যাপয়েন্ট আছে?

–না।–

–তবে একটা দরখাস্ত করতে হবে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য। আপনি কি আমেরিকান?–হ্যাঁ।–

প্রহরী একটা ছাপানো ফর্ম ড্যানার হাতে তুলে দিল।

ড্যানা সেটা পূরণ করে দিয়ে জানতে চাইল,–আজ বিকেলে কি দেখা হতে পারে?

–আপনি কোন হোটেলে উঠেছেন?

–দ্যা সবাস্টোপোল।

–কেউ খবর দেবে ফোনে।–

সেদিন বিকেলে ড্যানা হোটেলেই রইল। কিন্তু কোন ফোন এল না। টিমকে ফোন করে জানাতে সে বলল,–সহজে হাল ছেড়ো না। মনে রেখ অন্য এক গ্রহের ব্যুরোক্রেসির সঙ্গে তুমি লেনদেন করছ।–

পরদিন সকালে ড্যানা আবার কমিশনের অফিসে গিয়ে দরখাস্ত করল অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবার জন্য। কিন্তু কোন ফোন এল না।

তবে টিম ফোন করে জানাল,–এখানকার বিখ্যাত ব্যালে দেখে যাও। আজ রাত্রে গিসেলি ব্যালে হবে। যাবে?–নিশ্চয়ই। ধন্যবাদ।–

–তাহলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি তোমার হোটেলে আসছি।– ক্রেমলিনের ভেতরে ছহাজার সিটের প্যালেসে প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হল। সে এক ঐন্দ্রজালিক সন্ধ্যা। প্রথম অভিনয় হয়ে যেতেই বিশ্রামের জন্য হলে আলো জ্বলে উঠতেই টিম দাঁড়াল। বলল,–ড্যানা, আমাকে অনুসরণ করো।–

তারা টপ ফ্লোরে গিয়ে হাজির হল, তখন সেখানে টেবিলে টেবিলে দামি খাবার, ভদকার বোতল। থিয়েটারগামী যারা প্রথমে সেখানে হাজির হয়েছিল, তারা নিজেরাই খাবার পরিবেশন করছিল। ড্যানা শো-এর প্রশংসা করল। টিম বলল,–উঁচু তলার লোকদের এরকমই জীবন। কিন্তু শতকরা তিরিশ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।–

দ্বিতীয় অভিনয় শুরু হল। এই অভিনয় জাদুমন্ত্রে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। ড্যানার মনে কিন্তু তখন অন্য চিন্তা ও কথোপকথনের স্মৃতি

টেলর উইনথ্রপ প্রতারক। তিনি খুব চালাক ছিলেন এবং আমাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাসাতে চেয়েছিলেন..–

সেটা ছিল একটা দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা। গ্যাব্রিয়েল ছিল চমৎকার ছেলে…

টেলর উইনথ্রপ ম্যানসিনো পরিবারের ভবিষ্যৎ শেষ করে দিয়েছিলেন…।

ব্যালে শেষ হওয়ার পরে টিম বলল,–আমার ফ্ল্যাটে একটু মদ্যপান হবে নাকি?–

ড্যানা ভাবল টিম আকর্ষণীয়, সুদর্শন, বুদ্ধিমান হলেও জেফ নয়। তাই সে বলল,–দুঃখিত টিম।–

টিম হাল না ছেড়ে বলল,–তাহলে আগামীকাল?

–কিন্তু কাল ভোরবেলা আমাকে বেরোতে হবে।–

অবশেষে পরদিন সকাল আটটায় শ্যাডনফের অফিস থেকে ফোন এল। সহকারী কমিশনার ইয়েরিক কারবাভা বললেন–এক ঘণ্টার মধ্যে ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অফিসে আসতে।

অফিসটা বিরাট হলেও ভেতরটা জরাজীর্ণ। আসবাবপত্র বহু পুরনো। অফিসে তখন দুজন লোক। বয়স্ক মানুষটি ড্যানাকে বললেন,–আমি কমিশনার শ্যাডনফ।– বছর পঞ্চাশ বয়স। ছোটখাট চেহারা, ধূসর চুল, গোল মুখ, বাদামি চোখ দুটি সর্বদা চারদিকে কি যেন সন্ধান করে চলেছে। তিনি তার পাশে বসা লোকটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন,–এ আমার ভাই, বোরিস শ্যাডনফ। ও আমেরিকা ঘুরে এসেছে। ওয়াশিংটনে রাশিয়ান দূতাবাসের সঙ্গে জড়িত।– বোরিসকে দেখতে তার দাদার একেবারে বিপরীত। দাদার থেকে দশ বছরের ছোট।

বোরিস বললেন–মিস ইভান্স, আপনার কাজের খুব প্রশংসা করি।

–ধন্যবাদ।

— কমিশনার এবার বললেন,–আপনার সমস্যাটা কী?

–সমস্যা কিছু নয়। টেলর উইনথ্রপের ব্যাপারে আমি কিছু খবর জানতে চাই।–

বিস্মিত হয়ে শ্যাডনফ বললেন,–টেলরের সম্বন্ধে আপনার জানার কেন আগ্রহ হল? আর আমার কাছ থেকেই বা কেন?–

আমি শুনেছি, আপনি তার সঙ্গে কাজ করেছেন এবং সামাজিক অনুষ্ঠানেও আপনাদের দেখা সাক্ষাত হত। তাই আপনার ব্যক্তিগত মতামত জানতে চাই।–

–তিনি একজন চমৎকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এখানে তিনি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন আর…– বোরিস বাধা দিয়ে বলে উঠলেন,–মস্কোয় আমেরিকান দূতাবাসে বহু পার্টি আছে এবং টেলর উইনথ্রপ সবসময়…–

কমিশনার শ্যাডনফ তার ভাইয়ের দিকে তাকাতেই তিনি চুপ করে গেলেন। তখন কমিশনার আবার ড্যানাকে বললেন,–রাষ্ট্রদূত উইনথ্রপ কখনও কখনও দূতবাসের পার্টিদের কাছে যেতেন। তাঁকে মানুষজন ভালোবাসত। তিনিও মানুষকে ভালবাসতেন।– বোরিস আবার বললেন,–টেলর আমাকে বলেছিলেন, যদি তিনি পারেন–কমিশনার আবার তার দিকে তাকাতেই তিনি চুপ করে গেলেন। ড্যানা বোরিসের দিকে তাকাল। মনে হল ড্যানাকে তিনি কিছু বলতে চান।

ড্যানা কমিশনারকে জিজ্ঞেস করল,–এখানে থাকার সময় তিনি কি কোন অসুবিধায় পড়েছিলেন?–

–না তো৷– ড্যানা আবার জিজ্ঞেস করল,–টেলর উইনথ্রপ এবং তার পরিবারকে কেউ খুন করতে পারে এরকম কোন কারণ আছে বলে কি আপনার মনে হয়?–

–না, না, এতো ভাবাই যায় না।

— বোরিস বলে উঠলেন–তিনি একজন মহান রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আর কিছু বলার নেই।–

ড্যানার মনে হল ওঁরা কিছু একটা লুকোতে চাইছেন। তবে সে বুঝতে পারছে না সেটা কী হতে পারে। সে বোরিসের দিকে তাকিয়ে বলল,–যদি আপনি কিছু বলতে চান তাহলে কাল সকালের মধ্যে সেবাস্টোপোল হোটেলে আমাকে ফোন করতে পারেন।–

–আপনি কি কালই ফিরে যাচ্ছেন?–

–হ্যাঁ।–আমি– বোরিস কিছু একটা বলতে গিয়েও তার দাদার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন।

ড্যানা হোটেলে তার ঘরে ফিরে ম্যাট বেকারকে ফোন করল,–মিঃ ম্যাট এখানে একটা কিছু যেন ঘটতে চলেছে। তবে সেটা যে কি আন্দাজ করতে পারছি না। তাই আমি কালই ফিরে যাচ্ছি।–

শেরেমেটিয়েভো বিমান বন্দরে খুব ভিড়। ড্যানার মনে হল কেউ যেন তার ওপর নজর রাখছে। কিন্তু কাউকে চিহ্নিত করতে পারল না।

.

ডালাস বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ড্যানা যখন সোজা WNT বিল্ডিং-এ প্রবেশ করল তখন সব কর্মীরা তাকে অভিবাদন জানিয়ে বলে উঠল,–ড্যানা, তুমি ফিরে আসাতে আমরা সবাই খুব খুশি হয়েছি।–

ম্যাট বললেন,–তুমি রোগা হয়ে গেছ। বোসো।–ধন্যবাদ।–টেলরদের মৃত্যুর ব্যাপারটা তুমি যে মাথা থেকে বার করে দিয়েছ এতে ইলিয়ট খুশিই হবেন। তিনিও যে ড্যানার জন্য উদগ্রীব ছিলেন তা কিন্তু বললেন না।

ড্যানা এবার নিজের ঘরে ঢুকতেই অলিভিয়া বলল,–সুস্বাগতম, এক দিন…– ফোন বেজে উঠল। অলিভিয়া ফোন ধরে কথা বলে ড্যানাকে বলল,–পামেলা হাডসনের ফোন।– ড্যানা ফোন ধরতেই পামেলা বললেন,–ড্যানা তুমি ফিরে এসেছ? আমরা তোমার জন্য চিন্তায় ছিলাম। রাশিয়া নিরাপদ জায়গা নয়।–

–জানি।–আজ বিকেলে তুমি চায়ের আসরে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে খুব খুশি হবো।–

–নিশ্চয়ই যাব।–

বিকেলে হাডসন দম্পতির বাড়ি যেতেই তারা অভ্যর্থনা জানালেন। রজার বললেন,–তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।–

একজন পরিচারিকা চা আর স্ন্যাক্সের ট্রে নিয়ে এল। পামেলা নিজে চা ঢেলে দিলেন। রজার বললেন,–এবার বলো কি ঘটেছে সেখানে?–বলার মত কিছুই ঘটেনি। ডিয়েটার জ্যান্ডার নামে একজন লোকের সঙ্গে আমি মিলিত হই। সে বলেছে টেলর উইনথ্রপ তার বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা সাজিয়েছিলেন এবং তাকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। সে জেলে থাকাকালীন তার পরিবারের সবাই আগুনে পুড়ে মারা যায়। এরজন্য সে টেলর উইনথ্রপকেই দায়ী করেছে।–

ড্যানা বলে,–হ্যাঁ। তবে আরও আছে। ফ্রান্সে মার্শেল ফ্যালকন নামে একজন লোকের ছেলে গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়। সেই অপরাধের জন্য টেলর উইনথ্রপের গাড়ির চালককে দায়ী করা হয় কিন্তু এখন সেই চালক বলছে টেলর উইনথ্রপ নিজেই ঐ ঘটনার সময় গাড়ি চালাচ্ছিলেন।–

রজার বললেন,–ব্রুসেলসে এই ফ্যালকনই তো NATO কমিশনে ছিলেন?–

–হ্যাঁ। চালক তাকে জানিয়েছিল টেলরই তার ছেলেকে গাড়ি চাপা দিয়েছে। এছাড়াও ভিনসেন্ট ম্যানসিনো নামের একজন মাফিয়ার মেয়েকে গর্ভবতী করেন টেলর এবং গর্ভপাতের জন্য হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে পাঠাতে হয়। কসাইয়ের মত ভোঁতা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে তার গর্ভপাত করানো হয়। মেয়েটি এখন কনভেন্টে আর তার মা স্যানিটেরিয়ামে।–

ঈশ্বর!– ড্যানা বলল,–এই তিনজনেরই বদলা নেবার জোরালো কারণ রয়েছে। কিন্তু আমরা হাতে কোন প্রমাণ নেই।–

রজার বললেন,–তাহলে টেলর উইনথ্রপই দোষী।–

–অবশ্যই। প্রতটি খুনের একটা করে আলাদা কার্যপ্রণালী আছে। তাই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হওয়ার মত কোন প্রমাণ নেই। কোনও সাক্ষীও নেই।–

পামেলা বলেন,–যদি তিনজনেই হাত মিলিয়ে খুনগুলো করে থাকে?–

–আমার তা মনে হয় না। কারণ এরা প্রত্যেকেই শক্তিশালী তারা একাই বদলা নিতে পারে।–

অফিসে ফিরে এসে ড্যানা দেখল টেবিলে তার নামে একটা সিল করা খাম পড়ে রয়েছে। ভেতরের চিঠিটা পড়ল–মিস ইভান্স, যে খবরটা আপনি চাইছিলেন আমি তা পেয়েছি। মস্কোয় সোয়ুজ হোটেলে আপনার নামে একটা ঘর বুক করে রেখেছি। ব্যাপারটা গোপন রেখেছি। ব্যাপারটা গোপন রেখে এখনই চলে আসুন।– ড্যানা বুঝল প্রেরকের নামহীন এই চিঠিটা একটা চালাকি। রাশিয়ায় সে থাকাকালীন কেন যোগাযোগ করল না? বোরিস তাকে কিছু বলতে চাইলেও ড্যানার ঠিকানা সে পাবে কী করে? তবে কি তার ওপর কেউ নজর রাখছে? চিঠিটা সে ছিঁড়ে ফেলবে ঠিক করল। সন্ধ্যের পর ড্যানা স্টুডিওয় যাবার জন্য তৈরি হল।

ড্যানার পাশের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়াটে টেলিভিশন সেটের দিকে তাকিয়ে একটা টেপ রেকর্ডারে বলল–সে এখন খবর সম্প্রচারের জন্য স্টুডিওয় চলল। ছেলেটি ঘুমোতে গেছে। হাউসকীপার সেলাই করছে।–

পরদিন সকালে রজার হাডসনকে ফোন করে ড্যানা গতকালের চিঠির কথা বলল,–ড্যানা এটা একটা ফাঁদ, তুমি রাশিয়ায় যেও না।–

–আমি না গেলে সত্যের সন্ধান আর পাব না।

–তা অবশ্য ঠিক।

–আমি সাবধানে থাকব।

–আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখ।–

ড্যানা ম্যাটের জন্য একটা বার্তা রেখে এল। তারপর অ্যাপার্টমেন্টে এসে হাউসকীপার মিসেস ড্যানিকে বলল,–আমি আবার বাইরে যাচ্ছি। ফেনালকে দেখো।–

–আমরা ভাল থাকব।–

ড্যানার পাশের অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়াটে টেলিভিশনের পর্দা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে ফোন করল।

মস্কোগামী এরোফ্লোট বিমানে উঠে ড্যানা ভাবল হয়তো সে ভুল করতে চলেছে। পরদিন সকালে বিমান থেকে নেমে ব্যাগ সংগ্রহ করে বাইরে এসে দেখল বরফ পড়ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে ট্যাক্সি নিয়ে সে সোয়ুজ হোটেলে যেতে বলল। চালক জানাল ওটা খুব একটা ভাল হোটেল নয়।–

–তবুও সেখানেই চলো।– হোটেলটা মস্কোর বাইরে খেটে খাওয়া মানুষ অধ্যুষিত লোড্ডাবেরেজানেয়া স্ট্রিটে। ডেস্কের পিছনে একজন বয়স্কা মহিলা তার দিকে অবাক চোখে তাকাল। ড্যানা বলল,–আমি ড্যানা ইভান্স। আমার বিশ্বাস এখানে আমার জন্য ঘর বুক করা হয়েছে।–

–হ্যাঁ। ফোর্থ ফ্লোর ৪০২ নম্বর ঘর। এই নিন চাবি।

–কোথায় রেজিষ্ট্রি করব?–।

–রেজিষ্টার নেই, ঘর ভাড়ার টাকাটা দিয়ে দিন।–

ড্যানা অবাক হল। রাশিয়ার মতো দেশে বিদেশিদের নাম রেজিষ্ট্রি করতে হয় না? কোন এলিভেটর নেই। পোর্টার নেই। ড্যানা নিজেই ব্যাগ বয়ে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল। ঘরটিও খুব খারাপ। এখন তার একমাত্র চিন্তা বোরিস কি ভাবে যোগাযোগ করবেন? আবার এমনও হতে পারে, পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পা, দরজায় মৃদু টোকা দেবার শব্দ হল। দরজা খুলে কাউকেই দেখা গেল না। মেঝেতে একটা খাম পড়ে রয়েছে দেখা গেল। খামের ভেতর একটা ছোট কাগজে লেখা–VDNK4 রাত নটায়। গাইডবুকে এই সাংকেতিক চিহ্নের অর্থ দেখল–vDNK4 মানে রাশিয়া ইকোনমিক অ্যাচিভমেন্টস এগজিবিশন আর তার ঠিকানাও রয়েছে।

রাত আটটার সময় ট্যাক্সি ডাকতেই ট্যাক্সি চালক বলল,–এখানে সব কিছুই এখন । বন্ধ।–

–তাও সেখানে চলো।– একটু পরেই ড্যানা সেখানে পৌঁছল। মস্কোর উত্তর-পূর্বে বিরাট একটা পার্ক। সোভিয়েতের মহিমা প্রচারের জন্য এই বিলাসবহুল প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির অবনতিতে সেটি এখন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পড়েছে। পার্কটি জনমানবহীন। সে একটা বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

একটু পরে পেছন থেকে ডাক শুনে সে তাকিয়ে চমকে উঠল। বোরিস নয়, তার দাদা কমিশনার শ্যানডফ। তিনি বললেন,–আপনি আমাকে অনুসরণ করুন। পার্কের পেছনে একটা ছোট্ট গেঁয়ো কাফেতে গিয়ে তারা ঢুকল।

কমিশনার বললেন,–আপনি দেখছি খুব নাছোড়বান্দা। আপনি যে আসবেন তা আমি ভাবতেই পারিনি। যাই হোক, টেলর উইনথ্রপকে কে খুন করেছিল তা জানতে চান তো?–

–হ্যাঁ। আপনি জানেন টেলর উইনথ্রপ ও তার পরিবারকে কে খুন করেছিল?

—হ্যাঁ, জানি। তবে তার আগে আমাকে আপনার রাশিয়া থেকে বার করে নিয়ে যেতে হবে। আমি এখানে নিরাপদ নই।–

–সে তো আপনি ইচ্ছে করলেই বিমানে যেখানে খুশি চলে যেতে পারেন।–

–আগেকার কমিউনিজম দুনিয়া না থাকলেও আমি তা করলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।–

–আমি বোধহয় আপনাকে সাহায্য করতে পারব না।

–আপনাকে পারতেই হবে।–

–তাহলে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলি।–

–সেখানে অনেক বিশ্বাসঘাতক আছে। পাঁচকান হলে মৃত্যুর সম্ভবনা আরও বেড়ে যাবে।–

ড্যানা ভাবল কী করে কমিশনারকে সে রাশিয়ার বাইরে নিয়ে যাবে। আবার এও মনে হল হয়ত এর কাছে কোন খবরই নেই। নিজে দেশের বাইরে পালাবার জন্য মিথ্যে গল্প সাজিয়েছে। ড্যানা বলল,–আমি বোধহয় আপনাকে সাহায্য করতে পারব না।– বলে সে উঠে দাঁড়াল। –আমি আপনাকে প্রমাণ দেব।– কী প্রমাণ?– কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর কমিশনার বললেন, আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি। চলুন আমার সঙ্গে।

আধঘন্টা পরে কমিশনারের অফিসে পৌঁছল তারা। কমিশনার বললেন,–আমি আপনাকে যা দেখাতে যাচ্ছি তাতে আমার প্রাণদণ্ড হতে পারে। কিন্তু এখানে থাকলে আমি খুন হয়ে যাব। তাই এছাড়া অন্য পথ নেই।– বিরাট একটা দেওয়াল আলমারির দিকে । এগিয়ে গেলেন কমিশনার। একটা বই নামালেন। লাল অক্ষরে লেখা ছিল ক্লাসিফিটসিরোভানগি। বইটায় শ্রেণীবদ্ধ খবরা-খবর লেখা আছে। ড্যানা বইটার পাতা উল্টে দেখতে লাগল রঙিন ফোটোগ্রাফ-বহুবার, স্পেস লঞ্চ ভেহিকিল, অ্যান্টিব্লাস্টিক মিসাইল, আকাশ থেকে মাটিতে ফেলার মিসাইল, অটোমেটিক অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, সাবমেরিন। –এই হল রাশিয়ার সম্পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্রের ভাণ্ডার। আনবিক অস্ত্রশস্ত্রে আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকার চেয়েও উন্নত। কিন্তু রুশ মিলিটারির সামনে এখন সমস্যা। রাশিয়ার অর্থসঙ্কটের জন্য সৈন্যদের বেতন দেবার অর্থ নেই। রাশিয়া যখন আমেরিকার চেয়ে বেশি অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করত তখন তা পাবার জন্য অন্য দেশরা উৎসাহিত ছিল। সেগুলোর দাম কয়েক বিলিয়ান।–এখন সমস্যাটা কী?– ড্যানা বলল।

–আপনি ক্র্যাসনোইয়ার্ল্ড-২৬-এর নাম শুনেছেন?—

না।–আগামীকাল দুপুরে সেই কাফেতে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। কাউকে বলবেন না।–

পরদিন দুপুরে সেখানে ড্যানা কমিশনারের সঙ্গে মিলিত হতেই তিনি বললেন,–এখনই আমাদের শপিং-এ যেতে হবে।–

–আমার শপিং-এর দরকার নেই।–

–আমার কাজের জন্য দরকার আছে। একটা ট্যাক্সি থামিয়ে তাতে উঠে তারা শপিং মলে পৌঁছল। একজন সেলস লেডি তাদের দিকে এগিয়ে এল। রুশ ভাষায় কমিশনারের সঙ্গে কিছু কথোপকথন হল। একটু পরে পিংক মিনিস্কার্ট এবং অত্যন্ত লোকাট ব্লাউজ নিয়ে সে ফিরে এল। শ্যাডনফ ড্যানাকে ওগুলো পরতে বললেন।

ড্যানা প্রতিবাদ করে ওঠে,–না। ওগুলো আমি পরব না।–

–আপনাকে পরতেই হবে।–

ড্যানা ভাবল লোকটা পারভার্টেড। তাই বাধ্য হয়ে ছোট ড্রেসিংরুমে গিয়ে পোশাকগুলো পরে নিল। বেরিয়ে এলে শ্যাডনফ বলল,–কিছু মেকআপ এখনও বাকি আছে।–

ড্যানা রাস্তায় বেরোতে পথচারীরা তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে লাগল। একটা বিউটি সেলুনে ঢুকে শ্যাডনফ গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক ও রুজ লাগাতে বলল।

ড্যানা বলল,–আর নয়। আপনার সঙ্গে এই খেলায় আমি অংশ নিতে পারছি না।–

–ক্র্যাসনোইয়ার্স্ক-২৬ সিটি খুব কাছেই। সেখানে খুব কম সংখ্যক লোক বেশ্যাদের নিয়ে। যেতে পারে। তাই আপনাকে বেশ্যার সাজে সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। প্রবেশ মূল্য হিসাবে এক পেটি ভদকা উপহার দিতে হবে। আপনি এতে ইচ্ছুক তো?–

–হ্যাঁ–, ড্যানা অনিচ্ছার সঙ্গে বলল।

শেরেমেটিয়েভো বিমান বন্দরে একটা মিলিটারি জেট বিমান তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা দুজনই শুধু যাত্রী। –আমরা কোথায় যাচ্ছি?– ড্যানা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। –সাইবেরিয়ায়।–

চারঘণ্টা বাদে তারা একটা ছোট্ট বিমানবন্দরে অবতরণ করল। একটা লাড়া ২১১০ সেডান গাড়ি তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। জায়গাটা খুব নির্জন।

বহু সশস্ত্র প্রহরী একটা রেলস্টেশনের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়েছিল। ড্যানাদের দেখে তারা ড্যানার কুরুচিকর পোশাকের দিকে তাকাল। ড্যানার দিকে তাকিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করল কেউ কেউ। শ্যাডনফ তাদের রুশ ভাষায় কিছু বলতেই তারা শব্দ করে হেসে উঠল।

শ্যাডনফ একটা ট্রেনে উঠলেন। ড্যানাও উঠল। ট্রেন ছেড়ে দিল। ড্যানা জানতে চাইল–কোথায় যাচ্ছি আমরা?– এই সময় ট্রেনটা থেমে যেতেই শ্যাডনফ বললেন–এসে গেছি আমরা।–

ট্রেন থেকে নেমে একটু দূরে একটা অদ্ভুত বিল্ডিং-এর দিকে এগিয়ে গেল তারা। শ্যাডনফ বললেন,–আমার গলা জড়িয়ে ধরুন বেশ্যাদের মত।– সে তাই করল। এতে বাড়িটার গেট খুলে গেল। তখন তারা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলল। কমিশনারকে সুন্দরী প্রেমিকার সঙ্গে দেখে সৈনিকরা ঈর্ষাকাতর হল। ড্যানা দেখল তারা একটা এলিভেটর স্টেশনের উপর তলার কক্ষে প্রবেশ করছে যেটা নিচে নেমে যাবে।

–আমরা পাহাড়ের নিচে যাচ্ছি।– শ্যাডনফ বললেন।

–কেন যাচ্ছি সেখানে?–গেলেই দেখতে পাবেন।

— এক সময় এলিভেটর থেমে গিয়ে দরজা খুলে গেল। কমিশনার বললেন,–আমরা এসে গেছি।–

সেখান থেকে বেরিয়ে তারা একটা আধুনিক শহরের রাস্তায় পৌঁছাল। থিয়েটার, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট সবই রয়েছে। গরম আবহাওয়া।

–এই হল ক্রাসনোইয়ার্ল্ড-২৬।

–এটা কি বম্ব সেন্টার?

–এই মুহূর্তে আমি যা বলছি তাতে কোন প্রশ্ন না করলেই ভাল হয়।

— ড্যানা সতর্ক হয়।

–আপনি প্লুটোনিয়াম সম্পর্কে জানেন?–না।–

–প্লুটোনিয়াম আনবিক টরপেডোর জ্বালানি। এটি উৎপাদনের জন্যই ক্র্যাসনোইয়ার্ল্ড এখনও টিকে আছে। এক লক্ষ বিজ্ঞানী এবং টেকনিশিয়ানরা এখানে বাস করে কাজ করার জন্য। তাদের আহার, বাসস্থান, পোশাক দেওয়া হয়, এই শর্তে যে এখান থেকে কোথাও যাওয়া চলবে না।–

ড্যানা জানতে চাইল,–ওরা কোথায় প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করে?

–দেখাব। চলুন ট্রামে ওটা যাক।

— ট্রামটি ট্যানেলের গোলক ধাঁধায় প্রবেশ করল।

এইসব অবিশ্বাস্য কাজকর্মের কথা ভাবল ড্যানা। এই শহর তৈরি করতে নিশ্চয়ই অনেক সময় লেগেছে। এবার ট্রামটা থেমে গেল। এবার নামতে হবে,– কমিশনার বললেন। ড্যানা তাকে অনুসরণ করে বিস্মিত হয়ে গেল। তিনটি বিশাল রিঅ্যাক্টর, বিশাল একটা গুহার মধ্যে রাখা ছিল। একটি চালু তার পাশে ব্যস্ত, টেকনিশিয়ানের দল।

শ্যাডনফ জানালেন,–এই মেশিনগুলো যথেষ্ট প্লটোনিয়াম উৎপাদন করতে পারে। যা দিয়ে প্রতি তিনদিনে একটা আনবিক বোমা তৈরি করা যায়। ঐ রিঅ্যাক্টরটা বছরে আধটন প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতে পারে যা দিয়ে একশোটা বোমা তৈরি হতে পারে।–

–তবে ওরা আরও কেন উৎপাদন করছে?–

–কারণ, এই প্লুটোনিয়াম থেকে যে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন হয় তা উপরের শহরবাসীর জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই উৎপাদন বন্ধ করলে আলো, তাপ থাকবে না। প্রবল ঠান্ডায় মানুষ মারা যাবে।–

–তবে তো চিন্তার বিষয়।–

–আরও খারাপ আছে। রাশিয়ার আর্থিক অবস্থা এত খারাপ যে বিজ্ঞানী ও টেকনিশিয়ানদের বেতন দেওয়া যাবে না। তাদের বাড়িগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। লোকেরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।–

তাই কি রাশিয়া কিছু প্লুটোনিয়াম বিক্রি করে দেবে বলে আপনি মনে করেন?–টেলর উইনথ্রপ রাশিয়ায় রাষ্ট্রদূত হবার আগে বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তিনি ক্র্যাসনোইয়া ২৬ এর লেনদেন করতে চান কিনা। কয়েকজন বিজ্ঞানী জানান তাদের সরকার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে উইনথ্রপ লেনদেন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে যতক্ষণ না টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো একত্রিত করা যায় ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তাকে। এরপর রাশিয়ায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি। উইনথ্রপ এবং কয়েকজন পার্টনার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লিবিয়া, ইরান, ইরাক, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, চিন প্রভৃতি দেশে প্লটোনিয়াম পাচার করতে শুরু করে দিলেন।– টুকরো টুকরো ঘটনাগুলি একত্রিত হয়ে গেল। কারণ সর্বোচ্চ পদ পাওয়া যায় না। একটা টেনিস বলের মতো আকারের প্লটোনিয়াম একটা নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির পক্ষে যথেষ্ট। উইনথ্রপ এবং তার পার্টনার এই কাজে কয়েক মিলিয়ন ডলার আয় করতে থাকেন। কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে না।

ড্যানা বলল–টেলর উইনথ্রপ কেন খুন হলেন?–

–কারণ তিনি খুব লোভী হয়ে উঠেছিলেন। একদিন ঠিক করলেন ব্যবসাটা একাই চালাবেন। তার পার্টনার এই মনোভাবের কথা জানতে পেরেই তাকে খুন করে।–

–কিন্তু পরিবারের অন্যান্যদেরও খুন করল কেন?–টেলর ও তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে পল সেই পার্টনারকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করল। তারপর মনে হল অন্য সন্তানরা যাতে প্লুটোনিয়ামের ব্যাপারটা জেনে না ফেলে তাই তাদেরও খুন করা হল। কিন্তু এমনভাবে করা হল, যাতে মনে হয় নিছক দুর্ঘটনা।–

ড্যানা শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,–টেলর উইনথ্রপের পার্টনার কে ছিলেন?–

কমিশনার বললেন,–মিস ইভান্স, আপনি অনেক কিছু জেনে গেছেন। আপনি যখন আমাকে রাশিয়া থেকে বার করে নিয়ে যাবেন তখনই আমি বলব তার নাম। এবার আমাদের এখান থেকে যেতে হবে।–

ড্যানা ঘুরে সেই রিঅ্যাক্টরটা দেখল যেটা কখনও বন্ধ করা যাবে না। মৃত্যুর মত ভয়ংকর প্লটোনিয়াম যেটা ২৪ ঘণ্টা উৎপাদন করে যাচ্ছে।

–আমেরিকান সরকার এর খবর জানে?– ড্যানা জানতে চাইল।

–হ্যাঁ, তারা এটার ব্যাপারে আতঙ্কিত। ওদের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আমাদের সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে কাজ করে যাচ্ছে যাতে এই রিঅ্যাক্টরগুলি থেকে কম ক্ষতিকারক কিছু উৎপাদন করা যায়। FRA-এর সঙ্গে আপনি পরিচিত?

–হ্যাঁ। তারাও এব্যাপারে জড়িত। তারা দুজন এলিভেটরে উঠে গেল। ওপরে উঠে এসে শ্যাডনফ বললেন,–এখানে আমার একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে। আমরা সেখানেই যাব।– রাস্তায় দেখল তারই মতো রুচিহীন পোশাক পরিহিতা একটি মেয়ে একজন পুরুষের হাতে হাত রেখে চলেছে। শ্যাডনফ বললেন,–দিনের বেলা কিছু লোককে প্রেমিকার সঙ্গে ঘোরাঘুরির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রাত হলেই তাদের প্রহরীবেষ্টিত জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।–

ড্যানা একটা বিরাট উঁচু বিল্ডিং-এর দিকে তাকাতে গিয়ে দেখল একেবারে উপরে ঘড়ি থাকার বদলে একটা বিরাট যন্ত্র লাগানো রয়েছে।

–ওটা কি?– সে জানতে চাইল।

–ওটা তেজস্ক্রিয়তা মাপার যন্ত্র। রিঅ্যাক্টারে গোলমাল দেখা দিলে ঐ যন্ত্রটা সতর্ক করে দেবে। আমার অ্যাপার্টমেন্ট এখানেই। কিছুক্ষণের জন্য আমাদের এখানে থাকতেই হবে কারণ FSB প্রত্যেকের ওপরেই নজর রাখে। এর আর এক নাম KGB।–

বিরাট বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। তবে এখন দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। ড্যানা একটা কৌচে বসে FRA-র সম্বন্ধে জেফ-এর কথা ভাবছিল। জেফ বলেছিল FRA-এর সত্যিকারের কার্যকলাপ হল বিদেশি ইন্টেলিজেন্সি এজেন্সির ওপর নজর রাখা।– টেলর-এর প্রধান ছিলেন। ভিক্টর বুস্টার ছিলেন তার সঙ্গী।

–জ্যাক স্টোন অবশ্য ভাল লোক। তাকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে।

শ্যাডনফ তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,–এখন চলে যাবার সময় হয়েছে। আমাকে রাশিয়া থেকে বার করে নিয়ে যাবার ব্যাপারে কিছু ভাবলেন?–

–হ্যাঁ। তবে একটু সময় দরকার।–

বিমানটা যখন মস্কোয় অবতরণ করছিল সেখানে দুটো গাড়ি অপেক্ষা করছিল। একটা চিরকুট ড্যানাকে দিয়ে শ্যাডনফ বললেন,–সিরাফা অ্যাপার্টমেন্টে এক বন্ধুর সঙ্গে আমি থাকি। এখানে ঠিকানাটা রয়েছে। আজ রাত আটটায় চলে আসুন। আপনার পরিকল্পনার কথা আমাকে বলবেন। ড্যানা সম্মতি জানাল।–

ড্যানা সোয়ুজ হোটেলে ফিরে এল। দেখল ডেস্কের পিছনে বসে থাকা মহিলাটি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ড্যানা বুঝল কারণটা। সে আগে ঘরে গিয়ে পোশাক পাল্টে নিল। তারপর রজার হাডসনকে ফোন করল। সিজার ফোন ধরেছিল। রজারকে দিল। ড্যানা বলল ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আপনাকে একবারেই পেয়ে গেলাম।–

–তুমি এখন কোথায়?–

মস্কোয়। টেলর ও তার পরিবারের সদস্যদের কেন খুন করা হয়েছে জানতে পেরেছি। আপনার সঙ্গে দেখা হলে সব খুলে বলব। একটা সমস্যা হওয়ায় আপনাকে ফোন করছি। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়ান অফিসার শ্যাডনফ আমেরিকায় পালাতে চান। তাঁর জীবন বিপন্ন। আপনি সাহায্য করতে পারেন?–

–এ সব ব্যাপারে আমাদের কারো জড়ানো ঠিক নয়।

–তবু এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটা করতেই হবে।

–ড্যানা, আমি এসব পছন্দ করি না।

–আপনি ছাড়া আমি আর কার কাছে সাহায্য চাইব?

–তাকে এখন আমেরিকান দূতাবাসে নিয়ে এস। আমেরিকায় নিয়ে যাবার জন্য যতক্ষণ না একটা উপায় বার করছি ততক্ষণ সে নিরাপদে থাকবে।

–কিন্তু আমেরিকান দূতাবাসকে সে বিশ্বাস করে না।–

–ঠিক আছে আমি রাষ্ট্রদূতকে ফোনে বলে দিচ্ছি তার জন্যে ভাল সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে।–

–ধন্যবাদ।

–শ্যাডনফ এখন কোথায়?–

–সিয়াফা অ্যাপর্টমেন্টে, আজ রাত আটটায় আমি দেখা করতে যাচ্ছি।

–সাবধানে থেকো ড্যানা।–

পৌনে আটটায় ড্যানা সিয়াফা অ্যাপর্টমেন্টের সামনে এল। হলওয়েটা মরুভূমির মত খাঁ খাঁ করছে। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে এল সে। 28E অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এল। দরজাটা ভেজান ছিল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কিসে যেন হোঁচট পেয়ে মেঝেতে পড়ল। ড্যানা উঠে দাঁড়িয়ে, হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ড খুঁজে আলো জ্বালাতেই দেখতে পেল শ্যাডনফের মৃতদেহ যাতে হোঁচট খেয়ে সে মেঝেতে পড়েছিল। তার গলা থেকে কান পর্যন্ত লম্বালম্বিভাবে কাটা। ভয়ে ড্যানা চিৎকার করে উঠল। বিছানায় দেখল মাথায় প্লাস্টিক ব্যাগ জড়ানো এক মাঝবয়সী মহিলার মৃতদেহ। ড্যানা টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এল।

সেই অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক উল্টোদিকের বিল্ডিং-এর একটা অ্যাপার্টমেন্টের জানলার সামনে সে দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে সাইলেন্সর লাগানো উদ্যত AR-1 রাইফেল। যে কোন · মুহূর্তে মেয়েটি বেরিয়ে আসবে। দুটি মৃতদেহে দেখে নিশ্চয় সে আতঙ্কিত হয়েছে। এবার তার পালা। অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর দরজা খুলে যেতেই লোকটা সতর্ক হয়ে রাইফেলটা তুলে নিয়ে টেলিস্কোপের মাধ্যমে ড্যানার মুখ দেখতে পেল। ড্যানা তীরবেগে ছুটছে। লোকটা রাইফেলের ট্রিগারে চাপ দিল। ঠিক তখনই একটা বাস এসে বিল্ডিং-এর সামনে থামল। বাসের ছাদে বুলেটগুলো আছড়ে পড়ল। ছাদ উড়ে গেল।

রাস্তায় বরফ পড়ছে। সঙ্গে প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া। ড্যানা কোনরকমে হোটেলে ফিরে এসেই রজার হাডসনকে ফোন করল।

রজার ফোন ধরেন, ড্যানা কাঁদতে কাঁদতে বলে,–শ্যাডনফ আর ওর এক বান্ধবীকে খুন করা হয়েছে।–

–কী বলছ তুমি! এ যে অবিশ্বাস্য!–

–ওরা আমাকেও খুন করতে চায়।

—ঠিক আছে, শোন, মাঝরাতে ওয়াশিংটনগামী এক এয়ার ফ্রান্স বিমান ছাড়ে। তোমার জন্য একটা টিকিট সংরক্ষণ করে দিচ্ছি। কেউ যেন তোমায় অনুসরণ না করে। হোটেল মেট্রোপোলে চলে যেও। সেখান থেকে এয়ারপোর্টগামী বাসে উঠে পড়। তুমি যখন ওয়াশিংটনে পৌঁছবে তখন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।–

–ধন্যবাদ।– শ্যাডনফ আর তার বন্ধবীর মৃতদেহ দুটি খালি তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। টেলিফোন বুথ থেকে বেরিয়ে ড্যানা হোটেলে ফিরে এল।

ড্যানা তাড়াতাড়ি পোশাক বদল করে রাস্তায় দিয়ে হেঁটে চলল হোটেল মেট্রোপোলের দিকে। রাস্তা পেরোতে গিয়ে পেছন থেকে ধাক্কা অনুভব করল। বরফের ওপর পড়ে গেল ড্যানা। ঠিক তখনই একটা ট্রাক দ্রুতগতিতে ড্যানার দিকে এগিয়ে এল। ড্যানা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে দেখল ট্রাক চালক স্টিয়ারিং তার দিকে ঘোরালো যাতে ড্যানা ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে। ড্যানা ভয়ে চোখে বুজে ফেলল। একটু পরে চোখ মেলে সে আকাশ দেখতে পেল। ট্রাকটা চলে গেছে তখন। ড্যানা পথচারীদের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়াল। একদল যুবক তাকে হোটেল মেট্রোপোলে পৌঁছে দিয়ে গেল। এয়ারপোর্ট বাস ছাড়তে তখনও কিছুটা দেরি ছিল। ড্যানা হোটেলের লবিতে বসে ভাবছিল কে তাকে খুন করতে চাইছে, ফেনালের জন্যও চিন্তা হচ্ছে তার।

এক ঘণ্টা পরে শেরেমেটিয়েভো বিমানবন্দরে পৌঁছে ড্যানা তার টিকিট সংরক্ষিত আছে কিনা দেখে নিল। ড্যানা ঈশ্বরের কাছে রজারের জন্য প্রার্থনা করল। একটু পরেই লাউস্পীকারের ঘোষণা হল–ওয়াশিংটনগামী এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইটের যাত্রীরা তাদের পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাশ নিয়ে তিন নম্বর গেটের সামনে চলে আসুন।–

এয়ারফ্লোট কাউন্টার থেকে যে লোকটা নজর রাখছিল সে তার সেলফোনে কাউকে বলল,–বোর্ডিং গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।–

রজার হাডসন রিসিভার তুলে একটা নম্বর ডায়াল করে বলল–এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট টু টুয়েন্টিতে সে যাচ্ছে। আমি তার সঙ্গে বিমানবন্দরে দেখা করতে চাই।–

–আপনি তাকে নিয়ে কী করতে চান?

–আমি গাড়ি চাপা দিয়ে তাকে খতম করতে চাই।–

হঠাৎ ড্যানার মনে হল শ্যাডনফের সঙ্গে তার কথোপকথনের কথা। শ্যাডনফের লুকিয়ে থাকার কথা একমাত্র রজার হাডসনকেই বলেছিল ড্যানা। শ্যাডনফও পরোক্ষে হলেও টেলর উইনগ্রপের সঙ্গে রাশিয়ার অন্ধকার জগতের যোগাযোগের কথা উল্লেখ করেছিল।

রজার ও পামেলা হাডসনকে জিজ্ঞাসা করে ড্যানা তার সব গতিবিধির কথা বলে এসেছিল। কিন্তু তারা যে ড্যানার ওপর গুপ্তচরগিরি করছে তা সে বুঝতে পারেনি। টেলরের পার্টনার হয়ত রজার হাডসন নিজেই।

বিপদের আশঙ্কায় ড্যানা এয়ার ফ্লাইট ফ্রান্স টু টুয়েন্টি বদল করে আমেরিকান এয়ারলাইন্স ফ্লাইটে উঠে বসে। শিকাগোর ওহারে বিমান বন্দরে নেমে সে স্বস্তির শ্বাস নিল। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। ফেনালের সুরক্ষার জন্য এখন সে চিন্তিত। এমন একটা সংস্থার সাহায্য নিতে হবে যাতে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। জ্যাক স্টোনের কথা মনে পড়ল ড্যানার। জ্যাক স্টোন খুব সহানুভূতিশীল মানুষ ঐসব বিশ্বাসঘাতকদের দলে সে নেই।

ড্যানা টেলিফোন বুথে গিয়ে জ্যাক স্টোনকে ফোন করল।

বলল–আমি খুব বিপদে পড়ে গেছি। কেউ আমাকে অনুসরণ করে খুন করার চেষ্টা করছে।– ড্যানার কথায়, জ্যাক উদ্বেগ অনুভব করল।

ড্যানা বলল,–আমি নিজের জন্য ভাবছি না। ফেনালের জন্যই আমার চিন্তা হচ্ছে। ফেনালকে রক্ষা করতে কাউকে পাঠাবে তুমি?–

–কাউকে আমি তোমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে তোমাকে খুন করতে চাইছে কে?–

–জানি না। দুবার খুনের চেষ্টা করেছে তারা।

–আমি তোমাদের নিরাপত্তার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

–আমি এখন ওহারের আমেরিকান এয়ারলাইন্সে।

–তোমার ওপর নজর রাখার জন্য একজনকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি।–

–ধন্যবাদ।– জ্যাক স্টোন রিসিভার নামিয়ে ইন্টারকমের বোম টিপল। বলল,–টারগেট এইমাত্র ফোন করল। ওহারের আমেরিকান এয়ারলাইন্স টার্মিনালে রয়েছে। ওকে নিয়ে এস।–

–আচ্ছা স্যার।

–দূর প্রাচ্য থেকে জেনারেল বুস্টার কখন ফিরছেন?– জ্যাক স্টোন জানতে চাইল।

–আজ বিকেলে।

–এখানে কি চলছে তা দেখার আগে ড্যানাকে এখান থেকে তাড়াতে হবে।–

.

ড্যানার সেলফোন বেজে উঠল। জেফ বলল–ড্যানা, কতদিন তোমায় দেখিনি। আমি তোমায় ভালবাসি।–আমিও তোমার অভাব অনুভব করছি।– একটি লোক ড্যানার দিকে সন্দেহজনক ভাবে তাকিয়ে ছিল। ড্যানার মনে কুচিন্তার উদয় হল। সে বলল,–জেফ, আমার যদি কিছু হয়–মনে রেখো আমি…–

–কেন? তোমার কি কিছু…—

না, কিছু নয়, তবে সন্দেহ হচ্ছে কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। তবে মনে হয় শেষটায় সব ভালই হবে।– ফোন রেখে ড্যানা দেখল লোকটা তখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। ড্যানা ভাবল জ্যাক স্টোনের লোক এত তাড়াতাড়ি এখানে পৌঁছবে না। তাই আমাকেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে যে কোন ভাবে।

ড্যানার পাশের অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিবেশি দরজায় নক করল। মিসেস ড্যালি দরজা খুলে দিতে সে বলল,–ফেনালকে ডেকে দাও।–

মিসেস ড্যালি দরজা বন্ধ করে ফেনালকে ডাকল,–তোমার প্রিয় জইয়ের খাবার তৈরি। ফেনাল খেতে এস।– এরপর মিসেস ড্যালি রান্নাঘরের তাক থেকে বুস্টার লেবেল আটা তিনটে ড্রাগের প্যাকেট খুলে জইয়ের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিল।

স্টাডি থেকে ফেনালও এসে হাজির হল সেখানে। ফেনাল বলল,–আমি খুব একটা ক্ষুধার্ত নই।–

মিসেস ড্যালি তাকে বলল,–খেতে তোমাকে হবেই। মিস ড্যানাকে খুশি করতে হবে তো।– ফেনাল অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেতে শুরু করল।

মিসেস ড্যালি ভাবল এখন ফেনালের ছয় ঘণ্টা ঘুমনো উচিত।

বিমানবন্দরের ভেতরে দিয়ে ড্যানা প্রায় ছুটে এসে একটা বিরাট পোশাকের দোকানের সামনে থামল। কিন্তু দোকানের প্রবেশ পথে চোখ পড়তেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। দুটো ভয়ংকর চেহারার লোক সেখান স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একজনের হাতে ওয়াকিটকি। সেলস কাউন্টারের ক্লার্ককে সে জিজ্ঞেস করল,–এখান থেকে বাইরে যাবার দ্বিতীয় কোন পথ আছে?–

আছে, তবে সেটা দোকানের কর্মচারীদের জন্য।– ড্যানা একটু চিন্তা করে একটা পোশাক তুলে নিয়ে বাইরে বেরনোর দরজার দিকে ছুটতে লাগল। কর্মচারীটি দেখে চিৎকার করে উঠল। ড্যানা এইরকমই চাইছে, তারা তাকে পুলিশে দিক। তবে সে নিরাপদে থাকবে। খুনি লোক দুটোর খপ্পর থেকে মুক্তি পাবে। গোলমাল শুনে ম্যানেজার ছুটে এল। বলল,–তাহলে তো পুলিশ ডাকতে হয়।– বলে ড্যানার দিকে তাকিয়েই সে অবাক হয়ে গেল।

মাই গড। ড্যানা ইভান্স।– কৈফিয়তের ভঙ্গিতে সে বলে,–আমি দুঃখিত মিস ইভান্স। কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে।–

–না, আমি শপ লিফটার। আমাকে গ্রেপ্তার করুন।–

ম্যানেজার হেসে বলল,–তা কখনও হয়। পোশাকটা আমরা আপনাকে উপহার দিলাম। আপনার একটা অটোগ্রাফের বিনিময়ে পোশাকটার ব্যবসা আরও বাড়িয়ে তুলতে চাই।–

অন্য খদ্দেররা ড্যানার অটোগ্রাফ নিতে চাইল। ড্যানা স্থির করল এইভাবে খদ্দেরদের সঙ্গে মিশে দোকানের বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে লোক দুটির নজর এড়িয়ে।

সে খদ্দেরদের বলল,–দোকানের বাইরে গিয়ে খোলা হাওয়ায় আমি আপনাদের অটোগ্রাফ দেব। কেমন?–

তারপর ম্যানেজারকে বলল,–আপনাকে আমি অটোগ্রাফ দিচ্ছি, তবে এই পোশাকটা রেখে দিন।–

ড্যানা তার অনুরক্তদের অটোগ্রাফ দেবার ফাঁকে একটা ট্যক্সি থামিয়ে উঠে পড়ল। যাবার আগে অনুরক্তদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করল।

জ্যাকসন ফোনে রজার হাডসনকে বলছিল,–মিঃ হাডসন, ড্যানা বেরিয়ে গেল। ট্যাক্সির নম্বর আমরা রেখে দিয়েছি।

শিকাগোর কেন্দ্রস্থলের পোশাকের দোকান কারসন পিরি স্কট অ্যান্ড কোম্পানি ভিড়ে ঠাসা। ড্যানা খুশি হল কারণ ভাড়াটে খুনিরা তাকে সহজে খুঁজে পাবে না। স্কার্ফ কাউন্টার থেকে একটা স্কার্ফ কিনে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ড্যানা দেখল দুজন লোক ওয়াকিটকি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভয়ে সে কেঁপে উঠল।

ড্যানা ভাবছিল ঐ লোকগুলি তার পিছু নেওয়া ছাড়ছে না। ড্যানা ভাবল তার চেহারায় কিছু বদল আনতে হবে যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। ফ্যান্টাসি হেড কোয়ার্টারে গেল ড্যানা। একজন ক্লার্ক এগিয়ে এল। ড্যানা বলল,–পুলিশকে ডাকুন। কেউ আমাকে খুন করতে চায়।– আরও বলল,–আমার একটা সোনালি পরচুল চাই।– সোনালি পরচুল পরে তার চেহারায় অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। দোকানের বাইরে এসেই একটা চলন্ত ট্যাক্সি থামিয়ে বলল,–ওহারে বিমানবন্দর।– ফেনালের কাছে যেতে সে উদগ্রীব।

ফোনটা বাজতেই র‍্যাচেল ফোন তুলে বলল,–ডাঃ ইয়ং…কী বললেন?– জেফ দেখল র‍্যাচেলের মুখে একটা কালো ছায়া নেমে এল। ফোনটা নিয়ে সে শয়নকক্ষে চলে গেল। সেখান থেকে তার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে এল। –আমার যাই হোক না কেন আপনি বলুন ডক্টর।– তারপর মিনিট কয়েকের নীরবতা। তারপর র‍্যাচেল তার শয়নকক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। বলল,–আমার চিকিৎসা কার্যকর হয়েছে। আমি এখন সম্পূর্ণ রোগমুক্ত।–

জেফ খুশি হয়ে বলল,–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।– র‍্যাচেল বলল,–তোমাকে এখন আমার আর দরকার নেই। তুমি এখন ড্যানার কাছে ফিরে যাও। আমার কাছে থাকার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।–

জেফ তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে যখন বেরিয়ে পড়ল তখন র‍্যাচেল জানালা দিয়ে দেখল তার জীবনের একমাত্র ভালবাসার পুরুষটি চলে যাচ্ছে। ডাঃ ইয়ং-এর কথাগুলি র‍্যাচেলের কানে বাজছিল–মিস স্টিভেন্স, আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আপনার ক্যানসার অনেক দূর ছড়িয়ে পড়েছে। চিকিৎসায় কোন কাজ হয়নি। বড়জোর এক কিংবা দুমাস।–

ওয়াশিংটনের ডালাস বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করতেই ড্যানা ট্যাক্সি বুথে চলে, এল। ট্যক্সিতে উঠে পড়ল। সন্দেহজনক কোন লোককে দেখতে পেল না। পার্স থেকে আয়না বার করে তার মুখটা দেখল। তার মুখে বিরাট পরিবর্তন এসেছে।

স্টাডির দরজায় সম্মিলিত কণ্ঠস্বরের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ফেনালের। মিসেস ড্যালির কণ্ঠস্বর পেল–এখনও ঘুমোচ্ছ ফেনাল। আমি ওর খাবারের সঙ্গে মাদক দ্রব্য মিশিয়ে দিয়েছি।–

একজন লোক বলল,–ওকে এখন জাগিয়ে তোলা দরকার।

— অন্য পুরুষকণ্ঠ বলল,–ওকে ঘুমন্ত অবস্থায় বধ্যভূমিতে নিয়ে গেলে সেটাই সুবিধার হবে।

–না, কিছু সময় ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ইভান্সকে ধরবার জন্য ওকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হবে।–

ফেনাল খাট থেকে নেমে পড়ল। ভয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। এখন সে অনেক বোঝদার হয়ে গেছে। মিসেস ড্যালি যে বিশ্বাসঘাতক এটা ভেবেই অবাক লাগছে তার। ফেনাল ভারল আমাকে এত সহজে ওরা খুন করতে পারবে না। দ্রুত পোশাক পরে নকল হাত লাগিয়ে সে ফায়ার এস্কেপ দিয়ে নিচুতলায় পৌঁছল। নেমেই সে ছুটতে শুরু করল।

একজন লোক বলল,–চলো ছেলেটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলি।– স্টাডির দরজা খুলে তাকে বাঁধতে ঢুকে দেখল সে পালিয়েছে।

দুজন লোক এবং মিসেস ড্যালি জানালার দিকে ছুটে গিয়ে দেখল ফেনাল ছুটে পালাচ্ছে। তারা বলল,–চলো, ওকে এখনই ধরতে হবে।–

ফেনাল প্রাণপণে ছুটে চলেছে। তার পা আর পারছে না। তার লক্ষ্য স্কুল। কোনমতে স্কুলে পৌঁছতে পারলেই সে নিরাপদ। কিন্তু স্কুলে পৌঁছে সে দেখল গেটে তালা লাগানো। হঠাৎ তার কাঁধে শক্ত হাতের চাপ পড়ল–আজ শনিবার যে, মনে নেই?–।

ড্যানা তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে দুটো ব্লক দুরে ট্যাক্সি থেকে নেমে হেঁটে চলল। ফেনালের জন্য তার চিন্তা নেই। জ্যাক স্টোন নিশ্চয় তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। ড্যানা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের পিছন দিয়ে ঢুকে তিনতলায় পৌঁছাল সিঁড়ি বেয়ে। দরজা হাট করে খোলা দেখে সে কেঁপে উঠল। আতঙ্কিত হয়ে সে ডাকল–ফেনাল?– কোন সাড়া পেল না। রান্নাঘরের মেঝেতে ক্যাবিনেট ড্রয়ারটা পড়েছিল। কৌতূহলী ড্যানা ছোট ছোট প্যাকটে দেখতে পেল। লেবেলে লেখা ছিল বুস্টার 15; NDC D081 D822-32 চিহ্নিত করা। এগুলো কী ড্রাগ? সে প্যাকেটগুলি কোটের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। সে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে একটা ওষুধের দোকানে ঢুকল। একটা গাছের পিছনে লুকিয়ে থাকা একটা লোক বলল ফোনে–ড্যানা ফার্মেসিতে ঢুকল। প্যাকেটা দেখে ফার্মাসিস্ট বলল,–বুস্টার একটা অ্যান্টি অ্যাংগজাইটি ড্রাগ। হোয়াইট ক্রিস্টাল। জলে গুলে খেতে হয়। খেলে খুব শান্ত হয় মন। তবে ভোজ বেশি হয়ে গেল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।–

ড্যানা বুঝল মিসেস ড্যালিই ফেনালকে ড্রাগ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে কিডন্যাপ করিয়েছে।

ড্যানা রাস্তায় নামতেই দুজন লোক ড্যানাকে বলল,–মিস ইভান্স, আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?—

ড্যানা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিল যে পুলিশ তার দিকে ছুটে চলল সিগনাল না মেনেই।

–একী করছেন, আপনি যে ট্রাফিক নিয়ম অমান্য করছেন।– ড্যানা তার কথা অগ্রাহ্য করে ছুটে চলল।

–আপনি কি বধির?

— ড্যানা পুলিশ কর্মীটির গালে এক চড় কষিয়ে দিল।

পুলিশ কর্মীটি তার হাত চেপে ধরে বলল,–আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল?– ড্যানা এটাই চাইছিল। পুলিশের গাড়ি এল। ড্যানাকে তাতে তোলা হল। দুজন লোক অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইল। পুলিশ স্টেশনে ঢুকেই ড্যানা ফোন করতে চাইল।

বারোটি ব্লক ঘুরে একটা লোক ফেনালকে একটা লিমুজিন গাড়িতে তুলল। ফেনাল কাতরভাবে বলল,–আমাকে গলির ভেতর নিয়ে যেও না?– ইউনিফর্ম পরিহিত চারজন নাবিক সেখান দিয়ে যাচ্ছিল।

ফেনাল তাদের কাছে সাহায্য চাইল–আমায় ঐ গলির মধ্যে নিয়ে যেতে দিও না। ও আমায় পাঁচ ডলার দেবে বলেছে। কিন্তু আমি নোংরা কাজ করতে পারব না।–

নাবিকরা দাঁড়িয়ে পড়ল–তুমি নিজে তো বিপথগামী হয়েই ছো, ঐ ছোট ছেলেটাকেও বিপদে নিয়ে যাচ্ছ কেন?–

–তোমরা ঠিক বুঝতে পারছে না…–।

নাবিকরা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তাকে ঘিরে ধরল। ফেনাল সেই সুযোগে পালিয়ে গেল।

একজন ডেলিভারি বয় তার সাইকেল রেখে একটা বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। ফেনাল তার সাইকেলে উঠে জোরে চালিয়ে চলে গেল।

ওদিকে পুলিশ স্টেশনে ড্যানাকে সার্জেন্ট মুক্তি দিয়ে দিল। ড্যানা বুঝল ম্যাটকে ফোন করে কাজ হয়েছে। ড্যানা পুলিশ স্টেশন থেকে বেরোতে যেতেই বাধা পেয়ে চমকে তাকাল। একজন লোক হাত ধরে রাস্তায় নিয়ে যেতে লাগল। থানার প্রবেশদ্বারে wrN-এর পুরো টেলিভিশন টিম দাঁড়িয়ে। ড্যানার উদ্দেশ্যে সহকর্মীরা প্রশ্নবান ছুঁড়তে লাগল। লোকটি মুখ ঢেকে পালাতে থাকে। ড্যানা অবাক হয়। ম্যাট বেকার ড্যানাকে বললেন,–চলো, এখান থেকে যাওয়া যাক।–

WTN বিল্ডিং-এ ম্যাট বেকারের অফিসে তারা সবাই মিলিত হল। ড্যানা বলছিল–FRA-ও জড়িত, এই কারণেই জেনারেল বুস্টার তদন্তের কাজে বাধা দিয়েছিল।– ইলিয়ট ক্রমওয়েল বললেন,–আমি অবাক। টেলর উইনথ্রপ সম্বন্ধে আমরা সবাই এতবড় ভুল করলাম কী করে? হোয়াইট হাউসকে জানানো উচিত। অ্যাটর্নি জেনারেল এবং FBI-এর সঙ্গে ওরা যোগাযোগ করুক।– অ্যাবে ল্যাসম্যান বলল,–আমাদের কাছে কোন প্রমাণ নেই?–শ্যাডনফের ভাই বোরিস এখনও জীবিত। সে মুখ খুললেই সব প্রকাশ হয়ে যাবে।– ড্যানা ম্যাট বেকারকে জিজ্ঞেস করল,–ফেনালের ব্যাপারে আমরা কী করছি?– দৃঢ়ভাবে ম্যাট বললেন,–আমরা, তাকে খুঁজে বার করবই। তবে তোমার লুকিয়ে থাকার একটা জায়গা খুঁজে বার করতে হবে। অ্যাবে ল্যাসমান বলে উঠল,–তুমি আমার অ্যাপার্টমেন্টটা ব্যবহার করতে পারো। সেখানে তোমাকে কেউ চিনতে পারবে না।–ধন্যবাদ,– ড্যানা বলল।

ফেনাল একটা বাস স্টপে এসে সাইকেলটা ঘাসের ওপর ছুঁড়ে ফেলে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। পকেটে হাত দিয়ে বুঝল এক পেনিও নেই। তাই সে নকল হাতটা খুলে প্রতিবন্ধী হয়ে ভিক্ষা করতে লাগল। একটি লোক এক ডলার তুলে দিল তার হাতে। –ধন্যবাদ,– লোকটিকে বলল ফেনাল এবং লোকটি, চলে যেতেই নকল হাত পরে নিয়ে সে একটি বাসে উঠতে গেল। ঠিক তখনই কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল সবকিছু। সে চিৎকার করে উঠতে গেল কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বার হল না। সে অজ্ঞান হয়ে গেল। পথচারীরা একে একে ভিড় করতে লাগল। একজন লোক জবাব দিল,–আমার ছেলে ডায়াবেটিক।– বলে সে ফেনালকে তার অপেক্ষারত লিমুজিন গাড়িতে তুলে নিল।

ওয়াশিংটনের উত্তর-পশ্চিমে অ্যাবে ল্যাসম্যানের বিরাট অ্যাপার্টমেন্ট। ড্যানা সেখানে ফোনের অপেক্ষায় রয়েছে। উত্তেজনা আর আতঙ্ক গ্রাস করছে তাকে। তার সেলফোনটা বেজে উঠল। রজার হাডসনের ফোন, সে বলল–ড্যানা, তোমার ফেনাল এখন আমাদের হেফাজতে।– ড্যানা স্থির হয়ে গেল।

অবশেষে বলল,–রজার—আমার লোকেদের আমি আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। ওরা ওর ভাল হাতটা কেটে ফেলতে চায়। আমি কি তাই করতে দেব?–

–না।– আর্তভাবে বলে ড্যানা।

রজার হাডসন বলল,–আমি চাই তুমি শুধু আমার বাড়িতে চলে এস আধঘন্টার মধ্যে। কোনরকম চালাকির চেষ্টা করলে ফেনালের যা ঘটবে তার জন্য আমি দায়ী থাকব না।–

ড্যানা ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে ম্যাট বেকারের ফোন নম্বরে ফোন করল। ম্যাটের কণ্ঠস্বর ভেসে এল–ম্যাট বেকার বলছি। আমি এখন বাড়িতে নেই। তোমার কিছু বলার থাকলে মেসেজ দিতে পারো। আমি ফিরে এসে জবাব দেব।– ড্যানা বলল,–এইমাত্র রজার হাডসনের ফোন পেলাম। ফেনাল তাদের হাতে বন্দী। তুমি পুলিশ নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এস।– অ্যাবে ল্যাসম্যান ম্যাট বেকারের টেবিলে চিঠি রাখতে এসে মেসেজটা দেখে পাসওয়ার্ডে ডায়াল করে মেসেজের টেপটা চালিয়ে দিয়ে মেসেজটা শুনে মেসেজ মুছে ফোলার বোতামটা চালিয়ে দিল।

ডালাস এয়ারপোর্ট নেমেই জেফ ড্যানার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছিল।

জেফ এর আগে অনেকবার ফোনে ড্যানার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। ট্যাক্সিতে উঠে WTN-এ যেতে বলল চালককে।

ম্যাট-এর রিসেপশন অফিসে জেফ ঢুকতেই ম্যাট বলল,–তোমাকে দেখে খুব ভাল লাগছে।–ধন্যবাদ। ড্যানা কোথায়?–

–এখানে কী সব ঘটনা ঘটছে তুমি জান না?-

–না, আমাকে একটু বলুন।–

অ্যাবে ম্যাট-এর অফিস ঘরের বন্ধ দরজায় কান পেতে রইল। টুকরো টুকরো কিছু কথা শুনতে পেল–ড্যানার প্রাণনাশের চেষ্টা..শ্যাডনফ্যাসনোইয়াঙ্ক-২৬…ফেনাল… রজার হাডসন–

এইটুকু শুনেই বে রজার হাডসনকে ফোন করল।

ওদিকে জেফ ম্যাট-এর কথা শুনে বিশ্বাসই করতে পারল না। বেকার বললেন,–এ সব সত্যি।– ইন্টারকমের বোতাম টিপে ম্যাটের অ্যাপার্টমেন্টে ড্যানার খোঁজ করতে অ্যাবের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন তিনি

জেফ এখানেই রয়েছে। ড্যানার খোঁজে সেখানে যাচ্ছে। ড্যানাকে এখন বার করে : আনলেই ভাল হয়। যদি…– অ্যাবে একটা শব্দ শুনে চমকে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ম্যাট দাঁড়িয়ে। ম্যাট খিঁচিয়ে উঠলে,–অ্যাবে তুই…–

জেফ উত্তেজিত হয়ে বলল,–হাডসনের বাড়িতে আমাকে এখনই যেতে হবে। একটা গাড়ি দরকার।–

ম্যাট বেকার বললেন,–তুমি সেখানে সময়মত পৌঁছাতে পারবে না। যা ট্রাফিক জ্যাম।–

ছাদে হেলিপ্যাড থেকে তারা WTN হেলিকপ্টারের যান্ত্রিক আওয়াজ শুনতে পেল। পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তারা।

.

ড্যানা একটা ট্যাক্সিতে উঠে চালককে হাডসনের বাড়ির ঠিকানা বলল। ম্যাট নিশ্চয়ই তার মেসেজটা পেয়ে পুলিশে খবর দিয়েছেন। ড্যানা তার পার্সে একটা গোলমরিচের স্পের ক্যান রেখেছিল। পুলিশ না আসা পর্যন্ত এটা দিয়েই আত্মরক্ষা করা যাবে।

হাডসনের বাড়ির সামনে এসে ড্যানা দেখল সেখানে পুলিশ নেই। ড্যানা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তার মনে হল রজার আর পামেলা কত মধুর ব্যবহার করেছিল অথচ এখন তারা প্রতারক, খুনি।

বাড়ির দরজায় সিজারের সঙ্গে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ড্যানা, সিজার বলল–আপনার জন্য স্টাডিতে মিঃ হাডসন অপেক্ষা করছেন।–এসো ড্যানা,– রজার বলল তাকে দেখে। –ফেনাল কোথায়?–কে? ও, তোমার প্রিয় পুত্র?–

–পুলিশ কিন্তু একটু পরেই এসে পৌঁছাচ্ছে।–

–তাই বুঝি? তবে আমি পুলিশকে ভয় করি না।– বলেই রজার ড্যানার পার্সটা ছিনিয়ে নিয়ে গোলমরিচের স্প্রের ক্যানটা বার করে নিল। ড্যানার মুখে খানিকটা স্প্রে করে দিতেই যন্ত্রণায় ড্যান চিৎকার করে উঠল।

ব্যাঙ্গভাবে রজার বলল,–যন্ত্রণা যে কত তীব্র তা এবার তুমি টের পাবে।–

যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে ড্যানা বলল,–আমি ফেনালকে দেখতে চাই।–নিশ্চয়ই। ফেনালও তোমাকে খুব দেখতে চাইছে। ছেলেটি ভীষণ ভয় পেয়েছে। সে বুঝেছে সে মরতে চলেছে। তোমার মরণও আসন্ন, আমি তাকে তাও বলেছি। তুমি নিজেকে খুব চালাক ভেবেছিলে তাই না ড্যানা? আমরা জানতাম রুশ সরকারের একজন অফিসার আমাদের কার্যকলাপ জানে এবং আমাদের মুখোশ খুলে দিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সে যে কে, আমরা জানতে পারিনি। তুমি নিজের অজান্তেই আমাদের তা জানিয়ে দিয়েছ।– ড্যানার শ্যাডনফ আর তার বান্ধবীর রক্তাক্ত মৃতদেহর কথা মনে পড়ে গেল।

–রজার, ফেনাল কিন্তু এসবের সঙ্গে জড়িত নয়। তাই ওকে ছেড়ে দেওয়া হোক।–

ড্যানা তুমি যখন জোয়ান সিনিসির সঙ্গে দেখা করো, তখনই তোমার ব্যাপারে আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। রাশিয়ান প্ল্যান সম্পর্কে টেলরের আলোচনা জোয়ান শুনে ফেলে। তাই জোয়ানের সঙ্গে টেলর বোঝাঁপড়ায় আসে যে ব্যাপারটা নিয়ে ভবিষ্যতে সে কারো সঙ্গে আলোচনা করবে না। তাই বলা যায় তার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী, কারণ তোমার সঙ্গেই জোয়ান ব্যাপারটা আলোচনা করতে চেয়েছিল।–

ড্যানা বলল–জ্যাক স্টোন সব জানে কিন্তু–।

রজার বলল–জ্যাক স্টোন আর তার লোকেরা তোমার প্রতিটি গতিবিধির ওপর নজর রেখে এসেছে। শ্যাডনফের খবর তোমার কাছ থেকে জানার পরেই তোমাকে আর আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই না।–

–আমি ফেনালকে দেখতে চাই।–

–অনেক দেরি হয়ে গেছে ড্যানা। পামেলা আর আমি ঠিক করলাম একটা আগুন ফেনালের ছোট্ট দেহটাকে শেষ করবার পক্ষে যথেষ্ট। তাই তার স্কুলে ফেরত পাঠিয়ে দিই। সেখানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে।

ড্যানা ঘৃণাভরা চোখে বলে,–তুমিও রেহাই পাবে না এত পাপ করে।–

রজার ডেস্কের বোতাম টিপতেই সিজার এল। –মিস ইভান্সের দায়িত্ব তুমি নাও। দুর্ঘটনাটা ঘটার আগে পর্যন্ত যেন বেঁচে থাকে সে।–ঠিক আছে মিঃ হাডসন।– ড্যানা বুঝল সিজারও বিশ্বাসঘাতক।

রজার বলল,–বিদায় ড্যানা।

— সিজার ড্যানাকে একটা লিমুজিন গাড়িতে তুলল।

WTN-এর হেলিকপ্টার রজার হাডসনের এস্টেটে নামার কথা। কিন্তু জেফ হেলিকপ্টার থেকে ড্যানাকে একটা লিমুজিন গাড়িতে তুলতে দেখে পাইলট ব্রোনসনকে গাড়িটা অনুসরণ করতে বলল।

ড্যানা সিজারকে বলল,–তুমি এই অনৈতিক কাজ কোর না। এরা সব ঠান্ডা মাথার খুনি। রজার হয়ত তোমাকেও কাজ মিটে গেলে খুন করবে।–রজারের জন্য আমি কোন কাজ করছি না। করছি পামেলার জন্য। পামেলা আমাকে ভালমতই যত্ন করেন।–

ড্যানা অবাক হয়ে গেল,–তুমি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?–রক ক্রিক পার্কে।–

ওদিকে একটা স্টেশন ওয়াগানে চড়ে রজার হাডসন, পামেলা হাডসন, জ্যাক স্টোন এবং মিসেস ড্যালি ওয়াশিংটন ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। জ্যাক স্টোন রজারের উদ্দেশ্যে বলল,–বিমান প্রস্তুত আছে। পাইলট বিমানটা নিয়ে মস্কোয় যাবার প্ল্যান করছে।–

রজার বললেন,–আর ফেনালের খবর কী?

–একটু পরেই স্কুলের বেসমেন্টে আগুন লাগানো হবে।

— লিমুজিন গাড়ির পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে পাইলট বলল,–জেফ, সিজারের গাড়িটা বাঁক নিল। বোধহয় রক ক্রিক পার্কের দিকে যাচ্ছে।–

ওটা অনুসরণ করো।–

FRA-তে জেনারেল বুস্টার তার অফিসে ঢুকেই তার সহকারীকে বললেন,–এখানে কী সব ঘটছে।–

–আপনি যখন বাইরে ছিলেন তখন মেজর স্টোন কিছু ভাল লোককে নিয়োগ করেছিল। রজার হাডসনের সঙ্গে তাদের একটা বড় লেনদেন ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ড্যানা ইভান্স।–হাডসনের সঙ্গে দেশ ছেড়ে চলে যাবার পরিকল্পনা করেছেন।– বুস্টার বললেন,–ন্যাশনাল এয়ারপোর্টে লাইন দাও।–

.

নরম্যান ব্রোনসন নিচে তাকিয়ে বলল,–রক ক্রিক পার্কে প্রচুর গাছ রয়েছে। তাই হেলিকপ্টার নামানো যাবে না।–

–রাস্তায় এখানেই কোথাও গাড়িটার সামনে হেলিকপ্টার নামাতে পারবে?

— পাইলট তাই করল, লিমুজিন গাড়িটাও দাঁড়িয়ে পড়ল। সিজার গাড়ি থেকে নেমে ড্যানাকে বলল,–তোমার বন্ধু আমাদের অসুবিধায় ফেলতে চাইছে। তাই তোমাকে..– বলে ড্যানার মুখে তীব্র ঘুষি মারল। ড্যানা অজ্ঞান হয়ে গেল। এবার সিজার, হেলিকপ্টারের দিকে ছুটল। বোম চাপ দিতেই ডানাগুলো ঘুরতে শুরু করল। একটু পরেই সে বুঝতে পারল কী ঘটতে চলেছে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। হেলিকপ্টারের ঘুরন্ত ব্লেডের ধাক্কায় সিজারের দেহটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল।

পাইলট নরম্যান ব্রোনসন বলল,–আমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছি না।–

সে হেলিকপ্টার থেকে বেরিয়ে লিমুজিন গাড়িটার দিকে ছুটল। জেফও গেল। গাড়ির দরজা খুলে দেখল ড্যানা অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে।

–ড্যানা…– ডাক শুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল ড্যানা, বলল…।

–ফেনাল..– জেফ গাড়ির চালকের আসনে বসে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে লিঙ্কন প্রিপারেটরি স্কুলের দিকে গেল।

ড্যানা উত্তেজিত হয়ে বলল–ওরা স্কুলের বেসমেন্টে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ওখানে ফেনাল রয়েছে।–

জেফ বলল,–ঈশ্বর, এই কঠিন পরীক্ষায় তুমি আমাদের সহায় হও।–

স্কুল বিল্ডিং-এর সামনে এসে তারা দেখল দমকলকর্মীরা আগুন নেভাতে ব্যস্ত। জেফকে দৌড়ে স্কুলের ভেতর যেতে দেখে দমকলকর্মীরা বাধা দিল, বলল,–ওখানে ঢুকলে মৃত্যু অনিবার্য।–

জেফকে তবু যেতেই হবে। আগুনের হলকায় তার গা ঝলসে গেল তবু পরোয়া না করে সে ঢুকে গিয়ে ফেনালকে ডাকতে লাগল। কোন সাড়া নেই। অবশেষে জেফ তাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আবিষ্কার করে তাকে বেসমেন্ট থেকে তুলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল।

ওয়াশিংটন ন্যাশনাল এয়ারপোর্টের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নাথান নোডেররাকে ফোন করে জেনারেল বুস্টার জানতে চাইলেন,–রজার হাডসন তার বিমানটা কি ওখানেই রেখেছে?–হা।–উড়ান বাতিল করে টাওয়ারকে জানিয়ে দিন।–

নাথান বলল,–জানিয়ে দিচ্ছি।–

সঙ্গে সঙ্গে টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলল,–হ্যালো টাওয়ার, গালফস্ট্রিম R3487-এর উড়ান বাতিল করে দাও।–

রজার হাডসন ককপিটে উঠে এসে কৈফিয়ত চাইল,–আমার বিমান কেন উড়ছে না।–

রজার হাডসনকে পাইলট বলল,–উড়তে একটু দেরি হবে। আমাদের এখনি টার্মিনালে ফিরে যেতে হবে।–

পামেলা ক্রুদ্বস্বরে বলল,–আকাশে উড়তে থাকো। টার্মিনালে ফিরতে হবে না।

–আপনার কথা রাখতে গেলে আমাকে লাইসেন্স হারাতে হবে।–

এবার জ্যাক স্টোন পাইলটের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলল,–আমরা রাশিয়ায় যাচ্ছি,– পাইলট প্রাণের ভয়ে তাই করল।

ওদিকে এয়ারপোর্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আকাশের দিকে চেয়ে শঙ্কিত হয়ে বলল,–গালফস্ট্রিম আকাশের অনেক ওপরে উঠে এসেছে। আমার নির্দেশের বিরুদ্ধে…–

ফোনে জেনারেল বুস্টার জানতে চাইলেন,–তুমি ওদের রুখে দিয়েছ তো?–

–না, কোনভাবেই ওদের আটকাতে পারলাম না। জ্যাক স্টোনের বন্দুকের সামনে পাইলট ভয় পেয়ে যায়।–

ঠিক তখনই আকাশের বিস্ফোরণ ঘটল। নীচে মাটিতে বিমানকর্মীরা আতঙ্কিত হয়ে আকাশের দিকে নজর রাখছিল, গালফস্ট্রিমের ভগ্নাংশগুলি মেঘের আড়াল থেকে বৃষ্টির মত পড়তে লাগল।

মাঠের একেবারে শেষপ্রান্তে বোরিস শ্যাডনফ দীর্ঘ সময় ধরে আকাশের দিকে নজর রাখছিল। সাফল্য পেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে হেঁটে চলল।

দাদার খুনের বদলা নিতে পেরে এখন সে খুব খুশি।