ষোল
সর্বাঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথার ভেতরটা কেউ যেন খুবলে খাচ্ছে। কাছাকাছি কোথাও আহত পশুর গোঙানি শব্দ শুনতে পেলেন জুড। চোখ মেলে তাকালেন। অচেনা ঘর, অজানা পরিবেশ। এক কোণে ব্রুস বয়েড ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নড়াচড়ার শব্দ শুনে সে বিছানার কাছে এগিয়ে এল।
–সব দোষ আপনার। আপনার পাল্লায় না পড়লে জনি বেঁচে যেত। আমার সঙ্গে থাকলে কেউ তাকে মারতে পারত না।
হঠাৎ জুডের মনে হল, তিনি ভুল লোকের কাছে এসেছেন। ব্রুস বয়েড কখনোই ডন ভিন্টন নয়। যদি হত, তাহলে এতক্ষণ তিনি জীবিত থাকতেন না।
ধীরে ধীরে তিনি বললেন আমি কিন্তু হ্যানসেনকে একবারও বলিনি, আপনাকে ত্যাগ করতে। ওটা উনি নিজেই ভেবেছিলেন।
–আপনি মিথ্যেবাদী।
–উনি আমার কাছে আসার আগেই আপনাদের মধ্যে গোলমাল চলছিল।
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর–হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে সর্বক্ষণ ঝগড়া বাঁধত।
–ওর বিবেক চাইছিল, স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যেতে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু করার জন্য উনি উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন।
–হ্যাঁ, বয়েড ফুঁপিয়ে ওঠে। ও আমার কাছে সব বলত। আমি ভাবতাম, ও বোধ হয় আমাকে শাস্তি দিতে চাইছে। তারপর একদিন সত্যি সত্যি আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
–উনি কিন্তু তখনও বন্ধু হিসেবে আপনাকে ভালোবাসতেন।
বয়েড সরাসরি তাকাল আপনি আমাকে সাহায্য করবেন? আবার ফিরিয়ে দেবেন আমার স্বাভাবিক জীবন?
–সেটা নির্ভর করছে আপনার ইচ্ছা শক্তির ওপর। আমি আপনাকে মনোবৈজ্ঞানিক সাহায্য দিতে পারি।
–বলুন তাহলে কবে থেকে সেটা শুরু করব।
–আগামী সোমবার আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
ট্যাক্সি নিয়ে ফ্ল্যাটের দিকে ফিরতে ফিরতে জুড ডন ভিন্টনের কথা চিন্তা করছিলেন। ওই লোকটা কে? অপরাধী যদি হয়ে থাকে, তাহলে পুলিশের খাতায় নাম নেই কেন? তাহলে কি অন্য কোনো নামে সে পরিচিত? না, মুডি স্পষ্টই একথা বলেছে। তবে, একথা নিশ্চিত ডন ভিন্টন যেই হোক, টেরি বা বয়েডের মধ্যে কেউ নয়। তাই অনায়াসে সন্দেহের তালিকা থেকে ওদের বাদ দেওয়া যায়। তার মানে? আমার জীবনের ওপর আর একটা আঘাত আসছে? আজ অথবা আগামী কাল সেই আঘাত থেকে আমি বাঁচব তো?
ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে এসে ট্যাক্সি দাঁড়াল। দারোয়ান এগিয়ে এল তাকে সাহায্য করতে। জুড ঘুরে তাকালেন। একী, এ লোকটাকে তিনি তো আগে কখনও দেখেননি।
.
সতেরো
লোকটা বেশ লম্বা। গায়ের রং ঈষৎ বাদামী, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। গভীর কোটরাগত দুটি কালো চোখ। গলায় আড়াআড়ি একটা ক্ষতচিহ্ন। মাইকের পোশাকটা, সে পরেছে। কিন্তু সেটা ভীষণভাবে এঁটে বসেছে তার গায়ে।
ট্যাক্সি চলে গেল। জুড শান্ত মাইক কোথায়?
–ডাক্তার সাহেব ছুটিতে।
ডাক্তার সাহেব? তার মানে লোকটা আমার পরিচয় জানে।
কিন্তু মাইক এখন ছুটি নেবে কেন?
লোকটার মুখে পরিতৃপ্তির হালকা হাসি। জুড রাস্তার দিকে তাকালেন। চারপাশ ধু ধু করছে। জন প্রাণীর চিহ্ন নেই। সাহায্যের প্রত্যাশা বৃথা। দৌড়ে পালানো সম্ভব নয়। ভেতরে ঢোকাই ভালো। পায়ে পায়ে লিফটের দিকে এগিয়ে চললেন। ওখানে এডিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার নাম ধরে ডাকলেন।
আবার বিস্ময়, যে ফিরে তাকাল, তাকে নতুন দারোয়ানটার একটা ছোটো সংস্করণ বলা যেতে পারে। তফাতের মধ্যে গলায় ক্ষত চিহ্নটা নেই। অর্থাৎ ওরা দুজন আপন ভাই।
–ওপরে যাবেন তো? লোকটা খুব অমায়িক।
জুড ম্যানেজারের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন আমি একবার মিঃ কারজের সঙ্গে দেখা করব।
লম্বা নোকটা আচমকা পেছন থেকে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াল–উনি এখন ব্যস্ত আছেন ডাক্তার সাহেব।
লিফটের সামনে দাঁড়ানো লোকটা বলল চলুন, আপনাকে ওপরে নিয়ে যাই।
–না, আমি আগে—
–আপনাকে যা বলা হচ্ছে, তাই করুন।
আচমকা হিমেল হাওয়ার ঝাঁপটা ছুটে এল। লবির দরজা খুলে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী ঢুকল। হৈ হৈ করে ওরা লিফটের দিকে এগিয়ে চলেছে।
–ও, আজকের আবহাওয়া সাইবেরিয়াকে হার মানিয়েছে।
–যাই বলো দিনটা দারুণ গেল।
–আজ কিন্তু তোমার হাতে এক পেগ না খেয়ে নড়ছি না।
–আজ খুব দেরী হয়ে গেছে জর্জ।
–হোক দেরী। আরে বাবা, শরীরটা একটু গরম না করে শূন্য ডিগ্রির মধ্যে বেরোব কেমন করে বলো তো?
–কিন্তু এক পেগের বেশী নয়। মনে থাকে যেন।
–তাই হবে।
হাসতে হাসতে ওরা লিফটের খাঁচায় ঢুকল। জুড চট করে ওদের সঙ্গে মিশে গেলেন। বাইরে দু-ভাইয়ের মধ্যে চোখ চাওয়া-চাওয়ি হল। তারপর ছোট্ট একটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে ছোটো ভাই খাঁচায় ঢুকে পড়ল। জুডের ফ্ল্যাট পাঁচতলায়। ওরা যদি তার আগে নেমে যায়, তাহলে কী হবে? পরে নামলে হয়তো বাঁচবার একটা চেষ্টা করা যাবে।
–বলুন কতলা?
সোনালি চুলওয়ালা মেয়েটা দুষ্টু দুষ্টু হাসল।
–এত রাতে দু-দুটো অচেনা পুরুষ মানুষকে ফ্ল্যাটে ঢুকিয়ে স্বামীকে কী বলব বুঝতে পারছি না। লিফট চালকের দিকে ফিরে দশ।
ঢোক গিলে জুড–পাঁচ।
পাঁচতলায় লিফট থামল। জুড নামলেন, দরজা বন্ধ হল। কোনোরকমে হোঁচট খেতে খেতে ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে চললেন। পাঁচ মিনিট, এর মধ্যে নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। চাবি খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকলেন। ভেতর থেকে লোহার শিকলটা তুলতে গিয়ে তার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। গোটা চেনটা উপড়ে এল হাতে। ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে টেলিফোনের কাছে চলে এলেন। এখন অ্যাঞ্জেলিই ভরসা, কিন্তু সে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে শুয়ে আছে। কী বলবেন তাকে? নতুন দারোয়ান আর লিফটচালক বাড়িতে এসে তাঁকে খুন করতে চায়?
রিসিভার হাতে অসহায় চোখে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলেন। টেলিভিশনের ছোট সেটটার দিকে নজর পড়ল। হাত বাড়িয়ে চাবি ঘোরালেন। লবি ফঁকা। তখুনি একজনের কথা মনে পড়ল। ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলেন। ওপাশে ফোনের ঘণ্টা পাঁচবার বাজল। একজন সাড়া দিল–হ্যালো।
অসংলগ্নভাবে জুড কথা বলছিলেন। দৃষ্টি তখন টেলিভিশনের পর্দায়। ফাঁকা লবির দূর প্রান্তে তিনি দুজনকে দেখতে পাচ্ছেন। বলিষ্ঠ পায়ে তারা কাছে, ক্রমশ কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে।
.
ওরা নিঃশব্দে জুডের ফ্ল্যাটের দরজার দুপাশে এসে দাঁড়াল। লম্বা লোকটার নাম রকি। সে দরজায় আলতো ঠেলা দিল। তালা লাগালো। পকেট থেকে সেলুলয়েডের কার্ড বের করল। চাবির ফোকরে ঢুকিয়ে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকাল। দুজনেই কোমর থেকে সাইলেন্সর লাগানো রিভলবার বের করল। রকির কারসাজিতে তালাটা খুলে গেল। দরজা খুলে রিভলবার তাক করে ভেতরে ঢুকে গেল।
সামনে আরও তিনটে বন্ধ দরজা। জুডের চিহ্ন নেই। ছোটো ভাই নিক এগিয়ে গেল প্রথম দরজার কাছে। ওটাও তালা বন্ধ। দাদার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। রিভলবারের নল রেখে ট্রিগার টিপল তালার ওপর, কোনো শব্দ হল না। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল শোবার ঘর। রিভলবার ঘোরাতে ঘোরাতে ওরা সেখানে ঢুকে পড়ল।
কেউ সেখানে নেই। নিক আলমারিগুলো খুলে খুলে দেখতে শুরু করল। রকি এল বৈঠকখানায়। কোনো ব্যস্ততা নেই ওদের চলাফেরার মধ্যে। ওরা জানে, লক্ষ্য বস্তুকে যে, কোনো মুহূর্তে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাবে।
প্রথম ঘরটা শেষ হল, দ্বিতীয় দরজার সামনে পৌঁছে গেল নিক। ওটাও তালাবন্ধ। একইভাবে তালাটাকে ধ্বংস করে ভেতরে ঢুকল। এই ঘরটা একেবারেই ফাঁকা। তৃতীয় দরজাটির দিকে এগোতে গিয়ে হঠাৎ টেলিভিশনের পর্দার ওপর চোখ পড়ল। রকি তার ভাইয়ের হাত ধরে ফেলল। ওরা দেখল, একতলার লবিতে তিনজন লোক হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছে। সাদা পোশাক পরা দুজন একটা স্ট্রেচার ঠেলছে। তৃতীয় জনের হাতে ডাক্তারি ব্যাগ।
–কী আবার হল?
–মাথা ঠাণ্ডা রাখ রকি। নিশ্চয়ই কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কয়েক শো ফ্ল্যাট আছে এ বাড়িতে।
স্ট্রেচার শুদ্ধ তিনজন লিফটের ভেতর ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
–মিনিট দুই অপেক্ষা করা যাক। নিক বলল। মনে হচ্ছে কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। তাহলে পুলিশ আসবে।
–শালা ফাটা কপাল কাকে বলে।
–অত ভাবছিস কেন? স্টিভেন্স তো আর পালাতে পারছে না। দড়াম করে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল। স্ট্রেচার নিয়ে হুড় মুড় করে ঢুকেছে তিনজন। রকি আর নিক চোখের পলকে বন্দুক দুটো ওভার কোটের পকেটে ঢুকিয়ে নিল।
নিককে লক্ষ্য করে চিকিৎসকটি প্রশ্ন করল–মারা গেছে?
–কে?
–যে লোকটা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। বেঁচে আছে, না মারা গেছে?
নিক রকির সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল আপনারা ভুল অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছেন?
চিকিৎসক তাদের উপেক্ষা করে বন্ধ দরজাটার কাছে এগিয়ে গেল তালা দেওয়া দেখছি। এটা খুলতে আমাকে সাহায্য করবেন?
দুভাই আগ্রহ দেখাল না। চিকিৎসক নিজেই তার সহযোগীর সাহায্যে কাঁধের ধাক্কায় দরজাটা ভেঙে ফেলল।
–স্ট্রেচার নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি। বিছানায় শোওয়া জুডকে লক্ষ্য করে সে বলল,–এখন ভালো বোধ করছেন তো?
জুড কোনোরকমে চোখ মেলে তাকানোর ভান করলেন–হাসপাতাল।
রকি আর নিকের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে তাকে ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তোলা হল। ওখানে থাকা অর্থহীন ভেবে দুভাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চিকিৎসকের মুখে হাসি ফুটেছে। জুডকে লক্ষ্য করে বলল–এবার বল, কেমন লাগছে?
প্রত্যুত্তরে জুড হাসতে গেলেন। কিন্তু হাসিটা প্রকাশ পেল না। তিনি বললেন–তোমাকে অনেক ধন্যবাদ পিট।
পিটার হ্যাডলি তার দুই সহযোগীকে ইঙ্গিত করলেন চলল, এবার যাওয়া যাক।
.
আঠারো
হাসপাতাল ঘরটা আলাদা। নার্স সেই আগের জন। জুড. চোখ খুলে তাকে পাশে বসে থাকৃতে দেখলেন।
মেয়েটি মৃদু হাসল। বলল–উঠেছেন তাহলে। দাঁড়ান ডাঃ হ্যারিসকে ডেকে আনি।
–আসতে পারি। ডাঃ সিমুর হ্যারিস ঘরে ঢুকে হাসতে হাসতে বললেন–এই রকম আরও দু-চারটে খদ্দের আমাদের দরকার। তুমি কি জানো, ব্যান্ডেজ আর সেলাই বাবদ আমরা তোমার কাছ থেকে কত টাকা বিল করেছি? এবার ভাবছি, তোমার জন্য কিছু কনসেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাক ঘুম কেমন হল?
জুড হাসলেন–দারুণ ঘুমিয়েছি।
–সুসংবাদ, ভালো কথা। লেফটেনান্ট ম্যাকগ্রেভি একবার দেখা করতে চান। উনি খুবই হন্তদন্ত হয়ে এখানে এসেছেন। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা নাকি খুবই জরুরি।
অর্থাৎ ম্যাকগ্রেভি তাকে গ্রেপ্তার করতে চায়? জুডের হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করেছে। অ্যাঞ্জেলি এখন অসুস্থ। কদিন অফিসে আসছে না। এই সুযোগটা ম্যাকগ্রেভি নিশ্চয়ই ছাড়বে না। কিন্তু এত সহজে তিনি হার মানতে রাজী নন। মনে মনে একটা মতলব ভেজে নিয়ে বললেন এখানে নাপিত পাওয়া যাবে? দাড়িটা কামানো দরকার।
ডাক্তার হ্যারিস অবাক চোখে তাকালেন–নিশ্চয়ই আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জুড লাফিয়ে উঠলেন। টানা বিশ্রামের পর শরীরটা ঝরঝরে। তিন মিনিটের মধ্যে পোশাক বদলে ফেললেন তিনি। দরজা ফাঁক করে বারান্দার এপাশ ওপাশ তাকালেন। কেউ লক্ষ্য করছে না দেখে সিঁড়ির মুখে চলে গেলেন।
আর ঠিক তখনই লিফটের দরজা খুলে ম্যাকগ্রেভি লবিতে পা রাখল।
দুমদুম করে পা ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ল ম্যাকগ্রেভি। প্রথমেই নজরে পড়ল খালি বিছানাটা। যা পাখি উড়ে গেছে। খানিকক্ষণ এপাশ-ওপাশ তাকাল। টেলিফোনের কাছে গিয়ে থানার সঙ্গে যোগাযোগ করল।–হ্যালো ম্যাকগ্রেভি বলছি। সমস্ত থানায় খবর পাঠাও ডাঃ স্টিভেন্স…।
পুলিশের গাড়িটায় রেডিও কণ্ঠস্বর এক ঘেয়ে সুরে বলে চলেছে দশ নম্বর, দশ নম্বর। সমস্ত গাড়িকে বলা হচ্ছে পাঁচ নম্বরকে।
অ্যাঞ্জেলি সুইচ বন্ধ করে দিল আর কে জানে আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?
জুড মাথা নেড়ে–কেউ না।
অ্যাঞ্জেলি আশ্বস্ত ভঙ্গিমায় ঘাড় নাড়ল।
জর্জ ওয়াশিংটন সেতু ছাড়িয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলেছে নিউ জার্সির দিকে।
অ্যাঞ্জেলিকে পাশে পেয়ে জুড অনেকটা স্বস্তি বোধ করছিলেন।
–যাক ব্যাপারটা যে আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে এটাই সব থেকে আনন্দের কথা।
জুড বললেন–এটা একটা পেশাদার খুনেদের সংস্থা। এতে একাধিক লোক জড়িত আছে, তা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। মুডি ঠিকই অনুমান করেছিল।
বড়ো রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে অ্যাঞ্জেলি সরু গলিতে গাড়ি ঢোকাল।
জুড প্রশ্ন করলেন আমার কথা আপনার বন্ধু কি শুনেছেন?
–হ্যাঁ, আমি ফোনে জানিয়ে দিয়েছি, বলতে বলতে একটা গলিতে ঢুকে পড়ল অ্যাঞ্জেলি। তারপর আরও মাইলখানেক এগিয়ে একটা বৈদ্যুতিক ফটকের সামনে গেল। জুড লক্ষ্য করলেন, ছোট্ট দূরদর্শন ক্যামেরা গেটের ওপর লাগানো আছে। কয়েক সেকেন্ড পরে নিজে থেকেই পাল্লা দুটো খুলে গেল। গাড়িটা ভেতরে ঢোকার পর বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরে অনেকখানি লম্বা রাস্তার শেষ প্রান্তে জুড একটা বিরাট ছাদকে উঁকি মারতে দেখলেন।
.
উনিশ
পুলিশের সদর দপ্তরের বিশাল ঘর। শব্দ ঢুকতে পারে না, এমনই ব্যবস্থা। ডজন খানেক পুলিশ অফিসার বিশাল সুইচ বোর্ডকে ঘিরে বসে আছে। ওদের সজাগ দৃষ্টি ছজন অপারেটরের ওপর। ডাঃ জুড স্টিভেন্স আর ডিটেকটিভ ফ্রাঙ্ক অ্যাঞ্জেলির সন্ধান করতে তারা সমস্ত দেশে জাল ছড়িয়েছে। অপারেটরদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সামান্যতম খবর পেলেই যেন তা অফিসারদের কানে পৌঁছে দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে সেই তথ্য চলে যাবে : নিয়ন্ত্রণ বিভাগে। শুরু হবে পুলিশি তৎপরতা।
ক্যাপ্টেন বারটেলি ঢুকলেন অপরাধ দপ্তরের প্রধান অ্যালেন্স রিভানের ঘরে। একটু বাদে ম্যাকগ্রেভি সেখানে এসে হাজির হল। বারটেলি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
ম্যাকগ্রেভি বললেন–ডাঃ স্টিভেন্সের অফিস বাড়ির উল্টোদিকে আমরা একজন প্রত্যক্ষ দর্শীর সন্ধান পেয়েছি। দারোয়ানি করে লোকটা। সে বলছে বুধবার রাতে দুজন লোককে
সে ওই বাড়ির তালা খুলে ভেতরে ঢুকতে দেখেছে।
–সনাক্তকরণের কিছু ব্যবস্থা।
–হ্যাঁ, অ্যাঞ্জেলির ছবিটা সে দেখিয়েছে।
–কিন্তু বুধবার রাতে তার তো সর্দি জ্বরে শয্যাশায়ী থাকার কথা।
–ঠিক, তবে দ্বিতীয় লোকটাকে সে দেখতে পায়নি।
সুইচ বোর্ডে অসংখ্য লাল আলো জ্বলছে। একটার পাশে প্লাগ গুঁজে দিয়ে একজন অপারেটর ক্যাপ্টেন বারটেলিকে লক্ষ্য করে বলল–আপনার কল স্যার। নিউজার্সি হাইওয়ে টহলদার বাহিনী থেকে বলছে।
ক্যাপ্টেন বারটেলি রিসিভারটা ছিনিয়ে নিয়ে–ক্যাপ্টেন বলছি। হ্যাঁ ঠিক বলছেন–শুনুন, আপনাদের সমস্ত ইউনিটকে ওখানে কাজে লাগিয়ে দিন। রাস্তা অবরোধ করুন। পালাবার কোনো পথ যেন ভোলা না থাকে। সবসময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। ধন্যবাদ।
ফোনটা অপারেটরের হাতে দিয়ে–একটা সূত্র পাওয়া গেছে। নিউজার্সির একজন টহলদার অরেঞ্জবার্গের কাছেই অ্যাঞ্জেলির গাড়িটা দেখেছে।
–আর স্টিভেন্স?
–সেও সঙ্গে আছে।
ম্যাকগ্রেভি চুরুট ধরিয়ে ডাঃ স্টিভেন্সের বন্ধু ডাঃ পিটার হ্যাডলির সঙ্গে কথা বললাম। তিনি একটা মজার কথা শোনালেন। কয়েকদিন আগে বন্ধুর সঙ্গে অফিসে দেখা করতে গিয়ে তিনি অ্যাঞ্জেলিকে বন্দুক হাতে দেখেছেন। অ্যাঞ্জেলি অবশ্য তাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা, ডাঃ হ্যাডলি হঠাৎ এসে পড়াতেই সে যাত্রায় ডাঃ স্টিভেন্সের প্রাণ বেঁচে গিয়েছিল।
সুলিভান প্রশ্ন করলেন–কিন্তু অ্যাঞ্জেলির ওপর আপনার প্রথম সন্দেহ কীভাবে হল?
–কয়েক জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার অনাবশ্যক ঝগড়াঝাটির পর থেকেই তাকে আমি সন্দেহ করতে শুরু করি। তদন্ত করতে গিয়ে দেখি, তারা কেউ ওর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চাইছে না। আমার কেমন যেন মনে হল, ওরা কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে ভয় পেয়েছে। ব্যাপারটা আমি অ্যাঞ্জেলির কাছে চেপে গিয়েছিলাম। তখন থেকেই তার ওপর কড়া নজর রাখতে শুরু করি। এর কিছুদিন বাদে হ্যানসেন খুন হল। অ্যাঞ্জেলি সেই সময় নিজে আমার কাছে এল। এই কেসে আমার পার্টনার হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দিল। এমন কী এর জন্য ক্যাপ্টেন বারটেলির কাছে পর্যন্ত আবেদন করেছিল। যাই হোক তাকে আমি নিলাম। তখনও আমি ডাঃ স্টিভেন্সের নির্দোষিতা সম্পর্কে নিশ্চিত নই। আমি একটা চাল চেলে ওকে বললাম, ডাক্তারকে আমি সন্দেহ করি আর তাকে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ফাসাতে চাই। আমার ধারণা ছিল সে এতে আরও নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে। আমার দিক থেকে সন্দেহ মুক্ত হতে পেরেছে ভেবে সে ভালো ভাবে তার পথে হাঁটবে।
–কাজ হল তাতে?
–না, বরং আমাকে অবাক করে অ্যাঞ্জেলি ডাঃ স্টিভেন্সকে আড়াল করতে শুরু করল। আমি যেন কিছুতেই তাকে জেলে ভরতে না পারি তার ব্যবস্থা করতে লাগল।
সুলিভান বিভ্রান্ত–কিন্তু কেন?
–তার কারণ ডাক্তারকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিল অ্যাঞ্জেলির। জেলে গেলে সেটা সম্ভব হত না।
বারটেলি বললেন–অ্যাঞ্জেলি আমার কাছে এসেছিল। আমাকে সে বোঝায় আপনি নাকি অনর্থক ডাঃ স্টিভেন্সকে ফাসাতে চেষ্টা করেন।
–ক্যাপ্টেন আমাকে খবরটা জানিয়ে দেওয়াতে আমি আমার সন্দেহ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে যাই। ডাঃ স্টিভেন্স এরপর মুডি নামে একজন বেসরকারি গোয়েন্দার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি এই লোকটার একজন ব্যবসাদার মক্কেলের সঙ্গে অ্যাঞ্জেলির ঝামেলা হয়েছিল। মুডি কোর্টে জানায়, তার মক্কেলকে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। আসলে তখন থেকেই সে অ্যাঞ্জেলির পরিচয়ের আঁচ পেয়েছিল। তাই ডাঃ স্টিভেন্সের গাড়ির বোমাটা সে সরাসরি এফ বি আই-এর কাছে পাঠিয়ে দেয় পরীক্ষা করে দেখার জন্য।
–অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন, সে সন্দেহ করেছিল, অ্যাঞ্জেলির হাতে গেলে এটা ঠিক মতো পরীক্ষা হবে না। তাই তো?
–আমার তাই ধারণা। কিন্তু ঘটনাচক্রে এফ বি আই-এর কাছে পাঠানো মুডির রিপোর্টের কপিটা অ্যাঞ্জেলির হাতে পড়ে যায়। ওটা দেখেই সে বুঝতে পারে, মুডি তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। এছাড়া মুডি আর একটা ভুল করেছিল, ডাঃ স্টিভেন্সের কাছে ডন। ভিন্টনের নামটা প্রকাশ করে সে।
–কেন?
–কারণ ডন ভিন্টন হল লা কোসানোস্ত্রার একটা গুপ্ত সংস্থার সর্দারের নাম। অ্যাঞ্জেলি। সেই সংস্থার সঙ্গে জড়িত।
–কী করে বুঝলেন?
–যে ব্যবসাদারদের কথা বললাম, তাদের কাছে ডন ভিন্টন নামটা বলতেই যেন ম্যাজিক ঘটে গেল। ওরা গড় গড় করে সব বলে গেল। শুনলাম অ্যাঞ্জেলি ওই সংস্থার হয়ে ভয় দেখায়। নিয়মিত তোলা আদায় করে।
–কিন্তু ডাঃ স্টিভেন্সকে তারা খুন করতে চাইছে কেন?
সুলিভান এবার অধৈর্য।
–তা বলতে পারছি না। সেটা জানার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে দুটো ঘটনা ঘটে গেছে। অ্যাঞ্জেলির পেছনে আমরা যেসব লোককে লাগিয়ে ছিলাম, তাদের সে ঝেড়ে ফেলেছে। আর ডাঃ স্টিভেন্সকে সতর্ক করতে গিয়ে দেখি তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন।
সুইচ বোর্ডের একজন অপারেটর বলে উঠল ক্যাপ্টেন, বারটেলি।
বারটেলি ফোন ধরলেন। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। গাড়িটা ওদের চোখের আড়ালে চলে গেছে।
.
কুড়ি
অ্যান্টনি ডিমার্কো। দারুণ প্রশংসনীয় চেহারা। সত্যি অ্যানির কথা একেবারে সঠিক। তার স্বামী সুপুরুষ। রোমানদের মতো মুখের গঠন। কুচকুচে কালো দুটি টানা চোখ। মাথায় ঝাঁকড়ানো চুল। বয়স চল্লিশ। দীর্ঘকায় খেলোয়াড় সুলভ আকৃতি। অস্থির পশুর মতো সবসময় ছটফট করছে।
মনোরম গলা তার আপনাকে এক গ্লাস ড্রিঙ্ক বানিয়ে দিই ডাক্তার।
জুড মন্ত্র মুগ্ধ অর্থাৎ প্রয়োজন নেই।
বই পত্র ঠাসা লাইব্রেরি ঘরে ওরা পাঁচজন। জুড, ডিমার্কো, অ্যাঞ্জেলি আর সে দুই ভাই– রকি ও নিক ভ্যাকাররা।
ডিমার্কো জুডকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে করতে আপনার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছি, কিন্তু আপনাকে ধরে আনার জন্য আমি দুঃখিত। কিছু জিজ্ঞাসা ছিল–আচ্ছা, আমার স্ত্রীর সঙ্গে কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, ডাঃ স্টিভেন্স?
জুড অবাক হবার ভান করলেন–কে বলুন তো।
–গত তিন সপ্তাহের মধ্যে অন্তত পাঁচ-ছবার ও আপনার সঙ্গে দেখা করেছে। জুড ভুরু কোঁচকালেন ডিমার্কো পদবীওয়ালা কেউ তো–
–তাহলে সম্ভবত ও বিয়ের আগের পদবী আপনাকে জানিয়েছে, ব্লেক, অ্যানি ব্লেক।
–অ্যানি ব্লেক! ভ্যাকোরা ভাইয়েরা আরও কাছে এগিয়ে এল।
–না। ধমক দিয়ে উঠল ডিমার্কো। তারপর জুডের দিকে ফিরে তাকাল ডাক্তার, একটা কথা আপনাকে প্রথমেই জানিয়ে রাখি। আমি বাচ্চাদের খেলা পছন্দ করি না। শেষে অপ্রিয় যদি কিছু করে বসি, তাহলে আমাকে দোষ দেবেন না।
–আপনার যা প্রাণে চায় তাই করতে পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনার মুখ থেকে শোনার আগে পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল না যে অ্যানি ব্লেক আপনার স্ত্রী?
অ্যাঞ্জেলি বলল কথাটা সত্যি হতে পারে।
ডিমার্কো তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে বলুন, গত তিন সপ্তাহ ও কী নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করেছে।
জুড বললেন–সেটা বলার মতো কিছু নয়। আসলে উনি নিজের সমস্যার কথাটাই আমার কাছে প্রকাশ করেননি।
ডিমার্কো এক দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকাতে তাকাতে বলল–আমি কিন্তু আরও কিছু শোনার আশা করেছিলাম।
–আমি শুধু এটুকুই জানতাম, উনি কোনো ব্যাপারে অসুখী। কিন্তু সেটা নিয়ে উনি আলোচনা করতে চাইতেন না।
–আপনার অফিসে গিয়ে ও যা যা বলেছে, তার প্রত্যেকটি কথার রেকর্ড আমার কাছে আছে। আমার পরিচয় কী দিয়েছে ও?
–আপনার একটা নিজস্ব কারখানা আছে এটুকু শুনেছি।
–আপনার চারিত্রিক বিশ্লেষণ তথ্য আমি ভালোভাবে শুনেছি। তাতে আমার মনে হল রোগীর কোনো কিছুই আপনার কাছে অজানা থাকে না।
–ওটা আমার চিকিৎসার অন্যতম পদ্ধতি। কিন্তু মিসেস ডিমার্কের ক্ষেত্রে আমি একেবারে হেরে গেছি। এই কারণেই ওকে আমি ছেড়ে দেব ভেবেছিলাম।
–কিন্তু শেষ অব্দি ছাড়া হয়নি।
–তার প্রয়োজনও হয়নি। গত শুক্রবার উনি আমায় জানিয়ে গেলেন যে, আপনারা ইউরোপ চলে যাচ্ছেন।
–কিন্তু শেষ পর্যন্ত অ্যানি মত পাল্টে ছিল। আমার সঙ্গে ইউরোপ যেতেও রাজী হয়নি। বলতে পারেন কেন?
জুড এবার সত্যি অবাক–না!
–কারণটা স্বয়ং আপনি ডাক্তার।
–বুঝলাম না, খুলে বলুন।
–বোঝা কিন্তু উচিত ছিল। যাই হোক, গতরাতে অ্যানির সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। ও বলেছে, আমাকে বিয়ে করাটাই নাকি ওর ভুল হয়েছে। আমার ওপর ওর আদৌ আকর্ষণ নেই। সে জিনিসটা এখন চলে গেছে আপনার দিকে।
ডিমার্কের গলা ফিসফিসানির পর্যায়ে চলে এল আপনার অফিসে একান্তে বসে ও যা আচরণ করেছে, আমি আপনার মুখ থেকে সেগুলো শুনতে চাইছি।
–তেমন কিছুই উনি করেননি। আমাদের লাইনে অভিজ্ঞতা থাকলে আপনি বুঝতে পারতেন। প্রত্যেক রোগিনী কোনো একটা সময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। সেই সময় প্রায় তারা সাইকিয়াট্রিস্টদের প্রেমে পড়ে যায়। অবশ্য এই ভুল ভাঙতে খুব একটা দেরী হয় না। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন উনি আমার কাছে যাতায়াত করছেন?
ডিমার্কো এক মুহূর্ত জুডের দিকে তাকাল। টেবিল থেকে কাগজ কাটার একটা ধারালো ছুরি নিল খবর আমার কাছে ঠিকই এসে যায় ডাক্তার। যাই হোক, আমার দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমাদের গোপন খবরাখবর বাইরে পাচার করার অপরাধে অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের মতো ওকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু আমি অ্যান্টনি ডিমার্কো ওদের সর্বাধিনায়ক। আমার সিদ্ধান্ত হল যাকে অ্যানি গোপন খবরাখবর পাচার করেছে, তাকেই প্রথম পৃথিবী থেকে সরাব।
ডাক্তারের মনে হল একটা শীতল শিহরণ তার সমস্ত স্নায়ুকে আচ্ছন্ন করেছে। তিনি বললেন–আপনি গোড়াতেই ভুল করছেন।
–না ডাক্তার, ভুলটা আমার নয়, ভুলটা অ্যানির। খাঁচায় বদ্ধ হিংস্র জন্তুর মতো পায়চারি শুরু করল ডিমার্কো, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে, ও আমার থেকে আপনাকে যোগ্য বলে মনে করল কী করে? কী যোগ্যতা আছে আপনার? সারা বছর অফিস থেকে কত টাকা আয় করেন? তিরিশ হাজার পঞ্চাশ হাজার…এক লাখ? ওটা আমার হপ্তার রোজগার। বলুন আমাকে, কী দেখে আপনারা পরস্পরের দিকে মজে ছিলেন?
–আমার ক্ষেত্রে দুর্বলতার কোনো প্রশ্ন নেই।
ডিমার্কোর চোখ ঝলসে গেছে ওর উপর কোনো আকর্ষণ নেই আপনার?
–আমি আগেই জানিয়েছি ওর সঙ্গে আমার চিকিৎসক রোগীর সম্পর্ক।
–বেশ ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি এই কথাটা নিজের মুখে জানাবেন। ডিমার্কোর ইঙ্গিতে ভ্যাকাররা ভাইয়েরা পাশের হল ঘরে চলে গেল।
–যতক্ষণ অ্যানি আমার সম্বন্ধে কিছু জানবে না, ততক্ষণ ওকে বাঁচার সুযোগ দেওয়া হবে। তাই ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমার সঙ্গে ইউরোপ পাঠানোর দায়িত্ব আপনার।
একথা বলে বেরিয়ে গেল সে।
জুড অনুভব করলেন, তার গলা শুকিয়ে গেছে। ডিমার্কো যতই নিজেকে চালাক ভাবুক তার এই চালটা ধরতে ডাক্তারের একটুও অসুবিধা হয়নি। বেচারী অ্যানি, তিনি যাই করুন না কেন ওকে মরতে হবে। ডিমার্কো এখানে সে ঝুঁকি নিতে চাইছে না। ইউরোপে কোন সমস্যা নেই, ওখানে যে কোনো ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু যদি তিনি ওর স্বামীর আসল পরিচয়টা খুলে বলেন? তা হলে ডিমার্কো ওকে এখানেই হত্যা করবে অর্থাৎ কোনো দিকেই কোনো রাস্তা খোলা নেই। কেবল হত্যার স্থানটা নির্বাচন : করা ছাড়া।
অ্যাঞ্জেলির সঙ্গে জুড যখন বাড়িতে ঢুকলেন তখন অ্যানি ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে। মুহূর্তের জন্য অসম্ভব খুশী হয়ে উঠেছিল সে, কিন্তু অ্যাঞ্জেলির রিভলবার দেখে চমকে ওঠে।
স্বামীর আসল পরিচয় এখন ওর কাছে আর অজানা নয়। আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে স্বামীর মুখোশটা খুলে গেছে। তুচ্ছ কয়েকটা কথাবার্তাকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাস ধরে অশান্তির আগুন দাউদাউ জ্বলেছে। সেদিনের স্মৃতি আজও জ্বল জ্বল করছে। মদ্যপ এক অভিনেতার জন্য নাটক মাঝ পথে ভন্ডুল হয়ে যায়। অনেক আগে বাড়িতে ফিরে আসে সে। লাইব্রেরি ঘরে তখন জোর সভা চলেছে। ওকে দেখে অ্যান্টনি হতভম্ব। তারা এগিয়ে এসে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। একজনের চিৎকার তার কানে ভেসে আসে। লোকটা বলছিল আমার মতে আজ রাতেই কারখানাটা ধ্বংস করতে হবে। বেজন্মাগুলোকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া দরকার।
আর কিছু অ্যানি শোনেনি। কথাগুলো বেখাপ্পা শুনিয়েছিল। সেই মুহূর্তে গুরুত্ব দেয়নি। এর কয়েক দিন বাদে আর একটা ঘটনা ঘটল। খেলার ছলে টেলিফোন লাইনের রিসিভারটা তুলতে গিয়ে অ্যান্টনির গলা শুনতে পেল।
–টরেন্টার একটা জাহাজ আজ রাতে আমরা দখল করছি। তুমি রক্ষীকে দেখবে। সে আমাদের দলের নয়।
কাঁপতে কাঁপতে সে ফোন নামিয়ে রাখে কী সর্বনাশ? জাহাজ দখল? রক্ষীকে দেখা? পরক্ষণেই ভাবে এগুলো হয়তো ব্যবসায়িক সংকেত। অ্যান্টনিকে জিজ্ঞাসা করলেই পুরো ব্যাপারটা জানা যাবে।
কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে একটা বিপত্তি, ইস্পাতের দেওয়াল যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। ওকে কঠোর কঠিন ভাষায় সাবধান করে দেওয়া হল। বলা হয়েছিল, সংসার ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে সে যেন মাথা না ঘামায়। এরপর কথা কাটাকাটি অবশ্যম্ভাবী, হলও তাই। পরের দিন আবার মধুর মিলন। দামী একটা নেকলেস গলায় পরিয়ে ওর কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হল। এরপর কি আর রাগ করে থাকা সম্ভব?
এর মাস খানেক বাদে তৃতীয় ঘটনা। দরজার আওয়াজে ভোর চারটের সময় ঘুম। ভেঙে গিয়েছিল অ্যানির। কী হয়েছে জানতে, নিঃশব্দে নীচে নেমে আসে ও। লাইব্রেরী, ঘরে তখন তর্কযুদ্ধ চলেছে। অ্যান্টনির সঙ্গে জনাছয়েক অপরিচিত লোককে দেখে ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। দোরগোড়া থেকে আবার ফিরে আসে। পরের দিন প্রাতরাশের সময় কথায় কথায় স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে তারপর, রাতে ঘুম হয়েছিল তো?
অ্যান্টনি হাসতে হাসতে জবাব দেয়–দারুণ। রাত দশটায় শুয়েছি। আর সকালে চোখ খুললাম। এক ঘুমে রাত কাবার।
অ্যানি বুঝতে পেরেছিল এবার সত্যি ও বিপদে পড়েছে। বিপদটা কী, অথবা কোথা। থেকে আসতে পারে, সে সম্পর্কে ওর কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। তবে এটা ওর কাছে জলের মতো পরিষ্কার, অ্যান্টনি কোনো একটা বিশেষ ব্যাপারের জন্য মিথ্যে কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এমন কী গুরুত্বপূর্ণ যার জন্য মাঝরাত্তিরে গুণ্ডা শ্রেণীর লোজনদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে হবে? ওকে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই। উত্তর মিলবে না। কিন্তু কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায়?
ঠিক সেই সময় ক্লাবের সান্ধ্যভোজন আসরে মনোবিজ্ঞানী জুড স্টিভেন্সের নামটা ওর কানে আসে। বন্ধুদের মুখে লোকটার প্রশংসা শুনতে শুনতে ও শেষ পর্যন্ত মনস্থির করে। কৌতূহলের খাতিরে চলে যায় ডাক্তারের চেম্বারে। কয়েকদিন ধরে চলে আলোচনা। মনের বন্ধ দুয়ারগুলো ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে। কিন্তু আসল সমস্যাটা সেখানেও খুলে বলা গেল না। উল্টে যেটা হল সেটা আরও শোচনীয়। ডাঃ স্টিভেন্সের গভীর প্রেমে পড়তে শুরু করল অ্যানি। যদিও ভালো করে জানত অ্যান্টনির সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো কিছুতেই সম্ভব নয়।
মাত্র ছমাসের দাম্পত্য জীবনের পর একজনকে ও ভালোই বা বাসলে কীভাবে? ছিঃ, সব থেকে ভালো হয় লোকটার সাথে যদি দেখা করা বন্ধ করে দেওয়া যায়।
এরপর থেকে শুরু হয় ধারাবাহিক ঘটনা। ক্যারল রবার্টস খুন হয়। জুড গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেলেন। খবরের কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী তাঁরই উপস্থিতিতে মুডি নামে একজন বেসরকারি গোয়েন্দার মৃতদেহ এমন একটা অফিস বাড়ি থেকে পাওয়া গেল, যে বাড়িটার নাম অ্যানি আগে থেকেই জানত।
অ্যান্টনির টেবিলে নামটা ছাপা প্যাডে ও দেখেছে।
এতদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল ওর স্বামী খুনের বিষয়ে কিছু জানে না। কিন্তু গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অ্যান্টনি শোবার ঘরে এসে সরাসরি প্রশ্ন করেছে জুড সম্পর্কে। তার মুখ দেখে বোঝা গেছে, এবার ভয়ঙ্কর একটা আঘাত আসতে চলেছে ডাঃ জুডের জীবনে। এমন কী জুড হয়তো খুন হয়ে যাবে। নিজের জীবনের নিরাপত্তা বিষয়ে অ্যানি ভেবেছে। আর একটা ব্যাপারে সে মারাত্মক ভুল করে। জুডের দুর্বলতার কথা সোজাসুজি জানিয়ে দেয় অ্যান্টনিকে। এমন কী বলে, ইউরোপ যেতেও সে পারবে না।
সেই জুড বাড়িতে এসেছেন। একমাত্র ওরই কারণে তার জীবন আজ বিপন্ন।
দড়াম করে শোবার ঘরের দরজাটা খুলে গেল। অ্যান্টনি ঘরে ঢুকল।
–তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।
হলুদ রঙের স্কার্ট আর ব্লাউজ পরে মাথার চুলগুলো ঘাড়ের ওপর ছড়িয়ে ঘরে ঢুকে অ্যানি বলল–কী খবর ডাঃ স্টিভেন্স? অ্যান্টনি এই মাত্র খবর দিল আপনি এসেছেন।
জুড বুঝলেন, ও সব জেনে গেছে। কিন্তু এখন তার কিছুই করণীয় নেই। হয়তো মৃত্যুটাকে তিনি কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখতে পারেন। সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা করে বললেন–আপনি ইউরোপ যাবেন না শুনে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
অ্যানিকে মনে হল, সে জুডের কথা মন দিয়ে শুনছে। কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর চাপা গলায় বলল–আমি দুঃখিত।
জুড বললেন–আমার মনে হয় আপনার যাওয়া উচিত।
অ্যানি জুডের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করল–আর তা যদি না করি। যদি এখান। থেকে চলে যাই তাহলে?
–কক্ষনো ও কাজ করতে যাবেন না মিসেস ডিমার্কো। আপনার স্বামীর ধারণা আপনি আমার ওপর দুর্বল হয়ে পড়েছেন।
অ্যানি কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে, ডাক্তার বললেন–আমি তাকে বুঝিয়েছি এটা আমার প্রায় সব রোগিনীর ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। অনেক সময় আবেগের তাড়নায় তারা এসব কাজ করেন।
অ্যানি এই শব্দগুলোর আসল মানে বুঝতে পেরেছে জানি, আমিও খুব বোকার মতো কাজ করেছি আপনার কাছে গিয়েযাক আমি ভেবে দেখব, হয়তো ইউরোপ বেড়িয়ে আসতে পারলে আমারও উপকার হবে।
জুড একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জানলার বাইরে ঘন গাছে ঘেরা জঙ্গলের দিকে। তার চোখ পড়ল। আনি কি প্রায় ওখানে ঘুরে বেড়ায়? তাহলে ওখান দিয়ে বাইরে যাবার কোনো গোপন সড়ক পথ আছে কি? অ্যানি হয়তো সেই সড়কের সন্ধান জানে।
গলার স্বর খাদে এনে তিনি ডাকলেন–আনি।
কথা শেষ হয়েছে আপনাদের? জুড তাকালেন। ডিমার্কো ঘরে ঢুকেছে। পেছনে অ্যাঞ্জেলি, আর দুই ভ্যাকারো ভাই।
অ্যানি স্বামীর দিকে তাকাল–হ্যাঁ, ডাঃ স্টিভেন্স আমাকে বলছেন, তোমার সঙ্গে ইউরোপ যেতে। আমি ওনার পরামর্শ মেনে নিচ্ছি।
ডিমার্কোর মুখে হাসি–আপনার ওপর আমার আগেই আস্থা ছিল ডাক্তার। স্ত্রীর দিকে ফিরে –তাহলে আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব। তুমি বরং ওপরে গিয়ে জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নাও।
অ্যানি ইতস্তত করতে থাকে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, জুডকেও এই শত্ৰুপুরীতে একা ফেলে কোথাও যেতে চাইছে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে হল।
হাত বাড়িয়ে দিল অ্যানি চলি ডাঃ স্টিভেন্স।
–আসুন।
স্ত্রীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে ডিমার্কো হাসল বড়ো সুন্দর চেহারা তাই না ডাক্তার?
জুড বললেন–ওকে কি এর মধ্যে না জড়ালেই নয়? আপনার বিষয়ে কিছুই জানেন না উনি।
হাসিটা মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। জ্বলে উঠল প্রতিহিংসার আগুন চলুন, যাওয়া যাক এবার।
জুড অসহায়ের মতো চারদিকে তাকালেন। ভ্যাকাররা ভাইয়ের দুচোখে ক্ষুধার্ত দৃষ্টি। অ্যাঞ্জেলির একটা হাতে রিভলবার ধরা, পালানোর কোন পথ নেই।
ডিমার্কো তার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিল–না। এখানে কিছু করব না। যা হবার বাইরে হবে। এখন এখোন।
সিঁড়ির মাথার জানলা দিয়ে অ্যানি দেখল ওরা জুডকে ঠেলতে ঠেলতে অ্যাঞ্জেলির গাড়িতে ঢোকাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে ও শিউরে উঠল। ছুটে গেল নিজের শোবার ঘরে। টেলিফোনটার কাছে।
–হ্যালো অপারেটর আমি পুলিশকে চাইছি। তাড়াতাড়ি, খুবই তাড়াতাড়ি। সহসা পেছন থেকে একটা বলিষ্ঠ হাত ওর কাঁধটা চেপে ধরেছে। রিসিভার যন্ত্রটা ছিনিয়ে নিয়ে নামিয়ে রাখল। চিৎকার করে ঘুরে তাকাল অ্যানি। দেখল, নিক ভ্যাকাররা অসভ্যের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে।
.
একুশ
সবে বিকেল চারটে। সূর্য মেঘের আড়ালে মুখ ঢেকেছে। ঠান্ডা পড়েছে। অ্যাঞ্জেলি হেড লাইট জ্বালিয়ে দিল। প্রায় এক ঘণ্টা এক নাগাড়ে তাকে গাড়ি চালাতে হয়েছে। তার পাশে রকি ভ্যাকারো, পেছনের সিটে জুডকে নিয়ে অ্যান্টনি ডিমার্কো।
প্রথম দিকে কোনো ভ্রাম্যমান পুলিশের গাড়ির প্রত্যাশায় জুড রাস্তার দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন। পরে বুঝতে পারলেন, এ একটা দুরাশা। নির্জন গলি খুঁজি ধরে এগিয়ে চলেছে অ্যাঞ্জেলি। মরিস টাউনের সীমানা ছাড়িয়ে রুট দুশো ছয় ধরে আরও দক্ষিণে নিউজার্সির দিকে চলেছে তার গাড়ি। একটু পরে তুষার পড়তে শুরু হল।
ডিমার্কো বলল, আস্তে চালাও, অ্যাকসিডেন্ট বাঁধিয়ে বসোনা। জুডের দিকে ফিরে তাকাল, এই ভুলটা প্রায় সকলেই করে থাকে।
জুড পেশাদারী দৃষ্টিতে ডিমার্কোকে পর্যবেক্ষণ করলেন। লোকটা মনোরোগে ভুগছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নিজের সম্বন্ধে একটা বিরাট ধারণা, অথচ এই ধারণার অন্তরালে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এসব মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা। নৈতিকতার ধার ধারে না এরা। প্রয়োজন হলে হাসতে হাসতে খুন করে। যে ভাবে খুন করেছে জন হ্যানসেন আর ক্যারল রবার্টসকে।
হ্যানসেন অবশ্য তার ভুলের শিকার। অ্যাঞ্জেলি মারফত খবরটা জেনে সে জুডের অফিসে চড়াও হয়েছিল। বেচারী ক্যারল, প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া সত্ত্বেও সে প্রয়োজনীয় টেপগুলি দিতে পারেনি। আসলে অ্যানির প্রকৃত পদবী জানত না বলেই তাকে এমন কাজ করতে হয়েছে। ডিমার্কো ঠান্ডা মাথায় একটু সাহায্য করলে ক্যারল ওই টেপগুলো অনায়াসে খুঁজে পেত। হয়তো রেগে গেলে ডিমার্কো মাথা ঠিক রাখতে পারে না। তাই ক্যারলকে জীবন দিতে হয়।
এই ডিমার্কোই হল সেই লোক, যে জুডকে গাড়ি চাপা দিতে চেয়েছিল। অ্যাঞ্জেলির সঙ্গে তার অফিসে চড়াও হয় তাকে খুন করতে। সেই সময় ওরা দরজা না ভাঙাতে জুড় অবাক হয়েছিলেন কিন্তু আসল কারণটা অন্য। তখন ওদের ধারণা ছিল, ম্যাকগ্রেভি তাকে ফাঁসিয়ে দেবেই। তাই ঘটনাটা তারা সাজাতে চেয়েছিল আত্মহত্যার মতো। এতে পুলিশি তদন্ত বেশি দূর এগোত না। অনায়াসে তারা সন্দেহমুক্ত হতে পারত।
এবং মুডি। আহা, নিরীহ এক মানুষ। জুডের দোষেই তাকে প্রাণ হারাতে হল। অ্যাঞ্জেলিকে তিনি নিজেই তার খবরটা দিয়েছিলেন।
জুড বললেন–অ্যানির কী ব্যবস্থা হল?
ডিমার্কো ভুরু কুঁচকে তাকাল–ওটা নিয়ে ভাববেন না। ওর ভাবনা আমার। ভুলটা আমার। পরিবারের বাইরে কাউকে বিয়ে করাও আমার উচিত হয়নি। বাইরের লোক এসব বুঝতে পারে না। এটাই আমার জীবনে মস্ত বড় ভুল।
ফাঁকা জমির পাশ দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলেছে। দূরে দু-একটা কারখানার ছাউনি। এছাড়া জন মানবের চিহ্ন নেই।
অ্যাঞ্জেলি বলল–আমরা প্রায় পৌঁছে গেলাম।
ডিমার্কো বলল–তোমার কাজগুলো খুবই সুন্দর হয়েছে। একেবারে নিখুঁত। যতই তোমাকে দেখছি ততই অবাক হচ্ছি আমি।
–ব্যাপারটা সম্পূর্ণ থিতিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তোমায় কোথাও লুকিয়ে রাখব। বলো কোথায় যাবে?
–আমার ইচ্ছে ফ্লোরিডাতে থাকা।
–কোনো সমস্যা নেই। ওখানে আমার সংগঠনের সঙ্গে থাকতে পারো। ডানদিকে একটা কারখানা দেখা গেল। চিমনি দিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। অ্যাঞ্জেলি এবার যে রাস্তায় ঢুকল সেটা কারখানার দিকে চলে গেছে। বিশাল একটা পাঁচিলের সামনে এসে সে থামল। দরজা বন্ধ। হর্নের শব্দ শুনে বর্ষাতি আর টুপি পরা একটা লোক বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। ডিমার্কোকে অভিবাদন জানাল। ফটক খুলে দিল। অ্যাঞ্জেলি গাড়ি নিয়ে কারখানায় ঢুকে পড়ল।
.
তরুণ পুলিশ অফিসার ছুটতে ছুটতে দরজা খুলে থমকে দাঁড়াল। এত জন অচেনা লোক কেন এসেছে?
ম্যাকগ্রেভি প্রশ্ন করল–কী ব্যাপার?
–নিউজার্সি থেকে একটা খবর এসেছে স্যার। ব্যাপারটা জরুরী কিনা জানি না, তবে আপনি বলেছিলেন অস্বাভাবিক কিছু শুনলেই খবর দিতে, তাই।
–যা বলার চটপট বলল।
–একটু আগে একজন মহিলা আমাদের হেড কোয়াটারে ফোন করেছিলেন। উনি বললেন, ব্যাপারটা খুবই জরুরী। তারপর লাইনটা কেটে গেল। অপারেটর বলছে, উনি আর ফোন করেননি।
–কোথাকার ফোন ছিল ওটা?
–ওটা টপ্পার নামে একটা শহরের।
–নম্বরটা জানা নেই?
–না, হঠাৎ ফোনটা ছেড়ে দিলেন।
–আশ্চর্য।
বারটেলি বললেন,–কোনো বুড়ির বেড়াল-টেড়াল হারিয়েছে মনে হচ্ছে।
টেলিফোন বাজল। ম্যাকগ্রেভি রিসিভার তুলে লেফটেনান্ট ম্যাকগ্রেভি বলছি।
ঘরের সকলের দৃষ্টির সামনে চোয়াল ক্রমশ কঠিন ঠিক আছে। আমি না আসা পর্যন্ত ওদের কিছু করতে বারণ করুন। আমি এখুনি রওনা হচ্ছি।
রিসিভার নামিয়ে রাখল সে। আমাদের হাইওয়ের পুলিশ বাহিনী অ্যাঞ্জেলির গাড়িকে রুট দুশো ছয় ধরে মিডলস্টোনের দিকে যেতে দেখেছে।
একজনের প্রশ্ন–ওরা পিছু নিয়েছে?
ম্যাকগ্রেভি–ওরা উল্টোদিক দিয়ে আসছিল, ঘুরে আসার আগেই গাড়িটা উধাও হয়ে গেছে। তবে জায়গাটা আমি চিনি। ওখানে কয়েকটা ফ্যাক্টরি আছে।
এফ বি আই সদস্যের কাছে জানতে চাইল মাকগ্রেভি-ফ্যাক্টরির মালিকদের নামগুলো এখুনি আমার চাই।
সে বলল–ঠিক আছে, আমি এখনই দিচ্ছি।
–আমি এগোচ্ছি। ওগুলো পেলে আমাকে ওয়ারলেসে জানিয়ে দেবেন। দরজার দিকে এগিয়ে গেল ম্যাকগ্রেভি।
.
উঁচু উঁচু কয়েকটা ইটের চিমনি পেরিয়ে বেল্ট জড়ানো বিশাল কয়েকটা পাইপের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। প্রথমে অ্যাঞ্জেলি নামল। তারপর রকি। রকির হাতে উদ্যত রিভলবার। এক হাতে পেছনের দরজাটা খুলে ধরল সে–নামুন ডাক্তার।
জুড আস্তে আস্তে বাইরে এলেন। পেছনে ডিমার্কো। বাইরে হাওয়ার ঝাঁপটা চলেছে। আট গজ দূরে একটা পাইপ বিকট গর্জন তুলে সব কিছুকে ভেতরে টেনে নিচ্ছে। শব্দে কান পাতা যাচ্ছে না।
ডিমার্কো গলা চড়িয়ে বোঝাতে লাগল–এটা হচ্ছে এ দেশের অন্যতম বড়ো পাইপ লাইন। এর কাজ কী, নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন। আসুন ডাক্তার কাছে গিয়ে দেখা যাক। এমন সুন্দর দৃশ্য দেখার সুযোগ খুব একটা আসে না।
প্রথমে অ্যাঞ্জেলি পেছনে ডিমার্কো। পাশাপাশি জুড। সব শেষে রকি। তারা সকলে পাইপ লাইনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
ডিমার্কো গর্বের সঙ্গে বলতে থাকে–এই কারখানা থেকে বছরে পাঁচ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। সবটাই অটোমেটিক। অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় চলে।
হাওয়ার গর্জন বেড়ে উঠেছে। জুড ডিমার্কের উদ্দেশ্য অনুমান করতে পেরে শিউরে উঠলেন। পাইপের একশো গজ দূর দিয়ে বেল্টের সাহায্যে বিরাট বিরাট গাছের গুঁড়ি চলে আসছে। বিশাল একটা মেশিনের সামনে আসছে তারা। চাকার মতো ঘুরছে বেল্টগুলো। এর পেছনে পাইপের বিশাল গহ্বর। কাঠের গুঁড়িগুলোকে মেশিনের ব্লেড ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। হাওয়ার প্রচণ্ড টানে সেগুলো ঢুকে যাচ্ছে ওই গর্তের ভেতর।
ডিমার্কো বোঝাতে থাকে কাঠের গুঁড়িগুলো যতই বড়ো হোক ক্ষতি নেই। এই মেশিন সেটাকে এমনভাবে টুকরো করে দেবে, যাতে সেগুলো পাইপের মুখে একটুও না আটকায়।
পকেট থেকে রিভলবার বের করে সে হাঁক দেয়–অ্যাঞ্জেলি।
অ্যাঞ্জেলি ঘুরে তাকায়।
–অ্যাঞ্জেলি তোমার ফ্লোরিডা যাত্রা শুভ হোক। রিভলবার গর্জন করে। গোলাকার লাল দাগ ফুটে ওঠে অ্যাঞ্জেলির শার্টের সামনে। তার বিস্ময়ের ঘোর কাটবার আগেই আরও একবার ট্রিগারে চাপ দেয় ডিমার্কো। এবার সশব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ে তার দেহটা। ইঙ্গিত পেয়ে রকি তাকে কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে পাইপের কাছে এগিয়ে যায়।
–জুডের দিকে ফিরে ডিমার্কো–ওটা একটা আস্ত গাধা, মাথা মোটা। দেশের সমস্ত পুলিশ আজ ওকে খুঁজছে। ওকে পাওয়া মানে আমার বারোটা।
এরপর যে ঘটনা ঘটল, তা ঠান্ডা মাথার খুনের থেকেও ভয়াবহ। পাইপের কাছে। গিয়ে রকি অ্যাঞ্জেলিকে ভেতরের দিকে ছুঁড়ে দিল। হাওয়ার প্রচণ্ড টান নিমেষের মধ্যে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। জুড শিউরে উঠলেন। কোনোরকমে টাল সামলে নিলেন। রকি এবার ভাম্ব বের মুখে মোচড় দিল। সঙ্গে সঙ্গে একটা লোহার পাত এসে পাইপের মুখটাকে ঢেকে দিল। চারপাশে নেমে এল কবরখানার নীরবতা।
হাতের রিভলবারটা তাক করে মিটিমিটি হাসতে থাকল ডিমার্কো আপনার ক্ষেত্রে আমি শুধু এটাই ব্যবহার করব, যাতে অ্যানির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববার আর একটু বাড়তি সময় পান।
জুড মরিয়া হয়ে জবাব দিলেন–কাউকে না কাউকে তো ভাবতেই হবে। ওঁর ভাগ্য খুবই খারাপ, জীবনে সত্যিকার পুরুষের সাহচর্য পেলেন না।
ডিমার্কো শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। বোঝা গেল, এই বক্তব্যটা সে বুঝতে পারেনি।
জুড চিৎকার করে উঠলেন–হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। হাতে বন্দুক বা ছুরি না থাকলে–আপনি মেয়েছেলের সামিল। পুরুষত্ব যার আছে সে কখনও একটা নিরস্ত্র লোককে এই ভাবে ভয় দেখাবে না।
ডিমার্কোর চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলে উঠল। রিভলবারটা দূরে ছুঁড়ে দিল সে। রকিকে হাতের ইশারাতে পিছিয়ে যেতে বলল। বলল–ঠিক আছে। খালি হাতেই আপনাকে আমি খুন করব।
ডিমার্কো এগিয়ে আসছে। জুড পিছোতে শুরু করলেন। জুড জানেন, বিনা অস্ত্রের লড়াইতেও তিনি ডিমার্কোর সঙ্গে পেরে উঠবেন না। এক্ষেত্রে বাঁচবার একমাত্র পথ তার পৌরুষ সম্পর্কে কটাক্ষ করা। তিনি আবার বললেন আপনার আসল পরিচয় আমি জানি। আপনি একজন সমকামী।
রকি ছুটে গিয়ে রিভলবারটা কুড়িয়ে আনল। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে বলে চিফ, আমি একে শেষ করে দিচ্ছি।
ডিমার্কো গর্জন করে ওঠে–থামো।
ওরা দুজন চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে। ভিজে কাঠের গুঁড়োতে জুডের পা পিছলে গেল। ডিমার্কো বুনো ষাঁড়ের মতো তার দিকে ছুটে এল। জুডের চোয়ালে প্রচণ্ড একটা ঘুষির আঘাত। জুড মাটিতে শুয়ে পড়লেন। সেই অবস্থাতেই একটা লাথি চালিয়ে দিলেন। সেটা সরাসরি ডিমার্কোর মুখে লাগল। থমকে পিছিয়ে দাঁড়াল ডিমার্কো। দ্বিগুণ জোরে। ছুটে এসে একের পর এক ঘুষি চালাতে লাগল ডাক্তারের পেটে। যন্ত্রণায় ডাক্তার ছটফট করতে থাকলেন।
হো হো করে হেসে ওঠে ডিমার্কো কষ্ট হচ্ছে ডাক্তার? এককালে আমি একজন বক্সার ছিলাম। প্রথমে আপনার কিডনির ব্যবস্থাটা করে ফেলি। তারপর মাথাটা দেখব। ওই দুটো চোখ আমার চাই। এখন মনে হচ্ছে না, গুলি খেলেই বোধহয় ভালো হত। পাগলের মতো ঘুষি চালাতে লাগল সে।
জুড আর্তনাদ করে উঠলেন–ডিমার্কো।
একলাফে ডাক্তারের পেটের উপর উঠে বসে ডিমার্কো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল–খালি হাতে, হ্যাঁ, খালি হাতে আপনার চোখ দুটো উপড়ে আনব।
এবার জুডের ঠিক চোখের ওপর একটা সজোর ঘুষির আঘাত
***
রুট দুশো ছয়। বেডমিনস্টার ছাড়িয়ে দক্ষিণ দিকে ছুটছে পুলিশের গাড়ি। রেডিওতে শব্দ শোনা গেল–কোড তিন, নিউইয়র্ক সাতাশ নম্বর ইউনিট বলছি। নিউইয়র্ক সাতাশ নম্বর ইউনিট।
ম্যাকগ্রেভি মাইক্রোফোন তুলে–ইউনিট সাতাশ নম্বর কথা বলুন।
ক্যাপ্টেন বারটেলির উত্তেজিত গলা–আমরা কারখানাটার সন্ধান পেয়েছি ম্যাক। ওটার নাম নিউজার্সি পাইপ লাইন কোম্পানি। মিডলস্টোনের দুমাইল দক্ষিণে। এটা চালায় ফাইভ স্টার করপোরেশন নামে একটা সংস্থা। এর মালিক অ্যান্টনি ডিমার্কো নামে একজন।
–ঠিক আছে আমরা এগোচ্ছি।
–আপনারা ওখান থেকে কত দূরে?
–দশ মাইল, ছাড়ছি।
ম্যাকগ্রেভি রেডিও বন্ধ করল। সাইরেনের সুইচ টিপে দিল। তারপর দ্বিগুণ চাপ দিল অ্যাক্সিলেটরে।
***
চোখের মধ্যে কয়েকটা রং-বেরঙের চাকা ক্রমশ চক্কর মারছে। চেষ্টা করেও তিনি তাকাতে পারছিলেন না। বুকের ওপর বিরাট একটা পাহাড়। তারপর বললেন–দেখলেন। আমি বলছি, আমি বলছি কেবল মানুষের গায়েই আপনি হাত চালাতে পারেন। ঘুষি মারা বন্ধ হল। চলে গেল বুকের বোঝ। মনে হল, কে যেন কলার খামচে তাকে মাটি থেকে টেনে তুলেছে।
–আপনি মারাই গেছেন, ডাক্তার, খালি হাতে আপনাকে আমি শেষ করে দিয়েছি। জুড পিছিয়ে গেলেন–আপনি জন্তুর অধম। আপনাকে পাগলা গারদে রাখা উচিত।
–চুপ করুন।
–যা বলেছি, তাতে কোনো ভুল নেই। আপনার মাথা অপরিণত। আপনি একেবারে নিরেট।
ডিমার্কো ছুটে এসে গলা চেপে ধরল–আপনার ঘাড় আমি মটকে দেব।
হঠাৎ জুড অনুভব করলেন, তিনি পাইপ লাইনের ভালবের কাছে এসে পড়েছেন। প্রায় হাতের নাগালের মধ্যে। বিশাল দুটি হাতের থাবা ক্রমশ তার গলায় চেপে বসেছে। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে, বাঁচবার কোনো আশা নেই। হঠাৎ কোথা থেকে একটা প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি এসে ভর করল তার দেহের ওপর। মরিয়া হয়ে হাত বাড়িয়ে ভালবের প্যাঁচটা খুললেন। সজোর লাথি চালালেন ডিমার্কোর পেটে। হাওয়ার ঝাঁপটায় দুজনেই পড়ে গেলেন। আপ্রাণ চেষ্টায় তিনি ভালবের মুখটাকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ফেলেছেন। হঠাৎ একটা জান্তব চিৎকার তার কানে এল। পাশে কাউকে না দেখে প্যাঁচটাকে ঘুরিয়ে দিলেন। পাই তখন ডিমার্কোকে পুরোপুরি গ্রাস করে নিয়েছে।
টলতে টলতে জুড উঠে দাঁড়ালেন। শরীরে এতটুকু শক্তি নেই। নিক এখনও গুলি চালাচ্ছে না কেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ তার কানে এল। বেশ কয়েক জোড়া বুটের আওয়াজ। তার নাম ধরে কে যেন ডেকে উঠল। একটু বাদে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল কে যেন। ম্যাকগ্রেভির গলা তিনি শুনতে পেলেন সর্বনাশ, নিজের মুখটা একবার দেখুন।
গালের কাছটা ভেজা ভেজা লাগছে। রক্ত না চোখের জল তার জানা নেই। অনেক কষ্টে চোখের এককোণের পাতা ফাঁক করে ম্যাকগ্রেভিকে বললেন–অ্যানি, ডিমার্কোর স্ত্রী এখন বাড়িতে আছে। ওকে সাহায্য করুন।
ম্যাকগ্রেভি পুলিশের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। জুডের সামনে একজন উপুড় হয়ে। মাটিতে পড়ে আছে। লোকটা কি ভ্যাকাররা।, এতক্ষণে তার জিত হয়েছে। এই যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছেন। কিন্তু এ কেমন ধরনের জয়? তিনি একজন চিকিৎসক, তার পক্ষে কাউকে হত্যা করা সম্ভব? আত্মরক্ষার খাতিরে? সারাজীবন এই বেদনা তাকে কুরে। কুরে খাবে।
ম্যাকগ্রেভি সামনে এসে দাঁড়াল। অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে তার আচরণে। শান্ত গলায় বলল–পুলিশের গাড়ি ওঁকে আনতে রওনা হয়েছে ডাক্তার স্টিভেন্স। ঠিক আছে?
জুড কৃতজ্ঞ চিত্তে ঘাড় নাড়লেন। ম্যাকগ্রেভি জুডের হাতে হাত রাখলেন। তারা দুজন তখন গাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছেন।
জুড চোখ বন্ধ করলেন। অ্যানির বিষণ্ণ মুখখানা ভেসে উঠল। ভবিষ্যৎ জীবনের ধূসর ছায়া? না, এই জীবনে আর কোনো নারীকে তিনি স্মরণ করবেন না। চোখ বন্ধ করলেন। পঁচিশে ডিসেম্বর, এলিজাবেথ এবং তার অজাত পুত্ৰ–মনটা কেমন যেন বিহ্বল হয়ে গেল তার।